১
শুধু রাতের অন্ধকারে হল না, আবার আকাশে এসে জড় হল মেঘের দল।
ঘন অন্ধকারে ডুবে গেল কেল্লা। আন্দিজানের রাস্তাঘাট উৎকণ্ঠায় নীরব হয়ে গেছে। নিস্তব্ধ, জনহীন… ঐ যে সতর্কভাবে সামান্য ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ তুলে খুলে যাচ্ছে তোরণদ্বার।
সবার সামনে চলেছেন পুরুষের পোশাক পরা খানজাদা বেগম। মাথায় পুরুষের টুপি, কোমরে চওড়া কোমরবন্ধে ঝুলছে খঞ্জর। তার অনুচরদের মধ্যে রয়েছেন মওলানা ফজল উদ্দিন- তার কোমরবন্ধের পার্শ্বদেশে ঝুলছে তরবারি।
সমরখন্দ থেকে দূত মারফৎ যেই খবর পাওয়া গেল যে বাবর কঠিন রোগে পড়েছেন, জীবনসংশয় তার, অমনি দুর্গের প্রতিরক্ষার ভার যাদের ওপর ছিল তাদের এক অংশ ষড়যন্ত্রকারীদের দলে যোগ দিল। প্রাচীরের প্রতিটি ঝরোকা পাহারা দেবার জন্য যথেষ্ট লোক আর রইল না। রাতে বেলায় সবার অলক্ষ্যে দেওয়ালের গায়ে মই লাগিয়ে দুর্গে শত্রুদের প্রবেশ করার বিপদ আরও বেড়ে গেল। খানজাদা বেগম প্রতিরক্ষাব্যবস্থার তদারক করছিলেন- পুরুষের পোশাক নেহাৎ খেলাছলে পরেন নি তিনি।
পথের পাথরে ঘোড়ার নাল ঠুকে আগুনের ফুলকি তুলছিল ঘন অন্ধকারের বুকে। উষ্ণ হাওয়া বইছে। সে হাওয়ায় বৃষ্টি গন্ধ। মোল্লা ফজল উদ্দিন ভাবলেন বসন্তকাল আগতপ্রায়, দুর্গের ভিতরের বাগানগুলিতে খুবানী আর বাদাম ফলতে আরম্ভ করেছে। বসনে- রোদ খেলে ভালো। এখন তিনি চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন- রাত, অন্ধকার, এক ফোঁটা আলোও দেখা যায় না। প্রকৃতি, দুর্গ, শহর- সবকিছু কালো চাদরে ঢাকা পড়েছে।
ফজল উদ্দিনের মনে পড়লো সেই সুখের দিনগুলির কথা যখন তিনি খানজাদা বেগমকে দেখাতেন পরিকল্পিত মাদ্রাসা ও মহলগুলির নক্সা ও ছবি আর শুনতেন তার মুখের প্রশংসাবাক্য। বাবর যখন সমরখন্দ দখল করলেন মওলানা ধরেই নিয়েছিলেন যে তার স্থাপত্যকলার পরিচয় দানের স্বপ্ন সফল হবে। আর আনন্দে খানজাদা বেগমেরও আনন্দ হয়েছিল- কয়েকবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি স্থপতিকে ,অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা চালিয়েছেন, জিজ্ঞাসা করেছেন কোন জায়গায় মহল আর মাদ্রাসা তৈরী করলে ভাল হয়, নির্মাণকাজ আরম্ভের প্রস্থতি কেমনভাবে করা যায়।
খানাজাদ বেগম তাকে আপ্যায়ন করতেন নিজের ছয়টি কক্ষবিশিষ্ট রহস্যময় মহলের প্রথম কক্ষটিতে। ঐ মহলে তিনি তার বাঁদীদের নিয়ে থাকেন। সাধারণত বেগম রেশমী পর্দার আড়ালে বসে থাকতেন। কখনও কখনও কৌতূহলবশতঃ পর্দা সরিয়ে দিতেন।
‘দেখি, দেখি, গম্বুজওয়ালা ইমারত আর মিনারের মাঝখানের জায়গাটাতে কী থাকবে দেখান তো?’ হয়তো জিজ্ঞাসা করেন তিনি।
দু’দিক থেকে দু’জনে ঝুঁকে পড়তেন কাগজটির উপর, নিঃশ্বাস মিলিয়ে যেত। খানাজাদার চোখ হয়ে উঠত দ্যুতিময়, আর মওলানা মুখে কুলুপ পড়ত- একটা কথাও বেরোতে না, যেমন হত ওশে সেই বারাতাগের প্রথম দিনগুলিতে- বুকোর মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটত। ভয় হতো তার এমন কোন কথা বলে ফেলবেন যার সঙ্গে বর্তমান প্রসঙ্গের কোন সম্পর্কই নেই, ভয় হতো- দাসদাসীদের সামনে আর বেগমের কাছে মনের কথা প্রকাশ করে ফেলবেন। আর সবচেয়ে বেশী ভয় করেন কুতলুগ নিগর-খানমের অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে। তিনি প্রায়ই ওঁদের আলোচনার সময় উপসি’ত থাকতেন। চোখের দৃষ্টি গোপন করে হাজার বার মাথা নোয়ান স্থপতি তার উদ্দেশ্যে। শেষ যেদিন তাদের মধ্যে আলোচনা হয় খানজাদা বেগম হঠাৎ অপত্যাশিত প্রশ্ন করে বসলেন. ‘মওলানা, আপনি এতদিন পর্যন্ত বিবাহ করেন নি কেন?’
সম্ভ্রান্তবংশোদ্ভুত মহিলার উপযুক্ত স্বতন্ত্রতা বজায় রেখেই চলতেন যদিও বেগম, তবুও মওলানার লক্ষ্য এড়ালো না কী অকপট উৎকণ্ঠা, আগ্রহ, আশায় জ্বলজ্বল করছে তার চোখদুটি। বলে ফেলবেন নাকি তার গোপন কথা? না, তা হবে নিছক পাগলামি। ঠাট্টার মাধ্যমে উত্তর এড়িয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন ফজল উদ্দিন, ‘বেগম, আমি চিরকুমার থেকেই মরতে চাই।’
‘আরে, আমিও তো তাই চাই।’
‘আপনি.. অভিজাতবংশীয়া বেগম, কেমন করে একা থাকবেন তা’ আমি ভাবতে পারি না।’
‘কেন?’
‘আপনি.. এই দুনিয়ায়.. কত প্রখ্যাত, কত নামজাদা রাজাবাদশা যারা নিজেকে সুখী মনে করবেন..’
‘হয়ত আছেন এমন কেউ… আচ্ছা মওলানা, কোন বাদশাহকে আপনি আমার উপযুক্ত বলে মনে করেন?’
‘যদি আমার মত প্রয়োজন তো বলি, আপনার উপযুক্ত হতে পারেন কেবলই ফরহাদই।’
‘কেন কেবল ফরহাদ?’
ফজল উদ্দিন দিশাহারা হয়ে পড়লেন, ওদিকে খানজাদা বেগম আর একটি কুটিল প্রশ্ন করে বসলেন, ‘ফরহাদ- স্থপতি, কারিগর, যেমনি আপনি। তাই জন্য কি?’
‘হায় বেগম… এমন কথা বলার অধিকার নেই আমার।’ স্বরে বিষাদ ও গুরুত্ব ফুটিয়ে বললেন তিনি।
খানাজাদা বেগমও এবার তামাসার সুর ত্যাগ করলেন। বিষন্ন হয়ে পড়লেন, দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার। অকপট সুরে বললেন,
‘কেন যে আল্লাহ্ আমাকে পাঠিয়েছেন খানদানী বংশের সন্তান করে? সাধারণ ঘরের মেয়ে হলে নিজের সুখ খুঁজে পেতে কোন অসুবিধা হত না হয়ত…’
এই স্বীকৃতি যতই দুঃখের হোক না কেন, বলতে সংকোচ হয় ফজল উদ্দিনকে তা আনন্দ দিয়েছিল। তার মানে, খানাজাদা বেগম অনুমান করে নিয়েছেন তার প্রেমের কথা? শুধু জানেনই যে তা নয়- ‘শাহজাদীর’ প্রতি তার একান্ত অনুরাগে তার সমর্থনও আছে হয়ত? হয়ত সেজন্যেই অমনভাবে বললেন যে তার ও স্থপতির মধ্যে সামাজিক ব্যবধান তার অর্থাৎ বেগমেরও মনোকষ্টের কারণ? ওঃ যদি খানজাদা বেগমও তাকে ভালবেসে ফেলেন তাহলে তিনি কেমন করে অতিক্রম করবেন তাদের মাঝখানের দুস্তর ব্যবধান? ওশে তার নির্মিত ছোট্ট বাসভবনটির জন্য মির্জা বাবর তাকে মস্ত বড় সম্বান প্রদর্শন করেছেন। আর যদি ফজল উদ্দিন বিরাট বিরাট নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন যার ফলে সারা দুনিয়ায় তার নাম ছড়িয়ে পড়বে তখন? তখনও কি তিনি নামজাদা, অভিজাতবংশীয় লোকদের থেকে নীচেই পড়ে থাকবেন? বাবর তার ভগিনীকে স্নেহ করেন। তার হৃদয় দয়ায় পূর্ণ। হয়ত তিনি তাদের প্রতি কৃপা করবেন?
ফজল উদ্দিনের স্বপ্ন তাকে অনেক দূর নিয়ে গেল, কিন’ সে তো স্বপ্নই শুধু? এদিকে বেগমের প্রতি অনুরক্ত স্থপতির প্রতি তার অনুগ্রহ, মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে দেখা করার শুভ ইচ্ছা- এই-ই আপাততঃ স্থপতির পক্ষে গভীর সুখের কারণ…
এদিকে আন্দিজান অবরুদ্ধ। বিদ্রোহী বেগরা সারা মাভেরান্নহরে গোলমাল পাকিয়ে তুলেছে। স্থপতির স্বপ্ন, আনন্দ সবকিছুকে গ্রাস করল আজকের এই রাতের মতই ঘন অন্ধকার। তার নকশাপত্রগুলি পরিণত হয়েছে কতকগুলি অপ্রয়োজনীয় কাগজে। যুদ্ধের প্রতি, সৈন্যদের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা মওলানার। কিন’ আজ কেল্লায যখন শুনলেন সমরখন্দ থেকে আসা দুঃসংবাদ আর দেখলেন অস্ত্রসাজে সজ্জিত খানজাদা বেগমকে তখন আর একপাশে সরে থাকতে পারলেন না। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভাবলেন ভাগ্যের আঘাত কখন আসবে তার অপেক্ষায় থাকার চেয়ে খানজাদা বেগমের অনুচর হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে লড়াইতে নামা অনেক ভাল। জীবনের এই প্রথম তিনি তরবারিসমেত কোমরবন্ধ পরলেন।
উদ্বেগময় ও ভয়ংকর অন্ধকারে নিস্তব্ধ শহরের রাস্তা দিয়ে চলে ঘোড়ায় চড়ে অন্যান্য সৈন্যদের পাশে পাশে, সামান্য দূরে তিনি দেখতে পাচ্ছেন খানজাদা বেগমকে আর ভাবছেন তিনি বেগমকে রক্ষা করতে পারবেন। এই চিন্তায় একটু আশ্বস্ত হলেন তিনি।
মির্জা দরওয়াজার কাছে দুর্গপ্রাচীরের বাইরে থেকে তারা শুনতে পেলেন যুদ্ধে আহ্বানকারী শিঙ্গা, ঢাকঢোলের আওয়াজ, শতশত সৈন্যের চীৎকার। দুশমন চেষ্টা করছে ফটক খোলার, শহরে ঢুকতে চাইছে! চীৎকার করে বলেই খানজাদা বেগম লাগামে ঢিলা দিলেন।
সৈন্যরা তাকে ছাড়িয়ে তোরণদ্বারের দিকে এগিয়ে গেল। কিন’ মির্জা দরওয়াজার কাছের গোলমাল, হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্থত করে রাখা মইগুলি, প্রাচীর পেরিয়ে ছুঁড়ে ফেলা জ্বলন্ত তীর- এসবই ছিল তাদের লক্ষ্য অন্য দিকে ঘোরাবার জন্য একটা চাল মাত্র; ঠিক সেই সময়ই দুর্গপ্রাচীরের অন্য এক জায়গায় শত্রুরা খাড়া করেছে প্রধান সিঁড়িটা। খাজা আবদুল্লাহ্র লোক সেখানে খুবই কম।
খানজাদা বেগম তার সিপাহীদের নিয়ে পাহারার বরুজের দিকে এগিয়ে গেলেন। বুরুজের সৈনিক মশাল জ্বালালো। মশালের আলোয় সবাই দেখতে পেল একটা সিঁড়ি পাতা রয়েছে দেওয়ালের গায়ে। মওলানা ফজল উদ্দিনের ভয় হল যে খানজাদা বেগম সবার আগে সিঁড়িতে উঠবেন, তাই সবাইকে পেরিয়ে তিনি পা রাখলেন সিঁড়িতে। প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল সৈন্যরা। খানাজাদাও সেখানে উঠে এলেন হাতে মশাল ধরে। ফজল উদ্দিন আলতো করে মশালটা নিয়ে নিলেন খানজাদার হাত থেকে।
‘সাবধান বেগম, আলোয় শত্রুকে নিজের চেহারা দেখাবেন না’।
প্রাচীরের বাইরে থেকেও প্রশস্ত সিঁড়ি পাতা হয়েছে দেখতে পেল দুর্গরক্ষাকারীরা।
সাহায্য এসে পৌঁছানোতে সাহস পেয়ে প্রহরীকক্ষে প্রহরারত সৈনিকটি দু’হাতে একটি সিঁড়ির প্রান্ত ধরে উল্টো দিকে ফেলে দেবার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন’ তখনই শত্রুদের ছোঁড়া একটি তীর এসে তার বুকে বিঁধলো। বেচারী ছেলেটি সিঁড়িসমেত হুড়মুড়িয়ে পড়লো নীচে।
প্রাচীরের গায়ে পাটাতনের উপর পাথর রাখা ছিল। খানাজাদা বেগম একটা পাথর অতি কষ্টে তুলে নিয়ে নীচে ছুঁড়ে দিলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরাও পাথার ছুঁড়তে লাগল নীচে, নীচে থেকে ভেসে আসা গালিগালাজ আর আর্তচীৎকারে বোঝা যাচ্ছে যে সেগুলি লক্ষ্যে গিয়ে পড়েছে।
এবার প্রাচীরের বেড়ের ঠিক উল্টো দিকে খাকান দরওয়াজা থেকে ঢাকঢোক, শিঙ্গার আওয়াজ, জয়োল্লাস শোনা যেতে লাগল। আওয়াজটা ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসতে লাগল- এবার শহরের একেবারে কাছে।
‘বেগম, শুনছেন!’ ভীতস্বরে বললেন ফজল উদ্দিন, ‘দুশমন ঢুকে পড়েছে শহরে।’
মরিয়া চীৎকার করে উঠল নুয়ান কুকলদাস, ‘হায় বেগম, বিশ্বাসঘাতকরা খাকান দরওয়াজা খুলে দিয়েছে। প্রাসাদে ফিরে যেতে হবে, এক্ষুনি।’
খানাজাদা বেগম দ্রুত নেমে চললেন সিঁড়ি দিয়ে, মওলানা ফজল উদ্দিন ও অন্যান্য অনুচররাও মশাল ধরে পথ দেখাতে দেখাতে ছুটে চললেন তার পিছনে। সবাই দ্রুত ঘোড়ায় চড়লেন।
‘মশাল ফেলে দিন।’ খানাজাদা বেগম বললেন।
অন্ধকারে মশাল ধরে থাকা মওলানা দারুণ চমৎকার নিশানা হতে পারতেন। অন্ধকারে সবাই দ্রুত এগিয়ে চললেন শহরের মধ্যে অবসি’ত প্রাসাদের দিকে। দ্রুত ! আরো দ্রুত!
কিন’ যখন তারা প্রাসাদ থেকে সামান্যই দূরে তাদের পথরোধ করে দাঁড়াল বর্শা ও মশালধারী অসংখ্য অশ্বারোহী সৈন্য। তারা মশালের আলোয় দেখতে পেলেন আহমদ তনবালকে, জরির কোমরবন্ধ, উজ্জ্বল শিরস্ত্রাণপরা। ফজল উদ্দিনের বুকের ওপর যেন চেপে বসলো লোহার ঠান্ডা বেড়ি।
শত্রুসৈন্যের দলটি খানজাদা বেগম আর তার অনুচরদের ঘিরে ধরলো। আহমদ তনবাল উল্লসিত স্বরে একজন সৈন্যকে বলল, ‘মশাল দে তো। … আরে, খানজাদা বেগম যে? নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। এর মানে কী? আপনি এমন পোশাক পরেছেন কেন, যেন এক বীরপুরুষ?’
‘প্রকৃৃত পুরুষমানুষ যারা বিশ্বাসী এবং সাহসী তারা আর কেউ নেই যে দুনিয়ায়।’
‘আন্দিজানে প্রকৃত পুরুষমানুষ যদি না থাকে তো আমরা এসে পড়েছি, বেগম।’
তনবালের পিছন থেকে হেসে উঠল উজুন হাসান। আরো অশ্বারোহী সৈন্য এসে জড়ো হয়েছে। মশালের আলো পড়লো মাকুন্দ আলী দোস্ত বেগের মুখে- চোখ কুঁচকে আছে সে, মুখে করুণ হাসি। শহর ছেড়ে যাবার সময় বাবর এর হাতে শহর রক্ষার ভার দিয়ে যান। বাবর মুত্যুশয্যায় এ খবর শুনে আলী দোস্ত বেগ বাবরের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। তাই তনবালের সঙ্গে চুক্তি করে অবরোধকারীদের কাছে খুলে দিয়েছে খাকান দরওয়াজা।
খানজাদা বেগম ঘৃণাপূর্ণ স্বরে চীৎকার করে উঠলেন, ‘প্রকৃত পুরুষমানুষ আপনারা নাকি? বীরত্ব আর বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে কোন ফারাক নেই আপনাদের কাছে। গতকালই বাবরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার শপথ নিয়েছেন, আর আজ… আর এও জানি, কালই আবার আপনারাই জাহাঙ্গীর মির্জার সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করবেন।’
তরবারির হাতলে হাত রাখলো তনবাল।
‘ভেবে কথা বলুন, বেগম! মির্জা বাবর অন্যায় কাজ করেছেন। সমরখন্দ দখল করার পর আন্দিজান জাহাঙ্গীর মির্জার হাতে চলে আসা উচিত ছিল। কিন’ বাবর তাতে সম্মত হন নি। আমারা ন্যায়ের জন্য লড়াই করে আজ জয়ী হয়েছি।… আর আপনি, আপনি…’ হঠাৎ মাথায় রাগ চড়ে গেল বেগের, আপনি লজ্জা ভুলে আমাদের অপমান করছেন? আপনাকে কে শিখিয়েছে এমন আচার-আচরণ যা মোটেই শাহজাদীর উপযুক্ত নয়? ঐ স্থপতি নাকি, যে আপনার চারপাশে ঘুরঘুর করছে।’
ঘৃণাপূর্ণ চোখে সে তাকিয়ে রইলো ফজল উদ্দিনের দিকে। ফজল উদ্দিনও চোখ সরিয়ে নিলেন না।
‘বেগম আমাদের পুরুষমানুষদের প্রতি উপযুক্ত উপদেশই দিয়েছেন। … বেগমের কথার অন্য অর্থ ধরতে পারে কেবল দাঙ্গাবাজরাই।’
‘কে দাঙ্গাবাজ?’ খাপ থেকে তরবারি খুলে নিয়ে মওলানার দিকে ঘোড়া চালিয়ে দিল তনবাল। তখনি খানজাদা বেগমও ঘোড়া চালিয়ে দিলেন, তনবালকে বাধা দেবার জন্য।
‘বিদ্বান লোকের ওপরে অস্ত্র তুলে ধরা লজ্জার কথা।’
তনবাল আর খানজাদার ঘোড়ার মধ্যে সংঘর্ষ হল, ঘোড়াদুটি পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলো। খানজাদার মাথার উপর তরবারি ঘোরাতে লাগল তনবাল, ‘ঐ… ঐ নক্সা আঁকিয়ে লোকটার প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা? হীরাটের নীচ বংশের, পাপী ঐ লোকটাকে? বিশ্বস্ত লোকদের কাছেই শুনেছি যে ঐ মোল্লাটা বেগমকে প্রলোভনের পথে নিয়ে যাচ্ছে, তখন বিশ্বাস হয় নি।’
‘আমার দোষ ধরার তুই কে রে, বেইমান!’ বলে খানজাদা খঞ্জরটা তুলে নিলেন হাতে।
আঘাতটা লাগলো তনবালের পোশাকের নীচে লোহার বর্মে, খঞ্জরটা খানজাদার হাত থেকে ছিটকে পাথরে ওপর পড়ে আওয়াজ তুললো। তনবালও তরবারি চালালো- বেগমের টুপিটা টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে পড়লো, তার দীর্ঘচুলের রাশি এসে পড়ল কাঁধের ওপর।
মির্জা জাহাঙ্গীর তার দেহরক্ষী দল নিয়ে সেখানে এসে পড়লেন, তাকে দেখে দোস্ত বেগ তনবালকে সতর্ক করে দিল, ‘যথেষ্ট হয়েছে খোদাবন্দ আহমদ বেগ, এবার থামুন।’
খানজাদা বেগম মির্জা জাহাঙ্গীরের আপন বোন না হলেও বোন তো। সবার সামনে তার পিতার কন্যাকে অপমানিত হতে দেবেন না কিছুতেই। আহমদ তনবাল তখনই ঘোড়া ফেরালেন জাহাঙ্গীরের দিকে। দোষ ঢাকার চেষ্টা করলেন, ‘দেখলেন, দেখলেন, হুজুরে আলী? আপনার বোন অস্ত্র হাতে নিয়ে আপনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। তার সাথে আছে নচ্ছার এই স্থপতিটা। ওই তো তাকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে।’
‘তোর মত বিশ্বাসহন্তা বেগের থেকে মওলানা ফজল উদ্দিন হাজারগুণে ভাল!’ চীৎকার করে বললেন খানজাদা বেগম, ‘ওঁর শিল্প আন্দিজানের গর্বের কারণ হতে পারতো। তোমরা, তোমরা….খুনী, বিশ্বাসঘাতকের দল… খোদার গজব নাজেল হোক তোমাদের ওপর এই স্বপ্ন পদদলিত করে দেবার জন্য। আমাদের স্বপ্ন ভেঙে দেবার জন্য।’
শেষের কথাগুলি বলার সময় বেগমের চোখে জল দেলা গেল। ঘোড়াকে চাবুকের আঘাত করে প্রাসাদের প্রবেশ পথের দিকে যেতে চাইলেন, কিন’ সৈন্যদের সারির সামনে থামতে হলো। পিছনে ফিরে দেখলেন মওলানা ফজল উদ্দিনের কী হলো।
ফজল উদ্দিন কোমর হাতড়ে তরবারিটা খুঁজে পেয়ে আনাড়ির মত বার করে এনে খানজাদা বেগমের পথরোধ করে থাকা সৈন্যসারির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলেন। কিন’ অশ্বারোহী সৈন্যরা সাঁড়াশী ফাঁদে ধরে ফেললো তার ঘোড়াটা, বাঁহাত থেকে ঘোড়ার লাগাম ছাড়িয়ে নিলো, ডানহাতের ওপর ভারী মুগুর দিয়ে আঘাত করলো, তরবারিটা পড়ে গেল মওলানার হাত থেকে।
জাহাঙ্গীর ইঙ্গিতে সৈন্যরা খানজাদা বেগমের সামনে থেকে সরে গেলে খানজাদা বেগম প্রাসাদের ভিতর ঢুকে গিয়ে আর একবার পিছন ফিরে তাকালেন, দেখতে পেলেন তনবালের লোকরা মওলানাকে ঘোড়া থেকে টেনে নামিয়েছে, হাতগুলো এক মুহূর্তে পিছমোড়া করে বাঁধা হয়ে গেল, তারপর তার পিছে বর্শা ধরে রেখে কোথায় যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল।
২
অন্ধকার কারাকক্ষে একা পড়ে রইলেন মোল্লা ফজল উদ্দিন তখনই হাতে প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব করলেন। আন্দিজান শহরের প্রান্ডে প্রস্তরনির্মিত এই গারদখানায় এনে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিতদের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে বন্দী করা হয়েছে তাকে, দরজার বাইরে থেকে পড়েছে ভারী তালা। তাছাড়া বাইরে দুজন প্রহরীও বসানো হয়েছে। দুর্গপ্রাকারের কাছে মির্জা জাহাঙ্গীর ও আহমদ তনবালের সংক্ষিপ্ত কথোপকথন থেকে তিনি বুঝেছেন যে খানজাদা বেগমের সম্মানহানির অভিযোগ আনা হবে তার ওপর। এই অভিযোগে অভিযুক্ত অপরাধীদের পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা হয়। আগামীকাল তাই ঘটবে। মোল্লা ফজল উদ্দিন আরো বুঝলেন খানজাদা বেগমের নামে কলঙ্ক দিয়ে কী আনন্দই না হচ্ছে আহমদ তনবালের। বেগ প্রতিশোধ নিচ্ছে পুরনো অপমানের। জাহাঙ্গীরও তার কথায় সায় দিয়ে যাচ্ছে, কারণ সে আর তার মা ফতিমা-সুলতান বেগম প্রমাণ করে দিতে চাইছিলেন যে বাবরের সঙ্গে যুক্ত সবাই কত নীচ আর তারা শরীয়তের প্রয়োজনে, আইনানুযায়ী আন্দিজানের তখ্ত দখল করেছেন, কী ন্যায়ের কাজই না করেছেন তারা।
স্যাঁতস্যাতে, দুর্গন্ধময় অন্ধকার ঘরটিতে ফজল উদ্দিন পিছমোড়া করে বাঁধা হাতটা দেয়ালে চেপে ধরতে লাগলেন বারবার, যাতে ঠান্ডায় কব্জির ব্যথাটা একটু কমে। কিন’ কমছে না ব্যথাটা, বেড়ে চলল উলটে। এ কেবল মুগুরের একটা আঘাত। আর কাল… কাল তার ওপর পাথরবৃষ্টি হবে!… মনে মনে কল্পনা করলেন তিনি, কালকের ঘটনা। মাথা ঘুরে উঠলো, তার মনে হলো যেন তিনি এখন কারাগারে বন্দী নন, যেন তিনি দুটি দোদুল্যমান পর্বতের মাঝে, আর যেন পর্বতগুলির গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বড় বড় পাথরের চাঁই, পিষে মেরে ফেলবে তাকে এখুনি। এই কল্পিত দৃশ্যে তিনি এমন ভয় পেয়ে গেলেন যে মরিয়া হয়ে ছুটে গেলেন দরজার দিকে কাঁধ দিয়ে দরজার ওপর আঘাত করে সর্বশক্তি দিয়ে চীৎকার করে কললেন, ‘খোল! খোল, বলছি! খোল!’
এই অপ্রত্যাশিত চীৎকারে চমকে উঠল প্রহরী, তারপর রেগে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই কি পাগল হলি নাকি? কী হয়েছে কী?’
‘হাতের বাঁধন খুলে দাও! আমার প্রাণটা নেবে তো কাল, হাতটা এদিকে বিকল হয়ে গেল। খুলে দাও বাঁধন।’
প্রহরীদের মেজাজ ভীষণ খারাপ। তারা এখানে বন্দীটাকে পাহারা দিচ্ছে, আর অন্যরা এ সময় বাবরের সমর্থনকারীদের ধনসম্পত্তি লুঠপাট করছে। এখন রাত হলেও আন্দিজানের রাস্তা, বাড়ীগুলির উঠানে হৈচৈ শোনা যাচ্ছে, ঘোড়ার খুরের আওয়াজ, কুকুরের ডাক, মেয়েদের চীৎকার-কান্না, গোরুর হাম্বারব, ভেড়ার চীৎকার। হায়, হায়, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কী ক্ষতিই হয়ে গেল তাদের। বন্দীও তেমনি এক অকর্মা, বুদ্ধু। প্রহরীদের মধ্যে যার বয়স বেশী সে ঘড়ঘড় করে বলল, ‘হাতটা ভেঙে দিয়েছে বলছে!… ওরে বেজন্মা কালই তো পরপারে পৌঁছে যাবি, আজ আর হাত নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কি?’
‘জল্লাদ তোমরা!’
প্রহরী চীৎকর করে ধমক দিল, ‘চোপ্ রও! জিন্দা লাশ! না হ’লে এখনি এসে ওর ওপর আরও ঘা দেব!’
আমার মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে একি শুনছি আমি! বললেন ফজল উদ্দিন নিজের মনে। মানুষ এত নির্দয় হয়ে যাচ্ছে কেমন করে? আমায় যেমন মরতে হচ্ছে এ মোটেই ভাল না। মৃত্যুর হাত থেকে পরিত্রাণ নেই যখন, তনবালের সঙ্গে লড়াই করতে করতে হাতে তারবারি ধরে মৃত্যুই তো ভাল ছিলো। আর এখন এই জন’গুলোর গালিগালাজ শুনতে হচ্ছে, কালই পাথরবৃষ্টিতে মরতে হবে… খানজাদা বেগমের সামনে তনবালের ওপর ঝাপিয়ে পড়তে তো পারতাম। হায় কিসমৎ, কেন তুমি আমাকে তখন এগিয়ে দিলে না?
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শোনা গেল, প্রথমে রাস্তায়, তারপর বিচারালয়ের পাথর বাঁধানো উঠানে।
‘কে যায়? দাঁড়াও!’
তিনজন অশ্বারোহী এসে ঢুকলো উঠানে। একজন প্রহরীরকে বলল, ‘খোদাবন্দ কাজী মওলানা খাজা আবদুল্লাহ, বাদশাহের ফরমান নিয়ে এসেছেন।’
একে একে নামল তারা ঘোড়া থেকে। প্রহরীদের উঁচিয়ে ধরা বর্শার একেবারে সামনে গিয়ে থামলো।
‘ফরমান দেখাতে হবে আমাদের সর্দারকে।’ বয়সে বড় প্রহরীটি গলা ঘড়ঘড় করে বলল।
বিচারালয়ের দরজার উপরে একটা চিরাগ জ্বলছে মিটমিট করে। হালকাহলুদ রংয়ের আলখাল্লাপরা খাজা সোজা প্রহরীদের দিকে এগিয়ে গেলেন, নিশ্চিত ধীর স্বরে বললেন, ‘সর্দারকে খুঁজে পেলাম না আমরা। তোমরা ছাড়া ধারেকাছে আর কেউ নেই।’
অল্পবয়সী প্রহরীটির স্বরে বিরক্তি আর চাপা রইল না, ‘লুঠপাট করতে গেছে সবাই!’
খাজা আবদুল্লাহ গোল করে পাকান একটা কাগজ দেখালেন।
‘তাহলে হুকুম তোমাকেই তামিল করতে হবে’, তেমনই ধীরস্বরে বললেন তিনি। ‘নাও, পড়!’
দু’জন সৈন্য যারা পিছনে ছিল, ঘোড়াগুলোকে দেয়ালের আংটার সঙ্গে বেঁধে কাছে এগিয়ে এল। ‘ওখানে দাঁড়াও তোমরা!’ ঘড়ঘড়েগলা চীৎকার করে বলল।
সৈন্যরা সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রহরী বর্শাটা সরিয়ে নিয়ে খাজা আবদুল্লাহকে পথ করে দিলো। তারপর তার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে দেখলো। দামী কাগজে সামান্য কয়েকটা কথা লেখা, লেখার নীচে জমকালো একটা মোহরছাপ। প্রহরী কাগজটা আলোর কাছে নিয়ে এসে মোহরাছাপ পর্যবেক্ষণ করল ভালো করে (পড়তে তো পারে না সে), ‘তুই পড় দেখি।’
কিন’ অন্যজনের একেবারে অক্ষরজ্ঞানই নেই। খাজা আবদুল্লহাকে জানে কিন’ সে। কাগজটা হাতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো তারপর তাকালো খাজা আবদুল্লাহ্র দিকে, ‘পীর, এ কিসের ফরমান?’
‘এ ফরমানে লেখ আছে যে এখানে যে লোকটি বন্দী সে অত্যন্ত বিপজ্জনক বিশ্বাসঘাতক, আমাদের ওকে নিয়ে যেতে হবে কেল্লার ভিতরের গারদে।’
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যদের একজন বেশ জোরে বলল, ‘খোদাবন্দ কাজী ঐ বেজম্মাটাকে ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন সেখানে।’
খাজা আবদুল্লাহ আন্দিজানের কাজী এবং অনেক সম্মানিত ব্যক্তির ধর্মীয় উপদেশদাতা সেকথা কে না জানে? বয়সে বড় প্রহরীটি প্রথম দেখামাত্রই চিনেছে তাকে। কিন’ তার দ্বিধা হচ্ছিল তা সত্ত্বেও, কারণ সে জানে এই সেদিনও কাজী ছিলেন বাবরের পক্ষে।
‘এ ফরমান কি মির্জা জাহাঙ্গীর নিজে দিয়েছেন?’ ঘরঘড়গলা শক্ত করে চেপে ধরল বর্শাটা।
‘যদি সন্দেহ হয়, পড়ে দেখ্!’
‘আমাদের আদেশ দেওয়া হয়েছে বেজম্মাটাকে কড়া পাহারায় রাখতে, অত্যন্ত কড়া পাহারা, পীর।’
‘একে কি তোমরা বল কড়া পাহারা? তোমাদের বড় সর্দার কই? আর ছোট সর্দার? কেবল তোমরা দু’জন কেন? আর যদি… বন্দী পক্ষের লোকেরা দল বেঁধে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে? না, না তাড়াতাড়ি একে কেল্লার ভিতরে নিয়ে যেতে হবে! দরজা খোল!’
অল্পবয়সী প্রহরীটি অন্যজনের দিকে তাকালো যেন বলতে চাইলো, বুঝছো না, কাজীও মির্জা জাহাঙ্গীরের দল চলে এসেছে, কিন’ অন্যজনের মনে তখনও সংশয়, ‘আমরা সর্দারকে কী বলবো এরপর?’
‘তোমরা দু’জনেই যাবে আমাদের সঙ্গে,’ বললেন খাজা আবদুল্লাহ, ‘সবাই মিলে একে পাহারা দেব, না হ’লে দু’জনে কিছু হবে না।’
একথায় এবার আস্বস্ত হল ঘড়ঘড়েগলা। দেয়ালের গায়ে বর্শাটা হেলান দিয়ে রেখে দরজাটা খুললো। কিন’ সে একপা ভিতরে দেবার আগেই খাজা আবদুল্লাহর সঙ্গীদের একজন তার শিরস্ত্রাণের ওপর বসিয়ে দিল মুগুরের এক ঘা, তারপর ধাক্কা দিয়ে তাকে কারাকক্ষের ভিতর ঢুকিয়ে দিলো। তা দেখে হাঁকুপাঁকু করতে থাকা অপরজনকেও মাটিতে ফেলে দিয়ে একটা সরু বস্তা পরিয়ে দিলো মাথায়। খাজা আবদুল্লাহ্ ফিসফিস করে বললেন, ‘মেরে ফেলো না! রক্তপাত কোন মঙ্গল হবে না আমাদের!’
‘ওরা আমাদের কথা জানিয়ে দেবে পরে!’
প্রহরীটি ওদিকে ছটফট করছে বস্তা থেকে মাথা বার করার জন্য, রুদ্ধ করুণস্বরে কাকুতিমিনতি করছে, ‘ছেড়ে দিন, পীর! কোনদিনও আপনার কোন ক্ষতি করবো না। মেরে ফেলবেন না আমায়।’
‘ভাল চাস তো চুপ কর,’ চেঁচিয়ে উঠল একজন সিপাহী। ফজল উদ্দিন নিজের ভাগ্নের কণ্ঠস্বর চিনতে পারলেন।
‘দাঁড়াও!’ খাজা আবদুল্লাহ তাহেরকে আদেশ দিলেন। ‘ওর হাত-পা বাঁধো, তাই যথেষ্ট আর অন্যজনের তো জ্ঞান নেই।’
‘দেখছি আমি।’
তাহের আর খাজা আবদুল্লাহর দিকে ছুটে গেলেন মোল্লা ফজল উদ্দিন, ‘মোল্লা!… ভাগ্নে আমার!… তাহেরজান!… আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ তোমরা!’
স্থপতির হাতের বাঁধন না খুলে সাবধানে, শক্ত করে ধরে তাকে বাইরে নিয়ে এলেন খাজা আবদুল্লাহ্। দেয়ালের গায়ের প্রদীপের আলোয় ফজল উদ্দিনের হাতেবাঁধা দড়িটা কেটে দিলেন ছোরা দিয়ে।
তাহের আর তার সঙ্গীরা দ্বিতীয় প্রহরীটিকে টেনে নিয়ে গেল কুঠুরীর মধ্যে, তারপর কুঠুরীর দরজা বন্ধ করে দিল বাইরে থেকে।
‘ভাগ্নে রে, কী করে তোকে খোদা আমার কাছে পাঠিয়েছেন?’
‘সমরখন্দ থেকে এসেছি দূত হয়ে।’
‘মির্জা বাবর সুস্থ হয়েছেন?’
‘হ্যাঁ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আসছেন এদিকে, সাহায্য করতে।’
‘আন্দিজানের পতন হয়েছে, জানেন তিনি?’
‘এখনও জানেন না, সেখানেই তো অসুবিধা!…’
খাজা আবদুল্লাহ্ ফিসফিস করে বললেন, ‘আসে-! আসে- কথা বলুন।’
মামাকে নিজের ঘোড়ায় বসিয়ে দিলো তাহের, তারপর সবাই ধীরে ধীরে সতর্কভাবে চললো শহরের রাস্তা ধরে। ভাগ্যের কথা কারো চোখে পড়ে নি তারা। বিজয়ী দল লুঠপাট নিয়েই ব্যস্ত।
তিনটা ঘোড়ায় করে চারজন এসে পৌঁছাল দুর্গপ্রাচীরের কাছে। এখানে একেবারেই নির্জন।
‘এখানে প্রাচীর পার হওয়াই সব থেকে সুবিধাজনক,’ খাজা আবদুল্লাহ্ এ পর্যন্ত একবারও গলা উঁচু করে কথা বলেন নি।
সবাই নামল ঘোড়া থেকে। তাহেরের সঙ্গী ঘোড়ার পিঠে বাঁধা থলি থেকে পাকানো দড়ির একটা বিরাট গোলা বার করলো। তাহেরই দড়ির সিঁড়িটা ছুঁড়ে দিল প্রাচীরের গায়ে, তারপর তারা চারজনে প্রাচীরের উপর উঠলো। খাজা আবুদল্লা্ মোল্লা ফজল উদ্দিনের পাশে দাঁড়ালেন (ফটক দিয়ে বার হবার বিপদ আছে। বুঝেছি পীর, শুকরিয়া, ওস্তাদ?), পোশাকের ভিতর থেকে মোহরভরা একটা চামড়ার থলি বার করে ফজল উদ্দিনের হাতে গুঁজে দিলেন।
‘হুজুরে আলীর ওয়ালিদা মালিকা সাহবের কাছ থেকে।’
‘উনিও জানেন আমার সঙ্গে কী ব্যবহার করেছে?’
‘চোখে জল নিয়ে খানুম অনুরোধ করেছেন বারবার আপনাকে উদ্ধার করতে। তনবাল খানজাদা বেগমের নামে কলঙ্ক দিতে চায়, জানেন বোধহয়। কিন’ যতক্ষণ আমরা বেঁচে আছি ততক্ষণ মির্জা বাবরের পরিবারে গায়ে একটা দাগও পড়তে দেব না। ঠিক কিনা?’
‘হ্যাঁ, ঠিক তাই।’ পোশাকের ভিতর মোহরের থলিটা ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে দৃঢ়স্বরে উত্তর দিলেন মোল্লা ফজল উদ্দিন, আমি এখন সোজা যাব মির্জা বাবরের কাছে।’
‘মওলানা,’ আরো নেমে গেল খাজা আবদুল্লাহ্র গলার স্বর। ‘মালিকা, সাহেবা আর আমিও আপনাকে অন্য পরামর্শ দিতে চাই।’ এরপর আরবীতে বলতে আরম্ভ করলেন। ফজল উদ্দিনকেও একসময় তিনি আরবী শিখিয়েছেন, সেই জন্যই মওলানা তাকে ওস্তাদ বলে ডাকেন। ‘মওলানা! সমরখন্দ যাবে তাহেরবেগ। ও তো দূত। হয়ত মির্জা বাবর সমরখন্দ ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়েছেন। দূত তার সঙ্গে দেখা করবে। আর আপনার অমূল্য প্রতিভা মওলানা, আপনার উচিত তাকে রক্ষা করা, মাভেরান্নহরের এই ভয়ঙ্কর গোলমালের দিনগুলি খুব শীগগির শেষ হবে না। …. আপনি নিজেই তো এক সময় হীরাট যেতে চেয়েছিলেন। সেই ইচ্ছাপূরণ করার সময় হয়েছে এবার।’
ফজল উদ্দিন এর আগে হীরাটে গিয়েছেন, সেখানে যাবার দীর্ঘ পথ মনে মনে কল্পনা করলেন তিনি। সেই পথ গিয়েছে কয়েকটি অশান্ত অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে, বহুমাস লাগে সেপথ পেরোতে। স্থপতির হৃদয় বিষণ্নতায় ভরে গেল। সবকিছু ছেড়ে যেতে হবে, কিন’ কিসের জন্য? আহত হাতের ব্যথাটা যা ভুলে গিয়েছিলেন প্রায়, সেটা আবার অনুভব করতে লাগলেন। ডানহাতের কব্জিতে হাত বুলালেন ফজল উদ্দিন।
‘নিজের জায়গা…. নিজের দেশ কেমন করে ছেড়ে যাব আমি, ওস্তাদ?’
‘এখন যেখানে আলি শের নবাই আছেন সেই খোরাসানই হবে আপনার দেশ, মওলানা।’
‘অবশ্যই… কিন’ জন্মভূমি… হয়ত আর ফিরে আসা হবে ন, বাড়ীতে আমার বইপত্র, নকশাদি রয়ে গেছে, তাহের!’
‘আমি বাড়ীতে ফিরে সেগুলো সব ভাল করে লুকিয়ে ফেলব, মামা, আশ্বস্ত হোন!’
খুব মনখারাপ হয়ে গেল ফজল উদ্দিনের- খানজাদা বেগমের জন্য, বেশ বুঝতে পারলেন তার দেখা আর কোনদিনই পাবেন না। তিনি জানেন, তাকে হীরাট পাঠাবার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কুতলুগ নিগর-খানম আর খাজা আবদুল্লাহ তার অন্যতম কারণ খানজাদা বেগম ও স্থপতির মধ্যে স্নেহময় ও জটিল সম্পর্ক, যা তাদের আনন্দ ও কষ্ট দুই-ই এসে দিয়েছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন ফজল উদ্দিন। শেষে খাজা আবদুল্লার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘মৌলবী, মির্জা বাবরের নাম অকলঙ্ক রাখার জন্য যা প্রয়োজন তা করব আমি। কেবল একটা অনুরোধ, মালিকা সাহেবাকে বলবেন, মিথ্যা রটনায় কান না দিতে। খানাজাদা বেগমকে সন্দেহ করার কোন কারণই নেই, তার তুল্য পবিত্র আর কেউই নেই।’
‘আপনিও ঠিক তেমনই, মওলানা, এ আমি জানি। আপনার ইমানদারীতে বিশ্বাস না থাকলে কি আর আমরা জীবনের ঝুঁকিয়ে নিয়ে প্রহরীদের চোখে ধুলো দিতে যাই? এমন কাজ করতে হবে তা কখনও ভাবি নি, তাহেরবেগ খুব উৎসাহ দিয়েছে আমায়। বলে শত্রুর সামরিক কৌশলের সামনে আমাদেরও কিছু কলাকৌশল অবলম্বন করতে হবে।’
‘আপনি আমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন, ওস্তাদ! কিন’ আপনি নিজেও সতর্ক হোন, এই আমার অনুরোধ। আর, ভাগ্নে তুইও।’
পুবদিগনে-র আকাশে রং ধরতে আরম্ভ করেছে। মোল্লা ফজল উদ্দিন কোমরে দড়ির ফাঁস বাঁধতে আরম্ভ করলেন।
‘আবার দেখা হবে, মামা!’
‘সবই আল্লাহ্র মর্জি।…. তাহের আমার নকশাগুলো… আর অন্যান্য কাগজপত্র… যেন হারিয়ে যায় না। তুই যুদ্ধে ব্যস্ত তোর পক্ষে সেগুলোকে রক্ষা করা কষ্টকর। তাই সম্ভব হলে সেগুলো সব খানজাদা বেগমকে দিয়ে দিবি। … সবকিছু দিবি।… কেবল নকশাই নয়, বুঝলি?’
‘তাই করব!’
‘আপনার অনুরোধ আমি নিজে পৌঁছে দেবো বেগমের কাছে!’ খাজা আবদুল্লাহ বললেন।
পরস্পরকে আলিঙ্গন করে বিদায় নিলেন তারা, তারপর কেল্লার প্রাচীর বেয়ে নামতে আরম্ভ করলেন মোল্লা ফজল উদ্দিন- প্রাচীরের এগারোটি ধাপ নামতে হবে তাকে।
৩
খুব ভোরে ফজল উদ্দিন কুভার দিকে যাবার পথে পা বাড়ালেন।
পরের দিন দুপুরবেলায় আহমদ তনবালের লোকেরা হানা দিল খাজা আবদুল্লাহ্র এক মুরীদের বাড়ী, সেখানে স্বয়ং খাজা আবদুলাহ্ গা ঢাকা দিয়েছিলেন। কে কীভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে মোল্লা ফজল উদ্দিনকে কুঠুরীতে আটকাপড়া প্রহরীরা সবই স্বীকার করেছে তনবালের কাছে।
আহমদ তনবাল মহা খুশী হয়ে ঘোড়া চালালো সেদিকে যেখানে খাজা আবদুল্লাহ্ ধরা পড়েছেন। খাকান দরওয়াজার কাছে রাস্তা লোকে লোকারণ্য। অস্ত্রসাজে সজ্জিদ সৈন্যপরিবৃত হয়ে ধীরে ধীরে চলেছেন খাজা আবদুল্লাহ্। তিনি যেন এক অপরাধী, পা পর্যন্ত ঝুল পোশাক পরা, হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, মলিন মুখ। মাথার সাদা পাগড়ি আর সাদা পোশাক দাড়ি গজিয়ে ওঠা মুখমন্ডলের কালো রংকে আরো প্রকট করে তুলেছে।
তনবালকে পথ ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল লোকেরা। যে নোকরেরা খাজা আবদুল্লাহ্কে নিয়ে যাচ্ছিল, তারাও থেমে পড়ল।
লাগামে টান দিয়ে ঘোড়া থামালো তনবাল, ‘এই যে মিথ্যাবাদী পীর! বাবরের লেজুড়। আমাদের বিরুদ্ধে এত চক্রান্ত করেও আশা মেটেনি, এবার প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছ, ঐ বেজম্মটাকে তার প্রাপ্য শাসি- থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছো।’
‘নিরপরাধকে অন্যায় মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছি মাত্র।’
‘নিরপরাধ! মিথ্যা ফরমান, মোহরছাপ নিরপরাধে করে না।’
শত শত চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে খাজা আবদুল্লাহ্র ওপর। যদি এখন তিনি তনবালকে ভয় পেয়ে দিশাহারা হন তো লোকেরা ভাববে তিনি প্রকৃতই দোষী। নিজের মধ্যে দৃঢ়তা এবং আত্মসংযম ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করলেন খাজা আবদুল্লাহ্।
‘পাহারাদারদের আমি দেখিয়েছি মির্জা বাবরের মোহরছাপ। তাকেই আন্দিজানের একমাত্র বাদশাহ বলে জানি।’
‘বেইমানি, এখনও নিজের মুরীদদের ধোঁকা দিচ্ছিস তুই। মোহরছাপ? মির্জা বাবর সমরখন্দে, মৃত্যু হয়েছে তার। সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মির্জা জাহাঙ্গীর।’
‘মুসলমান ভাইসব, মিথ্যাকথায় বিশ্বাস কোরো না। আল্লাহ্র রহমতে বাবর বেঁচে আছেন। তিনি আবার আসবেন আন্দিজানে।’
‘মিথ্যা তুই বলছিস। শোন সবাই, ও নিজের মুরীদদের ধোঁকা দিচ্ছে, নিজের দোষ ঢাকার চেষ্টা করছে। ও এক অপরাধীকে পালাতে সাহায্য করেছে যে ওর বন্ধু। অসৎ পীরকে মেরে ফেলা উচিত। পাথর ছোঁড় ওর উপর। যদি পাক কাজ করতে চাও ওর উপর পাথর ছোঁড়।’
তনবাল সুকৌশলে ঘোড়া থেকে ঝুঁকে পড়ে মাটি ছুঁয়ে ঘোড়ার পায়ের কাছ থেকে তুলে নিলো হাতের মুঠির মত আকারের একটা পাথর, তারপর সোজা হয়ে বসে পাথরটা ছুঁড়ে মারলো খাজা আবদুল্লাহ্ গায়ে। পাথরটা গিয়ে লাগলো খাজা আবদুল্লাহ্র চওড়া বুকে, সাদা জামার ওপর উদগ্র ধূলিধূসর ছাপ রেখে গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। ব্যথায় চোখে জল এসে গেল। তনবালের দলের লোকরা ঝুঁকে পড়ে পাথর খুঁজতে লাগলো।
খাজা আবদুল্লাহ্ চীৎকার করে বললেন, ‘মুসলমান ভাইরা, কি করছ তোমরা? ভেবে দেখ।’
ভীড়ের মধ্যে তার চোখে পড়ল বছর বিশ বয়সের এক তরুণকে। হঠাৎ তার মনে পড়লো কেমন করে এক সময় গোবের গলা কাটা হয়েছিল। ঐ তরুণটি তারই ছেলে, হুবহু দরবেশ গোবের চেহারা। তখন যদি খাজা আবদুল্লাহ বাবরকে বলতেন, ওকে প্রাণদন্ড দিও না। বলতেন যদি। কিন’ তিনি উল্টো পরামর্শই দিয়েছিলেন, আহমদ তনবালের মত বেগদের বিরোধিতা না করতে, নিপরাধীর প্রাণ রক্ষা করতে পারেন নি তিনি তখন। আর এখন তিনি নিজেই নিরপরাধ হয়েও প্রাণদন্ডে দন্ডিত। এবার দরবেশ গোবের ছেলে বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার সুযোগ পেয়ে পাথর ছুঁড়ছে তার দিকে। আর যদি তা করেই- তাহলে কি সেটা উচিত কাজই হবে না?… কিন’ আপাততঃ কেউ পাথর ছুঁড়লো না। তিনি তো একজন মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন, দন্ড পেতে হবে কেন তার জন্য?
‘মুসলমান ভাইরা!’ আবার জোর গলায় বলতে আরম্ভ করলেন খাজা আবদুল্লাহ্, ‘ইনসাফের খাতিরে মরতে ভয় পাই না আমি। ইনসাফ কার পক্ষে তা তোমরা নিজেরাই ভেবে দেখ। কে বড় ভাইকে ছোট ভাইয়ের দুশমন হিসাবে দাঁড় করায়? কে সদাচারী ব্যক্তির প্রতি শত্রুতা পোষণ করে আর আমাদের জীবনে এনেছে এই অন্ধকার দিনগুলো?’
‘তুই নিজে! তুই নিজে…’ চীৎকার করতে থাকল তনবাল।
‘মির্জা বাবরের তরুণবয়স থেকে আমি তাকে শিক্ষা দিয়েছি, তাকে উপদেশ দিয়েছি ন্যায়পরায়ণ শাসক হতে, চেষ্টা করেছি যাতে মাভেরান্নহর সংঘবদ্ধ হয়, অনর্-যুদ্ধ বন্ধ হয়। বাবর এক মহান কাজে হাত দিয়েছেন আন্দিজান ও সমরখন্দ একত্রিত করার। আমি আন্তরিক আনন্দ পেয়েছিলাম আর তোমরা… বিদ্রোহী বেগরা এসব কি গোল পাকাচ্ছে? আবার রাজ্যটাকে টুকরো টুকরো করে ফেললে… ভাইসব, যদি আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের দুঃখ ঘুচে যায় তো আমি মরতে রাজী আছি।’
‘পাথর তুলে নাও, তাড়াতাড়ি।’ তনবাল আদেশ দিল ভীড়ের লোকদের উদ্দেশ্যে।
কাঁদো কাঁদো গলায় ভীত এক প্রতিবাদ শোনা গেল, ‘শেখ-উল-ইসলামের ফতোয়া ছাড়া কী করে আমরা তা করবো?’
এক বৃদ্ধ জানাল, ‘পীরের অভিশাপ লাগবে- তাই আমাদের ভয়।’
এমনকি তনবালের সৈন্যরাও পাথর ছুঁড়তে সাহস পেল না, তনবালের দিকে ফিরলো তারা পাথর হাতে নিয়ে। ক্রদ্ধ তনবাল আদেশ দিল, ‘এই সর্দার। তুই তলোয়ার দিয়ে কেটে ফেল ওর মাথাটা।’
কালো কুচকুচে চেহারা সর্দার খাপ থেকে খুলে নিল রূপোর হাতলওয়ালা তলোয়ারটা। খাজা আবদুল্লাহ্ তার চোখে চোখ রেখে নীচুস্বরে বললেন, ‘দেখো মীর বাদল বেগ, আমার নিরপরাধ রক্তপাতের অভিশাপ যেন না লাগে তোমার সাত পুরুষের গায়ে!’
ভীড়ের লোকেরা আতঙ্কে ফিসফিস করতে লাগল, ‘এ অভিশাপ লাগবে আমাদের সবার ওপর।’
সর্দারের তলোয়ার আর উঠলো না ওপরে। তলোয়ারের মালিক মিনতি জানালো, ‘খোদাবন্দ বেগ, মিনতি করি, এই নিষ্ঠুর দায়িত্ব থেকে রেহাই দিন আমায়।’
তার পিঠে চাবুকের এক ঘা বসিয়ে দিল তনবাল।
‘আমি তোকে সর্দারের কাজ থেকে রেহাই দিচ্ছি, কাপুরুষ। আচ্ছা, ঠিক আছে। এই সেপাইরা, তোমরা এই বেইমানটাকে দরওয়াজার কাছে পাহারার ঘরে নিয়ে যাও। আর তোমরা,’ ক্রুদ্ধ দৃষ্টিবর্ষণ করলো বেগ ভীড়ের লোকদের দিকে, ‘এখানেই থাকবে তোমরা। যে আমাদের পিছন পিছন যাবে, তরোয়ারের ঘায়ে মরবে। কোন মায়াদয়া দেখানো হবে না। কোন মায়াদয়া নয়।’
ঘন্টাখানেক বাদে আহমদ তনবাল তার দলবল নিয়ে দুর্গপ্রাচীরের প্রহরীকক্ষ ছাড়িয়ে দুর্গে ঢুকলো। তখন আন্দিজানবাসীরা প্রহরীকক্ষের কাছে গিয়ে দেখলো দুর্গের খিলানে ঝুলছে খাজা আবদুল্লাহ্র প্রাণহীন দেহ। মাথার পাগড়িটা তার পায়ের নীছে মাটিতে পড়ে আছে, লম্বা হয়ে ঝুলে আছে দেহটা, ইতিমধ্যেই শক্ত হয়ে গেছে। সাবধানে তারা ফাঁসীকাঠ থেকে নামালো তার দেহটা, তারই মাথার পাগড়ীটা খুলে তাতে জড়িয়ে নিল মৃতদেহটি তারপর বিনা দোষে মৃত্যুবরণকারী শহীদের সম্মানে তাকে দাফন করল।