ছাতিম, হেমন্তের উপহার

আহমেদ মুনির, চট্টগ্রাম

জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলার একটি কবিতার শুরু এভাবে, ‘সন্ধ্যা হয়—চারিদিকে শান্ত নীরবতা’। হরতালে আক্রান্ত চট্টগ্রাম নগরে হেমন্তের সন্ধ্যার বিবরণ এই এক লাইনেই তুলে ধরা যেত। কিন্তু বাদ সেধেছে ছাতিম ফুলের মাদকতাময় গন্ধ। সন্ধ্যা কিংবা রাতে উঁচুনিচু সড়কগুলো দিয়ে চলাফেরার সময় এই গন্ধটা এসে নাকে লাগছে। তাই ছাতিম ছাড়া এ নগরের হেমন্ত-সন্ধ্যার বিবরণ পূর্ণাঙ্গ হয় না। গন্ধটা যেন হেমন্তেরই গায়ের গন্ধ।

দৃষ্টিসীমার চেয়ে খানিকটা উঁচু বলে সাধারণ অবস্থান থেকে গন্ধ বিলানো ছাতিমের ফুল সহজে চোখে পড়ে না। কিছুটা উঁচু জায়গায় উঠলে দেখা যায় গাছজুড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ ক্রিম (হালকা ঘিয়ে) রঙের ফুল। মনে হবে যেন কেউ অসংখ্য ফুলের স্তবক তৈরি করে রেখেছে।

একগুচ্ছ ফুলকে ঘিরে থাকে চার থেকে সাতটি পাতা। আর এই জন্য সংস্কৃত ভাষায় এই গাছের নাম সপ্তপর্ণ বা সপ্তপর্ণা। দীর্ঘ লম্বাটে পাতাগুলো গাছের শাখায় যেন পরস্পর হাত ধরে থাকে। আর শেষে সব পাতা এক হয়ে গাছের মাথায় একটা গাঢ় সবুজ ছাতা মেলে ধরে। দেখলেই একটা অতিকায় ছাতার কথা মনে পড়ে বলেই কী এ দেশে এর নাম ছাতিম!

নগরের জামালখান, কাজীর দেউড়ি, আশকার দীঘিরপাড়, সার্সন রোড, পাহাড়তলী, গোলপাহাড়, জাকির হোসেন সড়কসহ বেশ কিছু এলাকায় ছাতিমগাছ দেখতে পাওয়া যায়।

প্রেসক্লাবের ছাতিমতলার পাশেই একটি গ্রন্থবিপণি। সেখানে নিয়মিত আসেন সিরাজুল ইসলাম। সিরাজুল জানালেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার এই ছাতিমগাছে অনেক বেশি ফুল ফুটেছে। আর গন্ধও বেশ তীব্র। ছাতিমপ্রেমীর সংখ্যাও কম নয় নগরে। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকে অনেকেই নিজের ওয়ালে ছাতিমের ছবি প্রকাশ করেছেন। দু-এক ছত্র লিখছেনও কেউ কেউ। ঘন কালো ও নরম কাণ্ডের এই গাছের ডাল ভাঙলে সাদা দুধের মতো কষ বের হয়। গ্রামবাংলায় একসময় প্রচুর ছাতিম দেখা গেলেও এখন এটি অবাধ নিধনের শিকার। চীনের গুয়াংজি প্রদেশ ও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ছাতিমের আদি বাসভূমি।

ছাতিমের বৈজ্ঞানিক নাম এলস্টনিয়া স্কলারিস (Alstonia scholaris)। স্কলারিস শব্দটির সঙ্গে বিদ্যা অর্থাৎ লেখাপড়ার যোগ আছে। এ ধরনের নামকরণের কারণ, ছাতিমের নরম কাঠ থেকে ব্ল্যাকবোর্ড ও পেনসিল তৈরি হয়। এ ছাড়া প্যাকিং বাক্স তৈরির জন্যও এটির কাঠ ব্যবহার করা হয়। ছাতিমগাছের আরও নানা ধরনের উপকারিতার কথা জানা যায়।

দুই দিন বাদেই হেমন্তের ঘাড়ে শীতের ঠান্ডা নিঃশ্বাস পড়বে। তবে তার আগ পর্যন্ত নগরে এই ঋতুর উপস্থিতি জানান দিয়ে যাবে ছাতিম ফুল। আর এ কদিন ভোরবেলায় ছাতিমগাছ-সংলগ্ন ফুটপাত ও সড়কগুলো ভরে উঠবে ক্রিম রঙের ঝরা পাপড়িতে। এই পুষ্পবর্ষণ বুঝি নগরবাসীর জন্য হেমন্তেরই অকৃত্রিম উপহার!

Leave a Reply