স্বর্গ মরীচিকা ৪

প্রথমে ভিক্টরের মনে কোনই দুশ্চিন-াই দেখা দিলো না । ও জানতো অ্যানা নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম, ওর নিজের মতোই পাহাড়ে ওঠায় যথেষ্ট পারদর্শী। কখনই বোকার মতো কাজ করবে না আর বৃদ্ধ যখন বলেছে চূঁড়ায় ওঠার পথটা বিপদজ্জনক নয়, তখন তো তেমন দুশ্চিন-ার কিছু থাকতে পারে না। তবু ওর মন খারাপ হয়ে গেল, অ্যানা ওর জন্য অপেক্ষা না করেই চূঁড়ায় ওঠার জন্য চলে গেল বলে। ওরা পরস্পরকে কথা দিয়েছিল একসাথে পাহাড়ে উঠবে, অ্যানা সেই প্রতিশ্রুতি ভেঙ্গে উপরে একা উঠে গেল, ব্যাপারটা মনে হতে বেশ অভিমান হলো ওর। তা ছাড়া অ্যানা যে কত আগে রওনা হয়েছে, তাও ভিক্টর জানে না, এতক্ষণে কতদূর এগিয়ে গেছে আনা। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রওনা হয়ে দ্রুত অ্যানার কাছে পৌছে যাওয়া যায়, তাই ওর একমাত্র চিন-া হয়ে দাঁড়ালো। ও ঘরের ভিতরে এসে সারা দিনের খাবার গোছাতে লেগে গেল। ও অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো অ্যানা ওর সঙ্গে কোন কিছুই নিয়ে যায়নি।

অন্য সব মালপত্র এখানে রেখে গেলে অসুবিধা হবে না। ফেরার সময় এখানে আর এক রাত কাটাতে হবে। ওর নড়াচড়ার শব্দেই বোধ হয়ে বাড়ির অন্যান্য লোকের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। কারণ ভিতরের ঘর থেকে বৃদ্ধটি বের হয়ে এলো ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। ওর দৃষ্টি অ্যানার ভাঁজ করা বিছানায় আটকে গেল। তারপর বিস্ময়ে ভিক্টরের মুখের দিকে তাকালো, ওর চোখে অভিযোগ আর প্রশ্ন।

ভিক্টর তাড়াতাড়ি বললো, ‘আমার স্ত্রী আগে রওনা হয়ে গিয়েছে। আমি এখনই রওনা হচ্ছি।’

বৃদ্ধের মুখ খুব গম্ভির হয়ে গেল, ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে গিয়ে গ্রামের চড়াইয়ের পথের দিকে আর শৃঙ্গের দিকে তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ।

‘ওকে একা যেতে দেয়া উচিত হয়নি। অনুমতি দেয়া খুবই অন্যায় হয়েছে।’

বৃদ্ধকে খুবই মর্মাহত হতে দেখা গেল। ওর মাথা এদিক-ওদিক নাড়াতে নাড়াতে বিড়বিড় করতে থাকলো।

ভিক্টর বৃদ্ধকে সান-না দেবার জন্য বললো, ‘ঠিক আছে। আমি এখনই উপরে যাচ্ছি, খুব শিগ্রী ফিরে আসবো, দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসবো।’

ও এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধের কাঁধে হাত রেখে আশ্বস- করতে চাইলো।

বৃদ্ধটি বিষণ্ন গলায় বললো, ‘আমার মনে হয় এর মধ্যেই যথেষ্ট দেরী হয়ে গেছে। ও ঠিকই ওদের কাছে চলে যাবে আর একবার ওদের কাছে গেলে ও কখনোই ফিরতে পারবে না।’

আবার বৃদ্ধটি সেই সাসেরডোটেসে শব্দটা উচ্চারণ করলো, সাসেরডোটেসের শক্তি আার বৃদ্ধের আচরণ, ওর মনের কোনে জমে ওঠা উৎকন্ঠা, এতক্ষণে ভিক্টরের মনেও কেমন আতঙ্কের সৃষ্টি হলো। ওর মন ভীতি আর অসি’রতায় ভরে উঠলো।

‘আপনি কি বলতে চাচ্ছেন মন্টে ভেরিটার শৃঙ্গে একদল লোক বাস করে? ওরা অ্যানাকে আক্রমণ করবে, মেরে ফেলবে?’

বৃদ্ধটি অত্যন- দ্রুত লয়ে কথা বলতে থাকলো, কথার দ্রুততায় ওর সব কথা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল ভিক্টরের।

‘না, অ্যানাকে কেউ দৈহিকভাবে আহত করবে না, ওরা কেউ কারো ক্ষতি করে না। ওরা ওদের দলভুক্ত করার জন্য নিয়ে যাবে। অ্যানা নিজেই গিয়ে ওদের সাথে যোগ দেবে, ও নিজেকে বাধা দিতে পারবে না, ওখানকার শক্তি এতোই প্রবল, কেউই সেটাকে প্রতিহত করতে পারে না। বিশ, ত্রিশ বছর আগে বৃদ্ধের মেয়েই চলে গিয়েছিল, ওকে আর কোন দিনই দেখতে পারেনি ও আরও অনেক মেয়ে, এই গ্রাম থেকে, নিচের উপত্যকার গ্রামগুলো থেকে ওদের ডাকে চলে গিয়েছে। ওদেরকে আর কেউ কোন দিন দেখতে পায়নি, কখনোই দেখা যায়নি ওদের।

বহু বছর ধরে এরকমই চলে আসছে বাবার সময় থেকে, তার বাবার সময় থেকে, হয়তো তারও আগে থেকে। সাসেরডোটেসা কবে থেকে মন্টে ভেরিটাতে বসবাস আরম্ভ করেছে তা জানা যায় না। কোন মানুষ এ পর্যন- তাদের দেখতে পায়নি। কিন’ ওরা আছে, ওখানে দেয়াল ঘেরা এলাকায় আবদ্ধ অবস’ায় প্রবল শক্তির অধিকারী, প্রভাবশালী। কেউ বলে এই শক্তি ওরা পেয়েছে ঈশ্বরের কাছ থেকে, কেউ বলে শয়তানের শক্তিতে ওরা শক্তিমান। কেউ বলতে পারে না, আমরাও জানি না। অনেকে বলে মন্টে ভেরিটার সাসেরডোটেসারা কখনও নাকি বৃদ্ধ হয় না, চিরকাল ওদের যৌবন অটুট থাকে, সুন্দরী থাকে। চাঁদের আলো থেকেই নাকি ওরা ওদের শক্তি সংগ্রহ করে। এই চাঁদেরই ওরা উপাসনা করে, সূর্যেরও উপাসনা করে।’

ওর এই কথাবার্তা থেকে ভিক্টর কোন সুস্পষ্ট কিছু তথ্য পেলো না। পুরোটাই কেমন পাগলামী, উপকথা আর কুসংস্কার মনে হলো। বৃদ্ধ মাথা নাড়তে নাড়তে শৃঙ্গের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘গত রাতেই ওর চোখে সেই সর্বনাশা আলো দেখতে পেয়েছিলাম। আমার তখনই আতঙ্ক হয়েছিল। ওর চোখেও ওদের দৃষ্টি, যখন ওখান থেকে ডাক আসে তখন চোখের দৃষ্টি বদলে যায়। আমি আগেও দেখেছি। আমার মেয়ের চোখে, আরও অনেক মেয়ের চোখে এ দৃষ্টি আমি দেখেছি।

ইতিমধ্যে গ্রামের আর সবাই জেগে গিয়ে ওর চার পাশে ভিড় করেছিল। সবাই যেন বুঝতে পেরেছে, কি ঘঠেছে। যুবক, মহিলা এমনকি কিশোর-কিশোরীরাও ভিক্টরের দিকে আতঙ্ক আর সমবেদনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। ওদের ভাবভঙ্গিতে আর চার পাশের আবহাওয়ায় ও যতটা না আতঙ্কিত হলো তার চেয়ে রাগ আর বিরক্তিতে মন ভরে গেল। প্রাচীনকালের ভুত, প্রেত ওঝার কান্ডবান্ডের কথা মনে হতে থাকলো ওর।

নিচের উপত্যকার কুয়াশা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। মেঘগুলো সরে যাচ্ছে, আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ক্রমে, পূর্বদিকের চূড়োগুলোর আড়াল থেকে সকালের উজ্জ্বল সূর্য উঁকি মারলো।

বৃদ্ধ যুবককে কি যেন বললো তারপর হাতের লাঠি তুলে মন্টে ভেরিটার দিকে উচুঁ করে ধরলো, ‘আমার ছেলে তোমাকে উপরে যাবার পথ দেখিয়ে দেবে; কিছুটা পথ ও তোমার সাথে যাবে। বাকী পথ তোমাকে একা উঠতে হবে।’

ভিক্টর বললো, ওরা রওনা হলো; গ্রামের বাকী সবাই কেউ ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে, কেউ দরজার অর্ধেক খুলে ওর দিকে অবাক বিস্ময়ে, ভয়ে আর আতঙ্কে তাকিয়ে থাকলো।

সঙ্গের যুবকটা ওর সাথে কোন কথা বলার চেষ্টাই করলো না। ও আগে আগে হাঁটতে থাকলো, মাথা ঝুঁকিয়ে, চোখ দুটো পথের সাথে নামিয়ে। ভিক্টর বুঝতে পারলো যুবকটা কেবল ওর বাবার আদেশ পালন করতেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওর সাথে যাচ্ছে।

সারাটা পথ ছোটখাটো পাথরে ভরা, অনেক জায়গায় ভাঙ্গা। ভিক্টরের মনে হলো পথটা আসলে শুকিয়ে যাওয়া পাহাড়ী নদী, যখন বৃষ্টি হয় তখন এ পথ হাঁটার অযোগ্য হয়ে যায়। এখন গ্রীষ্মের দাবদাহে পথটা শুকিয়ে গিয়ে পথচলা মোটামুটি সহজ। নিচের ‘িকের ঝোপঝাড়, লতাগুল্মে ঢাকা এলাকার হয়ে আর একটু উপরে প্রায় ঘন্টাখানেক হাঁটার পর রুক্ষ পাথুরে এলাকায় এসে পড়লো, তখনই চূঁড়োর দিকে নজর গেল ওর। হঠাৎ করেই দৃষ্টি সীমায় মন্টে ভেরিটার জোড়া শৃঙ্গ চোখের সামনে ধরা দিলো, ঠিক যেন পাশাপাশি দুটো আঙ্গুলের মতো স্পষ্ট আর পৃথক। উপত্যকা থেকে, এমন কি নিচের ঐ গ্রাম থেকেও ওদুটোকে একটা শৃঙ্গ বলে মনে হয়েছে।

ওরা উপরে ওঠার সাথে সাথে সূর্যও আকাশের অনেক উপরে উঠে এসেছে। এখন আকাশে ঝলমল করছে আর তার উজ্জ্বল রশ্মি শিখর দুটোর দক্ষিণ-পূর্ব দিকটা যেন আগুন ধরিয়ে দিলো। হালকা পাতলা মেঘ নিচের পৃথিবীকে সর্ম্পূণ ঢেকে রেখেছে।

ভিক্টরের সঙ্গী হঠাৎ থমকে দাড়াঁলো, তারপর হাত তুলে সামনের দিকে ইঈিত করলো। সামনে একখন্ড বড় পাথর ওপারের দৃশ্য আড়াল করে রেখেছে।

যুবকটি ঐ দিকে হাত উঁচু করে বললো, ‘মন্টে ভেরিটা’; একটু থেমে আবার বললো, ‘মন্টে ভেরিটা।’

তারপর হঠাৎ ঘুরে তাড়াহুড়ো করে যে পথ দিয়ে ওরা এসেছিল, সেপথ দিয়েই নিচে নামতে আরম্ভ করলো। ভিক্টর কয়েকবার ওকে ডাকলো, যুবকটি কোন উত্তর দিলো না, এমন কি ও পিছন ফিরে তাকালোও না একবার। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ও দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেলো। এখন একা উপরে উঠে যাওয়া ছাড়া ওর আর কোন গত্যন-র থাকলো না। সামনের ঐ বেরিয়ে থাকা পাহাড়ের বিশাল টুকরো কনুইয়ের মতো ভাঁজ হয়ে থাকা ওপারে যেতে হবে। ভিক্টরের মনে হলো ঐ মোড়টা পার হলেই ও অ্যানাকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে।

পাহাড়ের ঐ বিশাল ভাঁজের মোড়টা পার হতে ভিক্টরের আধা ঘন্টা লেগে গেল। ওর এই সময়টা অত্যন- সতর্কতা আর উদ্বেগের সাথে কাটাতে হলো। উপরে ওঠার পথটা ধীরে ধীরে উঠে যায়নি, একেবারে খাড়া এব্‌ড়োখেব্‌ড়ো ভাবে সোজা উঠে গিয়েছে। আর কিছুক্ষণ গেলে হয়তো ওঠা সম্ভবত অসম্ভব হয়ে যাবে।

ভিক্টর বললো, ‘ঠিক এই সময় আমি একটা ছোট্ট গিরিখাত পার হয়ে এগিয়ে শৃঙ্গের তিন শ’ ফিট নিচের খাড়া দেয়ালের উপরে এসে থামলাম; আর তখনই ওটা দেখতে পেলাম। একটা আশ্রম, একটা বিশাল পাথর কেটে দুই শৃঙ্গের মাঝখানে বানানো, সম্পূর্ণ খোলা আর ফাঁকা, খাড়া পাথরের দেয়াল চার দিকে ঘিরে আছে, দেয়ালের শেষ প্রান-টি সোজা নেমে গিয়েছে প্রায় হাজার ফিট। তার ওপাশে একটা পাহাড়ের ধার উঠে গিয়েছে, তার উপরে মন্টে ভেরিটার জোড়া শিখর আর খোলা অবারিত নীল আকাশ।

তাহলে ব্যাপারটা সত্যিই, ভিক্টরের মাথা তাহলে খারাপ হয়ে যায়নি। জায়গাটা আসলে আছে। কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। ভিক্টর এখন এই নার্সিং হোমের একটা ঘরে আগুনের ধারে চেয়ারে বসে আছে। এমন একটা ঘটনা ঘটলো, যা কোন কল্পনা নয়, যার উৎপত্তি দুঃখময়তার মধ্যে দিয়ে।

ওকে এখন অনেক শান- লাগছে, মনের অবরুদ্ধ কষ্টের ভাগ আমাকে দিয়ে হালকা হয়েছে ও। মনের বিশাল চাপের অনেকাংশ এখন আর নেই। ওর হাতদুটোও তাই আর উত্তেজনায় কাঁপছে না। ওকে এখন ঠিক আগের মতো লাগছে, ওর গলার স্বরও অনেকটা সি’র। দুই একমুহুর্ত চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করলো।

‘ওটা বহু শত বছরের পুরোনো। ইশ্বর জানেন ওটা তৈরী করতে কত বছর লেগেছিল। পাহাড় কেটে, খোদাই করে তৈরী করা। আমি এর আগে কখনও এমন আদিম আর কঠিন কিছু দেখিনি, অচেনা নয়, তবে অসাধারণ সুন্দর। ওটা যেন উপর থেকে ঝুলে আছে। পাহাড় আর আকাশের মাঝে আলগাভাবে যেন লটকে আছে। ভবনটির দেয়ালে আলো বাতাস চলাচলের জন্য সরু সরু লম্বা ফাটল। আমরা যাকে জানালা বলি, তেমন কিছু না। এলাকাটার পশ্চিমের কোণে একটা উঁচু স-ম্ভ, তার পাশেই অতলস্পর্শ খাঁদ। বিশাল দেয়াল সম্পূর্ণ এলাকাটাকে ঘিরে পুরোটাই অলঙ্ঘনীয় আর দুর্ভেদ্য করে রেখেছে, দুর্গের মতো। আমি ঢোকার কোন পথ খুঁজে পেলাম না। কোন প্রাণের চিহ্ন পর্যন- নেই ওখানে। কারো অসি-ত্বও বোঝা গেল না। ঐ দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি, মনে হলো সরু লম্বা জানালা গহ্বরের গর্তগুলো আমার দিকে তাকিয়ে আছে।’

‘আমি ঠিক করলাম যতক্ষণ না পর্যন- অ্যানাকে দেখা যায় ততক্ষণ ওখানেই অপেক্ষা করবো। এইসব দেখে আমার বদ্ধমূল ধারণা জম্মে গেছে যে, ঐ বৃদ্ধ যা বলেছে তার সবটাই সত্য আর কি ঘটেছে তাও বুঝতে পারলাম। ওখানকার অধিবাসীরা অ্যানাকে ঐ সরু লম্বা জানালা থেকে দেখতে পেয়ে ওকে ডাক দিয়ে ভিতরে নিয়ে যায়। ওদের সাথে ও ভিতরে আছে। নিশ্চয়ই ভিতর থেকে আমাকে দেখতে পাচ্ছে, আর আমাকে দেখতে পেলে ঠিকই বাইরে বেরিয়ে আসবে। তাই আমি সারা দিন ওখানে অপেক্ষা করতে থাকলাম।’

ভিক্টরের কথাগুলো খুব সহজ সরল যেন কোন ঘটনা সহজভাবে বলে গেল। এ যেন ছুটির দিনে কোন মহিলা হঠাৎ স্বামীকে না জানিয়ে তার বান্ধবীর বাসায় চলে গেলে তার স্বামী যেমন খুব বেশী উদ্ধিগ্ন না হয়ে স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করে।

ও বসে থাকলো, একসময় দুপুরের খাবার খেল নিরুদ্বেগে। অলসভঙ্গিতে নিচের উপত্যকাটায় বসে থেকে আকাশে ধীরে ধীরে মেঘের মিনার গড়ে উঠতে, আবার ভেঙ্গে যেতে, আবার গড়তে দেখলো। সকালের নরম সূর্য ক্রমে গ্রীষ্মের দাবদাহে পরিণত হয়ে রস্মির কশাঘাতে মন্টে ভেরিটার উম্মুক্ত এলাকা, সুউচ্চ স-ম্ভ আর সরু জানালা আর ঘোরালো বিশাল দেয়াল ঝলসে দিতে লাগলো, ওখান থেকে কোন চলাফেরা বা আওয়াজ টের পাওয়া গেল না।

‘আমি সারা দিন অপেক্ষা করলাম, কিন’ ও বেরিয়ে এলো না। একসময় সূর্যের তাপ এতো অসহ্য হয়ে উঠলো আর চোখ ধাঁধিয়ে গেলো যে, আমি ওখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। আমি পিছিয়ে এসে গিরিখাতটার ভিতরে এসে আশ্রয় নিলাম। উপরের বেরিয়ে থাকা একটা বিশাল প্রস-র খন্ডের জন্য নিচের অংশটা সুন্দর ছায়াঘেরা আর ঠান্ডা, ওখানে শুয়ে শুয়ে আমি স-ম্ভ আর জানালাগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম।

ছেলেবেলায় তুমি আর আমি পাহাড়ের শব্দহীন পরিবেশের সাথে পরিচিত ছিলাম। কিন’ মন্টে ভেরিটার ঐ জোড়া শিখরের চারধারের এই এলাকাটার নৈঃশব্দের সাথে কোনটার তুলনা হয় না। সময় ধীরে ধীরে বয়ে যেতে থাকলো, আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। ধীরে ধীরে আবহাওয়া শীতল হতে থাকলো আর সেই সাথে আমার উৎকন্ঠা বাড়তে থাকলো।

সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ার সাথে সাথে সময়ও যেন দ্রুত পার হতে থাকলো সূর্যের দিক পরিবর্তনের সাথে সাথে পাথরের রঙও বদলে যেতে থাকলো, চোখ ঝলসানো আলোর প্রকোপ কমতে আরম্ভ করলো। আমার উৎকন্ঠা আতঙ্কে পরিণত হলো। আমি ঐ গলিপথ থেকে বের হয়ে দেয়ালের কাছে গিয়ে অ্যানার নাম ধরে ডাকতে থাকলাম। আমার হাত দিয়ে পাথরের দেয়ালে অনুভব করতে চাইলাম, ওখানে কোন সূক্ষ্ম ফাটল আছে কিনা, কিন’ কোন ফাটল বা দরজা এমন কিছুই পেলাম না।

আমার গলার স্বর প্রতিধ্বনিত হয়ে আমারই কানে বার বার ফিরে এলো। আমি উপরের দিকে তাকিয়ে জনমানবশূন্য ফাঁকা জানালার মতো গহ্বরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার মনে আবার অন্য সন্দেহ উঁকি মারলো। গ্রামের ঐ বৃদ্ধের কথা মিথ্যে, এখানে দেয়ালের ওপাশে কেউ থাকে না, ওটা বসবাসের অযোগ্য। কেউ হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকতে পারে না। বৃদ্ধ যা বলেছে সব কিছুই মিথ্যা, বানোয়াট। এই ইমারত কেউ হয়তো বহুকাল আগে বানিয়ে থাকবে, কিন’ এখন পরিত্যাক্ত। আর অ্যানা কখনোই এখানে আসেনি। ঠিক সেখানটায় গ্রামের যুবকটা আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিল সেই পাহাড়ের মোড়টায় সংকীর্ণ পাথুরে খাড়া পথটুকু পার হতে গিয়ে অ্যানা নিচের পড়ে গিয়েছে, ঠিক যেখান থেকে খাড়া দেয়াল উঠে গিয়েছে তার অতল ফাটলের গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছে ও। আর ঠিক এমনই অবস’া হয়েছিল সেই সব মেয়েদের যারা এই পথ দিয়ে গিয়েছে, ঐ বৃদ্ধের মেয়ের মতো, উপত্যকার অন্যান্য মেয়ের মতো ওদের মধ্যে কেউই এই সংকীর্ণ পথটুকু পার হয়ে এই দেয়ালের ধার পর্যন- এসে পৌঁছাতে পারেনি।

ভিক্টরের অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনতে শুনতে মনে হলো, এই উৎকন্ঠার চাপ সম্ভবত কিছুটা কম হতো যদি ভিক্টরের কন্ঠের পূর্বের যন্ত্রণা আর ভাবাবেগ আবার দেখা দিতো। কিন’ লন্ডনের এই শান- নার্সিং হোমের আধা অন্ধকার ফাঁকা অবচেতন ঘরের আগুনের ধারে ভিক্টর শান- হয়ে বসে আছে, টেবিলের উপরে ওযুধের শিশি-বোতল, নিচের রাস-া থেকে ভেসে এসেছে গাড়ির শব্দ, এমন অবস’ায় ভিক্টরের বৈচিত্রশূন্য, একঘেয়ে, ঘড়ির টিক্‌ টিক্‌ শব্দের মতো, একটানা অসহনীয় হয়ে উঠছে। এর চেয়ে ভালো হতো যদি হঠাৎ ও ঘুরে চিৎকার করে উঠতো, অস্বাভাবিক আচরণ করতো।

ভিক্টর বলে গেল, ‘তবু অ্যানাকে দেখার জন্য আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। ঐ দেয়ালের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে অ্যানার অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না, তখন ধীরে ধীরে আমার চারপাশে সাদা মেঘ জমাট বাঁধতে আরম্ভ করলো আর ক্রমে সেগুলো কালো হতে থাকলো। সন্ধ্যা নেমে আসার সবকটা চিহ্ন পরিবেশে ফুটে উঠতে থাকলো। হঠাৎ একসময়ে পাহাড়ের বিশাল ঢালটা, চূড়ো থেকে নিচের উপত্যকা পর্যন-, সবটুকু দেয়ালটা, জানালার ফাটলগুলো, সোনালী বর্ণ ধারণ করলো। তারপর, একমুহূর্ত পর, সূর্য হঠাৎ অস- গেল। গোধুলীর কোন চিহ্ন আর দেখা গেল না। হঠাৎ করে চারদিকের আবহাওয়া শীতল হয়ে গিয়ে রাত নেমে এলো।’

ভিক্টর বললো, ‘ও সারাটা রাত ঐ পাহাড়ের দেয়ালের ধারে বসে থাকলো, ভোর হওয়া পর্যন-। শরীর গরম রাখার জন্য সারা রাত হাঁটাচলা, নড়াচড়া করতে থাকলো। ভোরের মুখে প্রকৃতি এত শীতল হয়ে গেল যে, ঠান্ডা আর ক্ষুধায় সারা শরীর নিঃসাড়, অবচেতন হয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবার উপক্রম হলো ওর। সকালে সাথে করে কেবল দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছিল তা’তো সেই দুপুরেরই শেষ হয়ে গিয়েছিল। ও বুঝতে পারলো আর একদিন এখানে অপেক্ষা করা পাগলামী হবে। এখন গ্রামে ফিরে যাওয়া, খাবার খাওয়া, পানীয় কিছু মুখে দেয়া আর সম্ভব হলে গ্রামের কিছু লোক নিয়ে আবার খুজঁতে বের হওয়া উচিত হবে ওর। অবশেষে অনিচ্ছাসত্ত্বেও, যখন সূর্য উঠলো ও ঐ পাথুরে চত্তর ছেড়ে নীচে নামার প্রস’তি নিলো। চারদিক তখনও নিস-ব্ধ। ও এতক্ষণে নিশ্চিত হলো পাহাড়ের দেয়ালের ওধারে কোন জীবনের চিহ্ন নেই।

ভিক্টর আবার পাহাড়ের সেই ভাঁজ করা কনুইয়ের মতো জায়গাটা ঘুরে নিচের পাথুরে পথটা ধরে, ভোরের কুয়াশা ভরা ভারি বাতাসে ভেদ করে নিচের গ্রামে ফিরে এলো।

ভিক্টর বললো, গ্রামের সবাই ওর আসার প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। বৃদ্ধটি ওর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল, ওর চারদিকে ওর প্রতিবেশীরা অধিকাংশই পুরষ আর শিশুরা জমা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

ভিক্টর প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো, ‘আমার স্ত্রী কি ফিরেছে?

উপরের শৃঙ্গ থেকে নিচে নামতে নামতে ভিক্টরের মনে হয়েছিল, অ্যানা হয়তো ঐ দুর্গম পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরে যায়নি, সে হয়তো অন্য পথ ধরে উপরে গিয়েছিল। হয়তো এতক্ষণে অন্য কোন পথ বেয়ে গ্রামে ফিরে এসেছে। কিন’ গ্রামবাসীদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভিক্টরের সব আশা এক ফুঁয়ে উবে গেল।

বৃদ্ধটি বললো, ‘ও তো ফিরে আসেনি! ও ফিরে আসবে না। আমরা তো তোমাকে বলেছি ও ঐ জায়গা থেকে ফিরবে না। ও ঐ মন্টে ভেরিটার অধিবাসীদের কাছেই চলে গিয়েছে।

ভিক্টর কোন রকমে ওদেরকে খাবার আর পানি দিতে বললো। এ নিয়ে কোন আলাপ করার আগে শক্তি সঞ্চয়ের প্রয়োজন। ওরা ওকে খাবার দিলো। ওরা ওর চারদিকে ঘিরে সমবেদনার সাথে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। ভিক্টর বললো, অ্যানার স্লিপিং ব্যাগ, কাপড়, পানির বোতল, ছুরি আর সাথে করে নিয়ে আসা ওর অল্প কিছু ব্যবহারের জিনিসের দিকে চোখ পড়তে মন ব্যাথায় কুঁকড়ে গেল, ও কোন কিছুই সাথে নিয়ে যায়নি।

ওর খাওয়া হয়ে যাবার পর পর্যন- ওরা অপেক্ষা করলো, কখন ও নিজে থেকে কথা বলে তার জন্য। খাবার পর ও বৃদ্ধকে সব কথা খুলে বললো। কিভাবে ও সারা দিন আর সারারাত ওখানে অ্যানার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করেছে।

মন্টে ভেরিটার ঐ বিশাল ইমারত আর জানালার কথা, ওখানকার জনশূন্যতা আর নৈশব্দের কথা সব খুলে বললো। বৃদ্ধটি মাঝে মাঝে ওর কথাগুলো নিজের ভাষায় গ্রামের উপসি’ত লোকগুলোকে বলে গেল।

ভিক্টরের কথা শেষ হতে বৃদ্ধ মুখ খুললো, ‘আমি যা বলেছিলাম তার সবকিছুই যে সত্যি, তা বুঝতে পেরেছো তো? তোমার স্ত্রী ওখানেই আছে। ও ওদের সাথেই আছে।

ভিক্টরের সমস- ধৈর্য্যের বাধঁ ভেঙে গেল, ও চিৎকার করে উঠলো, ‘কিভাবে ও ওখানে থাকবে? ওখানকার সমস- এলাকায় কোন জনপ্রাণী নেই। ওখানটা জনমানবশূন্য, খালি, মৃত, শত শত বছর ধরে কিছু নেই ওখানে।’

বৃদ্ধটি ঝুঁকে ভিক্টরের কাঁধের উপর হাত রাখলো, ‘না ওটা মৃত নয়। জনমানবশূন্যও নয়। এমন কথা আগেও অনেকে বলেছে। ওরা উপরে গিয়েছিল, অপেক্ষা করেছিল, তুমি যেমন অপেক্ষা করলে। পঁচিঁশ বছর আগে আমিও তোমার মতো অপেক্ষা করেছিলাম। এই যে এই লোকটা, আমার প্রতিবেশী, তিনমাস অপেক্ষা করেছিল, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, অনেক বছর আগে, যখন ওর বৌটা চলে গিয়েছিল। সে মেয়েও ফিরে আসেনি। মন্টে ভেরিটার ডাক যার কানে লাগে সে কখনোই ফিরে আসে না।

ভিক্টর ওদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করলো, অ্যানা নিচে পড়ে গেছে। ও নিচে পড়ে গিয়ে মরে গিয়েছে। ও ওদের অনুরোধ করলো, যাতে ওরা ওকে সাহায্য করে, পাহাড়ের নিচে গর্তে খুঁজে দেখার জন্য, হয়তো ওর মৃতদেহ পাওয়া যাবে।

বৃদ্ধ অতি সহানুভূতির সাথে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ালো, ‘আগে আমরাও খুঁজে ছিলাম, অনেকেই, যারা পাহাড় ভাল করে চেনে অত্যন- নিপুণতার সাথে ঐ খাড়া শিখরে উঠেছিল, পাহাড়ের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা খুঁজে দেখেছে। এমন কি কেউ কেউ দক্ষিণের ঢাল বেয়ে নেমে ওধারের বিশাল হিমবাহের ধার পর্যন- গিয়ে খুঁজে এসেছে। ওর ওধারে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। ওখানে কোন মৃতদেহ বা হাড়ের চিহ্নমাত্র নেই। আমাদের মেয়েরা পাহাড় থেকে পড়ে যাবার নয়। পড়ে যাবার মতো নাজুক নির্বোধও নয়। ওরা নিচে কোথাও পড়ে যায়নি। ওরা ঐ মন্টে ভেরিটারতেই আছে। ঐ সাসেরডোটেসেই আছে।’

ভিক্টর বুঝতে পারলো ওদেরকে কোন যুক্তি দিয়েই বোঝানো যাবে না। তবে কোন সমাধান হবে না। যা করার ওকে নিজেকেই করতে হবে, ও নিচের উপত্যকার অধিবাসীদের কাছে যাবে, ওরা যদি কোন সাহায্য না করে, অন্য কোন অঞ্চলে যাবে, যারা ওর যুক্তি বুঝবে, ওকে সাহায্য করবে, কোন সাহায্যকারী হয়তো ওর সাথে আসতে রাজী হবে।

ও বৃদ্ধকে বললো, ‘আমার স্ত্রীর দেহ ঐ পাহাড়ের কোথাও পড়ে আছে। আমাকে সেটা খুঁজে বের করতেই হবে। তোমরা যদি আমাকে সাহায্য না করো, আমি অন্য কারো সাহায্য নেবো।’

বৃদ্ধটি পিছন দিকে মুখ ঘুরিয়ে কারও নাম ধরে ডাকলো। জটলার মধ্যে থেকে একটা নয় বছরের ছোট মেয়ে এগিয়ে এলো। বৃদ্ধ ওর মাথায় হাত রাখলো।

‘এই মেয়ে সাসেরডোটেসের সাথে কথা বলেছে। আগেও শিশুদের সাথে ওদের দেখা হয়েছে। কেবল শিশুদের সাথে, তাও কদাচিৎ ওদের দেখা হয়। এ তোমাকে ওর অভিজ্ঞতার কথা বলবে।’

Leave a Reply