আমার সাথে সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের সরাসরি কোন যোগাযোগ ছিল না। আমি তার ছাত্র ছিলাম না, এমনকি কিশোর বয়সটা আমার পূর্ব পাকিস্তন বা পূর্ব বাংলাতেও কাটেনি। পিতার দূতাবাসে চাকুরী সূত্রে কলাকাতায় আমার সবটুকু স্কুল জীবন কেটেছে। কলকাতায় একজন বিশিষ্টট সাহিত্যিক, কাজী আবদুল ওদুদ সাহেবের বাসায় আমরা ভাড়া থাকতাম। তার পাঠকক্ষেই আমার সাহিত্যের হাতে খড়ি, তিপ্নপান্ন থেকে পঁয়ষট্টি সাল পর্যনত্ম। এখানে মাঝে মাঝে সাহিত্য আলোচনায় সেয়দ আলী আহসানের নাম কানে আসতো। একজন বিশিষ্ট কবি ও শিক্ষাবিদ হিসাবে তার সম্পর্কে অনেকে সমীহ করে কথা বলতেন।
পয়ষট্টি সাল থেকে একাত্তর পর্যনত্ম যশোরে উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পড়ার সময়ও মাঝে মাঝে তাঁর লেখা নিয়ে যশোর সাহিত্য বাসরে আলোচনা হয়েছে, খবরের কাগজে তার কিছু লেখা পড়ার সৌভাগ্যও হয়েছে। তার ছবিও বেশ কয়েকবার কাগজে দেখেছি। ঢাকার সাথে আমার কোন যোগাযোগ না থাকায় তাঁকে চাক্ষুস দেখিনি আমি। কিন্তু অজানেত্মই আমি তার একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম তার লেখা পড়ে এবং আশেপাশের লেখক ু সাহিত্যিকদের আলোচনা শুনে। একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলিতে ¯^vaxb বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে, ধর্ম, মূল্যবোদ, মনুষ্যত্ব, আত্মসচেতনতা প্রভৃতি বিষয়ের কথিকাগুলিতে যে উদ্দীপনাময় বিশ্লেষণ তিনি করতেন সেগুলি আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম।
বাড়িতে। দুপুরের কিছু পর একটা বড় গাড়ি এসে বাসার সামনে দাঁড়ালো। তার পরই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি দরজা খুলে দেখি একজন সুবেশিত ভদ্রলোক। আমাকে দরজা খুলতে দেখে বললেন, ‘এটা কার বাসা?
আমি আপার পরিচয় দিলাম।
তিনি বললেন, ভিসি সাহেব এসেছেন আপনাদের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়করতে। ভিসি সাহেব এখানেই বসতে চান। আপনি অন্য ফ্ল্যাটের প্রফেসরদের এখাইে আসতে বলুন।
জ্ঞ হয়ে যেতে হয়।’
একটি কবিতার নৃত্যরূপ দেয়া হয়। আমি কলেজের ঐ বছর সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় দুটি বিষয়ে প্রথম ও দুটিতে দ্বিতীয় স’ান দখল করে চাম্পিয়ান হয়ে যাই।
ভেরিটা’ উপন্যাসের আমার অনুবাদ ‘স্বর্গ মরীচিকা’ বইটি তাঁর হাতে তুলে দিলাম।
আমি বললাম, এই লেখিকার আর একটি উপন্যাস ‘দি বার্ডস্’-এর আমার অনুবাদ বাংলা একাডেমী ‘পাখি’ নামে প্রকাশ করেছেন। আর কোন বই এর আগে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়নি।
আমরা কথা শুনে একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘কলকাতা থেকে ‘রেবেকা’ ও আরও দু’একটা অনুবাদ প্রকাশ হয়েছে, তুমি সংগ্রহ করে পড়ে দেখো’।
আমি অবাক হয়ে গেলাম তাঁর স্মরণশক্তি আর বই পড়ার পরিধির কথা চিন-া করে। কেবল লেখিকার নাম দেখেই তিনি বলে দিলেন লেখিকার বইয়ের অনুবাদ ভারতে প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। তখনই ঠিক করেছিলাম ওঁর সম্পর্কে লিখবো। কিন’ সেটা তাঁর জীবদ্দশায় হয়ে ওঠেনি আমার ঢিলেমীর কারণে।
মোহমুক্ত, প্রভাবমুক্ত নয়।
কিছুদিন আগে আমাকে যখন সৈয়দ আলী আহসান সম্পর্কে একটি স্মারক গ্রন্থ সম্পাদনা ও প্রকাশের দায়িত্ব দেয়া হলো, তখন নিজেকে অনেক বড় মাপের মানুষ বলে মনে হতে লাগলো। কারণ সৈয়দ আলী আহসান সম্পর্কে যারা লিখবেন, তাঁর মূল্যায়ন যারা করবেন বা তাঁর সাথে দীর্ঘকাল কাটানোর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেবেন, তাঁরা সকলেই আমার ধরা-ছোঁয়ার অনেক উপরে। আমি কেবল তাঁদের কাছ থেকে লেখা সংকলিত কারে প্রকাশ করবো আর এই বিশাল মহীরম্নহের প্রতি আমার ক্ষুদ্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ পাবো। কিন্তু আমার মোহমুক্তি ঘটলো, যখন তিনশ’ জনকে চিঠি দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে মাত্র আট জনের কাছ থেকে লেখা পেলাম। আর তখনই টের পেলাম আমাদের মনের সঙ্কীর্ণতা কিভাবে আমাদের নিজেদেরকেই অতলস্পর্শী ধংশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের একজন ঘনিষ্ঠ ছাত্র, যিনি বর্তমানে একজন বিশিষ্ট অধ্যাপক, আমাকে তো মুখের উপরেই বলে ফেললেন, শিক্ষক হিসাবে তাঁকে আমি অত্যনত্ম শ্রদ্ধা করি, কিন্তু তাঁর সম্পর্কে আমি কিছু লিখবো না’। কী অকপট সত্যভাষণ। আমার মনে হলো, যখন এই অধ্যাপকটির মৃত্যু হবে, তাঁর ছাত্ররা কি ঠিক এমনই মনত্মব্য করবে তাঁর সম্পর্কে? এই স্বনামখ্যাত ছাত্রটি সৈয়দ আলী আহসান সম্পর্কে যে মনত্মব্য করলেন তাতে সৈয়দ আলী আহসানের কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হলো না। একটি লেখা লিখলে সৈয়দ আলী আহসান বেহেস্তে কোন বিশেষ সম্মান লাভ করবেন না, বরং না লিখে এই স্বনামখ্যাত অধ্যাপক (ছাত্রটি) তাঁর নিজের শিক্ষা, জ্ঞান আর চরিত্রকে অতিশয় ক্ষুদ্র করে ফেললেন। ঐ বিশিষ্ট অধ্যাপকের প্রতি আমার যেটুকু শ্রদ্ধাবোধ ছিল এবং যে শ্রদ্ধাবোধের কারণে তাকে আমি মাঝে মাঝে সহযোগিতা করতাম, তার বিন্দু মাত্রও আর আমার মনে অবশিষ্ট থাকলো না। মানুষ আর মনুষ্যত্ব্যের চেয়ে রাজনীতি আর মতাদর্শ কি এতোটাই বড় একটা বিষয়, যে একজন প্রয়াত শিক্ষককে আমরা এভাবে অপমান করবো? আসরে আমরা ইতিহাস থেকে পাঠ গ্রহণ করি না। আলস্নাহ আমাদের সকলের বোধদয় করম্নন। আমাদের কর্মের প্রকৃত পুরস্কার প্রদান করম্নন।