রংধনু এডভার্টাইজার্স – সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান ৬


শাহনাজ ওর ঘর থেকে চলে যাবার পরও অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে সুলতান। এখন যেন ওর চারপাশকে, নিজেকে, সবাইকে একটু অন্য রকম লাগছে। এতদিনকার বিরক্তি আর অসি’রতা যেন একটু একটু করে গলে যাচ্ছে। কি করবে বুঝে না পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ও। আলমারী থেকে কিছু টাকা বের করে পকেটে ঢুকিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে মিঠুর মাকে বলে দরজা খুলে বের হতে গিয়েই থমকালো।
উপরতলার সিঁড়ি বেয়ে একটা অল্প-বয়সী মেয়ে নেমে আসছে।
লম্বা, হালকা শরীর, গাঢ় নীল রঙের সালোয়ার-কামিজ আর হালকা নীল রঙের ওড়না। বছর বিশেক বয়স হবে হয়তো।
কিন’ সুন্দর, সুলতান ভাবলো।
ওর দিকে চোখ পড়তেই মেয়েটা একটু অপ্রতিভের মতো হাসার চেষ্টা করলো, তারপর সিঁড়ি পার হয়ে নিচে নেমে গেল।
একটু আশ্চর্য হলো সুলতান। ওর জানা মতে কোন ভাড়াটেরই এই বয়সের কোন মেয়ে, বোন বা বউ নেই। তা’ছাড়া উপরতলায় যে দু’জন আছেন, তাদের কারোরই তো স্ত্রী থাকে না এখানে। ভাবতে ভাবতে নিচে নেমে মেয়েটিকে আর দেখতে পেলো না ও। এদিক ওদিক খুঁজলো একটু। না পেয়ে ওর মিনি অস্টিনে উঠে রংধনু এডভার্র্টাইজার্স অফিসে গিয়ে হাজির হলো।

ওকে ঢুকতে দেখেই সেলস্‌ ডাইরেক্টর আবদুল্লাহ করিম এগিয়ে আসে, ‘আরে সুলতান, আফটার সচ্‌ আ লং টাইম। এভাবে আমাদের পথে বসাতে পারলে তুমি? তুমি তো জান তোমাকে আমরা সকলে কত পছন্দ করি। ইউ আর এর ক্রিমিনাল। যাও জলদি আলী হুসেনের সাথে দেখা করো গিয়ে। হি নিড্‌স ইউ এজ ব্যাড এজ এনিথিং।’
‘কি হয়েছে?’ সুলতান জিজ্ঞেস করে।
‘কি হয়েছে মানে? এভাবে ডুবে মারার কি কোন মানে থাকতে পারে? পুরো একটা বছর তোমার পাত্তা নেই। আসো না, ফোন ধরো না। জানোই তো তোমাকে দিয়ে কাজ করাতে আমার কতটা কমফোর্ট ফিল করি। আর আমাদের হাতে কেমন কাজ থাকে? পার্ল কেমিকেলস্‌-এর নয়টা প্রডাক্ট এখন আমাদের হাতে। এদিকে তুমি সেই যে ডুব মারলে, পারলে কি করে? – হাউ কুড ইউ? তোমার ওপর যেভাবে ভরসা করতে পারি আর সবাই তো তেমন না। আমাদের কারো সাথে কোন গোলমাল হয়েছে?’
‘না করিম ভাই , সে সব না, আসলে-’
সুলতানকে শেষ করতে না দিয়ে আবদুল্লাহ করিম আবার বলেন, ‘তোমাকে এসাইমেন্ট দিয়ে আমরা যে কতো রিলিফ বোধ করি সেটা যদি তুমি জানতে।’
‘আসলে, আই হ্যাড্‌ সাম হার্ড টাইমস।’
‘কার নেই বলো? সব্বাই আমরা হার্ড টাইমের শিকার। তা, তোমারটা কি প্রেমের ছ্যাঁকা, বিবাহ, না অসুস’তা?’ চোখ নাচিয়ে আবদুল্লাহ করিম জিজ্ঞেস করেন।
‘না, না, ওসব কিছু না। এনিওয়ে নাউ আই এম হেয়ার। দেখি, হুসেন ভাই কি ফরমান জারী করেন।’
হুসেন সাহেবের চেম্বারের দিকে এগোয় সুলতান। পিছন থেকে আবদুল্লাহ করিম মন্তব্য করে, ‘হুসেন ভাই তোমাকে ঠিক গিলে খাবে। হি উইল ইট ইউ আপ।’
আলী হুসেনের চেম্বারের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে একটু অপ্রস’ত হয়ে যায় সুলতান। আলী হুসেনের টেবিলের এপাশে দু’জন মহিলা বসে। একজন শাড়ি পরা, বয়স্কা, আর একজন টিশার্ট আর স্কার্ট পরা মেয়ে। ও একটু ইতঃস্তত করে বের হয়ে যেতে চায়। আলী হুসেন সুলতানকে ঢুকতে দেখে ইশারায় চেয়ারে বসতে বললেন।
সুলতান একটা চেয়ারে বসে পড়ে।
মহিলা কথা বলে যাচ্ছিলেন, সূরতানকে দেখে একটু থমকালেন, ওর দিকে তাকালেন একটু ভ্রু-কুঁচকে। তারপর মনে হয় চিনতে পেরে বলে উঠলেন, ‘আরে সুলতান, তুমি কেমন আছো? অনেক দিন পর তোমকে দেখলাম। আজকাল তোমার চেহারা তো দেখাই যায় না স্ক্রিনে।
সুলতান একটু হাসে, কিন’ কোন কথা বলে না।
ভদ্রমহিলা থামেন না, ‘আমার মেয়ের সাথে তো তোমার পরিচয় নেই। এ সুমী, একটু আধটু কাজ করে, ভাল সুযোগও তেমন পায় না। সুমী, এ সুলতান, খুব বড় আর্টিষ্ট। ওর সাথে অভিনয় করা ভাগ্যের কথা।’
সুলতান মেয়েটির দিকে তাকাতে গিয়ে থমকায়। মেয়েটির অস্বাভাবিক বড় উন্নত বক্ষ টিশার্ট ভেদ করে দর্শনীয় হয়ে আছে।
একটু ধাক্কা খায় সুলতান। কোন কথা না বলে একটু হাসির ভান করে ও।
ভদ্রমহিলা এবার আলী হুসেনের দিকে ফিরে কথা চালিয়ে যায়, ‘হুসেন ভাই, সুমীকে এবার একটা বড় ব্রেক দিতেই হবে। কোন কথা শুনবো না।’
আলী হুসেন মিটি মিটি হাসতে হাসতে বলেন, ‘দেখবো, দেখবো। হাতে বড় কিছু আসুক।’
এর মধ্যে টেলিফোনটা বেজে উঠতে আলী হুসেন, ‘এক্সকিউজ মি’ বলে টেলিফোনটা ধরেন।
‘জ্বি, আলী হুসেন বলছি। . . . . . . . ওহ, শিওর, উই আর অলওয়েজ এট ইওর সার্ভিস, ম্যাডাম। . . ওকে . দ্য বেষ্ট। হ্যাঁ, সেভাবেই হবে . . . ইউ উইল বি রেস্ট এশিওরড্‌। আপনাদের যেমন নতুন প্রডাক্ট, আমরাও নতুন ফেস দেবো। হ্যাঁ, কোরাল টয়লেট্রিজ-এর কাজ করতো যে ছেলেটা? ঠিক আছে, তাকেই না হয় . নতুন ফেস? আচ্ছা, আচ্ছা, দেখবো- শিওর – ডোন্ট ওরি – স্লামালেকুম।’
রিসিভার নামিয়ে রাখেন আলী হুসেন। তারপর মহিলার দিকে ফিরে আলী হুসেন বলেন, ‘ঠিক আছে, জাহানারা ম্যাডাম। আজ তবে আসুন, আমি দেখবো কি করা যায়।’
মহিলা ব্যাগ থেকে একটা খাম বরে করে আলী হুসেন সাহেবে দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘এখানে কয়েকটা স্ন্যাপ আছে ওর। রেইনবো লাইট থেকে একটা ফটো সেশন করিয়েছি। আপনার লাগতে পারে।’
আলী হুসেন খাম থেকে একটা ছবি বের করে এক নজর দেখেই ছবিটা আবার খামে ঢুকিয়ে রেখে বলেন, ‘ঠিক আছে। বললাম তো আমি, দেখবো। আজ তবে আসুন।’
সুলতানের মনে হলো, আলী হুসেন যেন ওদের দুজনকে তাড়াতে পারলে বাঁচেন।
মহিলা আর তার মেয়ে বের হয়ে যেতে আলী হুসেন যেন হাঁফ ছেগে বাঁচলেন এমন ভঙ্গি করে নিঃশ্বাস ফেললেন বেশ শব্দ করে। তারপর সুলতানের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, যেন কোন অপরিচিত লোকের দিকে তাকিয়ে আছেন। তারপর আবার ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
‘শাস্তি একটা দিতাম মনের মতো করে, কিন’ এবারের মতো মাফ। কারণ উই আর ইন গ্রেট ট্রাব্‌ল্‌।’
‘কি ব্যাপার, হুসেন ভাই? মনে হলো অফিসে আগুন লেগেছে?’
‘আগুন? হুঁ, যদি জানতে। পার্লের নয়টা প্রডাক্ট নিয়ে হিমসিম খাচ্ছিলাম, এখনই লোকস্বাস’্য ওদের ছ’টা প্রডাক্টের জন্য অর্ডার দিলো। বোঝ অবস’াটা।’
‘কিন’ আপনার রেগুলার স্টাফ কোথায়?’
‘একজনের অসুখ . . নিজের বাচ্চা হবে, আর একজনের সুখ . . বৌয়ের বাচ্চা হয়েছে, একজন পিতৃশোকে মূহ্যমান, অন্যজন হানিমুন করতে, কক্সবাজার, না তামাবিল, আল্লাহ্‌ই মালুম, কোথায়। আমি কারও উপরে মুখ খিস্তি করতে পারি না বলে চিন্তায় আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে গিয়েছে।’
‘আপনার চুল?’ আলী হুসেনের টাক মাথার দিকে তাকিয়ে সুলতান হাসে।
‘ইয়ার্কী করো না, আমার ষাট বছরে টাক হয়েছে, তোমার পঁচিশেই পড়তো, যদি আমার মতো অবস’া হতো তোমার।’
‘টাক হয়েছে, টাকাও হয়েছে। আর এখন তো আপনার আগুন নেভানোর জন্যে আমি হাজির হয়ে গেছি।’
‘তুমি আমার সাথে থাকতে চাও?’
‘হুসেন ভাই, আপনি আমাকে জানেন। আমি কি অন্য কোথাও যেতে পারি? গেছি কখনও? সেটা কি সম্ভব? আপনাকে আমার সত্যিকারের বড় ভাই মনে হয়। আমি নিজেকে সবসময় রংধনুর একজন ওয়ার্কিং পার্টনার মনে করি – জানি না আপনি কি মনে করেন। আসলে আমি মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত ছিলাম বেশ কিছু দিন, সেজন্য এই দীর্ঘ দিন আপনার সাথে দেখা করিনি। বাট আই ফেল্ট ফর ইউ। আর সেজন্যই আজ এখানে।’
‘তুমি আমার কাছে ফিরে এসেছো, দ্যাটস্‌ এনাফ। তোমাকে আমিও নিজের ছোটভাইয়ের চেয়েও আপন মনে করি। শোন তুমি স্ক্রিপ্ট তৈরী করবে, আর্ট ওয়ার্কে সাহায্য করবে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবে আর-’

Leave a Reply