৪
আদর যেটুকু পাওয়ার সেটুকু কেবল পেয়েছে ওর মামার কাছ থেকে। মামা ওকে খুবই আদর করতেন। নিজের ছেলেকেও বুঝি অতোটা করতেন না। নানী মাঝে মাঝে ধমক দিতে গেলে উল্টে মামাই নানীকে দু’কথা শুনিয়ে দিতেন। ও মায়ের কাছে গেলেই মামা যেন দু’হাত দিয়ে আগলে রাখতেন। যা কিছু ভালো কথা, ভালো ব্যবহার, যা কিছু সদাচরণ, সবকিছু ওর মামাই ওকে শিখিয়ে ছিলেন।
মা যে ঠিক কিভাবে মারা গেলেন, তা সুলতানের কাছে খুব স্পষ্ট না। মামার টেলিফোন পেয়ে দেরী না করে ছুটে গিয়েছিল। কিন’ মা’র সাথে কোন কথা বলতে পারেনি। যে তিন ঘন্টা বেঁেচছিলেন ও যাবার পর, কেবল ওর হাত নিজের বুকের উপরে চেপে ধরে রেখেছিলেন। মৃত্যুর সময়ও ছাড়েননি। তাঁর দুচোখ দিয়ে কেবল অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল অবিরল ধারায়। কথা বলার চেষ্টায় বার বার ঠোঁট কেঁপে উঠেছিল, কিন’ কোন শব্দ আর উচ্চারণ করতে পারেননি তিনি। তাঁর সে যন্ত্রণা কি কেবল রোগের, না কি অনুশোচনার জানতে পারেনি সুলতান।
এই সব বিষয় নিয়ে পরে মুখ খোলেননি নানীও। মামার কাছ থেকেও কোন কথা বের করতে পারেনি সুলতান। মাকে কবরে নামিয়ে দিয়ে আর যায়নি সুলতান ওখানে। সেও আজ তিন বছর পার হয়ে গিয়েছে।
কিসের আকর্ষণে যাবে ও? ও তো কারও কাছ থেকে স্নেহ পায়নি, সুখী নীড়ের নিরাপত্তা পায়নি? শুধু নিজেদের সম্মান আর আদর্শের লড়াই লড়ে গেল সারা জীবন ধরে, তবু ওর সান্তনা থাকতো, যদি এদের মধ্যে কেউ একজন জিততে পারতো। কেউই তো জিততে পারেনি এই নীরব যুদ্ধে।
বাবা কিম্বা মা কারও প্রতি এতটুকু আকর্ষণ বোধ করে না সুলতান। মাকে ও ভালবাসতো হয়তো, কিন’ সে ভালবাসায় কিছুটা জান্তব আবেগ, মমতা আর করুণা মেশানো। বাবার প্রতি ভক্তি আছে, কিন’ ভালোবাসা নেই, সম্মানবোধ আছে, কিন’ তার সাথে মিশে আছে কিছুটা বিদ্বেষ। কিছুটা ঘৃণাবোধও যে নেই, তা হলফ করে বলতে পারবে না সুলতান।
মা বাবাকে ভালোবাসেননি, ভালবাসলে বাবাকে ফেরাতে চেষ্টা করতেন। তাতে ফল কি হতো, জানে না সুলতান। হয়তো হতো, হয়তো না। বাবাও মাকে ভাল বাসেননি, বাসলে মাকে তিনি নিজের পথের অনুসারী করে তুলতে চেষ্টা করতেন কিম্বা নিজে বদলে যেতেন মায়ের মতো করে। মায়ের পথ যে খারাপ, তা বিশ্বাস করে না সুলতান, আবার বাবার পথ যে খারাপ, তাই বা কি করে জোর গলায় বলবে ও? আর এই প্রেমহীন, ভালবাসাহীন সংসারে জন্মগ্রহণ করে ও নিজেই কেমন অনুুভূতিহীন হয়ে পড়েছে। কোন কিছুই ওকে টানে না। ওর মনের তন্ত্রীতে নাড়া পড়ে না কোন কিছুরই।
মিঠুর মার প্রতি ওর একটা আর্কষণবোধ আছে, কিন’ সে আকর্ষণ কেবল একটা অব্যক্ত, গৃহপালিত, আশ্রিত, অসহায় পশুর প্রতি মায়ার মতো . . কেবলই করুণা, সরল নির্ভেজাল করুণা। সুলতান ভালো করেই জানে, ও মিঠুর মাকে যদি ছাড়িয়ে দেয় বা ও নিজে থেকেই চলে যায়, তাহলে ও আর কোথাও কাজ করবে না, করতে পারবে না- না খেয়ে থাকলেও। অবশ্য এ কয় বছরে মিঠুর মা-র নামে যে টাকা ব্যাংকে জমা করে দিয়েছে সুলতান, তাতে ওর মতো দুই-তিনজনের বাকী জীবন ভালভাবেই চলে যাওয়ার কথা। কিন’ কিসের টানে ও পড়ে আছে সুলতানের কাছে? সুলতানের ইকনমিক্স পড়া যুক্তিবাদী মাথায় ঢোকে না।
দরজায় টোকা দেওয়ার আওয়াজে মুখ তুলে তাকায় সুলতান। দরজায় বাবার অনেক কালের বান্ধবী দাঁড়িয়ে। বাবাকে শাহনাজ বলে ডাকতে শুনেছিল।
‘আসবো সুলতান?’
‘আসুন।’ সুলতান উঠে দাঁড়ায়।
ওকে দেখলে মিঠুর মায়ের চেয়ে বছর দশেকের বড়ো বলে মনে হয় সুলতানের। হঠাৎ করে ওর মনে হলো কস্মেটিক্স্ আর দামী শাড়িতে মিঠুর মাকে এঁর মতো সুন্দরী লাগবে কি না।
‘বসুন।’
শাহনাজ বসেন।
খাটের যেখানে এতক্ষণ বসে ছিল সেখানেই বসে পড়ে সুলতান। বাবার মতোই শাহনাজ সুলতানের ঘরের চারদিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন।
‘বাইরে কোথাও যাবে নাকি এখন?’ সুলতানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন শাহনাজ।
‘নাহ্, তেমন কোন বিশেষ কাজ নেই হাতে। আপনার কোন কাজ আছে?’
‘আমার আবার কি কাজ?’
শাহনাজ হাসলেন, একটু থেমে বলেন, ‘রংধনু এডর্ভাটাইজার্স্-এর সাথে কাজ করতে না তুমি, ছেড়ে দিলে কেন?’
‘আপনি রংধনুর কথা কিভাবে জানলেন?’
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে সুলতান। শাহনাজ হাসেন।
‘তোমার সব কথা আমি জানি। আলী হুসেন আমাদের দুজনের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু। তা’ছাড়া তোমার বিজ্ঞাপন টিভিতে দেখে ওকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছি। তা’ ওটা ছাড়লে কেন?’
‘ভালো লাগলো না।’
‘ওরা তোমাকে তো ছাড়তে চাচ্ছে না। আবার নিতে চাচ্ছে। আলী হোসেন কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন, আমাদের বাসায় এসেছিলেন, আমাকে অনেক দুঃখ করে বললেন, তোমার মতো ব্রাইট ছেলে এ লাইনে এলে কতো ভালো হতো। ওর সাথে অবশ্যই যোগাযোগ রাখবে, কেমন?’
‘কি হবে? এই তো বেশ চলে যাচ্ছে। আসলে আমার প্রয়োজনটা খুব কম, আগ্রহটাও, চাহিদাও।’
‘এখন কম আছে, কিন’ পরে বিয়ে করতে হবে না? মেয়ের বাপেরা অকর্মা ছেলেদের খুব একটা পছন্দ করেন না।’
মুচকি হাসলেন শাহনাজ। ম্লান হাসলো সুলতান, কিন’ কোন কথা বলে না।
একটু চুপ করে থেকে শাহনাজ আবার মুখ খোলেন, ‘বাবার উপর তোমার খুব রাগ, না?’
‘আমি রাগ করার কে? কি অধিকারে রাগ করবো?’ চাপতে গিয়েও গলায় অভিমানে ঝরে পড়ে সুলতানের।
‘আর যা কিছুই হোক না কেন, তুমি তার ছেলে। রাগ করে না থাকলে তার সাথে সহজ ব্যবহার করো না কেন? আমার তো দেখেশুনে মনে হয়, তুমি আর তোমার বাবা দুজনেই একটা ঠান্ডা যুদ্ধে জড়িয়ে রয়েছো।’
একটু উষ্ণ হয়ে ওঠে সুলতান নিজের অজান্তে। ‘এসব কিছুর জন্যে তিনি নিজেই দায়ী। তার আচার-ব্যবহার . . . . ’
শাহনাজকে মিটিমিটি হাসতে দেখে সুলতান থেমে যায়। শাহনাজ হাসেন, হাসতে পারেন, কারণ এ ছেলে তাঁকে আর ওর বাবা সম্পর্কে যা ভেবে রেখেছে, তিনি কিংবা ওর বাবা তা নন, জেনেই। তিনি এই মুহূর্তে সেই কথা এই ছেলের কাছে বলতে রাজী নন। তাতে ভুল ভাঙার বদলে আরও বেশী তিক্ততা সৃষ্টি হতে পারে বলেই তিনি মনে করেন। গত পনের বছর ধরে যখন কথাটা অজানাই রয়ে গিয়েছে, এখনই তা জানাবার সময় হয়েছে বলে মনে করেন না শাহনাজ।
সুলতান উল্টে প্রশ্ন করে, ‘হাসছেন কেন?’
গম্ভির হলেন শাহনাজ, ‘না, এমনি। তোমার অহেতুক রাগ দেখে আমার হাসি আসছে। তুমি ওঁর একমাত্র সন্তান। শিক্ষিত, যোগ্য, গ্রোন আপ। তোমার ব্যক্তিত্ব আছে, নিজের উপরে যথেষ্ট কন্ফিডেন্স্ আছে। ওকে ফেরাবার চেষ্টা করা উচিৎ ছিল তোমার, বলো, উচিৎ ছিল না?’
শাহনাজের দিকে ভালো করে তাকায় সুলতান, ওকে ঠিকভাবে বুঝতে চেষ্টা করে।
‘উনি ফিরতে চাইলে, নিজেই ফিরতে পারেন। সেটুকু মনের জোর ওঁর আছে বলেই তো মনে হয় আমার।’
সাথে সাথেই সমর্থন করেন শাহনাজ, ‘ঠিক। অবশ্যই ঠিক। আমিও এ কথা বিশ্বাস করি। কিন’ উনিও তোমার মতো। ব্যক্তিত্ব আছে, জ্ঞান-বুদ্ধি আছে, তবু পাশে একজনের খুবই দরকার।’
‘আপনি ওকে পছন্দ করেন? করেন না?’ হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে সুলতান।
শাহনাজ সুন্দর করে হাসেন, ‘পছন্দ না করলে দশ বছর ধরে তার সাথে এক ছাদের তলায় দিন কাটাচ্ছি কি করে?’
এমন স্পষ্ট করে একথা তিনি বলতে পারেন তা ধারণাই করতে পারেনি সুলতান। একটু অবাক হয় ও। তবু আঘাত করতে ছাড়ে না ও।
‘তা’হলে আপনি চেষ্টা করেন নি কেন? নাকি সে অধিকার নেই আপনার?’