৩
কিন’ সেটা প্রকাশ করলেন না তিনি। শান্ত গলায় বললেন, ‘একটা কিছু করবি তো? স্ক্রীন আর টিভি নিয়ে ছিলি, না হয় সে সব নিয়েই থাকতিস। তা’ছাড়া লিখছিলিও তো ভালো – লেখাটেখা বের হচ্ছিল দেখলাম। দ্যাটস্ অলসো নট ব্যাড্। ডু সামথিং- এনি ড্যাম থিং। কি করছিস, সেটা ইম্মেটেরিয়াল। একটা কিছু নিয়ে থাকলে অনেক অশান্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মিঠুর মার কাছে শুনলাম-’
একটু থামলেন। গলার স্বর একেবারে খাঁদে নেমে এলো ওর, ‘সারাদিন কিছুই নাকি করিস না তুই। বন্ধু-বান্ধবের সাথেও মিশিস্ না। চুপচাপ শুয়ে বসে থাকিস্। তুই বুঝিস না, আমি কষ্ট পাই – নিজেকে বড়ই অপরাধী লাগে?’
ওঁর গলার স্বরে অভিমানের ছোঁয়া। সুলতান বুঝতে পারে, তবু উত্তর দেয় না। কি আছে ওর বলার? বলার তো কিছুই নেই। মাথা নিচু করে বসে থাকে ও।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন কবির আনোয়ার। হয়তো ভেবেছিলেন ও কিছু বলবে। কিন’ সাড়া না পেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন, তারপর উঠে পাশের ঘরে চলে গেলেন।
কবির আনোয়ার বোঝেন সবই, কিন’ তার কি করার ছিল? স্ত্রী যদি তার স্বামীকে বুঝতে না চেয়ে, ফেরাতে না গিয়ে, অহেতুক জেদ ধরে ন্যায়-নীতির গন্ডি তৈরী করে, অবুঝ বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, রাগ আর অভিমান করে সংসার ভেঙে চলে যায়, তা’হলে স্ব্বামীর অহমিকায় আঘাত পড়বে না? স্বামীর কি করার থাকে? থাকে অনেক কিছুই। স্ত্রীর কাছে নিজের কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমা চেয়ে তাকে ফিরিয়ে আনা অথবা রাগ দেখিয়ে, অধিকার ফলিয়ে আরও তীক্ত কোন ঘটনার সৃষ্টি করা।
কিন’ কিছুই তিনি করেন নি। তাঁরও অহমিকায় বেঁধেছিল, তার সম্মানের হানি হয়েছিল। স্ত্রীর কাছে সম্মানে কিম্ব্বা হিংস্রতায়, কোনটাইতেই ছোট হতে চান নি। হলে হয়তো আজ এমনটা হতো না।
তা’ছাড়া সুলতানের মা লায়লা যখন তার জীবন থেকে চলে গিয়েছিল তখন তিনি বত্রিশ বছরের দাম্ভিক, শক্তিশালী, আত্মবিশ্বাসী, প্রতিষ্ঠিত যুবক। ভেবেছিলেন, কতদিন আর অন্য কোথাও গিয়ে দিন কাটাবে লায়লা। একদিন না একদিন নিজের সংসারে ফিরতেই হবে ওকে। যত যা কিছু হোক না কেন, স্ব্বামীর সংসারই মেয়েদের সবচেয়ে বড়ো আশ্রয়- বড়ো পরিচয়।
তখন না হয় স্ত্রীর সাথে সবকিছু বোঝাপড়া করে নেবেন। হারতে হয় গোপনে স্ত্রীর কাছে হারবেন, অন্য কেউ জানবে না। কিন’ তিনি যদি স্ত্রীকে আনতে যান, তা’হলে তার এই পরাজয়, সবাই জানবে।
কিন’ তার নীতিবাগিশ স্ত্রী আর তার ততোধিক নীতিবাগিশ শাশুড়ী কোন রকম সমঝোতার সুতোই কখনও জোড়া লাগাতে দেননি। তার সাথে কোন যোগাযোগই রাখেননি। তার কি করার ছিল?
দোষ যে তার একেবারেই ছিলো না, এমন নয়- ছিলো, হয়তো একটু বেশী রকমই ছিলো। এখন স্বীকার করতে লজ্জা নেই। ছোটবেলা থেকে অর্থের অভাব কোনদিন বোধ করেননি। তাছাড়া মাথার উপরে খবরদারী করার মতো তেমন কোন অভিভাবক না থাকায় সোনায় সোহাগা হয়েছিল। ছিলেন কেবল বিধবা মা। থোড়াই কেয়ার করতেন তাকে কবির আনোয়ার। তাই বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে অল্প বয়েসেই সুরায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। উপায়ান্ত না দেখে মা বিয়ের ব্যবস’া করেছিলেন। ঘরে এনেছিলেন লায়লাকে। ভেবেছিলেন বৌয়ের আকর্ষণে ঐ পথের নেশা বুঝি ভাঙবে ছেলের। কিন’ ভাঙেনি। স্ত্রী তার সুরায় আসক্তি দেখে বিরূপ ব্যবহার আরম্ভ করেছিলেন। ভালবেসে, কাছে টেনে ভোলাতে চেষ্টা করেননি লায়লা, কঠোর ব্যবহারের আঘাতে কবির আনোয়ারকে বিরক্ত করে তুলেছিলেন। ঘরের আকর্ষণ স্ব্বামীর মনে গড়ে ওঠার চেয়ে ঘরের প্রতি অনীহা বেড়েছিল বই কমেনি।
এর মধ্যেও সন্তান এসেছিল- এসেছিল সুলতান। কিন’ তাদের দাম্পত্য জীবনের কোন পরিবর্তন হয়নি- বরং তীক্ততা বেড়েছিল সন্তানকে ঘিরেও। পরে লায়লা সুলতানকে নিয়ে স্ব্বামীর বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন কবির আনোয়ার। নিজের স্ফুর্তির জগতকে নিস্কণ্টক ভেবেছিলেন। পিছনের টান না থাকায় বাইরের উচ্ছৃঙ্খলতার স্রোতে পুরোপুরি গা ভাসাতে পেরেছিলেন। আনন্দে ইন্ধন জুগিয়েছিল তার অতি চালাক বন্ধুরা। গভীর রাতে কিম্বা ভোর রাতে খালি বাসায় ফিরে নিঃসঙ্গতা দুর করতে আবারও বোতল নিয়ে বসেছেন কবির আনোয়ার কিংবা সঙ্গে নিয়ে এসেছেন সঙ্গিনী। খারাপ লাগলেও আরও খারাপ হওয়ার জন্যেই জেদ ধরে এসব করেছিলেন।
এর মধ্যে স্ত্রীকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে, অকারণ নিষ্ঠুরতায় দশ বছরের ছেলেটাকে নিয়ে চলে এসেছিলেন আইনের আশ্রয় নিয়ে। কিন’ ছেলেকে নিজের কাছে এনে প্রথম দিনই বুঝতে পেরেছিলেন ছেলে এই নতুন ব্যবস’া, নতুন পরিবেশ, তাকে, কোনকিছুকেই পছন্দ করছে না। পছন্দ করতে পারছে না জেনে সহানুভূতি হয়েছে। কিন’ প্রতিহিংসা আর নিষ্ঠুরতার কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছে সহানুভূতির।
কঠোর হলে হীতে বিপরীত হবে বুঝতে পেরেছিলেন কবির আনোয়ার। তাই ্লেহে ভালবেসে কাছে টানতে গিয়েছেন। কিন’ দশ বছরের ছেলের মন ছুঁতে পারেন নি। ছেলে নিজেকে গুঁটিয়ে নিয়েছে নিজের মধ্যে।
সেই ছেলে আজও তার কাছ থেকে দুরেই রয়ে গিয়েছে। আজকাল ছেলেকে ঐভাবে গুটিয়ে থাকতে দেখে, তাকে কষ্ট পেতে দেখে নিজেই কষ্ট পান, অনুশোচনা হয় অতীতের কাজের জন্য। আজকাল অনেক বেশী অসহায় আর পরাজিত মনে হয় নিজেকে। কি করবেন তিনি? কেমন করে প্রায়শ্চিত্ত করবেন? আর প্রায়শ্চিত্ত করলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে? সবাইকে হাসিখুশী দেখবেন?
কবির আনোয়ারকে গম্ভির মুখে ঘরে ঢুকতে দেখে যা বোঝার বুঝে ফেলেন শাহনাজ। কথা না বলে কাছে এসে কাঁধের উপর দুই হাত রাখেন, ‘ভেঙে পড়লে তো চলবে না, চেষ্টা করো, দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আর হয়েছে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন কবির আনোয়ার।
শাহনাজ জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি ওর সাথে একটু কথা বলি?’
‘বলবে? যে ছেলে, আবার অপমান না করে বসে।’
শাহনাজ হেসে ফেলেন, ‘ছেলের কথায় মায়ের কখনও অপমান হয়?’
‘মা?’ অবাক হলেন কবির আনোয়ার।
‘নয়, কেন?’ শাহনাজ হাসেন।
একটু চুপ করে থেকে মাথা ঝাঁকান কবির আনোয়ার, ‘তাই তো, ঠিক, মা-ই তো। দেখো, ঠিক করে দিতে পারো কি না।’
বাবা চলে যাবার পর একইভাবে চুপ করে বসে থাকে সুলতান। না, বাবার সাথে সরাসরি কোন বিরোধ, কোন তর্ক কিম্ব্বা কোনও ধরনের অবাধ্যতা – কোনটাই কখনও করেনি ও। সে রকম মানসিকতাও কোনদিন হয়নি। কোনদিন মনেও স’ান দেয়নি এসব কথা। কিন’ সবসময়েই সে তার সমস্ত অবয়ব দিয়ে, প্রতিটি পদক্ষেপে, নিঃশব্দে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে ও।
অবশ্য বাবা কোনদিন কখনও ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেননি, কোনসময় বাবাকে রাগ করতেও দেখেনি। এই সাতাশ বছরের জীবনে বাবাকে কখনও অসন্তোষ প্রকাশ করতেও দেখেনি ও। কিন’ একেবারে শিশুকাল থেকেই বাবা আর মায়ের সেই নিঃশব্দ দ্বৈরথ, সেই অঘোষিত বিরোধ আর বিচ্ছেদটা কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি ও।
তার উপরে যখন দশ বছর হতে না হতে বাবার সাথে তাকে চলে আসতে হয়েছিল তখনই বুঝেছিল ওর ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোন দাম দেবে না কেউই। বাইরে যতই শান্তশিষ্ট আর অনুগত থাকার ব্যবহার করে গিয়েছে, ভিতরে ভিতরে ততই বিক্ষুব্ধ আর বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে ও। কিন’ কখনও কোনদিন কাউকে বুঝতে দেয়নি। কেবল নিজে নিজে গুমরে মরেছে।
অবশ্য বছরে কয়েকবার করে ছুটিছাটায় ও মায়ের কাছে নিয়মিত যেতে পেরেছিল। বাবাই জোর করে পাঠিয়ে দিতেন ওকে। কোনদিন মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য আবদার করতে হয়নি।
কিন’ যতবার ও মায়ের কাছে ছুটে গিয়েছে, ভেবেছে মা ওকে আদর করে কাছে টেনে নেবেন, ততবারই তার নির্লিপ্ত শীতল ব্যবহারে আরও বেশী গুটিয়ে গিয়েছে সুলতান, আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। ও বুঝতে পেরেছে মা তাকে তার বাবার প্রতিনিধিই মনে করেছেন, বাবার দোষ, বাবার অপরাধ ছেলের মধ্যেও যেন দেখতে পেয়েছেন ওর মা।
কিন’ ও যে ওর মায়েরও, মায়ের রক্ত ওর মধ্যেও বইছে, সেটা যেন ওর মা ইচ্ছে করে ভুলেছেন, অথবা ঠিক ভোলেন নি . . ভোলার ভান করেছেন, অভিনয় করেছেন। ফলে মায়ের উপরেও ওর আগ্রহ আর আকর্ষণ দিনের পর দিন কমেছে। শেষের দিকে মায়ের কাছে যেতেই ইচ্ছেও হতো না ওর।