স্বর্গ মরীচিকা ৮

আমি সরাইখানা থেকে বের হয়ে পথে নামলাম তারপর একটা ছোট সাঁকো পার হলাম। পায়ের নিচে খরস্রোতা নদী ঘুরে নিচে বয়ে গিয়েছে। তারপর বাঁক ঘুরে পাহাড়ী পথটা বেয়ে এগোতে মন্টে ভেরিটার পূব দিকের মুখটার দিকে। বেশ কিছুক্ষণ লোকালয়ের নানা শব্দ ভেসে আসছিল কানে – কুকুরের ঘেউ ঘেউ, গরুর হাম্বা, লোকেরা একে অন্যকে জোরে ডাক দিচ্ছে। এই সব শব্দ শান- বাতাসে কানে লাগছিল। বাড়িগুলো থেকে বের হওয়া ধোঁয়া উপরের আকাশে যে ঘোলা কুয়াশার মতো জমাট বাঁধছিল, এক সময় সেই জমাট মেঘই আমার দৃষ্টি সীমা থেকে নিচের উপত্যকার লোকালয়টাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করে ফেললো, ফাঁক থেকে বহু নিচে লোকালয়ের বাড়িগুলোকে খেলনার – ম্যাচের খোলার মতো মনে হতে থাকলো – আমি একই গতিতে উপরের দিকে হেঁটে গেলাম।

দুপুর নাগাদ নিচের উপত্যকাটা যখন একেবারেই হারিয়ে গেল, তখন খালি উপরের শৃঙ্গে চড়ার অদম্য আকাংখা ছাড়া আর কোন কিছুই আমার মনে এলো না। একটা কথাই আমি ভাবছিলাম সামনের বাঁক ঘুরে একটা পাথুরে দেয়াল অতিক্রম করে পরেরটার দিকে এগিয়ে যাওয়া, তারপর দ্বিতীয়টা পার হওয়া, পিছনেরগুলোর কথা ভুলে গিয়ে সামনেরটা পার হওয়া। ক্রমে আমার পথটা খাড়া আর দূর্গম হয়ে উঠলো। দীর্ঘকালের অনভ্যাসের কারণে অশক্ত পদক্ষেপ আর বিপরীত বাতাসের কারণে আমি একটু ধীর গতিতে এগোচ্ছিলাম। কিন’ আমার অন-রের উদ্যম আমাকে অস্বাভাবিক শক্তি যোগাচ্ছিল। আমার ক্লানি- লাগছিল না, বরং ধীরে ধীরে চলার ছন্দ নিশ্চিত হচ্ছিল আর আস’া বাড়ছিল- মনে হচ্ছিল আমি যেন সারা জীবন ধরে হেঁটে যেতে পারবো।

হঠাৎ সামনে একটা ছোট গ্রাম পড়তে অত্যন- আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কারণ আমি ভেবেছিলাম আমাকে আরও অনেক সময় হাঁটতে হবে গ্রামে পৌঁছানোর জন্য। আমার হাঁটার গতি নিশ্চয়ই অনেক বেড়ে গিয়েছিল, কারণ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তখন মাত্র চারটা বাজে। পুরো গ্রামটা একেবারে নিঝুম আর পরিত্যক্ত। মনে হলো হয়তো অধিবাসীরা কেউই নেই। মাত্র কয়েকটা ঘর বসবাসের উপযোগী মনে হলেও, অধিকাংশই আধাভাঙ্গা। মাত্র দুই তিনটা বাড়ি থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেল, যদিও আশেপাশের ক্ষেতগুলো ফাঁকা কোন লোক নেই। দু’তিনটা রোগা দুর্বল গরু রাস-ার ধারের মরা ঘাস মুখে দিচ্ছে, গলার ঘন্টাগুলো থেকে কেমন ভোঁতা আওয়াজ তুলছে ওদের নড়াচড়াতে। সমস- এলাকাটা কেমন বিষন্ন, মনমরা – সারা দিনের পথ চলার আনন্দের শেষে এই রকম বিষাদময় পরিবেশে এসে কেমন যেন থমকে গেলাম। প্রথম যে কুঁড়েঘর থেকে ধোঁয়া উঠছিল সেটার দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ ধাক্কা দেবার পর দরজাটা খুলে গেল – ফাঁক দিয়ে বছর চৌদ্দ বয়সের ছেলে উঁকি দিয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর সেই অবস’াতেই মুখ ঘুরিয়ে ভিতর থেকে কাকে যেন ডাক দিলো। আমার বয়সী এক প্রৌঢ় দরজার কাছে এসে প্রথমেই ওদের আঞ্চলিক ভাষায় কি যেন বললো। তারপর আমার দিকে ভালভাবে দেখে নিয়ে ওদের দেশীয় ভাষায় ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে আমার সাথে কথা শুরু করলো।

‘নিচের উপত্যকা থেকে ডাক্তার আসার কথা, তুমি কি ডাক্তার?’

‘না। আমি বেড়াতে এসেছি, পাহাড়ে উঠবো। আমি এখানে থাকার মতো ঘর চাই, রাতে যাতে একটু ঘুমাতে পারি।’

আমি উত্তর দিলাম।

আমার কথা গুনে লোকটার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।

আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললো, ‘এখানে একজনের খুব অসুখ, আমরা বুঝতে পারছি না কি করবো। নিচের ওরা বললো, একজন ডাক্তারকে পাঠাবে। তুমি আসার পথে কি কাউকে দেখোনি?’

‘না। আর কারো সাথে দেখা হয়নি আমার। নিচের উপত্যকা থেকে কেবল আমিই উঠে এলাম, আর তো কাউকে দেখলাম না। কার অসুখ? কোন শিশু?’

লোকটা মাথা নাড়লো, ‘না, এখানে আমাদের কোন বাচ্চা থাকে না।

ও আমার দিকে হতভাগ্যের মতো তাকিয়ে থাকলো। ওর ভঙ্গিতে কেমন অসহায় আর বিব্রত অবস’া। ওর অবস’া দেখে আমার দুঃখ হলো, ভেবে পেলাম না আমি কিভাবে ওকে সাহায্য করতে পারি। আমার কাছে তেমন কোন ওষুধ ছিল না। কেবল একটা ফার্স্ট এইডের প্যাকেট ছিল, সাথে কিছু এসপিরিনের বড়িও ছিল। আমার মনে হলো, হয়তো এসপিরিন দিয়ে প্রাথমিক কিছু আরাম দেয়া যেতে পারে, বিশেষ করে যদি জ্বর, গায়ে ব্যাথা থাকে। ব্যাগ থেকে এসপিরিনের শিশি বের করে কয়েকটা ট্যাবলেট নিয়ে লোকটাকে দিতে গেলাম।

‘এগুলোতে কিছু কাজ হতে পারে। রোগীকে খাইয়ে দাও।’

লোকটা ওষুধ না নিয়ে ঘরের ভিতরে দেখিয়ে বললো, ‘তুমিই ওকে খাইয়ে দাও না কেন?’

আমার ভিতরে যাবার কোন ইচ্ছা ছিল না। বিশেষ করে মুত্যু পথযাত্রী কোন লোকের বিমর্ষ আত্নীয়ের মুখোমুখি হতে চাচ্ছিলাম না আমি, কিন’ সাধারণ ভদ্রতা আর নিতান- মানবিক কারণে আমি ভিতরে না গিয়ে পারলাম না।

ভিতরের ঘরে মাটির উপরে খড়বিচালী পেতে একটা বিছানার উপরে দুটো কম্বল ঢাকা দিয়ে একটা লোক শুয়ে আছে, চোখ দুটো বন্ধ, সম্ভবতঃ ঘুমাচ্ছে। লোকটাকে দেখতেই মনে হলো সে মুত্যুর দ্বারপ্রানে- এসে দাঁড়িয়েছে। সারাটা মুখ একেবারে সাদা, রক্তশূন্য, গালে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। আমি বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে ভালভাবে লোকটার মুখের দিকে তাকালাম। ও চোখ খুলে তাকালো। একমুহূর্তের জন্য সমস- বিশ্ব স-ব্ধ হয়ে গেল, সময় থেমে গেল যেন, অবাক বিস্ময়ে পরস্পরের দিকে বহুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম আমরা দুজনে। তারপর ওর সারা মুখ হাসিতে ভরে গেল, আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ওর সারা অবয়ব, হাত বাড়িয়ে আমার হাতের উপর হাত রাখলো ও!

ও! . . . ভিক্টর।

‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’ দুর্বল কন্ঠে ও বললো।

আমি তখনও এমনই বিস্ময়বোধ করছিলাম যে, মুখ খেকে কোন কথা বের হচ্ছিল না। ভিক্টর ইশারায় আমার সঙ্গের লোকটিকে ডেকে আঞ্চলিক ভাষায় কিছুক্ষণ কথা বললো, সম্ভবত ও আমার পরিচয় দিলো, হয়তো বললো, আমরা অত্যন- ঘনিষ্ট বন্ধু। কারণ ওর কথা শুনে লোকটির মুখের বিমর্ষতা কেটে গেল, ও সন’ষ্ট হয়ে ঘর থেকে বাইরে চলে গেল।

আমি ভিক্টরের খড়ের বিছানার ধারে ভিক্টরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

অনেকক্ষণ পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার এ অবস’া কতদিন ধরে?’

‘পাঁচ দিন। প্লুরিসি দেখা দিয়েছে। আগেও ছিল, এখন একটু জটিল হয়ে উঠেছে। বুড়ো হয়েছি না?’ ও উত্তর দিয়ে আবার হাসলো।

অত্যন- অসুস’ দেখালেও, ওর একটুও পরিবর্তন হয়নি। ও যেন সেই ছেলেবেলার ভিক্টর।

‘তোমার দেখি ভালই উন্নতি হয়েছে।’ তেমনি হাসিমুখে ও বললো, ‘সাফল্যের সবরকম চিহ্নই তোমার শরীরে ফুটে উঠেছে।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ও এতকাল আমাকে কোন চিঠি লেখেনি কেন, আগে তো নিয়মিত চিঠি দিতো।

‘আমি বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতে চেয়েছিলাম, আমার মনে হয় তুমিও অনেকটা তেমনি জীবনই বেছে নিয়েছিলে, ভিন্নভাবে। আমি তো আর কখনই ইংল্যান্ডে ফিরে গেলাম না, তুমি ওখানে কিভাবে এতকাল থাকলে?’

আমি ওকে এস্‌পিরিনের শিশিটা দেখালাম।

‘আমার মনে হয় এটার আর দরকার হবে না।’

আমি বললাম, ‘সবচেয়ে ভালো হয়, আজকের রাতটা আমি এখানে কাটিয়ে কাল সকালে দুই একজনকে নিয়ে তোমাকে নিচের উপত্যকায় বয়ে নিয়ে যাবো। তোমার ভালো চিকিৎসা দরকার।

ভিক্টর ঠোঁট উল্টালো, ‘শুধু সময়ের অপচয় হবে। আমি জানি আমার সময় শেষ।’

আমি রেগে গেলাম, ‘পাগলামী করো না। তোমার একজন ভালো ডাক্তার দরকার। সেবা শুশ্রুষা দরকার। এই বদ্ধ ঘরে, এখানে তা সম্ভব না।’

আমি ঘরটার চারদিক ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, অন্ধকার, বায়ুহীন, স্যাঁতস্যাঁতে।

‘আমার কথা ভুলে যাও। আর এক জনের কথা বেশী ভাবতে হবে।’

‘কে?’

‘অ্যানা।’

ভিক্টর উত্তর দিলো।

আমি হতবাক হয়ে গেলাম। আমাকে কোন কথা বলতে না দেখে, ও বললো, ‘ও এখনও ওখানে আছে। তুমি তো জানো, ঐ মন্টে ভেরিটাতে।’

‘কি বলছো তুমি?’ আমি বিষ্ময় প্রকাশ করি।

‘অ্যানা ঐখানে। এত কাল ধরে আছে? ও কোন দিন ওখান থেকে বাইরে যায়নি?’

একটু থেমে ভিক্টর আবার বললো, ‘সেই জন্যেই তো আমি এখানে। আমি প্রতি বছর এখানে চলে আসছি। সেই প্রথম দিনের মতো। আমি তো তোমাকে চিঠিতে লিখেছি, মুখে বলেছি; সেই যুদ্ধের পর থেকে। সারা বছরের অন্য মাসগুলো নিচের সাগরের ধারের ছোট শহরটাতে থাকি। খুব শান- আর বিচ্ছিন্ন, আর বছরে একবার এখানে উঠে আসি। এবছর আর আমি নিচে ফিরে যেতে পারিনি।’

অবিশ্বাস্য! অসাধারণ সহিষ্ণুতা, এতো বছর ধরে, বন্ধুবান্ধব, আত্নীয়-স্বজন থেকে দূরে, কোন লাভ ছাড়া প্রত্যেকটা বছরের ধরে প্রতিদিন, কোন স্বার্থ ছাড়া প্রত্যকটা বছরের ধরে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ ধরে বছরের একটা সময়ে এই আশা-আকাঙ্খাহীন তীর্থে অ্যানার অপেক্ষায় জীবন অতিবাহিত করা!

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার সাথে ওর দেখা হয়েছে?’

‘কখনোই না।’

‘ওকে চিঠি লিখতে?’

‘প্রত্যেক বছর একটা করে চিঠি নিয়ে আসতাম। সাথে করে নিয়ে এসে ঐ দেয়ালের নিচে রেখে দিয়ে আসতাম, তারপর দিন আবার ওখানে ফিরে যেতাম।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘চিঠি কি ও পেত?’

‘হ্যাঁ প্রতিবারই। প্রতিটা চিঠির উত্তরে একটা করে পাথরের ফলকে খোদাই করে কয়েকটা অক্ষর লিখে দিতো ও। এক ধরনের একই বক্তব্যে। একটি শব্দ বেশী বা কম নয়। ফলকগুলো আমি আমার সাথে করে নিয়ে যেতাম নিচে। নিচের বন্দরের আমার বাড়িটায় সবকটা জমা আছে।

হৃদয়বিদারক ঘটনা! অ্যানার প্রতি ওর অন্ধ ভালবাসা, এই বিশ্বাস, এই প্রতিশ্রুতি, সারা জীবন ধরে এই আনুগত্য; সত্যিই আশ্চর্য।

‘বিষয়টা নিয়ে আমি পড়াশুনা করতে চেয়েছি। এই নিয়ম, এই মতাদর্শ, এই বিশ্বাস। অত্যন- প্রাচীন, খৃষ্টের জম্মেরও আগে থেকে ছিল। প্রাচীন পুথিপত্রের কোন কোন জায়গায় এদের কথা পরোক্ষভাবে বলা হয়েছে। অনেকের সাথে আমি কথা বলেছি, গবেষকদের কাছে জিজ্ঞেস করেছি, যারা অতীন্দ্রিয় বিষয় নিয়ে যারা পড়াশোনা করছেন, তাদের কাছে গিয়েছি; দেখা গিয়েছে সেই সময়ের সকল পাহাড়ী জনগোষ্টির মধ্যে ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল, প্রাচীন গল, দ্র্যুজ; সব জায়গাতেই দেখা গিয়েছে। এদের জীবনযাত্রায় চাঁদের ভুমিকা অত্যন- প্রবল। শোনা যায় এদের নাকি সৌন্দর্য আর যৌবন অটুট থাকতো।’

আমি বললাম, ‘যেমনভাবে তুমি কথা বলছো ভিক্টর, তাতে মনে হচ্ছে, তুমিও এই সব বিশ্বাস করতে আরম্ভ করছো।’

‘হ্যাঁ আমি বিশ্বাস করি। এই এলাকার সব কিশোর-কিশোরী বিশ্বাস করে। সকল অধিবাসী বিশ্বাস করে।’

এতক্ষণ কথা বলে ভিক্টর ক্লান- হয়ে পড়েছিল। হাত বাড়িয়ে মাথার ধারে রাখা পানির কলসিটা টেনে নিয়ে পানি খেল।

আমি বললাম, ‘আমার কাছে কিছু এসপিরিন আছে, অন্য কোন কিছু না হোক কিছুক্ষণ আরাম লাগবে, জ্বর হলে কাজে দেবে। কিছুটা ঘুমও দরকার তোমার।’

ওকে তিনটে বড়ি খাইয়ে গায়ে কম্বল টেনে দিলাম।

‘বাসায় কোন মহিলা নেই?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘না।’ ও উত্তর দিলো। তারপর একটু থেমে বললো, ‘এটাই বড়ো অবাক করেছে আমাকে, এবারে এখানে আসার পর থেকেই সমস- পথটা কেমন পরিত্যক্ত, জনমানবশূন্য বলে মনে হয়েছে। সব মেয়ে আর শিশুদের নিচের উপত্যকায় পাঠিয়ে দিয়েছে এরা। সব মিলে বিশ জন পুরুষ আর কিশোর রয়ে গেছে এখানে।’

‘মেয়ে আর শিশুরা কবে নিচে চলে গেছে জানো?’

‘আমি এখানে আসার কয়েক দিন আগে। এই লোকটা, এই বাড়ি যে বুড়ো লোকটার, তার ছেলে, বুড়োটার সাথে আমার ঘনিষ্টতা ছিল। বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছে ও। এ ছেলে আকাশ-পাতাল কিছুই বোঝে না, এমনই নির্বোধ। কোন কিছু প্রশ্ন করলে হাবার মতো তাকিয়ে থাকবে। কিন’ অকল্পনীয় বিশ্বাসী আর অত্যন- কর্মঠ। ও তোমার যা প্রয়োজন খাবার, বিছানা সব জোগাড় করে দিতে পারবে। ছোট ছেলেটা ওর তুলনায় অনেক চটপটে আর বুদ্ধিমান।’

ভিক্টর চোখ বন্ধ করে ফেললো, সারা অবয়বে ওর অপরিসীম ক্লানি-। হয়তো ঘুমিয়ে পড়বে এখনই। আমার মনে হলো, গ্রামের মহিলা আর শিশুদের নিচের উপত্যকায় চলে যাবার কারণ আমি জানি। কিছুদিন আগের গ্রামের একটা মেয়ের অনর্-ধানের পরই অবস’ার পরিবর্তন হয়েছে। নিচের ওরা তো বলছেই, মন্টে ভেরিটার দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, সমস্যা দেখা দিতে পারে। ভিক্টরকে একথা বলতে সাহস হলো না আমার। আমার মনে হলো কোনভাবে ভিক্টরকে বুঝিয়ে যদি নিচের উপত্যকায় নিয়ে যাওয়া যেত ওকে, তাহলে ভাল হতো হয়তো।

বাইরে তখন সন্ধ্যা নেমেছে, আমার খিদেও পেয়েছে। আমি ঘরটার পিছন দিকের ছোট খোপটাতে উঁিক দিলাম। ওখানে কেউ নেই, কেবল সেই ছেলেটা বসে আছে। ওকে কিছু খাবার আর পানীয় আনতে বললাম। ও আমার কথা বুঝতে পেরে রুটি, রান্না মাংস আর পনির এনে দিলো। আমি এঘরে এসে খেতে লাগলাম ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ভিক্টর চোখ বন্ধ করে আছে, সম্ভবত ঘুমাচ্ছে।

ছেলেটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ও কি ভালো হবে?’

ছেলেটা কিন’ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিল না।

‘আমার মনে হয় হবে। আমি যদি ওকে নিচের উপত্যকায় নিয়ে গিয়ে ওকে ডাক্তার দেখাতে পারি।’

ও বললো, ‘আমি তোমাকে সাহায্য করবো। আমার দুজন বন্ধু আছে এখানে, ওরাও সাহায্য করবে। আমরা আগামী কাল যেতে পারবো। তারপর অসুবিধা হতে পারে।

‘কি অসুবিধা?’

‘আগামীকালের পর এখানে যাতায়াত বাড়বে। উপত্যকা থেকে অনেক লোক আসবে, অনেক উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে, আমি আর আমার বন্ধুরা ওদের সাথে যোগ দেবো।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আগামীকালের পর কি হবে?’

ও ইতঃস-ত করতে থাকলো। ও আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।

‘আমি ঠিক জানি না।’

ও তাড়াহুড়ো করে উঠে পাশের খোপে চলে গেল। বিছানা থেকে ভিক্টরের গলার আওয়াজ শোনা গেল।

‘ছেলেটা কি বললো? উপত্যকা থেকে কারা আসবে?’

‘আমি তো বুঝতে পারলাম না। মনে হয় কোন অভিযাত্রীদল। তবে ও তোমাকে নিচে নিয়ে যেতে ও রাজী হয়েছে।’

আমি অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিলাম।

‘কোন অভিযাত্রী এখানে আসে না, তোমার শুনতে কোন ভুল হয়েছে।’

ও ছেলেটাকে ডাক দিলো। ছেলেটা এঘরে এলে ওর সাথে অত্যন- দ্রুত আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে থাকলো। ছেলেটা কথা বলতে অস্বসি- বোধ করছিল, প্রশ্নের উত্তর দিতে যথেষ্ট অনীহা বোধ করছিল ও। কয়েক বার দুজনেই মন্টে ভেরিটা শব্দটা বার কয়েক উচ্চারণ করলো। তারপর ও পিছনের খোপটাতে চলে গেল।

ভিক্টর জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি কিছু বুঝতে পারলে?’

আমি ওর এ কথার উত্তর দিলাম না।

‘আমার ভাল মনে হচ্ছে না। কি যেন একটা অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এবারে এ গ্রামে আসার পরপরই ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছিলাম। এদের চলাফেরা, আচার-আচরণ কেমন ছলনাময় মনে হয়েছে। ছেলেটা বললো উপত্যকায় নাকি কি গোলামাল হয়েছে। লোকেরা নাকি খুব ক্ষেপে উঠেছে। রেগে আছে। তুমি কি নিচের থেকে কিছু শুনে এসেছো?

আমি কি বলবো বুঝে পেলাম না। ও আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।

আমি বললাম, ‘নিচের উপত্যকার পানশালার লোকটাকে খুবই অসহযোগী মনে হয়েছিল। ও আমাকে এখানে আসতে মানা করেছিল।

‘ও কি বলেছিল?’

‘সরাসরি কিছু বলেনি। ও বলেছিল কি নাকি গন্ডগোল হবে।’

ভিক্টর চুপ করে গেল। ও গভীরভাবে কিছু চিন-া করছে বলে মনে হলো।

ও জিজ্ঞেস করলো, ‘নিচের উপত্যকা থেকে কি কোন মেয়ে হারিয়ে গেছে?’

মিথ্যা কথা বলার কোন মানে হয় না আর।

‘শুনেছি একটা মেয়ে নাকি হারিয়ে গিয়েছে। বলতে পারবো না কথাটা সত্যি কিনা।’

‘অবশ্যই কথাটা সত্যি। তাহলে এটাই আসল ঘটনা।’

ও অনেকক্ষণ কোন কথা বললো না, আমি ওর মুখের কোন অভিব্যক্তিও দেখতে পারছিলাম না, ঘরের অন্ধকারের কারণে। সারা ঘরে একটা তেলের পিলসুজ জ্বলছে, ঘোলাটে আলোয় কোন কিছুই পরিস্কার দেখা যায় না।

‘তুমি কালই উপরে যাবে। মন্টে ভেরিটায় গিয়ে অ্যানাকে সাবধান করে দেবে।

অনেকক্ষণ পর ও বললো। আমিও যেন এটাই আশা করছিলাম। আমি কিভাবে যাবো সেটা জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমি পথের নিশানা এঁকে দেবো। তোমার ভুল হবার সম্ভাবনা নেই। পথটা একবারে সোজা উপরে উঠে গিয়েছে, শুকনো জলধারার পথ ধরে দক্ষিণ দিকে যেতে হবে। অনেক দিন বৃষ্টি না হওয়ার জন্য পথ যাতায়াতের অযোগ্য হয়ে ওঠেনি। ভোর হওয়ার আগে রওনা হলে সারাটা দিন তোমার হাতে থাকবে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওখানে যাবার পর কি হবে?’

‘একটা চিঠি লিখে ওখানে রেখে সরে আসবে। তোমার সামনে ওরা চিঠি নিতে আসবে না। আমিও একটা চিঠি দেবো। আমি বলবো আমি এখানে অসুস’ হয়ে পড়ে আছি। আর বিশ বছর পর তুমি হঠাৎ এসে হাজির হয়েছো এখানে। এই একটু আগে, তুমি যখন ঐ ছেলেটার সাথে কথা বলছিলে, তখন আমি কি ভাবছিলাম জানো? আসলেই এটা একটা দৈব ঘটনা – মিরাকল। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, অ্যানাই তোমাকে এখানে আসতে বাধ্য করেছে।’

ওর চোখ দুটো সেই কৈশোরকালের মতো জ্বলজ্বল করে উঠলো। ঠিক এমনি দৃষ্টি আমি বহুকাল আগে ওর চোখে দেখতে পেতাম।

আমি ঘাড় নাড়লাম, ‘খুবই সম্ভব। হয় অ্যানা, নয়তো, সেই যে তুমি বলতে, আমার পর্বত-জ্বর – তাই।’

‘দু’টো ব্যাপারই কি এক নয়?’

আমরা পরস্পরের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম, আমাদের চারদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার আর নৈশব্দ্য গাঢ় হয়ে উঠলো।

একসময় আমি ছেলেটাকে ডাক দিয়ে কম্বল আর বালিশ আনতে বললাম। ভিক্টরের পাশে মেঝেতেই আমার শোবার ব্যবস’া করলাম।

সারাটা রাত ভিক্টর খুবই ছটফট করলো, ওর নিশ্বাস-প্রশ্বাসে খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। রাতের মধ্যে কয়েকবার উঠে ওর অবস’া বুঝতে চেষ্টা করলাম, এসপিরিন খাওয়ালাম, পানি খাওয়ালাম। ওর খুবই ঘাম হতে থাকলো, এখন যে অবস’া, তাতে ভাল অথবা খারাপ দুটোই ঘটে যেতে পারে। আমার তাই মনে হতে লাগলো। রাত যেন আর শেষ হতে চায় না, মনে হলো আর বুঝি কোন দিন ভোর হবে না, সূর্য উঠবে না। সারাটা রাত একবিন্দু ঘুম হলো না। ভোরের পাখিটা ডাক দেবার সাথে সাথেই সজাগ হয়ে উঠলাম।

‘তোমার এখনই রওনা হওয়া উচিত।’

অন্ধকারের মধ্যে ভিক্টর কথা বলে উঠলো। ওর কাছে গিয়ে ওর শরীর স্পর্শ করে দেখলাম, ওর ত্বক কেমন অস্বাভাবিক রকমের ঠান্ডা আর চট্‌চট্‌ করছে। ওর অবস’া রাতের মধ্যে আরও খারাপ হয়ে পড়েছে, অত্যন- দুর্বলও লাগছে ওকে।

‘অ্যানাকে বলবে নিচের লোকালয়ে অধিবাসীরা দল বেঁধে ওদেরকে আক্রমণ করতে আসছে। সামনে ওর আর ওর সঙ্গীদের খুবই বিপদ। আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত।’

‘আমি ওকে সব লিখে জানাবো।’ আমি বললাম।

ভিক্টর বললো, ‘ও জানে, আমি ওকে কতটা ভালবাসি। আমার সবকটা চিঠিতে আমি আমার আবেগ আর অনুভূতির কথা লিখে জানিয়েছি। তাহলেও তুমি ওকে আমার এই ভালবাসা, এই ত্যাগ, আমার গভীর আত্মনিবেদনের কথা বলবে। গিরিখাঁদটার কাছে গিয়ে তুমি অপেক্ষা করবে। তোমাকে সম্ভবতঃ দেড়-দুই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হতে পারে, ভাগ্য অপ্রসন্ন থাকলে তিনঘন্টা বা তার চেয়ে বেশী সময়ও অপেক্ষা করতে হবে হয়তো। তারপর ঐ দেয়ালের কাছে ফিরে যাবে। ওখানেই পাথরে খোদাই করা চিঠি পাবে। ওখানেই থাকবে পাথরটা।’

আমি ওর বরফের মতো ঠান্ডা হাতটা একটু স্পর্শ করলাম; আর একমুহূর্তের জন্য পরম আবেগে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। তারপর ভোরের কনকনে ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে বাইরে বের হয়ে এলাম।

Leave a Reply