টাকা বাংলাদেশের কারেন্সী মুদ্রা

টাকা বাংলাদেশের কারেন্সী মুদ্রার নাম। শব্দটি সংস্কৃত ‘টঙ্কা’ থেকে উদ্ভুত। প্রাচীন যুগে, এমন কি মধ্য যুগেও এই ‘টঙ্কা’ কথাটার প্রচলন ছিল। চার মাষা ওজনের রৌপ্যমুদ্রার নাম ছিল তঙ্কা। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে টাকা কথাটি ব্যপকভাবে ও বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। উত্তর ভারতে টাকা ছিল তাম্রমুদ্রাবিশেষ, যা দুই পয়সার সমান এবং দক্ষিণ ভারতে চার পয়সা বা এক আনার সমান। কেবল বাংলাতেই টাকা বলতে একটি রূপার রুপিকে বোঝাতো। তুর্কি আফগান শাসকেরা রুপি কথাটি প্রবর্তন করে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসকেরা রুপিকে প্রধান্য দিলেও বাংলার জনগণ সকল সময়ই মুদ্রাকে টাকা বলে এসেছে। ইবনে বতুতা লক্ষ করেছেন, বাংলার মানুষ দিনারকে সোনার তঙ্কা আর রূপার মুদ্রাকে রুপার তঙ্কা বলতো। মুদ্রা যে ধাতুরই হোক না কেন বাংলার মানুষ তাকে সবসময়েই টাকা বলে এসেছে। এমনকি পাকিস্তান আমলে মুদ্রার নাম রুপি হলেও বাংলায় তা টাকা নামে পরিচিত ছিল। বাঙালি জাতি দুটি অত্যন্ত- গুরুত্বপূণ্য বিষয় তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের থেকে গ্রহণ করেছে। এর একটি হলো রাষ্ট্রের নাম: ‘বাংলাদেশ’ এবং অপরটি তার কারেন্সী মুদ্রার নাম ‘টাকা’। সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদের মুদ্রার প্রান-লিপিতে ‘তান্‌কাহ’ (সংস্কৃতে টঙ্কা) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে মুদ্রার নাম ও মূল্যমান হিসেবে। সম্ভবত ভারতের প্রথম ‘রূপি’ মুদ্রা চালু করেন শের শাহ শুরি (১৪৮৬-১৫৪৫)। সে সময়ে একটি রূপি মুদ্রার বিনিময়ে ৪০টি তাম্র মুদ্রা পাওয়া যেত। ঐতিহাসিকভাবে, রূপি কথাটি, সংস্কৃত রৌপ্য (রূপা) থেকে সংকলিত, (রূপা ধাতু হতে প্রস্তুত মুদ্রা)।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতে যে তিনটি প্রেসিডেন্সী (বেঙ্গল, বোম্বাই ও মাদ্রাজ) গঠন করে তার প্রতিটিতে ১৮৩৫ সালে পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করে। তিনটি প্রেসিডেন্সীতেই রুপি ও তার ভগ্নাংশ রুপির ১/১৬ তম খণ্ডাংশ পর্যন্ত মুদ্রা প্রচলন করে। তামার মুদ্রায় মূল্যমান বিভিন্নতর ছিল। বাংলায় ১ পাই, আধা, এক ও দুই পইসা ধাতব মুদ্রা চালু হয়। ১৮৪১ সালে রুপার ২ আনা যোগ করা হয়, এবং ১৮৫৩ সালে তামার ১/২ পাইস মুদ্রা চালু করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৮৬২ সাল পর্যন- মুদ্রা প্রচলন করে। তিনটি প্রেসিডেন্সীতেই স্বর্ণ মোহর চালু ছিল এবং বাংলায় মোহরের খণ্ডাংশ ১/১৬, ১/৮, ১/৪, ১/২ স্বর্ণ মোহর চালু ছিল।

১৮৬২ সাল ও তারপরের মুদ্রাগুলিকে রাজকীয় মুদ্রা হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এগুলিতে রাজা/রানীর মুখাবয়ব ও ‘ভারত’ কথাটি স্থান পায়। এগুলির মূল্যমান ছিল ১/১২ আনা, ১/২ পাইস, ১/৪ আনা এবং ১/২ আনা। এগুলির সবকটিই তামার। ২ আনা, ১/৪, ১/২ এবং ১ রুপি মুদ্রা রুপার এবং ৫ রুপি, ১০ রুপি এবং ১ মোহর সোনার তৈরি।

১৯০৬ সালে ভারতের সর্বনিম্ন তিনটি মূল্যমানের মুদ্রায় তামার পরিবর্তে ব্রোঞ্জ ব্যবহার আরম্ভ হয়। ১৯০৭ সালে তামা-নিকেল ধাতুতে তৈরি ১ আনার মুদ্রা চালু করা হয়। ১৯১৮ ও ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তামা-নিকেল-এর ২, ৪, এবং ৮ আনার মুদ্রা চালু করা হয়।

১৯৪০ সালের প্রথম দিকে মুদ্রার বেশ কিছু পরিবর্তন করা হয়। ১/৩ আনার মুদ্রা ব্রোঞ্জ ধাতুতে প্রস’ত করা হয়। ১ আনা ও ২ আনা মুদ্রা প্রস্তুতের জন্য তামা-নিকেল ধাতু ব্যবহার করা হয়। রূপার তৈরি মুদ্রাগুলির মান ৯১.৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮০ শতাংশ করা হয়। সর্বশেষ রাজকীয় মুদ্রা হলো ১৯৪৬ ও ১৯৪৭ সালে প্রচারিত তামা-নিকেলের ১/৪, ১/২ এবং ১ রুপি মূল্যের।

অবিভক্ত ভারতে প্রথম ১৮৬১ সালে কাগজি মুদ্রা চালু করা হয়। ব্যাংক অব বেঙ্গল কর্তৃক প্রচারিত কাগজি মুদ্রা মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত। ‘একক নকসা’য় একটি বসা অবস’ার নারী মুর্তি (বাণিজ্যের প্রতিরূপ) আছে। এর মূখ্য দিকে ব্যাংকের নাম এবং মুদ্রামান উর্দু, বাংলা ও নাগরী ভাষায় দেওয়া আছে। গৌন দিকে ব্যাংকের নাম আলঙ্করিক নকসায় লেখা আছে। ১৯ শতকের প্রথম দিকে ১০০ রুপি, ২৫০ রুপি, ৫০০ রুপি মূল্যের নোট চালু করা হয়। ১৮৬৭ সালে চালু করা আন্ডাপ্রিন্ট সিরিজে রানী ভিক্টোরিয়ার প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে। নোটগুলি ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০, ১০০০ এবং ১০০০০ মূল্যমানের ছিল। বাণিজ্য’ সিরিজের নোটগুলিতে কাল্পনিক নারী মুর্তি (বাণিজ্য মুর্তি) স্থান পেয়েছে। মূখ্য দিকে তিন ভাষায় ব্যাংকের নাম ও মুদ্রামান তিনটি ভাষায়, উর্দু, বাংলা ও নাগরী ভাষায় ছাপা এবং গৌন দিকে বিচিত্র অলঙ্করণ স্থান পায়। ‘ব্রিটানিয়া’ সিরিজ নোট ১৮০০ সালের শেষের দিকে ছাড়া হয়। এই নতুন নোটগুলিতে নকল ঠেকানোর বিভিন্ন ব্যবস্থা ছিল।

ব্রিটিশ ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া স্থাপন করা হয় ১ এপ্রিল ১৯৩৫, এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় স্থাপিত হয় কলকাতায়। রিজার্ভ ব্যাংক ১৯৩৮ সালে প্রথম ষষ্ঠ জর্জের প্রতিকৃতি সহ একটি ৫ রুপি নোট চালু করে। ফেব্রুয়ারী ১৯৩৮, ১০ রুপি, মার্চে ১,০০০ রুপি, এবং জুনে ১০,০০০ রুপি কাগজি মুদ্রা ছাড়া হয়। নোটগুলিতে প্রথম ব্যাংকের যে গভর্নরের স্বাক্ষর যুক্ত হয় তিনি ব্যাংকের দ্বিতীয় গভর্নর স্যার জেমস টেলর।

বিশ্বযুদ্ধকালীন জাপান জাল ভারতীয় কাগজি মুদ্রা প্রচার করার কারণে কাগজি মুদ্রার জলছাপ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। জলছাপে ষষ্ঠ জর্জের পার্শ্ব প্রতিকৃতি বদল করে পূর্ণ প্রতিকৃতি যোগ করা হয়। এই সাথে প্রথমবারের মতো নিরাপত্তা সুতাও যুক্ত করা হয়। ষষ্ঠ জর্জের প্রতিকৃতি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চালু থাকে।

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর বর্তমান বাংলাদেশ, প্রথমে ‘পূর্ববাংলা’ ও পরে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম ধারণ করে ও পাকিস্তান থেকে প্রচারিত কাগজি ও ধাতব মুদ্রা ব্যবহার করতে থাকে। পাকিস্তানের চব্বিশ বৎসরে প্রথম সিরিজে ১৯৪৭-৪৮ সালে ১, ২, ৫, ১০ ও ১০০ রুপির চারটি ব্রিটিশ ভারতীয় নোটে ইংরেজিতে ‘গভর্নমেন্ট অব পাকিস্তান ও উর্দুতে ‘হুকুমতে পাকিস্তান’ শব্দগুলি অতিরিক্ত ছেপে চালু করা হয়। দ্বিতীয় সিরিজে ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে ৫, ১০ ও ১০০ রুপির তিনটি নোট; তৃতীয় সিরিজে ১৯৪৮-৫১ সালে তিন ধরনের ১ রুপি নোট সহ ২, ৫, ১০ ও ১০০ রুপির নোট ছাড়া হয়। চতুর্থ সিরিজে মোহাম্মদ আলী জিন্নার প্রতিকৃতিসহ ১৯৫৭-১৯৭০ সালে ৫, ১০, ৫০, ১০০ ও ৫০০ রুপির পাঁচটি নোট ছাড়া হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ আদেশ বলে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ঢাকায় অবসি’ত স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের আঞ্চলিক কার্যালয়, অর্থাৎ ডেপুটি গভর্নরের কার্যালয়ের সকল সম্পদ, সম্পত্তি ও দায়-দায়িত্ব এবং তার কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে আত্মীভূত করে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক- বাংলাদেশ ব্যাংক স্থাপন করা হয়। সে সময়ে উক্ত ব্যাংকের সবচেয়ে বড় কর্মকর্তা আ. ন. হামিদুল্লাহকে গভর্নর পদে নিয়োগ দেয়া হয়।

দায়িত্ব গ্রহণের সাথে সাথে আ. ন. হামিদুল্লাহ তৎকালীন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানকে বাংলাদেশের কাগজি ও ধাতব মুদ্রা নকসা করার জন্য অনুরোধ জানালে তিনি রাষ্ট্রীয় ভিন্ন কাজে জড়িত থাকায় তার এক ছাত্র কে. জি. মোস্‌তাফাকে এ দায়িত্ব প্রদান করতে বলেন। কে. জি মোস্‌তফা অতি অল্প সময়ে ৫ টাকা ও ১০ টাকা মূল্যের দুটি করে চারটি নকসা অঙ্কন করে দেন। এই নকসা চারটিতে পল্লী বাংলার চিরায়ত দৃশ্য ও আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী দ্রব্য ও নকসার সমন্বয় সাধন করা হয়। কে. জি মোস্‌তাফা এই সাথে ১ পয়সা, ৫ পয়সা, ১০ পয়সা, ২৫ পয়সা ও ৫০ পয়সা মূল্যের ধাতব মুদ্রার নক্সাও অঙ্কন করে দেন। এ সকল মুদ্রায় লাঙ্গল, পান পাতা, ইলিশ মাছ ও কবুতরের ছবি অন-র্ভূক্ত করা হয়।

ইতিমধ্যে গভর্নর জরুরী ভিত্তিতে ভারতের নাসিকে অবসি’ত ইন্ডিয়ান সিক্যুরিটি প্রিন্টিং থেকে ১ টাকা, পাঁচ টাকা, ১০ টাকা এবং ১০০ টাকা নোট ছাপিয়ে জরুরী অবস্থা মিটানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। নাসিক থেকে কেবল জ্যামিতিক নক্সা ও শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সম্বলিত ১ টাকা, ৫ টাকা, ১০ টাকা ও ১০০ টাকার নোট স্বাধীনতার মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে ছাপিয়ে এনে ৪ মার্চ ১৯৭২ জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করা হয়। এই আপৎকালীন নোটগুলিতে জটিল জ্যামিতিক নকসা থাকলেও এতে কোন জল ছাপ বা নোট নিরাপত্তা সুতা অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি।

এক টাকা প্রথম নোটটি স্বাক্ষর করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব কে. এ. জামান। এবং প্রথম ব্যাংক নোটগুলি স্বাক্ষর করেন এ. এন. হামিদুল্লাহ।

পরবর্তীতে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ এবং ১৫ অক্টোবর ১৯৭৩ কে. জি মোস্‌তাফার নকসা করা ও ইংল্যান্ড থেকে উন্নত প্রযুক্তিতে ছাপিয়ে আনা নোটগুলি প্রচলিত করা হয়।

পরে পর্যায়ক্রমে ৫০০ টাকা মূল্যের নোট প্রথম ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৬, ২০ টাকা মূল্যের নোট ২০ আগস্ট ১৯৭৯, ৫০ টাকা মূল্যের নোট ১ মার্চ ১৮৭৬ এবং ১০০০ টাকা মূল্যের ব্যাংক নোট ১৭ জুলাই ২০০৯ তারিখে প্রচারিত হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ১, ২, ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০ এবং ১০০০ টাকা মূল্যের নোট প্রচারিত আছে।

অন্যদিকে ১ পয়সা, ৫ পয়সা, ১০ পয়সা, ২৫ পয়সা ও ৫০ পয়সার পাঁচ প্রকারের ধাতুর মুদ্রা চালু করা হয় ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩। পরবর্তীতে এক টাকার মুদ্রা ১৯৭৫ সালে ৫ টাকা মুদ্রা ১৯৯৩ সালে প্রচার করা হয়।

বাংলাদেশের ধাতুর মুদ্রার মৌলিক বৈশিষ্ট হলো মুদ্রা একদিকে রাষ্ট্রীয় প্রতীক আছে এবং এর ভাষা বাংলা। কেবল এক টাকা মূল্যের একটি মুদ্রার রঙ তামা বা হলুদ রঙের হলেও অন্য সকল মুদ্রা রূপার মতো সাদা। বর্তমানে ১৫ টি বৈশিষ্টমূলক নকসায় সাতটি মূল্যমানের মুদ্রা প্রচলিত আছে। এছাড়াও নানা উপলক্ষে বেশ কয়েকটি স্মারক মুদ্রাও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করেছে।

Leave a Reply