৮ সমরখন্দ
১
বাবরের অভিপ্রায় ছিল শয়বানী খানের আগেই সমরখন্দের সিংহাসন থেকে সুলতান আলিকে বিতাড়িত করা। সুলতান আলিকে কেউই দেখতে পারত না।
অপদার্থ- বুস্তান-সরাই মহলের আনাচেকানাচে একথাই কানাকানি করে বলত সবাই। তরুণ শাসকের বিশ্বস্ত ও অন্তরঙ্গ বেগ আবু ইউসুফ আর্গুন যে সুলতান আলির হারেমে নতুন নতুন সুন্দরী-বন্দিনীর যোগান দেয় সেও তার ওপর আশা ছেড়ে দিয়েছে। খোলা মর্মর পাথরের জলাধারসমেত হামামের অনতিদূরে এক নিরালা কক্ষে বসে রাজকার্য ও পরিবারের বিভিন্ন সমস্যার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ভালবাসে সে। কক্ষের দেওয়ালে একটি বিশেষ ধরণের জানলা আছে যা বাইরে থেকে দেখা যায় না (জানলাটি তৈরী হয়ে ছিল সুলতান মাহ্মুদের সময়ে) সেই জানলা দিয়ে আঠারবয়সী লম্পট নগ্ন মেয়েদের জলে আছাড়ি পিছাড়ি খাওয়ার দৃশ্য উপভোগ করতে করতে সুরাপান করে আর প্রত্যাশায় থাকে শুধুমাত্র দর্শনসুখের নয় আরো কিছুরও।
এবারও ছেলের সুবুদ্ধি জাগাতে ব্যর্থ চেষ্টা করল জোহরা বেগম। সুরা আর লালসায় ওর বুুদ্ধি একেবারে লোপ পেয়ে গেছে।
বিড়বিড় করে সুলতান আলি বলল, ‘কী?… আবার ঘেরাও? ও এখনও হয় নি ঘেরাও… ষড়যন্ত্রকারীরা বাবরের সামনে সমরখন্দের দরওয়াজা খুলে দেবে? আর আমার পীর খাজা ইয়াহিয়া তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন?… বেশ, বেশ, দিক…. নেতা…..বাবরকে ঢুকতে দেব শহরে আর দুর্গেও, তারপর ওকে ধরে জ্বালিয়ে দেব ওর চোখগুলো- জ্বলা… জ্বলন্ত শলা দিয়ে… লোহার ডান্ডা দিয়ে। হা-হা-হা…’
প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গেল জোহরা বেগম।
সে মনে প্রাণে বিরোধী সমরখন্দ বাবরের হাতে তুলে দেওয়ার। তার আদেশেই বাবরের ভক্ত ষড়যন্ত্রকারীদের ধ্বংস করা হয়েছে। তার পরামর্শেই প্রতিরক্ষায় নিযুক্ত লোকরা বাবরের সৈন্যদের অগ্রগামী দলটিকে ভুলিয়ে নিয়ে এসে বিপদে ফেলেছে, কিন’ বাবরের মূল সৈন্যদল বা তার বাবর নামকে তো আর সে পরাস্ত করতে পারবে না: সর্বনাশ হলো সমরখন্দের আর তার অপদার্থ সন্তান সুলতান আলিও।
‘হায় আল্লাহ্ কোথা থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে?’
নিজের মহলে এসে জোহরা বেগম উজ্জ্বল আলোকিত কক্ষগুলির মধ্যে ছটফট করে বেড়াতে লাগল। রাত্রি ভোর হওয়া পর্যন্ত ঘুমোতে পারল না সে।
আপাততঃ বিপজ্জনক ঘটনাবলীর সম্বন্ধে সতর্ক করে দেওয়া গেছে ভাবল সে, বন্দী করা হয়েছে সেই ষড়যন্ত্রকারীদের, যারা গত অবরোধের সময় থেকেই বাবরের প্রতি অনুরক্ত- এ ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত অনুমতি আদায় করা গেছে আধামাতাল সুলতান আলির কাছে। তাহলেও শহরে ক্রমশই কমে যাচ্ছে জোহরা বেগমের বিশ্বস্ত লোকের সংখ্যা। ষড়যন্ত্রকারী বেগদের ধনসম্পত্তি লুঠপাট করা হবে আর বেগদের কঠিন শাসি- দেওয়া হবে, এতে… সুলতান আলি আর তার প্রতি বিক্ষুব্ধ লোকেরা সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে। আর খাজা ইয়াহিয়া এত প্রভাবশালী যে তার সঙ্গে কোন খারাপ ব্যবহার করা সম্ভব নয়।
জোহরা বেগমের চিন্তাধারায় বারবারই ঘুরে ফিরে আসছে শয়বানী খান। সুখী, সফল মানুষ। সুযোগের অপেক্ষা করেছে, শক্তিশালী সৈন্যদল গড়ে তুলেছে, সমপ্রতি অতি সহজেই বুখারা দখল করেছে। এবার যে-কোন মুহূর্তে এগিয়ে আসতে পারে সমরখন্দের দিকে। ইমানদার মুসলমান আর প্রকৃত যোদ্ধাও। তিনদিন আগে এক নকশবন্দিয়া দরবেশ গোপনে জোহরা বেগমকে এনে দিয়েছে শয়বানী খানের পত্র।
পর্দার আড়ালে লুকানো এক বিশেষ ধরণের কুলুঙ্গীতে রাখা সোনার ছোট্ট একটি বাক্স খুললো চাবি দিয়ে, বার করলো সেই পাত্রটি, বাতির আলোয় আরো একবার পড়তে আরম্ভ করলো।
মধুরংয়ের পাতলা কড়মড়ে কাগজে সুন্দর হস্তাক্ষরে কবিত্বময় সূক্ষ্ম ভাষায় যাযাবর খান বুদ্ধি ও সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছে, বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছে যে তার বয়স এখনও অল্প হওয়া সত্ত্বেও আবার বিবাহের সম্ভাবনার কথা ভাবে নি, সন্তানের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছে। কিন’ পত্রে সবচেয়ে যে জাদুকরা অংশ হলো জোহরা বেগমের প্রতি প্রেমনিবেদন আর ইঙ্গিত যে তাকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক সে; তা না হ’লে এমন বয়াৎ লিখেছে কেন-
তোমার ঠোঁটের পরে আমার নিশ্বাস খেলে, ওগো মহীয়সী,
তোমার যে ছেলে, শোনো আমারও সেই তো ছেলে, ওগো মহীয়সী।
জোহরা বেগমের মনে হল মুখের ওপর যেন এক শক্তিশালী পুরুষের গরম নিঃশ্বাস পড়ল। ছ’বছরের একাকী জীবন, সুদীর্ঘ ছয়টা বছর। সুন্দর ফুল, বৃথা ঝরে যাচ্ছে। বিবাহ করতে চাইতো যদি সে তাহলে দেহে মনে শক্তিশালী, খ্যাতিমান, ধনী অনেক পাণিপ্রার্থীই এসে উপসি’ত হতো। সুলতান মাহ্মুদের প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর অপূর্ব রূপের খ্যাতি যে ছড়িয়ে পড়েছিল চতুর্দিকে। কিন’ বিধবাজীবন কাটাতে হচ্ছে তাকে এই কারণে যে নিজে সে অভিজাতবংশের মেয়ে, স্বামী-পুত্র সিংহাসনের অধিকারী, দ্বিতীয়বার বিবাহ সে করতে পারে কেবল কোন দেশের শাসককেই, এমনই প্রথা।
আর তার কাছে গোপনে বিবাহপ্রস্তাব করেছে যে শয়বানী খান সেও তো সিংহাসনের অধিকারী? আবার পড়ল জোহরা বেগম, আর হঠাৎ এমন উত্তেজিত হয়ে উঠল যেন সত্যি কেউ তাকে আলিঙ্গন করে প্রেমমুগ্ধ স্বরে ফিসফিস করে বলল, আমার সুন্দরী প্রেমিকা!
উঠে দাঁড়ালো বেগম, আয়নার দিকে এগিয়ে গেল। বিনিদ্র রাত কাটাবার ফলে চোখের নীচে নীলচে ছাপ। কিন’ ভ্রুজোড়া যেন দোয়েল পাখির দুটি পাখা। কালো চোখে আছে ঝলক। মসৃণ, শ্বেতমর্মর গ্রীবা, ওষ্ঠদ্বয় কামনায় অধীর।
শয়বানী খানের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি তা ঠিক, তার স্ত্রীপুত্র আছে তাও জানে জোহরা বেগম। আরে ঐ সে-পের মেয়েগুলো আমার কাছে কোথায় লাগে। খানের মাথা এমন ঘুরিয়ে দেব যে ওরা সবাই আমার বশ মানবে!
কাল আসবে সেই নকশবন্দিয়া দরবেশ বেগমের উত্তর জানবার জন্য।
কাগজ-কলম নিয়ে বসল বেগম।
বাতিদানের বাতিগুলো অনেক আগেই নিভে গেছে, তখনি কেবল বেগম লক্ষ্য করলো যে ঘর ভরে গেছে ভোরের আলোয়। জানলায় নীল মখমলের পর্দা সরিয়ে দিয়ে জোহরা বেগম মুখ রাখল ভোরের ঠান্ডা বাতাসের সামনে।
হঠাৎ দুর্গের কাছের রাস্তা থেকে শোনা গেল পুরুষকণ্ঠের মর্মভেদী চীৎকার, তারপরেই শোনা গেল আবার এক নারীকণ্ঠের চীৎকার।
আবু ইউসুফ ও তার ছেলের পক্ষের অন্যান্য লোকরা ষড়যন্ত্রকারী বেগদের খুঁজে তাদের বাড়ীঘর লুঠ করছে। কল্পনায় দেখলো জোহরা মারা পড়ছে। ধূর্ত, অবিশ্বাসী সব, ওদের চাই বাবরকে। আর তার নিজের চাই- শয়বানীকে। কিন’ যদি শয়বানী খানের এই প্রেমনিবেদনও ধূর্ত ছলমাত্র হয়, তবে? সে সমরখন্দ দখল করবে, তখন জোহরা বেগমের জীবনে নেমে আসবে ঐ মেয়েটির মত দুর্ভাগ্য যার মর্মবিদারী কান্না সে শুনেছে মাঝরাতে?
উঃ কী ভয়ংকর, কেঁপে উঠল সারা শরীর। আবার হাতে তুলে নিল শয়বানী খানের চিঠিটা, তাতে যেন তার এই ভয়ের বিরুদ্ধে যুক্তি হিসাবেই আরো দুটি পংক্তি যোগ করা হয়েছে:
তুমি ছাড়া সমরখন্দ নিয়ে আর কি হবে আমার, সুন্দরী?
দিল ছাড়া মরদেহে কবে কার কী হবে আর, সুন্দরী?
স্বামীছাড়া কেবল সমরখন্দ তারই বা কী কাজে লাগবে? এমন স্বামী চাই যে হবে প্রকৃত শাসক। যদি শক্তিমান, জীবনীশক্তিপূর্ণ শয়বানী খান না আসে সমরখন্দে আর তার শূণ্যপ্রাণে ভালবাসার আগুন না জ্বালায় তো সমরখন্দ হয়ে দাঁড়াবে কেবলমাত্র এক শূন্য অসি-ত্ব, মরদেহ।
আবার কামনার আবেশে শিউরে উঠল জোহরা বেগম। কাগজ-কলম নিয়ে খানকে পত্র লিখতে আরম্ভ করল। আরম্ভ করতে হবে প্রশংসায় আকাশে তুলে দিয়ে,
শরীফ ইমাম, খালিফা, আমির-উল্মুমিনিন, খোদার ইচ্ছাকে রূপ দেন যিনি…
সমরখন্দের প্রথম প্রাচীরের ভিতরে, প্রশস্ত বাগানগুলিতে,উলুগ বেগের মানমন্দিরের কাছের টিলাগুলোতে, আবে রহমত নদীর দু’তীরে- সর্বত্র বিরাট অসংখ্য সৈন্যদল ঘাঁটি গেড়েছে। চোপান-আতা পাহাড়ের নীচে আর দূরে জরাফ শান নদীর দু’তীরে বরাবরও সেই সৈন্যদলেরই অসংখ্য ছাউনি পড়েছে।
আমির-উল্-মুমিনিন, এই সৈন্যদলের অধিনায়ক শয়বানী খান জায়গা নিয়েছে চমৎকার, প্রখ্যাত বাগি ময়দানে উলুগ বেগের পরিকল্পনায় নির্মিত প্রখ্যাত চালিশাতুন মহলে। মহলের দ্বিতলে চারদিকে বারান্দা পরিবেষ্টিত এক প্রশস্ত কক্ষ। সেখানে দ্বিপ্রহরের নমাজের পর সুসজ্জিত উঁচু বেদীর উপর বসে আছে শক্তিশালী ও ভয়ঙ্কর শয়বানী খান।
খবর এলো সুলতান আলি তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে এসেছে শক্তিশালী ভয়ঙ্কর খানের সঙ্গে দেখা করতে। খানের ছোট ছোট চোখগুলি, যা দেখলে তার শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় না মোটেই, জ্বলে উঠল।
‘প্রথমে আমাদের সুলতানদের ডাক। তারপর সমরখন্দের মির্জাকে এখানে নিয়ে আসবে।’
‘কিন’ আপনার তখ্ত যে নীচে, জাঁহাপনা!’
‘আমার জায়নামাজ যে-কোন তখ্তেরও উপরে।’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়! জাঁহাপনা!’
উটের লোম দিয়ে তৈরী হালকা খয়েরী রংয়ের নরম গালিচাটির একেবারে এক প্রানে- বসলো শয়বানী খান ইচ্ছা করেই।
যখন সুলতান আলিকে ভিতরে ঢুকতে অনুমতি দেওয়া হল তখন তার চোখে প্রথমেই যা পড়ল তা হল ভয়ংকর খানের বসে থাকার নম্র ভঙ্গী। উঁচু আসনে বসে আছে সে, আর নীচে আরাম করে পা গুটিয়ে বসে আছে তার সুলতানেরা, জনদশেক হবে। তাদের পোশাক আশাক তাদের বাদশাহের মত অতটা জাঁকহীন নয়। শয়বানী খানের পোশাকে কোন অলঙ্করণই নেই। এদিকে সুলতান আলির উষ্ণীষে ঝলক দিচ্ছে মণিমাণিক্য, সোনার জরি ও মুক্তা সেলাই করা তার পোশাকে।
আঠার বছর বয়সী মির্জার অসি’র চোখগুলি এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলো। বয়সের অনুপযুক্ত স্থূল, গোলাকার দেহে মেয়েলি দুর্বলতা ফুটে বের হচ্ছেছ। মা আর আবু ইউসুফ আর্শুনের পরামর্শেই সৈন্যদলকে কেল্লার মধ্যে রেখে সে এখানে এসেছে। কী বিশাল শক্তিশালী সৈন্যদল নিয়ে শয়বানী খান সমরখন্দের দিকে এগিয়েছে তা বুঝেছে সুলতান আলি, তাই ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল সে।
সে কোথা থেকে জানবে যে আবু ইউসুফ বহুদিনই হাত মিলিয়েছে শয়বানী খানের সঙ্গে এবং তার প্রত্যক্ষ নির্দেশ অনুযায়ীই সে সুলতান আলিকে পরামর্শ দিয়েছে খানের কাছে আসার জন্য? আজ দ্বিপ্রহরের আহারপর্বের সময় সে অপদার্থকে বেশ ভাল করে পান করিয়েছে মাইনব সুরা, তাই এখন সুলতান আলি অভিবাদনের ভঙ্গীতে অল্প নীচু হতেই মাথাটা ঘুরে উঠলো তার। স্থূল বিশালকায় দেহ টলে উঠল, আবু ইউসুফ তাকে ধরে না ফেললে সে গালিচার উপরেই গড়িয়ে পড়তো।
শয়বানী খান উঠে দাঁড়ালো মির্জাকে অভিবাদন জানাবার জন্য। মুখে এসে লাগলো মাইনবের গন্ধ, আরে এ দেখি মাতাল, মাতাল হয়ে এখানে আসার সাহস পায়! শয়বানী ইঙ্গিতে আদেশ দিল খানে ছেলে তৈমুর সুলতান আর জামাই জানি বেগের নীচে বসাতে সুলতান আলিকে।
সুলতান আলির মন ভরে উঠল খানের প্রতি শ্রদ্ধায়।
লাল রংয়ের পশুলোমের মস্তকাবরণের ওপরে সাদা উষ্ণীব পরেছে শয়বানী, নীল বনাত কাপড়ের, ছোট হাতা হালকা চোগার বুকে সোনার বোতাম আঁটা, তার নীচে দেখা যাচ্ছে সবুজ রংয়ের পোশাক- সবুজ রং পয়গম্বরের রং, ইসলামী ঝান্ডার রং। আর বসার আসনটাও- সে-পের লোকটা দেখছি বেশ ধার্মিক, ভাবল সুলতান আলি। কিন’ সমরখন্দের শাসক সুলতান আলিকে যে অন্যান্য অনেকের- যারা তেমন অভিজাত নন- তাদেরও নীচে আসন দেওয়া হয়েছে, সেটা… আচ্ছা! সুলতান আলি ইচ্ছা করেই অবহেলাভরে অন্যান্য সুলতানের চোখের সামনে কোনরকমে পা মুড়ে বসল। শয়বানী খানের ছেলে তৈমুর সুলতান বিরক্তিভরে তাকালো পাশে উপবিষ্ট সুলতান আলির দিকে।
‘মির্জা, আপনি আমার সন্তানের মত আপন হতে চান?’ মিষ্টিস্বরে শয়বানী খান জিজ্ঞাসা করল সমরখন্দের শাসককে।
‘গাজী খলিফা, আমরা আপনার আমন্ত্রণ পেয়েছি, সন্ধিচুক্তি করার জন্য…’
‘আপনার ওয়ালিদা সাহেবা আপনার সঙ্গে আসেন নি নাকি?’
‘ওয়ালিদা সাহেবা আমাকে পাঠিয়েছেন,’ অকপট উত্তর দিল সুলতান আলি, অসতর্কভাবে তার ক্ষমতার সীমা প্রকাশ করে দিল এইভাবে।
‘কিন’ তার আসার কথা ছিল তো….’
‘আরে মেয়েরা… যুদ্ধ শানি-র ব্যাপার কিছু বোঝে না,’ ভুল শোধরাবার চেষ্টা করল সুলতান আলি আনাড়ীভাবে।
‘না, না, আপনি তার জন্য লোক পাঠান, মির্জা,’ বললো খান মিষ্টিসুরে, কিন’ এমনভাবে যা অমান্য করা যায় না।
সুলতান আলি তাকালো কাছেই হাঁটুগেড়ে বসে থাকা আবু ইউসুফের দিকে। আবু ইউসুফ ক্ষিপ্রগতিতে উঠে দাঁড়ালো, শয়বানী খানকে কুর্ণিশ করে বলল, ‘আজিম গাজী, আদেশ করুন অবিলম্বে জোহরা বেগমকে আনতে যাবার জন্য।’
মিষ্টি হেসে আবু ইউসুফের দিকে তাকাল শয়বানী খান, ‘আমার সবচেয়ে উমদা ঘোড়াগুলির একটি আপনার, বেগ।’
‘ধন্যবাদ, জাঁহাপনা।’
‘বেগ শহরে যাবেন,’ হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বলল সুলতান আলি, ‘খাজা ইয়াহিয়াকে জানাবেন আমাদের আদেশ। যেখানে আমি সুলতান আলি মির্জা হাজির রয়েছি যদি তিনি সেখানে না আসেন, তো আমাদের মধ্যে সন্ধি হবে না।’
‘আপনার মুখ দিয়ে সত্য কথাই বেরিয়েছে, বাদশাহ সালামত,’ কিঞ্চিৎ অনুকম্পার সুরে বলল আবু ইউসুফ, তারপর রওনা দিল হুজুরদের আদেশ পালন করার জন্য। শয়বানী খান নিজের সুলতানদের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি হানল।
‘আপনারা ততক্ষণ আলাপ করুন মির্জার সঙ্গে’, বলে পিছনদিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে নীচে নেমে গেল।
সুলতান আলি চোখ বুলিয়ে নিল সব সুলতানদের ওপর- তাদের মুখে কেবল শত্রুতার ছাপ। এদের মাঝে বসে থাকার কোন মানে হয় না বুঝে সুলতান আলি উঠে পাশের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তখুনি তুর্কীস্তানের একজন সুলতান লাফিয়ে উঠে তার পথরোধ করে দাঁড়ালো, ‘আপনি এখন আমাদের কাছ থেকে কোথাও যেতে পারবেন না, মির্জা, এই হুকুম।’
বিশাল চেহারার এক সেপাই, মস্ত হাতের মুঠিটা তরবারির হাতলে রেখে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। এতক্ষণে সুলতান আলি বুঝল সে ফাঁদে পড়েছে। মুহূর্তে নেশা ছুটে গেল তার। মলিনমুখে সে এসে আবার আগের জায়গায় বসলো।
কয়েক ঘন্টা বাদে চারজন বাঁদী সমেত জোহরা বেগম বাগি ময়দানে এসে উপসি’ত হলো। মাথায় বিশেষভাবে বাঁধা সাদা রেশমী রুমাল ও কপালে অর্ধচন্দ্রাকারের স্বর্ণালঙ্কার পরায় তাকে দেখাচ্ছিল বিবাহবাসরের কনেবধুর মত। সাধারণত অভিজাত মহিলারা যেমন পরে থাকেন তেমনি লম্বা হাতাওয়ালা ফুলতোলা কামিজ এঁটে বসেছে তার স্থূল কিন’ নমনীয় দেহে। সাদা রেশমী পোশাকের প্রান্ত কামিজের নীচ থেকে এসে মাটিতে পড়েছে, দু’দিক থেকে দু’জন বাঁদী সেই প্রান্ত তুলে ধরে আছে।
জোহরা বেগমকে নিয়ে আসা হলো এই উপলক্ষ্যে বিশেষভাবে সাজানো গোছানো একটি বড়ঘরে। শয়বানী খানের জ্যেষ্ঠা বেগম যার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, লক্ষ্য করল তাকে।
‘কী বেহায়া রে!’ ফিসফিসিয়ে বলল সে পাশে বসা তরুণী বেগমকে। ‘কেমন দেখলি? পুরুষমানুষের জন্য আঁকুপাঁকু করছে, লজ্জাশরম বিসর্জন দিয়ে কনেবধু সেজেছে।… অপেক্ষা করবি তো যে ঘটকীরা এসে কথা পাড়বে, সব কিছু যেমন যেমন হওয়া দরকার হবে।… এমন লজ্জার হাতে থেকে খোদা আমাদের রক্ষা করুন।
যখন জোহরা বেগম দরবারকক্ষে এসে ঢুকল, শয়বানী তার কয়েকজন অনুচর নিয়ে সেখানেই ছিলো। নত হয়ে খানকে কুর্ণিশ করলো বেগম এই প্রত্যাশায় যে খান তখ্ত থেকে গালিচার ফালির ওপর নেমে এসে তাকে অভ্যর্থনা জানাবে। কিন’ খান যেন তার সোনার তখ্তের মধ্যে আটকে গেছে, সেখান থেকেই সংযত স্বরে বলল, ‘খোদা আমদেদ, বেগম।’
জোহরা প্রত্যাশা করেছিল অন্যরকম অভ্যর্থনা। কেমন চুপসে গেল সে হঠাৎ, চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল তার।
‘হুজুরে আলি, খলিফা, নিজেকে আমি তুলে দিতে এসেছি আপনার হাতে! আমার সন্তান, আমার মর্যাদা, সম্মান-সব সব আপনার হাতে তুলে দিয়েছি। …. বিশ্বাস করেছি আপনার মহত্ত্বকে… আপনার চিঠিতে…’
মোটা সাদা রেশমীকাপড় দিয়ে জোহরা বেগমের মুখ ঢাকা। দেখা যাচ্ছে না মুখ। খান তাকাল তার হাতের দিকে, আঙুলগুলি সোনার আংটি আর দামী পাথরের ভারে ঝুলে পড়েছে, হাতের ধমনীগুলি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, যথেষ্ট বয়স হয়েছে বেগমের- কী আর করা যাবে। এই তো আর খানের উনিশবছর বয়সী তরুণী স্ত্রী নয়, যাকে সমপ্রতি লাভ করেছেন বুখারাতে।
শয়বানীর মনে পড়ল জোহরা বেগমের পুত্রসন্তান, সুলতান আলি, যাকে তার সুলতানরা প্রাসাদের অন্য অংশে নিয়ে গিয়ে শায়েস্তা করছে, তারই বয়স হল আঠার বছর।
‘চিন্তা করবেন না বেগম,’ শান্তস্বরে বলল খান, ‘আমাদের জানা আছে আপনার গোপন স্বপ্নের কথা। খোদার মর্জি হলে আপনার ইচ্ছা অপূর্ণ থাকবে না।’
কেবল এইটুকুই শুনতে পেল সে। জোহরা বেগম আর তার চারজন বাঁদীকে একটা ছোট ঘর ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে দেওয়া হল।
৩
সমরখন্দবাসীদের নিয়ে শয়বানী খান কী করবে তা কেউ জানে না, কিন’ সিপাহসালাররা আর শয়বানীর অনুচরেরা বুঝতে পারছিল যে এমন কতকগুলি ঘটনা পেকে উঠেছে যার গুরুত্ব খুব কম নয়। তাই তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে চালিশাতুন মহলের চারদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগলো।
তাদের মধ্যে মুহম্মদ সালেহ্ নামে এক মায়েরও ছিলেন। তার মাথায় সূক্ষ্ম ভাঁজ দেওয়া উষ্ণীষ। ছোটহাতা রেশমী কামিজে বেশ দেখাচ্ছে তাকে। অনবরত যুদ্ধের ফলে রুক্ষ হয়ে উঠেছে সে-পের সুলতানরা, তেলপেক মাথাছাড়া করে না কখনও, না শীতে, না গ্রীষ্মে। ওরা এই শায়েরকে ভাল চোখে দেখে না, একে লেখাপড়া জানা তায় আবার পোশাকে আশাকে সুরুচির ছাপ। সুযোগ পেলেই খোঁটা দেয়, এই ফুলবাবু কবিটি এক সময় ভয়ঙ্কর তৈমুর লঙের অকর্মণ্য বংশধরদের, সমরখন্দের বাদশাহদের খিদমত করত।
নয়মান গোষ্ঠীর প্রধান কামবারনি বিদ্রুপ করে মুহম্মদ সালেহকে বলল, ‘এই যে আমাদের তফাদার দোস্ত শায়ের সাহেব! আপনার প্রিয় ঢঙী মা তার ছেলেকে নিয়ে এসে পৌঁছেছে সমরখন্দ থেকে। সমরখন্দের আত্মীয়াকে কাছে পেয়ে আপনি খুসি তো?’
‘কামবারনি সাহেব, জানবেন জোহরা বেগমের জন্ম নয়মান উপজাতির বংশে, তাই তাকে আপনারই আত্মীয় বলা উচিত।’
মানগিত, কুনগ্রাত, কুশ্চি উপজাতিগুলির সুলতানরা এই শুনে হা-হা করে হেসে উঠল।
নয়মান কিপচাকদের এই নেতার বড় নাক উঁচু ভাব। খালি নিজের উপজাতির লোকদের বলে উজবেক।
প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হল কামবারনি, ‘আপনি আর আত্মীয় নিয়ে কথা বলবেন না… আপনি কি বার্লাস তুর্কী বংশের নন?’
শয়বানী খানের সবচেয়ে বেশী ঘৃণা বার্লাস উপজাতির প্রতি, যে উপজাতির বংশে তৈমুরের জন্ম। মুহম্মদ সালেহ্ কাজ করেছেন হুসেন বাইকারার প্রাসাদে, সুলতান আলি মির্জার অন্তরঙ্গ ছিলেন, তারপর এসে যোগ দিয়েছেন শয়বানীর দলে। কিছু গোপন কথা বলেছেন তাকে, বুখারা আর দুরুসিয়ার দুর্গদুটি জয় করতে সাহায্য করেছেন, এইভাবে খানের প্রিয়পাত্র হয়েছেন। কিন’ কামবারনি যে মুহম্মদ সালেহকে বিশ্বাসের অযোগ্য মনে করে ঘৃণা করে তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিকও নয়।
কবি ঠাট্টা করে ব্যাপারটা হালকা করে দিতে চাইলো, ‘আরে ভাই কামবারনি, এখন আমি- উজবেক তুর্কী।’
‘চালাকি করবেন না। উজবেক হল এক কথা, আর তুর্ক একেবারে অন্য ব্যাপার।’
‘তা কেন? সমস্ত উজবেক উপজাতিই আছে মাভেরন্নহরের তুর্কদের মধ্যে।’
‘কিন’ আমরা আজীম উজবেক খানের বংশধর। আর শায়ের, আপনি হলে সার্ত, ঐ… শহরের নীচুমানের ঐ ওদের বংশধর। সেকথা ভুলে যাবেন না।…’
কামবারনি সাহেব, আমার পূর্বপুরুষরা বাস করতেন তুর্কীস্তান শহরে, উজবেকদের একটা প্রবাদ আছে, পিতৃভূমি- তুর্কীস্তান। আছে কিনা এমন প্রবাদ?’
‘তা আছে। থাকলেই বা কি?’
‘আপনার পিতৃভূমি যখন তুর্কীস্তান, তখন আপনার পূর্বপুরুষ আমার পূর্বপুরুষের উৎপত্তি একই শিকড় থেকে। আপনি কামবারনি সাহেব কোন বিচ্ছিন্ন শাখা দেখে বিচার করবেন না, গাছের মূল দেখুন। তাহলে দেখবেন যে উজবেক খান ছিলেন দু’শ বছর আগে আর আমাদের তুর্কীস্তান আছে হাজার বছর ধরে, উজবেক খানেরও আগে থেকে। উজবেক নামেরও আমাদের মধ্যে প্রচলন ছিল উজবেক খানেরও অনেক আগে থাকতে।’
বললেই হল আর কি! বিশ্বাস করল না কামবারনি।
‘সত্যি, বিশ্বাস করুন। আমি বড় হয়ে উঠেছি খরেজমে, অনেক প্রাচীন বই পড়েছি… আপনি তো সহ্য করতে পারেন না বইপত্র… জানেন, খরেজম শাহ্ মুহম্মদ, ঐ যে যিনি চেঙ্গিজ খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, তিনি তার এক পুত্রের নাম দিয়েছিলেন উজবেক? তিনি যখন পুত্রকে ঐ নাম দিয়েছিলেন তার মানে সেই কবে থেকেই এই নামের আদর হয়ে আসছে। আর জানেন, এ নামের মানে কি? উজবেক মানে- নিজেই নিজের মালিক, স্বনির্ভর। আমাদের গাজী খলিফা শয়বানী খানের নেতৃত্বে উপজাতিগুলি নিজেদের যে উজবেক বলে তার কারণ এই নয় যে উজবেক খান নিজেকে এই নামে জাহির করতো অথবা তারও আগে খরেজম শাহের পুত্রের নাম তাই ছিলো। বরং ঠিক তার উল্টো, তারা ঐ চমৎকার নাম নিয়েছিলো তুর্কীদের কাছ থেকে।
‘যথেষ্ট হয়েছে। আবার তুর্কীদের দিক টেনে কথা বলছে। সুলতানদের পিতৃভূমি তুর্কীস্তান। আর তুর্কীস্তান কথার মানে হল তুর্কীদের দেশ।’
‘হায় আল্লাহ্্ এ কবি এবার আমাদের রুমের তুর্কীদের বংশধর বলে না বসে।’
‘না, না কামবারনি সাহেব, সুলতানরা, তা’ করব না আমি। রুমের তুর্কীদের … নিজস্ব ইতিহাস আছে। মাভেরান্নহরে তুর্কীরা আনাতোলির রুমের আবির্ভাবের বহুদিন আগে থেকেই বাস করত এই উপত্যকাগুলিতে ‘শাহনামা’ পড়লে দেখতে পাবেন… কবি ফিরদৌসী বলছেন, হাজার বছর আগে দক্ষিণ দিকে খোরাসান থেকে বিস্তৃত ছিল যে দেশ তাকে বলা হতো ইরান, আর খোরাসানের এদিকে, উত্তরের দিকে বিস্তৃত দেশকে বলা হত তুরান… আমাদের বাদশাহ শয়বানী খান ইতিহাস ভালো করেই জানেন। বুখারার মাদ্রাসাতে লেখাপড়া শেখার সময়েই আমাদের ইমাম সাহবের মুখস্ত ছিল নবাই আর লুৎফির কবিতা, নিজে লিখেছেন গজল তুর্কী ভাষায়। শুনবেন?’
সাদাসিধে সুলতানদের শুনতে হল কুটিল শায়েরের শায়েরী।
‘বিরহের ঘোড়া দিল মোরে, পিয়ারী এসেছে দরদী হয়ে,
শয়বানী ভালো হয়ে ওঠে ওরে, পিয়ারী এসেছে দরদী হয়ে।’
‘আমাদের খানের এ কবিতা তুর্কভাষায় নয়, উজবেক ভাষায়।’ কামবারনি কিছুতেই হার স্বীকার করতে চায় না।
‘সব তুর্কী কবিই এই ভাষায় কবিতা লিখেছেন। নবাইয়ের তুর্কভাষা আর শয়বানী খানের উজবেক ভাষা একাই ভাষা। এখন আমাদের মনপ্রাণও এক হওয়া দরকার, সুলতান সাহেবরা। তৈমুরের বংশধররা বলত ঐ ওরা করেছিল, জনগণের মধ্যে বিভেদ এনেছিল। এবার আমাদের ইমাম সাহেব, খলিফা, দ্বিতীয় ইস্কান্দার, আবার আমাদের সবাইকে একত্রিত করবেন। এই মহান কাজে সফল হোন আমাদের খান।’
তর্কযুদ্ধের এখানেই সমাপ্তি হল। গর্বিতভাবে মাথা উঁচু করে সেখান থেকে চলে গেলেন কবি।
কুশচি উপজাতির নেতা কুপাইবি কামবারানির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখেছ, সার্তের ব্যাটারা কেমন ধরনের? কথায় কাবু করতে পারবে না ওদের।’
‘কথায় না হলে তলোয়ার দিয়ে কাবু করবো, ইচ্ছে করে শুনিয়ে জোরে জোরে বলল কামবরনি।
সুলতানরা হেসে উঠল সবাই।
৪
সন্ধ্যার মুখে পাঁচ-ছ’জন মুরিদসমেত খাজা ইয়াহিয়া এসে পৌঁছলেন সমরখন্দ থেকে, ইনিই হলেন শেষ ব্যক্তি যার অপেক্ষায় ছিল শয়বানী খান নিজের পরিকল্পনামত কাজ আরম্ভ করার জন্য।
ঘোড়া থেকে নামবার সময় একটু বেশী তাড়াহুড়ো করছিলেন তার ফলে রেকাবের চামড়ার অংশে পা জড়িয়ে গেল। মুরিদরা সাহায্য করল তাদের পীরকে মাটিতে নামতে…
সাদা জমকালো উষ্ণীষ, পীরেদের হাল্কা, সুন্দর পোশক সাকারলত পরবে খাজা ইয়াহিয়া যেন আত্মমার্যাদার প্রতিমূর্তি, সিংহাসনে উপবিষ্ট শয়বানী খানের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি সামান্য মাথা নীচু করে। কোরান পড়তে অভ্যস্ত মিষ্টি সুরেলা গলায় ভারিক্কি ভাবে বললেন, ‘আসসালাম আলেইকুম, বাহাদুর খান! সমরখন্দের দরওয়াজা খোলা আপনার সামনে…’
শয়বানী তাকে বাধা দিয়ে বিদ্রুপ করে বলল, ‘আপনি খুলে দিয়েছেন সমরখন্দের দরওয়াজা? স্রেফ খোদাতাল্লার মর্জিতেই সব কাজ হয়।
‘খোদার ইচ্ছা কাজে পরিণত করছি আমরা, আর বাকীরা নিজেদের ইচ্ছামত সমরখন্দ তুলে দিতে চেয়েছিলেন বাবরের হাতে।’
পীরের মুখচোখ থেকে আত্মমর্যাদার ভাব উবে গেল। তিনি বুঝলেন যে উল্টে কোন হুল ফুটানো কথা বলায় বিপদ আছে।
‘মানুষের দুর্বলতা তো থাকবেই, জাঁহাপান… যদি আমরা কোন অপরাধ করেই থাকি তো মাফ করবেন। অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে এসেছি আমি আপনার কাছে…’
‘এসেছেন? নাকি নিয়ে এসেছে?’ কেঁদে ফেললেন খাজা ইয়াহিয়া।
‘খাজাকে উপরে নিয়ে গিয়ে তার প্রিয় মির্জার পাশে বসাও,’ আদেশ দিল খান।
খাজা ইয়াহিয়াকে নিয়ে চলে যাওয়া মাত্রই শয়বানী কাছে ডাকল তার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ পরামর্শদাতা বছর ষাট বয়েসের মোল্লা আবদুর রহিমকে।
তাদের দু’জনের মধ্যে কী কথাবার্তা হল তা সেখানে সমবেত হোমরাচোমরাদের কেউই জানতে পারল না। অনেক সুলতান অবাক হলো যে শয়বানী সমরখন্দের খোলা দরওয়াজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়তে ব্যস্ত হচ্ছে না। কেন আর দেরী করা, কেন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে হস্তগত করা হচ্ছে না মাভেরন্নহরের প্রাণকেন্দ্রকে যার জন্য এতদিন ধরে শয়বানী উজবেকরা অবিচল করে এসেছে?
সেইজন্যেই বোধহয় ডাকা হয়েছে উচ্চমহলের সভা, এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য? যাই হোক না কেন যখন প্রধান প্রবেশদ্বার দিয়ে শয়বানী এসে ভিতরে ঢুকলো তখন সভায় উপসি’ত সবারই কৌতূহল চরমে উঠল। এতক্ষণ পর্যন্ত যে যার জায়গায় বসেছিল, এবার তারা লাফিয়ে উঠি কুর্ণিশ করল। শয়বানী ধীরে ধীরে নিজের বসার জায়গায় উঠে পা ভাঁজ করে জরির আসনের ওপর বসে রইল নির্বাক হয়ে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মোল্লা আবদুর রহিম কোরানের একটি সুরা পড়লেন- ইসলামের গাজীর সমস্ত অমূল্য প্রচেষ্টা যেন সফল হয় এই কামনা করলেন। তারপর আবার খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতা। তারপর আবার মোল্লাই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে শেষে আসল কথায় এলেন, ‘আমাদের আজীম ইমাম, গাজী, খলিফা, খুদাবন্দ শয়বানী খান পাপে ডুবে যাওয়া এই শহরকে কেবলমাত্র দখল করতেই চাচ্ছেন না। পয়গম্বর মুহম্মদের দেখানো পাক পথ দিয়ে আমাদের নিয়ে যাবার সময় তিনি সাজা দিতে চান ধর্ম বিরোধী দুশমনদের। যদি আমাদের শাসক কেবল ধনসম্পত্তির কথাই ভাবতেন.. তাহলে সমরখন্দকে একেবারে কপর্দকশূন্য হতে হতো। কিন’ আজীম শয়বানী খান জ্ঞানে দ্বিতীয় ইস্কান্দারের সমান, তিনি সর্বপ্রথমে ভাবেন দীন ও ইমানের- জয়ের কথা।’
মোল্লা আবদুর রহিম থেকে একটু নীচে বসে ছিলেন মুহম্মদ সালেহ্। নীচুস্বরে কিন’ স্পষ্টভাবে তিনি বললেন, ‘ঠিক তাই।’
কবির কথায় কর্ণপাত না করে মোল্লা আবদুর রহিম বলে চললেন, ‘আমরা দেখছি যে তৈমুরের বংশধররা কত নীচ কাজ করতে পারে, দেশের কেমন দুর্দিন হতে পারে তাদের শাসনে, কত শীঘ্র তাদের শাসকরা ইনসাফ আর ইমান সব জলাঞ্জলি দিতে পারে। আবদুল লতিফের হুকুমে জন্মদাতা পিতা। হীরাটে হুসেন বাইকারা কোতল করেন নিজের পৌত্র মুমিন মির্জাকে। সুলতান আলি- এই যে এখানে আমাদের কাছে ইনি বসে আছেন- নিজের বড় ভাই বাইসুনকুরকে ধরে মেরে ফেলতে চিয়েছিলেন, বাইসুনকুর অবশ্য পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তারপর আবার বাইসুনকুর ছোট ভাইকে ধরে ফেলেন…’ একটু বিদ্রুপের হাসি হাসলেন মোল্লা, ‘তার চোখ কানা করে দিতে চেয়েছিলেন, নিজের লোকের মতই ব্যবহার আর কি। কিন’ আমাদের এই অতিথি মির্জা জল্লাদকে ঘুষ দিয়ে পালান। সমরখন্দের শাসকদের প্রাসাদ পরিণত হয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা, ভন্ডামি, নোংরামির ঘাঁটিতে। কোরানে মুসলমানদের মদ্যপান কঠোর নিষেধ আছে। আর এই তরুণ মির্জা… ঐ যে দেখছেন ওঁকে? ভালো করে লক্ষ্য করুন, দেখি- উনি মনে করেন যে নিষিদ্ধ পানীয় গ্রহণ করে মত্ত অবস্থায় আসতে পারেন ইসলামের গাজী, আমাদের পাক ইমামের কাছে। আমাদের পাক ইমাম আগেও জানতেন যে এই… অর্কমন্য মির্জা অল্পবয়স থেকেই পা রেখেছেন পাপে পথে, এবার সুলতানরা আপনারাও তা জানলেন….’
কিপচাক উপজাতির কুপাকবি চীৎকার করে বলল, ‘লম্পট, মাতালটাকে ফাঁসী দেওয়া হোক।’
‘তরুণ মির্জা অপরাধী নিশ্চয়ই,’ সমালোচনার ভঙ্গীতে মাথা নাড়িয়ে বললেন মুহম্মদ সালেহ, ‘কিন’ এর থেকেও বেশী অপরাধী এর পিতা সুলতান মাহ্মুদ। একেবারে দুশ্চরিত্র লোক ছিল। ধর্ম মানতো না মোটেই। মেয়ে আর বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেদের নিয়ে লালসায় গা ভাসিয়েছিল। হতভাগ্য সমরখন্দবাসীরা তাদের বাচ্চা ছেলেদের রাস্তায় বের করতে ভয় পেতো, নিজেদের বাড়ীর মেয়েমহলে তাদেরকে লুকিয়ে রাখত মেয়ের মতো করে…’
‘আমি বলছি, ছেলে বাবাকেও ছাড়িয়ে গেছে লাম্পট্যে!’ এমনভাবে বলল কামবারনি যেন তলোয়ার চালালো।
‘আরে বাবা কি, ওরা মা, মা কেমন ধরনের?’
কুপাকবি একটু বেশী ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল সবাই। অনেকেই গুজব শুনেছে যে শয়বানী খান বিবাহ করবে জোহরা বেগমকে। খান জানতো যে ঐ মহিলাকে বিবাহ করলে নিজের সুলতানদের চোখে সে ছোট হয়ে যাবে, তাছাড়া বেগমের শিরা ফুলে ওঠা হাতগুলো কিছুতেই ভুলতে পারছিলো না সে। মোল্লা আবদুর রহিমেরও জানা ছিল খানের অভিপ্রায়ের কথা, তাই এ গুজবের মূল ছেঁটে ফেলার জন্য কিপচাকদের সুলতানের ক্রুদ্ধ প্রশ্নের খেই ধরে বললেন, ‘শাসকদের পাপের ছোঁয়াচ লাগে তাদের স্ত্রীদেরও গায়ে। এই মির্জার মা, মনে হচ্ছে, নিজের লালসা মেটাবার জন্য সবকিছু করতে প্রস্থত। সেই কারণেই কি সে ছেলেকে আমাদের হাতে তুলে দেয় নি।’
একজন সুলতান স্বসি-র নিঃশ্বাস ফেলে প্রস্তাব করল, ‘এমন নীচ মেয়েছেলেকে ঘোড়ার লেজে বেঁধে না মরা পর্যন্ত ঘোড়া ছোটাতে হয়।’
অন্য একজন বলল অন্য শাসি-র কথা, ‘বস্তার মধ্যে ওকে পুরে সবচেয়ে উঁচু মিনার থেকে ছুঁড়ে ফেলতে হয়।’
শয়বানী নীরবে শুনতে লাগল একটার পর একটা এই ধরণের ভয়ংকর সাজার কথা। শেষে তাকাল মোল্লা আবদুর রহিমের দিকে। আবদুর রহিমের ইঙ্গিতে সুলতানদের মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
বলতে আরম্ভ করল খান- গম্ভীর, ভারীস্বরে, আত্মপ্রত্যয় নিয়ে। শুনতে শুনতে স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই যেন মন্ত্রমুগ্ধ, বিশেষ করে তখন, যখন শয়বানী একের পর এক উদারহণ দিয়ে প্রমাণ করে দিতে লাগল তৈমুরের বংশধরদের নৈতিক অধঃপতন, ব্যাভিচার, ধর্মবিরোধী কাজের কথা, যার ফলে এককালের মহিমাময় রাজ্য ছারখার হয়ে যায়। হঠাৎ খান খাজা ইয়াহিয়ার দিকে ফিরল, ‘এই যে, পীর, এই লম্পটগুলোর মুর্শীদ ছিলেন আপনার পিতা খাজা অহরার, পাক বলতেন তিনি নিজেকে। শাসকরা ছিল তার ধর্মীয় প্রভাবের ওপর নির্ভর। কত ধনসঞ্চয় করেছেন তিনি- এ সবই কি সৎপথে, পীর সাহেব? আমরা জানি যে আপনি অনেক অনেক সোনার উত্তরাধিকারী হয়েছেন। সেই ধনের সহায়তায়ই আপনি আজ এই এগারো বছর ধরে হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছেন সমরখন্দ। মাছে পচন ধরে তার মাথায়। যেমন পীর, তেমনি তার মুরিদ। এই যে তরুণ লম্পট মির্জা সুলতান আলি- ও তো আপনার মুরিদ- খোদার কাছে কথা দিয়ে ওর দায়িত্ব নিয়েছেন, ওর হাত নিজের হাত তুলে নিয়েছেন।’
সুলতান আলি আর খাজা ইয়াহিয়ার দিকে একে একে আঙুল দেখিয়ে তারপর মেঝেতে আঙুল ঠেকিয়ে শয়বানী বলল, ‘আর ঐখানে, নীচে বসে আছে আর এক চরিত্রহীনা মেয়েছেলে… লজ্জা বিবেক সব ভুলে এখানে এসেছে স্বামী খুঁজতে। ,… এমনি পীর আপনি! নিজের মুরিদ-মির্জার বিশ্বাসহনন করেছেন, সমরখন্দ বাবরের হাতে তুলে দিকে চেয়েছিলেন। আর এই মুরিদ নিজের পীরের বিশ্বাসভঙ্গ করে আমার কাছে এসেছে। শহর বটে একখানা, বিশ্বাসহন্তা আর প্রতারকে পূর্ণ। একজন এদিকে যায় তো অন্যজন ওদিকে যায়। সুলতান একদিকে, আর মুর্শীদ অন্যদিকে। এক অপরকে গিলে ফেলতে পারে। পয়গম্বর মুহম্মদ (সঃ) ছিলেন ধর্মনেতা, শাসক আবার সেনানায়কও। যে পয়গম্বরের পথ অনুসরণ করবে না তাকে এই পীর আর ঐ মির্জার মতই অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করা হবে।’
নিজের দলের কিছু লোকের প্রতি ইঙ্গিত ছিল এ কথায়। তারা গোপনে বলাবলি করতো, আমাদের খান তখ্ত পেয়েও খুশী নন, নিজেকে খোদ ইমাম আর খলিফা বলে প্রচার করতে চাইছেন। মাভেরান্নহরের ঘটনাবলী বহুদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে শয়বানী ভালই বুঝেছে খাজা আহরারের মত লোকদের হাতে ক্ষমতা থাকার ফলে রাজ্য কেমন করে দুর্বল হয়ে পড়ে। নিজের রাজ্যে এমনটি সে কখনও হতে দেবে না, কিছুতেই না। বুখারার মাদ্রাসাতে পড়াশোনা করার সময়ই সে ভাল করে তেলাওয়াত করে কোরান। ধর্মীয় নেতার ক্ষমতা না থাকলে সে কেবলমাত্র একজন সেনানায়ক সে বিভিন্ন সুলতানদের আর বিভিন্ন উপজাতির লোকদের একত্রিত করেছে। আর তার আদেশাধীন শক্তিশালী সেনাদল ছাড়া ইমাম বা খলিফা হয়েই বা লাভ কি? সেনানায়ক-খলিফা- একসঙ্গেই হতে হবে তাকে।
‘সমরখন্দে আমাদের দুশমনরা সাতমাথাওয়ালা ড্রাগনের মতই শক্তিশালী। কত বীরকে পরাজিত করেছে এই ড্রাগন! কিন’ আমাদের উদ্দেশ্য, চিন্তাধারা সৎ, মঙ্গলজনক। খোদা, স্বয়ং খোদা ঐ ড্রাগনকে বার করে এনেছেন তার গর্ত থেকে, আমাদের তুলে দিয়ে বলেছেন, যা মন চায় তাই কর এটাকে নিয়ে। আল্লাহ্র ইচ্ছায় সমরখন্দের দরজা বিনাযুদ্ধেই খুলে গেছে আমাদের সামনে।
খানের অনুচররা যেন কেবল এখনি বুঝল কী বিরাট সাফল্যলাভ করেছে তারা। সমরখন্দ, শক্তিশালী সমরখন্দ বিনা যুদ্ধে বশ্যতা স্বীকার করেছে। আল্লাহ্ সত্যিই সর্বশক্তিমান; শয়বানী খান প্রকৃত গাজী, খোদার প্রিয়পাত্র, সেজন্যই এমন চমৎকার ভাবে সুকৌশলে এমন কঠিন কাজ সুসম্পন্ন করলেন।
মোল্লা আবদুর রহিম উচ্চস্বরে বললেন, ‘আমাদের পাক ইমাম দীর্ঘজীবী হোন।’
অন্যরাও লাফিয়ে উঠল জায়গা ছেড়ে, ‘দ্বিতীয় সিকন্দর জিন্দাবাদ। খলিফাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। দুনিয়ার সমান আয়ু হোক গাজী খলিফার।’
সুলতান আলি আর খাজা ইয়াহিয়াও উঠে দাঁড়াল। ভয়ে মলিন মুখ, পা কাঁপছে তাদের। ভয় পাবারই তো কথা, শয়বানীর একটা কথায় তার অনুচররা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে তাদের।
খানের ইঙ্গিতে স্থতিবর্ষণ বন্ধ হল, আবার সবাই বসল নিজের নিজের জায়গায়।
খাজা আর মির্জার দিকে দেখিয়ে শয়বানী বলল, ‘বেশ জ্বালাযন্ত্রণা দিয়ে তারপর এদের মেরে ফেললেও হয়ত কোন পাপ হতো না। কিন’ আমরা আর একবার দুনিয়ার সামনে তুলে ধরবো- যারা ইমান ও ইনসাফের পথে যায় তাদের শক্তি যে করুণা প্রদর্শনেই, তার প্রমাণ! এই মেহমানদের খুন ঝরাবো না আমরা, এদের জীবনভিক্ষা দেব।
মির্জা ও খাজা যারা এতক্ষণে সব আশা হারিয়ে ফেলেছিল, এবার অনুগত দাসের মত মাথা নীচু করে কৃতজ্ঞতা জানাল। সুলতান আলির অহঙ্কার বা খাজা ইয়াহিয়ার আত্মমর্যাদার আর চিহ্নটুকুও নেই।
এমনকি খাজা ইয়াহিয়ার চোখে জল এসে গেল, ‘খোদা আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন, জাঁহাপনা।’
‘দাঁড়াও,’ গলা তুলে আবার বলল খান। ‘খাজা ইয়াহিয়া নিজের আত্মসর্বস্বতায় ইমানকেও ভুলে গেছ। আত্মাকে শুদ্ধ করার জন্য তোমার হজ করা দরকার। … প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর দুই ছেলেকে নিয়ে রওনা হয়ে যাও। কুপাকবি কাল সকালের আগেই যেন রওনা দেয়।’
‘জো হুকুম জাঁহাপনা।’
‘আর এই নওজোয়ান মির্জা,’ সুলতান আলির দিকে তাকিয়ে শয়বানী বলল, ‘আমাদের সন্তান হতে চেয়েছিল। যাক্, ধর্মপথবিচ্যুত পাপীকে প্রকৃত ধর্মের পথে ফিরিয়ে আনা পূন্যকর্ম। তৈমুর খান, তুমি ওকে নিজের দলে নিয়ে নাও।’
সুগঠিতদেহ তৈমুর খান ঘৃণাভরা চোখে তাকাল সুলতান আলির দিকে। কিন’ বাবার কথাই হল আইন। তৈমুর মাথা নীচু করে আদেশ মেনে নিল।
‘যদি ভাল ফল দেখায় তো ইনাম পাবে, আর যদি বেয়াড়াপনা করে তো মাথা কাটা পড়বে’ বললো শয়বানী।
যারা বুঝবার তারা ঠিকই বুঝল সুলতান আলি বেশীদিন বেঁচে থাকবে না।
এবার নীচে বন্দী করা জোহরা বেগমের কথা ভাবা দরকার।
জোহরা বেগমের সৌন্দর্যের খ্যাতি বহুদিনই তার কানে এসেছে। একসময় সে ভেবেছিল তাকে সাময়িক স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করার কথা। সেটা প্রথাবিরুদ্ধ নয়। ছন্দোবদ্ধ যে চিঠি সে পাঠিয়েছিল বেগমকে তাতে অবশ্য মেয়াদী নিকা করার কোন কথাই ছিল না। অহঙ্কারী বিধবা সমরখন্দ সুন্দরী ভাবুক যে সে শয়বানীর হৃদয় জয় করেছে, সত্যি সত্যিই তার জীবনসঙ্গিনী হবে। আজ যে মোহভঙ্গ হয়েছে শয়বানীর, সেটা ছাড়াও তার বিবেক তার মন কুরে কুরে খাচ্ছে- কবিতা দিয়ে সে তো বেগমকে পথচ্যুত করেছে, এক কথায় প্রতারিতে করেছে। এখন তার কাছে বড় কথা হল দেওয়ানে জোহরা বেগমের প্রতি সুলতানদের ঘৃণা প্রদর্শন করা, বেগমের পাপ আর কলঙ্কের কথা খানকে বোঝাবার চেষ্টা করা। বিবেককে একটু শান্ত করা গেল। জোহরা বেগম নিজেই তো দেখি একটা বাজে মেয়েমানুষ, ওকে প্রতারণা করলে কোন দোষ নেই, ভাবল খান। ওকে আমি মেরে ফেলতে দেব না সুলতানদের সমর্থন লাভ করা। বেগম চেয়েছিল আবার বিয়ে করতে। নিজের কথা রাখব, ওর বিয়ে দেব।
খানের কাছাকাছি যে সব সম্মানিত লোকেরা বসেছিল তাদের থেকে বেশ দূরে পড়ল শয়বানীর দৃষ্টি। মনসুর বখ্শি, ও-ই হবে জোহরা বেগমের সুলতান। সুলতান হিসেবে তেমন কিছু না, কিন’ সৈন্যচালনা ছাড়াও সে ঝাঁড়-ফুঁকও করতো। প্রচন্ড জোরে খঞ্জনী বাজিয়ে, যথেচ্ছ গালিগালাজ করে ভয় দেখিয়ে অসুস্থ লোকের দেহ থেকে ভূত-প্রেত তাড়াতো। এজন্যই তার নাম হয়েছিল ‘ভয়ংকর’। এছাড়া আরও এক কারণে খ্যাতি ছিল তার- কিছুতেই তার স্ত্রী টেঁকে না, দু’এক বছর পরেই হয় পালিয়ে যায়, নয় মরে রেহাই পায়।
‘মনসুর বখশি, আবার তোমার স্ত্রী মরেছে, তাই না?’ জিজ্ঞাসা করল শয়বানী, ‘নীচে বসে আছে যে বেগম, বিয়ের পোশাক পরে এসেছে, দেখছো? তোমার সঙ্গে তার বিয়ে দিলে কেমন হয়?’
মনসুর লাফিয়ে উঠলো জায়গা ছেড়ে, আকর্ণ হাসিতে মুখ ভরে গেল তার, নীচু হয়ে সম্মান জানিয়ে বলল, ‘জাঁহাপনা আমার, আপনার জন্য জীবন দিতেও প্রস্থত। নিশ্চয়ই বিয়ে করবো।’
হা-হা করে হেসে উঠলো সবাই। সব সুলতানই হাঁফ ছাড়লো যে শয়বানী এ জটও খুলল সুকৌশলেই।
‘আমাদের ইমাম উপযুক্ত সিদ্ধান্তই নিয়েছেন।… ভয়ংকর মনসুর বেহায়া বেগমকে তার আলিঙ্গনে পিষে ফেলবে…’
‘দু’জন দু’জনের উপযুক্ত…’
যেই শয়বানী বলতে আরম্ভ করল অমনি হাসি উচ্ছ্বাস থেমে গেল, ‘নিকাহ্ হবে সমরখন্দে। সুশৃঙ্খলভাবে সমরখন্দে ঢুকব আমরা।…
খান একাধিকবার এসেছে সমরখন্দে, ভাল করেই জানা আছে এ শহর, আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছে সে কেমন করে তার সেনাদল প্রবেশ করবে শহরে আর জায়গা করে নেবে থাকার। সিপাহসালাররা নির্ভুল নির্দেশ পেয়ে শয়বানীর পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে চাররাহ দরওয়াজা দিয়ে দ্রুত প্রবেশ করতে আরম্ভ করলো। ঠিক সেই সময়েই চাররাহর উল্টো দিকের তখন অবস্থান করছেন শাহরিসাব্জে। তার সমর্থকরা শাহরিসাব্জের দিকে ছুটছে।
কিন’ সবাই পালাতে পারে নি। শয়বানীর সৈন্যরা দ্রুতগতি ঘোড়ায় চেপে ঝড়ের বেগে ছুটে এসে অনেককে ধরে ফেললো, মহানন্দে লুঠপাঠ চালালো, যে বাধা দেবার চেষ্টা করলো সেই মারা পড়লো।
লুঠপাট আরও বাড়লো রাতের অন্ধকারে। শুধু খাজা ইয়াহিয়ার ধনসম্পদেভরা বাড়ীটাই নিরাপদে ছিল। সারারাত সে-বাড়ী পাহারা দিয়েছে কুপাকবির সৈন্যরা। কিপচাক সুলতানের নেতৃত্বে সৈন্যরা দেখতে লাগলে কেমন করে খাজা ইয়াহিয়া তার দুই ছেলে আর বিশ্বাসী গোলামদের সাহায্যে বাড়ীর বিভিন্ন অংশ থেকে টেনে টেনে আনছে সোনাবোঝাই সিন্দুকগুলো আর গোচাচ্ছে অন্যান্য জিনিসপত্র। ভোরবেলায় গোলামরা পাঁচটা ঢাকা গাড়ী আর গোটা দশেক উট মালবোঝাই করলো। খাজার তিন বিবি মালবোঝাই গাড়ীগুলোর মধ্যে উঠে বসলো। খাজা ইয়াহিয়া, তার দেহরক্ষী আর ছেলেরা ঘোড়ায় চড়ে চললো। সমরখন্দ থেকে বিদায় নিয়ে এক সময়ের ক্ষমতাবান পীর দক্ষিণ অভিমুখে রওনা দিলো। পাহাড়ী এলাকার মধ্যে দিয়ে চলে গেছে খাজা ইয়াহিয়ার পথ। সরু গিরিপথের ওদিকে আর গিয়ে পৌঁছলো না কাফেলা। সন্ধ্যার আধোআঁধারে নদীতীরে রাত কাটানোর জন্য থামার আগে কুপাকবি কেটে ফেলল হজযাত্রীদের- পীর, তার ছেলে, দেহরক্ষীদের সবাইকে। কেবলমাত্র মেয়েদের আর গোলামদের ভাগবাঁটোয়ারা করে দিলো নিজের অনুচর আর সৈন্যদের মধ্যে অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে। লুণ্ঠিত ধনসম্পদের অর্ধাংশ সে রাতেই কুপাকবি পৌঁছে দিল খানের কোষাগারে, খানের আদেশেই খাজা ইয়াহিয়াকে সে মেরেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। এই হত্যার কথা জানতে পেরে সুলতান আলি বুঝলো যে তার জন্যও সেই একই দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করে আছে। যেমন করেই হোক না কেন পালাতে হবে, ভাবলো সে। শরতের এক ঘন কুয়াশাভরা দিনে সে দু’জন দেহরক্ষীকে নিয়ে সবার অলক্ষ্যে সমরখন্দ কেল্লার পূর্ব দরওয়াজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে চললো সে পাঁজিকেনে-র দিকে। কিন’ সেও বেশী দূর যেতে পারল না। সমরখন্দের কিছুদূরে পুবদিকে বয়ে চলেছে ছোট্ট নদী সিয়াব। তারই তীরে তাকে ধরে ফেলে তৈমুর। অপদার্থের মুন্ডটা নিয়ে দেখানো হল গাজী খলিফাকে।
জোহরা বেগম মুনসুর বখশির সঙ্গে বিয়ের পরেই প্রথম আঘাতের স্বাদ পেল, যখন তার কাছে তার ছেলের মুন্ডহীন লাশটা নিয়ে আসা হলো। সে প্রচন্ড চীৎকার করে উঠলো, পরনের পোশাকটা ছিঁড়তে লাগলো, নিজের মাথায় ঘুষি মারতে লাগলো, মুখ আঁচড়ে রক্ত বার করে ফেললো। তা দেখে খুব মজা লাগল সবার, পরাজিত শত্রুর যন্ত্রণা দেখার মত আনন্দের আর কিছুই নেই তাদের কাছে।
৫
নদী বয়ে চলেছে শরতের বাতাসে খসে পড়া পাতার আবরণটাকে সঙ্গে নিয়ে।
পাতা পড়ে যেন হলুদ হয়ে গেছে জরাফশান নদী। অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত কয়েকশত অশ্বারোহী নদী পেরিয়ে চলে গেল সমরখন্দের ক্রোশ ছয়েক দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। সিয়াবের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে তারা, চলেছে সতর্কভাবে, যতটা সম্ভব নিঃশব্দে। গ্রামগুলো এড়িয়ে বা সবার অলক্ষ্যে সেগুলো পেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। যদি বা তারা কোন কৃষকের মুখোমুখি হচ্ছিল তো কৃষকরা ভয়ে তাড়াতাড়ি লুকাবার চেষ্টা করছিলো। কৃষকরা ভাবছিলো যে তারা শয়বানী খানের সৈন্যদল, যারা ইতিমধ্যেই এলাকার প্রচন্ড আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
কিন’ দেখেশুনে মনে হচ্ছে যে এই অশ্বারোহীরা নিজেরাই প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে শয়বানীর সৈন্যদলের মুখোমুখী হবার। যখন তারা সিয়াব পার হচ্ছিল রাতের বেলায় কাদামাটিতে কয়েকটা ঘোড়া আটকে যায়। লোকগুলি অনুচ্চস্বরে হেট্ হেট্, করছিল ঘোড়াগুলোকে টেনে তুলে আনার চেষ্টায় আর তাতে নিজেরাই আটকে যাচ্ছিল কাদামাটিতে। নলখাগড়ায় মুখ হাত ছড়ে যাচ্ছিল। একজন আর থাকতে না পেরে জোরে গালিগালাজ করে উঠল। তখুনি একজনের কর্তৃত্বময় কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘চেঁচাচ্ছিস কেন? বিপদ ডেকে আনতে চাচ্ছিস নাকি আমাদের ওপর?’
ওটা হল বাবরের গলা।
সৈন্যটি বললো, ‘মাফ করবেন জাঁহাপনা, এ ব্যাটাকে কিছুতেই টেনে তুলতে পারছি না।’
বিভিন্ন উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে জল এসে পড়ে সিয়াব নদীতে, তাই এই শীতের রাতে সিয়াবের ওপর জমা হয়েছে বাষ্প। আধা অন্ধকারে আর বাষ্প জমে থাকায় শক্ত মাটি আর গলা মাটির তফাৎ বোঝা যাচ্ছে না। দেরী করা চলে না বাবরের। দৃঢ়স্বরে তিনি বললেন, ‘হয়েছে, ঘোড়াগুলোকে এখানেই ফেলে যেতে হবে।’
কাসিম বেগও সমর্থনে বলল, ‘যাদের ঘোড়া রয়ে গেল, তাদের আমি আমার ঘোড়ার দল থেকে ঘোড়া দেবো।’
‘পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলার সময় কত উঠ, ঘোড়া মারা পড়েছে, আমার ঘোড়া সে সব বাধা পেরিয়ে এসেছে। আর এখন এখানে একে মরতে হবে?’ বিষণ্নস্বরে বললো তাহের (এই সৈন্যদলে সেও আছে)।
‘এখন আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কটজনক অবস্থা।’ বাবর বললেন।
কাসিম বেগের অস্ত্রবাহী যে ঘোড়াগুলিকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিল তাদের একটিতে বসল তাহের। অন্য দু’জন সৈন্যের বাবরের দুটি বদলি ঘোড়ায় চড়ার সৌভাগ্য হলো।
ঘোড়ার জন্য ভাবার আর সময় নেই। সমরখন্দ এসে পড়েছে প্রায়। যতটা সম্ভব দ্রুত আর কারো দৃষ্টি আকর্ষণ না করে এগিয়ে যেতে হবে। শয়বানী খানের লোকদের চোখে পড়লেই তারা সতর্ক হয়ে যাবে, গোটা সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তার বিরুদ্ধে টিঁকে থাকার মত ক্ষমতা ওদের আপাতত নেই।
সারা গ্রীষ্মকালটা বাবর ঘুরে বেরিয়েছেন পাহাড়ে পাহাড়ে, শাহ্রিসাবজ থেকে হিসার পর্যন্ত গিয়েছেন, সেখান থেকে গিয়েছেন জরাফশান নদীর উৎস ফান্দরিয়ার তীর পর্যন্ত। সমরখন্দের বেগরা নিজেদের সৈন্যবাহিনীসমেত হিসারের শাসক খসরু শাহের কাছে চলে এসেছে। বাবরের সঙ্গে যারা আন্দিজান থেকে এসেছিল তাদের অনেকেই ফরগানা উপত্যকায় ফিরে গেছে, এত ঘন ঘন জায়গা পরিবর্তন আর আপাতদৃষ্টিতে সাফল্যের সম্ভাবনাহীন অভিযানে হাঁফিয়ে পড়েছিল তারা। খুব সম্ভব শয়বানী খানের গোপন সংবাদদাতারা তাকে জানিয়েছিল যে বাবরের সৈন্যদল লোক ক্রমশই কমে যাচ্ছে। খান নিশ্চিত ছিল যে বাবর (কত সৈন্য আছে এখন আর, হাজার খানেক?) পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে অত কষ্ট সহ্য করতে পারবে না, ফিরে যাবে আন্দিযান। অথবা আশ্রয় চাইবে তার চাচা আলাচ খানের কাছে, যে বেশ দূরে ইসিককুল ঝিলের ওপারে কোথাকার যেন শাসক। আর যাই হোক না কেন তার সৈন্যদল এখন বাবরের সৈন্যদলের চেয়ে পাঁচগুণ বেশী আর বর্তমানে যা আছে তার থেকে আরো অনেকগুণ বেশী বড় করে ফেলাও যায় খুব তাড়াতাড়ি তাই বাবর তো আর তাকে আক্রমণ করে বসবে না। নিঃস্ব হয়ে যাওয়া সমরখন্দ শহরে শয়বানী শ’পাচেক লোক রেখে দিলো আর মূল সৈন্যদল নিয়ে ঘাঁটি গাড়লো শহরের থেকে সামান্য পশ্চিমে অবসি’ত খাজা দিদার নামে এক জায়গায়।
বাবর এক বিরাট ঝুঁকি নেবার সিন্ধান্ত করেছেন- সমরখন্দের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শয়বানীর নাকের ডগা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া, যতক্ষণ সে এমন কোন সম্ভাবনার কথা সন্দেহও করছে না। আবার খানের এই অজ্ঞানতা এক মুহূর্তে উবেও যেতে পারে। যদি তার চরেরা খানকে যথাসময়ে খবর দেয় তাহলে অবস্থা হয়ে দাঁড়াবে সঙ্কটজনক। খান এমন ভাব দেখাবে যেন কিছুই জানে না। বাবরকে আরো কাছে এগিয়ে আসতে দেবে তার দুর্বল বাহিনী নিয়ে শহরের একেবারে কাছে, তারপর সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করবে তাদের। তাছাড়া শহরের ভিতরেও বাবরের চেয়ে শত্রুপক্ষের সৈন্যই বেশী। আর বাবর যদি শয়বানীর হাতে পড়েন তো আর বেঁচে থাকতে হবে না তাকে। অবশ্য তার বেগরা, সৈন্যরা যারা খানের দাসত্ব করবে তারা বেঁচে থাকবে- সুলতান আলির অধিকাংশ বেগদেরও শয়াবানী নিজের সৈন্যদলে নিয়েছে। গাজী খলিফা মাভেরান্নহরে এক নতুন শাসকবংশের প্রতিষ্ঠাতা হতে চাচ্ছে, সেই জন্য তৈমুরের বংশধরদের নির্দয়ভাবে ধ্বংস করার শপথ নিয়েছে সে। এ কথা জানা আছে বাবরের। তাই তিনি সি’র করেছেন, লড়াই করতে করতে মরার। জীবন্ত অবস্থায় খানের হাতে পড়া চলবে না কিছুতেই।
অন্ধকারের মধ্যেই তার বাহিনী অনেক নালা, নদী, জলভরা খানাখোঁদল পেরিয়ে গেল। শরতের এই সময়ে নির্জন গাছপালাঘেরা এলাকাগুলি পেরিয়ে এসে পৌঁছল পুল মাগাক্-এর কাছে। সেতুটা শহরের প্রাচীরের একেবারে কাছেই। দু’দিন আগে এখানে পাঠানো হয়েছিলো বিশ্বস্ত অনুচরদের, তারা এখানে তৈরী করে রেখেছে উঁচু উঁচু মই, সমরখন্দের প্রাচীর পার হবার জন্য। এখন জনাঅর্াশি সৈন্য ঘোড়া থেকে নেমে মইগুলি নিয়ে চুপি চুপি এগিয়ে চললো খাড়া পাড়ের দিকে। আর বাবর অন্যান্যদের নিয়ে চুপিসারে এগিয়ে চললেন ফিরোজা দরওয়াজার দিকে, প্রবেশপথের বিপরীতে গাছ আর ঢিবির ছায়ায় লুকিয়ে রইলেন।
চারপাশ- নিস্তব্ধ। কেবল হঠাৎ দূরে থেকে শোনা গেল প্রথম মোরগের ডাক। শহরের প্রাচীরের ওপর নেমে এসেছে রাতের অন্ধকার, ঘন মেঘ। আবছা দেখা যাচ্ছে প্রাচীরের উপরাংশ আরও উপরে কোথায় চলে গেছে।
কাসিম বেগ বরাবরের মতই বাবরের পাশে দাঁড়িয়ে। ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে তার। বাবর নিজেও সারা শরীরে কাঁপুনি অনুভব করছেন।
সমরখন্দের প্রাচীর। চারমাস আগে এমনই আঁধার রাতে বাবর এসেছিলেন এই প্রাচীরের কাছে, খাজা ইয়াহিয়ার প্রবেশদ্বার খুলে দেবার অপেক্ষায়। কিন’ দেখে ফেলেছিল তাদের, তীর ছূঁড়তে আরম্ভ করেছিল তাদের উপর, নিজের দলের আহত লোকদের আর্তনাদ, শত্রুপক্ষের লোকদের ছুঁড়ে দেওয়া গা-জ্বলানো মন্তব্য সবকিছু শুনতে শুনতে ফিরে আসতে হয়েছিল তখন। প্রতারণা, খলতা, অবরোধ, অতর্কিতে আক্রমণ… মৃত্যু – নিজের দলের লোকদের, শত্রুপক্ষের… এই সবকিছু মিলিয়েই হল এই যোদ্ধা, মাভেরন্নহরকে সঙ্ঘবদ্ধ করার সঙ্কল্পে অটল রাজনীতিকের জীবন।
আবার যাতে ফাঁদে না পড়তে হয় বা শহরের ভিতরে তার সমর্থকরা বিপদে না পড়ে, সেজন্য এবার বাবর প্রাচীরের কাছে তার আসার কথা জানান নি কাউকে। কেবল নিজের ওপর আর তার বেপরোয়া অনুচরদের ওপর ভরসা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই অনুচরের সংখ্যা এখন- বাবর সঠিক জানেন- দুই শ’ চল্লিশ। ওদিকে প্রাচীরের ভিতরে পাঁচ শ’। আর খানিকদূরে পাঁচ হাজার।
কে কার জন্য ফাঁদ পেতেছে এখানে? তিনি শয়বানীর জন্য, না শয়বানী তার জন্য?
কতবার বাবরের বেগরা তাকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেছে এমন অদ্ভুত ঝুঁকি নেওয়া থেকে, বুঝিয়েছে যে ফিরে যাওয়াই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
কিন’ নিজের পরিকল্পনা ত্যাগ করা- তার মানে মার খেয়ে ফিরে আসা আন্দিজানে; আহমদ তনবালের কর্তৃত্ব মুখ বুজে সইতে হবে। শরতের স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় আর শীতের হিমের মধ্যে নিজের রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় দিন কাটাতেও ইচ্ছা হয় না। যুদ্ধই তার পক্ষে শ্রেয়, যুদ্ধ, হয় মরবেন, নয় সিংহের মত যুদ্ধ করে শয়বানীকে পরাভুত করবেন।
সিংহ আর ধূর্ত শিয়ালের মত। ফাঁদ এড়িয়ে অতর্কিতে শত্রুর উপর এসে পড়ে শিয়াল। সব ভরসা এখন এতেই। কান খাড়া করে রইলেন বাবর।
রাত। নিস্তব্ধতা। নিজের বুকের ভেতর ধুকধুক করছে দারুণ জোরে- এ হলো তার কিসমতের ঘোড়ার পদধ্বনি…
৬
যতক্ষণ সৈন্যরা প্রাচীর সমাধিস্থান চাকারদিজার পাশ কাটিয়ে মোটামুটি সমান জমির ওপর দিয়ে চলছিলো ততক্ষণ তাহের মইগুলোর ভার অনুভব করে নি। কিন’ যখন তারা খাতের খাড়া পাড় বেয়ে নীচে নামতে লাগলো তখন ভার যেন ক্রমশঃ বাড়তে লাগলো, হোঁচট খেতে লাগলো সবাই আর অস্ফুট গালিগালাজ করতে লাগলো। অন্ধকার গুহামুখটা পেরিয়ে গেল কুসংস্কারপ্রসূত ভয় নিয়ে- দিনের বেলায়ও কেউ এখানে আসে না আর তারা… এই রাতের বেলায়… গুহাটা পেরিয়ে… আবার উপরে ওঠা, বিশ্রী কাঁটাঝোপে আটকে যাচ্ছে পোশাক-আসাক। শহরের প্রাচীরের এক অংশ দেখা যাচ্ছে খাতের মধ্যে থেকে, এখান থেকে প্রাচীর আরো অনেক বেশী উঁচু বলে মনে হচ্ছে।
ঘেমে নেয়ে শেষ পর্যন্ত সৈন্যরা মইগুলো নিয়ে এলো প্রাচীরের নীচে।
সেই দলের নেতৃত্বে ছিলো নুয়ান কুকলদাস। দলের লোকদের একটু জিরিয়ে নিতে দিয়ে ভাবনায় ডুবে গেল সে।… ইঁটের প্রাচীরের উচ্চতা প্রায় একটা পপলার গাছের সমান, আর প্রাচীরের ওপরটা এত চওড়া যে দু’জন লোক পাশাপাশি চলতে পারে তার ওপর দিয়ে, তা জানে কুকলদাস। এখন কী হচ্ছে সেখানে? কে আছে ওখানে? মনে হচ্ছে সব নিস্তব্ধ। কোন আলো বা মশাল কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্রহরীরা বোধহয় রাতে হিমে জমে যাওয়ার নীচে প্রহরাকক্ষে গিয়ে ঢুকেছে।
তা যদি হয়- তো এই উপযুক্ত সময়।
মইগুলো সাবধানে তুলে ধরে সবাই প্রাচীরের উপরপ্রানে- রাখল অত্যন্ত সতর্কভাবে ও নিঃশব্দে।
‘উঠে যাও,’ অনুচরদের আদেশ দিল নুয়ান কুকলদাস ফিসফিস করে।
স্তব্ধ হয়ে গেল তারা সবাই। পঞ্চাশ হাত উঁচু প্রাচীর, সোজা কথা নাকি, হাত ফসকে পড়লেই হলো, হাড়গুলোও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর প্রহরীরা হঠাৎ যদি বুঝতে পারে? কার ওপরে সবার আগে এসে পড়বে তাদের ছোঁড়া তীর আর পাথর? মইটাও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে বেশীক্ষণ লাগবে না।
মইয়ের ধাপে প্রথম পা রাখলো নুয়ান কুকলদাস। মরতে তো একদিন হবেই। বীরের মত মরাই ভাল। দ্বিতীয় মই বেয়ে উঠতে লাগেেলা তাহের, সেটিও বেশ মজবুত- অনেকের ভার ধরে রাখতে পারে। এবার বাকী সবাইও উঠতে লাগলো। একটু পরেই নুয়ান ওপরে পৌঁছে গেল। চারপাশে তাকালো। কেউ কোথাও নেই। দেয়াল বরাবর চওড়া করে পাতা তক্তার ওপর দিয়ে এমন কি ঘোড়ায় চড়েও যাওয়া যায়। প্রাচীরের ওপরে খাঁজের আড়ালে লুকিয়ে তাহের দলের অন্য একজনকে সাহায্য করল উঠে আসতে, ফিসফিস করে তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর কুড়ালটা কোথায়?’
লোকটি কোমরবন্ধ থেকে কুড়ূল খুলে নিয়ে এগিয়ে দিল তার দিকে।
‘খাঁজগুলোর গায়ে গায়ে লুকিয়ে থাক সবাই।’ আদেশ দিল নুয়ান।
প্রাচীরের ওপর এই খাঁজগুলি না থাকলে নীচে চত্বর থেকে তাদের দেখে ফেলা খুবই সহজ হত। বড় বড় খাঁজের আড়ালে আড়ালে ঘন হয়ে থাকা অন্ধকারে তাদের ছোট্ট দলটিকে পুরোপুরি সমবেত করা গেল, তারপর প্রাচীরের গায়ের তক্তার ওপর দিয়ে দ্রুত ছুটে চললো তারা নীচের দরওয়াজার দিকে। নামবার পথে কিছদূর অন্তর প্রহরাকক্ষ ছিল অবশ্য। যখন তারা প্রথমটির কাছে গিয়ে পৌঁছালো ভিতর থেকে একজন কিপচাক ভাষায় ঘুমন্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘ইরিস্পাই, তুই এলি নাকি? এত দেরী হল কেন? তোর জন্য অপেক্ষা করে করে…’
স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই। তাহের দু’হাতে কুড়ালটা আঁকড়ে ধরে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি.. আমি এই..’
গলা চেনা ঠেকলো না প্রহরীর কাছে, উৎকণ্ঠিত হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করল সে, ‘কে তুই?’
নুয়ান কুকলদাস ঝাঁপিয়ে পড়লো দরজার কাছে, দরজা খুলে প্রহরী বাইরে আসামাত্রই বর্শা গিয়ে বিঁধলো তার দেহে। এই প্রহরীর মৃত্যুচীৎকার নীচের প্রহরীদের জাগিয়ে তুলতে পারে।
‘তাহের দরওয়াজার দিকে দৌড়াও। দরওয়াজার দিকে- শীগগির।’ বলে কুকলদাস জনদশেক সৈন্য নিয়ে পরের প্রহরাকক্ষের দিকে ছুটে গেল। আর তাহের এক তক্তা থেকে আর এক তক্তায় লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটতে ছুটতে আরও দুটি প্রহরাকক্ষ পেরিয়ে গেল (সেগুলির দরজা ভেজানো ছিল,) কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাহের নীচে ফিরোজা দরওয়াজার কাছে পৌঁছে গেলো।
এই প্রবেশপথের প্রহরার দায়িত্ব ছিল ফজিল তরখানের উপর। তার দলের এক শ’ পঞ্চাশ জনের বেশীর ভাগই যে যার ঘরে ফিরে গেছে। প্রাচীরের উপরে অবসি’ত প্রহরাকক্ষগুলিতে ও প্রবেশপথের কাছে ছিল মোট জনাবিশ, তারাও তন্দ্রাচ্ছন্ন। চেতনা ফিরে পেয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নেবার অবসার পেল খুব অল্প কয়েকজন- দ্রুত হাত চালালো নুয়ান। তাহের কুড়াল হাতে ফটকের কাছে ছুটে গিয়ে জোরে আঘাত করতে লাগলো ঘোড়ার মাথার মত বিশাল তালার উপর। প্রথম কয়েকবার আঘাতে কিছু হলো না। ফজিল তরখানের বাড়ী কাছেই, ইতিমধ্যেই তাকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। পিছনের জ্বলন্ত মশাল হাতে তার অনুচররা। তাদের দু’জন দেখতে পেল কে যেন ফটকের তালাটা খোলার চেষ্টা করছে- দুটো তীর এসে ফটকের কাঠের পাটায় বিঁধে গেল- একটা তাহেরের মাথার সামান্য ওপরে, অন্যটা সামান্য ডানদিকে। হাতাহাতি আরম্ভ হয়ে গেল ফটকের কাছে। লড়াই হচ্ছে খঞ্জর, তলোয়ার, বর্শা দিয়ে বা ঘুষোঘুষি। নুয়ান কুকলদাস অত্যন্ত তৎপর ও বুদ্ধিমান। ফজিল তরখানকে তরবারির এক আঘাতে ফেলে দিলো।
তাহের ওদিকে উন্মত্তের মত আঘাত করেই চলছে একবার তালার উপর, একবার শিকলের উপর, একবার পরিখার সেতুর শিকল লাগানো আছে যে কড়াগুলি, তার উপর। কড়া ও শিকলগুলো ঝনঝন করে খুলে মাটিতে পড়ে গেল। তারপর তালাও খুলে পড়ে গেল।
দুর্গপ্রাচীরের বাইরে চওড়া জল ভরা পরিখা। যতক্ষণে তাহের ফটকটা খুর্লছিলো, ততক্ষণে শিকলের পাক খুলে সেতু নামিয়ে দিলো পরিখার উপর দিয়ে।
ইতিমধ্যে পরিখার অন্যপারে আর কাসিম বেগ দলের সবাইকে নিয়ে প্রস্থত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ফটক খুলে সেতু নেমে আসা মাত্রই তারা খোলা তলোয়ার হাতে ঘোড়ায় চড়ে ছুটে গিয়ে ঢুকলেন দুর্গের ভিতর। ফজিল তরখানের যে সব অনুচর ও সৈন্য জীবিত ছিল পালাতে আরম্ভ করল তারা। কাসিম বেগ সামান্য কিছু সৈন্য নিয়ে তাদে পিছু ধাওয়া করলো।
এর পরের ঘটনা আরও দ্রুত ঘটে চললো। নুয়ান আক্রমণ করলো চাররাহ দরওয়াজা-পিছন দিকে থেকে, শহরের মধ্য থেকে। অন্য এক দল স্বয়ং বাবরের নেতৃত্ব ঝড়ের মত ঝাঁপিয়ে পড়লো সোজানগরান দরওয়াজার কাছের প্রহরীদের উপর। চারটি প্রবেশপথই দখল করা দরকার, শয়বানীর সৈন্যদল যে-কোন মুহূর্তে এসে পড়তে পারে হুড়মুড়িয়ে, কিছুই বলা যায় না।
শীঘ্রই লড়াইয়ের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়লো সার শহরে। শেখজাদা দাওয়াজার কাছে খাজা ইয়াহিয়ার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া সুসজ্জিত বাড়ীতে আরামে ঘুমিয়ে ছিল কোতোয়াল জানওফা। চীৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গিয়ে ভয়ে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলো না সে; বাইরে বেরিয়ে এসে প্রবেশপথ প্রহরায় নিযুক্ত প্রহরীদের সঙ্গে ধাক্কা খেলো সে। শহর দখল করে নিয়েছে বিরাট শত্রু সৈন্যদল- তাদের তাড়া খেয়ে এখন ওরা পালাচ্ছে। কে শত্রু, কে মিত্র কিছুই বোঝার উপায় নেই- সবাই চেঁচাচ্ছে, গালাগালি করছে আর… দৌড়াচ্ছে বাঁচবার জন্য।
কোতোয়াল জানওফা অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নিল- ঘোড়ার মুখ ঘোরালো শেখজাদা দরওয়াজার দিকে, একমাত্র সেখানেই বাবরের লোকেরা এসে পৌঁছায়নি তখনও। কোতোয়ালের হুকুমে ফটক খুলে দেওয়া হল অবিলম্বে। নিজের এক শ’ জন হতবুদ্ধি সিপাহী সঙ্গে নিয়ে সে চললো খানের ছাউনির দিকে, হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে এসে বাবর সমরখন্দ দখল করেছেন, এ খবর দেবার জন্য।
সমরখন্দবাসীরা ভয়ে ভয়ে রাতটা কাটিয়েছে, আলো জ্বালায় নি বা রাস্তায় উঁকিও দেয় নি, তাদের শহরে কী ঘটছে না ঘটছে কিছুই বুঝল না তারা। কেবল ভোরবেলায় নবীবদের ঘোষণা আর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়া গুজব শুনে তারা জানতে পারলো যে বাবর তাদের মুক্ত করেছেন পরদেশী খানদের হাত থেকে। শয়বানী খানের প্রতি অসন’ষ্ট লোকের সংখ্যা ছিল প্রচুর। সর্বত্র কারিগরদের বাড়ীঘরদোর লুণ্ঠিত হয়েছে, কৃষকদের শস্য দলিত করেছে অশ্বারোহী সৈন্যরা। নির্দয়ভাবে নিহত খাজা ইয়াহিয়া আর তার দুই পুত্রের সমর্থকরা কালো পতাকার নীচে সমবেত করেছে কারিগর আর কৃষকদের প্রতিশোধ নেবার জন্য। ভূতপুর্ব সরকারের কর্মচারীরা যারা শয়বানীর জয়লাভে ক্ষমতা সুযোগসুবিধা হারিয়েছে তাদের মনেও প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল। বাবরের দলের দুইশ’ চল্লিশজন লোকের সঙ্গে যোগ দিল আরও হাজার দশেক। আরম্ভ হলো দাঙ্গাহাঙ্গামা, দলে দলে লোক ছুটে বেড়াতে লাগল শহরময়। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য। খান খলিফার যে-সমস্ত লোক লুকিয়ে পড়েছিলো, টেনে টেনে রাস্তায় বার করে আনা হচ্ছে তাদের। কয়েকজনকে ধরা হলো পালাবার সময়। মারতে লাগলো তাদের ছোরা, কুড়াল, লাঠি, পাথর দিয়ে। খুনের পর খুন চলতে লা,লো। তাদের এই অন্ধ ক্রোধের তো সত্যিই কারণ আছে (গত দশ বছর ধরে সাধারণ মানুষ যে দুঃখ কষ্ট পেয়েছে তার প্রতিশোধ নিচ্ছে) সেই সঙ্গে মিলিত হলো যারা কিছু সময়ের জন্য নিজেদের অপমান আর কষ্টের বদলা নিতে পারছিল না, তাদের নিষ্ঠুরতা।
যখন দুর্গপ্রাচীরের ওপারে যুদ্ধ সাজে সজ্জিত শয়বানী খানের বাহিনী দেখা গেল তখন ওদিকে সূর্য উঠছে। পরিখার উপরের সেতুগুলি উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। শহরের সব প্রবেশপথ বন্ধ, নিখুঁত প্রহরার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
শহরে হাঙ্গামা কিন’ তখনও থামে নি।..
৭
সারারাত তাহের শহরময় ছুটে বেড়িয়েছে। জয়লাভের আনন্দ ক্লানি- ভুলিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে কেবল অনুভব করছে প্রচন্ড ক্ষুধার তাড়না। শেষে আর থাকতে না পেরে কাসিম বেগের অনুমতি নিয়ে সে রুটির দোকানের সারির দিকে গেল- ভোর হয়ে এসেছে প্রায়, কিন’ খেতে পাবার কোন আশাই নেই- রাস্তাঘাটে তখনও চলেছে দাঙ্গাহাঙ্গামা।
বাজারের চত্বরে অনেক লোক জড়ো হয়েছে, খানের কয়েকজন অনুচরকে ঘিরে ধরে পাথর দিয়ে মারছে তাদের। চারজন ইতিমধ্যে রক্তবন্যায় ভাসছে, নিঃশ্বাস পড়ছে না, বাকীরা মুখে হাতচাপা দিয়ে আর্তনাত করছে। তাদের মধ্যে বছরকুড়ি বয়সের এক যুবক- তার গায়ের জামাটা ছিঁড়ে কুটিপাটি, সারা শরীরময় ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছে, কাকুতিমিনতি করছে সে তাকে প্রাণে না মারার জন্য। ঘোড়া চালিয়ে ভীড়ের মধ্যে ঢুকে গিয়ে চীৎকার করে বলল তাহের, ‘এই, শোন সবাই! বাবর মির্জা আদেশ দিয়েছেন! যারা হার স্বীকার করছে, তাদের বন্দী করো! অকারণ রক্তপাত ঘটিও না! এই ছোকরাও মুসলমান!… বন্ধ সব! আমরাও নোকর। নোকরের কী দোষ? দোষ এদের খানের!…এখুনি বন্ধ করো এসব! মির্জা বাবরের হুকুম তালিম কর!’
এমন সময় অন্য দু’জন অশ্বারোহী সৈন্য ভীড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে এল। তাদের সাহায্যে তাহের আসে- আসে- শান্ত করল ভীড়ের-লোকদের।
গোলেমালে উক্তেজনায় সে ভুলেই গিয়েছিল কী কারণে এখানে এসেছিল। শয়বানীর তিনবানীর তিনজন অনুচরের এখনও সামান্য শ্বাস পড়ছে- তাদের বন্দী হিসাবে নিয়ে যাবে ভাবলো। এমন সময় ভীড়ের মধ্য এক দীর্ঘকায় লোক ডাকল তাকে।
‘দাঁড়াও তো… তাহের, নাকি?’
লোকটির দিকে তাকালো তাহের। হলদেটে গোঁফ, লম্বা, মজবুত চেহারা, হাতে তার ভারী একটা লাঠি। তাহেরের মনে পড়ল তিনবছর আগের ঘটনা, যখন এখানে দাড়িয়েই সে ক্ষুধার্ত সমরখন্দবাসীদের মধ্যে রুটি বিলোচ্ছিল।
‘মামাত যে! তোমার হাতে লাঠি কেন? তুমি নিজেও কি কিপচাক নও?’
‘আরে ভাই, শয়বানীর সাঙ্গপাঙ্গরা সব উপজাতির লোকদের উপরই খুব অত্যাচার চালিয়েছে। আমার স্ত্রীকে মেরে ফেলেছে।’
এই লোকটির কাছে সে জিজ্ঞাসা করেছিল রাবেয়ার কথা, সেকথা মনে পড়ে তাহেরের বুকের মধ্যে পুরনো ব্যথাটা চাগিয়ে উঠলো। বাবরের সৈন্যদলের লোকদের সঙ্গে বন্দীদের পাঠিয়ে দিয়ে তাহের লাফিয়ে নামল ঘোড়া থেকে, মামাতকে একপাশে নিয়ে গেল।
‘মামাত-ভাই, তোমার মনে আছে আমার অনুরোধ?’
‘জানতাম তুমি জিজ্ঞেস করবে, ভাই… সেজন্যই তো ডাক দিলাম।… আমার বিবি বেচারি কিছু শুনেছিল… ঐ মেয়েটির সম্বন্ধে, তুমি যার কথা বলেছিলে। আন্দিজানের মেয়ে তো?’
‘কুভার।’
‘একই কথা, আন্দিজানের, ঐ দিকেরই। তাকে লুঠ করে এখানে নিয়ে এসেছিল। তারপর তুর্কীস্থানের এক সওদাগর তাকে কিনে নিয়ে যায়।’
‘তারপর, তারপর?’
‘তারপর সেই সওদাগর শয়বানীর দলের সঙ্গে সমরখন্দ আসে।’
‘সেই মেয়েটিকে নিয়ে? বেঁচে আছে সে?’
‘বেঁচে আছে।’
মামাতের হাত চেপে ধরল তাহের, হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল, ‘তার নাম রাবেয়া, রাবেয়া?’
‘আমার স্ত্রীর জানা ছিল না তার নাম।’
‘দেখেছিল সে মেয়েটিকে?’
মামাত যখন ঘাড় নেড়ে জানালো দেখেছিল।
তাহের তাকে ঝাঁকুনি দিতে লাগল, ‘কোথায়? কোথায়? শীগগিরি বলো!’
‘ফজিল তরখানের বাড়ীতে… তোমাদের লোকেরা তাকে আজ রাত….’ গলার উপর দিয়ে লাঠি বুঝিয়ে দিল মামাত তার কি হয়েছে।
‘তার বাড়ী কোথায়?’
‘চল আমার সঙ্গে, দেখিয়ে দেব।’
লাফিয়ে ঘোড়ায় উঠল তাহের, মামাতকে বসাল পিছনে। লাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মামাত তাহেরের পোশাকটা আঁকড়ে ধরে সমরখন্দের গলিঘুঁজি দিয়ে পথ দেখিযে নিয়ে চললো।
খোদা, বুকটা যেন ভেঙে দিও না। ও যেন বেঁচে থাকে। এ মিনতি রেখো, খোদা, ছ’বছর ধরে নিষ্ফল চেষ্টা করেছে খুঁজে পাবার। এতদিনে সে নিজেকে বুঝিয়েছে রাবেয়াকে খুঁজে পাওয়া তার ভাগ্যে নেই। এই চিন্তায় সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। এখন আশা হঠাৎ যেন ঝলকে উঠল বিদ্যুৎ চমকের মতো। প্রত্যাশায় আনন্দ ও কষ্ট দুই-ই অনুভব করছে সে, কারণ সে প্রত্যাশা বিদুৎ চমকের মতই নিভে যেতে পারে। সে সম্ভাবনার চিন্তায় তার বুকের মধ্যে ভীষণ ব্যথা করে উঠলো।
দু’তলা একটা ইঁটের তৈরী বাড়ী দেখিয়ে মামাত বলল, ‘এই বাড়ী!’
বাড়ীটির পিছনে দেখা যাচ্ছে প্রশস্ত বাগান। বাড়ী, উঠান ও বাগানের সবগুলো ফটকই হাট করে খোলা- বাবরের অস্ত্রধারী সৈন্যরা বাইরে বার করে নিয়ে আসছে শক্ত করে আঁটা অলঙ্কৃত সিন্দুকগুলি, লাল নক্সাকরা গালিচা, মোড়ক, পোঁটলা বাসনপত্র, অনেককিছু। ফজিল ছিল বেশ বড় ধনী ব্যবসায়ী, শয়বানী খানের অন্তরঙ্গ- তার ধনসম্মত্তি সব দখল করে নিয়ে বাবরের কাজে লাগানো হবে।
ফটকের কাছে ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামলো তাহের, মামাতকে কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভুলে গেল সে, পরিচিত সৈন্যরা তাকে কীসব বললো কিছুই শুনতে পেল না সে, সোজা ছুটে গেল সে জেনানা মহলের দিকে। বারান্দায় সাদা কাফনে চাপা দিয়ে শোয়ান রয়েছে ফজিল তরখানের রক্তাক্ত লাশ। বাড়ীর দ্বিতল থেকে ভেসে আসছে মেয়েদের কান্নার আওয়াজ- মৃত ফজিল তরখানের বেগমরা আচার পালন করছে স্বামীর শোকে কেঁদে, কেউ বা কাঁদছে নিহত স্বামীর ধনসম্পত্তি অন্যেরা নিয়ে যাচ্ছে দেখে, আবার কেউ বা কাঁদছে ভয়ে যে এবার তাদের কী হবে।..
নীচের তলার ঘরগুলিতে খোলা দরজা দিয়ে দেখল তাহের। কোথাও কেউ নেই। এখানে ওখানে পড়ে আছে মেয়েদের অলংকার, পোশাক-আশাক। এই তরখানের কয়টা বিবি? রাবেয়া যখন তার হাতে পড়েছে, তখন নিশ্চয়ই রাবেয়াকেও সে বিয়ে করেছে? নাকি সে কেবল… দাসী?
উঠানের মাঝখানে বেরিয়ে এসে তাহের উপরদিকে, যেখান থেকে কান্না ভেসে আসছিল, তাকিয়ে হাঁক পাড়ল, ‘এই, রাবেয়া আছে ওখানে? রাবেয়া! কুভার রাবেয়া আছে ওখানে?’
হঠাৎ কান্না থেমে গেল। মাথায় সবুজ রুমাল বাঁধা এক মহিলা এসে দাঁড়ালো ওপরের বারান্দার প্রানে-। তাহেরের মনে হলো তার চোখ, ভ্রু যেন অত্যন্ত পরিচিত…
রাবেয়া! রাবেয়া!
সবুজ রুমাল বাঁধা মহিলাটি তাহেরকে দেখে চমকে সরে গেল, তারপর আবার এসে দাঁড়ালো, এবার তাহের দেখতে পেল তার মখমলের পোশাক, গলায় মুক্তার মালা। রাবেয়া, সত্যি সত্যি রাবেয়া! কিন’ আবার সরে গেল মেয়েটি, সৈন্যটির বিশাল চেহারা, গোঁফদাড়িভরা মুখ, মুখমন্ডলের ক্ষতচিহ্ন তার মনে ভয় ধরিয়ে দিল, কিন’ গলার স্বর… গলার স্বর তার, তাহেরের। সেই স্বর বার বার ডাকছে, তাকে বোঝাচ্ছে, ‘রাবেয়া! রাবেয়া! আমি তাহের।’
ওপর থেকে তার মর্মবিদারী চিৎকার শোনা গেল, ‘তাহের-আগা।’
এবার সে ছুটে গেল সিঁড়ির দিকে (তাহের দেখলো সিঁড়ি বেয়ে কি দ্রুত নেমে আসছে তার পাগুলি, শুনল টুং টাং করে বাজছে তার বেণীতে ঝোলান ঝুমকো অলংকার। চোখ মুখ সেই আগের দিনের রাবেয়ারই, কিন’ অন্য ধরনের পোশাক-আশাক পরায় তার ভিতর কেমন যেন এক পরিবর্তন হয়েছে।
রাবেয়া ছুটে নীচে এসে থেমে গেল। তাহেরের থেকে চোখ সরাতে পারছে না। তাহের স্তব্ধ হয়ে গেছে প্রতিমার মত। ভয়ে ভয়ে রাবিয়া ফিসফিস করে বলল, ‘আপনি জিন নয় তো, তাহের-আগা?’
অনেকদিন রাবিয়া ধরে নিয়েছে যে তাহের বর্শাবিদ্ধ মারা গেছে তাই প্রতিদিন খোদার কাছে দোয়া করেছে ওর রুহের ওপর রহমত জানাতে। অনেক সময়ই সে দোয়ায় বলেছে, তাকে আর জীবন- কোনদিনই দেখব না, অন্ততঃ স্বপ্নে তাকে দেখতে দাও। খোদা তার দোয়া শুনেছেন নাকি?
‘আমি বেঁচে আছি রাবেয়া! ছ’বছর ধরে খুঁজছি তোমায়।’
‘বেঁচে আছেন আপনি?’ তাহেরের দিকে এগিয়ে এলো রাবেয়া! ছুঁয়ে দেখল তার পোশাক, তরবারি, তার হাতগুলো। তাহের ওকে বুকে চেপে ধরলেই কেবল রাবেয়ার বিশ্বাস হলো সে ভূত নয়…. বেঁচে আছে! খোদা, ও বেঁচে আছে।
তাহের ওর গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে এলোমেলো কথা বলতে লাগলো, ‘রাবেয়া, আমার জীবন! তুমি, তুমিও বেঁচে আছো। ছ’বছর খুঁজেছি তোমাকে! কোথায় ছিলে তুমি? ছ’বছর … তোমাকে ছাড়া…’
হঠাৎ রাবেয়ার মনে পড়ল- এখন কে সে। হায় কপাল! ধনী সওদাগরের সপ্তম বিবি। তাহেরের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ঝটকা দিয়ে, ‘আমাকে ছোঁবেন না, তাহের-আগা। আমি আপনার উপযুক্ত নই।’
ওকে কিনেছিল ফজিল তরখান সেই লুঠেরা সৈন্যদের কাছে একথলি মোহর দিয়ে। বুড়োর প্রতি অসম্ভব ঘৃণা হলো রাবেয়ার। বহুদূরে তুর্কীস্তানের ইয়াসি শহরে ওকে বিয়ে করে বুড়ো, তারপর দিন দশেকের মধ্যেই সম্পূর্ণ ভুলে যায়। বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বুখারা গিয়ে ফিরে আসে সুন্দরী যুবতী স্ত্রী সঙ্গে নিয়ে। বুখারার মেয়েটিই ছিল তার স্ত্রী, আর বাকীরা…ঐ… থাকতো হারেমে, ঐ পর্যন্তই। বয়স্কাদের সঙ্গে যুবতী সেও। আসতো মাঝে মধ্যে (খুব কদাচিৎ) রাতের বেলায় ওর কাছে- বন্দিনী, দাসী মনে করে। ও বাধা দিতো- ফিরে যেতো বুড়ো।… কিন’ এই কলঙ্ক ঘোচাবে কী করে সে, একসময় সে ছিল তাহেরের বাগদত্তা তারপর বিবাহিতা কি না, বোঝার জো নেই…’
মনের দুঃখে কেঁদে ফেললো রাবেয়া মুখে হাত চাপা দিয়ে। তার গলার মুক্তার মালা, বেনীতে লাগান রূপার অলংকার, রেশমী পোশাক- সবই সওদাগরের অর্থে কেনা এ সত্যি।
‘রাবেয়া সত্যি করে বলো তো, তুমি স্বামীকে ভালবাস? সেই জন্য কাঁদছ?’
‘আমাকে বিক্রী করেছে ওর কাছে জোর করে। ওকে ঘৃণা করি আমি, ঘৃণা করি।’
‘তাহলে তুমি কাঁদছ কেন?’
‘তোমার জন্য তো নিষ্কলঙ্ক থাকতে পারলাম না আমি। আমি তোমাকে ভুলে যাই নি তাহেরজান। আল্লাহ্ আছেন মাথার ওপর সাক্ষী।.. আর ঐ সওদাগর.. বাঁদী করতে চেয়েছিল আমায়।’
যে ব্যথায় তাহিরের বুক টনটন করছিল, সেটা চেপে সে বলে ফেলল অবশেষে, ‘তোমার… কোন সন্তান আছে?’
‘কেবল নামেই স্ত্রী ছিলাম আমি।.. স্পর্শ করতে দেইনি আমাকে- বিধবার মতো ছিলাম।… দাসী ছিলাম।’
ব্যথায়, করুণায় ভরে গেল তাহেরের মন। অবশ্যই একথা আগেও ভেবেছে তাহের, অসহায়া রাবেয়ার ওপর কেবল একজন অত্যাচারীর হাতই পড়বে না। তবুও যখন তাকে খুঁজছিলো ভাবছিল কেবল- তাকে জীবিত পেলে হয়। আর এখন সে তার সামনে দাঁড়িয়ে- জীবিত। আগের সেই কুসুমকলিটি আর নেই- হতভাগ্য এক মেয়ে, সন্তান নেই, পরিবার নেই, কুটিল হাতে ভাঙা খেলনা, দামী পোশাক পরা, হারেমের বিধবা… গভীর ক্ষতস্থান সারিয়ে তোলা হলেও, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দাগ রেখে যায় সে। তাহের ভাবল, এসব কিছুর ছাপ রাবেয়ার মন থেকে মুছে দেওয়া খুব সহজ হবে না, আর সে নিজেও যা কিছু এখন শুনছে তা ভুলে যাবে না খুব সহজে। তবুও, তাদের এই মিলনে অশ্রুপাত হলেও এ তাদের জীবনে বিরাট আনন্দও তো এনেছে।
‘রাবেয়া, আর কেঁদো না, ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও যে আমরা দু’জনেই বেঁচে আছি, আমাদের দেখা হল, অবশেষে!… চলো এবার।’
‘কোথায়?’
‘তুমি কি আমার বাগদত্তা নও?’
‘তাহলে, আমি…. আমার জিনিসপত্র নিয়ে আসি।’
‘এখান থেকে কিছু নিতে হবে না। এ সবের কথা ভুলে যাও। এখানকার সব কথা ভুলে যাও। দ্বিতীয়বার আমাকে আর মনে করিয়ে দিও না।’
নিহত সওদাগরের ধনসম্পত্তি তখনও বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল সৈন্যরা, সেদিকে তাকিয়ে লজ্জাজড়িত স্বরে রাবেয়া বলল, ‘বোরখা চাপা না দিয়ে… রাস্তা দিয়ে যেতে লজ্জা… করে আমার।’
তাহের নিজের চোগাটা খুলে দিলো। সেটা মাথায় চাপা দিল রাবেয়া। রূপালী চোগাটা তার পায়ের পাতা পর্যন্ত ঢেকে ফেলল প্রায়। রাবেয়াকে ঘোড়ায় বসিয়ে দিল তাহের।
শীঘ্রই বিয়ে হয়ে গেল তাদের- যুদ্ধের সময়ে আর অপেক্ষা করা চলে না।