স্বর্গ মরীচিকা 5

মেয়েটা চড়া গলায় কবিতা আবৃত্তি করার মতো করে বলে গেলো, চোখদুটো ভিক্টরের দিকে নিবদ্ধ। ওর কথা বলার ধরণ শুনে বোঝা গেল ও আরও অনেকবার এই একই কথা উচ্চারণ করেছে। একই ধরনের শ্রোতাদের কাছে। তাই এখন পুরো বিষয়টা ওর কাছে কবিতা আবৃত্তি কিংবা মন্ত্র পড়ার মতো হয়ে গিয়েছে। মেয়েটার সব কথায় এমনই আঞ্চলিকতার টান যে, ভিক্টর মেয়েটার একটা কথাও বুঝতে পারলো না। মেয়েটির বলা শেষ হতে বৃদ্ধটা দোভাষীর কাজ করলো। ঠিক এই ভঙ্গিতে, একই সুরে মেয়েটির জবানীতেই কথাগুলো উচ্চারণ করলো ও।

‘আমি কয়েকজন বন্ধু নিয়ে মন্টে ভেরিটায় গিয়েছিলাম। ঝড় এলো আর আমার সঙ্গীরা পালিয়ে গেল। আমি দৌড়াতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেললাম। তারপর একসময় দেখি আমি দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে। উপরে জানালাগুলো দেখা যাচ্ছে। আমি কাঁদতে আরম্ভ করলাম ভয়ে। খুব ভয় পেয়েছিলাম আমি। দুইজন মহিলা দেয়ালের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো, ও খুবই সুন্দরী আর লম্বা। ওরা দুইজনে মিলে আমাকে সান-না দিলো। আমি ওদের সাথে ভিতরে যেতে চাইলাম। এমন সময় মিনারের উপর থেকে গান ভেসে এলো আর ওরা বললো, ভিতরে যাবার অনুমতি নেই আমার। ওরা বললো, আমার যখন তেরো বছর বয়স হবে, তখন আমি ওদের সাথে থাকতে পারবো। ওদের গায়ে সাদা আলখাল্লার মতো পোশাক ছিল, পায়ের গোড়ালী পর্যন- তার ঝুল। ওদের হাত পা খোলা আর খালি। চুল ছেলেদের মতো করে ছাঁটা। ওরা পৃথিবীর যে কোন মানুষের চেয়ে অনেক বেশী সুন্দর। ওরা আমাকে মন্টে ভেরিটার ঐ শৃঙ্গ থেকে নামিয়ে নিচে নিয়ে এলো, যেখান থেকে আমি গ্রামের পথ খুঁজে পাবো। তারপর ওরা চলে গেল। আমি যা জানি তাই বললাম।’

বৃদ্ধ কথা শেষ করে ভিক্টরের অনুভুতি বোঝার জন্য ওর মুখের দিকে তাকালো।

ভিক্টর আমার দিকে তাকিয়ে বললো ঐ আত্মবিশ্বাস কিভাবে অতটুকু মেয়ের মনে গভীরভাবে গ্রথিত হওয় গেছে দেখে ও অবাক হয়ে গিয়েছিল। ওর মনে হয়েছিল মেয়েটি হয়তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এই রকম স্বপ্ন দেখেছিলো। আর জেগে উঠে সেটাকে বাস-বে ঘটছে বলে মনে করছে।

ও বৃদ্ধকে বললো, ‘আপনি যাই বলুন না কেন, মেয়েটার ঐ গল্প বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। আমার কাছে ওটা অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু না।’

বৃদ্ধটি শিশুটিকে আবার ডাক দিয়ে কি যেন বললো। সে দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল।

বৃদ্ধটি বললো, ‘মন্টে ভেরিটার ওরা ওকে একটা পাথরের মালা দিয়েছিল অশুভ কিছু যাতে না ঘটে এ জন্য, ওর বাবা মা ওটা লুকিয়ে রেখেছিল। আপনাকে দেখাবার জন্য আনতে বললাম।’

একটু পরেই মেয়েটা ফিরে এসে ভিক্টরের হাতে ছোট পাথরের মালা দিলো। মালাটা ছোট, ছোট কিশোরীর চিকন কোমরে অথবা গলায় পরার মতো ছোট। মালার পাথরের টুকরোগুলো স্ফটিক পাথরের, হাতে কাটা, মসৃণ, মধ্যে দিয়ে সরু ছিদ্র করে একটার সাথে আর একটা গাঁথা হয়েছে। হাতের কাজ অত্যন- সুন্দর। অসাধারণ দক্ষতা আর নিপুনতায় মালাটা তৈরী। গ্রামের কৃষক কিংবা শ্রমিকের আনাড়ী হাতে অবসর মুহূর্তের খেয়ালী কাজ এটা নয়। ভিক্টর কোন কথা না বলে শিশুটিকে মালাটা ফেরত দিলো।

তারপর নিরাসক্ত গলায় মন-ব্য করলো, ‘ও হয়তো ঐ চূড়ার আশেপাশে ওটা কুড়িয়ে পেয়েছে।’

বৃদ্ধটি উত্তর দিলো, ‘আমরা কেউই এ ধরনের কাজ করি না, নিচের উপত্যকার অধিবাসীরাও করে না, এ দেশের শহরগুলোতেও হয় না, এমনকি এেেশর কোথাও এধরনের জিনিষ পাওয়া যায় না। মেয়েটা যা বলেছে তা সত্য, ঐ মালা ওকে মন্টে ভেরিটার ওরাই দিয়েছে।’

ভিক্টর বুঝলো এ নিয়ে আর কোন কথা বলা বৃথা। ওদের অদ্ভুত বিশ্বাস আর সংস্কার ওদেরকে এমনই অন্ধ করে রেখেছে যে, জাগতিক কোন যুক্তিই ওদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ও গ্রামে আর এক দিন থাকার অনুমতি চাইলো।

বৃদ্ধ বললো, ‘ঠিক আছে, তুমি থাকো, যতদিন না তুমি সত্য জানতে পারছো।’

ধীরে ধীরে জমায়েত গ্রামবাসীরা যে ঘরে ফিরে তাদের দৈনন্দিন কাজে লেগে গেল। ভিক্টর আবার বের হলো। এবারে ও পাহাড়ের উত্তরের ঢাল বেয়ে ওঠার চেষ্টা করলো। কিছুদুর উঠেই বুঝতে পারলো, খালি হাত-পা নিয়ে এদিক দিয়ে উপরে ওঠা অসম্ভব, উঠতে গেলে বিশেষ ধরনের জিনিষ আর প্রশিক্ষণ লাগবে। যদি অ্যানা এ পথে গিয়ে থাকে, তা’হলে নিঃসন্দেহে ও নিচে পড়ে মারা গিয়েছিল।

ও আবার গ্রামে ফিরে এলো, গ্রামটা পাহাড়ের পূর্বের ঢালে হওয়ায় এদিকটাতে আর সুর্যের আলো নেই। ও ঘরে ঢুকে দেখে ঘরের একপাশে ওর খাবার সাজানো আর মেঝেতে আগুনের পাশে বিছানা পাতা। ও এতো ক্লান- হয়ে পড়েছিল যে খাবার মুখে দেওয়ারও অবস’া ছিল না ওর। কোন রকমে বিছানার উপরে নিজেকে এলিয়ে দেবার সাথে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল।

পর দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ও আবার মন্টে ভেরিটার চুড়ায় উঠে সারাদিন দেয়ালের ধারে বসে থাকলো।

জানালার মতো ফাটলগুলোর দিকে চোখ রেখে ও অপেক্ষা করতে থাকলো। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সুর্যের প্রখর তাপ চারদিক কয়েক ঘন্টা ধরে ঝলসে দিতে থাকলো। তারপর ধীরে পশ্চিম দিকে ঢলে পড়তে প্রকৃতি ঠান্ডা হয়ে এলো। এক সময় সূর্য ডোবার সাথে সাথে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। দেয়ালের ওপারে এই দীর্ঘ সময়ে কোন নড়াচড়া টের পেলো না, কাউকে দেখাও গেল না।

ভিক্টরের মনে পড়লো, বৃদ্ধের একটা কথা, গ্রামের একজন নাকি দীর্ঘ তিন মাস, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এখানে অপেক্ষা করেছিল তবু কারও দেখা পায়নি। ও ভাবলো কত দীর্ঘ সময় ধরে ওকে প্রতীক্ষা করতে হবে। আর ও কি কোনদিন ঐ দুর্গের মধ্যেকার অধিবাসীদের সমকক্ষ হতে পারবে?

তৃতীয় দিন দুপুরের দিকে সূর্য যখন তার প্রখর দীপ্তিতে চারদিক অগ্নিকুন্ডে পরিণত করে ফেললো, সেই উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে ও পাশের সংকীর্ণ গলিপথে গিয়ে আশ্রয় নিলো। উপরে বেরিয়ে থাকা একটা বড় পাথরের আড়ালে এ জায়গাটা শীতল আর আরামদায়ক। ক্রমাগত স্নায়ুর চাপে বিধ্বস- ভিক্টরের দেহে ক্লানি- জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল। ও এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো।

হঠাৎ চটকা লেগে ওর ঘুম ভেঙে গেল। ওর ঘড়িতে তখন পাঁচটা বাজে। গলিপথের ভিতরে তখন বেশ ঠান্ডা। ও ওখান থেকে বের হয়ে ঢলে পড়া সূর্যের আলোর সোনালী হয়ে যাওয়া মন্টে ভেরিটার দিকে তাকালো।

আর তখনই ও অ্যানাকে দেখতে পেলো। দেয়ালটার শেষ মাথায় কয়েক ফিট চওড়া একখন্ড পাথরের বেদীর উপর ও দাঁড়িয়ে, একটু পাশেই অতলস্পর্শী খাঁদ, হাজার ফিটের বেশী খাড়াভাবে নেমে গিয়েছে। ও ভিক্টরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। ভিক্টর দ্রুত অ্যানার দিকে ছুটে এগিয়ে গেল ফাটলের শেষ প্রান- পর্যন-। নিজের অস্ফুট গলার শব্দ ও নিজের কানে শুনতে পেলো, ‘অ্যানা . . অ্যানা. .।’

ও ফোঁপাতে থাকলো, কান্নায় ওর গলার স্বর বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল বার বার। ওর মনে হতে থাকলো, হয়তো ওর বুক ফেটে যাবে কষ্টে। একটুখানি এগিয়ে গিয়েই ভিক্টর বুঝতে পারলো, ও অ্যানার কাছে পৌঁছাতে পারবে না। কয়েক হাত চওড়া ঐ অতলস্পর্শী ফাটলটা ওদের দু’জনকে আলাদা করে রেখেছে। অ্যানা মাত্র বারো ফিট দূরে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ ভিক্টর ওকে ছুঁতে পারছে না।

ভিক্টর বলতে থাকলো, ‘আমি যেখানে ছিলাম, সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লাম আর অ্যানার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে গাল বেয়ে নামতে থাকলো। আমি কোন কথা বলতে পারছিলাম না। আমার গলার ভিতর কিছু একটা দলা পাকিয়ে আটকে রয়েছে যেন আমি কাঁদতে থাকলাম। কিছুক্ষণ আগে আমার ধারণা ছিল অ্যানা মারা গিয়েছে, অসতর্কভাবে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পড়ে গিয়েছে। অথচ এখন ও আমার সামনে সশরীরে ‘াঁড়িয়ে আছে, ও বেঁচে আছে! কোন সাধারণ কথা মনে পড়লো না আমার।’

আমি জিজ্ঞেস করতে চাইলাম, ‘কি হয়েছিল তোমার?’ বা ‘কোথায় ছিলে তুমি?’ কিন’ কোন কথাই বলতে পারছিলাম না আমি। কারণ ওকে দেখার সাথে সাথে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, যা কিছু আমি শুনেছি, সবকিছুই সত্য। গ্রামের সেই বৃদ্ধ যা বলেছে, বাচ্চা মেয়েটা যা ‘েখেছে, কোন কিছুই অলীক কল্পনা নয়, আর এটা কোন কুসংস্কারও নয়। যদিও অ্যানাকে ছাড়া আর কাউকে আমি দেখতে পারছিলাম না, তবু আমার মনে হলো সমস- এলাকাটা যেন হঠাৎ জীবন- হয়ে উঠেছে। ঐ জানালার ফাঁটলগুলোর আড়াল থেকে, ঈশ্বর জানেন, কতজন, কতগুলো চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি দেয়ালের ওধারে ওদের সকলের উপসি’তি অনুভব করতে পারছিলাম। আমার এই অনুভূতিটা কেমন অস্বসি-কর, অশরীরি, আর ভয়াবহ; অথচ অনেক বেশী বাস-ব।

ভিক্টরের কন্ঠে আবার সেই আগের উত্তেজনা আর আতঙ্ক ফুটে উঠলো। ওর হাতদুটো থর্‌ থর্‌ করে কাঁপতে থাকলো। ও উঠে কাঁপা কাঁপা হাতে গ্লাসে পানি ঢেলে নিয়ে অস্বাভাবিক তৃষ্ণার্তের মতো ঢক্‌ ঢক্‌ করে এক নিশ্বাসে খেয়ে নিলো। তারপর একটু থেমে আবার বলা শুরু করলো।

‘ওর গায়ে আগের কোন পোষাক ছিল না। কেমন অদ্ভুত সার্টের মতো আলখাল্লা পরেছিল ও, পায়ের হাটু পর্যন- ঝুলছিল ওটা, কোমরের চারদিকে একটা পাথরের মালা দিয়ে আলখাল্লাটা আটকানো। গ্রামের সেই ছোট্ট মেয়েটি যেরকম মালা আমাকে দেখিয়েছিল, অ্যানার কোমরের মালাটা ঠিক সেরকম পাথরের তৈরী। সবচেয়ে আশ্চর্যের আর সবচেয়ে ভীতিকর বিষয় হলো ওর অতো সুন্দর লম্বা চুলগুলো ছেঁটে ছোট করে ফেলা – তোমার, আমার চুলের মতো, ছেলেদের মতো করে ছাঁটা। ঐ অবস’া ওকে অদ্ভুতভাবে বদলে দিয়েছিল, ওকে অনেক অল্প বয়স্ক, অনেক ছেলেমানুষ, অথচ কেমন অসাধারণ কঠোর আর নির্মম মনে হচ্ছিল। হঠাৎ ও কথা বলে উঠলো।

অত্যন- স্বাভাবিক আর সহজভাবে কথা বলতে আরম্ভ করলো ও, যেন কিছুই ঘটেনি, ‘আমি মনে করি বাড়িতে ফিরে যাওয়াই ভালো হবে তোমার জন্য, ভিক্টর। আজ থেকে তুমি আমাকে নিয়ে মোটেই চিন-া করবে না।’

ভিক্টর আমাকে বললো, ও কল্পনাও করতে পারেনি অ্যানাকে ও ঐ অবস’ায় কখনও দেখতে পাবে, আর ও এ রকমভাবে কথা বলবে। ওর মনে হলো, কোন কোন বিশেষ আসরে যেভাবে অশরীরি আত্মা একটা মাধ্যমের সাহায্যে তার আত্মীয়-স্বজনের সাথে আধ্যাত্মিক ভাব বিনিময় করে, কথা বলে, এ যেন তেমন কিছু।

কোন কথা বলতে ওর সাহস হলো না। মনে হলো অ্যানাকে সম্ভবত সম্মোহিত করে রেখেছে কেউ, ও কোন ঘোরের মধ্যে কথা বলছে।

ভিক্টর খুব সাবধানে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি কেন আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলছো?

ওর মনে হলো, অ্যানাকে এমন কোন কথা বলা উচিৎ হবে না, যাতে ওর মনে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, এমনিতেই হয়তো ও যথেষ্ট প্রভাবিত হয়ে আছে।

অ্যানা উত্তর দিলো, ‘এটাই হবে সবচেয়ে উচিত কাজ, ভিক্টর ।

কথাটা বলে অ্যানা হাসলো। অত্যন- আন-রিক আর সুখী মানুষের হাসি, বাড়িতে যেভাবে হাসতো ও, ঠিক তেমনিভাবে।

‘আমি খুব ভালো আছি, ডার্লিং। এটা কোন পাগলামী না, কেউ আমাকে প্রভাবিত করেনি, সম্মোহিত করেনি, যা তুমি ভাবছো, তা নয়। গ্রামের লোকেরা তোমাকে সত্য কথা বলেনি, ও সব ভ্রান- ধারণা, ওরা অহেতুক তোমাকে আতঙ্কিত করেছে, এটাই স্বাভাবিক, কারণ সবাই এ বিষয়টা বুঝতে পারবে না। আমি আমার অন-র দিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম এমন কিছু একটা সত্যি আছে, কোথাও না কোথাও, আর এরকম একটা দিনের অপেক্ষায় আমি অপেক্ষা করেছিলাম অধীরভাবে। পুরুষরা যখন সংসার ছেড়ে বৈরাগী হয়, মেয়েরা সন্ন্যাসিনী হয়, ওদের পরিবারের কেউ কেউ কষ্ট পায়, দুঃখ পায়। এক সময় সবকিছু সহ্য করে মেনে নেয়। ভিক্টর, আমি চাই তুমিও আমার ব্যাপারটা সেভাবেই গ্রহণ করবে। আমি জানি তুমি বুঝবে।

কথাগুলো বলে অ্যানা চুপ করে গেল। ওর সারা মুখে কি অপূর্ব প্রশানি-, স্মিত হাসিতে ওকে আরও উজ্জ্বল আর আলোকময় মনে হলো।

ভিক্টর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তার মানে, তুমি কি বাকী জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দেবে?’

অ্যানা উত্তর দিয়েছিলো, ‘হ্যাঁ এটাই আমার জীবন, এছাড়া আমি আর কিছুই বুঝি না, আমার কোন অতীত অবশিষ্ট নেই, ভবিষ্যতও নেই, বিশ্বাস করো। তুমি ফিরে যাও, তাই আমি চাই। যেভাবে এতকাল তুমি ছিলে সেভাবেই থাকবে। বাড়িঘর দেখবে। জমিদারী দেখবে আর যদি কোন ভাল মেয়ের সাথে তোমার পরিচয় হয়, ভালবাসা হয়, তবে তাকে বিয়ে করে সংসারী হও, সুখী হও। তুমি আমাকে যে ভালবাসা, যে সুখ দিয়েছো, তার জন্য তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তোমার সুখ সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করি। আমি যদি মারা যেতাম, তাহলে তুমি কামনা করতে, আমি যেন স্বর্গবাসী হই, তাই না? এই জায়গাটা, এটাই আমার স্বর্গ। এর অন্য কোন বিকল্পের কথা কেউ যদি জিজ্ঞেস করে আমাকে, আমি বলবো এখান থেকে অন্য কোথাও যাবার চেয়ে আমি বরং এই হাজার ফিট খাঁদের ভিতর লাফ দিয়ে পড়বো।’

ভিক্টর স-ম্ভিত হয়ে অ্যানার কথা শুনছিল। অ্যানার চেহারার অপার্থিব সৌন্দর্য আর ঔজ্জ্বল্য দেখে ও একেবারে অভিভূত হয়ে পড়েছিল।

ভিক্টর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বাইবেলে পুনরাত্থানের কথা অর্থাৎ ঞৎঁংভরমঁৎধঃরড়হ সম্পর্কে আমরা দু’জনেই পড়েছি। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছি কতো, তাই না? অ্যানার ক্ষেত্রে ঐ অবস’ায় আমার মনে ঐ শব্দটাই উপযুক্ত বলে মনে হলো। এটা কোন ধর্মীয় উম্মাদনা বা উম্মত্ততা না, মনোবিকৃতিও নয়, কোন আবেগের বশবর্তী হয়ে কিছু করাও নয়। এটা এমন কিছু, যা এই নস্বর পৃথিবীর কোন বিষয় নয় – এটা একটা অসাধারণ অপ্রাকৃত শক্তি, যা অ্যানাকে আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে। ওর কাছে কোন যুক্তি কাজ করবে না, ওর উপর শক্তি প্রয়োগ অসম্ভব। অ্যানা তো বলেই দিয়েছে, বর্তমান সময়ে আর পরিবেশে ফিরে আসার চেয়ে বরং হাজার ফুট গভীর খাঁদে ঝাঁপ দেবে।

ভিক্টর বললো, সেই মুহূর্তের চরম নিরুপায় অনুভূতি ওকে অবশ করে ফেলেছিল, ও বুঝতে পারলো ওর কিছুই করার নেই। এ যেন অ্যানা একটা জাহাজের পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছে, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জাহাজটা সাইরেন বাজিয়ে চিরতরে অনির্দিষ্ট গন-ব্যে রওনা হয়ে যাবে, আর ও নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

ভিক্টর অ্যানাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ওর কোন কিছু লাগবে কিনা, ওর খাবার, কোন অসুবিধা হয় কিনা, পোশাক-কম্বল লাগবে কিনা, অসুস’ হলে ঠিকমতো ওষুধ পায় কিনা। ও জানতে চাইলো, ও এমন কিছু দেবে কিনা, যা ওর দরকার হবে। প্রতি কথায় অ্যানা মিষ্টি হেসে বলেছিল, সবকিছুই ওর আছে, কোন কিছুর অভাব নেই ওখানে, দেয়ালের ওধারে ওদের কোন কিছুরই অভাব হয় না।

ভিক্টর ওকে বলেছিল, প্রতি বছর এই সময় ও এখানে ফিরে আসবে ওকে অনুরোধ জানানোর জন্য, যাতে ও ওর মত পরিবর্তন করে। অ্যানাকে ও কখনই ভুলবে না।

অ্যানা উত্তর দিয়েছিল, ‘এর কোন প্রয়োজন নেই, কোন অর্থ হয় না এমন কি করার। অনেকটা কবরে ফুল দেবার মতো, এতে কবরের ভিতরের মানুষটার কোন অনুভূতি হয় না। তুমি বরং এখানে আর আসবে না।

ও বলেছিল, ‘তুমি এখানে থাকবে, এই দেয়ালের ভিতরে, এই চিন-া আমি মন থেকে বের করে দিতে পারবো না। আমাকে প্রতি বছর ফিরে আসতেই হবে।’

অ্যানা বলেছিল, ‘এসে কোন লাভ হবে না; তুমি আমাকে আর দেখতে পাবে না, আজই শেষ। মনে রোখো আমি সবসময়েই একই রকম থাকবো। এটাই সত্য। আমার এই সৌন্দর্য তুমি তোমার স্মৃতির মধ্যে বয়ে নিয়ে যাও।’

ভিক্টর বললো, এরপর অ্যানা ওকে চলে যেতে বললো। ও তাকিয়ে থাকলে অ্যানা চলে যেতে পারবে না।

Leave a Reply