চারপাশে তাকিয়ে মন অজানা আশঙ্কায় ভরে গেল। চারদিক কুয়াশা আর মেঘে ঢাকা – ঘন কালো মেঘ আর গাঢ় নিশ্ছিদ্র কুয়াশা। নিচের পথটা দৃষ্টি সীমা থেকে একেবারে আড়াল করে রেখেছে। আমার চোখের সামনে পর্দার মতো ঝুলে আছে যেন কুয়াশা আর দলাদলা মেঘ। আমার পিছনের এই লোকালয়ের ঘরগুলোর চালের উপর ওপর দিয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে ঘুরে ঘুরে, গড়িয়ে গড়িয়ে সরে যাচ্ছে। আমার সামনের যে পথটা ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে ঘুরে উপরে উঠে গিয়েছে, সেটাও ঐ মেঘের আড়ালে বাতাসে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
অত্যন- আলতোভাবে নিঃশব্দে মেঘ আমার গাল ছুঁয়ে ধীরে ধীরে সরে গেল, কিন’ গলে গেল না, অদৃশ্য হয়ে গেল না। বাতাসের জ্বলীয় অংশ আমার চুলে, হাতে লেগে যাচ্ছে, ঠোঁটে লাগছে, জিভ বার করে এর স্বাদও অনুভব করতে পারলাম। অস্পষ্ট আধো আলোয় এ দিকে ও দিকে তাকিয়ে দেখলাম; ঠিক কি করবো সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারলাম না। আমার মনের গভীরে বহু যুগের সঞ্চিত আত্মনিয়ন্ত্রণ শক্তি আমাকে ফিরে যেতে বললো।
আমার দীর্ঘকালের পাহাড়ে ওঠার অভিজ্ঞতার আলোকে মনে হলো, এই বিদ্রোহী আবহাওয়ার মধ্যে কোথাও বের হওয়া বা কোন কিছু করা নিতান- পাগলামী। অন্যদিকে গ্রামের ঐ বন্ধ ঘরে মৃত্যু পথযাত্রী ভিক্টরের পাশে বসে থাকাও একেবারে অসম্ভব, যখন এই জীবন্মৃত লোকটা অনেক আশায়, অনেক স্বপ্নে আর দীর্ঘ প্রতিক্ষার তৃষ্ণা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। ও মারা যাচ্ছে, সেটা আমি যেমন জানি, ও তেমনই বুঝে ফেলেছে।
এখন আমার বুকের পাশে ওর স্ত্রীকে লেখা শেষ চিঠি বয়ে নিয়ে যাচ্ছি আমি। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণ দিকে মোড় ঘুরলাম, একইভাবে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ধীরে ধীরে অবিশ্রান-ভাবে মন্টে ভেরিটার চূড়া থেকে নেমে এসে আমাকে পার হয়ে নেমে যাচ্ছিল। আমি উপরে উঠতে আরম্ভ করলাম। ভিক্টর বলেছিল, আমি দুই ঘন্টার মধ্যে চূড়োর ধারে পৌঁছাতে পারবো। কিন’ সূর্য ওঠার কিছুক্ষণ পরই আমি ওখানে পৌঁছে গেলাম। তাছাড়া আমার সাথী অর্থাৎ ভিক্টরের এঁকে দেওয়া পথের নিশানা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।
গ্রাম ছেড়ে আসার একঘন্টার মধ্যেই আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম। সারাটা দিন আমি সুর্যের মুখ দেখতে পাবো না। সারাটা সময় পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ সামনের দিকে থেকে এসে আমাকে পার হয়ে পিছনে চলে যাচ্ছিল, ভিজে মেঘের দাপটে আমার সারা মুখ, দেহ, জলীয় বাষ্পে ভিজে, স্যাঁতসেঁতে আর বরফের মতো ঠান্ডা হয়েছিল। মেঘ আর ঘন কুয়াশার কারণে মাত্র পাঁচ মিনিট আগে ছেড়ে আসা স্রোতধারার নিচের অংশটা আমি দেখতে পারছিলাম না। ধীরে ধীরে চারপাশের পরিবেশ বদলে যেতে থাকলো। আমার চারধারে এখন আর ঝোপঝাড় নেই, ছোট বড় বিভিন্ন মাপের পাথর। এখন প্রায় দুপুর।
আমি অত্যন- ক্লান- হয়ে পড়লাম। আর সবচেয়ে বড় কথা সম্ভবত উপরে ওঠার পথটাও যেন হঠাৎ হারিয়ে গেল। আমি পিছন ফিরে সেই এতক্ষণের স্রোতধারা দেখতে পেলাম না, যেটার নিশানা ধরে আমি এতদুরে উঠে এলাম। কাছেই আর একটা স্রোতধারার চিহ্ন দেখতে পেলাম। কিন’ সেটা উত্তর-পূর্ব দিকে নেমে গেছে, আর সেটা দিয়ে এতো তীব্র গতিতে পানি বয়ে যাচ্ছে, যে ঐ পথে এগোতে গিয়ে একটু পা পিছলে যাওয়ায় তীব্র স্রোতধারা আমাকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে নিচে ফেলতে গিয়েছিল, বহু কষ্টে রক্ষা পেলাম।
সকালের দিকে আমার মনে যে আনন্দ-উদ্দীপনা ছিল, তার আর এখন বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট থাকলো না। পর্বত-জ্বরের আগে আমার হৃদয় থেকে মুছে গিয়ে সারা দেহ-মন জুড়ে আতঙ্ক এসে ভর করলো। এইভাবে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ আর কুয়াশা আমাকে আচ্ছন্ন করেছে বহুবার, বহুবার নিরাশ হয়ে হতোদ্যোম হয়েছি, উপরে যাবার কিংবা নিচে ফেরার পথগুলো অনেক সময়ই আমার কাছে দুর্গম্য আর দুর্ভেদ্য মনে হয়েছে অনেকবারই, কিন’ এরকম হতাশ করেনি কখনো। কারণ এখন আমার উপরে ওঠা কিংব্বা নিচে নামা দুটো পথের প্রতিটা ইঞ্চিই হয়ে উঠেছে আমার কাছে সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা। আগে যখন এমন পরিসি’তির শিকার হয়েছি তখন আমার বয়স ছিল অল্প, পাহাড়ে ওঠার বিদ্যে মনের মধ্যে ছিল তরতাজা, পাহাড়ে ওঠার শক্তিও ছিল অশেষ। এখন আমার বয়সে টান পড়েছে, শহুরে জীবনের আয়েস আমাকে দুর্বল আর শক্তিহীন করে ফেলেছে, এখানে আমি একা, বহুকাল যাবৎ পাহাড়ে উঠিনি আর সেই সাথে মনে এসে বাসা বেধেছে আতঙ্ক আর ভীতি।
আমি একটা বিশাল প্রস-রখন্ডের ধারে গিয়ে বসে পড়লাম, মেঘের গতিপথ থেকে কিছুটা দূরে। গতকাল নিচের উপত্যকার সরাইখানা থেকে কেনা স্যান্ডউইচের অবশিষ্টাংশ ব্যাগ থেকে বের করে খেলাম – তার পর চুপ করে বসে থাকলাম। প্রচন্ড কনকনে ঠান্ডার কারণে কিছুক্ষণ পর পর উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পা ঝাড়া মেরে রক্ত চলাচল বাড়াতে চেষ্টা করলাম। বাতাস এখন সরাসরি গায়ে-মুখে আঘাত করছে না, কিন’ আবহাওয়া এতো ঠান্ডা যে, শীতলতা ত্বকের নিচে দেহের প্রতিটি স-র অত্যন- ধীরে জমিয়ে দিতে দিতে আরও গভীরে নেমে যাচ্ছে; দেহের প্রতিটি অনু-পরমানু যেন ভিজে স্যাতঁসেঁতে হয়ে যাচ্ছে।
আমার মনে ক্ষীণ আশা দেখা দিলো বেলা বাড়ার সাথে সাথে তাপমাত্রা কমে গিয়ে অন্ধকার নামলে মেঘের চলাচল কমে যেতে পারে। একই সাথে মনে এলো আজ পর্ণিমা – একটা বড় আশার কথা। সাধারণত এসময়ে মেঘ থাকে না, জমাট বাঁধতে না পেরে মেঘ গলে যায়। তাই মনে মনে কামনা করলাম, যেন তাপমাত্রা তাড়াতাড়ি নেমে যায়। বাতাসের গতি এখনও অনেক বেশী, যে দিক দিয়ে মেঘ নেমে আসছে সেই দক্ষিণ দিকে মাথা উঁচিয়ে তাকিয়ে দেখি এখন কিছুটা হালকা হয়ে গিয়েছে, প্রায় দশ ফিট দরেও দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট, অথচ নিচের দিকটা এখনও জমাট বেঁধে আছে মেঘ আর কুয়াশা, নিশ্ছিদ্র ঘন কুয়াশা আর মেঘের দেয়াল নিচের পথটা সম্পূর্ণ ঢেকে দিয়েছে। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম।
উপরের দিকটা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একটু আগে যে দশ ফিট মতো দূরত্ব দেখা যাচ্ছিল, ক্রমে সে দূরত্ব, দশ থেকে পনেরো, তারপর বিশ, ঘন জমাট মেঘ হালকা হতে হতে ঘন কুয়াশার রূপ ধারণ করলো, তারপর ধীরে ধীরে আরও হালকা হয়ে যেতে থাকলো। হঠাৎ সামনের সমস- পাথুরে এলাকাটা আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেল। কেবল চূড়োটা বাদ দিয়ে একটু নিচে দক্ষিণ দিক ঝুঁকে থাকা বিশাল স্ফিতি আর তার পিছনের বিশাল আকাশটা ঝক্ঝক করতে থাকলো। আমার ঘড়ির দিকে তাকালাম, সোয়া ছয়টা বাজে। মন্টে ভেরিটায় রাত নামলো।
আবার একটা বিশাল বড় মেঘের খন্ড সামনের স্পষ্ট এলাকাটা ঢেকে দিয়ে নেমে এলো, আবার কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে সরেও গেল, আবার ঐ দিকটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। আমি সারা দিন যে কামরায় বসে ছিলাম। সেটা ছেড়ে এবার বের হয়ে এলাম। কিছুটা অনিশ্চিয়তায় দোলায় দুলতে থাকলাম। উপরে উঠবো, না নেমে যাবো? এখন আমার সামনে উপরে ওঠার পথটা পরিস্কার হয়ে গেছে। ভিক্টর যেমন বলেছিল, ঠিক তেমনি সেই বিশাল পাথরের স্ফিতিটা এখন আমার সামনে, সেই দীর্ঘ খাড়া দেয়ালটাও এখানে থেকে দেখা যাচ্ছে। ঐ দিকে আমার দশ-বারো ঘন্টা আগেই যাওয়া উচিত ছিল। আর দুই-তিন ঘন্টার মধ্যে চাঁদ উঠবে আর স্নিগ্ধ আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে, তখন মন্টে ভেরিটার পাথুরে চত্তরটাতে যাওয়া সুবিধা হবে আমার।
আমি পূর্ব দিকে গিয়ে নেমে যাবার পাথুরে পথটার দিকে তাকালাম। এখনও ঐ সব এলাকা ঘন কালো কুয়াশা আর জমাট মেঘে ঢাকা। ঐ মেঘ আর কুয়াশা যতক্ষণ ওখানে জমাট বেঁধে আছে, ততক্ষণ আমার নিচে নেমে যাবার কোন উপায় নেই, কারণ দৃষ্টিসীমা ওদিকে এখন তিন ফিটেরও কম। সামনের মেঘ আমার পিছনে সরে যাওয়ায় আমার মনে উৎসাহ ফিরে এলো।
ভিক্টরের আনাড়ি হাতে এঁকে দেয়া মানচিত্রটা আর একবার ভাল করে দেখে নিলাম, তারপর দক্ষিণের পাথরের সেই বিশাল স্ফিতিটার দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার খিদে পেয়ে গিয়েছিল। দুপুরের সেই স্যান্ডউইচ ছাড়া পেটে আর কিছুই ঢোকেনি। কেবল একটা পাউরুটি আছে আমার কাছে। রুটি আর সিগারেট। সিগারেটে খিদে মেটায় না, তবে খিদেবোধটা নষ্ট করে দেয়, কিন’ এই বাতাসে সিগারেট ধরানোও সম্ভব নয়। আর একটু এগিয়ে যেতে আমি জোড়া শিখর দুটো দেখতে পেলাম। কালচে নীল আকাশের পটভূমিকায় স্পষ্ট, ঝলমল করছে। ওদুটোর দিকে চোখ যেতে এক অসাধারণ উত্তেজনা বোধ করলাম। আমি জানতাম পাথরের ঐ বিশাল স্ফিতির কাছে পৌঁছানোর পর পাহাড়টার দক্ষিণের মুখটার সামনে যেতে পারলে আমি আর অভিযানের শেষ ধাপে এসে পৌঁছাবো। আমি আরও উপরের দিকে উঠতে থাকলাম। আমার দৃষ্টিসীমার সামনে ধীরে ধীরে দক্ষিণের ঢালু এলাকা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। পাথুরে দেয়াল আর শিলাখন্ডগুলো ক্রমে সংকীর্ণ হয়ে উঠলো।
কিছুক্ষণ পরে পূর্ণিমার বিশাল গোল চাঁদের মুখটা পূর্ব দিকে হালকা কুয়াশা ভেদ করে স্পষ্টভাবে দেখা গেল। চাঁদের দিকে তাকিয়ে আমার একাকিত্বটা গভীরভাবে অনুভব করলাম। মনে হলো আমি একবারে একা, নিঃসঙ্গ অবস’ায় পৃথিবীর শেষ প্রানে- এসে দাঁড়িয়েছি। আমার নিচে ও সামনে সমস- বিশ্বব্রহ্মান্ড। এই জায়গায় আর কেউ তার পা রাখেনি, কেবল আমি, সমস- এলাকাটা ঘুরতে ঘুরতে মহাবিশ্বের চরম অমানিশার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি।
আকাশের চাঁদ দেখা দেয়ার সাথে সাথে এই আমার সমস- অবয়ব আর অসি-ত্বটা কুঁকড়ে গুটিয়ে সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন হয়ে পড়লো যেন। আমি আমার নিজের অসি-ত্ব আর পরিচয় ভুলে গেলাম। এই যে দেহপিঞ্জর, যার মধ্যে আমি আমার অসি-ত্বটা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি এতকাল ধরে, এখন আর আমার কোন নিজস্ব অসি-ত্ব অবশিষ্ট থাকলো না। এক অপ্রতিরোধ্য দুর্বোধ্য শক্তি অদৃশ্য টানে আমাকে এই দুর্গম শৈল শিখরে টেনে এনে উপসি’ত করেছে। এই টান, এই আহ্বান, এই আকর্ষণ, ঐ দিগন- উদ্ভাসিত পূর্ণিমার চাঁদের থেকে উৎসরিত। জোয়ারের পানি যেভাবে অনিবার্য কঠিন টানে ফুলে ফেঁেপ ওঠে সমুদ্রের বুকে, আমাকেও তেমনি এখানে অন্ধ মুগ্ধের মতো টেনে এনেছে। এই অপ্রতিবোধ্য আকর্ষণ, অন-র্নিহিত অশ্রুত আহ্বান আমি অস্বীকার করার অর্থ যে শ্বাসহীনতা, মৃত্যুতুল্য। এ সেই কিশোরকালের পর্বত জ্বর নয়। এ আমার রক্তে প্রবাহিত কোন আবেগ নয়, এটা বইয়ের কোন ঐন্দ্রজালিক প্রভাব। এ প্রভাব কেবল ঐ পূর্ণিমার চাঁদ থেকে উৎসরিত, পরিব্যপ্ত।
পাহাড়ী পথটা আরও সংকীর্ণ হয়ে উঠলো, দুই পাশের পাথুরে দেয়াল ক্রমে আমার মাথার উপর সংকীর্ণ হতে হতে জুড়ে গেল পথটা এতোই সংকীর্ণ হয়ে গেল যে আমাকে ঝুঁকে মাথা নিচু করে হাঁটতে হচ্ছিল। পা ফেলতে হচ্ছিল আন্দাজে।
এই শ্বাসরুদ্ধকর অন্ধকার থেকে হঠাৎ আলোয় এসে পৌঁছালাম। এখন আমার সামনে মন্টে ভেরিটার উজ্জ্বল রুপালী সাদা জমজ শৃঙ্গ আর বিশাল পাহাড়ী চত্তর। জীবনে প্রথম আমি এতো অসাধারণ সুন্দর উন্মুক্ত রূপের সম্মুখীন হলাম। আমি আমার অভিপ্রায়, আমার গন-ব্য, সব ভুলে গেলাম একমুহূর্তের জন্য। ভুলে গেলাম নিচে ভিক্টর মৃত্যু পথযাত্রী। ভুলে গেলাম সারাটা দিন আমি মেঘের সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে আতঙ্কে সময় অতিবাহিত করেছি। মনে হলো এই আমার জীবনের পরম ও শেষ আকাঙ্খিত স’ান; এটাই চরম প্রাপ্তি। স’ান-কাল-পাত্র সবার উর্ধে এখন আমি চলে গিয়েছি। আমার সকল চিন-া-ভাবনার অবসান হয়েছে। উজ্জ্বল পূর্ণিমার দিগন- বিস-ারী দুধ-সাদা আলোর প্লাবনের মধ্যে মুগ্ধ, নির্নিমেষ চোখে নিস-ব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি।
কতক্ষণ নিস-ব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম তা বলতে পারবো না, আমি বলতেই পারবো না ঐ দেয়ালে আর মিনারটার কি পরিবর্তন হয়ে গেল। হঠাৎ ওখানে ছায়ামুর্তির উপসি’তি সম্পর্কে আমি সচেতন হয়ে উঠলাম। আগে ওগুলো ছিলো না। দেয়ালের উপর একজনের পিছনে আর একজন সারিবদ্ধভাবে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল, আকাশের পটভূমিকায় দেহগুলো কালো দেখাচ্ছিল, যেন পাথরের খোদাই করা মর্তি, যেন ঐ শিখরের শৈলখন্ড থেকেই খোদাই করে তৈরী করা, নিস-ব্ধ, অচঞ্চল। আমি বেশ একটু দুরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য ওদের চেহারা বা অবয়ব স্পষ্টভাবে দেখতে পারলাম না। খোলা মিনারের ধারে পৃথকভাবে একটা নিঃসঙ্গ অবয়ব দাঁড়িয়ে। ওর সারা দেহ মাথা থেকে পা পর্যন- কাপড় আবৃত। হঠাৎ আমার স্মরণ হলো প্রাচীনকালের কথা, প্রাচীন কালের আত্মহত্যা আর আত্মাহুতির কথা মনে পড়লো। সেকালের সেই সব লোকেরা চাঁদের উপাসনা করতো, বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে তারা উপাসনা করতো। আজও হয়তো ঐ ওদের কেউ কেউ আত্মাহুতি দেবে, আর আমি ঐ দৃশ্য দেখতে পাবো।
ইতিপূর্বে বহুবার আমি ভয় পেয়েছি। কিন- আতঙ্ক আমাকে কখনও স্পর্শ করেনি। এখন এই মুহূর্তে পরিপূর্ণ, গভীর আতঙ্কে মন একেবারে সংকুচিত হয়ে গেল। আমি হাটু গেড়ে বসলাম। আমার চারদিকে শৈল দেয়ালের ছায়া, ওরা ওপাশ থেকে নিশ্চয়ই চাঁদের আলোয় আমাকে দেখছে। আমি দেখলাম ওরা ধীরে ধীরে ওদের হাত দুটো মাথার উপরে আকাশের দিকে প্রসারিত করলো আর এক অস্ফুট সুরধ্বনী শুনতে পেলাম আমি। প্রথমে একেবারেই অস্পষ্ট, ফিসফিস্ করে শব্দটা উৎসারিত হয়ে ধীরে ধীরে জোরালো হয়ে উঠলো। এতক্ষণে অপার অনন- নৈশব্দ ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। সেই সংগীত ধ্বনি পর্বতের গায়ে প্রতিধ্বনিত হলো, ধীরে ধীরে একবার বেড়ে যায়, আবার কমে যায়। আমি ঐ ছায়ামুর্তিদের সকলকে পূর্ণিমার চাঁদের দিকে মুখ উঁচু করে তাকাতে দেখলাম। ওখানে কোন আত্মাহুতি হলো না, কোন প্রাণীকে হত্যা করা হলো না। ওরা কেবল অদ্ভুত আবেগময় ছন্দে প্রার্থনা সংগীত গাইলো।
আমি সেই পাহাড়ের ছায়ার লুকিয়ে বসে থাকলাম। নিজের কাছে মনে হলো এক অসাধারণ প্রার্থনা গৃহে অজ্ঞানতা আর অপরিসীম লজ্জা নিয়ে অপরাধীর মতো আমি উপসি’ত হয়েছি, আর আমার চারদিকে অপ্রাকৃত, ভীতিময়, অথচ অসাধারণ সুন্দর প্রার্থনা উচ্চারিত হচ্ছে। আমি দুই হাতে আমার কান চাপা দিয়ে, দুই চোখ বুঁজে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকলাম, আমার মাথা নিচের পাথর স্পর্শ করে থাকলো।
এক সময় – অনেকক্ষণ পর, প্রার্থনা সংগীত ধীরে ধীরে সি’মিত হতে থাকলো। এক সময় আগের মতো অস্পষ্ট, ফিস্ফিস্ শব্দে রূপায়িত হতে হতে সম্পূর্ণ থেমে গেল। মন্টে ভেরিটায় আবার নৈশব্দ ফিরে এলো।
তবু আমি নড়তে পারলাম না। আমার হাত দিয়ে কান আর মাথা চেপে রাখছিলাম, আমার মুখ পায়ের নিচের পাথর স্পর্শ করেছিল। আমার আতঙ্কের কারণে নিজের কাছেই লজ্জা বোধ হচ্ছিল। দুটি ভিন্ন জগতের মাঝখানে আমি যেন হারিয়ে গেলাম। আমার পরিচিত নিজস্ব জগৎটা আমার কাছে থেকে দুরে বহু দুরে হারিয়ে গেছে; এদিকে আমার সামনের ঐ ওদের জগতেও আমি ঢুকতে পারছি না। আমি মনে মনে কামনা করলাম ঘন কুয়াশায় যেন আমার চারধার আবার অবলুপ্ত হয়ে যায়। আমি ঠিক একইভাবে আরও কিছুক্ষণ হাঁটু গেড়ে বসে থাকলাম। তারপর অত্যন- সাবধানে ধীরে ধীরে চোরের মতো মাথাটা তুলে ঐ শিখরের দিকে তাকালাম। দেয়াল আর মিনারটা ফাঁকা, ওখানে কেউই নেই, জনশূন্য আর মেঘ আকাশের পূর্ণিমার চাঁদটাকে ঢেকে ফেলেছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম, নড়াচড়া না করে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঐ মিনার আর দেয়ালটার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম। ওখানে যেন কোন কিছুই সংগীত উচ্চারিত হয়নি। সম্ভবত আমার ভীতি আর আতঙ্ক সেই সাথে কোন অলীক কল্পনায় ঐসব দৃশ্য আমি অনুভব করেছি, আসলে ওখানে কোন কিছু নেই, কোন কিছু ঘটেনি। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। এক সময় চাঁদ ঢেকে রাখা ঘন মেঘটা ধীরে ধীরে সরে গেল। আমার মনে সাহস ফিরে এলো। পকেটে হাত দিয়ে চিঠিটা স্পর্শ করলাম।
ভিক্টর ওর চিঠিতে কি লিখেছিল জানি না, আমারটা এই রকম:
প্রিয় অ্যানা,
এক অসাধারণ ঘটনা পরম্পরায় আমি মন্টে ভেরিটার গ্রামে এসে হাজির হয়েছি। এখানে ভিক্টরের সাথে দেখা হয়েছে। ও ভয়াবহ রকমের অসুস’, সম্ভবত ও মারা যাচ্ছে। ওকে যদি তোমার কোন কথা বলার থাকে, তবে দেয়ালের নিচে তা’ লিখে জানাতে পারো। আমি ওকে পৌঁছে দেবো। আমি তোমাকে সতর্ক করে দিতে চাই যে, আমার মনে হয়েছে তোমার সমপ্রদায় বিপদে পড়তে যাচ্ছে। নিচের উপত্যকার অধিবাসীরা অত্যন- ভীত আর ক্রুদ্ধ, কারণ ওদের একটা মেয়ে হারিয়ে গিয়েছে। ওরা মন্টে ভেরিটাতে এসে হাজির হতে পারে এবং ধ্বংসাত্মক অবস’ার সৃষ্টি হতে পারে।
নিচে আমার নাম লিখে দিলাম।
আমি দেয়ালটার দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছে এগিয়ে যেতে, জানালার ফাটলগুলোর দিকে চোখ পড়লো, ভিক্টর ঠিক যেমন বর্ণনা দিয়েছিল। আমার মনে হলো, ঐ ফাটলের ভিতর থেকে অনেকগুলো চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আর প্রত্যেকটা অন্ধকার উন্মুক্ত এলাকায় একটা করে মানবমুর্তি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
আমি বেশ ঝুঁকে দেয়ালের গোড়ায় চিঠিটা রাখতে গেলাম। চিঠিটা রাখার জন্য নিচু হতেই সামনের দেয়ালটা পিছনে সরে দরজার মতো খুলে গেল। কয়েকটা হাত এগিয়ে এসে আমাকে খপ্ করে ধরে টান দিলো আর আমি তাল হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। দু’টো হাত আমার গলায় চেপে বসলো। জ্ঞান হারিয়ে পাথরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়তে পড়তে শেষ যে শব্দটি আমার কানে এলো সেটা হলো একটা বাচ্চা ছেলে হাসছে।