আমার বই পড়া ও লাইব্রেরী

১৯৫৩ সালে আমার যখন ছয় বছর বয়স, আব্বা পররাষ্ট্র দপ্তরের চাকরী নিয়ে কলকাতায় চলে গেলেন। মা ও আমাদেরকে রেখে গেলেন ঢাকায়। আমরা তখন থাকতাম আমলিগোলায়। আব্বার ইচ্ছা ছিল, ঢাকায় সংসার খরচ কম, এখানে পরিবারটা থাকলে আব্বা অনেক টাকা সাশ্রয় করতে পারবেন। কিন্তু মা চিনত্মা করলেন অন্য কথা। ঢাকায় থাকলে আমলিগোলার চারপাশের অনুন্নত পরিবেশের কারণে সনত্মানদের পড়াশুনা কিছুই হবে না। তাই মা জোর করে আমাদেরকে নিয়ে কলকাতায় চলে গেলেন।

মা আগে থেকে কলকাতায় যাওয়ার পরিকল্পনার কথা আব্বাকে জানাননি বলে আব্বা আমাদের থাকার কোন ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি, অথবা হয়তো ভেবেছিলেন, মা কিছুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছেন, তাই আমাদেরকে নিয়ে তার এক সহকর্মীর বাসায় গিয়ে উঠলেন। দুই এক দিনের মধ্যে তিনি মা’র আসল উদ্দেশ্য জানতে পেরে, অনন্যোপায় হয়ে পার্ক সার্কাস ও গড়িয়াহাটার মাঝামাঝি জাযগায় একটা তিন তলা বাড়ির একতলার তিনটি ঘরের ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিলেন আর আমরা সেখানে গিয়ে উঠলাম। এই বাড়িটার ঠিকানা ৮বি তারক দত্ত রোড।

তারক দত্ত রোডের মাধামাঝি সার্কাস রেঞ্জ রাসত্মাটা এসে যেখানে মিশেছে ঠিক উল্টো পাশের এক ছোট্ট গলির শেষ মাথায় এই তিন তলা বাড়িটা। এই বাড়িটার কয়েকটা বাড়ি পশ্চিমে গিয়ে উত্তর দিকে দুটি বাড়ি পরে পার্ক সার্কাস এলাকার কড়েয়া থানা। আর পূবে দশ বারটা বাড়ি পার হলে সৈয়দ আমির আলী এভিনিউ-এর ট্রাম রাসত্মা। বাড়িটার মালিক বিখ্যাত গবেষক ও সাহিত্যিক কাজী আবদুল ওদুদ। আমাদের বৈঠকখানার ঠিক উপরের দোতলার একটা ঘর ছিল কাজী আব্দুল ওদুদ সাহেবের স্টাডি আর তিন তলার তিনটি ঘর নিয়ে ওদের সংসার।

কাজী আব্দুল ওদুদের সংসারে তখন ছিলেন তাঁর স্ত্রী, সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রসত্ম, তার জগৎ-সংসার ছিল কেবল বিছানার চারপাশ। সেখানে শুয়েশুয়েই তিনি বাড়ির বাজার-ঘাট, রান্না, খাওয়ানো সব তদারক করতেন। তাদের সনত্মানদের মধ্যে বড় মেয়ে, জেবুন্নিসার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই, ¯^vgx তখন ঢাকা কলেজের অধ্যাপক। বহু পরে অবশ্য তাদের সাথে দেখা হয়েছিল। দ্বিতীয় সনত্মান ছেলে, ইঞ্জিনিয়ার, †ev¤^vB‡Z কর্মরত; আর সব থেকে ছোট ছেলে তখন মেডিকেল কলেজে পড়তো।

নানার কাজী নানা বড় ছেলেকে ডাকতেন বুদ্ধ বলে, গৌতম বুদ্ধের কথা মনে করে; আর ছোট ছেলের নাম বুদ্ধেরই অন্য এক নামের সাথে মিলিয়ে ছিল জিবু। তিনি আব্বার সামনে দুঃখ করে বলতেন, আমার দুই ছেলেই অশিক্ষিত। তাঁর দুঃখ ছিল ছেলেদুটির কোনটিই তার মতো জ্ঞানের চর্চ্চায় নিয়োজিত হয়নি, তার কথায় তাই বিদ্বান হয়নি। তারা শিক্ষিত হয়েছে, জীবন ধারণের জন্য ভাল অর্থ উপার্জন করছে, কিন্তু জ্ঞানের চর্চ্চা করে না কেউই।

আমার প্রথম গ্রন্থাগার

কাজী আব্দুল ওদুদ সাহেবকে আমরা নানা বলে ডাকতাম। অল্প দু’চারদিনের মধ্যেই, অপরিচিতের গণ্ডিটা অতিক্রম করতে যে সময়টুকু, তার পরেই ওদুদ সাহেবের স্টাডিতে যাওয়া আরম্ভ করলাম আমি। ওদুদ সাহেব আমাদের নানা হলেও, সম্পর্কটা অবশ্য নানা-নাতির মতো তরল ছিল না। কিন্তু তিনি যেমন একমনে পড়তেন, ভাবতেন ও লিখতেন, আমি শুধু পড়েই যেতাম। দর্শন না সাহিত্য, কবিতা না প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী না রাজনৈতিক প্রতিবেদন, কোরআন-হাদিস-ফিকাহ, না হিন্দু-বৌদ্ধ অথবা খ্রিষ্টান ধর্মের বিশ্লেষণ- কোন কিছুই বাদ বাছাই নেই। রবীন্দ্র রচনাবলী, শরৎ সাহিত্য, বঙ্কিম রচনাবলী তো ছিলই, আরও ছিল ভারতের বিভিন্ন সাহিত্যিকদের উপহার দেয়া বই ও পত্র-পত্রিকা। সবার উপরে ছিল কাজী আব্দুল ওদুদের নিজের লেখা বইগুলো, প্রবন্ধের বই- শাশ্বত বঙ্গ, বাংলার জাগরণ, মহাকবি গ্যেটে, এবং উপন্যাস নদীবক্ষে ও আজাদ। আমি তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি। বছরের মাঝামাঝি, আসেপাশে কোন বন্ধুও তৈরি হয় নি। তাই আমার গনত্মব্য শুধু দোতলার ঐ বইয়ের জগতে। এটাই আমার জীবনের প্রথম গ্রন্থাগার- ওপেন একসেস লাইব্রেরী।

ঘরটা খুব একটা ছোট ছিল না। কিন্তু দরজা দিয়ে ঢুকলেই সামনে দেখা যেত একটা বিশাল পালঙ্ক আর দরজাত্ম পাশে বিশাল কাঠের আলমারী- বইয়ে ঠাশা।

কাজী নানা বসতেন আলমারীটার সামনে একটা ইজি চেয়ারে। তার ডানদিনের দেয়াল ঘেঁশে রাখা তিনটি বেতেন বুনুনী দেয়া কাঠের সোফা। সোফাটার মাত্র একটিতে একজন বসতে পারতো আর বাকী সোফাগুলিতে ভরা থাকতো বইয়ে। ঘরের উত্তর দিকের দেয়ালে ছিল একটা বড় কাঠের ভারী বনেদী টেবিল, উপরে থরে থরে বই, সাজানো না গাদা করে রাখা।

ঘরে দরজা দিয়ে ঢুকে সোফাটাতে বসতে যাওয়ার জন্য ছিল সরম্ন এক চিলতে পথ।

আমরা ওখানে থাকতে থাকতেই কাজী নানা প্রকাশ করলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া বক্তৃতামালা শরৎচন্দ্র ও তার পর। এর পরে চৌষট্টি সালে তিনি লেখা শুরম্ন করেন হজরত মোহাম্মদ ও ইসলাম এবং কোরআন শরীফ অনুবাদ। এই দুটি বই লেখা ও প্রকাশের পিছনে অবশ্য আমার আব্বার গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

তিনি হজরত মোহাম্মদের জীবনী লেখার সময় আর কোরআনের প্রথম খণ্ড অনুবাদ করলেন তখন প্রতি সপ্তাহে দোতলার স্টাডি থেকে নেমে এসে তিনি আব্বাকে তার লেখাগুলি পড়ে শোনাতেন। আরবী ভাষায় আব্বার উলেস্নখযোগ্য দক্ষতা থাকার কারণে, কাজী আব্দুল ওদুদ সাহেব আব্বার কাছ থেকে তার লেখা সঠিক এবং ভাষা সহজ ও সুন্দর হচ্ছে কি না তা ঝালিয়ে নিতেন। একাজে তিনি আমার মা-র পরামর্শও নিতেন। তিনি যখন তার এ সব লেখা পড়তে আমাদের বাসায় আসতেন তখন অবধারিতভাবে আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে সে সব জ্ঞানগর্ভ লেখা মনযোগ দিয়ে শুনতাম।

কিভাবে যে বই পড়ার প্রতি আমার এমন আগ্রহ ও অভ্যাসটা তৈরী হলো বলতে পারবো না, তবে আমি গভীর আগ্রহে তৃষ্ণার্ত প্রাণীর মতো পড়তে লেগে গেলাম। কাজী নানা তার ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে পড়তেন, ভাবতেন আর লিখতেন। আমার এই পড়ার অভ্যাসে তিনি কখনই কোন বাধা দিতেন না, বরং আমার পড়ায় তাঁর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল।

আমার দ্বিতীয় গ্রন্থাগার

এর কিছুকাল পরই খোঁজ পেলাম পাড়ার এক লাইব্রেরীর। পাড়ার বিভিন্ন জনের অনুদানে গড়ে ওঠা এ লাইব্রেরীর অবস্থান ছিল একটি বাড়ির একতলায় একটা গ্যারেজের মতো ঘরে। পাড়ার ছেলে বলে আমাদের কোন চাঁদা দিতে হতো না। যদিও তখন চাঁদা ছিল মাসে এক টাকা, বছরে দশ টাকা। বাড়ির অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে লাইব্রেরীর সদস্য হতে হতো। কিন্তু অভিভাবকদের বলার মতো সাহস আমাদের ছিল না যে লাইব্রেরীর সদস্য হবো। ‘পড়ার বই বাদ দিয়ে গল্পের বই?’! হাতে গল্পের বই দেখলে বাসায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যেত। আমাদের অনেকেই বই পড়তো চুপি চুপি। আমার বাড়িতে অবশ্য এ বাবদে কোন আপত্তি ছিল না। আমার আনা বই, আপা আর মা তো পড়তেনই, আব্বাও মাঝে মাঝে পাতা উল্টাতেন। এ লাইব্রেরীতে আমাদের বই নেয়াতে কোন বিধিনিষেধ ছিল না। যে লোকটি বই দেয়া নেয়া করতেন তিনি কেন জানি না আমাদের ব্যাপারে বেশ নমনীয় ছিলেন। বই চাইলে নাম-ঠিকানা লিখে রেখে বই দিয়ে দিতেন। বইগুলো আমরা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেশুনে নিতে পারতাম না। গ্রন্থাগারিকের পছন্দ অনুযায়ী বই বেছে দিতেন। শর্ত ছিল দুই-তিন দিনের মধ্যেই ফেরত দিতে হবে। আমরা এ শর্ত অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতাম।

মনে আছে, এই সময় “দেড়শ খোকার কান্ড” বইটা প্রকাশ পেয়েছে। কিশোর কিশোরীদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে গেল। একদিন লাইব্রেরীতে গিয়ে শুনলাম বইটা এসেছে। আমরা দশ বারো জন সবাই বললাম, আমাকে আগে আমাকে আগে। লাইব্রেরীয়ান বললেন, টস করে দেয়া হবে।

ছোট ছোট কাগজে নিজের নিজের নাম লিখে লাইব্রেরীয়ান সাহেবের হাতে দিলাম একটা ছোট বাক্সে টুকরোগুলো ঢুকিয়ে কয়বার ঝাঁকিয়ে নিয়ে এক একটা করে টুকরো বের করতে লাগলেন তিনি। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলাম। আমার নাম উঠলো চার b¤^‡i, তার মানে আমাকে তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। দিন সময় কাটতেই চায় না। যে প্রথম বইটা পেয়েছে আমরা সবাই মিলে তার কাছে ধর্না দেই- তাড়াতাড়ি করে পড়ে শেষ কর। তাতেও সমস্যা। প্রথমে অনিল বই পেয়ে তিন দিনের মধ্যে পড়া শেষ করলেও বাসায় ওর বড় ভাই, ছোট বোন, মা সবাই মিলে পড়তে পড়তে দশ দিন পার হয়ে গেল। তারপর বইটা গেল অজিতের কাছে, সেও সময় নিলো আরও দশ দিন। তৃতীয় b¤^‡i তুষার অবশ্য একা- তাই প্রায় সাতাশ দিন পর বইটা পড়ার জন্য পেলাম আমি। অত্যনত্ম দ্রম্নত পড়তে পারতাম আমি, তাই দুই দিনেই বইটা শেষ। আর একদিন সময় নিলাম ভাল ভাল জায়গাগুলো আবার একবার পড়ার জন্য। তারপর অবশ্য আর ও বইটা পড়ার আগ্রহ হয়নি।

এ সময় উলেস্নযোগ্য যে বইটি লাইব্রেরী থেকে এনে পড়েছিলাম সেটা হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত বাংলায় অনুবাদ করা ভ্যালেনতিন কাতায়েভের ‘অমল ধবল পাল’। ১৯১৭ সালের জার বিরোধী আন্দোলনের সময় রম্নশ বিপ্লব সম্পর্কে দুটি দশ বছর বয়সী দুটি অসম শ্রেণীর শিশুর অভিজ্ঞতার অসাধারণ বর্ণনা। এ দুটি শিশুর একজন বড় সম্পদশালী অধ্যাপকের সনত্মান, অন্যটি পিতা-মাতাহীন একটি হতদরিদ্র জেলের নাতি। এই দুটি অসম শ্রেণীর শিশুর মধ্যেকার বন্ধুত্ব ও রম্নশ বিপস্নবের একটি খন্ডিত অংশে তাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন- একজন পলাতক বিপ্লবীকে নিরাপদে পালিয়ে যেতে সহায়তা করা- এই নিয়েই ঘটনা। আজও আমি যেন বইটির প্রতিটি পংক্তি চোখের সামনে দেখতে পাই। অতি সমপ্রতি আমি অবশ্য ইন্টারনেটে বইটির ইংরেজী সংস্করণটি পড়ার সুযোগ পেয়েছি। এ সময়ের আর একটা বইয়ের নাম ‘বুখারার বীর কাহিনী’। এটাও সোভিয়েত প্রকাশনা, যদিও লেখক বা অনুবাদকের নাম আর মনে করতে পারি না শত চেষ্ট করেও।

আব্বা আর মা দুজনেরই কিন্তু বাড়িতে পাঠ্যবই ছাড়াও অন্য বই আনায় তেমন বাধা দিতেন না। বরং বছরের বিভিন্ন সময়ে শিশুতোষ বই নিয়মিত কেনা হতো। দূর্গাপূজার সময়ে বের হওয়া শিশু সংকলন কেনা হতো নিয়ম করে। এই করে করে আমাদের বাড়িতে বইয়ের সংগ্রহও অনেক বড় হয়ে গেল।

অবসর সময়ে আমাদের একজন জোরে জোরে বইয়ের গল্প, কবিতা কিংবা প্রবন্ধগুলো পড়তাম আর অন্য সবাই শুনতাম। আমার পড়া প্রথম ভ্রমণ কাহিনী সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে-বিদেশে’- কতবার যে এ বইটা আমরা একা একা অথবা সবাই মিলে জোরে জোরে পড়েছি তার বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সময়ে পড়া আর একটি বইয়ের নাম অবধূতের ‘মরম্নতীর্থ হিংলাজ’ আর মনোজ বসুর ‘চীন দেখে এলাম’। মনোজ বসু তার এ বইটি আব্বাকে উপহার দিয়েছিলেন। অফিসে আব্বার তখন দায়িত্ব ছিল ভিসা বিভাগে। এ সুবাদে বহু গণ্যমান্য ভারতীয়দের সাথে তার ঘনিষ্টতা গড়ে উঠেছিল।

Leave a Reply