স্বর্গ মরীচিকা ৭

আমি বিমানে এক শহর থেকে অন্য শহরে যাচ্ছিলাম। শহরের নামগুলো না হয় নাই বা বললাম – ওগুলোও তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে ঘটনাটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো বিমানটিকে জরুরী অবতরণ করতে হলো যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে, ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলে কোন প্রাণহানী ঘটেনি। এলাকাটা নির্জন আর পাহাড়ী। বিমানকর্মী ও যাত্রী সকলেই বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস’ায় ওই দিন পার করলাম। আমরা আধাভাঙ্গা বিমানের মধ্যেই কোন রকমে সময় পার করছিলাম আর সাহায্যের অপেক্ষা করছিলাম। এই দুর্ঘটনার খবর পৃথিবী সেই সময়ের রাজনৈতিক বিষ্ফোরন্মুখ অবস’াতেও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় শিরোনাম দখল করে রেখেছিল।

সেই আটচল্লিশ ঘন্টার দুর্ভোগ খুব বেশী তীব্র বা কষ্টকর হয়ে ওঠেনি। সৌভাগ্যবশতঃ যাত্রীদের মধ্যে কোন শিশু বা মহিলা ছিল না। ফলে আমরা পুরুষেরা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ও সহজভাবে এই কষ্টকে বরণ করে নিচ্ছিলাম। আমরা জানতাম, অনতিবিলম্বে সাহায্য এসে পৌঁছবে, কারণ এখানে পড়ে যাবার কিছুক্ষণ আগে বেতারে আমাদের অবস’া আর সর্বশেষ অবস’ান সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাঠানো হয়েছিল। এখন কেবল ধৈর্যধারণ আর শরীর গরম রাখাই প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ালো আমাদের। আমি আমার নিজের অবস’ার কথা ভাবলাম। আমার ইউরোপের কাজ ভালভাবে সমাধা হয়েছে। কোন পিছুটান নেই আমেরিকায় ফিরে যাবার, চোখের জল ফেলারও নেই কেউ নিভৃত গৃহকোণে; কিশোর আর যুবক অবস’ায় যেমন পরিবেশ আমি গভীরভাবে ভালবাসতাম, তেমন একটা জায়গায় এমন হঠাৎ করে এসে হাজির হওয়ায় আমি বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। দীর্ঘকাল যাবৎ আমি শহুরে জীবন আর আরাম আয়েসে অভ্যস- হয়ে পড়েছিলাম। আমেরিকার জীবন ধারার দ্রুতি, গতি আর শক্তি এবং নতুন পৃথিবীর শ্বাসরুদ্ধকর ক্ষমতা ও উদ্যোম পুরাতন আর মায়াময় বিশ্বের সাথে আমার নিবিড় বন্ধনের স্মৃতিকে ভুলিয়ে ফেলেছিল।

আমার চারপাশের এই চমৎকারিত্ব আর নির্জনতার দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম এই দীর্ঘ সময় যাবৎ আমি কি হারিয়েছি। আমি আমার সহযাত্রীদের কথা ভুলে গেলাম, ভাঙ্গা বিমানটির ধূষর কাঠামোর কথাও মন থেকে মুছে গেল। এই শতবর্ষের জনহীন প্রান-রে বিমানটি এক মুর্তিমান অসঙ্গতি আর সেই সাথে আমি আমার পাকা চুলের কথা, স’ূল অবয়বের কথা ভুলে গেলাম, ভুলে গেলাম দীর্ঘ পঞ্চান্ন বছর ধরে সঞ্চিত জীবনের ভার। আমি আবার কিশোর হয়ে গেলাম, প্রাণবন-, আগ্রহী, আশাবাদী, আদিকালের প্রশ্নের উত্তর খোঁজায় প্রতিশ্রুতিশীল। যেন ঐসব এখনও অনায়াত্ব রয়েছে, অপেক্ষামান ঐ শিখরগুলোর ওপারে কোথাও। শহুরে পোশাকে ঐ পরিবেশে মুর্তিমান অসঙ্গতি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি, ধীরে ধীরে আমার রক্তস্রোতের মধ্যে ছুটে চলছে সেই বহুকালের পুুরাতন পর্বত-জ্বর।

আমি ঐ ভাঙ্গা বিমানের কাঠামো আর দুশ্চিন-াময় সহযোগীদের কাছ থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইলাম। আমি ঐ দীর্ঘ যন্ত্রণাময় বৎসরগুলোকে ভুলে যেতে চাইলাম। সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে ‘িয়ে আবার আমার ইচ্ছা হলো কিশোর হয়ে পরিণতি সম্পর্কে বেপরোয়া হয়ে ঐ শিখরগুলো জয় করে বিজয়ের আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠি। আমি যেন অনুভব করতে পারছিলাম, ঐ উঁচু পর্বত শৃঙ্গে উঠে আমার কেমন লাগবে। ওখানকার বাতাস হালকা আর অনেক বেশী শীতল, নৈশব্দে আরও গভীর। বরফের আশ্চর্য জ্বালাময় অনুভুতি, সূর্যের অন-ঃপ্রবিষ্ট শক্তি আর সেই বিশেষ মুহূর্ত, যখন পাহাড়ের সুতোর মতো সরু ধার পার হতে গিয়ে পা ফস্‌কে যাবার মুহূর্তে বাঁচার আকুতিতে দড়ি আঁকড়ে ধরার মুহূর্তগুলো আবার ফিরে পেতে চাইলাম। আমি মেঘ ফুঁড়ে ওঠা শিখরগুলোর দিকে মুখ তুলে তাকালাম, এগুলোকেই আমি ভালবাসতাম, অথচ এখন নিজেকে বিশ্বাসঘাতকের মতো মনে হতে লাগলো। অনেক অকিঞ্চিৎকর জিনিষের জন্য, আরাম-আয়েসের জন্য নিরাপত্তার জন্য বিশ্বাসভঙ্গ করেছি।

আমি সিদ্ধান- নিলাম যখন আমাদের কাছে সাহায্যকারী দল এসে পৌঁছবে, তখন আমি আমার এই দীর্ঘকালের ক্রটি সংশোধনে নিজেকে নিবেদিত করবো। আমেরিকায় ফিরে যাবার যখন কোন তাড়া নেই। ইউরোপের এই নির্জন অক্ষত প্রকৃতির কোলে আমি কিছুদিন ছুটি কাটাবো। আর আবার পাহাড়ে উঠবো। আমি পাহাড়ে চড়ার জন্য উপযুক্ত কাপড় কিনবো, জিনিষপত্র জোগাড় করবো, তারপর পথে বেরিয়ে পড়বো। বিষয়টা মনের মধ্যে গেঁথে বসতেই মনটা খুব হালকা হয়ে উঠলো, কেমন উচ্ছৃঙ্খল আর বেহিসেবী হয়ে পড়লাম। আমার মন থেকে পৃথিবীর আর সবকিছুর দাগই মুছে গেল এক মুহূর্তে। আমি আমার বিমানের সঙ্গীদের কাছে ফিরে এলাম। বিমানটার ঐ চাপাচাপির মধ্যে বসে হাসিঠাট্টা আর গল্পে মেতে ঊঠলাম।

দ্বিতীয় দিনে সাহায্য এলো। আমরা সাহায্যের বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গেলাম যখন ঐ দিন আকাশে অনেক নিচে দিয়ে একটা বিমান উড়ে যেতে দেখলাম। উদ্ধারকারী দলের মধ্যে অভিজ্ঞ পর্বতারোহী, পথ প্রদর্শক, আর কিছু শক্তিশালী কঠিন প্রকৃতির লোক ছিল, কিন’ সকলেই খুবই অমায়িক। ওরা সাথে গরম কাপড়, প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র আর খাবার নিয়ে এসেছিল আর আমাদের সুস’ আর ঝামেলামুক্ত দেখে বেশ আশ্চর্য হযে গিয়েছিল। ওরা ভেবেছিল ওরা কোন জীবিত মানুষ পাবে না।

ওরা আমাদেরকে নিচের একটা উপত্যকার নিয়ে যাবার জন্য রওনা হলো। আর এর জন্য সমস-টা দিন কেটে গেল। আমরা প্রথমে এক বিশাল পর্বত শৃঙ্গের ধারে আমাদের রাতের আশ্রয় স’াপন করলাম, যেটাকে আমাদের আগের জায়গা থেকে, যেখানে আমাদের বিমানটা ছিল, দুর্গম আর দূরারোহ মনে হচ্ছিল। সকালে আমরা আবার রওনা দিলাম – খুব সুন্দর আলো ঝলমলে আর পরিষ্কার দিন ছিল সেটা। আমরা যে ঢাল বেয়ে নামছিলাম, সেখান থেকে নিচের উপত্যকাটা ছবির মতো লাগছিল। পূর্বদিকে পাহাড়ের ধার খাড়া হয়ে বহু উপরে উঠে গিয়েছে, উপরের দিকে তাকিয়ে বহু কষ্টে চোখে পড়লো সুতীক্ষ্ণ একটা – না, ঠিক একটা নয় – এক জোড়া পর্বতশৃঙ্গ। ঠিক মুঠিবদ্ধ হাতের আঙ্গুলের দু’টি হাড় যেমন উঁচু হয়ে থাকে, তেমন।

আমি আমাদের উদ্ধারকারী দলের নেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছেলেবেলায় আমি খুব পাহাড়ে উঠতাম। এই এলাকাটা আমার তেমন পরিচিত না। এখানে কি প্রায়ই পর্বতারোহীরা আসে?’

ও মাথা নাড়লো।

ও এই এলাকা সম্পর্কে খুব বেশী কিছু জানে না। ওরা আরও দূর থেকে এসেছে। পূর্বের ‘িকের যে লোকালয় দ তার অধিবাসীরা অশিক্ষিত আর পশ্চাদপসার। এখানে পর্যটকদের জন্য বা বাইরের কারো জন্য কোন সুযোগ সুবিধা নেই। আমার যদি পাহাড়ে চড়ার শখ হয় তবে যেন আমি অন্য কোথাও যাই, যেখানে আমি অন্য সব সুবিধা পাবো। তাছাড়া পাহাড়ে চড়ার সময়ও এটা নয়।

আমি পূর্ব দিকের ঐ পাহাড়টার দিকে আর একবার তাকালাম। কেমন নিঃসঙ্গ আর দূর্গম, অথচ কতো অস্বাভাবিক রকমের সুন্দর।

‘ঐ শৃঙ্গদুটোর নাম কি?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সে উত্তর দিলো, ‘মন্টে ভেরিটা।’

আর ঠিক তখনই আমি বুঝতে পারলাম, আমার ভাগ্য কেন আমাকে ইউরোপের এই দূর্গম প্রদেশে এনে ফেলেছে। বিমানের ধ্বংসস’পের প্রায় বিশ মাইল নিচের এক ছোট্ট লোকালয়ে এসে আমি আবার সহযাত্রীদের কাছে থেকে বিদায় নিলাম। অন্যরা গাড়ীতে করে কাছের রেলস্টেশনে চলে গেল – সেখান থেকে নগর সভ্যতায় মিশে যাবে আবার। আমি একটা ছোট হোটেলে গিয়ে সাথের মালপত্র রেখে কিছু কেনাকাটায় বের হলাম। এক জোড়া ভারী বুট, এক জোড়া ব্রীচেস্‌, একটা জার্কিন আর কয়েকটা সার্ট কিনে পিঠে বেঁধে লোকালয়কে পিছনে ফেলে রওনা হলাম। যদিও আমার পথ প্রদর্শক বলেছিল পাহাড়ে ওঠার সময় নয় এটা, তবু আমি তা পরোয়া করলাম না।

আমার যাত্রাপথে আমি একা আবার সেই পাহাড়ের কোলে কি যে প্রশানি- আমি সারা অবয়ব ‘িয়ে অনুভব করছিলাম তা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। সেই যুবক বয়সের শক্তি আমার দুই পায়ে ফিরে এলো যেন, আমার ফুসফুস ফুলে উঠতে থাকলো আরও বেশী, আরও শীতল বাতাসে। আর কন্‌কনে ঠান্ডা বাতাস সারা শরীর এক অনাস্বাদিত আবেগে আল্পুত করে ফেললো। আমার মনে হলো এই পঞ্চাশ বৎসর বয়সেও চিৎকার করে মনের অবরুদ্ধ আবেগ ছড়িয়ে দেই। এত বৎসরের বিশৃংখলা আর অশানি-, বহুকাল ধরে মনের মধ্যে জমে ওঠা উদ্বেগ একমুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে গেল, নিরস নাগরিক ঔজ্জ্বল্য আর ঘ্রাণ এক ফুৎকারে উঠে গেল। আমি নিতান- উম্মাদ বলেই এতকাল এই সব সহ্য করে এসেছিলাম। মহা আনন্দে আর উৎসাহে আমি মন্টে ভেরিটার গোড়ায় পূর্ব দিকের উপত্যকায় এসে পৌঁছালাম। ভিক্টর আমাকে এই এলাকার যে বর্ণনা বহু বছর আগে দিয়েছিল, তার থেকে খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে আমার মনে হলো না। লোকালয়টা খুব ছোট আর আদিম, লোকগুলোকে আমার একগুঁয়ে আর নির্বোধ বলে মনে হলো। একটা ছোট অগোছালো পান’শালায় আমি রাত কাটাবো বলে সি’র করলাম।

ওদের ব্যবহার খুবই নির্লিপ্ত, যদিও অভদ্র নয়। রাতের খাবার সময় মন্টে ভেরিটার চূঁড়োয় ওঠার সহজ পথ সম্পর্কে জানতে চাইলাম।

যে লোকটা কাউন্টারের অন্যপাশে দাঁিড়য়ে আমার খাবার দিচ্ছিল, সে অবহেলা করে আমার কথার উত্তর দিলো, ‘উপরের গ্রাম পর্যন- যাওয়া খুব কষ্টের নয়, তার ওপারের পথ আমি জানি না।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘উপরের গ্রামে কি তোমাদের যাতায়াত আছে? ওরা কি আসা যাওয়া করে?’

সে উত্তর দিলো, ‘মাঝে, মাঝে, তবে এই মৌসুমে আসা-যাওয়া তেমন নেই।’

‘এখানে পর্যটকরা আসে না?’

‘খুব কম। ওরা উত্তরে যায় বেশী। উত্তরের দিকটা সহজ।’

‘গ্রামে কি থাকা-শোয়ার কোন জায়গা পাবো?’

‘বলতে পারবো না।’

আমি একটু চুপ করে থাকলাম, ওর গোমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যাসেরডোটেসারা কি এখনও মন্টে ভেরিটার ঐ পাহাড়ের উপত্যকায় থাকে?’

ও আমার কথায় চমকে উঠলো। আমার চোখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো একমুহূর্ত তারপর ঝুঁকে এলো, ‘তুমি কে? ওদের সম্পর্কে তুমি কি জানো? কতটুকু জানো?’

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে ওরা এখনও ওখানে আছে?’

ও আমার চোখের উপর চোখের রাখলো, ওর দৃষ্টিতে সন্দেহ। গত বিশ বছরে বহু কিছু ঘটে গিয়েছে – যুদ্ধ-বিগ্রহ, বিপ্লব, বিদ্রোহ, হিংসা-বিদ্বেষ, পিতার সাথে পুত্রের, গোত্রে-গোত্রে এমন কি এই দূরবর্তী এলাকাতেও এই সহিংসতার উত্তাপ এসে লেগেছে। এ কারণেই হয়তো তার যত সংশয়।

অনেকক্ষণ পর ধীরে ধীরে বললো, ‘কত গল্প রটে। এ সকল বিষয়ে নিজেকে না জড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ। পরিবেশ ক্রমে বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠছে। শিগ্রিই হয়তো সমস্যা হতে পারে।’

‘সমস্যা কাদের জন্য?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘যারা গ্রামে আছে, তাদের জন্য, মন্টে ভেরিটাতে যারা থাকতে পারে, তাদের জন্য এই উপত্যকাতে আমরা যারা আছি, তাদের জন্যও। আমি যত কম জানবো, ততোই কম সমস্যা হবে।

কথা এমনভাবে শেষ করলো, যাতে পরিস্কার বুঝতে পারলাম ও আর কোন কথা বলতে রাজী নয়।

‘সকালে কখন নাস-া খাবেন আপনি?’

আমি বললাম, ‘সকাল সাতটায়।’

তারপর ওখানে অপেক্ষায় না থেকে নিজের ঘরে চলে এলাম।

ঘরে এসে জোড়া জানালাটা খুলে অপ্রশস- বারান্দাতে এসে দাঁড়ালাম। ছোট জনপদটা শান-। অন্ধকারে অল্প কয়েকটা আলো দপ্‌দপ্‌ করছে। আকাশ ঝকঝকে পরিস্কার, আবহাওয়া ঠান্ডা, চাঁদটা বেশ বড় আর ভরাট। আর দুই একদিনের মধ্যেই পূর্ণিমা। ধুসর পাহাড়ের উপর চাঁদের স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আমার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হলো।

মনে হলো আমি যেন অতীতে চলে গিয়েছি। সে ঘরটাতে আমি এখন আছি, সে ঘরেই হয়তো ভিক্টর আর অ্যানা বহু বছর আগে রাত কাটিয়েছিল, সেই ১৯২৩ সালের গ্রীষ্মে। অ্যানা হয়তো সেই রাতে আমারই মতো বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে দূরের ঐ মন্টে ভেরিটার শৃঙ্গদু’টির দিকে তাকিয়েছিল। সেই সময় ভিক্টর কয়েক ঘন্টা পরের আসন্ন শোকাবহ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত না হয়েই হয়তো অ্যানার সাথে কথা বলছিল। আর বর্তমানে, তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমিও মন্টে ভেরিটার পায়ের কাছে এসে হাজির হয়েছি।

পরদিন সকালে নিচের কাফেটারিয়াতে এসে নাস-া খেতে এলাম। আমার গৃহকর্তা তখন ওখানে ছিল না। আমার খাবার আর কফি নিয়ে এলো একটা কিশোরী, সম্ভবতঃ তার মেয়ে। মেয়েটা খুব কমনীয় আর ভদ্র। ও আমার কিকে মিষ্টি হেসে সুপ্রভাত জানালো।

আমি বললাম, ‘আমি পাহাড়ে উঠতে যাচ্ছি। আবহাওয়া বেশ সুন্দরই মনে হচ্ছে। তুমি কি কখনও মন্টে ভেরিটায় উঠেছো?’

ওর চোখের দৃষ্টি হঠাৎ অন্য দিকে ঘুরিয়ে ফেললো। ও অন্য দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এই উপত্যকা ছেড়ে আমি কোথাও যাইনি।’

আমি অন্যমনস্কতার ভান করে কথা বলতে লাগলাম। আমি বললাম, ‘ আমি আমার এক বন্ধুর কাছে শুনেছি, ওরা ঐ পাহাড়ের চূঁড়োয় উঠেছিল। দুই শৃঙ্গের মাঝে একটা বড় চত্তর দেখেছিল, ওরা শুনেছিল, ওখানে নাকি এক অদ্ভুত সমপ্রদায় বাস করে, ওরা ওখানকার একটা দেয়াল দেয়া এলাকায় বাস করে।’ কথার এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি কিছু জানো? ওরা কি এখনও ওখানে আছে?’

মেয়েটা অস্বসি’বোধ করছিল, বারবার এদিকে ওদিকে শঙ্কিত দৃষ্টিতে দেখছিল আর কেউ ওকে দেখছে কিনা। তারপর মৃদুকন্ঠে বললো, ‘হ্যাঁ সেরকমই শোনা যায়। বাবা আমাদের সামনে এসব কথা আলোচনা করেন না। মানে, আমাদের সামনে এই সব কথা আলোচনা করা হয় না।’

আমি সিগারেট ধরালাম, ঠিক যে ধূমপান করার জন্য তা নয়, আমাদের দু’জনের মাঝে একটা আড়াল সৃষ্টি করার জন্য, যাতে আরও স্বাভাবিকভাবে কথা বলা যায়।

আমি বললাম, ‘আমি আমেরিকায় থাকি, সব জায়গার মতোই ওখানেও অল্পবয়সের ছেলেমেয়েরা নিষিদ্ধ বিষয় নিয়েই আলোচনা করতে পছন্দ করে বেশী।

মেয়েটি ম্লান হাসলো।

আমি বললাম, ‘আমার মনে হয়, যদিও বলা ঠিক হবে না, তুমি তোমার বন্ধুদের সাথে মন্টে ভেরিটার বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলো, তা’ই না?

এই কিশোরীটির সাথে ছোট্ট শঠতা করতে আমার খুব খারাপ লাগছিল; কিন’ আমার মনে হলো এভাবে কথা বললে হয়তো কোন তথ্য বেরিয়ে আসবে। ও আমার ফাঁদে পা দিলো।

‘ঠিকই বলেছেন। তবে যা কিছুই কথা বলি, তা সবই গোপনে। কিন’, এই সেদিন . .’

মেয়েটি হঠাৎ থেমে গিয়ে চারপাশটা আতঙ্কিত দৃষ্টি মেলে দেখে নিলো, আর একটু নিচু স্বরে বললো, ‘ আমার এক বান্ধবী, কয়েকদিন পরেই বিয়ে হবে, হঠাৎ চলে গেল। আর ফিরে এলো না। সবাই বলাবলি করছিলো, ওকে মন্টে ভেরিটা থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছে।’

‘কেউ ওকে যেতে দেখেনি?’

‘না। ও রাতের অন্ধকারে চলে গেছে। কাউকে কিছু বলেনি, কিছুই না।’

‘এমনও তো হতে পারে, ও কাউকে কিছু না বলে শহরে চলে গিয়েছে – রাজধানীতে কিম্বা কোন বড় পর্যটন কেন্দ্রে?’

‘মনে হয় না। তাছাড়া, চলে যাওয়ার কয়েকদিন আগে, ও কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করছিল, ঘুমের মধ্যে ও মন্টে ভেরিটার কথা বলতো।’

অন্যমনস্কভাব দেখিয়ে আমি একটুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। তারপর আগের মতো জিজ্ঞেস করলাম, ‘ মন্টে ভেরিটার মধ্যে কি এমন মোহিনী শক্তি রয়েছে? যে জায়গা, তাতে তো মনে হয় ওখানে জীবনধারণ খুবই কষ্টকর আর নিরানন্দময়।’

মেয়েটি ওর সারা অবয়ব দিয়েই যেন আমার কথাটার প্রতিবাদ করলো, ‘যাদের ডাক আসে তাদের জন্য না। ওখানে যারা থাকে তারা চির-যৌবনা, কখনো বার্ধক্য আর জ্বরা ওদের ছুঁতে পারে না।’

‘ওদের যদি দেখাই না যাবে, তাহলে কি করে বুঝবো ওখানে সবকিছু চির-নবীন?’

‘সবাই তাই বিশ্বাস করে। তেমন কথাই সবাই জানে। আর এটা সবাই জানে বলে এই উপত্যকার সবার এতো হিংসা, এতো ক্রোধ, এতো ঘৃণা; সেই সাথে এতো ভীতি। মন্টে ভেরিটার ওরা জীবনের রহস্য উন্মোচন করতে পেরেছে।’

মেয়েটি জানালা দিয়ে দূরের ঐ শিখরের দিকে তাকালো, ওর চোখেও অতৃপ্ত বাসনা, বিষণ্ন্নতা আর ব্যকুলতা। আমি আর একটু টোকা দিলাম।

‘আর তুমি? তোমার কি মনে হয় তোমারও ডাক আসবে?’

‘আমার মনে হয়, আমি ওদের মতো উপযুক্ত না, তাছাড়া আমার মন আতঙ্কে ভরপুর।’

ও আমার কফির সরঞ্জাম সরিয়ে নিয়ে গেল আর ফিরে এলো কিছু ফল নিয়ে।

‘আমার এই বান্ধবীটা হারিয়ে যাওয়াতে এখানে বেশ সমস্য দেখা দিয়েছে। সবই খুব ক্ষেপে গিয়েছে, এখানে কয়েকজন উপরের গ্রামে গিয়ে ওদেরকেও উত্তেজিত করে তুলেছে; সবাই এখন একত্রিত হতে চেষ্টা করছে। যাতে সবই মিলে ঐ জায়গায় হামলা করতে পারে। এখানকার বয়স্করা উম্মাদ হয়ে উঠেছে। ওখানে যাদেরকে দেখবে তাদেরকে হত্যা করবে। আর এমন কিছু হলে তো সমস্যা বাড়বে। পুলিশ-সেনাবাহিনী আসবে, তদন- হবে, জেল-জরিমানা, ফাঁসি, ফায়ারিং স্কোয়াড, সব কিছুই, একটা দুঃখজনক পরিণতি। সবার মনে তাই এক আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। নানা ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে।’

বাইরে কার পায়ের শব্দ শোনা যেতে মেয়েটি চট করে ঘরের অন্য কোনায় চলে গেল। অন্য একটা কাজে ব্যস- হয়ে পড়লো। আর তখনই মেয়েটার বাবা ঘরে ঢুকলো। আমার দিকে সন্দেহজনক চোখে একমুহূর্ত তাকিয়ে দেখলো, তারপর ওর মেয়ের দিকে তাকালো। আমি অত্যন- নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে একটা সিগারেট ধরালাম। দুই একটা টান দিয়ে ঘর থেকে বের হতে গেলাম। যাতে লোকটির মনে সন্দেহ বেশী জমাট না বাধে।

‘তা’হলে ঐ পাহাড়ে ওঠার সিদ্ধান-ই ঠিক আছে?’ লোকাটি আমাকে জিজ্ঞেস করলো।

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ দুই একদিনের মধ্যেই ফিরে আসবো।’

‘ঠিক আছে। তবে বেশী দিন ওখানে থাকা ঠিক হবে না।’

‘কেন, আবহাওয়ার অবস’া খারাপ হবে? ঝড়-বাদল?’

‘হ্যাঁ, ঝড়-বাদল তো আছেই। তা’ছাড়াও ওখানে বেশীদিন থাকা নিরাপদও হবে না।’

‘কেন, নিরাপদ নয়, কেন? কি হবে?’

‘গোলমাল দেখা দিয়েছে। সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। একটু আগে। লোকজনদের মেজাজ খুব খারাপ – মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে – কি হয় বলা যায় না। অপরিচিত আর বিদেশী দেখলে মারপিট আরম্ভ করতে পারে। আমার মনে হয় তোমার মন্টে ভেরিটায় ওঠার পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়া উচিত; সবচেয়ে ভাল হয় তুমি উত্তরে চলে যাও, ওখানে তোমার কিছু হবে না।’

‘ধন্যবাদ। কিন’ আমি মনসি’র করেছি মন্টে ভেরিটার চূড়াতেই উঠবো।’

লোকটি ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললো, ‘যা ভালো বোঝ কর। আমার বলার কি আছে।’

Leave a Reply