২
‘আব্বা এখনও উঠলে না? ঘর ঝাড়ু দেবো তো?’
আর শুয়ে থাকতে পারে না সুলতান, উঠতে হয়। না উঠে উপায় কি? সাত সকালে ঘর দুয়ার ঝাড়া-মোছা করা ওর অভ্যাস। বলে, না হলে নাকি সংসারে অকল্যাণ হয়।
দরজার ছিটকানী খুলে রাগ করে ওঠে সুলতান, ‘ভর সকালে ও রকম ডাকাডাকি করলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। রান্নাঘরের কাজকর্ম হয়ে গিয়ে থাকলে চুপ করে বসে থাকবে। আমি আমার ইচ্ছেমতো উঠবো, তারপর আমার ঘরের কাজ করবে। বুঝেছো?’
সুলতানের এইরকম রাগের যেন কেয়ারই করে না মিঠুর মা। উত্তর দেয়, ‘বেলা আটটার সময় ভর সকাল হয় কি করে? বেশী বেলা অবধি শুয়ে থাকলে শরীর ভালো হয় না।’
‘আমার শরীরের দিকে নজর না দিলেও ভাত হজম হবে তোমার। নাস্তা তৈরী
হয়েছে- না মুখ হাত ধুয়ে বসে থাকতে হবে?’
মাথা নাড়ে মিঠুর মা, ‘হ্যাঁ, সব তৈরী। তুমি বাথরমে থেকে আসো তো আগে?’ তারপর গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে প্রায় ফিস্ ফিস্ করে বলে, ‘দাদা এসেছেন?’
‘দাদা মানে, আমার বাবা?’
মাথা নাড়িয়ে মিঠুর মা বোঝায়, ‘হ্যাঁ তাই।’
শোয়া থেকে দ্রুত উঠে বসে সুলতান। বাবা, আজকে হঠাৎ?
অবশ্য এমনি হঠাৎ করে দুই-একদিনের জন্যে চট্টগ্রাম থেকে হাজির হন তিনি, খবরটবর না দিয়ে। আগে অবশ্য হোটেলেই উঠতেন। কিন’ সুলতান আপত্তি করাতে আজকাল এখানে ছেলের কাছেই ওঠেন। বেশির ভাগ সময় একাই আসেন, কখনও কখনও সঙ্গে একজন মহিলা থাকেন। তিনি কে সুলতান কোনও দিন জিজ্ঞেস করেনি। তিনিও বলেন নি। এ বাবদে সুলতান মুখে তালাচাবি আটকে রাখাই ভালো মনে করে। কি দরকার এসব কথা তুলে? যার যা পথ, তার তাই থাক। পরামর্শ দিয়ে, উপদেশ দিয়ে কাউকে কারও পথ থেকে সরানো যায় না। যদি যেতোই তবে পৃথিবীতে আর কোন অপরাধ থাকতো না। তাছাড়া নিজে সেই পথের পথিক না হলেই হলো।
ওকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে মিঠুর মাও কোন কথা না বলে মশারীটা তুলে বিছানা ঝাড়তে আর ঘর গোছাতে থাকে।
সুলতান কয়েক মিনিট পর মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে, ‘কখন এসেছেন?’
মিঠুর মা উত্তর দেয়, ‘রাতের ট্রেনে। এই একটু আগে।’
‘একা?’
মিঠুর মা সুলতানের অনেক কিছু জেনে গেছে বলেই কথা না বলে কেবল নিঃশব্দে মাথা নাড়ে, না, তিনি একা আসেন নি।
একটু ব্যস্ততা অনুভব করে সুলতান, ‘ওদের নাস্তা দিয়েছো তো? কি দিলে?’
‘পরটা, ডিম ভাজি, কোল্ড বিফ আর সেমাই। নাস্তা খাওয়া হয়ে গেছে ওদের। এখন চা দেবো।’
মিঠুর মার প্রতি সুলতানের অগাধ আস’া। কখন কাকে কতটুকু আপ্যায়ন করতে হবে তা এই সাত বছরে ও খুব ভালোমতো বুঝে নিয়েছে। কোন কিছু বলতে হয় না।
‘শোন, দুপুরে শিককাবাব করবে কিন’। বাবা খুব পছন্দ করেন। গোস্ত আছে তো ফ্রিজে?’
‘সে তোমাকে ভাবতে হবে না। এখন যাও দেখি মুখ ধুয়ে এসো। তোমার নাস্তা দিচ্ছি।’
সুলতান উঠে পড়ে।
গোছল-শেভ শেষ করে বাথরুম থেকে বের হতে প্রায় আধাঘন্টা লেগে যায় সুলতানের। প্যান্ট-শার্ট পরে একেবারে বাইরে যাবার মতো তৈরী হয়ে ঘরে ঢোকে ও।
বিছানার পাশের নীচু টেবিলটার পরে এরই মধ্যে খাবার সাজিয়ে ঢেকে রেখে দিয়েছে মিঠুর মা। হয়তো আরও কিছু আনতে গিয়েছে।
ঢাকনা খুলে দেখে ছ’টা ছোট গরম চাপাতি, সিম-আলু কুচি করে ভাঁজা, তাতে কুচি কুচি গোস্তের ঝুরি আর অন্য পিরিচে পাতলা করে কাটা বাসায় বানানো পনিরের টুকরো।
একদিন কথায় কথায় বলেছিল ও পনির খুব পছন্দ করে।
মিঠুর মা বলেছিল, ‘কিনে এনে খেলেই তো পারো।’
ও বলেছিল, ‘বাজারের পনির খেতে ভালো লাগে না যে।’
তারপর সপ্তাহখানেক পরেই খাবারের টেবিলে পনির দেখে বলেছিল, ‘তুমি আবার পনির কিনতে গেলে কেন?’
মিঠুর মা বলেছিল, ‘কিনিনি, বানিয়েছি?’
ও অবাক হয়েছিল, ‘তুমি বানিয়েছ? কিভাবে?’
মিঠুর মা হেসে বলেছিল, ‘খুব সোজা। শিখিয়ে দিলে তুমিও পারবে। প্রথমে দুধ ছানা করলাম। পরিস্কার কাপড়ে বেঁধে বারান্দায় ঝুলিয়ে দিয়ে সেই ছানা থেকে পানি ঝরিয়ে ফেললাম ভালো করে। তারপর ঐ কাপড়সুদ্ধ ছানায় নুন দিয়ে একটা বাঁশের টুকরীতে চেপেচুপে বসিয়ে রেখে দিলাম এই এক সপ্তাহ। ব্যস হয়ে গেল। দেখো তো কেমন হয়েছে?’
পনির মুখে দিয়ে আশ্চর্য হয় সুলতান। খুশীতে মুখটা চক্ চক্ করে ওঠে ওর। ‘ওহ্, দারুণ সুন্দর হয়েছে। তোমার হাতটা সত্যিই সোনায় মোড়া, মিঠুর মা, অদ্ভুত! সত্যিই অপূর্ব।’
মিঠুর মার মুখটাও খুশিতে জ্বলজ্বল করতে থাকে।
ও খেতে বসে। এক কাপ দুধ এনে টেবিলটার উপর রাখে মিঠুর মা। এই দুধটুকুই ওর বিলাস। চা, পান, সিগারেট কোনটাই খায় না সুলতান। অভ্যাস করেনি ও। খেয়ে দেখেছে, কিন’ ভালো লাগেনি। বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়ে মাঝে মাঝে খেতে হয়েছে, কিন’ এইসব কঠিন, বায়বীয় আর তরল মাদক দ্রব্যগুলোর কোনটাই ওকে আকর্ষণ করতে পারেনি। নেশা ভাঙার পরের অনুভূতিটাই বিশ্রি, বিরক্তিকর- অসহ্য লেগেছে ওর কাছে। বন্ধুরা ইদানিং দস’রমতো ওকে মিল্ক বেবী বলে ঠাট্টা করে।
এটা- ওটা নানা কথা ভাবতে ভাবতে খাওয়া শেষ করে সুলতান। তারপর দুধের কাপটা তুলে তাতে চুমুক দিতেই ওর বাবা কবির আনোয়ার ঘরে ঢোকেন। ওঁকে ঘরে ঢুকতে দেখেই সুলতান উঠে দাঁড়ায়। ছোট বেলায় মামার কাছে শেখা এইসব মামুলী ভদ্রতাটুকু বহু তিক্ততার মধ্যেও মনের থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারেনি।
‘খাচ্ছিলি নাকি? আরে, বোস্, বোস্।’
এগিয়ে এসে একটা টুল টেনে বসলেন তিনি। ওঁর দিকে তাকিয়ে থমকালো সুলতান। পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা পাকানো পেটা শরীর ওঁর। কিন’ কেমন যেন ঢিলে হয়ে গেছে এই অল্প কদিনেই।
কিছুদিন আগেই তো দেখা হয়েছিল! না, ঠিক কিছুদিন পার হয়নি- পার হয়েছে চার মাসের উপর। গত ঈদের সময় এসেছিলেন। তখনও ভালো ছিলেন, এতোটা খারাপ হয়নি শরীর। এর মধ্যেই সারা মুখ যেন ঝুলে গিয়েছে, চোখদুটো লালচে, চোখের নিচেটা, চোয়ালের নিচের চামড়া ফোলা-ফোলা, ঝুলঝুল করছে, এলকোহলের জন্য। আজকাল নিশ্চয়ই মাত্রা ছাড়া খাচ্ছেন ওসব। হাইপারটেনশন তো আছেই।
বেশ দুই-এক মিনিট চুপ করে থেকে ঘরের চারধারে চোখ বুলিয়ে নিলেন। ছেলে কেমন থাকছে, কেমন আছে, সেসব বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলেন।
‘কিছু বলবেন?’
সুলতান জিজ্ঞেস করে। তন্দ্রার ঘোরে যেন এতক্ষণ ছিলেন তিনি, চমকে উঠে ছেলের দিকে তাকালেন।
‘অ্যাঁ – না। এই – কি করছিস এখন?’
‘আজকে ? এখন?’ প্রশ্নটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সুলতান।
ইষৎ জড়ানো ভারী গলায় জিজ্ঞেস করলেন কবির আনোয়ার, ‘না, না, আজকে না, আজকাল কি করছিস? ভার্সিটিতে তো নাম নেই, চাকরীও কিছু করছিস না শুনলাম। তোর চলছে কি করে?’
‘বাড়ী ভাড়া তো ভালোই পাই। সেটাই তো আমার জন্যে যথেষ্ট।’
ইষৎ বিরক্ত হলেন যেন কবির আনোয়ার, ‘আরে, টাকার কথা কে বলছে। সেটা যে সাফিশিয়েন্ট, তা আমি ভালো করে জানি। বাট ইউ অট টু ডু সামথিং ফ্রুটফুল। কোন কাজের মধ্যে জড়িয়ে থাকা তো উচিৎ . . সামথিং . . এনিথিং। এইভাবে চুপচাপ হাত পা কোলে করে বসে থাকলে দিন কাটে? ভালো লাগে?’
চুপ করে থাকে সুলতান। কি বলবে ও? কিছুই ভালো লাগে না ওর। কোন কিছুুতেই উৎসাহ পায় না ও। মিনিট খানেক চুপ করে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন, ‘একটা কিছু বলবি তো?’
মুখ নিচু গলায় উত্তর দেয় সুলতান, ‘আমার কোন কিছুই ভালো লাগে না। এক একটা দিন পার হলেই মনে হয় বাঁচা গেল। এই তো বেশ চলে যাচ্ছে ।’
উত্তরটা যে তাঁর মনঃপুত হবে না, সুলতান তা ভালো করেই জানে। হয়ওনি।