অবলোকিতেশ্বর এবং তিব্বতী বৌদ্ধসূত্রে ধ্যানমগ্নতার ঐতিহ্য

অবলোকিতেশ্বর এবং তিব্বতী বৌদ্ধসূত্রে ধ্যানমগ্নতার ঐতিহ্য

অবলোকিতেশ্বর কে? বৌদ্ধ ইতিহাস আর দর্শনে এঁর স্থান কোথায়? তিব্বতী বৌদ্ধসূত্রে এর প্রভার কি? তাঁর কাজ কি? তাঁর অস্তিত্বের দার্শনিক ব্যাখ্যা কি? ধ্যানমগ্নতায় তাঁকে কিভাবে উপস্থাপন করা হয়?

করুণাময় বোধিসত্ত্ব, বৌদ্ধ দেবমুর্তির মধ্যে অবলোকিতেশ্বর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় মুর্তি। মহাযান বৌদ্ধ ধর্মধারায় এই দেবত্বের কল্পচিত্রের কথা প্রথম সৃষ্টি করা হলেও, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন অবয়বে সকল ধরনের বৌদ্ধ চিন্তাধারায় এই দেবত্বভাবনার উপাসনা করা হয়ে থাকে।

অবলোকিতেশ্বর প্রথমে ভারতীয় বৌদ্ধ চিন্তাচিন্তনে উদ্ভব হয়। মূলতঃ এই সকল বোধিসত্ত্বের নানা প্রকার বৈশিষ্ট ও গুণাবলীর ব্যক্তিরূপ সৃষ্টি করা হয়। অবলোকিতেশ্বর করণাময়তার ব্যক্তিক রূপ। বোধিসত্ত্বের বৌদ্ধ চিন্তাধারার উন্নয়ন প্রায় সমসাময়িক ব্রাহ্মণত্ব দেবতা উপাসনার সাথে আরম্ভ হয়েছিলো। সম্ভবত একই সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই চিন্তাধারার উদ্ভব হয়েছিলো কিংবা বোধিসত্ত্ব তাত্ত্বিকতা প্রতিদ্বন্দ্বি ব্রাহ্মণত্ববাদের গতিধারার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে সৃষ্টি করা হয়েছিলো। সম্ভবত বোধিসত্ত্ব তত্ত্ব খৃ.পূ. দ্বিতীয় শতকে উদ্ভব হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়।

মৌলিকভাবে, বুদ্ধের চেয়ে বোধিসত্ত্ব কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। যদিও বুদ্ধ পরিপূর্ণ আলোকিত সত্ত্বা, যেখানে বোধিসত্ত্ব এমন একটি রূপ, যা পরিপূর্ণ আলোকময় সত্তার প্রতি ধাবিত সত্ত্বা। বিভিন্ন রচনায় বোধিসত্ত্ব রূপ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। অল্প কিছু বোধিসত্ত্ব অন্যগুলির চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বোধিসত্ত্ব সম্পর্কিত প্রাচীন লিপিতে অবলোকিতেশ্বরের পরিচয় পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় শতকে, বৃহৎ সুখবতিভ্যুতে মহাস্থানপ্রাপ্ত বিভুর সাথে অবলোকিতেশ্বরকে সুখবতির দুইটি রূপ হিসেবে, পবিত্রতম বুদ্ধ আমিত্ব দেখানো হয়েছে। এই দুই অবস্থা সকল আলোকময়তার উৎস, যা পবিত্রভূমিকে আলোকিত করে রাখে। এরা আমিত্বের উপাসকদের প্রকৃত শ্রবণকারী হতে শিক্ষাদান করে।

অবলোকিতেশ্বরের গুরুত্ব পরিবর্তিত হয়েছে মহাযান বৌদ্ধধর্মের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। মহাযান তত্ত্বে প্রতিটি ব্যক্তির হৃদয়ে বিচক্ষণতা ও সমবেদনা, এই দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গড়ে ওঠা প্রয়োজন। আগের মহাযানে, সমবেদনার চেয়ে বিচক্ষণতাকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হতো। আর এ কারণে, বিচক্ষণতার বুদ্ধ, মঞ্জুশ্রী, সবচেয়ে অধিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপনকারী বোধিসত্ত্ব হিসেবে পূজিত হতো। যদিও সময়ের বিবর্তনে, সমবেদনা গুণটি অধিক গুরুত্ব লাভ করে এবং অবলোকিতেশ্বর অত্যন- শ্রদ্ধা অর্জনকারী বোধিসত্ত্ব হয়ে ওঠে।

অবলোকিতেশ্বরের প্রসিদ্ধির এই উত্থান এখানেই স্থগিত হয়ে যায়নি। সম্ভবত পঞ্চম শতকের দিকে অবলোকিতেশ্বর ধারণার পূর্ণতা পায়। অবলোকিতেশ্বর সকল কষ্টভোগকারীদের চরম পরিত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হতে থাকে। অবলোকিতেশ্বর কয়েকটি হিন্দু (ব্রাহ্মণীয়) অবতার, যেমন- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের চারিত্রিক বৈশিষ্টসহ পরিচিত হতে থাকে। ব্রহ্মার মত অবলোকিতেশ্বরকে মহাবিশ্বের স্রষ্টা হিসেবে দেখা হতে থাকে। ‘তাঁর চক্ষুদ্বয় হতে সূর্য আবির্ভূত হয়েছে . . . চন্দ্র উদীত হয়েছে তার মুখগহ্বর হতে, বায়ু প্রবাহিত হয় তার পদদ্বয় হতে।’ (জন সি. হোল্ট, বুদ্ধা ইন ক্রাউন, নিউইয়র্ক, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯১, পৃ. ৪১)। অবলোকিতেশ্বর সকল হিন্দু (ব্রাহ্মণীয়) দেবতাদেরও সৃষ্ট। ধারণা করা হয় যে এ সকল অবলোকিতেশ্বরের ওপর এই সকল শক্তির প্রয়োগের কারণ হিন্দুদের ধর্মান্তরিতকরণে উদ্বুদ্ধ করা।

অবলোকিতেশ্বরের দৈহিক বর্ণনায় পর্যায়ক্রমিকভাবে অদ্ভুত কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়। তার অবয়ব অস্বাভাবিক রকমের বিশাল। তাঁর মুখমণ্ডল লক্ষ যোজন ব্যাপি। তার দেহ স্বর্ণরঙা। তার মাথার পেছনে যুক্ত করা হয়েছে এ দিব্যজ্যোতি, যাতে পাঁচশত বোধিসত্ত্ব অন-র্ভূক্ত, যাদের উপাসনা করছে শত শত দেবমুর্তি। তাঁর ভ্রু-লোম থেকে উৎসরিত হচ্ছে চুরাশিটি রঙের শিখা। প্রতিটি শিখায় রয়েছে অসংখ্য বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব। তাঁর দশটি আঙুলের প্রতিটির শীর্ষে রয়েছে চুরাশি হাজার চিত্র এবং প্রতিটি চিত্র থেকে উৎসরিত হচ্ছে চুরাশি হাজার শিখা। ইত্যাদি।

এখানে অবলোকিতেশ্বর বুদ্ধের চেয়ে অধিক অগ্রগণ্য হয়ে ওঠেন। এমন কি বুদ্ধ অবলোকিতেশ্বরের গুণাবলীর সমকক্ষ হতে পারেন না। বলা হয়ে থাকে সহশ্র বুদ্ধকে স্মরণ করার চেয়ে অবলোকিতেশ্বরকে কেবল একবার স্মরণ করলে অধিক উৎকর্ষতা অর্জন করা যাবে। মহাযান মতবাদের বোধিসত্ত্বতার আংশিক প্রভাবের কারণে অবলোকিতেশ্বরের গুরুত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মহাযান মতবাদে বলা হয়েছে, সবচেয়ে চমৎকার করুণাপ্রদর্শনকর সিদ্ধান- হলো বুদ্ধ হওয়ার চাইতে বোধিসত্ত্ব হতে প্রতিজ্ঞা করা কারণ বোধিসত্ত্ব আরও কার্যকরভাবে চারপাশের সকলকে আলোকিত হতে সচেষ্ট থাকে। কারুণাময় হওয়ার কারণে বুদ্ধ হতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ না হয়ে অবলোকিতেশ্বর নির্বাণ লাভের পথে অগ্রসর হবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত সকল অনুভবক্ষম প্রাণী সংসারের সীমাহীন কষ্টের আবর্ত থেকে মুক্তি লাভ না করে। অবলোকিতেশ্বর কেবল বোধিসত্ত্বই নয়, যে এই প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হবে। তিনি কৃপাময় প্রেরণার উৎস হয়ে সকল বোধিসত্ত্বকে এই প্রতিজ্ঞায় তাড়িত করবেন। আর তাই বোধিসত্ত্ব্‌ প্রতিজ্ঞা ক্রমে অবলোকিতেশ্বর এবং সর্বপ্রকার প্রতীভূর প্রতিজ্ঞায় পর্যবসিত হবে।

অবলোকিতেশ্বরের নির্যাস হলো কৃপাময় প্রেরণার উৎস, আর একারণে তিনি সর্বসহায়তাকারী। অনুভূতিক্ষম প্রাণীদের সহায়তা দানের জন্য তিনি যে কোন রূপ পরিগ্রহ করতে পারেন আর তাই তিনি বুদ্ধ, ব্রাহ্মণ্য দেবতা, মানব এবং জন’র রূপ পরিগ্রহ করার বর্ণনা পাওয়া যায়। এই সকল রূপ পরিগ্রহ করে তিনি চমৎকার সব কর্ম সম্পাদন করে থাকেন, যার মাধ্যমে তিনি সকল প্রাণীর কষ্ট লাঘব করে আলোকময়তার পথ প্রদর্শন করেন। তিনি তাঁর অনুসরণকারীদের অগ্নিতে প্রজ্জলিত হওয়া থেকে, জলমগ্ন হওয়া থেকে, তষ্কর থেকে, হত্যা থেকে এবং কারারুদ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা করেন। তিনি সন্তানপ্রত্যাশীদের সন্তান দান করেন। তিনি জীব সকলকে তিনটি মানসিক বিষ, যথা ক্রোধ থেকে, ঘৃণা থেকে এবং প্রবঞ্চনা থেকে রক্ষা করেন। তিনি দৈহিক ও পার্থিব বেদনায় এবং আত্মিক ও আধ্যাত্মিক কর্মে সহায়তাকারী।

কৃপাময়তার ব্যক্তিরূপে প্রকাশের পাশাপাশি অবলোকিতেশ্বর যে কোন বুদ্ধরূপের চেয়ে আরও সম্পূর্ণরূপে আলোকময়তার সাথে সম্পর্কিত। বলা হয়ে থাকে তিনি আলোকরস্মি থেকে উৎসরিত, যা অমিতাভ বুদ্ধ থেকে নিঃসরিত হয়। অবলোকিতেশ্বর আলোর সমুজ্জ্বল প্রভা এবং প্রতি মুহূর্তে সকল সৃষ্টজীব ও বিশ্বের সকল কোণে আলোক বিকীরণকারী। একইভাবে, তিনি মহাবিশ্বের সকল কোণের সকল কিছু এবং সকল ব্যক্তিকে দেখতে পান। আর একারণেই তার নাম হয়েছে অবলোকিতেশ্বর।

অবলোকিতেশ্বর শব্দটি মূল ‘অবলোকিত’ এবং ‘ঈশ্বর’ এই দুটি শব্দের সম্নিলনে গঠিত। ‘অবলোকিত’ (মূল শব্দ ‘অবলোকন’) অর্থ ‘দৃষ্টি দেওয়া’ বা ‘দেখা’ থেকে উদ্ভুত এবং ঈশ্বর অর্থ ‘বিধাতা’, ‘অধিপতি’ বা ‘স্রষ্টা’। পুর্ণাঙ্গ অবলোকিতেশ্বর শব্দটির অর্থ ‘আমরা স্রষ্টাকে যেমন দেখি, অথবা ‘সর্বত্র বিদ্যমান স্রষ্ঠা’ ‘সর্বোচ্চ স’ান থেকে দর্শনকারী স্রষ্টা’ বা ‘সর্বোচ্চ করুণা প্রদর্শনকারী স্রষ্টা’। এই ব্যাখ্যাগুলির কোনটিই সঠিক বা সুনির্দিষ্ট নয়। তবে যেভাবেই বর্ণনা করা হোক না কেন, অবলোকিতেশ্বর শব্দটি আলোকময়তা ও দর্শনময়তার সাথে সম্পর্কিত। সবকিছু দেখতে পাওয়াটাই তার সবচেয়ে বড় গুণ। কারণ এর মাধ্যমেই তিনি সর্বত্র ও সৃষ্ট জীবন ও জড়ের ওপর করুণ প্রদর্শন ও বর্ষণ করতে পারেন। তিনি যে আলো সর্বত্র প্রবাহিত করেন, সেটি তাঁর সর্বত্র প্রবাহিত করুণারই এক অনন্য নিদর্শন।

বৌদ্ধধর্ম সারা এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে অবলোকিতেশ্বর সংক্রান্ত শিক্ষা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। চীন ও জাপানে অবলোকিতেশ্বর সবচেয়ে জনপ্রিয় বোধিসত্ত্ব। যদিও স্থান ভেদে, তার লিঙ্গেরও পরিবর্তন দেখা যায়, এবং অনেক স্থানে বোধিসত্ত্বের নারীরূপ পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। চীনে তিনি কুয়ান-ঈন বা কখনও কখনও কুয়ান-ঝু-ৎসাই নামে পরিচিত। জাপানে, নারী মুর্তি কান-নন বা কোয়ান-নন নামে পরিচিত। ঊভয় দেশেই, তিনি সকল দুঃখভোগী প্রাণীর সর্বোচ্চ ত্রাতা এবং অনুগ্রহ ও করুণার দেবী। যে সকল নারী তাঁর কাছে সন্তান কামনা করে, তিনি সেই সকল নারীকে সন্তান দান করেন। অবলোকিতেশ্বর ধারণা শ্রীলংকাতেও প্রসার লাভ করেছে। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, শ্রীলংকাতে থেরাভেদা বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত, অথচ অবলোকিতেশ্বর মূলত মহাযান ধারার চেতনা সমৃদ্ধ। শ্রীলংকায় তিনি ‘নাথ’ হিসেবে পরিচিত, যা লোকেশ্বরনাথ শব্দের সংক্ষিপ্তসার, যার অর্থ ‘বিশ্বপ্রভু’। তিনি বোধিসত্ত্ব মৈত্রেয়, অর্থাৎ ‘ভবিষ্যতের বুদ্ধ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকেন। তাঁকে অনেক সময় কয়েকজন হিন্দু দেবতার প্রতিভূ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। ‘নাথ’ শ্রীলংকার অভিভাবক দেবতা হিসেবে মনে করা হয়। এই ‘নাথ’ ঐতিহ্য অন্যান্য থেরাভেদা বৌদ্ধমতাবলম্বী দেশ, যেমন ব্রহ্মদেশ ও কাম্বোডিয়াতেও ছড়িয়ে পড়েছে।

নেপালে, অবলোকিতেশ্বর ব্রাহ্মণ্য দেবতা মাৎসেন্দ্রনাথ হিসেবে পূজিত হয়ে থাকে। তিনি মহাসমারোহে পুরোহিতশ্রেণীর ব্যক্তিদের দ্বারা পূজিত হন। পূজা করার এই প্রথা বংশপরম্পরায় পিতা থেকে পুত্রে চলে আসে এবং এই দায়িত্ব কেবল পুরোহিতশ্রেণীর শীর্ষ ব্যক্তিদের মধ্যে অত্যন্ত উচ্চমূল্যে সর্বোচ্চ দরদাতার ওপর বর্তায়। অবশ্য অনেকে মত প্রকাশ করে থাকেন যে, প্রকৃত পূজার আনুষ্ঠানিকতা ও মন্ত্র আজকাল অনেকেই ভুলে গেছেন। তা সত্ত্বেও এ পূজার আনুষ্ঠানিকতা এখনও পালিত হয়। কারণ ধারণা করা হয়, এর ফলে পরিবারে ও সমাজে সৌভাগ্য দেখা দেয়।

তিব্বতে, অবলোকিতেশ্বর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে গিয়েছে। একে ঘিরে প্রচলিত গল্প-গাথা, মানবজীবনের বাস্তবতার সাথে এর সম্পৃক্ততা, আধ্যাত্ববাদী মনোসংযোগ (মেডিটেটিভ প্র্যাকটিস) কার্যক্রম অনেক উন্নত পর্যায় পর্যন্ত উন্নীত হয়েছে। ভারতীয়রা অবলোকিতেশ্বরের উপাসনা যে স্তরে শেষ করেছে, তীব্বতিরা সেখান থেকে আরম্ভ করে নিজেদেরকে আরও অনেক উর্ধে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী তীব্বতিরা মনে করেন, অবলোকিতেশ্বর দর্শন তীব্বতে এসেছে খৃষ্টীয় অষ্টম শতকে। রাজা শ্রং-বৎসান সাংমা-পো বুদ্ধবাদ তীব্বতে আনার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই রাজাকে অবলোকিতেশ্বরের মানব-প্রতীভূ হিসেবে মনে করা হয়। প্রাচীনপন্থী তীব্বতিরা বিশ্বাস করেন, অবলোকিতেশ্বর দর্শন তীব্বতে ৮ শতকে, রাজা শ্রং-বৎসন সাংমা-পো প্রবর্তন করেন। এই নৃপতিকে অবলোকিতেশ্বরের মানবরূপ বলে মনে করা হতো। এই রাজার মৃত্যুর পরই তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভার কমতে থাকে এবং ১১ শতকের দিকে এর প্রসার রুদ্ধ হয়ে থাকে। সে সময়ে মনে করা হতো, অবলোকিতেশ্বর যে কেবল সমগ্র বিশ্ব-সংসারের স্রষ্টাই নন, বরং তিনি সমস্ত হিন্দু দেব-দেবী ও সকল বুদ্ধ ও বুদ্ধ-ক্ষেত্রেরও স্রষ্টা। অবলোকিতেশ্বরের সৃষ্টিময় কার্যক্রমের কারণেই এই মহাবিশ্ব টিকে আছে।

কথিত আছে, অবলোকিতেশ্বর সরাসরিভাবে তিব্বত সৃষ্টি করেছেন। নানা উপকথার একটিতে, কিভাবে তিব্বতী মানুষের জন্ম তার উল্লেখ আছে। এক সময় একটি বানর অবলোকিতেশ্বরের দেহধারী ছিলেন। তিনি পর্বতে অবস্থান করতেন এবং ধ্যানমগ্ন থাকতেন। এক দানবী ঐ পথ দিয়ে যেতে গিয়ে তাকে দেখতে পেলো এবং তার প্রেমে আপ্লুত হলো। দানবী তাকে বারবার প্রেম-নিবেদনে ব্যর্থ হয়ে তাকে বললো, যদি তিনি তাকে বিবাহ না করেন তবে, সে ঐ এলাকার সকল জীবিত প্রাণী ধ্বংশ করে দেবে। বানর দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়েন এবং অবলোকিতেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করেন এ অবস্থায় তিনি কি করবেন। অবলোকিতেশ্বর বানরকে ঐ দানবীকে বিবাহ করার পরামর্শ দিলেন। এর ফলশ্রুতিতে বানর ও দানবীর বিবাহ অনুষ্ঠিত হলো এবং তাদের ছয়টি সন্তান হলো। বর্তমান তিব্বতী জনগণ তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম। আর ফলে তিব্বতীদেরকে অবলোকিতেশ্বরেরই সরাসরি ইচ্ছের ফসল ও বংশধর হিসেবে মনে করা হয়।

তিব্বতী বুদ্ধবাদে, নশ্বর মানবসত্ত্বাকে ঈশ্বরত্বের প্রকাশরূপ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। তিব্বত এমন একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্র যেখানে এই ভাবধারা প্রবলভাবে দেখা হয়। অবলোকিতেশ্বরের প্রকাশরূপ তিব্বতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ইতিপূর্বে, বানর ও রাজা শ্রংবৎসান স্‌গাম-পো সম্পর্কিত বিষয় আলোচিত হয়েছে। তিব্বতের ইতিহাসে অবলোকিতেশ্বরের আর একটি যে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট লক্ষ্য করা হয়, সেটি হলো দলাই লামা। দালাই লামা সেই পনেরো শতক থেকে পর্যায়ক্রমে তিব্বতেই আবির্ভূত হয়েছেন। বর্তমান দলাই লামা চতুর্দশতম আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি কাগ্যিউ-পা দর্শনের প্রধান, যা চারটি প্রধান তিব্বতী বৌদ্ধবাদের অন্যতম। সপ্তদশ শতকের প্রথম দিক থেকে চীনের তিব্বতের শাসনভার গ্রহণের পূর্ব পর্যন- পঞ্চম দলাই লামার সময় থেকে দলাই লামা তিব্বত শাসন করে আসছেন। আর তাই ধারণা করা হয়, দলাই লামার সংরক্ষণমূলক দেবত্ব তিব্বতী জনগোষ্ঠির আদীজনক ও শাসক এবং তিব্বততে তিনিই তিব্বতে বুদ্ধবাদ প্রবর্তন করেছেন। এই দেবত্ব এবং সেই কারণে তার এই প্রকাশ করুণাময়তায় মানবীয় রূপ, যার শাসন দয়া ও কষ্টলাঘব করতে বদ্ধপরিকর।

অবলোকিতেশ্বরের ধারণা, তিব্বতীদের নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা লাভ করতেই নয়, বরং বৌদ্ধ অনুধ্যান সাধনাতেও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত তান্ত্রিক দিব্যদর্শনে, সমবেদনার মূর্ত প্রকাশ হিসেবে অবলোকিতেশ্বর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তন্ত্র চর্চাকরীগণ বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষার অভিজ্ঞতানির্ভর উপলব্ধির লক্ষ্যে এরূপ দিব্যদর্শন চর্চা করে থাকে। (আমি নিজে তন্ত্র কেবল বুঝতে শুরু করেছি মাত্র। কাজেই আমার ব্যাখ্যা একবারেই প্রারম্ভিক পর্যায়ের, এবং এতে মারাত্মক ভুল থাকতে পারে। এখানে এই ব্যাপক বিষয়টি সম্পর্কে আমি শুধুমাত্র আমার ধারণা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি।) এধরনের দিব্যদর্শনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে এর মাধ্যমে যে দর্শনকে অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তব রূপ প্রদান করা হয় সে দর্শন সম্পর্কে ধারণা লাভ করা প্রয়োজন।

এই দর্শন কী? যদিও এই নিবন্ধের স্বল্প পরিসরে মহাযান ও বজ্রযান বৌদ্ধ দর্শনের সম্পূর্ণ শিক্ষা সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা প্রদান করা সম্ভব নয়, তবে সাধারণত অবলোকিতেশ্বরের তান্ত্রিক দিব্যদর্শনে যে সকল দর্শনের সর্বাধিক প্রয়োগ লক্ষ্য করা হয় সেগুলো সম্পর্কে এখানে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব।

এ সকল সাধনায় সাধারণত বৌদ্ধ দর্শনের যে শিক্ষা প্রয়োগ করা হয়ে থাকে তা হলো সমবেদনার গুরুত্ব। বৌদ্ধ দর্শনে সমবেদনার সম্যক ধারণা আসলে কী? অন্যের দুঃখে দুঃখিত হওয়ার মাধ্যমে সমবেদনার শুরু এবং এটি অন্যের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের উদ্দেশ্যে ক্রিয়াকর্ম গ্রহণে উদ্দীপনা প্রদান করে। সমবেদনা উপকারী কর্মসাধনের পশ্চাতে উদ্বুদ্ধকারক শক্তি হিসেবে কাজ করে। এটি অন্যকে সাহায্য করতে একটি আন্তরিক ও ইতিবাচক শক্তি।

যখন আমরা অন্য ব্যক্তিদের থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দেখি না কেবল তখনি আমাদের মাঝে সমবেদনার প্রকাশ ঘটে। যদি আমাদের মনে এমন অনুভূতি থাকে যে, আমি আমার মত আছি এবং তুমি তোমার মতো আছো, এবং আমরা স্বতন্ত্র সত্ত্বা, তা’হলে আমরা অন্যের দুঃখ দুঃখিত হতে পারবো না। কারণ এ ক্ষেত্রে অন্যের দুঃখ বেদনা আমাদের মনকে ছুঁয়ে যাবে না। অন্যের দুঃখ-দুর্দশা ও কষ্ট নিজের মনে সত্যিকার অর্থে অনুধাবন করতে হলে আমাদেরকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কঠোর বিভেদ বা স্বতন্ত্রবোধ হতে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। আমদেরকে নিজের ও অন্যের মাঝে বন্ধনের চেতনাপ্রবাহ সম্পর্কে সচেতনতার মাঝে বাস করতে হবে। চাগিয়াম ত্রুঙ্গপা বলেন, “যখন কোন ব্যক্তি সত্যিকারে সমবেদনা অনুভব করতে পারেন, তখন তিনি নিজেও জানেন না যে, তিনি অন্যের প্রতি সহৃদয়তা প্রকাশ করছেন, নাকি তাঁর নিজের প্রতি করছেন, কারণ সমবেদনা হলো পারিবেশগত সহৃদয়তা, যা কোন ব্যক্তি বিশেষের উদ্দেশ্যে উৎসারিত হয় না; এবং এতে কোন প্রকার ‘আমার জন্য’ বা ‘তাদের জন্য’ বলে কিছু থাকে না।”

অন্যের সাথে এরূপ একাত্মবোধকে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত করা হয় যা জাগতিক সত্তার সম্পর্কভিত্তিক, উন্মুক্ত ও শূন্য প্রকৃতি সম্পর্কে একধরনের সচেতনতাবোধ উৎপন্ন করে। জাগতিক সত্ত্বা হলো সম্পর্কভিত্তিক কারণ প্রতিটি বিষয়ই অন্যটি দ্বারা নিবিড়ভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। স্বতন্ত্র বা স্বাধীন সত্তা বলে কিছু নেই। আমার ভালমন্দ আপনার ভালমন্দ দ্বারা প্রভাবিত। একটি পুকুরে পানির উপরিভাগে একটি স্পন্দন যেমন মৃদু তরঙ্গ আকারে সারা পুকুরে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি প্রতিটি কর্মের ফল সারা জগৎময় ছড়িয়ে পড়ে। জাগতিক সত্ত্বা হলো উন্মুক্তকরণ, এর কোন সীমারেখা নেই। “এখানেই নিহিত . . . উন্মুক্ত অনুধ্যান–ধ্যানের অভিজ্ঞতা–উন্মুক্ততার দিব্যদর্শন। এতে আপনি আপনার বাইরের জগতকে আপনার নিজ হতে আলাদা করে দেখতে পারবেন না কারণ আপনি জীবনের নৃত্য-ক্রীড়ার সাথে এমনিভাবে একাত্ম হয়ে মিশে আছেন।” উন্মুক্ততার অর্থ হলো প্রতিটি বিষয়কে তার স্ব স্ব অবস্থায় গ্রহণ করতে পারা। প্রকৃতপক্ষে ‘সূচি’ ও ‘অসূচি’ এবং ‘ভাল’ ও ‘মন্দের’ মাঝে কোন সীমারেখা নেই। প্রতিটি বিষয়ই প্রাজ্ঞ মনের বহিঃপ্রকাশ। সত্ত্বাকে শূন্য বলে অভিহিত করা হয় কারণ প্রতিটি বিষয়ই স্থায়ীত্ব, পৃথক অস্থিত্ব ও মৌলিক গুণশূন্য। থিনলে নরবু বলেন, “. . . চেতন সত্তার কোন বাস্তবতা তা নেই এবং দৈবের কোন স্থায়ীত্ব নেই।” কোন বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। প্রতিটি বস্তুই নিবিড়ভাবে অনন্যসংযুক্ত।

আমরা যখন শূন্যতা এবং বাস্তবতার অনন্যসংযুক্ততা বিষয়ে সচেতনতার জগতে বাস করি তখন আমাদের মনে সমবেদনা স্বতস্ফুর্তভাবে উৎসারিত হয়। বৌদ্ধ দর্শনের মধ্যমকা ধারায় ‘প্রজ্ঞা’ বলতে বুঝায় শূন্যতা ও অনন্যসংযুক্ততার অভিজ্ঞতাভিত্তিক ধারণা। জ্ঞানের এই ধারণার ভিত্তিতে বোঝা যায় যে সমবেদনা জাগানো ও প্রজ্ঞা একে অন্যের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত, এবং একটি অন্যটি হতে উৎসারিত। মহামান্য চতুর্দশ দালাই লামা লিখেছেন, “বোধিচিত্ত বিশিষ্ট মন জাগিয়ে তোলা, সমবেদনা, ও পার্থক্য নিরূপণকারী প্রজ্ঞা এই তিনটি বিষয়ের পুরোপুরি . . . মিলন, সমন্বয়, বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। বোধিচিত্ত হলো এমন এক মন যা সকল চেতন সত্তার মঙ্গলার্থে আলোকিত হতে চায়। কাজেই দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে আলোকিত হতে চাওয়া, সকল প্রাণীর মঙ্গল কামনা করা, এবং শূন্য ও অনোন্যসংযুক্ততা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা — এসকল বিষয়সমূহ একই উদ্দেশ্যের অংশমাত্র।

তান্ত্রিক চর্চাতে এসকল বিষয়কে একত্রিত করা হয়। অবলোকিতেশ্বর কেন্দ্রিক এই চর্চাতে সমবেদনাকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়ে থাকে, কিন্তু এখানে সমবেদনা প্রজ্ঞার সাথে এমনভাবে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে থাকে দুটির অস্তিত্বকে আর আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় না। দিব্যদর্শনের প্রায় প্রতিটি উপাদানই সমবেদনার ও শূন্য অনন্যসংযুক্ততার আরো একটি রূপ জাগিয়ে তোলে।

আমার পঠিত অবলোকিতেশ্বরের সকল তন্ত্রেই প্রায় একই ধরনের উপাদানের ব্যবহার করে থাকে। তবে একেক তন্ত্রে একেক উপাদানের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে। আবার এক তন্ত্রে যে বিষয়কে বাদ দেয়া হয়েছে অন্য তন্ত্রে সেটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তান্ত্রিক দিব্যদর্শন চর্চাতে সমবেদনা ও প্রজ্ঞার অভিজ্ঞতা অর্জনে কিভাবে অবলোকিতেশ্বরের ব্যবহার করা হয় তা দেখাতে আমি এখানে একটি মাত্র তন্ত্রের ব্যাখ্যা করব, যা দ্বিতীয় দালাই লামা কর্তৃক রচিত হয়েছে। এখানে আমি এই বিশেষ তন্ত্রটি বেছে নিয়েছি, কারণ এটিতে অন্যান্য তন্ত্রে ব্যবহৃত সাধারণ উপাদানসমূহের সবগুলোই অন্তভুক্ত করা হয়েছে, এবং এছাড়াও আমার পঠিত অন্যান্য তন্ত্রে সাধারণত ব্যবহৃত হয় না এমন কতিপয় উপাদানও এখানে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাছাড়া বিশেষ করে এখানে বিষয়টিকে এমনভাবে ব্যাখা করা হয়েছে যে এ থেকে দিব্যদর্শন চর্চার দার্শনিক উৎস সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়।

এই তন্ত্রে অনুধ্যান চর্চার প্রচলিত প্রাথমিক ধাপসমূহ বাদ দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক ধাপগুলো একেক ধারাতে একেকভাবে অনুসরণ করা হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনটি সাধারণ বিষয় লক্ষ্য করা যায়। এই তিনটি ধাপ এখানে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।

প্রথমে বুদ্ধ, ধর্ম (বুদ্ধের শিক্ষাসমূহ), সংঘ (বৌদ্ধ সমাজ), এবং সাধারণত লামাগণ, ধ্যানের দেবগণ, ও তাদের অনুসারীগণের (ডাক ও ডাকিনী, ও ধর্ম রক্ষাকরীগণ) আশ্রয় গ্রহণ করা হয়। এরপর, জগতের সকলের কল্যাণে আলোকপ্রাপ্ত হবার আকাঙ্খা প্রকাশ করা হয়। এবং সর্বশেষে, জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক, দুঃখ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাক, নিরবিচ্ছিন্ন সুখভোগ করুক, এবং চিরশান্তিতে বসবাস করুক– এই কামনা করা হয়।

এই তন্ত্রে দিব্যদর্শন চর্চার আরম্ভটা হয় আলোকদর্শনের মাধ্যমে যাতে মাথার উপরে একটি স্বচ্ছ স্তুপের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। একমাত্র এই ধারাতেই আমি শুধু স্তুপের উল্লেখ পেয়েছি। উক্ত স্তুপের মধ্যে ধ্যানকারী তাঁর মূল গুরুকে মহান অবলোকিতেশ্বর রূপে অধিষ্ঠিত দেখতে পান। মূল গুরু হলো আধ্যাত্মিক গুরু। তিব্বতীয় ধারাতে আধ্যাত্মিক গুরুকে ‘বৌদ্ধত্বের মানবীয় ও বোধগম্যরূপে’ দেখা হয়। আধ্যাত্মিক গুরুর মাঝে অলৌকিকতার প্রকাশ ঘটে। একইভাবে দৈব ও একধরনের অলৌকিকতার প্রকাশ। গুরুর মাঝে অলৌকিকতার প্রকাশ ঘটে মূলত মানবীয়, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আকারে, কিন্তু অলৌকিকতার দৈব প্রকাশ ঘটে অধিকতর অশরীরী ও স্বর্গীয় রূপে। উভয়ের ক্ষেত্রে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা হলো অলৌকিকতার প্রকাশ। তবে এক্ষেত্রে গুরুকেও দৈব প্রকাশ হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে।

এরপর, অবলোকিতেশ্বরের অবয়ব বর্ণনা করা হয়। তাঁর আকৃতি, ভঙ্গি, পোশাক, তিনি যা ধারণ করে আছেন ও যার উপরে উপবিষ্ট আছেন সবকিছুই সাংকেতিক অর্থে ইঙ্গিতময়। এগুলো প্রথমত সমবেদনা, শুদ্ধতা, এবং আলোকিত অবস্থা বা প্রজ্ঞার প্রতীকরূপে রূপায়িত হয়। সবশেষে, তাঁকে এভাবে বর্ণনা করা হয়, “এভাবে তিনি আকাশের রংধনুর মত কোন প্রকার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ব্যতীত আলোকরশ্মির মহাবিস্ফোরণের মাঝে প্রকাশমান হলেন”। অবলোকিতেশ্বরের অবয়বের বিস্তারিত বর্ণনা প্রদানের পর এ পর্যায়ে আবারো স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে, অবলোকিতেশ্বরের এই অবয়ব স্বতন্ত্র অস্তিত্বহীন। এই অবয়বে কোন প্রকার স্থায়ী গুণ বা বৈশিষ্ট্য আরোপ করা যাবে না।

ধ্যানকারীর মাথার উপরে প্রকাশিত স্তুপে সহস্র দ্বার রয়েছে। প্রতিটি দ্বারে একালের সহস্র বুদ্ধের উপসি’তি কল্পনা করে নেয়া হয়। যদিও এই দিব্যদর্শনে প্রকাশমান বিশেষ আকৃতিটি বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র, অবলোকিতেশ্বরের বিভিন্ন তন্ত্রে কোন এক পর্যায়ে অন্যান্য আরো অনেক বুদ্ধ ও বোধিসত্তার আবাহন সাধারণভাবে লক্স্য করা যায়।

শিরোভাগে উপবিষ্ট গুরুক অবলোকিতেশ্বর রূপে দর্শনের পর ধ্যানকারী অবলোকিতেশ্বরকে নিজের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত দেখতে পান। হৃদয়ে অধিষ্ঠিত অবলোকিতেশ্বর ও শিরোভাগের অবলোকিতেশ্বরের আকৃতি একই রকম। তিনি সহস্র পাপড়ি বিশিষ্ট একটি লাল পদ্মফুলের উপরে বসে আছেন। এর ফুলের প্রতিটি পাপড়ির উপরে “অ” লেখা আছে। “অ” শূন্যতার প্রতীক। এই হৃদয়ে আবার একটি চন্দচক্র রয়েছে যার উপরে ‘ঋহ’ অক্ষর অঙ্কিত। ‘ঋহ’ হলো অবলোকিতেশ্বরের মূল অক্ষর যা অবলোকিতেশ্বর এবং তাঁর দ্বারা নির্দেশিত সকল সাংকেতিক বহিঃপ্রকাশের প্রতীক। চন্দ্র হলো বোধিচিত্ত এবং সকল প্রাণীর মঙ্গলার্থে আলোকিত হবার পরার্থসম্মত আকাঙ্খার প্রতীক। অবলোকিতেশ্বরের দিব্যদর্শনে চন্দ্রচক্র একটি সাধারণ বিষয় যা প্রায় সকল তন্ত্রে লক্ষ্য করা যায়। চন্দ্রচক্রের সকল প্রান্তে ছয় অক্ষরের মন্ত্র থাকে, যা হলো ওম মনি পদ্মে হুম। এই মন্ত্র হলো অবলোকিতেশ্বরের মন্ত্র। এর আক্ষরিক অর্থ হলো ‘পদ্মের অন্তরে রত্ন’। এটি অবলোকিতেশ্বরের সকল তন্ত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং এর নানাপ্রকার অর্থ ও ব্যবহার রয়েছে।

এই অবলোকিতেশ্বর ধ্যানকারীর হৃদয়ে অবস্থান করেন। হৃদয় হলো মনের প্রতীকি অবস্থান। কাজেই অবলোকিতেশ্বর আসলে মনে অবস্থান করেন। বিভিন্ন নির্দেশনা থেকে জানা যায় যে তিনি যেই মনে অবস্থান করেন সেই মন থেকে তিনি আসলে অবিচ্ছেদ্য। যদিও মনে অবলোকিতেশ্বরের যে অবয়ব ধারণ করা হয়, তা’ এই পর্যায়ে উক্ত মনের সাথে পুরোপুরি একীভূত হয়ে যেতে পারে না, তবুও মনটি অবলোকিতেশ্বর হতে আলাদা কিছু নয়।

এরপর, মাথার উপরে গুরুদেবের উপস্থিতি কল্পনা করা হয়, এবং মনে বিশ্বাস উৎপাদন করা হয় যা “এমনি গভীর যে চোখে অশ্রুর ধারা বয়ে আনে এবং শরীরের সকল লোমকূপের লোমকে প্রকম্পিত করে”। এবং ধ্যানকারী তাঁর গুরুদেবের নিকট এভাবে আকুল আবেদন করেন:

আমার পিতা-মাতা, এবং ষড়জন্মচক্রে আবদ্ধ সকল প্রাণী জগৎ সংসারে দুঃখের মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত। এসকল অসহায় প্রাণী এমনিভাবে যন্ত্রণা ভোগ করছে যে, তাদেরকে রক্ষা করার কেউ নেই, নেই তাদের কোন আশ্রয়। এদেরকে সংসারের দুঃখ মহাসমুদ্র হতে এখনি রক্ষা করার জন্য আমি আপনার নিকট সনির্বন্ধ প্রার্থনা জ্ঞাপন করছি।

প্রথমত, এখানে ‘আমার পিতা-মাতা’ ও ‘ষড়জন্মচক্রে আবদ্ধ সকল প্রাণী’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী সকল প্রাণীই বহুবার পুনর্জন্ম লাভ করে, যার ফলে কোন এক পর্যায়ে প্রতিটি প্রাণীই আমাদের মাতৃরূপে জন্মলাভ করে থাকে। মাতাকে সাধারণত মনে করা হয় প্রতিপালন ও নিঃশর্ত ভালবাসার আধার। এই বিষয়টি সম্পর্কে যদি আমরা সচেতন থাকি, তাহলে আমরা মাতাকে যেমন তাঁর ভালবাসার প্রতিদান দিতে চাই ও তাঁর সর্বোচ্চ মঙ্গল কামনা করি, ঠিক তেমনি আমরা সকল প্রাণীকে তার নিকট হতে যে ভালবাসা ও স্নেহ লাভ করেছি, তার প্রতিদান দিতে চাইবো। সকল প্রাণীকে আমাদের মাতা হিসেবে দেখতে পারলে তাদের প্রতি পরার্থসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা আমদের জন্য সহজ হয়ে যায়। তিব্বতীয় ধ্যানচর্চায় এটি একটি অতি পরিচিত চিত্র। ষড়জন্মচক্র বলতে জগৎ সংসারের ষড়লোকের বা ছয়টি রূপের কথা বোঝানো হয়েছে। সকল জীবিত সত্ত্বা যে সকল প্রাণীরূপে জন্মগ্রহণ করতে পারে, এটি তার সবগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। সকল রূপেই প্রাণীকূল দুঃখভোগ করে থাকে।

দ্বিতীয়ত, গুরুদেবকে কেন জগতের সকল প্রাণীকে রক্ষা করতে অনুরোধ করা হয়? তবে আমরা সকল প্রাণীকে কেন দুঃভোগ থেকে রক্ষা করতে চাই সে বিষয়ে ইতোমধ্যে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করা হয়েছে। কিন’, এ জন্য গুরুদেবকে কেন অনুরোধ করা হয়? মহামান্য দ্বিতীয় দালাই লামা বলেন, “তুমি যতক্ষণ না বুদ্ধত্ব লাভ করবে, . . . ততক্ষণ সকল প্রাণীকে সংসারের দুঃখযন্ত্রণা হতে মুক্তি প্রদান করা তোমার পক্ষে অসম্ভব।” যেহেতু, আমরা সকল প্রাণীকে মুক্তি প্রদান করতে সমর্থ নই, আমরা অলৌকিকতা ও সমবেদনার মূর্ত প্রকাশ, অর্থাৎ আমাদের গুরুদেবকে এটি করতে অনুরোধ করি। সকল প্রাণীকে জগতের ষড়রূপ হতে মুক্তি প্রদান করতে গুরু বা স্বয়ং অবলোকিতেশ্বরের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা তান্ত্রিক দিব্যদর্শন চর্চাতে একটি সাধারণ রীতি। বিশেষত গুরুর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা খুবই যথার্থ কারণ তিব্বতীয় ধারাতে একজন আধ্যাত্মিক শিক্ষক বা গুরুর সাহায্য ব্যতিত এটি করা একবারেই অসম্ভব। একজন গুরুর দীক্ষা ছাড়া তন্ত্র চর্চা অসম্ভব। যেহেতু আধ্যাত্মিক জগতে পদাপর্ণের ক্ষমতা গুরু কর্তৃক অর্পিত হয়। এধরনের আধ্যাত্মিক চর্চায় অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের ক্ষমতাও একজন গুরু বা আধ্যাত্মিক শিক্ষকের মাধ্যমে অর্জন করাটাই যথার্থ।

এরপর কী ঘটে?

ধ্যানকারীর শিরোভাগে অধিষ্ঠিত অবলোকিতেশ্বরে দেহ থেকে আলেকিরশ্মি বিচ্ছুরিত হয়, যা তাঁর হৃদয়ে অধিষ্ঠিত অবলোকিতেশ্বরকে স্পর্শ করবে। এবং একইভাবে সহস্র বুদ্ধের প্রতিমূর্তি হতে আলোকধারা উৎসারিত হয়ে . . . তা হৃদয়ে অবসি’ত সহস্র অ-কে স্পর্শ করবে। এরপর হৃদয়ে অধিষ্ঠিত অবলোকিশ্বের ও সহস্র অ হতে শুভ্র অমিয়ধারা অপরিমেয় তরঙ্গে তরঙ্গায়িত হয়ে বইতে থাকে। এই অমিয়ধারার প্রকৃতি হলো অদ্বৈতসম্বন্ধীয় প্রজ্ঞা; এবং এটি এমনিভাবে (শুভ্রবর্ণে) উৎসারিত হয়।

গুরুর এই অবলোকিতেশ্বর রূপ সমবেদনার দৈবরূপে আবির্ভূত হন। সহস্র বুদ্ধের প্রতিমূর্তি জাগতিক সত্তার শূন্য ও অনন্যসংযুক্ত অবস্থার প্রতীকরূপে প্রতীয়মান হয়। অ-সমূহ ও অবলোকিতেশ্বর (শূন্য অনন্যসংযুক্ত অবস্থা ও সমবেদনা) একত্রে এক অমিয়ধারা উৎপন্ন করে, যা আসলে ‘অদ্বৈতের প্রজ্ঞা’। অমিয়ধারার এই চিত্রটি বিভিন্ন তন্ত্রে একটি সাধারণ বিষয়। কখনো কখনো একে সমবেদনার অমিয়ধারা হিসেবে অভিহিত করা হয়। কাজেই একে প্রজ্ঞা ও সমবেদনা উভয় হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে।

এই অমিয়ধারা ধ্যানকারীর সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাঁকে সকল অপরিপক্ক কর্ম ও কুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্ত করে। ধ্যানকারীর

অভ্যন্তরের সকল অশুভকে তাঁর দেহের সকল লোমকূপ দিয়ে কৃষ্ণবর্ণের আলকাতরা, ক্লেদ ও বিছারূপে বের হয়ে যায় এবং তাঁকে পরিপূর্ণ শুদ্ধতা প্রদান করে। এটি তিব্বতীয় শুদ্ধিকরণ ধ্যানচর্চার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূল বিষয়। রীতি অনুযায়ী প্রতি ধ্যানচর্চাকারীকে এই এমন চর্চা অন্তত এক লক্ষ বার করতে হয়। এটি অবশ্য অন্যান্য বিভিন্ন তন্ত্রেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

এই তন্ত্রের রীতি অনুযায়ী যখন কোন ধ্যানকারীর দেহ সকল প্রকার কলুষতামুক্ত হয়ে যায়, তখন তা ‘অবলোকিতেশ্বরে রূপান্তরিত হয়’। কাজেই এখন তিনি অলৌকিকতা ও সমবেদনার মূর্ত রূপে প্রতীয়মান হন। যদিও তিনি ইতোমধ্যে বুঝে গেছেন যে অবলোকিতেশ্বর তাঁর নিজের মনে অবিচ্ছেদ্যভাবে অধিষ্ঠিত, এখন তিনি অবিচ্ছেদ্যতাকে আরো গভীরভাবে অবলোকন করতে পারেন। এবং এই পর্যায়ে এসে তাঁর পক্ষে বলা কঠিন যে তাঁর নিজের কর্মসমূহ কি তাঁর নিজের নাকি অবলোকিতেশ্বরের। প্রকৃতপক্ষে এই দু’য়ের মাঝে এখন আর কোন পার্থক্য নেই।

এরপর, অবলোকিতেশ্বর হিসেবে ধ্যানকারী স্বয়ং অবলোকিতেশ্বরের ক্ষমতা ও সমবেদনা নিয়ে নিজেরই প্রার্থনার জবাব দেবেন যা তিনি পূর্বে অবলোকিতেশ্বরের নিকট করেছিলেন, কারণ তখনো তিনি অবলোকিতেশ্বর থেকে নিজেকে আলাদা হিসেবে দেখেছিলেন। ‘আপনার (ধ্যানকারীর) দেহের সকল লোমকূপ ও পথ দিয়ে অমিয়ধারা বইতে আরম্ভ করে’। এই অমৃতসুধা জগতের সকল লোকে প্রবাহিত হতে থাকে, যা সকল প্রাণীর দুঃখ ও দুঃখের কারণসমূহ, অর্থাৎ কর্ম এবং মায়া বা বিভ্রম, হতে মুক্তি প্রদান করে। এটি আশেপাশের সবকিছুকে শুদ্ধ করে দেয় এবং এসকল কিছুকে বুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করে। সকল প্রাণীই অবলোকিতেশ্বরে পরিণত হয় এবং কারো আর কোন প্রকার ‘স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বলে কিছ থাকে না, যেমনটি আকাশের রংধনুর থাকে না’।

ধ্যানকারী অবলোকিতেশ্বররূপে জগতের সকল প্রাণীর দুঃখ নিবারণ করে থাকেন। এটি তাদের সকলকে অবলোকিতেশ্বরে পরিণত করে এবং জগতকে একটি পবিত্র ভূমিতে পরিণত করে। এটি হাবজ্রতন্ত্রের একটি নীতি অনুযায়ী সংঘটিত হয়, যাতে বলা হয়েছে, ‘যখন কোন ব্যক্তি আর বিভ্রান্ত থাকে না, তখন তার কাছে জগতটাকে পরিশুদ্ধ স্থান বলে মনে হয় এবং এ জগৎ সংসার নির্বাণ লাভ করে’। এই দিব্যদর্শনে সকল বিভ্রমও পরিশুদ্ধ হয়ে যায়; কাজেই এই জগৎ ও জগতের সকল প্রাণীই পরিশুদ্ধ হিসেবে পরিগণিত হয়। সকল সত্ত্বাকেই অলৌকিকতা ও সমবেদনার প্রকাশ, ও আলোকিত বলে মনে হয়, এবং কারো কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকে না।

এখন তিনি অবলোকিতেশ্বর হিসেবে ওম মনি পদ্মে হুম ছয় অক্ষরের এই মন্ত্র উচ্চারণ করেন। এবং সেইসাথে কল্পনা করেন যে অবলোকিতেশ্বরের প্রকাশ হিসেবে জগতের সকল প্রাণী তাঁর সাথে এই মন্ত্র উচ্চারণ করে। মনে হয় ‘যেন এই মন্ত্রের শব্দে সারা জগৎ প্রকম্পিত হয়’। সকল সত্ত্বা সমবেদনার প্রতিরূপে প্রকাশিত হয় এবং নিজেকে আবাহন করে।

অবশেষে, তিনি কল্পনা করেন যে তাঁর হৃদয়ে অধিষ্ঠিত দৈবশক্তি হৃদয়ের ঋহ হতে আলোক নির্গত হচ্ছে। এই আলো তাঁর কল্পনার সকল পবিত্র ভূমিতে অবতীর্ণ হয়। যখন এই আলো ভূমি স্পর্শ করে তখন:

এসকল স্থান আলোক ও অবলোকিতেশ্বররূপে ধ্যানকারী, যে সকল সত্তা দর্শনলাভ করেন তার মাঝে, সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়। এসকল সত্ত্বা আবার আলোকের মাঝে সম্পূণরূপে বিলীন হয়ে যায় এবং তা তাঁর নিজের মাঝে বিলীন হয়ে যায়। তাঁর শিরোভাগে অধিষ্ঠিত অবলোকিতেশ্বর আলোকের মাঝে বিলীন হয়ে যায় এবং তা তাঁর হৃদয়ে অধিষ্ঠিত অবলোকিতেশ্বরের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। শুভকালের সহস্র বুদ্ধ তাঁর হৃদয়ের সহস্র অ-র মাঝে বিলীন হয়ে যায়। স্তুপটি আকাশের রংধনুর মতো অদৃশ্য হয়ে যায়। এখন তিনি নিজে, যাকে তিনি অবলোকিতেশ্বররূপে অবলোকন করেছেন, তাঁর হৃদয়ে অবস্থিত পাপড়িতে সহস্র অ-ধারণকারী পদ্মের মাঝে বিলীন হয়ে যান। এই পদ্বটি আবার এর কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত অবলোকিতেশ্বরের মাঝে বিলীন হয়ে যায়, এবং তিনি চতুর্দিকে ছয় অক্ষরের মন্ত্রের জপমালাসহ তাঁর আসনের (চন্দ্রচক্র) মাঝে বিলীন হয়ে যান। এটিও এর কেন্দ্র অবস্থিত ঋহ-র মাঝে বিলীন হয়ে যায়, এবং এটিও শেষ পর্যন্ত অদৃশ্য হয়ে যায় এবং রেখে যায় একটি সম্পূর্ণরূপে পরিশুদ্ধ চিত্ত, যাতে আর কোন বস্তুর অস্তিত্ব থাকে না।

এই তান্ত্রিক চর্চার পুরো প্রক্রিয়াটিতে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রহীনতার কথা বলা হলেও আমরা কিন্তু ব্যক্তির উপসি’তি দেখতে পাই। তবে এখন সকল স্বতন্ত্র রূপ একে অন্যের মাঝে বিলীন হয়ে যায়, কারণ তাদের অদ্বৈত প্রকৃতি সম্পূর্ণরূপে একত্বের রূপে আবির্ভূত হয়, যা আসলে কর্তা-কর্ম বিভেদের উর্ধ্বে। যখন সকল স্বতন্ত্র রূপের বিলীন হয়, তখন যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো ‘একটি শুদ্ধ চিত্ত’। এই অবস্থা হলো থিনলে নরবুর ভাষায় “সকল বুদ্ধের অবিভ্রান- প্রজ্ঞা চিত্তের মত [যা] আকাশের নিষ্কলঙ্ক, অপরিবর্তনীয় রূপের মাঝে স্থায়ীরূপে প্রবাহিত হয়।” এটিকে কখনো কখনো ধর্মকায়া নামে অভিহিত করা হয়।

মহাযান দর্শনে বলা হয়েছে আলোকিত শক্তি প্রকাশিত হবার তিনটি পর্যায় রয়েছে। প্রথমটি হলো ধর্মকায়া, যা হলো সরল ও নিষ্কলঙ্ক আলোকিত অস্তিত্ব। শুদ্ধ অবয়বসমূহ ধর্মকায়া হতে আবির্ভূত হয়। এ থেকে উদ্ভুত হয় সম্ভোগকায়া, যা হলো স্বজ্ঞাভিত্তিক ও কল্পনানির্ভর যোগাযোগের পর্যায়। দীপ্তিমান দৈব আবির্ভাব এই পর্যায়ে ঘটে। শুদ্ধ শরীরী বিষয়সমূহ সম্ভোগকায়া থেকে আবির্ভূত হয়। এ থেকে উদ্ভুত হয় নির্মাণকায়া যা শরীরী অস্তিত্বসম্পন্ন বিষয়ের পর্যায়, এবং যা থেকে আলোকিত শক্তির প্রকাশ ঘটে। মূর্তিমান বুদ্ধ ও অন্যান্য শরীরী সত্ত্বার প্রকাশ। যা অন্য সকলকে আলোকিত হবার পথে নিয়ে যায় তা এই পর্যায়ে বিরাজ করে।

এই তন্ত্রে (একইভাবে অন্যান্য তন্ত্রেও), ধ্যানচর্চাকারীগণ প্রথমে গুরুর নিকট দীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে শুরু করেন। গুরু হলেন নির্মাণকায়ার একটি অংশ। তাঁদের গুরু তাঁদেরকে দৈব প্রকাশের ক্ষমতা প্রদান করেন, যা সংঘটিত হয় সম্ভোগকায়ায়। ধ্যানচর্চার বেশিরভাগ বিষয়ই এ পর্যায়ে ঘটে থাকে। শূন্যতা, অনন্যসংযুক্ত অবস্থা, ও সমবেদনার অনুধাবন জাগতিক সত্তার আরো অন্যান্য বহু বিষয়ের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে সম্ভোগকায়া ধর্মকায়াতে বিলীন হয়ে যায়, এবং ধ্যানচর্চাকারীগণ একাগ্রচিত্তে অদ্বৈত প্রজ্ঞাচিত্তের উপর মনোনিবেশ করেন।

অবলোকিতেশ্বরের ধারণাটি অসংখ্য উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। দার্শনিক দৃষ্টিকোন থেকে সরল আচারাদি পালন ও আখ্যান বর্ণনা করা থেকে মহাযান ধারার বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের মাঝে সমন্বয়ের মত বিষয়ে এর ব্যবহার হয়ে আসছে। অবলোকিতেশ্বরকে অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন দৈবসত্তা থেকে তান্ত্রিক ধ্যানচর্চাকারীগণের গভীরতম পর্যায়ের প্রজ্ঞাচিত্তের অভিজ্ঞতাভিত্তিক ধারণালাভের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

Leave a Reply