পিরিমকুল কাদিরভের “মোগল সিংহ বাবর” ৪ * অনুবাদঃ সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান

৪ কুভা


মোল্লা ফজল উদ্দিন একদিনের জন্য আন্দিজান গিয়েছিলেন, ফিরে এলেন প্রচন্ড দুশ্চিন্তা নিয়ে। নতুন বাদশাহ্ বাবরের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করার ইচ্ছা নিয়ে গিয়েছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল যে সাহায্য পাবেন, তরুণ শাসকের কাছে একবার গিয়ে পড়তে পারলে হয়। স্থপতি জানতেন বাবরকে, শহরের বাইরে বাগানবাড়ীটা তৈরী করার সময়ে প্রায়ই তার সঙ্গে কথা বলেছেন, জানেন সদ্য মুকুটধারী কিশোর বাদশাহর অসম্ভব ক্ষমতা, কবিতা মনে রাখার আর কবিতা তিনি ভালোও বাসেন। ছবিও ভালবাসেন সেই জন্যই স্থপতি তাকে মহান নবাইয়ের প্রতিকৃতি উপহার দিয়েছিলেন। প্রতিদানে বাবর তাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন জরির চাপকান। এবার তিনি বাবরকে বলবেন ভেবেছিলেন যে কী অত্যাচার তার ওপর করেছে স্বেচ্ছাচারী বেগরা, বাবর অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন।
কিন’ বাবরের কাছে যেতে দেওয়া হল না স্থপতিকে। উজুন হাসান আর ইয়াকুব বেগ যেতে দিল না।
প্রথমজন মোল্লা ফজল উদ্দিনকে পাঠাল দ্বিতীয় জনের কাছে, ইয়াকুব বেগের কাছে। সবচেয়ে ধনী ও চাটুবাক্য বলতে সক্ষম এই বেগটি প্রতিরক্ষা ভান্ডারে অন্যান্যদের থেকে অনেক বেশী অর্থ দিয়েছে, আর সহচর, ভৃত্যও সে, দরকারের সময় লাগতে পারে বলে, রেখেছিল অন্যদের চেয়ে বেশী সংখ্যায়। প্রতিবারেই বাবরের সামনে সে আনুগত্য প্রদর্শন করত অন্যদের থেকে অনেক বেশী কৌশলে। এসবে কাজ হল। ইয়াকুববেগ হলেন উজীরে আজম, সব থেকে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি। সেই জন্যই ফজল উদ্দিন রাজ্যে স্থপতির কাজ বাবদ তরুণ মির্জার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের অনুরোধ জানালে উত্তরে তাকে থামিয়ে দিয়ে ইয়াকুব বেগ বলল, ‘তরুণ বাদশাহের প্রয়োজন এখন যোদ্ধার, স্থপতি নয়! যত বেশী দক্ষ যোদ্ধা পাওয়া যায় ততই ভাল। যুদ্ধ শেষ হলে, আসবেন।’
মর্যাদাসহ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকা স্থপতির পাশ কাটিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাবার সময় একটু ব্যঙ্গ করেই বলল, ‘ঐ যে ওখানে সিপাহী হবার জন্য নাম লেখানো হচ্ছে। যান ওখানে, সিপাহী হবেন!’
‘বেঁচে থাকলে সেই দিন দেখতে পাব যখন স্থপতিরও প্রয়োজন হবে!’ বেগের পিছন পিছন বললেন মোল্লা ফজল উদ্দিন।
কেল্লার মধ্যে যেখানে ইয়াকুব বেগ আর উজুন হাসান প্রতিপত্তি খাটাচ্ছে, সেখানে থাকা নিরাপদ নয়। মোল্লা ফজল উদ্দিন জানতে পেরেছেন কী ভাবে ও কেন গোবের মৃত্যু হলো। সেইজন্যই তিনি কুভাতে বোনের বাড়ী ফিরে গেলেন।
ভাগিনা, বোন, ভগ্নীপতি সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে শত্রুসৈন্য এগিয়ে আসার অপেক্ষায়, যারা ইতিমধ্যেই কার্কিদোনে সংকেতের আলো জ্বালিয়েছে। স্থপতি সিন্দুকটা আবার লুকিয়ে ফেলতে চাইলেন।
‘গম রাখার গর্ত একটা ফাঁকা আছে তোমাদের?’ বোন আর ভাগ্নিপতিকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
‘আছে, বিচালী-ঘরে।’
‘তাহের কোথায়?’
‘মাহ্‌মুদের সঙ্গে কোথায় গেল যেন। আমরা নিজেরাই পারবো এ কাজ।’
লোহার সিন্দুকটা আবার বস্তায় ভরা হলো, বহুদিন খালি পড়ে থাকা গর্তের গভীরে সেটাকে রাখা হলো, গর্তের মুখ কাঠের তক্তা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হলো, তার উপরে ঘাসপাতা চাপা দেওয়া হল একগাদা।


রাতের বেলায় আবার কালো কালো মেঘ দেখা দিল আকাশে। ছাড়া ছাড়া, কিন’ বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল- জোর বৃষ্টি নামার পূর্বলক্ষণ।
কুভা জনহীন, নিস্তব্ধ। সবাই বাড়ীতে বসে, যদি মাঝে মধ্যে দু একটা কুকুরের ডাক না শোনা যেত তো মনে হতে পারত যে গোটা কুভা কোথায় যেন চলে গেছে।
কুভাসাইয়ের পুলও জনহীন, নিস্তব্ধ। দেখা গেল তাহির ঠিকই বলেছে প্রহরীরা পালিয়েছে।
ঠিক মাঝরাতে পুলের দিকে যাবার পথের উপর কাদের যেন ছায়া দেখা গেল। ঐ আর একটা ছায়া ভেসে উঠল।
‘কাঠ আর আগুন এনেছিস?’ চাপা স্বরে কথা বলতে চেষ্টা করছে তাহের।
‘এনেছি,’ খাটো চেহারার, বদনাকাঁধে লোকটিও ফিসফিস করে উত্তর দিল। খাটো চেহারার লোকটির পোশাক থেকে তিল তেলের গন্ধ বেরোচ্ছে, তেলের ঘানিতে কাজ করে সে।
কপালে, গালে বৃষ্টির ফোঁটা অনুভব করে তাহের উপরদিকে তাকাল। মেঘ ক্রমশ ঘন আর ভারী হচ্ছে, একটা তারাও দেখা যাচ্ছে না।
জোর বৃষ্টি নামবে। তাহলে আগুন জ্বলবে না, ভাবল তাহের। পুলের কাঠ এর মধ্যেই বোধ হয় স্যাঁত সেঁতে হয়ে গেছে।
‘উমুরজাক, আমি একটা কুড়াল নিয়েছি, আরো কুড়াল চাই, আর চাই দু’হাতলওয়ালা করাত। তুই ছুতোর, তোর এ সবই আছে।’
‘করাত কী হবে?’
‘জিজ্ঞেস করে সময় নষ্ট করিস না। মাহ্‌মুদ তুইও ওর সঙ্গে যা, তাড়াতাড়ি কর, ভাই।’
একটু পরেই সবকিছু তৈরী হয়ে গেল।
এই যে পুল।
পুলের প্রহরী যে আন্দিজানে পালিয়ে গেছে সেকথা কেবল তাহেরই জানে না, জানে শত্রপক্ষও, সেইজন্যই তাড়াতাড়ি করা দরকার, হয়ত কাল সকালেই তারা পুল পেরিয়ে চলে আসবে।
পুলের কাছে বড় গাছটার নীচে সঙ্গীদের দাঁড় করিয়ে তাহের বলল, ‘আমাদের ক্ষতি হবার আর কিছুই নেই ভাই, শত্রুবাহিনীর মুখে আমাদের ফেলে রেখে পালিয়েছে বেগরা আর সৈন্যরা। আবার বলি “নিজেই নিজের জন্য মর রে অনাথ!”। আর যদি আমাদের ভাগ্য ভাল হয় তো আমরা আমাদের পরিবার পরিজনসমেত মস্ত বিপদের হাত থেকে বাঁচবো। কুভাসাইয়ের মত নদীর ওপর আবার সাঁকো তৈরী করা খুব সহজ নয়। আর যদি কোন কারণে আমরা সফল না হই… তো মুখবন্ধ রাখতে হবে সবাইকেই, সে যাই ঘটুক না কেন।’
‘শপথ নিলাম,’ দৃঢ়স্বরে বললো মাহ্‌মুদ। ‘যদি আমাদের মধ্যে কেউ শত্রুর কাছে গোপন কথা ফাঁস করে দেয়, তো… তো সে যেন নিজের মাকে ভোগ করে।’
‘তাই হোক! তাই হোক!’
সবাই পুলের ওপর উঠল গিয়ে। তাহেরের উদ্দেশ্য ছিল চল্লিশ-পঞ্চাশ পা গিয়ে পুলের মাঝখানে আগুন জ্বালাতে। যত দূরে তারা যাচ্ছে ততই অসহায় বোধ করছে তারা। দু’পাশের খোলা জলে পুলটা তত অন্ধকার দেখাচ্ছে না। তাদের দেখতে পেতে পারে কেউ! অগ্রাগামী শত্রু সৈন্যদলের কোন তীরন্দাজের পক্ষে তারা চমৎকার চাঁদামারি হতে পারে। এমন সময় আবার ছুতোরের হাতের করাত তাহেরের হাতের কুড়ালে ধাক্কা লেগে এমন আওয়াজ তুলল যে ছেলেরা সবাই কেঁপে উঠল, থেমে গিয়ে কান খাড়া করে আওয়াজ শুনতে লাগল, খানিক অপেক্ষা করল। ভাল কথা যে হাজার হাজার ব্যাঙ ডাক থামায় নি।
‘আর দূরে যাবার দরকার নেই, তাহের, কেমন?’ ফিসফিস করে বলর মাহ্‌মুদ। ‘যদি ওদিক থেকে ওরা আসে তাহলে আমরা পালাব কেমন করে সে কথা ভেবেছিস?’
‘একজনকে গোটা পুলটা পেরিয়ে যেতে হবে। উমুরজাক ঐদিকে গিয়ে পাহারা দিক। ভয় পেও না তোমরা। ওরা এখান থেকে অনেক দূরে।’
আরো জোরে বৃষ্টি নামল। তাতে দূরে জ্বলতে থাকা আগুনগুলি সব নিভে গেল। শত্রুরা এবার তাদের আর দেখতে পাবে না।
পুলটি লম্বা, তিনটি ভিত্তিস্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে। ত’হের পুলের পাশের গরাদ পেরিয়ে নীচে ঝুঁকে দেখলো, এই যে তাদের তীরের কাছে পুলের প্রথম ভিত্তিস্তম্ভ। এখানে সে উমুরজাক বাদে বাকী সবাইকে দাঁড় করালো। উমুরজাক আরো দূরে চলে গেল যেখানে দাঁড়িয়ে তার পাহারা দেবার কথা। তাহের লোকদের বিভিন্ন জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল তারা যেন কুাূলের সাহায্যে চটপট পুলের কাঠের ওপরের স্তরটা তুলে ফেলে আর তখনি শুকনো কাঠের ওপর তেল ঢেলে দেয়। নিজে আগুন জ্বালাতে বসল বৃষ্টি থেকে শুকনো খড়কুটো আড়াল করে। কয়েক বার ব্যর্থ চেষ্টার পর চকমকি দিয়ে আগুন জ্বালালো আর তখুনি বিকট ধোঁয়ার গন্ধ এসে নাকে লাগল। তেলের ঘানিতে কাজ করা লোকটি খুবই চটপটে, একটা কাঠের টুকরো জ্বালিয়ে দিলো। তাহের যে দড়ির ফেঁসোগুলো বইছিল এতক্ষণ ধরে, তাতে আগুন লাগিয়ে দিল এবার।
পুলের ওপরের তক্তার আচ্ছাদনের ওপরে সামান্য একটু আগুন জ্বলে উঠল, কিন’ হাওয়া আর বৃষ্টির ফোঁটা নিভিয়ে দিল সে আগুন।
‘তেলটা বড় বাজে, জ্বলছে না,’ গজগজ করল মাহ্‌মুদ।
‘বৃষ্টি হচ্ছে তো,’ তেলের ঘানির লোকটি বলল। ‘এটুকু যে পাওয়া গেছে তাই কপাল ভাল বুঝলি।’
‘আসে-,’ ফিসফিস করে বলল তাহের, ‘খড়কুটোটা জ্বলুক।’
তাহের তাড়াতাড়ি দুটি কোমরবন্ধকে কষে বাঁধল, তার একদিক নিজের কোমরে বাঁধলো আর অন্য দিক বাঁধলো পুলের গরাদে। তারপর গরাদ পেরিয়ে ঝুলে পড়লো, পা দিয়ে দিয়ে ভিত্তিস্তম্ভটা খুঁজে পেয়ে তার আড়কাঠের ওপর দাঁড়াল। বৃষ্টির ছোঁয়া না লাগা কাঠটার ওপর শুকনো খড়কুটোর গাদা রাখলো, তেল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। তাড়াতাড়ি আগুন জ্বলে উঠলো, কিন’ খড়কুটো খুব তাড়াতাড়ি জ্বলে গেল, হাওয়ার দমকা এসে আগুনের ফুলকিগুলো উড়িয়ে নিয়ে ফেলল পানির মধ্যে।
ওপরে লাফিয়ে উঠে তাহের প্রচন্ড রাগে কুড়াল তুলে নিয়ে গরাদ কাটতে লাগল।
‘নে, নে জ্বলছিস না যখন! এই নে, নে!’
তেলের ঘানির লোকটাও কুড়াল তুলে নিয়ে অন্যদিকের গরাদটা কোপাতে লাগল।
‘আরে দাঁড়া, তাহের কী হবে এতে?’ চীৎকার করে উঠল মাহ্‌মুদ। ‘কুড়ালটা আমার দে দেখি বরং। এই দেখ, এই তক্তাগুলো পেরেক দিয়ে আঁটা- আমরা ঐ তক্তাগুলোকে উপড়ে উপড়ে ফেলে দেব।’
‘এটা একটা উপায় হতে পারে।’ অন্ধকারে কিছু বোঝাই যাচ্ছে না কোথায় পেরেক, কিন’ মাহ্‌মুদ হাতের ছোয়ায় সেগুলোকে খুঁজে পাচ্ছে। দু’জনে মিলে অবশেষে একটা বিরাট তক্তা খুলে ফেলল যেটা পুলের ওপর আড়াআড়িভাবে লাগান ছিল। কিন’ দ্বিতীয় তক্তাটা খুলে ফেলতে শক্তিতে কুলোল না আর।
‘আয় ভাই, করাত দিয়ে কাটি।’ বলল মাহ্‌মুদ। আড়াআড়ি বসান কাঠটা করাত দিয়ে কাটতে লাগল।
‘তাড়াহুড়ো করিস না,’ বলল তাহের। ‘একই কথা, আড়াআড়িভাবে পাঁচ-ছটা তক্তা খুলে ফেলে এমন কিছুই ক্ষতি করতে পারব না আমরা।’
‘কেন? এমন একটা গর্ত করে ফেলব যে ঘোড়া বা গাড়ী যেতে পারবে না।’
‘যে কোন ছুতোর ঝটপট তা মেরামত করে ফেলবে। তুই কি ভাবিস ওদের ছুতোর নেই নাকি? বেঢপ মোটা। ওগুলোকে কাটা যাবে না।’
‘কেটে ফেলব,’ উত্তেজিত হয়ে উঠল তাহেরও।
দু’জোড়া করে ছেলেরা পালা করে করে করাত দিয়ে ভিত্তিস্তম্ভের আড়কাঠগুলি কাটতে লাগল। উষ্ণ বৃষ্টিধারা ফোঁটা ফোঁটা পড়েই চলেছে, কিন’ জোরে নামছে না, কাজ করতে থাকা ছেলেগুলির ঘামের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে বৃষ্টি- শেষে তাদের পোশাক ভিজে গেল একেবারে। ছেলেগুলি ভেবেছিল দু’তিন জায়গায় আড়কাঠ কেটে দেবে, যাতে সেগুলি পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত না থাকে, কিন’ তারা বুঝছিল না তাদের পরিকল্পনা যদি সফল হয় তো তারা সবাই এই গাছের গুঁড়ি আর তক্তাগুলো সমেত কুভাসাইয়ের জলে পড়বে হুড়মুড়িয়ে। কিন’ পুল তাদের প্রত্যাশামত ভেঙে পড়ল না। আরো কিছু পেরেক, আড়কাঠ তাকে ধরে রেখেছে। তাহের আর মাহ্‌মুদ আবার কুড়ূল তুলে নিল। এক জায়গায় পুলটা হঠাৎ মড়মড় করে উঠল, একটু বেঁকে গেল, কিন’ দাঁড়িয়ে রইল আগের মতই।
‘হয়েছে!’ বিদ্ধস্ত মাহ্মুদ বললো, ‘এ পুল ভাঙা আমাদের কর্ম নয়।’
‘চুলোয় যাক!’ বললো তাহের, তারপর আবার গরাদ কাটতে লাগল। এমন সময় উল্টো দিক থেকে উমুরজাক ছুটে এল, ‘শেষ কর! অমন দুমদাম আওয়াজ কোরো না! মনে হচ্ছে শত্রুরা রওনা দিয়েছে এবার।’
‘তুই দেখলি?’
‘শুনলাম চীৎকার, ঘোড়ার চড়! সারি বাঁধ… তার মানে, শীগগিরি এদিকে এসে পড়বে ওরা!’
‘পালাবার জন্য ব্যস্ত হোস না, করাত নে। কোন কিছু ফেলে রেখে যেও না এখানে।’ আদেশের সুর বলল তাহের, তারপর বাকী পড়ে থাকা খড়কুটোগুলো, কাঠের টুকরোগুলো সব জলে ফেলে দিল। পাঁচটি যুবক ব্যর্থতায় হতাশ ও ক্লান্ত হয়ে যে যার ঘরে ফিরে গেল।
পুবদিকে আকাশ লাল হয়ে আসছে।


সেহরীর পরে শত্রু সৈন্য এগোতে আরম্ভ করলো। অগ্রগামী দলটি পুলের ওপর এসে উঠলো যখন তখনও ভোরের কুয়াশা কাটে নি। জোরে বৃষ্টি হয়েছে কেবল এখানেই নয়, হয়েছে পাহাড়ে, তাই কুভাসাইয়ের পানি অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছে, প্রচন্ড দ্রুত গতিতে সে স্রোত ছুটে চলেছে। অগ্রগামী দলের অশ্বারোহীরা সহজেই পুল পেরিয়ে গেল, সংখ্যায় তারা অল্প, একজন একজন করে সারি বেঁধে যাচ্ছিল।
তার পরের সারিগুলো যাচ্ছিল গোটা পুলটা ভরে গায়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। অনুচররা বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল লুঠকরা মালপত্র উটেটানা গাড়ীতে করে। অশ্বারোহী দল, গাড়ী, উটের দল- এসব কিছুকে যেন প্রত্যুষের ম্লান আলোয় ধোঁয়াটে মেঘের মত মনে হচ্ছে। যেন কালো ময়লা জলের প্রবাহ এসে ঢেকে দিয়েছে পুলকে।
সেই ভিত্তিস্তম্ভটা যেখানে কুভার যুবকরা কেটে রেখেছিল মড়মড় করে ভেঙে পড়ল। এমন সময় আবার একটা ঘোড়া পা আটকে গেল দুটি তক্তার মাঝে এক গর্তে। ঘোড়াটা পা ছাড়িয়ে নেবার জন্য টানাটানি চেঁচামেচি করতে লাগলো। তার পিঠে চড়ে থাকা লোকটি আচমকা ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল পুলের ওপর, পিছন থেকে আসা ঘোড়াগুলির পায়ের নীচে। সামনে পুলের তক্তা ভাঙার মড়মড় আওয়াজ, পুলে পড়ে যাওয়া লোকটির প্রচন্ড আর্ত চীৎকার ঘোড়াগুলোকে ভয় পাইয়ে দিল। তারা পিছিয়ে আসতে লাগলো, সারি ভেঙে সব একাকার হয়ে গেল।
ওদিকে পিছন দিক থেকে ক্রমশ ঠেলা আসছে তো আসছেই। এই ধাক্কাধাক্কি ঠেলাঠেলিতে পুলের ওপর চলাচল একেবারে থেমে গেল, তার ফলে দাঁড়িয়ে থাকা যানবাহন ও লোকের ভার সামলাতে পারল না পুুুল, হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল; ঘোড়া, লোকজন, গাড়ী, গুঁড়ি তক্তা সব কিছু নদীর কবলে পড়লো, জলের উচ্চতা একদিক উঠে এসেছে পুলের নীচের আড়কাঠ পর্যন্ত প্রায়।
যারা পুলের ওপর ছিলো- পিছু হঠবার চেষ্টা করলো। কিন’ পিছন দিক থেকে তখন চাপ আসছে। এখনও পুল ভাঙার খবর না পেয়ে সিপাহসালার যাদের পাঠাচ্ছে তারা ক্রমশ এগোবার চেষ্টা করছে। ধাক্কাধাক্কিতে লোক পড়ে যাচ্ছে নদীতে- তাদের মরীয়া চীৎকার জানান দিচ্ছে নদীর নতুন বলির কথা। পুলের বেশ কয়েক জায়গায় গরাদ না থাকায় নদীস্রোতে পড়ে যাচ্ছে বেশ কিছু লোক। বোঝাইকরা গাড়ীগুলো একে অন্যের ওপর উঠে যাচ্ছে, পথ আটকে দিচ্ছে, তাদের পুলের গরাদে একেবারে ঘেঁসিয়ে দিচ্ছে ঠেলাঠেলি করে, গরাদের বাকী অংশগুলিও ভেঙে ভারী আওয়াজ তুলে নীচে গিয়ে পড়ছে। কেউ কেউ চাবুক চালিয়ে পথ করে নিতে চাইলো, কেউ কেউ আতঙ্ক বন্ধ করার জন্য তলোয়ার হাতে তুলে নিল, কিন’ নদীতে ধসে পড় লোকজনের সঙ্গে তাদেরও স্থান হলো নদীতে। যানবাহন লোকজনের জটটা আরো পাকিয়ে উঠলো। আরো বেশী করে লোক মরতে লাগলো।
সমরখন্দের বাদশাহের কাছে পুলের দুর্ঘটনার খবর পাঠানো হলো। সুলতান আহ্মদ নিজের দেহরক্ষীদের মধ্যে থেকে লোক পাঠালেন নদীতে পড়া লোকদের বাঁচাবার জন্য। এ হলো আর এক ভুল। লোকগুলি নলখাগাড়ার ঝোপ পেরিয়ে নদীর পাড়ের কাছে এগিয়ে গেলো আর ডুবে যেতে লাগলো জলার মধ্যে। তাদেরই এখন বাঁচাবার প্রয়োজন হয়ে পড়লো- দড়ির ফাঁস লাগিয়ে তুলে আনা হলো কয়েকজনকে, আরও অনেক ডুবে গেলো জলার মধ্যে।
অনেকে জলাভূমির কবলে পড়লো যারা নদীতে পড়েও ভাল সাঁতার জানার ফলে স্রোতের সঙ্গে সংগ্রাম করে তীরের জলাভূমিতে পৌছায়, সেখানেও বিশ্বাসঘাতক আলগা মাটির কবলে পড়ে নিস্তার পেল না। নদীস্রোত ও জলাভূমি রূপকথার ডাইনীর মত গ্রাস করছিল লোক, ঘোড়া, উট সবকিছু। নদীতে পড়া লোকেদের চীৎকারের সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছিল জলাভূমিতে বসা লোকদের চীৎকার। পুলের ওপরও বেশ কিছু লোক পদদলিত হয়ে মরে পড়ে রইলো।
সমরখন্দের সুলতান আহমদের সৈন্যবাহিনীর দু’তিন ঘন্টায় যা ক্ষতি হল যুদ্ধের একেবারে শুরু থেকে এ পর্যন্ত তেমনটি হয় নি।
এছাড়া এমন দুর্ঘটানার কারণও কেউ জানতো না, তাই সবাই বলতে লাগলো যে আল্লাহ্ ফরগানাবাসীদের পক্ষে, শত্রুপক্ষকে শাসি- দিয়েছেন তিনি।


কুভাবাসীরা ছাদে, বারান্দায় উঠে দেখতে লাগল পুরের ওপর সৈন্যবাহিনী কেমন করে মৃত্যু বরণ করছে- সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মরছে লোকে। অনেক কুভাবাসী মনে মনে দোয়া করছিল যেন আল্লাহর গজবের শীঘ্র উপশম না হয়। আবার কিছু লোক দুঃখ পাচ্ছিল, হায়, হায়। জোয়ান জোয়ান লোক ডুবে মরছে নদীতে, জলায়।
গত সন্ধ্যায় তাহের মামাকে একটু ইঙ্গিতে জানিয়েছিল পুলে তাদের অভিযানের কথা, আর ভোরে বলেছে তাদের উদ্দেশ্যে শেষ পর্যন্ত সফল হয় নি। মোল্লা ফজল উদ্দিন বাড়ীর ছাদ থেকে যখন দেখলেন পুলের ওপর কী ঘটছে, তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এসে তিনি ইঙ্গিতে তাহেরকে উঠানের এক কোণে যেতে বললেন, ‘বন্ধুদের গিয়ে বল এখুনি সবার লুকিয়ে পড়া দরকার।’
‘কেন, মামা?’
‘কাল তোরা পুলটার যেখানে আড়কাঠ কেটেছিস সেখানেই ভেঙে পড়েছে ওটা। তোরা যদি পুলটা জ্বালিয়ে দিতিস তাহলে ওদের এত ক্ষতি হত না, একটু সরিয়ে নিয়ে আবার এগোতে পারতো। আর এমন ফাঁদে পড়ার পরে বুঝতে বাকী থাকবে না কাদের এ কাজ। পুল সরিয়ে এ পারে এসে তোদের সবাইকে কেটে ফেলবে। আমাদেরও সেই সঙ্গে।’
‘কিন’ ওরা এখনও তো ওই পারে?’
‘চররা এপারে পৌঁছে গেছে দেখেছি আমি… কথা বলে সময় নষ্ট করিস না, কাজে লাগ্। নলখাগড়ার বনে গিয়ে লুকিয়ে পড়। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি….’
মামার উপদেশ জানালো তাহের বন্ধুদের, ‘দড়ি আর কাসে- নিও সঙ্গে। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে বলবে কাঠ কাটতে যাচ্ছি। দু’তিন দিনের মত খাবার নিও সঙ্গে।’
পাঁচজন যুবক যাতে কারো চোখে না পড়ে এমনিভাবে একে একে গ্রাম ছেড়ে গেল। নলখাগড়ার গভীর, অভেদ্যপ্রায় বনে গিয়ে মিলিত হল তারা।
শত্রুরা চরেরা ইতিমধ্যে মোড়লকে খুঁজে বার করে তার সাহায্যে কুভার যত ছুতোরকে জড়ো করে পুলসারাইয়ের কাজে লাগালো। শত্রুসৈন্যরা ওপার থেকে গুঁড়ি তক্তা টেনে টেনে আনতে লাগলোা। পুলসারাইয়ের কাজে তাহেরের বাবাও ছিল। সে জানে যে রাতের বেলায় ছেলে কোথায় যেন গিয়েছিল, ভোরের আগেই অত্যন্ত ক্লান্ত অবস্থায় বাড়ী ফিরে আসে। একজন ছুতোর তাকে দেখালো করাতের দাগ, কিন’ তাহেরের বাবা মুখে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করতে বললো, ‘এসম্বন্ধে একটা কথাও না। জানতে পারলে আজই কুভা জ্বালিয়ে দেবে। ঘাড়ে মাথা থাকবে না আর আমাদের।’
‘ঠিক বলেছেন আপনি।’
দু’দিন ধরে পুলটা সারাবার সময় ছুতোরদের কেউই মুখ খুলল না।
শত্রুসৈন্য সতর্কভাবে পুল পেরিয়ে গেল, সবার শেষে গেলেন সুলতান আহমদ নিজের দেহরক্ষীদের নিয়ে, কুভাতে না থেমে এগিয়ে চললেন আরো।
মালবোঝাই গাড়ী, উট আর সৈন্য দলের কিছু অংশ ওপারে রয়ে গেল: বোঝা গেল গত দু’দিনে তাদের পরিকল্পনায় কিছু অদলবদল হয়েছে।
নলখাগড়ার বনে বসে শানি- পাচ্ছে না তাহের। রাবেয়ার জন্য চিন্তা হচ্ছে। সে জানে রাবেয়ার বাবা-মা তাকে ভাল করেই লুকিয়ে রাখবে, কিন’ শয়তান জানে যখন শত্রুর চর ঘুরছে পায়ে পায়ে তখন কখন যে কী হবে। সেই সঙ্গে তৃতীয় দিনে তাদের খাবারদাবারও ফুরিয়ে গেল। বাড়ীতে একবার ঘুরে আসা দরকার। সন্ধ্যাবেলায় তাহের এক বোঝা নলখাগড়া নিয়ে রওনা দিলো। বাড়ীর কাছে এসে দেখে ফটকে শিকল লাগান, ফটকের এক ফাটল, যা কেবল তারই জানা, তার মধ্যে দিয়ে হাত গলিয়ে শিকলটা খুলে ফেললো। উঠোনে আধাঅন্ধকারের মধ্যে দেখতে পেল মোল্লা ফজল উদ্দিনকে, চালাঘরের ছাঁচতলার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি গাড়ির চাকাটা দেখছেন। কাঁধে নলখাগড়া বয়ে নিয়ে তাহেরকে আসতে দেখে তিনি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন তার দিকে, হাত তুলে বললেন, ‘মোবারক হোক তোর ভাগনে, শানি-তে চুকে গেছে সব!’
‘লড়াই থেমেছে?’
‘আল্লাহ্র রহমে থেমেছে।’
বোঝাটা ফেলে দিল তাহের। মামা তাহেরকে বুকে চেপে ধরে আবেগাপ্লুত স্বরে ফিসফিস করে বললেন, ‘তোমাদের বীরত্ব বৃথা যায় নি, তাহেরজান। শুনছি, সমরখন্দের বাদশাহ নিজেই শানি-র প্রস্তাব দিয়েছে। কুভাসাইয়ে এত সৈন্য হারিয়ে আক্কেল হয়েছে, বোধহয়। আল্লাহ্র গজবে পড়ার ভয় হয়েছে।’ ভাগনের বলিষ্ঠ কাঁধে হাত বোলাতে বোলাতে বলতে লাগলেন, ‘চমৎকার হয়েছে, অপূর্ব! এত এত অতি বুদ্ধিমান ধনী বেগরা শত্রুদের কিছু করতে পারল না আর তোমরা সাধারণ কয়েকটি ছেলে ওদের দারুণ ঠেকিয়েছ… কিসান, হুনরী, ছুতোর… আর কে….’
‘কলু।’
‘হ্যাঁ, কলু,’ খুশীতে জোরে হেসে উঠলেন মামা, ভাগনেকে আলিঙ্গনমুক্ত করে দিয়ে প্রশংসাভরা চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ‘কিসান, হুনরীদের…. এই তোদের মত লোকদের. . নাক-উঁচু বেগরা যাদের ডাকে কালো হাড় বলে, এই ‘কালো হাড়’ না থাকলে কে আজ এই বিপদ থেকে বাঁচাত ওদের? কে?’
‘আরে আমরা নিজেরাও বুঝতে পারিনি এমন চমৎকার হবে।…. আর আপনি এসে পড়ায় খুব ভাল হয়েছে… আপনি না বললে আমার মাথায়ও আসতো না…’
‘খুব ব্যাপার ঘোরাতে জানিস দেখি, ভাগনে! আমাকেও সেই সঙ্গে আসমানে তুলে দিলি।’ মোল্লা ফজল উদ্দিন কথা বলেই চলেছেন দ্রুত উত্তেজিতভাবে, কখনও জোরে আবার কখনও গলা নামিয়ে, যেন এখনও কোন বিপদের ভয় রয়েই গেছে।
‘মামা, কুভাতে ওরা আছে এখনও?’
‘আছে। সৈন্যদল যাচ্ছে এখনও, পাহারা ওঠায় নি। আন্দিজান থেকে চার ক্রোশ দূরে তাদের শাসক সন্ধি করেছে, এবার ফিরে গেছে তারা। তার রক্ষীদের কিছু অংশ ইতিমধ্যেই নদীর অন্য তীরে পৌঁছে গেছে, আমি নিজ চোখে দেখেছি। সুলতান তাদের সঙ্গে আছে কি নেই, তা জানি না, বাকীরাও শীগগিরি পৌছে যাবে এখানে। এখনও সতর্ক থাকতে হবে তাহেরজান। শত্রু আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে পিছু হঠার সময়। বাড়ীর ভেতরে যা। লোকেদের সামনে বেরোবার দরকার নেই।’
নিজের গায়ের থেকে খড়কুটোগুলো ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বাড়ীর মধ্যে ঢুকল তাহের, পাশের বাড়ীতে ছোট বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তখনি তাহেরের মনে পড়ল রাবেয়ার কথা, বুকের মধ্যে ধক্ করে উঠলো। ওর জন্য এখন মন কেমন করছে। সম্ভব হলে ও পাঁচিল পেরিয়ে পাশের বাড়ীতে গিয়ে ঢুকতো। রাবেয়াকে বলতো যে যুদ্ধ থেমে গেছে। হয়তো ও এখনও জানে না সন্ধির কথা। ওর খুশীমুখ দেখতে পেতো। না, না, ও এমন করবে না, বরাবরের মত রাবেয়ার সঙ্গে গোপনে, নির্জনে দেখা করবে।
তাহের বাড়ীর ভিতর ঢুকে বাবা-মাকে সন্ধির জন্য অভিনন্দন জানানো মাত্রই শোনা গেল কুকুরের ডাক, ঘোড়ার খুরের আওয়াজ আর ফটকে ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজ। বিচালী ঘরে যাওয়া দরকার শীগগির।
খঞ্জরের হাতলটা চেপে ধরে বিদ্যুৎগতিতে সে বারান্দার মধ্যে দিয়ে এক মুহূর্তে গোপন জায়গায় পৌঁছে গেল, জায়গাটা শুকনো নলখাগড়ার বোঝায় ঢাকা।
দরজায় জোরে ধাক্কা চলতেই থাকল। খুলতেই হল দরজা। শিরস্ত্রাণ পরা একদল অশ্বারোহী সৈন্য, ঘোড়ার জিনের সঙ্গে ফিতে দিয়ে ধনুক বাঁধা, চওড়া সালোয়ার এসে পড়েছে উঁচু জুতোর ওপর, উঠোনে এসে ঢুকলো। দু’জন বসেছিল একটা কালো ঘোড়ার ওপর। কোন কথা না বলে চারদিকে তাকালো যেন বাড়ীর মালিককে দেখতেই পাচ্ছে না।
সৈন্যদলের ওপরওয়ালা শিরস্ত্রাণের সুক্ষ্ম শেষাগ্রে সবুজ কাপড়ের ছোট পতাকা লাগানো, চালাঘরের ছাঁচতলার কাছে জিন না পরানো ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে দেখে কালোঘোড়ায় বসে থাকা দু’জনকে বলল, ‘ঐ যে, তোর জন্য।’
ঝাঁকড়া গোঁফ, নিগ্রোর মত কালো চেহারার ছেলেটি লাফিয়ে মাটিতে নেমে ঘোড়ার দিকে ছুটে গেল। বাকীরা ওপরওয়ালার ইঙ্গিতে বাড়ীর মধ্যে ঢুকলো। উঠোনে টেনে বার করতে লাগলো নতুন নতুন যত চাদর, গালিচা, কতকগুলো পুঁটলি।
মোল্লা ফজল উদ্দিন বারান্দার থামে হেলান দিয়ে পাথরের মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে দেখছিলেন কী ঘটছে। প্রথমটা উনি ভেবেছিলেন সৈন্যরা এসেছে তাহেরকে খুঁজতে। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন’ এরা অতি সাধারণ লুঠেরার দল। তাহেরের বাবা-মা দিশাহারা, স্তব্ধ। আর থাকতে না পেরে মোল্লা ফজল উদ্দিন বললেন, ‘এই যে হাবিলদার সাহেব!’ সর্দার তখনও উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। ‘বিবেক নেই তোমাদের? আমাদের বাদশাহের মধ্যে সন্ধি চুক্তি হবার পর ইসলামের আইন অনুযায়ী এমন লুঠপাঠ করা অন্যায়!’
কালো ছেলেটি মোল্লা ফজল উদ্দিনের ঘোড়ার জিন পরিয়ে তাড়াতাড়ি চড়ে বসে হেসে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ সন্ধি….’ তারপর আবার ব্যঙ্গ করে বলল, ‘নিশ্চয়- আমাদের শানি- আর উন্নতি হোক!’
অন্যজন জিনিসবোঝাই একটা পোঁটলা খুলে রেশমী কাপড়ের একটা টুকরো বার করে সর্দারের হাতে তুলে দিল, ‘আপনার ভাগ।’
সর্দার মোল্লা ফজল উদ্দিনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অলস ভঙ্গীতে কাপড়ের টুকরোটা জিনের পাশে বাঁধা থলির মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো, তারপর অলসভাবে আসে- আসে- বলল, ‘আমাদের ষাটটা ঘোড়া মড়কে মরেছে। এমনই বিপদ! তুই ঘোড়ায় চড়ছিস আর আমার সৈন্য কি পায়ে হেঁটে যাবে সমরখন্দে তোর মতে? দু’জন সৈন্য একটা ঘোড়ায় বসেছিল দেখলি তো!’
তার উচ্চারণে বোঝা যায় যে সে সমরখন্দের লোক।
‘দেখেছি। নিন, যদি চান। কিন’ ওই ঘোড়াটা গাড়ীটানার জন্য, ওর ওপরে জিন চাপানোর জন্য না। যদি মনে করেন ঐ বীর সৈন্যকে ঘোড়াটা সমরখন্দ পৌঁছে দেবে, তা নিন। কিন’ মেয়েদের পুঁটলির মধ্যে ঘাঁটাঘাটি করা? এ কি আপনার মত খানদানী লোকের উপযুক্ত কাজ?’
‘আরে, আমাদের বিবিরা বলেছে ফরগানার রেশমের কাপড় উপহার আনতে। এত কষ্ট আর ঝামেলা করে এত দূরে এসেছি, এখন কি খালি হাতে ফেরা যায়? তোর মতে সেটা কি উপযুক্ত কাজ হবে?’
সর্দারটি ঘোড়ার রেকাবে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, ক্রুদ্ধ হয়েছে বোঝা গেল। বিজয় ছাড়াই যুদ্ধ শেষ হওয়ায় সে অসন’ষ্ট, আর বোঝা যাচেছ যে বড় রকম লাভের কথা ভেবে তারা এত রক্ত দিয়েছে আর যাত্রাপথের সব কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করেছে তা তাদের ভাগ্যে জোটে নি। আন্দিজান আর আখসি আস্তই রয়ে গেল, কুভার পুলের ওপর ঐ ঘটনার পর সঙ্গে সঙ্গেই সন্ধি হলো। তাতে হল কী? সমরখন্দের শাসক পেলেন সোনা, রূপো, মণিমাণিক, তেজী ঘোড়া, উট। এসবের ভাগ পেলেন তিনি আর তার ঘনিষ্ঠ বেগরা, উপদেষ্টারা, দরবারের কর্মচারী আর তার দেহরক্ষীরা। আর এই হাবিলদারটির মত যোদ্ধারা পথে গ্রামগঞ্জে লুঠ করা সামান্য কিছু জিনিস ছাড়া ভাল কিছুই পেল না।
এই দলের পাঁচজন লুঠেরা রাবেয়াদের বাড়ীর উঠোনে গিয়ে ঢুকলো। যে বিচালিঘরে তাহের লুকিয়ে ছিল তার দেওয়াল আর পাশের বাড়ীর বিচালী ঘরের দেওয়াল একই। ওদের বাড়ীতে কেমন গোলমাল আরম্ভ হলো তা শোনা যাচ্ছে।
রাবেয়া মেয়েমহলে লুকিয়েছিল, কিন’ ঠিক সেই মুহূর্তেই সে গরু দুইতে বের হলো- সন্ধিচুক্তির কথা সেও জানতে পেরেছে। বাছুরটাকে গরুর কাছে এগিয়ে দিলো, যাতে গরু দুধ দেয়। এইসব কাজে ব্যস্ত থাকায় যখন সৈন্যরা ছুটে এসে ভেতরে ঢুকেছে দেখতে পেল অনেক দেরী হয়ে গেছে তখন।
ওর মা দৌড়ে এল গোয়ালের কাছে, ‘হায় মরণ আমার! তুই এখনও এখানে।’
‘কী হয়েছে, মা?’
‘দুশমন! দাঁড়া! উঠোনে বেরুস না!… ঐ ওপরে উঠে ওপরের ঐ ছোট জানালটা দিয়ে বিচালি ঘরে ঢুকে যা!’
গোয়ালঘরের দরজায় দু’জন সৈন্য দেখা দিলো, ঘোড়া খুঁজছে ওরা নিজেদের জন্য। ছোটখাট চোখ তুর্কভাষী কিপচাকটির চোখে পড়ল একটি মেয়ের শরীর, ঝট করে বিচালির ঘরে ঢুকে গেল। খুবসুরত মনে হচ্ছে।
‘ঘোড়া নেই,’ হতাশ সুরে বলল তার সঙ্গী।
‘খুবসুরত ছুকরীর দাম ঘোড়ার চেয়েও বেশী…. এই, দাঁড়া।’ চীৎকার করে রাবেয়াকে বললো ও। ওকে সমরখন্দে নিয়ে গিয়ে ফজিলাবেগকে বেচে দেব।
মা ছুঠে এসে নিজের দেহ আড়াল দিয়ে চেপে ধরল বিচালিঘরে যাবার পথটা।
‘যদি তোমরা মুসলমান হও তো আমার মেয়েকে ছুঁয়ো না। আমায় মার! আমাদের মেয়ের দিকে এগিও না! বাগদত্তা ও! একটা চমৎকার জোয়ান ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে হওয়ার কথা!’
খুদে চোখ লোকটি ক্ষেপে উঠল। মেয়েটি বাগদত্তা, বিয়ের যোগ্য! এর জন্য বেশী দাম পাওয়া যাবে। এক ধাক্কা দিয়ে রাবেয়ার মাকে সেখানে থেকে সরিয়ে দিল। পড়ে গিয়ে গরুর ডাবায় মাথা ঠুকে জ্ঞান হারালো রাবেয়ার মা। খুদে চোখ লোকটি বিচালি ঘরে গিয়ে ঢুকলো এবার। চটপটে রাবেয়া ততক্ষণে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে উঠোনে গিয়ে পড়েছে। কিন’ সেখানে গিয়ে পড়লো অন্য বদমাশের হাতে। প্রথমজনও সেদিকে ছুটে গেল। দু’জনে মিলে রাবেয়ার হাত মুচড়ে ধরলো। তৃতীয়জন ঘোড়ার জিন থেকে খুলে নিয়ে এলো একটা লম্বা থলে, সেটাকে মেলে ধরে আছড়াআছড়ি করতে থাকা মেয়েটির দিকে এগোতে লাগল যেন লক্ষ্য সি’র করছে। রাবেয়া বুঝল এবার তার মাথার ওপর থলে ছুঁড়ে দেবে, তাই সর্বশক্তি দিয়ে চীৎকার করতে লাগল সাহায্য পাবার আশায়।
তাহের দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে নিজের বাড়ীতে লুঠপাট। কিন’ রাবেয়ার চীৎকারে সে সব সতর্কতা ভুলে গেল। বিচালিঘর থেকে বেরিয়ে সে তাদের দুই বাড়ীর মাঝের দেওয়ালের ওপর লাফিয়ে উঠলো। পাঁচিলের ওপর থেকে সব দেখতে পেলো কী ঘটছে। একজন সৈন্য রাবেয়ার পা দুটো চেপে ধরেছে দারুণ জোরে, অন্যজন হাতদুটো পিঠের দিকে পাকিয়ে শক্ত করে ধরে আছে, আর তৃতীয়জন তার মাথার ওপর থলে তুলে ধরেছে। তাহের প্রচন্ড চীৎকার করে লাফ দিলো। পাঁচজনের বিরুদ্ধে একজন- চতুর্থজন ঘোড়গুলোর লাগাম ধরে আছে, আর পঞ্চমজন লম্বা বর্শা হাতে নিয়ে ঘোড়ায় বসে আছে, সেকথা তাহের ভাবেনি। তার মাথায় কেবল এক চিন্তা- বদামাশটাকে মেরে রাবেয়াকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কথা। ছুটতে ছুটতেই খাপ থেকে খঞ্জরটা খুলে নিল সে।
‘এই, দাঁড়া,দাঁড়া বলছি!’ বর্শা হাতে সৈন্যটা ঘোড়া ছোটালো।
দু’লাফে উঠোন পেরিয়ে গেল তাহের। রাবেয়াকে ধরে থাকা সৈন্যগুলির দিকে এগিয়ে গিয়ে ছোটচোখ সৈন্যটির পাঁজরে খঞ্জরটা ঢুকিয়ে দিল একেবারে হাতল পর্যন্ত, তারপর ছাড়িয়ে নিলো খঞ্জরটা। তারপর কাঁধে দারুণ আঘাত অনুভব করলো, শুনল বর্শাটা কেমন করে তার জামাটা ছিঁড়ছে। টলে উঠে তাহের, যে লোকটাকে সে মেরেছিলো তার ওপরই পড়ে গেল। পড়তে পড়তে সে শুনতে পেল রাবেয়ার উন্মত্ত চীৎকার, ‘হায় তাহের-আগা!’
কিন’ মনে হল যেন চীৎকারটা ভেসে আসছে অনেক দূর থেকে।
রক্তমাখামাখি হয়ে সে সেখানেই পড়ে রইলো। রাবেয়াকে হাতপা বেঁধে ওরা নিয়ে গেল….

Leave a Reply