আমি বুঝতে পারলাম ও অ্যানা। আমি বুঝতে পারলাম ও ছাড়া এমনভাবে আর কেউ দাঁড়াতে পারে না। আমি ভিক্টরের কথা ভুলে গেলাম, আমি কেন এখানে এসেছি তাও ভুলে গেলাম, সময়, স’ান, এই দীর্ঘ বৎসরগুলোর সবকিছুই আমার স্মৃতি থেকে মুছে গেল। আমার চোখের সামনে কেবল অ্যানার উপসি’তি, ওর মুখের সৌন্দর্য, আর ওর সেই শান-, স্নিগ্ধ কন্ঠস্বর, ‘আমরা দুজনেই কি একই জিনিষ খুঁজছি না?’। আমার মনে হলো, আসলে আমি এতকাল ধরে অ্যানাকেই ভালবেসে এসেছি। ভিক্টরের সাথে ওর পরিচয় হয়তো আমার আগে হয়েছে, ওকে তার জীবনসঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করছে ঠিকই, কিন’ ওদের ঐ বন্ধন আর আনুষ্ঠানিকতা আমাদের আত্মিক ঘনিষ্টতার উপর কোন প্রভাব ফেলেনি। আমাদেরকে যখন ভিক্টর প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, সেই সময় থেকেই আমাদের দুজনের হৃদয় মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। আর সেই অদ্ভুত অপ্রাকৃত হার্দিক বন্ধন সকল গন্ডি, সকল বাধা অতিক্রম করে আমাদেরকে এক অদৃশ্য নিবিড়তায় বেঁধে রেখেছিল এতকাল, দীর্ঘকালের নৈশব্দ, দীর্ঘ বৎসরের বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও।
প্রথমেই আমার ভুল হয়েছিল, অ্যানাকে পাহাড়ে উঠতে দেয়া উচিত হয়নি আমার। বহুদিন আগে ম্যাপ হাউজে ও আর ভিক্টর যখন ওদের সাথে আমাকে যেতে বলেছি, তখন ওদের সাথে আমার যাওয়া উচিত ছিল। আমার অবচেতন মনে বোঝা উচিত ছিল অ্যানার মনে সেই সময় কি অনুরণিত হচ্ছিল। আর তার সেই আহ্বান আমার মনেও অনুরণিত হওয়া উচিত ছিল। আমি নিশ্চয়ই সে রাত্রে ভিক্টরের মতো অচেতন ঘুমে ঘুমিয়ে না থেকে জেগে থাকতাম আর অ্যানার সাথে এখানে চলে আসতে পারতাম। যে দীর্ঘ সময়, কতকগুলো বৎসর অবহেলায় নষ্ট করেছি, ছুঁড়ে ফেলেছি আমার জীবন থেকে, সেগুলো, অ্যানার আর আমার, আমাদের আনন্দময় সময় হিসাবে অক্ষয় হয়ে থাকতে পারতো, সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন, এই দুর্গম পর্বতের নিঃসঙ্গতা স্বর্গরাজ্যে রূপান-রিত করতে পারতাম।
আমি আর একবার আমার চারপাশে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের দিকে তাকালাম। অতৃপ্ত আকাঙ্খা আর বেদনার সাথে লক্ষ্য করলাম, ওদের মুখগুলি কি এক অনাবিল আনন্দের প্রেরণায় উদ্ভাসিত, সেই অমৃতের স্বাদ আমি অনুভব করতে পারছি না। ওদের নিস-ব্ধতা, কোন প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ নয়, অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার আতঙ্কে নয়, কিন’ এ পর্বত ওদের মনে যে প্রশানি-, যে সুরময়তার সৃষ্টি করেছে তারই বহিঃপ্রকাশ। এখানে মুখ ফুটে কোন শব্দ উচ্চারণের প্রয়োজন নেই, যখন একটু স্মিত হাসি, একটু সুকোমল দৃষ্টি মনের সকল প্রশান- কমনীয়তাকে উৎসরিত করে দেয়; অথচ উচ্চকিত, উল্লসিত হাসি হৃদয়ের অন-স’ল থেকে উৎসরিত বৈজয়ন-ী উচ্ছ্বাস এই প্রশানি-কে অতিক্রম করতে পারে না। এখানে জীবন পরিপূর্ণ, পরিতৃপ্ত আর পরিব্যপ্ত; এখানে সূর্যের তীব্র শক্তি শিরায় প্রবাহিত হতে হতে মাংসে, মজ্জায় মিশে যায় আর দেহের সকল জমাট কলুষতা, ঘৃণ্য জটিলতা, দেহ থেকে, ফুসফুস হতে পরিশ্রুত হতে থাকে, দেহে শক্তি আর উদ্যমের উদ্ভব হতে থাকে।
এই অল্প সময়ের মধ্যে আমার অন্তরের মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়ে গেল আর ঘন কুয়াশা আর ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে ভীত, সন্ত্রস-, ক্রুদ্ধ যে আমি অল্প কিছুক্ষণ আগে এই শৈল শিখরে উঠছিলাম, তার আর কোন অস্তিত্ব থাকলো না। যে আমি একজন মধ্যবয়স্ক, চুল অর্ধেক পেকে গিয়েছে, সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় মন্টে ভেরিটার অধিবাসীদের সাথে প্রখর সূর্যের দিকে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছি, পৃথিবীর কোন লোক আমাকে এখন দেখলে পাগল বলে মনে করবে নিঃসন্দেহে।
সূর্য এখন আকাশের অনেকটা উপরে উঠে আমাদের প্রায় মাথার উপরে স’ান নিয়েছে। সূর্যের প্রখর উত্তাপে আমার ত্বকে একই সাথে আনন্দ আর যন্ত্রণার সংমিশ্রণ দেখা দিলো আর আনন্দময় উত্তাপ ত্বক অতিক্রম করে হৃৎপিন্ড আর ফুসফুস ভেদ করে গেল।
আমি অ্যানার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছিলাম, আমার মন থেকে সবকিছু মুছে গেল, আমি সব ভুলে গেলাম। আমার কানে এলো আমি জোরে জোরে ‘অ্যানা, অ্যানা’ বলে চিৎকার করছি। অ্যানা বুঝতে পারলো আমি ওখানে দাঁড়িয়ে, কারণ ও আমার দিকে হাত তুলে ইশারা করলো। কেউ কিছু মনে করলো না, কেউ কোন গুরুত্বও দিলো না। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো, ওরা আমার অবস’া বুঝতে পেরে নিশ্চুপ থাকলো।
তখন ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা মেয়ে এগিয়ে এলো। গ্রামের সাধারণ হালকা কাপড় পরা, পায়ে জুতো, মোজা; ওর চুল কাঁধ পর্যন- ঝুলছে। আমি ভেবেছিলাম ওর হাতদুটো প্রার্থনার ভঙ্গিতে ভাঁজ করা থাকবে বুঝি, কিন’ না, ওর হাতদুটো ভাঁজ করে বুকের উপরে হৃৎপিন্ডের উপরে রাখা, আঙুলগুলো যেন হৃৎপিন্ডটা ছুঁয়ে আছে।
ও ধীরে ধীরে হেঁটে গভীর খাঁদটার ধারে গিয়ে যেখানে অ্যানা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। গত রাতে, চাঁদের আলোয় এক অদ্ভুত আতঙ্কে আমার মন ভরে গিয়েছিল, কিন’ এখন কোন ভয় আমাকে স্পর্শ করলো না। এখন আমাকে যেন এই সমাবেশে গ্রহণ করা হয়েছে। আমি যেন এখন ওদেরই একজন। অন্তত একবার, এখন এই সময়ে, এই আকাশের তলে, আজকের সূর্য যখন খাঁদটার প্রান- ছুঁয়ে আছে আর নীলশুভ্র তুষার সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে। আমরা এক সাথে হাঁটু গেড়ে বসেছি, আমাদের মুখমন্ডল সূর্যের দিকে প্রসারিত আর অপূর্ব সুন্দর সেই প্রার্থনা-সঙ্গীত আমার কানে এসে বাজছে।
আমার মনে হলো, এইভাবেই মানুষ পৃথিবীর প্রথম দিন প্রার্থনা করেছিল, আর এভাবেই পৃথিবীর শেষ দিনে প্রার্থনা করবে। এখানে কোন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, কোন ত্রাতা নেই, কোন প্রতিমাও নেই। কেবল সূর্য, সৃষ্টির আদি থেকে আলো আর জীবনীশক্তি দিয়ে আসছে অকৃপণভাবে। এভাবেই সৃষ্টির আদি থেকে অন- পর্যন- রয়ে যাবে।
সূর্যের আলো ধীরে ধীরে সরে যেতে আরম্ভ করলো, আর মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো; ও ওর জুতো, মোজা আর পোশাক খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। অ্যানা এগিয়ে এসে একটা ছুরি দিয়ে ওর ঝুলন্ত চুল কেটে কানের উপর পর্যন্ত ছেঁটে দিলো পুরুষদের মতো করে। মেয়েটি ঠিক একইভাবে বুকের উপর হাতদুটি মুঠিবদ্ধ করে রাখলো।
আমার মনে হলো, মেয়েটি এখন মুক্ত, ও আর নিচের গ্রামে ফিরে যাবে না। ওর বাবা-মা ওর জন্য কাঁদবে, ওর মনে মানুষও বেদনাহত থাকবে। কিন্ত ওরা কোনদিনই জানতে পারবে না মেয়েটি মন্টে ভেরিটার এই শৈলশিখরে কি সত্যের স্বাদ গ্রহণ করলো। নিচের উপত্যকায় হয়তো এখন আর একটা বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে, আর এক জোড়া নারী-পুরুষের সংসার শুরু হলো। এর পর কিছুদিনের দাম্পত্য জীবনের উদ্দাম আনন্দ প্লাবনের পর সংসার পালনের চিন্তা, সন্তান ধারণ, পালন, রোগ, ব্যাধি, জরা, সমস্যা, জটিলতা, দৈনন্দিন জীবন যন্ত্রণার স্রোত বেয়ে এক সময় বৃদ্ধ হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া, এই তো জীবন! কিন্তু এখন এই মেয়েটি সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে গেল আজ।
এখানে কোন অনুভূতিরই শেষ হয় না। প্রেম আর সৌন্দর্যের মৃত্যু নিই, নিঃশেষও হয় না। জীবনযাত্রা কঠিন, কারণ প্রকৃতিই কঠিন এবং প্রকৃতির কোন ক্ষমা নেই, মেয়েটি এই জিনিষটিই চেয়েছিল, আর একারণের ও এখানে এসেছে। ও আগে যা জানতো না, যা কখনও নিচের জগতের আর কেউ জানতে পারবে না, তার সবকিছুই ধীরে ধীরে জানতে পারবে। আবেগ আর আনন্দ আর হাসি, সূর্যের প্রখর উত্তাপ, চাঁদের গভীর আকর্ষণী শক্তি, দৈহিক আকর্ষণবিহীন প্রেম, দুঃস্বপ্নহীন ঘুম। আর এটাই নিচের জগতের সকলে ঘৃণা করে এসেছে, আর মন্টে ভেরিটার এ বিষয়টাই ওদের জন্য সবচেয়ে ভীতিময়। কারণ এখানে এমন কিছু আছে, যা তাদের নেই, যা ওরা কোনদিনই স্পর্শ করতে পারবে না। আর এ জন্যই ওদের এত ক্রোধ, এত হিংসা, এত অতৃপ্তি।
অ্যানা ঘুরে দাঁড়ালো, ওর সাথে মেয়েটা, ওর নিচের সমাজের সকল চিহ্ন, পোষাক, নারীত্ব, নগ্নতা, সব কিছু পরিত্যাগ করে নগ্ন পায়ে, আর সকলের মতো এক হয়ে গেল। ওর চোখমুখে মুগ্ধতা আর ঔজ্জ্বল্য; আমি বুঝতে পারলাম, আর কিছুই ওকে স্পর্শ করতে পারবে না।
ওরা একে একে নিচের চত্বরটাতে নেমে এলো, আমি একা চূড়োর কাছে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার মনে হলো যেন স্বর্গরাজ্যের বন্ধ দরজার সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। অল্প সময়ের স্বর্গীয় আনন্দ একটুখানি আমাকে স্পর্শ করেই অন-র্হিত হলো। ওরা এ জগতেরই অধিবাসী; যেখানে আমার প্রবেশাধিকার নেই। আমি ঐ নিচের পার্থিব জগতের আগনদক।
আমি আবার আমার পোশাক, জুতো পরে, যে সুস’ জগতকে ফিরে যেতে চাইছিলাম না, আবার সেটাকেই গ্রহণ করলাম। মনে পড়লো ভিক্টর আর আমার উদ্দেশ্য কি। আমি চত্বরটাতে নেমে এসে উপরে তাকিয়ে দেখি অ্যানা আমার জন্য চূড়ার পাশে অপেক্ষা করছে।
অন্যরা দু’পাশে পাথরের দেয়ালের সাথে মিশে গিয়ে আমাকে জায়গা করে দিলো। তাকিয়ে দেখলাম অ্যানার পোশাক অন্যদের থেকে আলাদা, ওর সারা দেহ জোব্বা আর ঘোমটা দিয়ে ঢাকা।
পাহাড়ের চূড়োটা সরু হয়ে উঠে গিয়েছে অনেক উপরে, আকাশ ভেদ করেছে যেন। অ্যানা, সেই দীর্ঘকাল আগে ওর বাড়িতে সেই শীতের সন্ধ্যায় ফায়ারপ্লেসের পাশে সেভাবে বসেছিল, তেমনভাবে, চূড়াটার শেষ ধাপে, এক হাঁটু ভাঁজ করে গলার কাছে রাখা, কনুইটা সেই হাঁটুর উপর। আজ যেন গতকাল, আজ যেন ছাব্বিশ বছর আগেকার সেই দিন, আমরা আবার দুজনে নিঃসঙ্গ, যেন সেই শীতল সন্ধ্যায় শ্রপশায়ারের সেই ম্যানর হাউজে, আমার মনে এক অনাবিল শানি-র পরশ বয়ে গেল, সেদিন যেমন আমি অনুভব করেছিলাম। আমি অ্যানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ওর হাতটা ছুঁতে চাইলাম, তা না করে হাতদুটো বুকের উপর ভাঁজ করে আমি ওর কাছে পাথরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম।
ও বললো, ‘এ জায়গাটা তা’হলে তুমি খুঁজে পেলে, অনেক বেশী সময় নিয়ে ফেলেছো। তাই না? ‘
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমিই তা’হলে আমাকে এখানে টেনে আনলে? প্লেনটা ভেঙে পড়ার সময় কি তুমি আমাকে ডেকেছিলে?’
ও হাসলো, আর আমার মনে হলো, এত বছর ধরে আমি কখনোই ওর কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাইনি।
মন্টে ভেরিটায় সময় স্তব্ধ হয়ে গেল।
‘আমি চেয়েছিলাম তুমি অনেক আগেই আমার কাছে চলে আসো। কিন্তু তোমার মন সব সময়েই বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। অনেকটা টেলিফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখার মতো। যোগাযোগের জন্য দুই তরফের সমান আগ্রহ দরকার, নয় কি? এখনও কি তোমাদের জগতে তেমনিভাবে যোগাযোগ করতে হয়?’
আমি উত্তর দিলাম, ‘হ্যা, একইভাবে। আমাদের জগতে অবশ্য তারের সংযোগ লাগে, মন লাগে না।’
‘তুমি তো তোমার মনটাকে বহু বছর ধরে বাক্সের মধ্যে বন্ধ করে রেখেছিলে। খুবই দুঃখের ব্যাপার, আমরা অনেক অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে পারতাম। ভিক্টর তার মনের কথা বলার জন্য চিঠি লিখতো, তোমার ক্ষেত্রে তো সেটার প্রয়োজন হতো না।’
আমার কাছে অনেক কিছু ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠলো, মনে একটু ক্ষীণ আশার সঞ্চারও হলো। এখনও আমি সঠিক পথে যেতে পারবো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি ওর চিঠি পড়েছো? আমারটা পড়েছো? তুমি জানো ও মারা যাচ্ছে?’
ও বললো, ‘হ্যাঁ, ও অনেক দিন ধরেই ভুগছে। আর সেজন্যই আমি চেয়েছি তুমি এই সময় এখানে আসো। এটা ওর জন্য ভালই হলো। যখন তুমি এখান থেকে ফিরে যাবে, তুমি বলতে পারবে তুমি আমার সাথে কথা বলেছো। ও শুনে খুশি হবে।’
‘তুমি নিজে গিয়ে দেখা করো না কেন?’
‘এভাবেই ভালো। ওকে ওর স্বপ্ন নিয়েই থাকতে দাও।’
ওর স্বপ্ন? অ্যানা কি বলতে চাইলো? তা’হলে, এই মন্টে ভেরিটায় ওরা সর্বশক্তিমান নয়? অ্যানা তা’হলে বুঝতে পেরেছে, কি বিপদের মধ্যে ওরা এখন পড়েছে?
আমি বললাম, ‘অ্যানা, তুমি যেভাবে বলবে আমি সেভাবেই কাজ করবো। আমি ভিক্টরের কাছে ফিরে যাবো, আর ওর শেষ সময় পর্যন- ওর পাশে থাকবো। কিন’ সময় খুবই কম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তুমি আর যারা এখানে আছে, সবাই খুব একটা বড় বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছো। কাল, কিম্বা সম্ভবত আজ রাতে, উপত্যকার অধিবাসীরা মন্টে ভেরিটায় উঠবে, ওরা এই এলাকাটা ভেঙে ফেলবে হয়তো, তোমাদের মেরে ফেলতেও পারে। ওরা আসার আগে তোমাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে। যদি তোমাদের নিজেদের রক্ষা করার কোন ব্যবস’া না থাকে, তা’হলে আমাকে তোমাদের সাহায্য করতে দাও। আমরা আধুনিক সভ্যতার বেশী দুরে নই। আমি নিচের উপত্যকায় গিয়ে পুলিশের শরণাপন্ন হবো, প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করবো, বড় কোন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করবো . . .
আমি আমার কথা শেষ করতে পারলাম না, যদিও নিজের কাছেই আমার পরিকল্পনা খুব একটা বাস্তব শোনালো না, তবু আমার উপর অ্যানা আস্থা আনুক, আমাকে বিশ্বাস করে কোন দায়িত্ব দিক এটাই আমি চাচ্ছিলাম।
আমি ওকে বললাম, ‘আসল কথা হলো, এখানে তোমাদের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়বে। এবারে হয়তো আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারবো, যদিও সন্দেহ আছে; কিন্তু এমন ঘটনা আবার ঘটবে, হয়তো আগামী সপ্তাহে, কিংবা আগামী মাসে। তোমাদের নিরাপত্তার দিন শেষ হয়ে আসছে। তুমি দীর্ঘকাল এই এলাকায় বন্দী জীবন যাপন করছো বলে এখনকার বাইরের জগত সম্পর্কে কিছুই জান না। এমন কি এই নিঃসঙ্গ জনপদ সন্দেহে দ্বিধাবিভক্ত, এখন নিচের উপত্যকার অধিবাসীরা আর আগের মতো কুসংস্কারাচ্ছন্ন নেই, ওরা এখন আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত, ওদের হৃদয়ে হত্যার আগুন জ্বলছে। তুমি নিজেকে আর মন্টে ভেরিটার আর সকলকে রক্ষা করার একটু সুযোগও পাবে না।’
অ্যানা আমার কথার কোন উত্তর দিল না। ও সম্পূর্ণ নিশ্চুপ আর নিস্পন্দ হয়ে আমার সব কথা শুনলো।
আমি আরও বললাম, ‘অ্যানা, ভিক্টর মারা যাচেছ। এতক্ষণে হয়তো মারা গেছে। তুমি যদি এখান থেকে বেরিয়ে আসো, ও তোমাকে সাহায্য করতে পারবে না, কিন্তু আমি পারবো। আমি তোমাকে সারা জীবন ভালবেসে এসেছি। তোমাকে বলার প্রয়োজন হয়নি, আমি জানি এটা তুমি জানতে। চাব্বিশ বছর আগে তুমি মন্টে ভেরিটায় চলে আসার কারণে দু’জন ব্যক্তির জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তুমি জান, যদিও এখন এটা কোন আলোচনার বিষয় না। এখন যখন অমি তোমাকে আবার খুঁজে পেয়েছি, এখনও অনেক জায়গা আছে, দূরে, সভ্যতা থেকে অনেক দূরে, অগম্য, যেখানে আমরা থাকতে পারবো, তুমি আর আমি, আর তোমার সঙ্গীরা, অবশ্য যদি তুমি ওদেরকে সঙ্গে নাও। আমার কাছে এ সব কিছু ব্যবস্থা করার মতো অর্থ আছে।
আমি কথা বলছি আর কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছি, আমি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করছি, পাসপোর্ট, কাপড়, কাগজপত্র সংগ্রহ করছি। আমি চোখের সামনে বিশ্বের মানচিত্রটা যেন দেখতে পেলাম, দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ থেকে এশিয়ার হিমালয়, হিমালয় থেকে আফ্রিকা, কানাডার উত্তরের দূর্গম পাহাড়ী অঞ্চল, যেখানে এখনও কোন মানুষর পায়ের চিহ্ন পড়েনি, গ্রীনল্যান্ডের সমস- এলাকাটাই তো অগম্য। তাছাড়া রয়েছে দ্বীপ, অসংখ্য, অগনিত দ্বীপ, যেখানে এখনও কোন মানুষের পায়ের চিহ্ন পড়েনি, যেগুলো শুধু সমুদ্রের পাখিদের বিচরণক্ষেত্র আর নিঃসঙ্গ সমুদ্রের স্রোতবিধৌত। পর্বত আর দ্বীপ ছাড়াও আছে গহীন জঙ্গল, উষর মরুপ্রান-র, মেরু অঞ্চল, অ্যানা যেটাই পছন্দ করুক না কেন আমার তাতে কিছু এসে যাবে না; এতকাল ও আমার দৃষ্টির অন-রালে ছিল, এখন আমি সব সময় ওর সাথে থাকতে চাই।
এখন এটা সম্ভব, কারণ ভিক্টর মারা যাচ্ছে, অ্যানার উপর ওরই একমাত্র অধিকার ছিল। আমি ভীতু হলেও আমি বিশ্বস- ছিলাম, আমার সব কথাও আমি অ্যানাকে বললাম। তারপর চুপ করে গেলাম, এখন ওর কথা শুনবো আমি, ওর কি বলার আছে?
অ্যানা হাসলো, ওর সারা মুখে সেই পুরানো দিনের উষ্ণ, প্রাণবন্ত, হালকা উচ্ছ্বল হাসি; আমার মনে হলো এগিয়ে গিয়ে ওকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরি, কারণ ওর ঐ হাসি পরিপূর্ণ জীবন আর পরিপূর্ণ প্রাণময়তায় ভরা।
আমি সাবধানে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা’হলে কি ঠিক করলে?’
‘এক সময় একজন লোক ট্রেন স্টেশনের কাউন্টারে এসে বুকিং ক্লার্ককে বললো, আমি স্বর্গের টিকিট চাই। কেবল একদিকের টিকিট, ফিরতি টিকিটের দরকার নেই। ওর কথা শুনে যখন ক্লার্কটা বললো, তেমন কোন টিকিট ওর কাছে নেই। লোকটা টেবিলের উপর রাখা কালির দোয়াতটা তুলে ক্লার্কটার মুখে ছুঁড়ে মারলো। পুলিশ এসে লোকটাকে ধরে নিয়ে জেলখানায় পুরলো। তোমার কথাগুলো কি সেই রকম শোনাচ্ছে না? স্বর্গের টিকিট? এটা সত্যের পবত, সবকিছু থেকেই এটা পৃথক।’
আমার মনে খুব আঘাত লাগলো। অ্যানা আমার কোন পরিকল্পনাই গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি, আর এখন এ নিয়ে ঠাট্টা করছে।
‘তা’হলে তোমার পরিকল্পনাটা কি, শুনি? এখানে অপেক্ষা করবে, এই দেয়ালের গন্ডির মধ্যে? আর ওরা এসে এই দেয়াল, এই ঘর, এখানকার সবকিছু ধ্বংস করে দেবে?’
‘আমাদের নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমরা জানি আমরা কি করবো।’
অত্যন- নির্বিকারভাবে অ্যানা কথাগুলো বললো, মনে হলো বিষয়টার কোন গুরুত্বই নেই। আর আমি যে কল্পনার প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলাম ওকে নিয়ে সেটা মুহূর্তে ভেঙে গেল।
আমি অভিযোগের সুরে বললাম, ‘তা’হলে, তোমাদের কোন গোপনীয় বিষয় আছে। তোমরা কোন অলৌকিক পদ্ধতিতে তোমাদেকে রক্ষা করবে? আমার কি হবে? আমাকে কি তোমাদের সাথে নিতে পার না?
‘তুমি তো নিজেই আসতে চাওনি? এর জন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন, মনের মধ্যে মন্টে ভেরিটার অনভূতি গড়ে তোলা কঠিন। এটা কেবল পার্থিব কাপড় ত্যাগ করা আর কেবল মন্ত্রোচ্চারণ বা সূর্যের উপাসনা করা নয়।’
অ্যানা আমার হাতের উপর ওর হাতটা রাখলো।
আমি ওর কথা বুঝতে পারলাম। বললাম, ‘তোমার কথা বুঝতে পারছি, আমি নতুন করে আরম্ভ করবো, সকল মূল্যবোধ নতুন করে শিখবো। আমি জানি এতকাল আমি যা করেছি সবই মূল্যহীন। জ্ঞান, কঠোর পরিশ্রম, সাফল্য পৃথিবীর এই সব শব্দের কোন অর্থ নেই। কিন’ আমি যদি তোমার কাছে থাকতে পারি. .’
‘কি ভাবে আমার সাথে থাকবে?’ অ্যানা আমাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
আমি ওর এই কথার উত্তর দিতে পারলাম না। প্রশ্নটা যেমন আকস্মিকভাবে করা হয়েছে, উত্তরটা অতটা সহজে দেয়ার জন্য আমি প্রসদত ছিলাম না। আমার মনে যে কথাটা ছিল, ওর সাথে থাকার অর্থ, একজন পুরুষ একজন মেয়ের সাথে যেভাবে দিন অতিবাহিত করে সেভাবে, তবে প্রথমেই সেভাবে নয়, ধীরে ধীরে, যখন আমরা একটা নির্জন স্থান খুঁজে পাবো, এক ভিন্ন পর্বতে, কিংবা জঙ্গলে, যেখানে পৃথিবীর জটিলতা থেকে আমরা নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারবো। এখনই কি সব কথা বলা যায়? আসল কথা হলো, আমি পৃথিবীর শেষপ্রান্ত পর্যন্ত ওকে নিয়ে ওর সাথে দিন পার করতে চাই।
‘অমি তোমাকে ভালবাসি, দীর্ঘকাল যাবত ভালবেসে এসেছি, এটাই সব না?’
‘না, মন্টে ভেরিটাতে না।’
একথা বলে অ্যানা ওর মাথার উপরের ঘোমটার আবরণ উন্মুক্ত করলো।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেলাম . . . . স’বির হয়ে গেলাম, আমার কথা হারিয়ে গেল, সকল অনুভূতি নিঃসাড় হয়ে গেল। আমার হৃদয় শীতল হয়ে জমে গেল।
অ্যানার মুখের এক ধারটা খেয়ে গেছে, ক্ষয়ে গেছে। বিধ্বস-, ভয়াবহ কালান্তক ব্যাধি ওর সুন্দর ভুরু, গাল, ওর গলায় ছড়িয়ে গেছে, ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে উপরের ত্বক আর তার নিচের উন্মুক্ত ঝিল্লি। যে চোখদুটো আমার মনে আনন্দের ঝড় তুলতো, সে চোখ মশিলিপ্ত, কোটরে ঢুকে গিয়েছে।
অ্যানা বললো, ‘বুঝতেই পারছো, এটা তোমাদের স্বর্গরাজ্য না।’