স্বর্গ মরীচিকা ২

এক গ্রীস্মে কানাডায় কাজ শেষ করে লন্ডনে ফিরে ভিক্টরের উচ্ছাসভরা চিঠি পেলাম। ও বিয়ে করতে যাচ্ছে। ওদের বাকদান হয়ে গিয়েছে। শিগ্রি ওদের বিয়ে হবে। মেয়েটি ওর চোখে সুন্দরতম। আমি যেন অবশ্যই ওর উকিল হই। এমন অবস’ায় অন্য যে কোন প্রকৃত বন্ধু যা করতো, আমিও তাই করলাম। তখনই চিঠি লিখে ওকে আমার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানালাম আার পৃথিবীর সকল সুখ আর আনন্দ যেন ওদের ঘরে বাঁধা পড়ে সেই আশা ব্যক্ত করলাম। আমি নিজে অবিবাহিত, তাই ওর বিয়ের খবরে আমার মনে হলো, আমি আমার একটা ভাল বন্ধু, শ্রেষ্ঠতম বন্ধু হারাতে চললাম। এ ব্যথা আমার বুকে বড় বেশী করে বাজলো।

ভিক্টরের হবু বৌ ওয়েল্‌সের অধিবাসী। ভিক্টরের গ্রাম, শ্রপশায়ারের কাছেই ওদের গ্রামের বাড়ী। ভিক্টর ওর দ্বিতীয় চিঠিতে লিখলো, ‘তুমি বিশ্বাসই করতে পারবে না, ও স্নোডন পাহাড়েই ওঠেনি কোন দিন। আমি ওকে পাহাড়ে ওঠার প্রথম পাঠ দেবো।’

চিঠি পড়ে মনে মনে ভাবলাম, একটা অনভিজ্ঞ মেয়েকে পাহাড়ে ওঠা শেখানোর চেষ্টা না করাই বোধ হয় ভাল।

তৃতীয় চিঠিতে ভিক্টর ও আর ওর বাগদত্তার লন্ডনে আসার তারিখ জানালো। বিয়ের কেনাকাটা আর ব্যবস’া করার জন্য ওরা লন্ডনে এলো। আমি একদিন ওদের নিমন্ত্রণ করলাম।

ভিক্টরের বৌ সম্পর্কে আমার মনে কেমন ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল তা বলতে পারবো না। সম্ভবত ছোট খাটো, ভারী উজ্জ্বল চোখের কোন ছেলেমানুষী চেহারার মেয়ের মতো হয়তো। কিন’ যে মেয়েটি ভিক্টরের সাথে আমার সামনে এসে বললো, আমি অ্যানা। তার দিকে আমি এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের দিনগুলোতে কুমারী মেয়েরা প্রসাধন ব্যবহার করতো না। অ্যানাও লিপস্টিক ব্যবহার করেনি, ওর সোনালী চুল কানের উপর পাকিয়ে পাকিয়ে ঝুলছিল। ওর অসামান্য সৌন্দর্য আমাকে হতবাক করে দিয়েছিল।

ভিক্টর হেসে উঠে বললো, ‘কি, আমি বলেছিলাম না?’

আমরা তিনজন একসাথে খেতে বসলাম আর অল্প সময়ের মধ্যেই অত্যন- সহজ সরলভাবে পরস্পর আলাপে মগ্ন হয়ে গেলাম। অ্যানা একটু গম্ভির প্রকৃতির মেয়ে হলেও ভিক্টরের ঘনিষ্টতম বন্ধু হওয়ায় আমার সাথে ও বেশ স্বাভাবিকভাবে ঘনিষ্ট হয়ে উঠলো।

ভিক্টরের সৌভাগ্যে আমি মনে মনে খুশি হলাম। ভিক্টরের উপসি’তিতে স্বাভাবিকভাবেই পাহাড়ে চড়ার কথা উঠে এলো।

আমি অ্যানার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুমি এমন একটা লোককে বিয়ে করতে যাচ্ছো, যার প্রধান সখ পাহাড়ে চড়া, অথচ তুমি নিজেই কোনদিন পাহাড়ে চড়োনি?’

অ্যানা উত্তর ‘িলো, ‘না আসলেই আমি কোনদিন পাহাড়ে উঠিনি।’

আমি ওর কথায় কেমন দ্বিধা লক্ষ্য করে অবাক হলাম। এক মুহূর্তের জন্য ওর সুন্দর দু’টি চোখে বিরক্তির ছাপ এসেই মিলিয়ে গেল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন? ওয়েল্‌সের বাসিন্দা হয়ে পাহাড়ে না ওঠা তো একেবারে অপরাধের মতো।’

ভিক্টর আমাদের মধ্যে কথা বলে উঠলো, ‘অ্যানার খুব ভয়। যখনই পাহাড়ে ওঠার কথা বলেছি, তখনই ও একটা না একটা অজুহাত দেখিয়ে পরিকল্পনা বাতিল করেছে।’

অ্যানা ভিক্টরের দিকে ফিরে বললো, না ভিক্টর, ও কথা ঠিক না, তুমি বুঝতে পারোনি। আমি পাহাড়ে উঠতে ভয় পাই না।’

ভিক্টর জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে কি?’

টেবিলের উপর রাখা অ্যানার হাতের উপর ভিক্টর ওর হাতটা রাখলো। আমি ওর চোখে আবেগ, ভালোবাসা আর অনুরাগের প্লাবন দেখতে পেলাম। ওরা দুজনে যে খুবই সুখী আর পরিতৃপ্ত দম্পতি হবে তা বুঝতে অসুবিধা হলো না। অ্যানা আমার দিকে ফিরে তাকালো, চোখ দিয়ে আমার মনটা ছুঁতে চাইলো যেন, আর তখন আমি বুঝতে পারলাম, ও কি বলতে যাচ্ছে।

ও বললো, ‘পাহাড়ের দাবীর কোন শেষ নেই। ওখানে সবকিছু দিয়ে দিতে হয়। আমার যে মানসিকতা, তাতে ওখান থেকে দূরে থাকাই ভালো।’

বুঝতে পারলাম, অ্যানা কি বলতে চাচ্ছে। ঐ সময় মনে হয়েছিল, আমি যেন ওর না বলা কথা বুঝতে পারছি। কিন’ ভিক্টর যেভাবে ওকে ভালবাসে আর অ্যানাও ওকে যতটা ভালবাসে, তাতে ওদের দুজনের একই সখ থাকলে তার চেয়ে আর কোন কিছুই ভাল হতে পারতো না, যদি অবশ্য অ্যানা ওর পাহাড়ে চড়ার প্রাথমিক আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারে।

আমি বললাম, এটাই আসল কথা। তুমি এই কথাটা ধরতে পেরেছো, অ্যানা, তোমাকে সব কিছুই দিয়ে দিতে হবে। কিন’ তোমরা দু’জনে মিলে সেটাকে জয় করতে পারবে। ভিক্টর তোমার ক্ষমতার অতিরিক্ত কিছু করতে দেবে না নিশ্চয়ই, ও আমার চেয়েও অনেক বেশী সতর্ক আর অভিজ্ঞ।

অ্যানা একটু হেসে ওর হাতটা ধীরে ধীরে ভিক্টরের হাতের বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে নিলো, তারপর বললো, ‘তোমরা দু’জনেই অত্যন- জেদী- আর তোমরা দুজনের কেউই বিষয়টা বুঝতে পারবে না। আমার জন্ম পাহাড়ের কোলে, আমি জানি আমি কি বলতে চেয়েছি।’

এমন সময় ওখানে আমাদের একজন বন্ধু এসে উপস্থিত হওয়ায় ঐ বিষয়টা চাপা পড়ে গেল।

ছয় সপ্তাহ পর ওদের বিয়ে হয়ে গেল। কনে হিসাবে অ্যানাকে অনন্যসাধারণ রূপবতী লাগছিল। ভিক্টরকে খুবই অপ্রতিভ আর বোকার মতো লাগছিল। বুঝতে পারছিলাম কি একটা বিশাল দায়িত্ব ওর কাঁধে এসে পড়লো। অ্যানার মতো এমন একজন সুন্দরী আর রূপবতী মেয়েকে সব সময় সুখী রাখা সত্যিই কঠিন। বিয়ের আগের ছয় সপ্তাহে আমি অ্যানাকে বেশ ঘনিষ্টভাবে লক্ষ্য করেছিলাম। যদিও ভিক্টরকে সেটা বুঝতে দেইনি। আর এর মধ্যেই অ্যানাকে আমার ভাল লেগে গিয়েছিল – এ এক ভিন্ন ধরনের ভালবাসা। অ্যানার প্রতি আমার এ আকর্ষণ কেবল ওর স্বাভাবিক সম্মোহনী শক্তি কিম্বা ওর দৈহিক সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং এই দুটি গুণের সমন্বয়ে ওর অন-ঃস’লে যে উজ্জ্বলতা সৃষ্টি করতো, সেটাই আমাকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল। আমার মনে একটা অদ্ভুত অস্বসি-বোধ দেখা দিয়েছিল – ভিক্টর বড় বেশী উদ্দাম আর চঞ্চল – আর ওর এই চঞ্চল, খোলামেলা, হালকা ব্যবহারে শান- অ্যানা হয়তো নিজের মধ্যে আরও বেশী গুটিয়ে ফেলবে। তা সত্ত্বেও ওরা দু’জনে একজন যেন অন্যজনের, দু’জনে-দু’জনার। অনুষ্ঠান শেষে ওরা যখন চলে গেল – ওদের সুখী জীবনের জন্য মনে মনে প্রার্থনা করলাম। ভাবলাম আর কিছুদিন পর হয়তো ওদের ওখানে যাবো, ওদের প্রথম সন-ানের আবির্ভাবের সময়।

ওদের বিয়ের পর আটমাস আমাকে ব্যবসায়িক কাজে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হলো। ক্রিসমাসের আগে ভিক্টর সেবারের ক্রিসমাসটা ওদের সাথে কাটাবার জন্য নিমন্ত্রণ করে চিঠি দিলো আর আমিও রাজী হয়ে গেলাম।

আট মাস পর আমরা আবার একসাথে হলাম। ভিক্টরকে খুবই সুখী আর পরিতৃপ্ত মনে হলো আমার কাছে, আর অ্যানা আগের চেয়েও অনেক বেশী সুন্দরী হয়ে উঠেছে। আমি তো ওর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। ওরা দু’জনেই আমাকে সাদরে গ্রহণ করলো। ভিক্টরের এই সুন্দর পুরানো খামার বাড়ীটাতে আমি আগেও এসেছি। তাই আমি যেমন এখানে এসে আরাম পেলাম, তেমনই অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা এক অসাধারণ সখ্যতায় আবদ্ধ হয়ে পড়লাম। ওদের বিবাহিত জীবন যে খুব আনন্দে কাটছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এত দিনে ওদের বংশধর আসার সংবাদ না থাকলেও আমার মনে হলো তার জন্য আরও অনেক সময় পড়ে আছে।

ভিক্টরের বাড়ীটার বড় বড় অপরিকল্পিত ঘর – ভাঁজ করা জানালা – সব কিছু মিলিয়ে বাস করার জন্য চমৎকার – কিন’ এখন এই শান- পরিবেশ যেন আরও ঘনিভূত হয়ে উঠেছে, গভীর-গহীনভাব ধারণ করেছে। আমার মনে হতে লাগলো ঐ বাড়ীটার প্রতিটি ঘরে নিঃস-ব্ধতা ধীরে ধীরে যেন চেপে বসছে। এই নিস-ব্ধতা অ্যানার অন-রের গভীর থেকে উৎসরিত সারা বাড়ীতে ছড়িয়ে যেতো – সব কিছুর উপর প্রভাব ফেলতো। আমরা বাগানে বেড়াতাম, পাখি শিকার করতাম, সন্ধ্যায় বই, পত্র-পত্রিকা পড়তাম, গল্প করতাম, – মোট কথা তিনজনে মিলে এক হয়ে যেতাম।

আমি বুঝতে পারলাম ভিক্টর এই অল্প সময়ের মধ্যেই অ্যানার শান- স্বভাবের কিছুটা আত্মস’ করতে আরম্ভ করেছে নিজের মধ্যে, ও অ্যানার নিস্তব্ধতাকে গ্রহণ করে নিয়েছে, নিস্তব্ধতা কথাটি ব্যবহার করলাম, কারণ অ্যানার ক্ষেত্রে কেবল এই কথাটাই প্রযোজ্য। এই শান- নৈশব্দ্য যেন আমাকেও প্রভাবিত – আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগলো।

সেই ক্রিসমাসের দিনগুলোর কথা এখন মনে পড়লে খুব আশ্চর্য লাগে। সেই কয়টা দিনের কোন আনুষ্ঠানিকতার কথা মনে পড়ে না আমার।

মনে পড়ে না কি খেয়েছিলাম, গীর্জায় গিয়ে প্রার্থনা করেছিলাম কি না। ভিক্টর যখন গ্রামের প্রধান তখন নিশ্চয়ই ওখানে যেতে হয়েছিল। কিন’ যে সব ঘটনা বার বার মনে পড়তো তা হলো শীতের সেই সব সন্ধ্যাগুলোতে ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে ফায়ার প্লেসের ধারে আমরা চুপ করে থাকতাম। কিছুদিন আগে আমার ব্যবসায়িক কাজের ব্যস-তার কারণে সম্ভবত আমি একটু বেশী ক্লান- হয়ে পড়েছিলাম। তাই ভিক্টর আর অ্যানার বাড়ীতে সারাটা সময় চুপ করে বিশ্রাম করাটাকে আমি খুব উপভোগ করছিলাম, অন্য কিছু করতে ইচ্ছেই করতো না। এই প্রশান্তি আমার কাছে পরম আশীর্বাদের মতো মনে হতো।

বাড়িটার আর একটা পরিবর্র্তন আমার চোখে পড়েছিল; ওদের বাড়িতে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই। ওদের ঘরগুলো যেন আরও বেশী ফাঁকা – আগেও ফাঁকা লাগতো – কিন্তু এখন যেন আরও বেশী ফাঁকা লাগলো আমার চোখে। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া প্রাচীন আসবাবপত্রগুলো যেন একেবারে হাওয়ায় উবে গিয়েছে। সব কয়টা ঘরের মতো যে বড় হল ঘরটায় আমরা বসতাম, সেখানে আগুনের পাশে কেবল কয়েকটা চেয়ার আর একটা বড় টেবিল ছাড়া আর কিছুই নেই। বাড়ীতে মেয়েমানুষ থাকলেই চাদর, পর্দা, এসব জিনিষের প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায়, এগুলোই ঘরে মেয়েলী ছাপ এনে দেয়, যা অবিবাহিত পুরুষের ঘরে দেখা যায় না। কথাটা এক সময় ভিক্টরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও নিজের চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিয়েছিল, ‘ও, হ্যাঁ। পুরোনো জিনিষগুলো আমরা সরিয়ে ফেলেছি। আনাই বলেছে ওগুলো সরিয়ে ফেলতে। ওর ঐ সব জিনিষপত্রে তেমন আগ্রহ নেই। বিক্রি করিনি – সব দান করে দিয়েছি।

যে ঘরটাতে ওরা আমাকে থাকতে দিয়েছিল, সেটাতে আগেও এসে আমি থাকতাম। ওটা তখনও ঠিক আগের মতোই ছিল। তাই আমি আগের মতোই আরাম বোধ করছিলাম। গরম পানির ব্যবস’া, ভোরে চা, বিছানার পাশে থাকতো বিস্কুট, মাঝরাতে যদি আমার প্রয়োজন হয়, থাকতো সিগারের বাক্স – সবকিছুর মধ্যেই স্নেহময়, বুদ্ধিমতী গৃহকর্তীর হাতের ছোঁঁয়া।

তবু এসবের মধ্যেও একদিন উপর থেকে নিচে নামার সময় অ্যানার ঘরের দিকে চোখ পড়লো আমার। সব সময়েই ঘরের দরজাটা বন্ধ থাকতো, সেদিন খোলা ছিল। আগে ওটাতে ভিক্টরের মা থাকতেন – ভারী জাজিম দেয়া, নক্সা করা বড় খাট আর ভারী ভারী আসবাবপত্র, বাড়ির অন্যান্য ঘরের সাথে মিল রেখে এই ঘরটাকেও সাজানো হয়েছিল। সেদিন কৌতুহলী হয়ে ঐ ঘরটার দরজাটা খোলা দেখে ভিতরে তাকিয়ে দেখি ঘরটাতে কোন আসবাবপত্র নেই। জানালায় কোন পর্দা ঝুলছে না, মেঝেতে কোন গালিচা নেই, কাঠের দেয়ালগুলোও ফাঁকা। ঘরের একপাশে কেবল একটা টেবিল আর চেয়ার, হালকা আড়ম্বরহীন কাঠের বিছানা – আর কিছু নেই। এই শীতের সন্ধ্যাতেও জানালাগুলো খোলা।

মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এলাম। সিঁড়ির গোড়ায় ভিক্টরের সাথে মুখোমুখি হলাম। ও উপরে উঠছিল। সম্ভবত আমাকে আনার ঘরে উঁকি দিতে দেখেছিল আর আমি লুকানো পছন্দ করি না।

ওকে তাই অকপটে বললাম, ‘উঁকি দেয়ার জন্য দুঃখিত। কিন’ তোমার মায়ের সময়ের ঘরটাতো অনেক বদলে দেয়া হয়েছে, মনে হলো।’

ভিক্টর ছোট্ট করে উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ। অ্যানা কৃত্রিমতা পছন্দ করে না। তুমি কি এখন খেতে আসবে? অ্যানা জানতে চাইলো।’

আমরা আর কোন কথা না বলে নিচে নেমে এলাম। আমার ঘরের আড়ম্বরের সাথে অ্যানার মতো নরম একটা মেয়ের বৈভবহীন ঘরের তুলনা করে অস্বস্তি লাগলো। নিজেকে বড়ই নিকৃষ্ট মনে হতে লাগলো; মনে হলো অ্যানা আমাকে আরামপ্রিয় আর আয়েসী মনে করে অনুকম্পা করছে; অথচ ও কতো অনায়াসে এই সব আয়েসী জিনিষ ত্যাগ করতে পারছে।

সেই সন্ধ্যায় বসার ঘরে আগুনের ধারে যখন আমরা তিনজনে বসেছিলাম, ভিক্টর একটা কাজে উঠে বাইরে চলে গেল। আমি আর অ্যানা কিছুক্ষণ একা বসে থাকলাম। একটা অদ্ভুত অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা আমাদের দু’জনকে ভারী কম্বলের মতো জড়িয়ে রাখলো। এই নৈশব্দময় শান্ত অনুভূতির সাথে আমার আগে কখনও পরিচয় ছিল না। আমি বুঝতে পারছিলাম এই অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা অ্যানাই তৈরী করছিল – না, ভুল বললাম; ঠিক অ্যানা নিজে তৈরী করছে না, সে কোন অজ্ঞাত স্থান থেকে এ নিস্তব্ধতা উৎসরিত করছে। আমার কথা বলার ইচ্ছা করছিল, কিন্তু বিষয় খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

শেষে বললাম, ‘তুমি এ বাড়িটা অনেক পরিবর্তন করে ফেলেছো দেখলাম। কেন, তা’ বুঝতে পারলাম না।’

ও উত্তর দিলো, ‘বোঝনি? আমার তো মনে হয় তুমি বুঝতে পেরেছো। আমার মতো তুমিও তো একই জিনিষের প্রত্যাশী, নয় কি?’

আমার সারা দেহে এক অদ্ভুত আতঙ্কের শিহরণ বয়ে গেল। নিস্তব্ধতা আরও ঘনীভূত হয়ে আমাদের চারপাশে চেপে বসলো।

‘আমি ঠিক বুঝলাম না, আমি কি খুঁজছি?’

আমার কথাগুলো যেন ফাঁকা, অর্থহীন বুলির মতো ঘরের নৈশব্দের মধ্যে হারিয়ে গেল। আমি আগুনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, মুখ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালাম। মনে হলো ও আমাকে ওর দিকে তাকাতে বাধ্য করলো।

ও বললো, ‘কি খুঁজছো, তা’ কি তুমি সত্যিই জানো না?’

সেই একই আতঙ্কময় শিহরণ আমার দেহে আবার ছড়িয়ে পড়লো। নিজেকে নিজের কাছেই খুব মূল্যহীন আর অকিঞ্চিতকর বলে মনে হতে লাগলো। এই প্রথম মনে হলো আমরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন- কেবল উদরপূরণ আর সুন্দর পোশাকে দেহ আবৃত করে আরামদায়ক ঘরে শুয়ে-বসে সম্পূর্ণ অকারণে অপ্রয়োজনীয় সক্রিয়তায় গুরুত্বহীন একদল মানুষের সাথে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘোরাফেরা করছি, উড়ন্ত পোকামাকড়ের মতো। এই সাথে আমার ওয়েস্টমিনিস্টারের বাড়িটার কথা মনে পড়ে গেল – কতো যত্নে; কতো মূল্যবান আর আরামদায়ক আসবাবপত্র দিয়ে, বইপত্র, ছবি, সেরামিক সামগ্রী জড়ো করে বাড়িটা সাজানো হয়েছে। আমার দুই জন বিশ্বস্ত আর বশংবদ সহকারী আমার আগমন অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে বাড়ির সবকিছু ঝক্‌ঝকে পরিস্কার করে রাখছে। এত দিন আমার এই গৃহাঙ্গন কেবল তৃপ্তি আর সুখানুভূতি দিয়ে এসেছে। অথচ আজ এই মুহূর্তে আমার মনে হতে লাগলো এতো জৌলুষ আর বৈভবের যেন কোনই মূল্য নেই, সবই মেকী, সবই অকিঞ্চিতকর।

আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘তোমার কি মনে হয়, আমার সমস- সম্পদ, বাড়িঘর বিক্রি করে দেবো? আমার সব কাজকর্ম, দায়দায়িত্ব সব ঝেড়ে ফেলে দেবো? তারপর কি করবো? কি হবে?’

কথা কয়টা কিভাবে আমার মুখ থেকে বের হয়ে এলো তা’ বুঝিই পেলাম না। অথচ এক মুহূর্ত আগে অ্যানা এমন কোন কথা বলেনি, যার উত্তরে এমন কথা বলতে হলো। ও তো কেবল বলেছিল, আমি অন্য কিছুর সন্ধানে আছি কি না। এর উত্তরে সরাসরি না কিম্বা হ্যাঁ না বলে আমি কিনা ওকে উল্টে প্রশ্ন করলাম, আমি সব কিছু ছেড়ে দেবো কি না। এমন ধরণের কোন কথা আমার কল্পনাতেও আসেনি কখনো। কথা কয়টা বলার পর এর গুরুত্বও আমার বোধগম্য হয়নি। কেবল বুঝতে পারছিলাম, এই কথা কয়টা আমাকেও কেমন অদ্ভুতভাবে নাড়া দিলো, আর কিছুক্ষণ আগে আমার মনের মধ্যেকার যে প্রশানি- বাসা বেঁধে ছিল, তা একমুহুর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল আর আমি এক অজ্ঞাত অশানি-র আবর্তে ডুবে যেতে থাকলাম।

আমার প্রশ্নের উত্তরে অ্যানা শান- কন্ঠে বললো, ‘তোমার প্রশ্নের উত্তর আমার উত্তরের সাথে নাও মিলতে পারে, আর আমি নিজেও সঠিকভাবে জানি না আমার প্রশ্নের সমাধানটা কেমন হবে।’ একটু থেমে ও আবার বললো, ‘একদিন হয়তো জানতে পারবো, ঠিকই জানতে পারবো।’

ওর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, ও এর উত্তরটা জানে – এখনই। ওর সৌন্দর্য, ওর স্নিগ্ধতা, ওর অন-র্দৃষ্টি, সবকিছুর মধ্যেই এর উত্তর আছে। ওর আর চাওয়ার কি বাকি আছে? পাওয়ারও আর কি অবশিষ্ট আছে? এই মুহূর্তে কেবল একটি সন-ানের মুখ দেখার দুর্নিবার আকাঙ্খা ছাড়া আর তো কিছু চাওয়ার নেই।

এই সময়েই ভিক্টর ঘরে ঢুকলো, আর তার এ ঘরে ঢোকার সাথে সাথে ঘরের মধ্যে কেমন একটা বলিষ্ঠতা আর উত্তাপ ছড়িয়ে পড়লো; ওর সারা অবয়ব আর পোশাকে কেমন একটা আপন করা পরিচিতি আরামদায়ক অনুভব যা এতক্ষণ এ ঘরে ছিল না।

‘ওহ্‌, বাইরে কি অসম্ভব জমাট ঠান্ডা। একটু বাইরে গিয়েছিলাম দেখতে। পারদ নেমে গেছে হিমাঙ্কের ত্রিশ ডিগ্রির নিচে। সুন্দর রাত, আকাশে পুর্ণিমার চাঁদ।’

বলতে বলতে ও চেয়ার টেনে নিলো আগুনের আরও কাছে, অ্যানার দিকে তাকিয়ে মিস্টি করে হাসলো, ‘আমরা যখন স্নোডনে উঠেছিলাম, সেদিনকার মতো ঠান্ডা। তাই না? আরে সর্বনাশ, আমি তো একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম।’ বলে ও আমার দিকে ফিরে তাকালো, হেসে ফেলে বললো, ‘তোমাকে বলিনি? নাকি বলেছি? অ্যানা পাহাড়ে উঠতে রাজী হয়েছে।

আমি চমকে উঠলাম, ‘না! আমি তো জানতাম, ও পাহাড়ে চড়ায় বিপক্ষে ছিল সবসময়।’

আমি অ্যানার দিকে তাকালাম। লক্ষ্য করলাম ওর চোখ দু’টো হঠাৎ যেন ফাঁকা আর অভিব্যক্তিহীন হয়ে গেছে। বুঝতে পারলাম ও চায়নি ভিক্টর এ বিষয়টা নিয়ে আলাপ করবে। ভিক্টর ওর এই অনুভূতি সম্পর্কে না বুঝেই কথা বলে গেল।

‘আসলে ও একেবারে অসাধারণ। এতকাল এই শক্তি ও লুকিয়ে রেখেছিল। আমি আর তুমি পাহাড়ে ওঠা যতটা জানি ও তার চেয়ে কম জানে না। সারাটা সময় ও আমার আগে আগেই ছিল, এক সময় তো আমি ওকে হারিয়েই ফেলেছিলাম।

ওদের অভিজ্ঞতার কথা কখনও হাসতে হাসতে, কখনও গম্ভীরভাবে পর্বতারোহনের খুঁটিনাটি ঘটনা বলে গেল।

সকালের চমৎকার ঝকঝকে মিষ্টি আবহাওয়া বিকাল হতে না হতে বর্জ্রপাত, শিলাবৃষ্টি, আর তুষারঝড়ে পরিণত হয়ে গেল, এমনই অবস’া হলো নামার সময়, যে আধহাত দূরের জিনিষও দেখা যায় না, ফলে রাতটা খোলা আকাশের নিচে কাটাতে হলো ওদের।

ভিক্টর বললো, ‘একটা জিনিষ আমার কিছুতেই বোধগম্য হয়নি, কিভাবে আমি অ্যানাকে হারিয়ে ফেললাম। এক মুহূর্ত আগে ও আমার পাশে ছিল, তার পরেই সে নেই। দীর্ঘ তিনঘন্টা সময় ঐ নিচ্ছিদ্র অন্ধকার আর তুষার ঝড়ের মধ্যে আমি কিভাবে যে কাটালাম তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না।’

ভিক্টরের এই দীর্ঘ বর্ণনার সারা সময়টা অ্যানা একটা কথাও উচ্চারণ করলো না। মনে হলো সে যেন নিজেকে একেবারে গুটিয়ে রেখেছে। ও ওর চেয়ারে নিশ্চল, নিঃশব্দ অবস’ায় বসে থাকলো। আমার খুব অস্বসি- লাগলো, শঙ্কিত হয়ে ভিক্টরকে থামাতে চাইলাম, ‘যাই হোক। তুমি শেষে ঠিক মতো নেমে এসেছিলে কোন খারাপ কিছু ঘটেনি।’

মুখ গোমড়া করে ভিক্টর বললো, ‘হ্যাঁ! ভোর পাঁচটায় আগাগোড়া ভিজে আতঙ্কিত হয়ে যখন আমার একেবারে ভেঙে পড়ার অবস’া; তখন অ্যানা এসে হাজির হলো ঘন কুয়াশা ভেদ করে, একেবারে খট্‌খটে শুকনো, ঝরঝরে। আমাকে রাগ করতে দেখে অবাক হলো। ও বললো, একটা পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছিল। ও যে ঘাড় ভেঙে কোন ফাটলের তলায় পড়ে থাকেনি, সেটাই আশ্চর্যের। আমি বলেছি আগামীতে পাহাড়ে উঠলে গাইড হয়ে ও আমার পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।

আমি আড়চোখে অ্যানার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘সেই আগামী দিন যেন আর না আসে। একটা অভিযানই যথেষ্ট।’

ভিক্টর উচ্ছলভাবে বললো, ‘আরে না, বললেই হলো? আমরা তো সব ঠিক করে ফেলেছি, এই গ্রীষ্মেই আবার যাবো। আল্পস্‌ কিম্বা ডলোমাইটে, পীরেনিজেও যেতে পারি- এখনও মনসি’র করতে পারিনি। তুমিও আমাদের সাথে যাবে, আমাদের এই যৌথ অভিযান জমবে ভাল।’

আমি উত্তর দিলাম, ‘তোমাদের সাথে যেতে পারলে খুব খুশী হতাম। কিন’ তা হবার নয়। মে মাসে আমাকে নিউ ইয়র্কে থাকতে হবে আর সেপ্টেম্বরের আগে বাড়ি ফিরতে পারবো না।

‘এতো আগে কোন কথা বলো না। মে মাসের আগে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে। ঠিক আছে, এ নিয়ে পরে আলাপ করা যাবে,’ উৎফুল্ল গলায় ভিক্টর বললো।

এই দীর্ঘ কথাবার্তার মধ্যে অ্যানা একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। আমি অবাক হলাম ওর এই বোবা হয়ে থাকাটা ভিক্টরের চোখে ধরা পড়ছে না কেন।

হঠাৎ অ্যানা উঠে শুভরাত্রি জানিয়ে উপরে চলে গেল। বোঝাই গেল এই পাহাড়ে ওঠা নিয়ে কথাবার্তা আনা মোটেই পছন্দ করছে না। আমি ভাবলাম এ নিয়ে ভিক্টরকে কিছু বলা উচিৎ।

‘শোন ভিক্টর, তোমাদের এই পাহাড়ে ওঠার বিষয়টা নিয়ে আর একবার ভেবে দেখো। আমার তো মনে করেছিলাম, অ্যানা সম্ভবত বিষয়টা ঠিক পছন্দ করছে না।’

ভিক্টর অবাক হয়ে বললো, ‘অ্যানা পাহাড়ে ওঠা পছন্দ করে না, কি বলছো তুমি? এবারের এটাতো ওরই পরিকল্পনা।’

এবার অবাক হবার পালা আমারই, ‘সত্যি বলছো?’

‘অবশ্যই! শোন, ও বরাবরই এ বিষয়ে উম্মাদ, বলতে পারো – পাহাড়ের প্রতি ওর আজন্ম পাগলামী বুকের মধ্যে লালন করে এসেছে। বোঝই তো, ওয়েলসের পাহাড়ী মাটিতে ওর জন্ম। স্নোডনের ঘটনা বলতে গিয়ে আমি অবশ্য একটু আবেগপ্রবণ হয়েছিলাম, কিন’ ওর অসাধারণ সাহস আর সহ্য ক্ষমতা দেখে আমি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। আমার স্বীকার করতে লজ্জা নেই ঐ তুষার-ঝড়ের তান্ডবে আর অ্যানাকে নিয়ে দুশ্চিন-ায় ভোরের দিকে আমি একবারে মরণাপন্ন হয়ে পড়েছিলাম। অথচ অ্যানা যখন কুয়াশা ভেদ করে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, আমার মনে হলো ও অন্য গ্রহের কোন অধিবাসী। আগে কখনও ওর এমন চেহারা দেখিনি। পাহাড় থেকে আমরা যখন নামছিলাম ক্লানি- আর অবসাদে আমার শরীর বিধ্বস-, আমি খোঁড়াচ্ছিলাম। অথচ অ্যানা যেন পাখির মতো হালকা হাওয়ায় উড়তে উড়তে নামছিল। ওর সমস- কিছুই অসাধারণ। তাই না?’

আমি ধীরে ধীরে উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ, সত্যিই ও অসাধারণ।’

কিছুক্ষণ পর আমরা যে যার ঘরে ঘুমাতে গেলাম। আমি ঘরে ঢুকে কাপড় বদল করলাম। শোবার কাপড় আগুনের ধারে সুন্দরভাবে ভাজ করে রাখা, বিছানার ধারের ছোট টেবিলের উপরে থার্মোফ্লাস্কে গরম দুধ, রাতে ঘুম ভেঙে গেলে যদি ক্ষুধা লাগে, ঘরের মেঝেতে ভারি কার্পেট আর আরামদায়ক ভারী স্লিপার। এসব দেখে অ্যানার খালি, ফাঁকা আর আড়ম্ব্বরহীন ঘরটার কথা মনে পড়ে গেল। বিছানার উপরে কম্বলের উপরে রাখা চমৎকার ভারি সাটিনের লেপটা টান মেরে তুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম নিস্ফল আক্রোশে, জানালার দিকে গিয়ে ওগুলো খুলে দিলাম।

খুব অসি’র লাগছিল আমার, ঘুম আসছিল না। ঘরের আগুন ধীরে ধীরে কমতে থাকলো আর খোলা জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঘরের আবহাওয়াতে শীতল করে তুললো। শুয়ে শুয়ে ঘড়ির টিক্‌টিক্‌ শব্দ শুনতে থাকলাম। ভোর চারটার দিকে আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। থার্মোফ্লাস্কে রাখা গরম দুধের কথা মনে পড়তে ভাল লাগলো। দুধ খাবার আগে ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করা দরকার বলে মনে হলো।

শীতে কাঁপতে কাঁপতে বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গেলাম ওগুলো বন্ধ করতে। ভিক্টর ঠিকই বলেছিল। চারদিক সাদা কুয়াশায় ঢাকা, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। আমি সবকিছু ভুলে গিয়ে ঐ অসম্ভব সুন্দর দুধ-সাদা জ্যোৎস্না আর ঘন সাদা কুয়াশার দিক তাকিয়ে থাকলাম। আর তখনই আমার চোখে পড়লো একটা মানুষ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আমার জানালার নিচে দাঁড়ালো। ওর চলা চোরের মতো নিঃশব্দে কিম্বা অনাধিকার প্রবেশকারীর মতো সাবধানী পদক্ষেপে ছিল না। সে যেই হোক না কেন, ওর দেহটা নিস্পন্দ হয়ে চাঁদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে থাকলো – যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে গেল।

তখন আমার মনে হলো, ও অ্যানা। ওর দেহ পা পর্যন- লম্বা শোবার পোষাক, কোমরের কাছে কেবল একটা ফিতা দিয়ে বাঁধা, ওর চুলগুলো খোলা, কাঁধ পর্যন- ঝুলছে। ঐ কনকনে ঠান্ডা আবহাওয়ায় ও শব্দহীন নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো, আর তখনই অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ওর পা দুটো খালি। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম, আমার হাত দুটো তখন জানালার কপাট ধরে আছে। হঠাৎ মনে হলো, এমন একটা গোপন আর একান- আপন বিষয়ের উপর আমার চোখ পড়েছে, যার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি অনাধিকার চর্চা করছি।

তাড়াতাড়ি নিঃশব্দে জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় ফিরে এলাম। মনের গভীরে আমাকে কে যেন বলে উঠলো, এ বিষয়টা ভিক্টরকে জানানো উচিৎ হবে না, অ্যানাকে তো নয়ই; আর এই কারণে মনটা খুব অসি’র হয়ে উঠলো, কেন জানি না আতঙ্কে শিউরে উঠলাম।

পরদিন প্রকৃতি ঝলমল করে উঠলো, উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় সবকিছু ঝরঝরে লাগছিল। আমরা সবাই কুকুর নিয়ে শিকারে বের হলাম। অ্যানা আর ভিক্টরকে এতো স্বাভাবিক আর উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল যে আমার মনে হলো গতরাতে হয় তো খুব বেশি উত্তেজিত ছিলাম বলে আজে বাজে কথা মনে এসেছিল। অ্যানা যদি শীতের শেষ রাতে খালি পায়ে বাগানে হাঁটা পছন্দ করে তবে সেটা তার ব্যাপার, আমি সে বিষয়টা দেখে ফেলে গুরুতর অপরাধ করেছি।

পরবর্তী দিনগুলোতে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটলো না। আমরা এতো আনন্দে সময়টা কাটিয়ে দিলাম যে, ওদের ছেড়ে চলে আসতে খুব খারাপ লাগছিল।

Leave a Reply