স্বর্গ মরীচিকা ১২

আমার মনে হয় অমি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। সঠিক স্মরণ নেই। আমার মনে আছে পাথরের দেয়ালের দিকে ঝুঁকে নিচের অতলস্পর্শী খাঁদের নিচে তাকালাম। আমার চোখে কিছু ধরা পড়লো না, কেবল বিশাল এক মেঘরাশি নিচের পৃথিবীটাকে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল।

‘অন্য সবারই এমন হয়েছে, ওরা মারা গেছে। আমি যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকি তা’হলে বুঝতে হবে ওদের চেয়ে আমার জীবনীশক্তি বেশী। কুষ্ঠ পৃথিবীর সব জায়গাতেই হানা দিতে পারে, মন্টে ভেরিটার অমর আত্মাদেরকেও ছেড়ে দেয়নি। এতে কিন’ কিছু যায় আসে না। আমার দুঃখ করার কিছু নেই। অনেক আগে আমি তোমাকে বলেছিলাম, যারা পাহাড়ে যায়, তাদের কিছু ত্যাগ করতে হয়। এটাই ভবিতব্য। আমাকে বেশীদিন কষ্ট করতে হবে না। তাই তোমার মন খারাপ করার কিছু নেই।’

কোন কথা বলতে পারলাম না। আমার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। সেটা মোছারও প্রয়োজন বোধ করলাম না।

‘মন্টে ভেরিটায় কোন স্বপ্ন নেই, কোন অলীকতা নেই। এটা পৃথিবীরই একটা অংশ মাত্র, তুমিও এর একটা অংশ। যদি তোমার মনের কোন অলৌকিক কল্পনা ধ্বংস করে দিয়ে থাকি, তবে আমাকে ক্ষমা করে দিও। তুমি যে অ্যানাকে জানতে সে হারিয়ে গেছে, তার বদলে এখন নতুন অ্যানাকে দেখছো, তুমি কোন অ্যানাকে বেশী করে মনে রাখবে সেটা তোমার ইচ্ছে। তুমি তোমার নারী-পুরুষের জগতে ফিরে গিয়ে একটা নতুন মন্টে ভেরিটা তৈরী করে নাও।’

দূরে কোথাও পছাট ছোট ঝোপ আর খাটো খাটো গাছের মধ্যে দিয়ে বাতাস বয়ে যাওয়ার শব্দ কানে এলো, মাটি আর পাথরের গন্ধ নাকে এলো।

বহু নিচের উপত্যকায় কিছু কুঁড়েঘর, ওখানে কিছু নারী-পুরুষ সংসার করছে, সন্তানদের লালন-পালন করছে। ওদের কাছে আগুন আছে, ওদের ঘরের চুলো থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে, জানালার ভেতরে ঘরের আলো দেখা যাচ্ছে। দূরে একটা রাস্তা ঘুরে ঘুরে নেমে চলে গেছে, ওখানে রেললাইন এঁকে বেঁকে চলে গেছে আরও দুরের কোন লোকালয়ে, শহরে। আরও কত শহর রয়েছে, কত শত-সহস্র রাস্তা, প্রত্যেক রাস্তার দুই ধারে অসংখ্য বাড়ি, বাড়ির জানালায় আলো। এই মন্টে ভেরিটা থেকে দুরে ওরা সকলেই ওদের দৈনন্দিন কাজকর্ম করে যাচ্ছে।

‘দুশ্চিন্তা করার কিম্ব্বা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ঐ উপত্যকার অধিবাসীদের কথা ভাবছো তো? ওরা আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তবে একটা কথা . . .

অ্যানা হঠাৎ একটু চুপ করে গেল, আমি অবশ্য ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম না, তা সত্ত্বেও আমার মনে হলো ও একটু হাসলো যেন, তারপর বললো, ‘ভিক্টরকে ওর স্বপ্ন নিয়ে থাকতে দাও।’

ও আমার হাত ধরলো, আমরা চূঁড়ো থেকে সিঁড়ি বেয়ে চত্বরটাতে নেমে এলাম, তারপর চত্বরটা পার হয়ে গলিপথটার কাছে এলাম। ওরা সকলে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো, ওদের সবার বাহু আর পা উন্মুক্ত, ওদের চুল একই কায়দায় পুরুষদের মতো করে ছাঁটা।

সেই গ্রাম্য কিশোরীটার দিকে আমার দৃষ্টি গেল, নতুন দীক্ষাপ্রাপ্ত মেয়েটা, যে এই কিছুক্ষণ আগে সমস’ পৃথিবীকে অস্বীকার করে ওদের একজনে রূপান-রিত হয়ে গেছে। ওকে অ্যানার দিকে ফিরে তাকাতে দেখলাম, ওর চোখের দিকে তীখ্নদৃষ্টিতে তাকালাম, সে চোখের মধ্যে কোন ভীতি নেই, আতঙ্ক নেই, কোন অনুশোচনাও নেই।

সকলে অ্যানার দিকে তাকিয়ে থাকলো, ওদের চোখে আনন্দ, বিজয়ের আনন্দ, যেন সকল জানা আর সকল অজানার পরিসমাপ্তি ঘটে গিয়েছে ওদের মনে। ওরা সকলে অ্যানার কষ্ট বোঝে, অ্যানার শ্রম-সাধনার মূল্য উপলব্ধি করে, আর অ্যানার সকল অনুভূতির সাথে ওরা একাত্ম হয়ে যায়। নিজেরা সেই সব অনুভূতি নিজের মধ্যে অনুভব করে আর গ্রহণ করে নিয়েছে সকল কষ্ট, সকল যন্ত্রণা। অ্যানা কখনই আর নিঃসঙ্গ হবে না।

ওরা আমার দিকে তাকালো, ওদের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হয়ে গেল; ভালবাসা আর অভিজ্ঞতার বদলে ওদের চোখে আমি সমবেদনার ছোঁয়া দেখতে পেলাম। অ্যানা বিদায় জানালো না। ও এক মুহূর্তের জন্য ওর হাত আমার কাঁধের উপর রাখলো।

সূর্য এখন আর মাথার উপরে নেই। পশ্চিম আকাশের দিকে যথেষ্ট ঢলে পড়েছে। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ নিচের উপত্যকা থেকে উঠে আসছে উপরে। আমি মন্টে ভেরিটার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।

আমি যখন গ্রামে ফিরে এলাম তখন সন্ধ্যা। আকাশে তখনও চাঁদ দেখা যায়নি। পাহাড়ের সবচেয়ে নিচের চূড়োটা পার হয়ে সারা আকাশে আলো ছড়াতে আরও ঘন্টা দুই সময় লাগবে। উপত্যকার অধিবাসীরা একজোট হয়ে অপেক্ষা করছে। ওরা সংখ্যায় তিন শ’ জনেরও বেশী, গ্রামের কুঁড়েঘরের চারধারে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ওরা অপেক্ষা করছে। সকলের হাতেই অস্ত্র, কারও হাতে বন্দুক, গ্রেনেড্‌ও আছে সাথে, কেউ কেউ আবার আদিম বর্শা আর কুড়াল জাতীয় অস্ত্রে সজ্জিত। ওরা আগুন জ্বেলে অপেক্ষা করছে, গ্রামের পায়ে চলা পথটার ধারে, কুঁড়েঘরগুলোর আঙ্গিনায়, ওদের সঙ্গে ওরা খাবারও নিয়ে এসেছে। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে, আগুনের চারধারে জটলা করে ধুমপান করছে, মদপান করছে, কথা বলছে। কারো কারো সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা শিকারী কুকুর।

প্রথম কুঁড়েটার মালিক ওর ছেলের সাথে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ওদের হাতেও অস্ত্র, ছেলেটার হাতে একটা বর্শা আর কোমরে একটা ছুরি গোঁজা। লোকটা আমার দিকে বোকা, ভোঁতা চোখে তাকালো।

‘তোমার বন্ধু মারা গেছে, ও বেশ কয়েক ঘন্টা আগেই মারা গেছে।’

ও নিরুত্তাপ গলায় কথাগুলো উচ্চারণ করলো। আমি ওকে ঠেলে ঘরের ভেতের ঢুকলাম।

ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। একটা ভিক্টরের মাথার ধারে আর একটা পায়ের দিকে। আমি ভিক্টরের মুখের ওপর ঝুঁকে ওর হাতটা ধরলাম।

ঐ লোকটা মিথ্যা কথা বলেছে। ভিক্টর শ্বাস নিচ্ছে। ওর হাতে আমার হাতের স্পর্শ পেয়ে ও চোখ খুললো।

‘ওর সাথে তোমার দেখা হয়েছে?’

ও জিজ্ঞেস করলো। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’

‘আমার মনে হয়েছিল তুমি ওর সাথে দেখা করতে পারবে। এখানে শুয়ে আমার মনে হয়েছিল এমন হবে। ও আমার স্ত্রী, আর আমি দীর্ঘকাল ধরে ওকে ভালবেসে গেলাম, কিন্তু কেবল তোমাকেই ও দেখা দিলো। অনেক বেশী দেরী হয়ে গেল, না? তোমাকে এখন হিংসা করা বা ঈর্ষা করা অর্থহীন।

মোমবাতির ঘোলাটে আলোর জন্য ও দরজার ওপাশের লোকসমাগম দেখতে পারছিল না, ওদের কথাবার্তার শব্দও অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।

‘ওকে কি আমার চিঠি দিয়েছিলে?

‘হ্যাঁ, ও চিঠিটা পেয়েছে, ও বলেছে চিন্তার কোন কারণ নেই, ভয় পাবারও কোন কারণ নেই। ও ঠিক থাকবে। ওদের কিছু হবে না।’

ভিক্টর হাসলো। ও আমার হাতটা ছুঁয়ে থাকলো।

‘তা’হলে এ সবই সত্যি। মন্টে ভেরিটাকে নিয়ে আমি এতকাল যে স্বপ্ন দেখে এসেছি সব সত্যি। ও আনন্দে আছে, তৃপ্তিতে আছে, কোন দিনই ওর বয়স বাড়বে না, ওর রূপ নস্ট হবে না। ওর চুল, চোখ, ওর হাসি, সব কিছুই কি আগের মতো আছে? আমাকে খুলে বল।’

‘হ্যাঁ, সব, সব কিছুই ঠিক একই রকম। আমি আর তুমি অ্যানাকে যেমন দেখেছি, অ্যানা ঠিক তেমনই সুন্দরী রয়ে যাবে।’

ও কোন উত্তর দিলো না। আর আমি ওর পাশে চুপ করে বসে থাকতে থাকতে একটা সিঙ্গা বেজে উঠলো, তারপর আর একটা, তারপর আর একটা। বাইরে অস্থির চলাফেরার আওয়াজ পেলাম। ওরা ওদের অস্ত্র কাঁধে তুলে নিয়ে, জ্বলন্ত আগুন লাথি মেরে নিভিয়ে দিলো, তারপর একত্রিত হয়ে শৃঙ্গের দিকে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করলো।

আমি উত্তেজিত কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনতে পেলাম, লোকজন হাসছে, উচ্চকন্ঠে কথা বলছে, ওরা এক অজানা অভিযানের উত্তেজনায় উত্তেজিত।

ওরা সবাই চলে যাবার পর আমি ঘর থেকে বেরিয়ে জনমানবহীন গ্রামটার পথটাতে এসে দাঁড়ালাম, আমার সামনে বিশাল বড় পূর্ণিমার চাঁদটা বহু নিচের অন্ধকার উপত্যকা থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসছে।

Leave a Reply