হঠাৎ করে আমার চেতনা ফিরে এলো, কোন এক গভীর নিদ্রাময়তা থেকে চমকে উঠে সজাগ হলাম আর তখনই মনে হলো এক মুহূর্ত আগেও যেন আমি একা ছিলাম না, আমার পাশে কেউ যেন একজন ছিল, হাঁটু গেড়ে আমার ঘুমন- মুখের দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে ছিল।
আমি উঠে বসে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম – সারা শরীর ঠান্ডা আর অবশ। একটা দশ ফুট লম্বা ছোট্ট কুঠুরীর মধ্যে আমাকে রাখা হয়েছে, অস্পষ্ট, ঝাপসা আলো পাথরের দেয়ালের সরু ফাটলের মধ্যে দিয়ে ঘরটাকে আলোকিত করেছে। আমি আমার ঘড়ির দিকে তাকালাম, সোয়া পাঁচটা; আমি চার ঘন্টারও বেশী সময় অজ্ঞান অবস’ায় ছিলাম। ঘরের অন্ধকারকে তরল করে দিচ্ছে বাইরের ভেরের আলো।
জেগে ওঠার পর আমার মনে প্রথম যে অভিব্যাক্তি দেখা দিলো, তা’ হলো ক্রোধ। আমাকে বোকা বানানো হয়েছে! মন্টে ভেরিটার নিচের উপত্যকার অধিবাসীরা আমাকে মিথ্যা বলেছে, ভিক্টরও আমাকে মিথ্যা বলেছে। যে হাত দু’টো আমাকে ধরে টান দিয়েছিল, যে কিশোর কন্ঠের হাসির শব্দ আমি শুনেছিলাম, আর সবই গ্রামের অধিবাসীদের। যে লোকটা আর তার ছেলে আমাকে এই পর্বত শিখরে ওঠার পথের নিশানা দেখিয়ে দিয়েছিল, ওরাই এখানে আমার অপেক্ষায় ছিল। ওরা নিশ্চয়ই এই দেয়ালের এধারে আসার অন্য কোন পথ চেনে। দীর্ঘ সময় ধরে ওরা ভিক্টরকে বোকা বানিয়ে এসেছে আর এখন আমাকে বোকা বানাচ্ছে। ঈশ্বর জানেন ওদের আসল উদ্দেশ্য কি! নিছক বাটপারিও হতে পারে। কিন’ গায়ের কাপড় ছাড়া আমার তো সঙ্গে আর কিছুই নেই। এই কুলুঙ্গি ঘরটা, আমি এখন যেখানে আছি, সেটা একেবারে ফাঁকা। কোন লোক এখানে থাকে বলে মনে হলো না, এমন কি শোয়ার জন্য একটা কাঠের তক্তা বা পাটাতনও নেই। একটা আশ্চর্যের বিষয় হলো – আমাকে ওরা বেঁধে রাখেনি। এই কুটুরিটার কোন দরজাও নেই। দরজা – না, দরজা নয়, একটা পাথরের ফাটল – ওটা দিয়েই বের হয়ে যেতে হয়।
আমি ভোরের আলো উজ্জ্বল হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকলাম, যাতে চারদিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে; তাছাড়া হাত-পায়ের শক্তি বাড়ার জন্যও অপেক্ষার প্রয়োজন ছিল। অন-রের অন-স’ল থেকে কে যেন বললো, অপেক্ষা করো। এই আবছা আলো-আঁধারীর মধ্যে বাইরে বের হতে গেলে, হয়তো হোঁচট খেতে পারি, পড়ে যেতে পারি, হয়তো সিঁড়ি কিম্বা সরু গলিপথ দিয়ে চলতে গিয়ে পথ হারিয়ে যেতে পারি – এখানকার কিছুইতো আমি চিনি না।
দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে আমার রাগও বেড়ে যেতে থাকলো, অবশ্য সেই সাথে এক অদ্ভুত হতাশাও মনকে ভরে করে রাখছিল। মনে উদগ্র বাসনা হলো, ঐ লোকটা আর তার ছেলের মুখোমুখি হয়ে চরম বোঝাপড়া করা জন্য, প্রয়োজনে ওদের গায়ে হাত তোলার জন্যও মনসি’র করে ফেললাম। কেবল আমাকে কেন আর কারও সাথে যেন ও আর এই জঘন্য খেলা খেলতে না পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্যও মানসিক প্রসদতি নিয়ে ফেললাম। পরক্ষণে মনে হলো, এমনও তো হতে পারে, ওরা এখানে আমাকে ফেলে পালিয়ে চলে গেছে, আর আমি বাইরে যাবার পথ খুঁজে পাবো না। এমনও তো হতে পারে অপরিচিত সবার সাথেই ওরা এমন খেলা খেলে থাকে – যে নিঃসঙ্গ পর্যটক এ অঞ্চলে আসে তাদের ভুলিয়ে নিয়ে আসে এখানে – এই দেয়ালের ভিতরে – তারপর ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হয়ে এক সময় মরণের কোলে ঢলে পড়ে সেই হতভাগ্য। এমন খেলা এই দুইজন – এদের আগে ভিক্টরের সময়ে সেই বৃদ্ধ তারও আগে অন্যান্য অধিবাসীরা বিভিন্ন সময়ে মেয়েদেরকে ভুলিয়ে এই পাথরের দেয়ালের এধারে এই মৃত্যুপুরীতে এনে ফেলতো।
এইসব নানা ধরনের দুশ্চিন-ায় আমার মন ভারাক্রান- হয়ে উঠলো। অনাগত ভবিষ্যতের চিন-ায় মনে আতঙ্ক দেখা দিলেও মনকে যথাসাধ্য শান- রাখার চেষ্টা করলাম। পকেটে হাত দিয়ে দেখি সিগারেটের প্যাকেটটা আছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে দু’একটা টান দিতে মনে কিছুটা সি’রতা বোধ করলাম। সিগারেটের ধোঁয়া আর কড়া গন্ধ নাকে এসে লাগতে আমি আমার পরিচিত জগতের স্বাদ যেন ফিরে পেলাম। আর তখন দেয়ালচিত্রগুলোর দিকে আমার নজর গেল। এতক্ষণ আবছা অন্ধকারে চোখে পড়েনি। দিনের আলো ফোটার সাথে সাথে ধীরে ধীরে ছবিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কুটুরীটার সবকটা দেয়ালে অসংখ্য ছবি আঁকা, এমনকি ছাদেও। এ ছবি কোন প্রগৈতিহাসিক বর্বর মনিুষের অনভিজ্ঞ হাতের খসড়া কিম্বা ধর্মীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আঁকা কোন আধ্যাত্মিক ছবিও নয়। ছবিগুলোর মধ্যে প্রাণ আছে, জীবন আছে, শক্তির স্ফুরণ, রঙের বৈচিত্র আর গভীরতা আছে। এ মাধ্যমে কোন ঘটনা কিম্বা বক্তব্যের বিন্যাস করা হয়েছে কি না, বলতে পরবো না, তবে এর বিষয়বসদ একটাই, আর তা অত্যন- সুস্পষ্ট- চন্দ্রবন্দনা। কিছু অবয়ব হাঁটু গেড়ে, কিছু দাঁড়িয়ে; কিন’ সকলের হাতই আকাশের দিকে প্রসারিত, ছাদের মাঝখানে আঁকা পূর্ণচন্দ্রের দিকে উঁচু করে ধরা।
উপাসনাকারীদের চোখ এক অদ্ভুত আর অতিপ্রাকৃত ভঙ্গিতে আঁকা, কোন চোখের দৃষ্টিই চাঁদের দিকে নিবদ্ধ নেই, সব ক’টি দৃষ্টি নিচে, আমার দিকে নিবদ্ধ। আমি আরও একটা সিগারেট টানতে টানতে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করলাম। কিন’ সব সময়ই মনে হতে থাকলো চোখগুলো আমার দিকে তাকিয়ে আছে, অনেকগুলো দৃষ্টিবাণ আমাকে বিদ্ধ করছে যেন।
দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে আমার মনে হতে থাকলো আমি বুঝি এই দেয়ালঘেরা অন্ধকূপের বাইরে আমার পুরাতন পৃথিবীতেই আছি, আমার চারধারের দরজার ফাঁটলের আড়াল থেকে কিছু নিঃশব্দ দর্শক আমার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি লক্ষ্য করছে।
আমি উঠলাম, সিগারেটের জ্বলন- টুকরোটা পা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। আমার মনে হলো, এই কুঠুরিটার চার দেয়ালের মধ্যে একা নিঃসঙ্গ অবস’ায় এই অস্বসি-কর দেয়ালচিত্রের মাঝখানে হাতপা গুটিয়ে চুপ করে বসে না থেকে অন্য কিছু করাও ভালো। আমি দরজার ফাঁটলের দিকে এগিয়ে গেলাম। আর তখনই, সেই ভৌতিক হাসিটা আবার শুনতে পেলাম। হাসির শব্দটা একটু চাপা হলেও আগের মতোই প্রাণবন- অথচ হাসিটা যেন আমাকে ব্যঙ্গ করছে।
‘জাহান্নামে যাও।’
আমি পাথরের দেয়ালটার সেই উন্মুক্ত অংশটা দিয়ে চিৎকার করে গালাগালি করতে করতে বেরিয়ে এলাম। ওর হাতে কোন অস্ত্র থাকুক বা নাই থাকুক- আমি ওকে খুন করবোই- ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেলাম আমি।
আর তখনই ওকে দেখতে পেলাম একটা দেয়ালের সাথে দেহটা মিশিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও যেন আমারই অপেক্ষা করছে। ওর চোখের অর্থপূর্ণ কটাক্ষ আর ছোট করে ছাঁটা চুল আমার চোখ স্পষ্টভাবে ধরা পড়লো। আমি ওর মুখে সজোরে আঘাত করতে গেলাম, ও সাথে সাথে মুখটা সরিয়ে নিলো। সরে যেতে যেতে ঠিক একইভাবে ও হেসে উঠলো। হঠাৎ দেখি ও একা নয়, ওর পিছনে আরও একজন, তার পিছনে আরও একজন। ওরা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, আর আমি পড়ে গেলাম। শরীরে একবিন্দু শক্তি পেলাম না, যে প্রতিরোধ করবো। প্রথম জন আমার বুকের উপর চেপে বসে গলায় দুই হাত দিয়ে চাপ দিতে থাকলো, মুখে একই রকম হাসি মাখা। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। এক ফোঁটা বাতাসের জন্য ছট্ফট্ করতে থাকলাম। হঠাৎ শ্বাসনালীর উপর থেকে ও ওর হাতের চাপ কমিয়ে দিলো। অন্য তিনজন সতর্কভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ওদের চোখেমুখে ঠিক একই রকমের বিদ্রুপের হাসি। আর তখনই আমি বুঝতে পারলাম, ওদের কেউই নিচের গ্রামের সেই কিশোর নয়, কিশোরের বাবাও এদের মধ্যে নেই, ওদের কাউকে গ্রামের কারও মতো মনে হলো না। ওদের চেহারা কিছুক্ষণ আগে দেখা দেয়ালচিত্রের অবয়বগুলোর মতো। ওদের চোখের পল্লব ভারী, বাঁকা, নিস্করুণ, অনেকটা দীর্ঘকাল আগে মিশরের পিরামিডে দেখা চেহারা, অনেকটা ভূমধ্যসাগরের তলদেশ থেকে তুলে আনা প্রাগৈতিহাসিক শহরের তৈজসপত্রে আঁকা অবয়বরে মতো। প্রত্যেকের গায়ে হাঁটু পর্যন- ঝোলা আলখাল্লা, উন্মুক্ত বাহু, খালি পা, ছেলেদের মতো ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল, তাদের সমস- দেহ ঘিরে যেন অদ্ভুত একটা কঠোর সৌন্দর্য আর সেই সাথে নিষ্ঠুর সৌষ্ঠব।
আমি মেঝে ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করলাম, কিন’ যে ছেলেটার হাত আমার গলার উপর চেপে বসে ছিল, সে গলার উপর তার হাতে চাপ বাড়িয়ে দিল। আমি বুঝতে পালাম ও কিম্বা ওর সাথীদের সাথে আমি পেরে উঠবো না; এমনকি ওরা যদি মনে করে আমাকে ওরা অনায়াসে মন্টে ভেরিটার ঐ বিশাল খাঁদের অতলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারবে। এখনই শেষ সময়, ভিক্টর নিচের গ্রামে নিঃসঙ্গভাবে মারা যারে।
আমি অবসন্ন গলায় চিৎকার করে উঠলাম, ‘মেরে ফেল আমাকে, আমি পরোয়া করি না।’
আমি ভেবেছিলাম, ওরা বোধ হয় আবার হেসে উঠবে, ব্যঙ্গ করবে, হ্যাঁচকা টানে আমার শরীরটাকে তুলে ধরে পাথরের দেয়ালের ফাটল দিয়ে বাইরের অতল গহ্বরে ছুঁড়ে ফেলবে এবার। আমি চোখ বুঁজে ফেললাম, আতঙ্কে আমার স্নায়ু টান টান হয়ে গেল। কিছুই ঘটলো না।
মনে হলো ছেলেটা আমার ঠোঁট স্পর্শ করলো। আমি চোখ খুললাম, ও তখনও হাসছিল। ওর এক হাতে একটা পাত্র, সম্ভবত ওটাতে দুধ, ও আমাকে ইশারায় খেয়ে নিতে বললো। আমি মাথা নেড়ে অস্বীকার করলাম। ছেলেটার সহযোগীরা এগিয়ে এসে আমার পিছন দিকে হাঁটু গেড়ে বসে আমার কাঁধ আর পিঠ তুলে ধরলো। আর আমি শিশুর মতো নির্বোধ কৃতজ্ঞতায় দুধটুকু গিলতে থাকলাম। ওরা আমাকে এমনভাবে ধরে ছিল যে, আমার মনের সকল ভয় আর আতঙ্ক মুছে গেল। মনে হলো, ওদের শরীর থেকে শক্তির প্লাবন আমার শরীরে প্রবাহিত হলো।
আমার দুধ খাওয়া হয়ে গেলে ছেলেটা পাত্র মেঝেতে নামিয়ে রাখলো, আর দুই হাত প্রসারিত করে আমার বুকের উপর রাখলো, হাতের আঙ্গুলগুলো একেবারে হৃৎপিন্ডের উপর সি’র হয়ে গেল। আমার অন-রের অন-স’ল থেকে এমন এক অদ্ভুত অনুভূতি সারা দেহে ছড়িয়ে পড়লো যা আমার সারা জীবনে আমি অনুভব করিনি। মনে হলো ঈশ্বরের সর্বোত্তম প্রশানি- যেন আমার সারা জীবনের সকল আশঙ্কা, সকল ভীতি, সকল ক্লানি- আর আতঙ্ক সব কিছু মুছে গেল।
পর্বতে ওঠার সময়ের মেঘ আর কুয়াশার স্মৃতি ভুলে গেলাম, ভুলে গেলাম নিচের পাহাড়ী গ্রামটার কুঁড়েঘরে ভিক্টর মৃত্যুর প্রহর গুনছে; পৃথিবীর সব কিছু আমার কাছে ক্ষুদ্র আর মূল্যহীন হয়ে গেল। এই মুহূর্তের আনন্দ, সৌন্দর্য আর শক্তিময়তার কাছে অন্য সবকিছুই অকিঞ্চিতকর বলে মনে হলো। যদি ভিক্টর মারা যায়, তাহলে কিছুই ঘটবে না। ওর দেহটা একটা খোলসের মতো ঐ ক্ষুদ্র কুঁড়েঘরে পড়ে থাকবে, আর ওর হৃৎপিন্ডটা এখানে প্রাণবন- হয়ে উঠবে, যেমন আমারটা এখন প্রাণবন- হয়ে উঠেছে; ভিক্টরের মনটাও আমাদের মতো এখানে এসে হাজির হবে।
আমি ‘আমাদের’ কথাটা ব্যবহার করলাম কারণ ঐ সংর্কীণ কুঠুরীতে বসে থাকার সময় আমার মনে হয়েছিল আমাকে ওদের সমপ্রদায়ের অন-র্ভুক্ত করা হয়েছে; আমি ওদের একজন হয়ে গিয়েছি। আমি সব সময়েই মনে করতাম, মৃত্যু এমনই হবে, আনন্দায়ক আর আশ্চর্যজনক; সকল দুঃখ, সকল কষ্টের অভাব, আর জীবনের স্রোত যুক্তিবাদী মসি-ষ্কের নির্দেশে প্রভাবিত না হয়ে হৃদয়ের আবেগে নিয়ন্ত্রিত হবে।
ছেলেটা আমার বুকের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলো, তখনও ও হাসছিল। হাত সরিয়ে নিলেও আমার শরীরে প্রবাহমান শক্তি আর প্রাণময়তা রয়ে গেল। ও উঠে দাঁড়ালো, ওর সাথে সাথে আমিও দাঁড়ালাম, আর ওদের তিনজনকে অনুসরণ করে কুটুরীটার ফাটল পার হয়ে বেরিয়ে এলাম। যেমন ভেবেছিলাম তেমন না, দীর্ঘ ঘোরানো গলি বা মাকড়সার জালের মতো অসংখ্য সুড়ঙ্গ পথ না, আমরা বিরাট খোলা চত্তরে এসে হাজির হলাম।
চত্তরটার তিন দিকে ছোট ছোট কুঠুরী আর বাকী এক দিকটা ধীরে ধীরে মন্টে ভেরিটার জোড়া শিখর পর্যন- বিস-ৃত, শিখর দুটো নিস্কলঙ্ক সাদা বরফে ঢাকা, সুন্দর, উঠন- সূর্যের গোলাপী আলোয় উজ্জ্বল। চত্তর থেকে বরফ কেটে ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে শিখর পর্যন-। এখানে এসে আমি প্রথম বুঝতে পারলাম চারদিক, দেয়ালের এপারে কিম্বা এই চত্তরটা এত শব্দহীন কেন। এখানেই সকলে নিঃশব্দে সমবেত হয়ে আছে। সকলের দেহে একই ধরণের আলখাল্লা, হাত আর পা উন্মুক্ত, কোমরে একটা পাথরের মালা, চুল পুরুষের মতো ছোট করে ছাঁটা।
আমরা চত্তরটা পার হয়ে সিঁড়ির ধাপের দিকে এগিয়ে গেলাম। চারদিক একেবারে শব্দহীন; ওরা কেউ আমার সাথে কথা বললো না, নিজেদের মধ্যেও কোন কথা বিনিময় করলো না। কিন’ সকলেই আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো, ছেলেটি যেভাবে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল ওদের হাসিটাও ঠিক তেমনই, নৈব্যক্তিক। ওদের হাসি সৌজন্যমুলক নয়, আন-রিকও নয়; আমার পৃথিবীতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে যেমন ভাবে হাসি তেমন না, এ হাসি কিছুটা উচ্চমার্গের; প্রজ্ঞা, সাফল্য আর উদ্দীপনায় পূর্ণ। ওদের বয়স বোঝা গেল না, ওরা পুরুষ, না স্ত্রীলোক তাও বোঝা গেল না, কাউকে বৃদ্ধ বা কিশোর বলেও মনে হলো না। ওদের মুখমন্ডল আর দেহের সৌন্দর্য আমার দেখা সকল মানুষ, সকল প্রাণীর সৌন্দর্যের চেয়ে অনেক বেশী উদ্দীপক অনেক বেশী আবেগকম্পিত। হঠাৎ আমার নিজেরও ওদের মতো হয়ে যেতে ইচ্ছে করলো, ওদের পোষাক পরতে, ওদের মতো ভালবাসতে, ওদের মতো প্রার্থনা করতে আর ঠিক ওদের মতো নিশ্চুপ থাকতে ইচ্ছে করলো।
এক সময় আমার কোট, ব্রিচেস্, ভারী মোজা আর উঁচু জুতোর দিকে নজর গেল আমার। এগুলোর প্রতি ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে উঠলো। এগুলোকে মৃতদেহের কাফনের মতো মনে হতে লাগলো আমার কাছে; আমি চরম বিতৃষ্ণায় ওগুলোকে একে একে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম, তারপর উজ্জ্বল দিনের আলোয় নগ্ন হয়ে নিঃসঙ্কোচে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার কোন লজ্জা কিংবা অস্বসি- লাগছিল না। আমাকে কেমন দেখাচ্ছে, সেটা নিয়ে আমার মনে কোন উদ্বেগের সৃষ্টি হলো না, আর এ নিয়ে কোন দুশ্চিন-াও দেখা দিল না। আমার মনে কেবল একটাই চিন-া, বৈষয়িক পরিমন্ডল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আর পোশাক হলো পৃথিবী আর পার্থিব আমির জ্বলন- উদাহরণ।
আমরা সিঁড়ির ধাপে ধাপে পা দিয়ে উঠতে উঠতে শিখরে গিয়ে পৌঁছালাম, এখন সমস- বিশ্ব আমাদের সামনে দিগনে- প্রসারিত, কোথাও একটুখানি কুয়াশা বা মেঘ নেই, ছোট ছোট শৃঙ্গগুলো ধাপে ধাপে ছোট হতে হতে ঝাপসা হয়ে অসীমে গিয়ে মিশেছে, অনেক নীচে ঝাপসা সবুজ উপত্যকা আর সরু ফিতার মতো স্রোতধারা আর ছোট্ট লোকালয় আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। নীচের ঐ পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে এ দিকে তাকিয়ে দেখি জোড়া শিখরকে, বিশাল ফাটল, সঙ্কীর্ণ অথচ দুস-র, শিখরের ধারে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে, আমি অবাক বিষ্ময়ে আর আতঙ্কে লক্ষ্য করলাম ফাটলের তলা আমার চোখে ধরা পড়লো না। এই অতলস্পর্শ ফাটলের তুষারশুভ্র দেয়াল মশৃণ আর অভঙ্গুরভাবে নীচে নেমে তলাহীন বিশাল গহ্বরে, পর্বতের অন-স’লে চিরজীবনের জন্য আত্মগোপন করে গেছে। যে সূর্য এখন মধ্যাকাশের দিকে এগিয়ে চলেছে, দুপুর বেলা চারদিক উদ্ভাসিত করলেও তার প্রখর তীর্যক রশ্মি কিংবা স্নিগ্ধ চাঁদের আলোও ঐ গভীর ফাটলের তলদেশে কখনই পৌঁছাতে পারবে না। আমার কাছে দুটো চূঁড়োর মাঝে এই ফাটল অনেকটা দুই হাতের তালুর মধ্যে ধরে থাকা গোল পাত্রের মতো মনে হলো।
ঐ বিশাল গহ্বরের একেবারে কিনারায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে, মাথা থেকে পা পর্যন- সাদা কাপড়ে আবৃত, মুখ উপরের দিকে তুলে, মাথা পিছন দিকে হেলিয়ে, হাত দুটো উপরে প্রসারিত করে রয়েছে, যদিও সাদা আলখাল্লার ঘোমটার কারণে এখান থেকে তার চেহারা আমি স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম না, তা সত্বেও ওর ঋজু, জ্যামুক্ত দেহের দিকে চোখ পড়তে আমার সারা দেহে অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করলাম।