কোলকাতা,ও কোলকাতা ৩ * সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান

কলকাতা, ও কলকাতা ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৫

১৯৫২ সালের শেষের দিকে কলকাতায় এসে আমরা প্রথমে যে বাসায় গিয়ে উঠলাম সেটা ব্রাইট স্ট্রিটের পেছনের একটা গলিতে আব্বার এক সহকর্মীর বাসায়। এলাকা টা প্রায় ঢাকার আমলিগোলার মতোই। কলকাতায় এসে আমার প্রথম যে অভিজ্ঞতাটা হলো ভোর বেলা আর সন্ধ্যা হতেই চারপাশের বাড়িতে পাথুরে কয়লা দিয়ে চুলা ধরানোর ফলে বিপুল ধোঁয়ায় সারা এলাকা আ”ছন্ন হয়ে থাকতো। এ সময়ে একটা সবচেয়ে অদ্ভুত দৃশ্য আমার চোখে পড়েছিল, যা পরবর্তীতে আমি আর কোন গ্রামে বা শহরে দেখিনি। সেটা হলো কয়লার চুলো। একটা লোহার বালতির মুখটাতে মাটি দিয়ে তিন মাথার চুলো তৈরি করা হতো আর নীচের দিকে থাকতো একটা চৌকোনা মুখ। বালতির মাঝামাঝি বালতির এ মাথা ও মাথা ফুটো করে কয়েকটা লোহার শিক দিয়ে একটা আধা ফাঁকা প্লাটফর্ম বানানো থাকতো। শিকের সেই ঝাঁঝরিও ওপর কিছু ঘুঁটে, শুকনো নারকেলের ছোবড়া ইত্যাদি দাহ্য পদার্থ সাজানো হতো তার ওপর সাজানো হতো টুকরো টুকরো কয়লা- একেবারে ওপরের তিন মাথাটার কাছ বরাবর। এবার নীচের মুখটা দিয়ে ঘুঁটে আর ছোবড়াতে আগুন জ্বালানো হতো। পাথুরে কয়লার কারণে এ চুলোর কয়লায় আগুন ধরতে বেশ সময় লাগতো। একবার আগুন ধরে গেলে এ আগুন বহুক্ষণ- প্রায় তিন-চার ঘন্টা উত্তাপ দিত- যে কোন বাড়ির তিন-চার ভাগের রান্না সম্পন্ন করার জন্য যথেষ্ট। তারপরও ও চুলায় দুপুরের আগুন সন্ধ্যা পর্যন-ও থাকতো। মাঝে মাঝে তলায় শিক দিয়ে পুড়ে যাওয়া কয়লার ছাই ঝেড়ে ফেলতে হতো। শীতের সময় শেষ বিকেলে যখন শত শত বাড়ির রসুইঘরে কিংবা বাড়ির উঠোনে মা, বৌ কিংবা মেয়েরা কয়লার চুলোয় আগুন ধরাতো তখন শীতের ভারি বাতাসের চাপে এর ধোঁয়া কেমন একটা অপার্থিব চাদর হয়ে মাথার অল্প একটু ওপরে ঝুলে থাকতো বহুক্ষণ। সারা পাড়া জুড়ে আধা-শুকনো ঘুঁটে আর কয়লায় আগুন লাগার কেমন এক অদ্ভুত গন্ধ নাকে এসে লাগতো। সে গন্ধ যেন আজও আমার স্মৃতিকে ‘নস্টালজিক’ করে তোলে।

বাড়িটার কাছেই চার নম্বর পুল। আমরা সকাল-বিকাল এই পুলের ওপর দাঁড়িয়ে নীচের রেললাইন দিয়ে শিয়ালদহ-বালিগঞ্জ র”টের ট্রেনের যাওয়া আসা দেখতাম। একদিন সকালে পুলের ওপরে উঠে নীচে তাকিয়েই আমার মাথা ঘুরে উঠলো। লাইনের পাশে একটা রক্তাক্ত দেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সম্ভবত রাতের অন্ধকারে ট্রেনে কাটা পড়ে লোকটা মারা গিয়েছিল। দেহটা দেখার পর আমি তিন-চার দিন অত্যন- আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। বহুদিন ঐ ভীতিকর দৃশ্য আমাকে তাড়িত করতো। আর এ নিয়ে বড় ভাই নানা রকম মন-ব্য করে আমাকে অনেকদিন খুব জ্বালাতন করেছিল।
এখানে একটা ঘরে আমাদের খুব গাদাগাদি করে থাকতে হতো। মা খুব একটা স্বসি- বোধ করছিলেন না। আব্বা অবশ্য প্রথমে ভেবেছিলেন মা তাদের সন-ানদের নিয়ে কলকাতায় বেড়াতে এসেছেন। কিন’ যখন তিনি মার আসল উদ্দেশ্য জানতে পারলেন তখন যথেষ্ট অসন’ষ্ট হলেও তার আর তখন করার কিছু ছিল না। কারণ মা ঢাকার সাথে সমস- সম্পর্ক চুকিয়েই কলকাতায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। প্রায় দেড়-দুই মাস খোঁজাখুঁজির পর আব্বা পার্ক সার্কাস ও গড়িয়াহাটার মাঝামাঝি এলাকায় একটা তিন তলা বাড়ির একতলা ভাড়া নিলে আমরা এখানে এসে উঠলাম।

বাড়িটার ঠিকানা ৮বি তারক দত্ত রোড। তারক দত্ত রোড আর সার্কাস রেঞ্জ রাস-ার সংযোগস’লের ঠিক উল্টো পাশের এক গলির শেষ মাথায় এই বাড়িটা। বাড়ির মালিক কাজী আব্দুল ওদুদ। কিছুদিন পরে জানতে পারলাম তিনি প্রশিদ্ধ গবেষক, সাহিত্য বিশেষজ্ঞ ও সাহিত্যিক।

ফ্ল্যাটটা অনেকটা এল- মাপের। বাইরের ঘরটা বৈঠকখানা, ওখান দিয়ে বাইরের গলিতে বের হওয়া যায়। তার পাশে ডান দিকে আর একটা ঘর- এখানে আব্বা, বড় ভাই আর আমার শোয়ার ব্যবস’া। এ ঘর থেকে বের হলেই বাম দিকে একটা ছোট গলি ওখান দিয়েও বাড়ি থেকে বের হওয়া যেত। পাশে দোতলা-তিনতলায় ওঠার সিঁড়ি। দোতলা-তিনতলার লোকজন এ গলি দিয়েই বাইরে যাওয়া-আসা করতো। এইখান থেকে একেবারে বাড়ির পশ্চিমের শেষ মাথা পর্যন- চওড়া ঘোরানো বারান্দা। সিঁড়িটা পার হলে আর একটা ঘর- এখানে মা আর আপা থাকতেন। এ ঘরটার শেষ মাথায় ডান দিকে দুটো ছোট ছোট ঘর, পাশাপাশি, ওর একটা রান্নাঘর আর একটা হাঁড়ি-পাতাল, থালা-গ্লাস, খাবার পানির কলসি আর রান্না-করা খাবার রাখার জায়গা। অনেক সময় আমরা এখানে বসেও খেতাম। তবে অধিকাংশ সময় মা-আপার শোবার ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খাবারের ব্যবস’া করা হতো। এর সব কিছু পার হয়ে ডান দিকের শেষ মাথায় একটা গোছলখানা আর একটা টয়লেট। গোছলখানার এক পাশটায় একটা মাঝারী পানি রাখার চৌবা”চা।
বাড়ির বাইরে পশ্চিম কোণায় একটা বিরাট চৌবা”চা। ওটাতে মিউনিসিপ্যালিটির সরবরাহ করা পানি এসে ভরতো। আর সেখান থেকে বালতিতে করে পানি নিয়ে গোছলখানার চৌবা”চা ভরে রাখা হতো। বাইরের চৌবা”চার পেছন দিকে আর একটা কল, সেটা দিয়ে গঙ্গার ঘোলাটে পানি সরবরাহ করা হতো। মা-আপার শোবার ঘরের সামনে একটা বেশ খোলামেলা উঠানমতো জায়গা। বিকেল বেলা বা ছুটির দিন ওখানে বসে গল্প-গুজব করতাম। আব্বা বাজার থেকে আনাজ-পাতি আনলে মা এখানে বসেই মাছ-মুরগী কাটাকুটি করতেন আর আমরা বারান্দায় বসে কথাবার্তা বলে মাকে সঙ্গ দিতাম। শীতকালে আমরা ওখানটায় বসে সূর্যের আলোয় পানি গরম করে গোছল করতাম।
এই বাড়িটার কয়েকটা বাড়ির পশ্চিমে গিয়ে উত্তর দিকে দুটি বাড়ি পরে পার্ক সার্কাস এলাকার কড়েয়া থানা। আর পূবে দশ বারটা বাড়ি পার হয়ে সৈয়দ আমির আলী এভিনিউ-এর ট্রাম রাস-া। আমাদের বৈঠকখানার ঠিক উপরে দোতলার ঘরটা ছিল কাজী আব্দুল ওদুদ সাহেবের স্টাডি। যেহেতু পক্ককেশ বয়স্ক ব্যক্তি, তাই আমরা ছোটরা তাঁকে ‘নানা’ বলে সম্বাধন করতাম।

কাজী নানার সংসারে তখন ছিলেন তাঁর স্ত্রী সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস-, তার জগৎ-সংসার ছিল কেবল বিছানার চারপাশ। সেখানে শুয়ে শুয়েই তিনি তিন-চার জন কাজের বুয়াকে দিয়ে বাড়ির বাজার-ঘাট, রান্না, খাওয়ানো সব তদারক করতেন। তাদের সন-ানদের মধ্যে বড় এক মেয়ে, যার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, স্বামী কলেজের অধ্যাপক, তার পরের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। সে বোম্বাইয়ে কর্মরত। আর সব থেকে ছোট ছেলে তখন মেডিকেল কলেজে পড়তো। কাজী নানা বড় ছেলেকে ডাকতেন বুদ্ধ বলে, গৌতম বুদ্ধের কথা মনে করে আর ছোট ছেলের নাম ছিল জীবু- গৌতম বুদ্ধের সময়ের অন্যতম বিখ্যাত চিকিৎসক ‘জীবক’ শব্দের অপভ্রংশ।
এই জীবক বুদ্ধকে একবার হত্যা প্রচেষ্টায় পাহাড়ের ওপর থেকে বির”দ্ধ শক্তি পাথর ছুঁড়ে মারলে পাথরটি তার পায়ে আঘাত করে। পায়ের দুটি আঙুল থেঁতলে যায়। কিন’ তিনি কোন অষুধ খেতে সম্মত ছিলেন না। বিষয়টি জানতে পেরে জীবক একটি অষুধ আটটি পদ্মফুলের কুঁড়ির ডাঁটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে ফুলের কুঁড়িগুলি নিয়ে বুদ্ধের সাথে দেখা করতে গেলেন। বুদ্ধ পদ্মফুল খুব পছন্দ করতেন।
বুদ্ধ জানতেন জীবক অত্যন- প্রসিদ্ধ ভীষক, চিকিৎসক, তাই তাকে দেখে তিনি আগেই বললেন, ‘আমি কিন’ তোমার কোন ঔষধ সেবন করবো না বৎস।’
জীবক বললেন, ‘না, প্রভু, আমি কোন ঔষধ নিয়ে আসিনি। আমি আপনার প্রিয় ফুল নিয়ে এসেছি। আমার বিনীত অনুরোধ, আগামী আট দিন প্রতিদিন প্রত্যুষে একটি করে ফুলের সুবাস আপনি গ্রহণ করবেন।’
বুদ্ধ বললেন, ‘তথাস’।’
আশ্চর্যের বিষয় কুঁড়ির ডাঁটার ভেতর প্রবেশ করিয়ে দেওয়া ঔষধের প্রভাব ফুলের সুবাসে এমনভাবে ছড়িয়ে গিয়েছিল, যে ঐ সুবাস গ্রহণ করেই বুদ্ধ পরের আট দিনের মধ্যেই সুস’ হয়ে গেলেন।

এ গল্পটা আমি এ সময়েই একটা শারদীয় কিশোর সাময়িকীতে পড়েছিলাম। মজার বিষয় ‘জীবু মামা’ও ডাক্তারী পড়ছিলেন।
কাজী নানা আব্বার সামনে দুঃখ করে বলতেন, আমার দুই ছেলেই অশিক্ষিত। তাঁর দুঃখ ছিল ছেলে দুটির কোনটিই তার মতো বিদ্বান হয়নি। তারা শিক্ষিত হয়ে জীবন ধারণের অর্থ উপার্জন করতে পারে, কিন’ জ্ঞানের চ”র্চা করে না কেউই।
কাজী আব্দুল ওয়াদুদের সাথে আব্বার অনেক আগে থেকেই আলাপ পরিচয় ছিল। দুজনের দেশের বাড়িই ফরিদপুরে। আব্বার বাড়ি ব্রাহ্মণদি আর কাজী সাহেবে বাড়ি পাংশায়।
১৯৭৫-৭৭ সালের দিকে অন্ধ আব্বার শখ হয়েছিল নিজের জীবন কাহিনী লিখবেন, তাই তিনি বলে গেছেন আর মা কিংবা আপা লিখে গিয়েছেন, তার জীবনের নানা কথা। কিন’ সেটা আর সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। আব্বার স্বল্প পরিসর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি থেকে জানতে পারি অনেক কিছু। আব্বার খাতা থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করতে ই”েছ হলো, এ জন্য যে, আব্বার এ লেখা তো আর ছাপার অক্ষরে বের করার সুযোগ আর নেই, এই ছোট ছোট লেখা তো আর বই হতে পারে না।
‘. . . . ১৯৩০ থেকে ১৯৬৫ – সুদীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর জীবনের সেরা দিনগুলি কেটেছে কলকাতায়। প্রাচ্যের অন্যতম সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ শহর। বিশ্ব-বণিক ইংরেজ এ শহরটাকে গড়েছিল সব ধরনের সুখ স্বা”ছন্দ পাবার জন্য। ১৮৫৭ সালের বিপর্যয় এড়ানোর জন্যে পূর্ব ভারতের সব ইংরেজ এক সাথে জড়ো হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়ামের চারপাশে, যাতে প্রয়োজনে কেল্লায় আত্মগোপন করতে আর বিপর্যয়ে কেল্লার উল্টোপাশের গঙ্গা নদীর বন্দর থেকে জাহাজে করে সাগর পাড়ি দিতে পারে সেজন্য। ইংরেজরা আসামের স্বর্ণ-নির্য্যাস চা, বাংলাদেশের স্বর্ণ-সুত্র পাট এ দুই হীরে-মানিক সংগ্রহ করতো। জাহাজ ভরে বয়ে নিয়ে যেত তাদের আদরের “হোমে”। উৎপত্তিস’ল বাংলা আর আসাম হলেও তারা এর বদৌলতে বাস করতো বিলাসবহুল কলকাতায়। আর এ কারণেই কলকাতার এত জৌলুস।

১৯৩০-৪৬ কলকাতায় ছিলাম নিজ দেশে, ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ায়। সাতচল্লিশে কলকাতা হয়ে গেল বিদেশ। চলে যেতে হলো নিজ দেশ পাকিস-ানে- পূর্ব পাকিস-ানে। সেই কলকাতাতেই আবার হাজির হতে হলো ১৯৫২ অক্টোবরে বিদেশ কলকাতায় পাকিস-ান সরকারের প্রতিনিধি হয়ে। কিছু আত্মীয়-স্বজন আর বহু সংখ্যক বন্ধুবান্ধবের সাথে আবার মিলিত হলাম একটা অ”েছদ্য সীমারেখার ব্যবধান রেখে।
এদেরই একজন কাজী আব্দুল ওদুদ। দেখা করতে গেলে তিনি স্বভাবসিদ্ধ সরব উল্লাসে অভ্যর্থনা জানালেন। আমার সাথে যে আবার দেখা হতে পারে, সে আশা তাঁর আদৌ ছিল না। এই অপ্রত্যাসিত সাক্ষাতে তিনি খুবই আনন্দিত এবং আরও আনন্দিত আমার পরিবারবর্গও কলকাতা আসছে শুনে। স্বতপ্রণোদিত হয়েই বললেন তাঁর বাড়ির নিচের তলাটা আমাকে ভাড়া দিতে পারেন। তাঁর তিনতলাটা কিছুদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ হলে তিনি উপরে যাবেন এবং নিচের তলায় আমার ফ্যামিলি থাকলে তিনি খুশিই হবেন নাতি-নাতনীদের কাছে পেয়ে (পারিবারিক সম্পর্ক না থাকলেও আন-রিক সম্পর্কে নিঃসঙ্গ তিনি আমার ছেলে-মেয়েদের এই নজরেই দেখতেন।) কিচেন-বাথ ছাড়া তিন কামরার বাড়ি আমার অসুবিধা হবে না জেনে খুশিই হলেন। নিজেই ভাড়া নির্ধারিত করলেন পুরাতন হারেই, তিন কামরা দেড় শ’ টাকা। অগ্রিম বা সালামী বলতে কিছুই না।
বিদায়কালে বললেন, ‘যাক আপনাকে বাড়ি দিয়ে এতদিনে নিশ্চিন- হওয়া গেল। যা জ্বালাতন চলছিল ক’মাস ধরে। দুই শ’, আড়াই শ’ টাকা ভাড়া, অগ্রিম, সালামি, ভাড়া রশিদের কারচুপি ইত্যাদি সুযুক্তিপূর্ণ প্রলোভনে অতীষ্ট করে তুলেছিল গরীব মাস্টারকে।’
পার্কসার্কাসের ৮/বি তারক দত্ত রোডস’ বাড়িতে প্রায় একাত্ম হয়েই বাস করেছি পূর্ণ এগারো বছর। তাঁর স্ত্রী দীর্ঘকাল শয্যাশায়িনী থাকার পর আমরা এ বাড়িতে ওঠার অল্প কিছুকাল পরই তিনি ইনে-কাল করলেন। একমাত্র কন্যা ঢাকাবাসিনী। দুই পুত্রও বিদেশে।
এই নিঃসঙ্গ জীবনের বার্দ্ধক্যে আমার ছেলে-মেয়েদের সাথে তাঁর অবসর উপভোগ্যই হয়েছিল। আর আমার মেয়ে ও ছোট ছেলে হাতে স্বর্গ পেয়েছিল তাঁর লাইব্রেরীর স্ব”ছন্দ ব্যবহারের অধিকার পেয়ে। আমার স্ত্রীকেও তার ঢাকাবাসিনী কন্যা ‘বুলি’র (জেবুন্নিসা) স’লাভিষিক্ত করেছিলেন।
নতুন লেখা শেষ হলেই তিনি নিচে নেমে এসে পড়ে শোনাতেন। কাজী সাহেবের লাইব্রেরীটা ছিল খুবই সমৃদ্ধ। বিভিন্ন মনিষী, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ও আরও অনেকের সুদৃশ্য রচনাবলী, চল্লিশ দশকে প্রকাশিত বাংলা ও ইংরেজী বিশ্বকোষের সংগ্রহ ছাড়াও সারা বাংলার প্রকাশিত তাবৎ পুস-ক ও সাময়িক পত্র-পত্রিকার সৌজন্য ও উপহার সংখ্যায় তার লাইব্রেরী ঘরের আলমারী, টেবিল, চেয়ার, সোফা, অতিথিদের জন্য রক্ষিত বিরাট পালঙ্ক এবং সারাটা মেঝে এমনই টই-টুম্বুর হয়ে থাকতো, যে তাঁর সযত্নে পোষা মার্জারকূলের মাঝে মাঝে শয়নের স’ানাভাব ঘটতো।
কাজল ও সিদ্দিক এই মহাসাগর থেকে অহরহ মুক্তো উত্তোলন করলে তাদের নানা মহা সুখী হতেন। এই সন’ষ্টির অভিব্যক্তি ছিল তাঁর প্রিয় খাদ্য মোরগ পোলাওয়ের আয়োজনে এবং তাতে ওদের, বিশেষ করে সোনালীর নিমন্ত্রণে।
তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘পড়, পড়। তোমরা পড়ছ তাই তোমাদের হাতের ছোঁয়ায় আমার বইগুলোর জীবন সার্থক। আমার ছেলেরা তো মহামূর্খ।’ তাঁর এই মূর্খ পুত্রের বড়টি হলেন আমেরিকায় পাশ ইঞ্জিনিয়ার। বোম্বাইয়ে একটি বৃহৎ ফার্মে বৃহত্তর বেতনে চাকুরী করেন এবং ছোটটি কলকাতা মেডিকেল কলেজের ডিগ্রি অর্জন করে (পরে আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন, বৃদ্ধ নিঃসঙ্গ বাবাকে ফেলে)।
তাঁর কর্মী বাহিনী, লালুর মা ও আল্লাদির নানী, সঙ্গে তেরটি বিড়াল আর দুই ডজনের মত চড়-ই পাখি নিয়ে কাজী সাহেবের সংসার। কাজী সাহেব ছিলেন ভোজন বিলাসী। লালুর মায়ের হাত ছিল সাফ (অন্য হাতও বটে! লালু ও কালু দুই ভাই মাকে সাহায্য করতো)। লালুর মা সকালে এসে বিকেল পর্যন- কাজ করে বিপুল তল্পিসহ চলে যেত। আহ্লাদির নানী দুপুরে ঘর সাফ (!) করতো। তার নাতনী আল্লাদি নানীকে সাহায্য (!) করতো। তবে এরা মার্জারকূলের কোন বিরক্তি উৎপাদন করতো না।
লেখার কাজের সাথে নিজের কাজ অর্থাৎ নিজের বাজার করার কাজ কাজীসাহেব নিজেই করতেন। মার্জারকূলের দুগ্ধ ঘাটতি দেখা দিলে, প্রায়শই সন্ধ্যায় ওদের জন্য শিককাবাব সংগ্রহে বের হতেন তিনি। ৮/বি তারক দত্ত রোড কলকাতার বিদগ্ধ সমাজে একটি পরিচিত ঠিকানা ছিল। মূল রাস-া থেকে ৫/৬ গজ গলি পেরিয়ে তিন তলা বাড়ি। তার বাড়ির পাশেই আর একটি তিনতলা বাড়ি ছিল অন্য এক হিন্দু পরিবারের।
দূর থেকেই দেখা যেত লাইব্রেরী ও বৈঠকখানা সম্মিলিত ঘরে আরাম চেয়ারে অর্ধশায়িত অবস’ায় অধিষ্ঠান করছেন কাজী সাহেব, হাতে বই অথবা কলম। এখানেই সমাগম হত উভয় বাংলার তর”ণ, প্রবীন কবি সাহিত্যিক, লেখক, চিন-াবিদ, সুধীবৃন্দের। বিদেশ থেকেও আসতেন অনেকে। ঐ বইয়ে ঠাসা ঘরে স’ান সংকুলান না হলে আসর বসত নিচের তলায় আমার বৈঠকখানায়। চলতো নানাবিধ আলাপ আলোচনা, গল্প-কবিতা পাঠ, কখনও বা বসত গানের আসর। আমার বৈঠকখানায় বৈঠক প্রায়ই বসত। তিনি নবীন লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন খুবই। উৎসাহ, উপদেশ আর অনুপ্রেরণা দিতেন অকাতরে। নতুন লেখা বই প্রকাশের সুযোগ করে দিতেন প্রকাশকদের ধরে। প্রায়ই আসতেন সস্ত্রীক অন্নদাশঙ্কর রায়, অতুল গুপ্ত, মনোজ বসু, বিমল মিত্র, নরেন্দ্র মিত্র প্রভৃতি। এপার থেকে যেতেন আবদুর রহমান খান, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী আব্দুল মান্নান, শামসুদ্দিন আবুল কালাম, কবি জসিমুদ্দিন ও আরও অনেকে। সে যুগে দুই বাংলার মনিষী মিলন কেন্দ্রই ছিল ৮/বি তারক দত্ত রোড। কলকাতার উ”চতর সাহিত্য মহলে কাজী সাহেব ছিলেন সুবিদিত ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের তাঁর পৌরহিত্য ছিল প্রায় অপরিহার্য।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শরৎ বক্তৃতামালায় তিনি অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। এই বক্তৃতা দেওয়ার সময় তিনি কাজল ও সিদ্দিককে সঙ্গে নিতেন, যদিও তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা শোনার মত জ্ঞান সিদ্দিকের তখনও গড়ে ওঠেনি, কারণ তখন তার বয়স মাত্র এগারো-বার বছর। তছার এই বক্তৃতামালা ‘শরৎচন্দ্র ও তাঁর পর’ এই নামে পুস-ক আকারে প্রকাশিত হয়ে তৎকালীন বাংলা সাহিত্যে এক প্রামান্য গ্রন’ হিসেবে সুপরিচিত। বিশ্বভারতীর কার্যকরী সংসদের তিনি ছিলেন নেহের”-মনোনিত সদস্য। এছাড়াও আরও বহু সমিতি ও সংগঠনের সাথে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল।
প্রয়াত কবি, সাহিত্যিক ও মনিষীদের স্মৃতিসভায় তাঁকে অবধারিতভাবে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করতে ডাক পড়তো। কলকাতায় সে সময়ে এ ধরণের অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো। সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের প্রতি তাঁর এই প্রবল আকর্ষণ শুধু খ্যাতিমান উ”চতর মহলেই সীমাবদ্ধ থাকতো না, অখ্যাত সাহিত্যিকদের প্রতিও ছিল তার সমান দৃষ্ঠি। অনেক উদীয়মান সাহিত্যিক তাঁর বাসায়ও থাকত। খ্যাতিমানদের ভিড়ে যারা স’ান পেতেন না তিনি নিজের বাড়িতে অনাড়ম্বর পারিবারিক অনুষ্ঠানে তাদের উপসি’পিত করতেন।

দুই ঈদের নামাজ ছাড়া তাঁকে কখনও দৈনিক নামাজগুলো পড়তে দেখিনি। কিন’ প্রতি শুক্রবারে তাঁকে দেখা যেত তাঁর ঘরের সামনের দোতলার বারান্দায় অগণিত সর্বহারাদের মধ্যে পয়সা বিতরণ করতে।
কাজী সাহেবের সাথে প্রথম সাক্ষাত একটা অবিস্মরণীয় ঘটনা। ১৯২৫ সালের শেষ দিকে। গ্রামের স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করে সগৌরবে জেলা সদরে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হয়েছি। কূপমণ্ডুক এলো সাগরকূলে। প্রথম ঢেউ তুললো ‘শিখা’। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের অগ্রদূত তর”ণ সমাজের মুখপত্র। এর মধ্যমনি কাজী আব্দুল ওদুদ। এর সমর্থন, সমালোচনা ও বিরোধিতা দুই-ই প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকলো। কাজী সাহেব এলেন তাঁর নিজের জেলা ফরিদপুরে। টাউন হলে জনাকীর্ণ সভা। সভা শেষে তুমুল বিতর্ক যখন সংঘর্ষে পরিণত হওয়ার উপক্রম সেই মুহূর্তে মগরেবের আজান ধ্বণিত হলো হলের বারান্দা থেকে। সব বিপ্লব স-ব্ধ হলো যাদুমন্ত্রে। একদল জামাতে দাঁড়াল আর এক দল স’ান ত্যাগ করল। বলাবাহুল্য শেষোক্ত দল কাজী আব্দূল ওদুদের।
একদিন কাজী সাহেব বললেন, ‘চলনি-কার দর”ণ কিছু টাকা পেলাম আজ (পরিমাণটা মনে নেই সম্ভবত তিন-চার হাজার টাকা হবে) ভাবছি কি করে খরচ করি।’
বললাম, ‘কেন? মোরগ পোলাও? লালুর মার হাত তো বেশ পেকেছে।’
তিনি বললেন, ‘না। সংকল্প করেছি একটা কাগজ বের করব।’
আমি বললাম, ‘অতি উত্তম। আপনার সম্পাদনায় সাময়িক পত্রিকা নিশ্চয়ই শীর্ষ স’ান দখল করবে। তবে পরিচালকটি সুদক্ষ হওয়া চাই।’
তিনি বললেন, ‘সেটা আমি নিজের হাতেই রাখব।’
সামনাসামনি কিছু না বললেও, আমি কিন’ সে কাগজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আশান্বিত হতে পারিনি। কারণ বিচক্ষণ ও সুদক্ষ সম্পাদক মাত্রেই সুপরিচালক নাও হতে পারেন। বিশেষত কাজী সাহেবের মত জাত সাহিত্যিকরা কখনও বৈষয়িক হতে পারেন না।
যাই হোক যথারীতি ত্রৈমাসিক “সংকল্প” প্রকাশ হতে থাকল। প্রকাশক ও ম্যানেজার কাজী আব্দুল ওদুদ। কার্যালয় ৮/বি তারক দত্ত রোড, কলকাতা ১৯।
অনিয়মিত কয়েকটা সংখ্যাও প্রকাশ হল। প্রেস থেকে আনা কপিগুলো তাঁর ছোট কামরায় স’পিকৃত হতে থাকল। অবশেষে স’ান সঙ্কুলান না হওয়ায় কাজী সাহেব সংকল্পচ্যূত হলেন। কারণ অগণিত লেখক প্রকাশকদের কাছে সৌজন্য সংখ্য পাঠানোর ডাকটিকিট খরচেই বরাদ্দ অর্থ শেষ হয়ে গেল।’

আব্বাকে লেখা কাজী আব্দুল ওদুদের দু’টি চিঠি। প্রথমটি লেখা পাশের বাড়িতে থাকা সন্ধ্যা নামে একটি মেয়ের। মেয়েটি কাজী নানার হাত কাঁপা রোগ দেখা দিলে নিয়মিত নানার ডিকটেশন লিখে দিত। নানা তাকে একটা মাসোহারা দিতেন। ১৯৬৬ সালের অক্টোবরে লেখা চিঠিটির পঞ্চম লাইনে আমার কথা লেখা হয়েছে-
’সিদ্দিক লেখক হ”েছ জেনে খুশী হলাম। তার ভিতরে এই সম্ভাবনা ছিল। তার পড়াশুনায় যেন গাফিলতি না করে। লেখার নেশা অনেক সময় সেই পথেই নিয়ে যায়। কাজেই সাবধান হতে হবে।’

আজ ৪৭ বছর পরে আমি কাজী নানা বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ‘নানা, পড়াশুনার প্রতি আমার কোনকালেই অনীহা ছিল না। পড়াশুনায় বাধা পড়েছে আমার ই”েছর বির”দ্ধে, পারিপার্শ্বিক অবস’ার কারণে, আমি নিজে ঢিলেমী দেইনি, শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বো”চ ডিগ্রি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
তা’ছাড়া সত্যিই আমি লেখক হতে পেরেছি কি না, তা’ বলতে পারবো না, ভবিষ্যত বলবে। কিন’ আমি আপনার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চেষ্টা করেছি। আপনি অর্থনীতিতে উ”চতর ডিগ্রি পেয়ে অধ্যাপক হয়েও সাহিত্য গবেষণায় শীর্ষ স’ান দখল করেছিলেন। আমি ইংরেজী সাহিত্যে পড়াশুনা করলেও ইতিহাসের গবেষণায় এক নতুন দিক নির্দেশনা দিতে পেরেছি- বাংলাদেশের ডাকব্যবস’া, ডাকটিকিট, ধাতব ও কাগজী মুদ্রা নিয়ে গবেষণায় আমি ঈর্ষণীয় পর্যায়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। আর অনুবাদে এক অনন্য মাত্রা যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। আর আমার মত এত অধিক সংখ্যক কবিতার অনুবাদ আমার সময়ে তো বটেই আমার আগেও আর কেউ করতে পেরেছে কি না আমার জানা নেই।

কাজী নানার বাসায় আসার দুই একদিন পর হঠাৎ একদিন ভোর বেলা আব্বা আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুললেন, ‘ছোট, দেখ একটা মজার ব্যাপার।’
চোখ ডলতে ডলতে বাড়ি থেকে বের হয়ে বাড়ির সামনের গলিটা পেরিয়ে রাস-ার কাছাকাছি আসতেই শুনি উৎকট ফট্‌ ফট্‌ শব্দ, আর তার পরই প্রচণ্ড শব্দে পানি বের হওয়ার শব্দ। ভালভাবে তাকিয়ে দেখি একজন দেহাতি লোক রাস-ার উপরে হাতে মোটা কাপড়ের পাইপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে আর ওর ঐ পাইপ থেকে তীব্র শক্তিতে বের হয়ে আসছে ঘোলা পানি।
লোকটি পাইপটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সমস- রাস-াটা ধুয়ে পরিস্কার করে দি”েছ। আরও ভাল ভাবে তাকিয়ে দেখি পাইপটা ফুটপাথের এক পাশে মাটির সাথে লাগানো। না, ঠিক মাটির সাথে না, পাইপটা লাগানো আছে ফুটপাথের ধারের আর একটা পাইপের মাথার সাথে। রাস-ার একপাশ ধোয়া হয়ে গেছে লোকটি আর কিছু দূরে দিয়ে ফুটপাথের পাশের ময়লা সরিয়ে বের করলো একটা পাইপের মুখ।
কাপড়ের পাইপটার এক মাথা ঐ পাইপের সাথে লাগিয়ে কোমরে ঝুলে থাকা চাবি দিয়ে পাইপের পাশের কলের মাথায় চাবি বসিয়ে চাবিটা ঘুরাতেই আবার সেই আগের মতো ফট্‌ ফট্‌ শব্দ করে কিছুটা বাতাস বের হওয়ার পর ঘোলা পানি তীব্র গতিতে বেরিয়ে এলো। লোকটি রাস-ার পরের অংশ ধুতে থাকলো।
আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পানিটা ঘোলা কেন?’
আব্বা বললেন, ‘ওটা গঙ্গার পানি, পাম্পে করে সরবরাহ করা হ”েছ রাস-া ধোয়ার জন্য, সারা কলকাতা শহরের প্রায় সব রাস-াতেই এমন ব্যবস’া আছে।’
সেদিন থেকে আমার একটা নেশা ধরে গেল। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে বাইরের রাস-ার ধারে অপেক্ষা করতাম কখন ঐ দেহাতী লোকটা এসে মোটা পাইপের সাহায্যে গঙ্গার পানি দিয়ে রাস-াটা পরিষ্কার করবে। আমি তখন খালি পায়ে ঐ ঠাণ্ডা ভিজে
রাস-ায় ধীরে ধীরে হাঁটতাম আর রাস-া ধোয়া দেখতাম।
প্রথম কিছুদিন পরিবেশ পরিসি’তি বুঝতে সময় লেগেছিল আমার, তারপরই ওদুদ সাহেবের স্টাডির একজন সদস্য হয়ে গেলাম আমি। ওদুদ সাহেব তখন আমার নানা। সম্পর্কটা অবশ্য নানা-নাতির মতো তরল ছিল না। কিন’ তিনি যেমন একমনে পড়তেন, ভাবতেন ও লিখতেন, আমি শুধু পড়েই যেতাম। দর্শন না সাহিত্য, কবিতা না প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী না রাজনৈতিক প্রতিবেদন, কোরআন-হাদিস-ফিকাহ না হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খ্রিষ্টান ধর্মের বিশ্লেষণ- কোন কিছুই বাদ বাছাই নেই। রবীন্দ্র রচনাবলী, শরৎ সাহিত্য, বঙ্কিম রচনাবলী তো ছিলই, আরও ছিল ভারতের বিভিন্ন সাহিত্যিকদের উপহার দেয়া বই ও পত্র-পত্রিকা। তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি। বছরের মাঝামাঝি, আসেপাশে কোন বন্ধুও তৈরি হয়নি। তাই আমার গন-ব্য শুধু দোতলার ঐ বইয়ের জগতে।

আমরা যখন কলকাতায় গেলাম তখন বিভিন্ন কলেজ-স্কুলের ভর্তির সময় পার হয়ে গেছে। ক্লাসও হয়ে গেছে অনেক দিন। ভাল কোন কলেজে আপার ভর্তি করা গেল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর গড়িয়াহাটার নিকট মুরলিধর মহিলা কলেজে আপার ভর্তির ব্যবস’া হলো।
আপা প্রথম যে সমস্যায় পড়লো সেটা হলো, এর আগে যে আপা তার ক্ষুদ্র জীবনের কখনই একা ঘরের বাইরে পা রাখেনি, তার পক্ষে এখন বাসা থেকে সিঁকি মাইল হেঁটে ট্রাম রাস-া পর্যন- গিয়ে ট্রামে চড়ে মাইল পাঁচেক দূরের কলেজে যাওয়া কতটা কঠিন ও বিড়ম্বনাময় তা’ এখনকার কোন ছেলেমেয়েই ভাবতে পারবে না।
এখনও মনে পড়ে কলকাতায় যাওয়ার পর সন্ধ্যার পর বাসার সামনের ছোট্ট গলি পথটুকুও প্রথম প্রথম একা হাঁটতে আপা ভয় পেত। মা যখন প্রথম দিন তাকে বাসার দরজা থেকে গলির মোড়টুকু পথ, মাত্র এক শ’ ফিটও হবে না, হাঁটতে যেতে বললেন, তখন আপা ভয়ে প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। আব্বা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে ঐ পথটুকু দুই একবার হাঁটিয়ে কিছুটা সাহসী (!) করার চেষ্টা করেন।
আব্বা অনেক দৌড়াদৌড়ি করে একটা ট্রামের মান’লি টিকিটের ব্যবস’া করে দিলেন, যাতে প্রতি দিন তাকে টিকিট কাটতে না হয়। মা প্রথম কয়েকদিন ওর সাথে গেলেন, ফেরত আসাটা অবশ্য নিজে নিজে করতে হলো ওর! তারপর অবশ্য এই যাতায়তাটা আপার অভ্যাস হয়ে গেল।
এখানে দুই-তিন মাস যাবার পরই কলেজ কর্তৃপক্ষ আপার বুদ্ধিমত্তায় আকৃষ্ট হয়ে তাকে কলেজের বার্ষিক নাটকে নায়িকার রোলে নির্বাচিত করে ফেললো। আব্বা সংবাদটা শুনে আপার অভিনয়ে যথেষ্ট আপত্তি করায় কলেজ কর্তৃপক্ষ অনি”ছা সত্ত্বেও তাকে প্রধান চরিত্র থেকে বাদ দিলেও একটি পার্শ্ব চরিত্রে আপাকে নির্বাচিত করলো।
আমার মনে পড়ে উৎসবে দিন আমরা সকলে মিলে আপার অভিনয় দেখতে গেলাম। একটি কি দুটি সিনে তাকে দুই একটি সংলাপ বলতে দেখা গেল। তারপর সারা জীবনে আপা আর কোন মঞ্চে অভিনয় করেনি।

বছরের মাঝামাঝি হওয়ায় আমি বাড়িতেই থেকে গেলাম সে বছরের বাকী সময়টা। ধীরে ধীরে অল্প কিছুকালের মধ্যে পাড়ায় আমার দু’চারটে বন্ধু জুটলো তখন খোঁজ পেলাম পাড়ার যুবকদের দ্বারা স’াপিত একটা সত্যিকারের লাইব্রেরীতে। সেটাও ছিল আমার বই ক্ষুধা তৃপ্তির আর একটা মাধ্যম।
কলকাতায় আসার পরই আমাদের সকালের নাস-ার নিয়ম একেবারে বদলে গেল। ঢাকায় থাকতে সকালে সাধারণত রাতের ভাত আর তরকারীই ছিল মূল খাবার। শীতকালে সেই ঠাণ্ডা শুকনো ভাতের সাথে পিঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, লবন আর সরিষার তেল দিয়ে মেখে খাওয়া হতো আর গরম কালে শুকনো ভাত গরম আবহাওয়ার কারণে নষ্ট হতে পারে, তাই ঠাণ্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখা হতো। এই পানি দেওয়া ভাত, চলতি কথায় যাকে বলা হতো, ‘আমানি’- শুকনা মরিচ পুড়িয়ে, পিঁয়াজ আর লবন সহযোগে চটকিয়ে মাখা হতো। কখনও কখনও রাতের ডাল এর সাথে যোগ করা হতো।
কলকাকায় আসার পর মাঝে মাঝে এই রেসিপি চললেও বেশিরভাগ দিনই ভোর বেলা আমি অথবা বড় ভাই দৌড়ে যেতাম ধাঙড় বাজারে। বাজারের উত্তর দিকের কোনায় দুটি দোকান ছিল, যেখানে সকাল বেলা গরম গরম পাঁউর”টি বিক্রি হতো। একটু দেরী হলেই কপালে জুটতো লবডঙ্কা- মানে, র”টির চালান আসাার পনেরো মিনিটের মধ্যেই সব শেষ। দোকানের একজন কর্মচারী বিশাল লম্বা একটা ছুরি নিয়ে ঘচ ঘচ করে র”টিগুলো নিখুঁতভাবে স্লাইস করে দিতো। সেই সাথে কেনা হতো টাটকা মাখন। এটাও অল্প সময়ের জন্য দোকানে পাওয়া যেত।

র”টি টোস্ট করার জন্যে কেনা হলো টোস্টার। তবে সেটা বিদ্যুতের সাহায্যে চলতো না। টোস্টারটা ছিল লোহার তার দিয়ে তৈরী দুটি ফ্রেমের। ফ্রেমের মাঝে র”টি আটকিয়ে কয়লার চুলোর ধিকি ধিকি তাপে চমৎকার টোস্ট করা হতো। বরং বড়লোকদের বৈদ্যুতিক টোস্টারের চেয়ে আমাদের সেই ম্যানুয়াল টোস্টার অনেক ভাল ছিল।
সকাল বেলা ঐ র”টির স্লাইস, কখনও কাঁচা, আবার কখনও চুলোয় টোস্ট করে মাখন লাগিয়ে খাওয়া হতো। তখনও অবশ্য ইলেকট্রিক টোস্টার পাওয়া যেত, কিন’ সেগুলো কেবল সম্পদশালীদের বাসাতেই দেখা যেত। আমাদের বাসায় লোহার সর” শিক দিয়ে বানানো ‘ম্যানুয়াল’ দুই ভাঁজের টোস্টার পাওয়া যেত, সেটার একধারে র”টির চারটা পিস বসিয়ে অন্যধারটা লাগিয়ে দিয়ে কয়লার চুলোতে শেঁকা হতো। ইলেকিট্রিক টোস্টারের চেয়ে এর টোস্ট কোনও অংশে খারাপ হতো না।
আব্বা অবশ্য পাউর”টি দিয়ে নাস-া করতে খুব স্বা”ছন্দ্য বোধ করতেন না। তিনি তাঁর প্রাচীন পদ্ধতি পান-া ভাতই বেশি পছন্দ করতেন। কোন কারণে যদি রাতের ভাতে টান পড়তো, তখন তিনি বাধ্য হয়ে পাউর”টি দিয়ে নাস-া করতেন।
আমাদের বাসাটা সার্কাস রেঞ্জ আর তারক দত্ত রোডের সংযোগ স’লের উল্টো দিকে। রাস-াটার পরে ফুটপাথ, তারপর বেশ বড় একটা গলির শেষ মাথায় যে বাড়িটা তার একতলায়। আমাদের বাসার পাশে একই রকম আর একটা গলির শেষ প্রানে- আর একটা বাড়ি। দুই গলির মাঝে বেশ উঁচু দেওয়াল। প্রায় আট-নয় ফুট উঁচু।
আমাদের গলিটার মাঝামাঝি ওপাশের গলিটাতে একটা ঝোপালো গাছ দেওয়াল পার হয়ে এপাশেও তার আঁকাবাঁকা বেশ কয়েকটা ডাল ছড়িয়ে দিয়েছে। গাছটা যে অংশের সে অংশের চেয়ে এ পাশে আমাদের গলিতেই গাছটার বিস-ার বেশি। গোল গোল ঘন পাতায় এতই ঝোপবহুল গাছ যে গাছটার নিচে দাঁড়ালে ওপরটা দেখা যায় না, ছোট-বড় গিজগিজে জড়ানো ডাল-পাতায় ভরা। তলা থেকে ডালপালার দিকে তাকালে যেটা নজরে আসে সেটা হলো পুরো ডালপালা জুড়ে অসংখ্য মাকড়শার জাল। আর একটা জিনিষ অবাক করা সেটা হলো গিজগিজে ডালপালার মধ্যে আটকে আছে অনেক ছোটবড় ইটের টুকরো, মানে ঢিল।
তখনও আমি গাছপালা খুব একটা চিনে উঠতে পারিনি। কিন’ অল্প কয়েক মাসের মধ্যে বাস-ব অভিজ্ঞতা থেকে গাছটা চিনতে পারলাম, যখন দেখলাম পাড়ার ছেলেরা গাছটার তলায় এসে গলির চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঢিল তুলে এই ঘন ঝোপালো গাছটার দিকে ঢিল ছুড়ে ছুঁড়ে মারছে আর মাঝে মাঝে যখন ওপর থেকে কিছু একটা টুপ করে পড়ছে তখন সেটা ধরার জন্যে ছেলেদের মধ্যে সে কী প্রতিযোগিতা! ততদিনে ঐ দঙ্গলের দুই-একজনের সাথে একটু ঘনিষ্টতা হয়েছে।
নির্বোধের মতো একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি দেখে ওদের একজন, সম্ভবত নেহায়েত কর”ণা করে, কুড়িয়ে পাওয়া একটা সবুজ ফল আমাকে দিয়ে বললো, ‘হা করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কি, নে খা।’
আমি কালচে-সবুজ সঙের প্রায় গোলাকৃতির দ্রব্যটার দিকে তাকিয়ে দেখি ফলটার বোঁটার কাছটা সাদা দুধের মতো এক ফোঁটা রস। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি ওটা বেশ আঠালো। ফলটা মুখে দিয়ে দাঁত দিয়ে চাপ দিতে অসম্ভব কষাটে টক রসে মুখের এক পাশটা যেন অবস হয়ে গেল। সেই সাথে অসম্ভব ভাল লাগলো ওর স্বাদটা। বোকার মতোই নতুন গজিয়ে ওঠা বন্ধুটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কিরে?’
বন্ধুটি পরম অসন’ষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুই গাধা নাকি রে। এটা তো করমচা।’
ঐ অল্প বয়সে সম্ভবত প্রথম একটা কাঁচা ফলের সাথে আমার পরিচয় হলো। তারপর থেকে যতকাল ও বাসায় আমরা ছিলাম ততকালই করমচার মৌসুমে আর দশটা ছেলের সাথে আমিও প্রতিদিনই গাছটার নীচে এসে ঢিল দিয়ে ওপরের ফল পাড়ার চেষ্টা করতাম।
একবার হলো কি, ঢিল ছুঁড়তে ছুঁড়তে একটা ঢিল ছিটকে এসে আমার কপালে এসে লাগলো। খুব বড় ঢিল না, খুব জোরেও লাগেনি। কিন’ সাথে সাথে কপাল থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকলো। পাশে যে দুই একজন ছেলে ছিল, তাদের সবাই আমার কপাল থেকে রক্ত বের হতে দেখে একছুটে উধাও। কেবল একজন, বয়সে আমার চেয়ে দুই-এক বছর বড় হবে, কাছে এসে হাত দিয়ে কপালের ফুটো হয়ে যাওয়া জায়গাটা হাত দিয়ে চেপে ধরে আমাকে বাসায় নিয়ে এলো।
মা আমাকে দেখতে পেয়ে প্রথমে ‘ন ভুত ন ভবিষ্যৎ’ গালাগালি করতে লাগলেন, সেই সাথে অবশ্য তার হাতদুটো ক্রীয়াশীল হয়ে উঠলো, প্রথমো আমার কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধার কাজে, পরে আমার পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে দিতে তার তৎপরতার কমতি ছিল না।
এ ফলটার স্বাদ আজও আমাকে নস্টালজিক করে তোলে। আজ চৌষট্টি বছর বয়সেও আমি কোথাও করমচা গাছ দেখলে সি’র থাকতে পারি না। গাছটার কাছে গিয়ে দেখবো ওতে কোন ফল আছে কি না। থাকলে অন-ত একটা হাত দিয়ে ছিঁড়ে নিতে চেষ্টা করবো আর এদিক ওদিক তাকিয়ে টপ করে ফলটা দাঁতের নীচে ফেলে চাপ দিয়ে ওর কষাটে টক রসটার স্বাদ জিভ দিয়ে অনুভব করবো। ততক্ষণে আমার চোখদুটো আবেশে বন্ধ হয়ে যাবে।

কাজী নানার স্ত্রী প্রায়ই নানা জটিলতায় ভুগতেন। এক দিন তিনি অত্যন- অসুস’ হয়ে পড়লেন। এরকম হলে সাধারণত কাজী নানা নিজে হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করে অক্সিজেন এনে তার শ্বাসকষ্ট দূর করার চেষ্টা করতেন। সেদিন বিকেলে রোগীর অবস’ার অবনতি হলে কাজী নানা নিজে গেলেন অক্সিজেন আনতে। নানা অক্সিজেন নিয়ে ফিরে আসার আগেই সন্ধ্যার সময় ভদ্রমহিলা মারা গেলেন। মা দ্র”ত উপরে চলে গেলেন। আমাকে বলে গেলেন ঘরে থাকতে। কিন’ আমার ই”ছা করছিল উপরে গিয়ে কি ঘটনা ঘটেছে দেখার।
আমি গুঁটি গুঁটি পায়ে সিঁড়ির কাছে গিয়েছি, উঠবো কি উঠবো না এই দোটানায় মনটা অসি’র। ঘটনাটা দেখার খুব ই”েছ, কিন’ ওদিকে মা-র নিষেধটাও অমান্য করা মনের শক্তি অর্জন করে উঠিনি তখনও। এমন সময় কাজী নানা অক্সিজেন সিলিণ্ডার সহ এক জন সহকারীকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকছেন। উপর থেকে তখন কাজী নানা ছোট ছেলে জিবু ও কাজের মেয়েগুলো উ”চকণ্ঠে কাঁদছে।
কাজী নানা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার, ওরা কাঁদছে কেন?’
আমি বোকার মতো বলে ফেললাম, ‘মনে হয় নানী মরে গেছেন।’
কাজী নানা কোন কথা না বলে সহকারীটাকে বললেন, ‘সিলিণ্ডার ফেরত নিয়ে যাও।’
তারপর আসে- আসে- করে উপরে উঠে গেলেন।

এর পর থেকে বহুদিন তিনি আমাকে ‘ভগ্ন দূত’ বলে ডাকতেন। তখন বুঝিনি শব্দটির অর্থ। পরে বড় হয়ে জেনেছি রাজাদের কাছে দুঃসংবাদ পৌঁছে দিত যে দূত, তাকে ‘ভগ্ন দূত’ বলে ডাকা হতো। কাজী নানার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের সংবাদ দিয়ে আমি তার কাছে ‘ভগ্ন দূত’ হয়ে গিয়েছিলাম।
নানী মারা যাওয়ার পর কাজী নানার দৈনন্দিন কাজের তেমন পরিবর্তন আমার চোখে পড়লো না। তবে মাস খানেকের মধ্যে তিনি তাঁর বাড়ির সামনে একটা খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস’া করলেন। প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ জন ফকির বাড়ির সামনের গলিটায় থালা নিয়ে লাইন ধরে বসলো। আর তার তদারকিতে তার বাসার দুই তিনজন কাজের মেয়ে ওদের খাওয়ার ব্যবস’া করলো।
আমার বয়স তখন নিতান-ই কম- পাঁচ কি ছয় হবে। ফকিরদের লাইন ধরে খেতে দেখে আমার খুব লোভ হয়েছিল ঐ রকম লাইন ধরে বসে খাবো। কিন’ সে ই”েছর কথা কাউকে বলতে সাহস পেলাম না।
এর পর থেকে প্রতি শুক্রবারে আমাদের বাসার সামনে এক দঙ্গল পুর”ষ ও নারী ফকির এসে ভীড় জমাতো। আর কাজী নানা দোতলায় ওর ঘরের সামনের ঝুল বারান্দা থেকে দেখেশুনে বেছে বেছে ফকিরদের এক পয়সা দুই পয়সা ভিক্ষা দিতেন।

কাজী আব্দুল ওদুদ সাহেবের কাছে প্রায়ই নানা বিশিষ্ট ব্যক্তি আসতেন। অধিকাংশই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। তবে তখনকার পূর্ব পাকিস-ান থেকে প্রায়ই যে ব্যক্তি কলকাতায় গিয়ে কাজী সাহেবের আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন তিনি ছিলেন ড. কাজী মোতাহার হোসেন।
এই বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদ ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় প্রতি বছরই এক্সটারনাল পরীক্ষক হিসাবে আমন্ত্রণ জানানো হতো। আর তিনি কলকাতায় এলেই অবধারিতভাবে কাজী সাহেবের বাসায় এসে উঠতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার দায়িত্ব পালনের সময়টুকু ছাড়া বাকী প্রায় সকল সময়ই তিনি ও কাজী সাহেব বসে বসে দাবা খেলতেন। এ খেলায় তারা এতই মগ্ন থাকতেন যে তাদের সময়জ্ঞান পর্যন- রহিত হয়ে যেত। অনেক দিনই আছে সন্ধ্যার পর আমি তাদের ঘরে গিয়ে লাইট জ্বেলে দিতাম।
সন্ধ্যার অন্ধকারে দাবা ঘুটি দেখতে অসুবিধা হলেও দুজনের কেউই তারা উঠে গিয়ে আলো জ্বালানোর কথা মনে আনতেন না। সবচেয়ে মজা হতো রোজার সময়। সারা দিন খাওয়ার ঝামেলা ছিল না তাই কেবল দাবার ছক পেতে দুই জনে মগ্ন থাকতেন।
সাধারণত মগরেবের আজান হলে মা দুই থালায় ইফতারী সাজিয়ে আমার বড় ভাইকে দিয়ে ওদের ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে ইফতারী করার কথা ভাল করে বলে না দিলে হয়তো তারা খাবার সময়টুকুও পেতেন না। ইফতারীর সময় না হয় আমাদের বাসা থেকে খাবার পাঠানো হতো, কিন’ সেহেরীর সময় তো তাদের মনে করিয়ে দেয়ার কেউ থাকতো না। প্রায়ই দেখা যেত কাজী মোতাহার হোসেন সাহেব না খেয়ে রোজা আছেন।

দেরীতে ভর্তি হলেও কীভাবে যেন অল্প সময়ের মধ্যেই আপা ওর পাঠ্য বিষয়গুলো সহজেই আয়ত্ব করে ফেললো। আর মুরলীধর গার্লস কলেজ থেকে ১৯৫৫ সালে আপা আই এ পাশ করে ফেললো দ্বিতীয় বিভাগে। আপার এ সাফল্যে মা আর আব্বা খুবই খুশি হয়ে গেলেন। তাই মা যখন মহা উৎসাহে আপাকে লেডী ব্রেবোন কলেজে ডিগ্রি ক্লাসে ভর্তি করার ব্যাপারে আব্বাকে বলতে আব্বা সহজেই রাজী হয়ে গেলেন।
লেডী ব্রেবোন কলেজ তখন কেবল কলকাতারই নয়, ভারতের মধ্যে অন্যতম প্রশিদ্ধ কলেজ ছিলো। পার্ক সার্কাস ময়দানের পাশে বিশাল এলাকা জুড়ে দেয়াল ঘেরা এই কলেজে আপার যেতে তেমন অসুবিধা হতো না। ট্রামে করে বালীগঞ্জের মুরলীধর কলেজে যাওয়া আসা করে আপার ততোদিনে বেশ একটু সাহস হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের বাসা থেকে লেডী ব্রেবোন কলেজ সেই তুলনায় অনেক কাছে- মাত্র ছয়-সাত স্টপেজ দূরত্ব।
আমাদেরকে আধুনিক করার প্রয়াসে মা নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়ে যেওেত থাতকলেন। এরই অংশ হিসেবে। আপাকে পাড়ার একজন এংলো-ইন্ডিয়ান পরিবারের সাথে যুক্ত করে দিলেন পিয়ানো শেখার জন্য। আসলে ঠিক পিয়ানো শেখাটা মূল উদ্দেশৗ্যৗ ছিল না। মা’র উদ্দেশ্য ছিল ঐ পরিবারে গিয়ে পিয়ানো শেখার পাশাপাশি আপা যেন বিদেশী এটিকেট ও স্পোকেন ইংলিশে অভ্যস- হয়ে ওঠে।
কাজী নানা আমাদের বাসার বৈঠকখানায় বেশ কিছুদিন অন-র সাহিত্য আসর বসাতেন। সে আসরে সে সময়ের অনেক বিশিষ্ট সাহিত্যিকরা আসতেন। এ অনুষ্ঠান আমাকে খুব একটা আকৃষ্ট করতো না তবে মনে আছে সে অনুষ্ঠানের একটা নির্দিষ্ট সূচি ছিল আমার কবিতা আবৃত্তি। যে কবিতাগুলো আবৃত্তি করতে হতো সেগুলো অবশ্য কাজী নানাই বেছে দিতেন। একবার মনে পড়ে আমি আবৃত্তি করেছিলাম-
‘জীবনে যত পূজা হলো না সারা
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।
যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে
যে নদী মর”পথে হারালো ধারা
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।
কবিতাটির অর্থ তখন অবশ্য বোঝার কথা নয়, তবে আমার মনে কবিতাটা গেঁথে গিয়েছিল।

পরের বছরের প্রথমে মা আমাকে পাড়ার একটা ইংরেজী মাধ্যমের স্কুল- মিসেস এ্যালফোর্ডস কনভেন্ট-এ ভর্তি করিয়ে দিলেন। আজ ভাবতে অবাক লাগে ঊনিশ শ’ পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে মফস্বলের এক স্বল্প শিক্ষিত মহিলা তার ছেলেকে ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। ইংরেজী শিখলে বড় চাকরী পাওয়া যাবে এ কথা মনে করে নয়, বরং বিদেশে গিয়ে উ”চ শিক্ষা নিতে পারবো।
সেই সময়, যখন তার সমসাময়িক অধিকাংশ মহিলাই তার কন্যা সন-ানদের তের-চৌদ্দ বছর হলেই বিয়ে দিয়ে দিত আর পুত্র সন-ানদের কোন মতে স্কুল-কলেজের গণ্ডি দ্বিতীয় বিভাগে পার করাতে পেরেই চরম আত্মপ্রসাদ লাভ করতো আর স্বপ্ন দেখতো ছেলেটা যেন কোন প্রতিষ্ঠানে কেরানী হিসাবে যোগ দিতে পারে। সেখানে মার চিন-া ছিল ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে উ”চ শিক্ষা দিতে হবে। এ কথা তিনি প্রায়ই আমাদের মাথায় ঢোকানোর চেষ্টা করতেন।
স্কুলের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন মিসেস এ্যালফোর্ড। বেশ গোলগাল নাদুস-নুদুস চেহারার মহিলা- বা”চাদের বেশ আদর করতেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো একটা র”মের মধ্যেই দুই-তিনটা ক্লাসের পড়াশুনা চালানো হতো।
আমার চেয়ে এক ক্লাস উপরে পড়তো মিসেস এ্যালফোর্ডের বড় মেয়ে ইভেট এ্যালফোর্ড। ফর্সা, রোগা, বকের মতো মেয়ে- কেন জানি না আমাকে সে বেশ পছন্দ করতো আর সব সময় আমার সাথে খেলতে চাইতো, আমার পড়া দেখে দিত।
আমার সাথে পড়তো ওর ছোট ভাই জনি এ্যালফোর্ড। ওদের বাবা ছিলেন অত্যন- রোগা আর লম্বা। কোন এক বেসরকারী অফিসে চাকরী করতেন। খুব যে বড় চাকরী করতেন, তা’ না, কারণ তাকে সব সময় দেখতাম ট্রামে করে চলাচল করতে। সম্ভবত সংসার খরচ ভালভাবে চালানোর জন্যই মিসেস এ্যালফোর্ড এ স্কুলটা চালু করেন।
আমি খুব অল্প দিনের মধ্যেই স্কুলের পড়াশুনায় বেশ চৌকশ হয়ে পড়লাম।
মিসেস এ্যালফোর্ডের স্কুলের প্রথম বছরের শেষে তিনি এক বড় স্টেজ ভাড়া করে আমাদের নিয়ে বার্ষিক অনুষ্ঠানের ব্যবস’া করলেন। একটা বড় নাটকের ব্যাবস’া করা হলো নার্সারী রাইমের বিভিন্ন ছড়ার চরিত্রের অভিনয়। সবাইকে কোন না কোন চরিত্র দেয়া হলো। নাটিকাটির শেষে সবাই মিলে একটি নাচের সিকুয়েন্স।
আমাকে দেয়া হলো হামটি ডামটির চরিত্রে অভিনয় করতে। নাটকের মাঝামাঝি সময় থেকে শেষ পর্যন- আমাকে ক্র্যাচ নিয়ে চলতে হলো। দেয়াল থেকে পড়ে গিয়ে হামটি ডামটির পা ভেঙে গিয়েছিল- তাই। অনুষ্ঠানের শেষের গান ও নাচের সময়, যদিও টিচার আমাকে বার বার বলে দিয়েছিলেন আমি যেন ক্র্যাচ নিয়েই নাচি। কিন’ নাচতে গিয়ে বার বার আমার ছন্দপতন হতে থাকলো, বিশেষ করে যখন হামটি-ডামটির সাথে লিটল মিস মাফেট নাচবে তখন।
স্কুলে আমার সবচেয়ে প্রিয় মেয়েটি লিটল মিস মাফেটের চরিত্রে অভিনয় করছিল, তার সাথে নাচতে গিয়ে প্রথমে এক-দুই বার হোঁচট খাওয়ার পর সে ফিস ফিস করে বললো, তুমি ক্র্যাচটা নিচে রেখে নাচ। যে কথা সেই কাজ। পরের সময়টুকু আমি সাবলিলভাবে নাচলাম।
আমার অনুষ্ঠান দেখতে আব্বা-মা-আপা সবাই গিয়েছিল। নাচের সময় আমার চোখ পড়লো ওদের উপর আমি ওদের দেখতে পেয়ে হেসে উঠেছিলাম। আমার হাসি দেখে আমার যাতে অভিনয়ে কোন ছন্দপতন না হয়, তার জন্যে বাকী সারাক্ষণ ওরা মাথা আড়াল করে ছিল, যাতে আমি ওদের দেখতে না পাই। পরে অবশ্য টিচার ক্র্যাচটা রেখে নাচার জন্য আমাকে শাসি- দিয়েছিল ক্লাসে, কিন’ আমি তাতে কিছু মনে করিনি।
এটাই আমার দ্বিতীয় মঞ্চে ওঠা- তখন আমার বয়স নয়।

কলকাতায় সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশকে রাস-ায় সবচেয়ে বেশি চলতো রিক্সা। তবে বাংলাদেশ সহ সারা পশ্চিমবঙ্গে যে ধরনের তিন চাকার রিক্সা চালু ছিল বা এথনও আছে সেই তিন চাকার ঐতিহ্যবাহী রিক্সা কলকাতার রাস-ায় চলাচল করতো না। কলকাতার রিক্সায় ছিল তিন চাকার জায়গায় দুটি চাকা, তবে চাকা দুটি ছিল ঘোড়ার গাড়ির চাকার মতো বেশ বড়।

কলকাতার রাস-ায় রিক্সা, কী পরিশ্রম করতে হতো রিক্সাওয়ালাদের- যাত্রী আর মালামাল নিয়ে
দুই হাতের ওপর পুরোটা ওজন নিয়ে রৌদ্রের ভেতর দৌড়ে দৌড়ে রিক্সা টানতে!
যাত্রী সিটের তলা থেকে দুটি বিশাল তিন হাত লম্বা হাতল থাকতো। এই হাতলটা ধরে চালক ছুটে চলতো। সাধারণ সময় হাতলদুটো মাটিতে রাখার কারণে যাত্রীদের রিক্সায় উঠতে সুবিধা হলেও চালক যখন হাতল দুটো ধরে উচু করতো তখন অনভিজ্ঞ যাত্রী পেছন দিকে হেলে গিয়ে বিব্রত বোধ করতো। কলকাতার রিক্সার অধিকাংশ চালকই উড়িষ্যা রাজ্যের অধিবাসী ছিল। রিক্সার ভাড়া এক আনা, দু’আনা, তিন-চার আনা – দূরত্বভিত্তিক পরস্পরের সম্মতির ভিত্তিতে নিধাররিত হতো। তবে খুব বেশি তর্কতর্কি করা লাগতো না।
কলকাতার দ্বিতীয় প্রকার গণপরিবহন ছিল ট্রাম। বিদ্যুৎচালিত এই ট্রাম কলকাতা ট্রাম কোম্পানী দ্বারা পরিচালিত ছিল। কোম্পানী ছিল স্বায়াত্বশাসিত। সম্ভবত সরকারকে এবটা বড় অংশের রাজস্ব দিতো। এর পরিচালনায় তখন বিদেশী কর্মকর্তা থাকতেন আর এর চালক ও অন্যান্য কর্মচারীরা অধিকাংশই ছিল অবাঙ্গালী। খুব অল্প সংখ্যক বাঙ্গালী এ প্রতিষ্ঠানে চাকরী করার সুবিধা ভোগ করতো। ট্রাম দুটি বগিতে ভাগ করা ছিল, সামনের বগি প্রথম শ্রেণী, এর সিটগুলি ছিল গদিওয়ালা আর মাথার ওপর ঘুরতো ফ্যান। এর ভাড়াও ছিল একটু বেশি। আমাদের বাসা তারক দত্ত রোডের স্টপেজ থেকে চৌরঙ্গী বা এসপ্লানেড যেতে বার আনা বা একটাক লাগতো। সে তুলনায় ট্রামের পিছনের অংশ বা বগিতে ছিল কাঠের বেঞ্চি, এতে মাথার ওপরে কোন ফ্যান ছিল না। এর ভাড়াও ছিল অনেক কম, প্রথম শ্রেণীর প্রায় অর্ধেক। চৌরঙ্গী যেতে ভাড়া লাগতো আট আনা।

কলকাতার ট্রাম। সামনেরটা প্রথম শ্রেণী আর পরেরটা দ্বিতীয় শ্রেণী। প্রথম শ্রেণীর সিট গদি
মোড়া, মাথার ওপর ফ্যান, পরেরটায় কাঠের বেঞ্চি। সামনে দুই ধারে দুটি রঙীন আলো,
আলোর রঙের কম্বিনেশন দেখে কোন ট্র্রাম কোন পথে যাবে সেটা বুঝে নিতে হতো।
কলকাতার তৃতীয় প্রকার গণপরিবহন ছিল ট্যাক্সি। এর অধিকাংল চালক ছিল শিখ। সম্পূর্ণ মিটারে চলতো বলে অনেক মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠি একটু আরামে যাতায়াতের জন্যে ট্যাক্সি ব্যবহার করতে কুণ্ঠা বোধ করতো না। মিটারে চলতো বলে, মিটার চালু করলেই চার আনা বা পঁচিশ পয়সা উঠতো মিটারে। আমাদের বাসা থেকে চৌরঙ্গী যেতে চার-পাঁচ টাকা লাগতো।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় বাঙ্গালী যুবকদের অধিক পরিমানে কর্মসংস’ানে উদ্বুদ্ধ করে তোলার জন্যে পাঁচশ’ ট্যাক্সি কলকাতার রাস-ায় নামালেন। ঠিক করা হলো এইসব ট্যাক্সির চালক হবে সব অল্প বয়ষ্ক বাঙালী যুবক। তাঁর এই উদ্যোগের পিছনে অবশ্য অন্য কারণও ছিল- পঞ্চাশ দশকের শেষের দিক থেকেই ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে, বিশেষ করে উড়িষ্যা, বিহার, পাঞ্জাব, গুজরাট থেকে বিপুল সংখ্যক অবাঙ্গলী জনগোষ্ঠি কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ শহরের দোকান-পাট, বাজারঘাট, ব্যবসায়-বাণিজ্যে এমনভাবে ছড়িয়ে যেতে থাকে, যে পশ্চিমবঙ্গের আসল জনগোষ্ঠি ক্রমে কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকে।
কলকাতার বাঙ্গালীরা জাত্যাভিমানে নিজেদেরকে এত বেশি বড় মনে করতো, যে দোকান-পাট ব্যবসায় চালানো তাদের কাছে অত্যন- নিচু কাজ বলে মনে হতো। ট্যাক্সি চালানোটাও তাই তাদের কাছে ‘ইজ্জতহানীকর’ বলে মনে হতে থাকলো। ফলে রাজ্য সরকার এই বিপুল সংখ্যার কর্মসংস’ানের ব্যবস’া করে দিলেও অল্প কিছুকাল পরেই আমরা দেখতে পেলাম এই সকল নব্য ড্রাইভাররা তাদের ট্যাক্সি পাঞ্জাবী-শিখদের হাতে হস-ান-র করে ফেললো।
সৈয়দ মুজতবা আলী এই সকল বাঙ্গালীদের কথা বেশ রসিয়ে রসিয়ে তাঁর ‘দেশে বিদেশে’ বইয়ের ২৭ পৃষ্ঠায় খুব সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন:
“বাঙালী যখন ব্যবসা করে তখন তার কায়দাও আজব। আমি তখন ইলিয়ট রোডে থাকতুম, সেখানে দোকানপাটর্ ফিরিঙ্গীদের। মুসলমানদের কিছু কিছু দর্জীর দোকান আর লন্ড্রি, ব্যস। তার মাঝখানে এক বাঙালী মুসলমান ঝাঁ-চক্‌চকে ফ্যান্সি দোকান খুলল। লোকটির বেশভূষা দেখে মনে হলো, শিক্ষিত, ভদ্রলোকের ছেলে। সি’র করলুম দোকান যখন খুলেছে, তখন তাকে পেট্রনাইজ করতে হবে।
জোর গরম পড়েছে- বেলা দুটো। শহরে চর্কিবাজীর মত ঘুরতে হয়েছে- দেদার সাবান চোখে পড়েছে কিন’ কিনিনি- ভদ্রলোকের ছেলেকে পেট্রনাইজ করতে হবে।
ট্রাম থেকে নেমে দোকানের সামনে এসে দেখি ভদ্রলোক নাক ডাকিয়ে ঘুম”েছন, পাখিটা খাঁচায় ঘুম”েছ, ঘড়িটা পর্যন- সেই যে বারটায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, এখনও জাগেনি।
আমি মোলায়েম সুরে বললুম, ‘ও মশাই, মশাই।’
ফের ডাকলুম, ‘ও সাহেব, সাহেব।’
কোন সাড়াশব্দ নেই। বেজায় গরম, আমারও মেজাজ একটু একটু করে উষ্ণ হতে আরম্ভ করেছে। এবার চেঁচিয়ে বললুম, ‘ও মশাই, ও সাহেব।’
ভদ্রলোক আসে- আসে- করে বোয়াল মাছের মত দুই রাঙা টকটকে চোখ সিকিটাক খুলে বললেন, ‘আজ্ঞে?’ তারপর ফের চোখ বন্ধ করলেন।
আমি বললুম, ‘সাবান আছে? পামওলিভ সাবান’?
চোখ বন্ধ রেখেই উত্তর দিলেন, ‘না।’
আমি বললুম, ‘সে কি কথা, ঐ তো রয়েছে শো-কেসে’।
‘ও বিক্কিরির না।’
হাতেটানা রিক্সা, ট্রাম, ট্যাক্সি আর বাস- এই চার প্রকার গণ-বাহনের পাশাপাশি আর এক প্রকার বাহনও রাস-ায় দেখা যেত, এগুলো ছিল ঘোড়ায় টানা ফিটন। এগুলোও আবার দুই ধরনের ছিল। প্রথমত জানালাওয়ালা বাক্স টাইপ আর একটা হলো হুডয়ালা খোলা গাড়ি। তবে এগুলোর সংখ্যা ক্রমে হারিয়ে যা”িছল। হাতেটানা রিক্সা কেবল কলকাতাতেই প্রচলন ছিল। কলকাতার বাইরে মফস্বল শহর ও গ্রামে সারা দেশজুড়ে সাইকেল রিক্সাই স্বল্প দূরত্বের বাহন হিসেবে প্রায় একচেটিয়া ছিল।
কোন কোন র”টে, বিশেষ করে পুরানো কলকাতায় অবশ্য অল্প সংখ্যায় মুড়ির টিন মার্কা বাস ছিল। কিন’ সকল রাস-ায় এই বাস দেখা যেত না।
এর পরেও ব্যক্তিগত বাহন তো ছিলই। আমরা যখন কলকাতায় প্রথম গেলাম তকন ফিয়াট, ফক্‌সওয়াগেন, ডজ ও আরও নানা প্রকারের গাড়ি চলাচল করতো। এগুলো সাধারণত সম্পদশালীরাই ব্যবহার করতো। তবে পরে ভারতের নিজস্ব ‘এমব্যাসাডার’ গাড়ি যখন রাস-ায় নামলো তখন অনেক উ”চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষও গাড়ি কিনতে আরম্ভ করলো।
মফস্বলের বিপুল সংখ্যক বাসিন্দা প্রতিদিন সকালে কলকাতায় চাকরী ও নানা ধরনের আয় রোজগারের জন্য লোকাল ট্রেনে করে শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনে এসে হাজির হতো। দূরদুরানে-র শহর থেকে, কলকাতার উত্তর ও পূবে বনগ্রাম (বনগাঁ), ব্যারাকপুর, হাবড়া, ভাটপাড়া, কাচড়াপাড়া, কল্যানী, বারাসত; দক্ষিণে ও পশ্চিমে বাগনান, ইছাপুর, খড়দহ, ফলতা, মহেশতলা, পানিহাটি, কোন্নগর, তমলুক, বশিরহাট, গোশাবা, হলদিয়া ও ডায়মন্ড হারাবার প্রভৃতি জায়গা থেকে মানুষ প্রতিদিন আসতো কলকাতায় রোজগারের ধান্দায়। আবার সন্ধ্যাবেলায় ফিরে যেত বাড়িতে। এই সব শহরের অনেকগুলিই এখন অবশ্য বৃহত্তর কোলকাতার অংশ হয়ে গেছে।
সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা লিখতে গিয়েই মনে পড়লো- আমরা বাসায় প্রথম দিকে ‘পামওলিভ’ সাবান ব্যবহার করতাম। পরে যখন ‘মার্গো’ সাবান চালু হলো তখন মার্গো সাবান ব্যবহার আরম্ভ করলাম। মার্গো সাবানের ফেনা মুখে লাগলে ঠিক নিম পাতার স্বাদ লাগতো।
আব্বার বিছানার তলায় থাকতো চৌকা আকারের একটন্ট্রান্‌ক। ওটা সব সময় তালা দেওয়া থাকতো। ওাাতে আব্বার দামী পোষাক- একটা কালো সার্জে কাপড়ের আচকান, গোটাদুই উত্তম কাপড়ের স্যুট, বেশ কয়েকটা প্যান্ট, সার্ট, যেগুলো খুব সাবধানের কাচা ও ইসি-রী করে রাখা হতো আর যেগুলো আব্বার অফিস ড্রেস ছিল। আর ছির প্রচুর কাজপত্র।
নানা প্রয়োজনে বিছানার তলায় রাখা তার ব্যক্তিগত ট্রাংকটা খুলে কাগজপত্র নাড়াচাড়া করতেন, তখন দেখেছি আব্বার কাগজপত্রের ভেতর বিদেশী ‘পিয়ার্স’ সাবানের ছোট বাক্স, এমন মাপের যে তাতে তিনটি সাবান পাশাপাশি রাখা যায়। সম্ভবত আব্বা বিয়ের পর কোন এক সময় মা-কে কিনে দিয়েছিলেন। সে সময়ে একটা পির্য়াস সাবানের দামে পাঁচটা পামওলিভ সাবান পাওয়া যেত।
মা কাঁথা, বিছানার চাদর, মশারী জাতীয় ভারি কাপড় কাচতেন পানি গরম করে তাতে সোডা মিশিয়ে তার ভেতর কাপড়গুলো দিয়ে কিছুক্ষণ ফোটাতেন, তারপর নামিয়ে নিয়ে পানি কিছুটা ঠাণ্ডা হলে এক একটা কাপড় বারান্দায় নামিয়ে আমাকে বলতেন ঐ কাপড়ের ওপর গিয়ে পা দিয়ে পাড়াতে। মাঝে মাঝে মা একটু করে কাপড়টা উল্টে দিতেন আর আমি পা দিয়ে কাপড় পাড়িয়ে যেতাম দশ পনেরো মিনিট তারপর মা পানি ঢেলে দিতেন আর আমি পাড়িয়ে দিতে থাকলে ময়লা পানিগুলো ধীরে ধীরে বেরিয়ে যেত, তখন মা কাপড়ের এক পাশটা আমাকে ধরতে দিয়ে অন্য পাশ ধরে মুড়িয়ে দিতে থাকলে বাকী পানিগুলো ঝরে যেত। তারপর মা উঠানের তারে কাপড়টা মেলে দিতেন শুকানোর জন্য।
একটু দামী আর ভাল কাপড়গুলো সার্ফ ডিটার্জেন্ট পাউডার দিয়ে ধোয়া হতো। ষাটের দশকের প্রথম দিকে ‘ডেট’ নামে একটা নতুন ডিটার্জেন্ট পাউডার বাজারে পাওয়া যেতে আরম্ভ করলো। বাজার ধরার জন্য কোম্পনী প্রতি প্যাকেটে একটি করে স্টেনলেস স্টিলের চা চামচ দেয়া আরম্ভ করলো। মা ঐ চামচের আকর্ষণে ‘ডেট’ কিনতে থাকতেন আর আমাদের বাসায় সেই চামচ জমতে থাকলো। পরে ওরা চা চামচের পরিবর্তে আইসক্রিম খাওয়ার চ্যাপটা চামচ দেয়া আরম্ভ করলো। আমাদের বাসায় প্রায় প্রতি সপ্তাহেই এক প্যাকেট করে ‘ডেট’ পাউডার কেনা হতো।
উলের জামা, সোয়েটার, কার্ডিগান, শাল, এ সব কাপড় পরিষ্কার করার জন্য বাজার থেকে ‘রিটা’ ফল কেনা হতো। রিটা দেখতে কালচে রঙের ফল, ওপরটা অনেকটা খেজুরের মতো শাঁস। এই শাঁস কাটলে ভেতরে ছোট বাদামের মতো বিচি। এই শাঁস উষ্ণ গরম পানিতে মিশিয়ে নাড়লে পানি ফেনায় ভরে যেত। উলের জামাগুলো এই পানিতে ডুবিয়ে একটু নাড়লেই ময়লাগুলো পরিষ্কার হয়ে যায়।
আমরা যখন পয়ষট্টি সালে যশোরে চলে আসি তখন আমাদের বাসায় প্রায় ছয়-সাত ডজন চা চামচ আর তিন-চার ডজন আইসক্রিম চামচ ছিল। মা যশোরে আসার পর আত্মীয়-স্বজন চার-পাঁচ-ছয়টা করে চামচ গিফট দিলেন। বাড়িতে যে সব কাজের লোক আসতো কাজ করতে তারা একটা দুটো করে সরাতো। এত কিছু করেও আমাদের বাসায় সে সব চামচ প্রায় একাত্তর সালেও দুই-একটা অবশিষ্ট ছিল।
ঈদ-বকরি ঈদের নামাজে পরার জন্য যখন পাঞ্জাবী বের করা হতো,তখন আর একটা জিনিষের খোঁজ পড়তো। সেটা হলো ‘গিলা’ ফল। হাতের তালুর চেয়ে একটু ছোট চকলেট রঙের প্রায় চৌকা এই ফলটা আট আনা- বার আনা দিয়ে কেনা হতো। ফলটার যে কোন চ্যাপটা পাশে কাঁচি দিয়ে একটু ফুটা করে সেই পাশটা পাঞ্জাবীর দুই হাতের আগা থেকে কাঁধ পর্যন- ধীরে ধীরে ঘষে দিতাম আর পুরো হাতার দৈর্ঘ ক্রমে সূক্ষ্ণ কুঁচিতে ভরে যেত আঙুল পর্যন- লম্বা হাতা কবজি পর্যন- খাটো হয়ে যেত। এই রকম পাঞ্জাবীর হাতা কুঁচি করা ছিল সে সময়ের অত্যন- উচু মানের এরিস্ট্রোক্রেসি।

কলকাতায় আমরা আসার পর থেকেই মা যে কেবল আমার ইংরেজী পড়ায় উৎসাহিত ছিলেন, তাই না, আব্বাও আমার পড়াশুনার ব্যাপারে অন্যভাবে প্রভাব সৃষ্টি করতেন। তিনি অফিস থেকে ফেরার পথে প্রায়ই কলকাতার শীর্ষ ইংরেজী দৈনিক ‘দি স্টেটসম্যান’ ও করাচির শীর্ষ দৈনিক ‘দি ডন’ পত্রিকার আগের দিনের একটি করে কপি সাথে করে নিয়ে আসতেন।
আব্বার অফিসের সময়সূচী ছিল সকাল সাড়ে সাতটা থেকে দুইটা। আব্বা আড়াইটার দিকে বাসায় ফিরে গোছল-খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে আমাকে ডাকতেন। তারপর কাগজ দুটির কোন একটাতে দাগ দিয়ে রাখা উপসম্পাদকীয় দেখিয়ে বলতেন, ‘এখন আমি ইংরেজী বুঝবো না। তুমি এটা জোরে জোরে পড় আর পড়ে আমাকে বাংলা করে বোঝাও।’
আজ বুঝতে পারি, জোরে জোরে পড়ার মাধ্যমে আমার ইংরেজী উ”চারণ ঠিক হ”েছ কি না সেটা তিনি খেয়াল করতেন, আমি উ”চারণে কোন ভুল করলে ধরিয়ে দিতেন। এভাবেই নিয়মিত অনুবাদ করার মাধ্যমে আমার মনে প্রতিদিনই নতুন-নতুন ইংরেজি শব্দ আর তার অর্থ মনে মধ্যে গেঁথে যেতে লাগলো। সেই সাথে শব্দগুলোর নিয়মিত ব্যবহারের বিষয়টার দিকেও আব্বা নজর রাখতেন।
সবগুলো শব্দের অর্থ আমি জানতাম না, বলাই বাহুল্য, সেই জন্যে পাশে ইংরেজী-বাংলা শব্দকোষও রাখতেন। শব্দের অর্থ তিনি জানলেও বলে দিতেন না। এই করে প্রয়োজন হলেই, সাথে সাথে শব্দকোষ ঘাটার অভ্যাসও আমার গড়ে উঠেছিল। ফলে ইংরেজী ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাটার ওপরও ধীরে ধীরে দখল তৈরী হতে থাকলো আমার মধ্যে।
আব্বা খুব ভোরে উঠে নামাজ পড়তেন। তারপর বাড়ির সামনের রাস-ায় কিছুক্ষণ পায়চারী করতেন। তারপর বাসায় ফিরে নাস-া খেয়ে বাজারে যেতেন। বাজার থেকে ফিরে গোসল করে অফিসে যেতেন।
একদিন বাজার থেকে ফিরে আব্বা মাকে বললেন, ‘জানো কাজলের মা, (বড় আপার ডাক নাম ছিল কাজল, বড় ভাইয়ের ডাক নাম ছিল বাবুল) যখন লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে বাজার থেকে ঘামতে ঘামতে দুই হাতে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়ে বাসায় আসি তখন পাড়ার অনেকের সাথে দেখা হয়, বলে, রহমান সাহেব বুঝি বাজার থেকে আসলেন। অথচ যখন স্যুটেড-বুটেড হয়ে টাই ঝুলিয়ে সেজেগুজে অফিসে যাই কিংবা অফিস থেকে ফিরি তখন কোন ব্যাটার সাথে দেখা হয় না।’

Leave a Reply