স্বর্গ মরীচিকা ১

পরে ওরা আমাকে জানালো, ওরা ওখানে কিছুই খু্ঁজে পায়নি। জীবিত কিংবা মৃত কোন প্রাণীরই চিহ্ন নাকি ওখানে ছিল না। আর আমার মনে হয়, দীর্ঘকালের ঘৃণা আর আতঙ্কে মরিয়া হয়ে ওরা শেষ পর্যন্ত ঐ নিষিদ্ধ দেয়াল ভেঙে ফেলেছিল। রাশি রাশি জনমানব শূন্য ঘর-বারান্দা আর অলিন্দে কোন জনপ্রাণীর চিহ্ন দেখতে না পেয়ে পরাজয়ের গ্লানি ঢাকতে সমস্ত এলাকায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে হিংস্রতা আর উন্মত্ততায় উপত্যকার বাসিন্দারা বর্বরযুগের প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করার প্রাচীনতম পথ বেছে নিয়েছিল। সম্ভবত ওরা যা বুঝতে পারেনি, তার উত্তর ওরা খুঁজতে গিয়েছিল ঐ ধংশের মাধ্যমে। তারপর যখন ওদের হিংশ্রতার অবসান হলো, ওরা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল, আসলে ওরা কিছুই ধংশ করতে পারেনি।

বেশ কয়েকটা অনুসন্ধানী দল পাঠানো হলো বিভিন্ন দিকে। অভিজ্ঞ, অকুতোভয় পর্বতারোহীর সমন্বয়ে গঠিত এই সব অনুসন্ধানী দল সমস- এলাকাটার উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব আর পশ্চিমের সকল পাহাড়, উপত্যকা আর শৈলমালার প্রতিটি প্রান্ত খুঁজেছে, কিন’ সবই নিস্ফল।

এখানেই এই ঘটনার পরিসমাপ্তি। আর কিছুই জানা গেল না।

দুইজন গ্রামবাসী ভিক্টরের মৃতদেহটা নিচের উপত্যকায় বয়ে নিয়ে গেল আমার সাথে। ওকে ঐ মন্টে ভেরিটার পায়ের কাছে কবর দেয়া হলো। ওকে হিংসা করতে ইচ্ছা করলো আমার। আর যা’ই ঘটে থাকুক না কেন, ও ওর স্বপ্নের জগৎটাকে সত্য মনে করেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

আর আমি?

বার্ধক্য এসে আমার দেহের উপর দখল নিতে আরম্ভ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমস- পৃথিবীটাকে উল্টেপাল্টে দিয়েছে। আজ এই সত্তর বছর বয়সে আর কি বাকি থাকলো আমার? তবু এখনও মাঝে মাঝে মন্টে ভেরিটার কথা মনে পড়ে। ভাবনা হয়, এ সমস্যার সমাধান কোথায়?

প্রশ্নটার তিনটা সম্ভাব্য সমাধান মনের মধ্যে উঁকি দেয়, কিন্তু আমি ভাল করেই জানি এই সমাধানগুলোর কোনটাই সঠিক নয়।

প্রথম সমাধানটা একটু বেশী রকমের অবিশ্বাস্য। আমার মনে হয়, হয়তো ভিক্টরের কথাটাই ঠিক। হয়তো সত্যিই মন্টে ভেরিটার রহস্যময়ী বাসিন্দারা অলৌকিক উপায়ে এমন এক মৃত্যুহীন জীবনের অধিকারী হতে পেরেছিলো যে, নিতান্ত প্রয়োজনের সময়ে ওরা স্মরণাতীত কালের মহাপুরষদের মতো স্বশরীরে ‘অমরালোকে’ অদৃশ্য হয়ে যেতে পেরেছিলো। প্রাচীন গ্রীসে, এদেরকেই হয়তো ‘ঈশ্বর’ বলতো, ইহুদিরা সম্ভবতঃ এদেরই নাম দিয়েছিলো ‘এলাইজা’, আর খৃস্টানদের কাছে এরাই হয়তো কেন্দ্রীভূত একক শক্তি ‘আদি পিতা’ নামে পরিচিত।

পৃথিবীতে ধর্মীয় কুসংস্কার আর বিশ্বাসপ্রবণতা ইতিহাসে যে সার্বজনীন বিশ্বাস বংশানুক্রমিকভাবে চলে আসছে, তা হলো কোন কোন ব্যাক্তি এমন পবিত্রচিত্ত আর আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করতে সক্ষম, যখন মৃত্যু তাকে স্পর্শ করতে পারে না। এই বিশ্বাস প্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোতে প্রবলভাবে দেখা যায়, কেবল পাশ্চাত্যের অত্যাধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোন শারীরী দ্রব্য বা দেহ কিংবা রক্তমাংসের মানুষের অন্তধানের বিষয়টি একেবারেই অসম্ভব।

ন্যায় আর অন্যায়ের পার্থক্য ও সীমারেখা টানতে গিয়ে ধর্মীয় শিক্ষাগুরুদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য দেখা যায়। একদলের কাছে যা অলৌকিক আধ্যাত্মবাদ, অন্যদলের কাছে সেটাই ভোজবাজি বা জাদুর খেলা। অতীতে অনেক মহাপুরষ, নবী, সমাজ সংস্কারককে মেরে ফেলা হয়েছিলো, অবশ্য একইভাবে পুরোহিত-জাদুকর-ওঝাদেরকে মেরে ফেলার কথাও শোনা যায়। একটা কাজ কিংবা কথা একসময়ে ‘অধার্মীক’ বা ‘ঈশ্বরনিন্দা’ হিসেবে আখ্যায়িত হলেও, পরবর্তী সময়ে তা’ পবিত্রবাক্য হিসেবে পরিগণিত হয়েছে, একসময়ের ঈশ্বরবিরুদ্ধ কাজ, একালে অবশ্য পালনীয় হিসেবে মনে করা হচ্ছে।

আমি অবশ্য কোন বড় চিন্তাবিদ নই। কিন’ আমার দীর্ঘদিনের পর্বতারোহনের অভিজ্ঞতার আলোকে আজ যে কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, সেটা সবসময়ই জোর গলায় বলবো। কথাটা হলো, পর্বতের উর্ধলোকের নির্জনতায় আমরা সেই সব আত্মার অস্তিত্ব অনুভব করে থাকি, যারা প্রকৃতই আমাদের অদৃষ্ট নিয়তিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিশ্বের প্রায় সকল, পবিত্র বাণীই পাহাড়ের চুড়া থেকে উচ্চারিত হয়েছে, আর প্রায় সকল নবীর সাথেই পাহাড়ের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো। ওলি, পীর আর সাধুসন্তরা পাহাড়ের নির্জনতায় মেঘমালার কাছে আদি পিতার সাথে মিলিত হতেন। আমার একান- বিশ্বাস সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর দিনটাতে এক ধরণের কোন অলৌকিক ঐন্দ্রজালিক শক্তি মন্টে ভেরিটার সকল অধিবাসীকে পরম নিরাপত্তার আবাসস’লে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো।

আজ আমার মনে পড়ছে, ঐ পাহাড়ের চুড়োয় পূর্ণিমার চাঁদের আলো গলে গলে পড়তে দেখছি, ঠিক দুপুর বেলায় প্রখর সূর্যের আলোতে সমস- এলাকাটা উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। কিন’ ঐসব ঘর, বারান্দা, অলিন্দ আর ঐখানকার বাসিন্দাদের চর্মচক্ষু দিয়ে দেখার মধ্যে দিয়ে আসলে যা দেখেছি, শুনেছি কিংবা অনুভব করেছি, তার সবটুকুই অপ্রাকৃত, সবটাই অপার্থিব। চোখের সামনে এখনও আমি ঐ পাহাড়ী চত্তরটা দেখতে পাই; আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ, নিষিদ্ধ নগরীর মধ্যে থেকে ভেসে আসছে মিলিত কন্ঠের অদ্ভুত দুর্বোধ্য অথচ মায়াময় ভজনের সুর, পর্বতের দীর্ঘ বিশাল ফাটলটার বিকট মুখব্যাদনের ওপারে জোড়া শৃঙ্গের মাঝখানে বড় গামলাটার মতো জায়গাটাতে ছড়িয়ে থাকা সেই জনপদটা। এমনকি এখনও কান পাতলে শুনতে পাই অদ্ভুত খিল্‌খিল্‌ হাসির শব্দ আর চোখের সামনে ভেসে ওঠে আকাশের পূর্ণিমার চাঁদের দিকে দুই হাত প্রসারিত করে থাকা স-ব্ধ পাথরের মতো কয়েকটা মানবদেহ।

এসব কথা যখন আমার মনে নড়াচড়া করে তখন মানবাত্মার অমরত্বের কথাই বিশেষভাবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে।

আজ আমার পাহাড়ে চড়ার বয়স, ক্ষমতা আর শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। স্মৃতি থেকে পাহাড়ের ঐন্দ্রজালিক প্রভাব ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে। দেহের অন্যান্য অঙ্গের উপরও এর প্রভাব এখন নিঃশেষিত প্রায়। এখন তাই মনে হয় মন্টে ভেরিটায় যে চোখের ওপর আমার চোখ পড়েছিল, সেই কোমল চোখদুটো প্রকৃতই জীবন- – সে চোখ আসলেই একজন জীবন-, প্রাণময় মানুষের। আর যে হাতের স্পর্শ আমি সেখানে পেয়েছিলাম, সে হাত সত্যই কোন রক্তমাংসের মানুষের – এর মাঝে কোন অলৌকিকতা – অবাস-বতা – কিছুই ছিল না, থাকতে পারে না।

এমন কি যে কথাগুলো নিজের কানে আমি শুনেছিলাম, যে কন্ঠস্বর এখনও আমার কানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়, সেগুলো আসলেই একজন মানুষের।

‘আমাদেরকে নিয়ে তুমি কোন চিন্তা করো না। আমাদের কি করতে হবে, তা’ আমরা জানি।

তারপর এখনও আমার কানে বাজছে ওর সেই ব্যথিত আবেদন, ‘ভিক্টরকে ওর স্বপ্ন নিয়েই থাকতে দাও।’

এ সব কিছুই তো মিথ্যা বা অলৌকিক হতে পারে না।

আর এখানেই আমার দ্বিতীয় সমাধানের জন্ম। এখনও আমি অন্ধকার রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি, নক্ষত্রের ঝিকিমিকি দেখতে দেখতে সেই সব শক্তিমান আত্মাদের কথা আমার মনে পড়ে। মনে পড়ে যায় কিভাবে ওরা নিজেদেরকে আর ওদের সহযোগীদের রক্ষা করলো।

আমি যখন ভিক্টরের মরদেহ নিয়ে ফিরে এলাম আর উপত্যকার অধিবাসীরা যখন সর্বাত্মক আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ঐ ফাটলের ওধারের অধিবাসীরা, সত্যানুসন্ধানীরা পর্বতের ওধারে, লোকচক্ষুর অন্তরালে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমার মনে তৃতীয় তত্ত্বের উদয় হয়, যখন মনে বৈরাগ্য দেখা দেয়। এমন কিছু সময় আসে যখন আমার কেবল একা থাকতেই ভালো লাগে, যখন অপরিচিত একদল লোকের সাথে রাত্রের খাবার খাওয়ার পর বাসায় ফিরে জানালা দিয়ে শহরের ঝলমলে আলোর দিকে তাকিয়ে গাড়ি চলাচলের শব্দের আবর্তে ডুবে যেতে যেতে হঠাৎ শানি- আর নৈশব্দের জন্য মনটা ছটফট করে ওঠে; তখনই মনে হয়, মন্টে ভেরিটার অধিবাসীরা কোনদিনই ঐ এলাকা ছেড়ে চলে যাবার কথা চিন্তা করেনি, কিন্তু যখন সত্যিই সেই রকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি ওদেরকে হতে হলো, তখন অমরত্ব কিম্বা মৃত্যু কোনটাকেই গ্রহণ না করে পৃথিবীর অন্য সব সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে গেল। অতি সঙ্গোপনে, সকলের অজানে-, ওরা ওদের ঐ আস্তানা ছেড়ে উপত্যকায় এসে সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিলিয়ে গেল, অন্য সকলের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেল। আমার এই এপার্টমেন্ট থেকে নিচের জনাকীর্ণ জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়, হয়তো এদের মধ্যেই কেউ কেউ ঐ এলাকার অধিবাসী হতেও পারে। হয়তো আমি ঐ পথচারীদের কাউকে জিজ্ঞেস করলে, ওরা কিভাবে মন্টে ভেরিটা থেকে পালিয়ে এসেছে, তা আমি জানতে পারবো।

কখনও রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ কারো চলার ভঙ্গি, মাথা নাড়া, চোখের দৃষ্টির অদ্ভুত পার্থক্য, নজরে যেন ধরা পড়ে, মনে হয় যেন সে আমাদের মতো স্বাভাবিক মানুষ নয়, অন্য কেউ, অন্য কোথাকার। তখন তাকে থামিয়ে কথা বলতে চেয়েছি – হয়তো এটা আমার অলীক কল্পনা – আর তখনই এক অজ্ঞাত সচেতনতায় ওরা বুঝতে পারে আমার মনের ভাব। একমুহূর্ত ইতঃস্তত করেছি – হয়তো কথা বলবো, কি বলবো না – ভাবতে গিয়েই দেখেছি জনতার ভিড়ে সে হারিয়ে গিয়েছে। হয়তো ট্রেনে কিম্বা বাসের ভিড়ে অথবা জনাকীর্ণ চলতি মানুষের স্রোতের মাঝে হয়তো কাউকে পৃথক মনে হয়েছে, পার্থিব সৌন্দর্য কিম্বা পবিত্রতার অতিরিক্ত মনে হয়েছে – তাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছি, ‘আপনি কি মন্টে ভেরিটার অধিবাসী?’

কিন’ তেমন সুযোগ হয়নি কখনও। জনতার ভিড়ে সে হারিয়ে গিয়েছে – আমি আবার নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছি। আর এভাবেই আমার তৃতীয় তত্ত্ব অপ্রমাণিত থেকে গিয়েছে।

বয়স যতোই বাড়ছে, এখন আমার বয়স প্রায় সত্তর বৎসর, স্মতি ক্রমে ধূসর থেকে ধূসরতর হয়ে ক্রমে মুছে যাচ্ছে আর ততোই ধীরে ধীরে মন্টে ভেরিটার কথা বিস্মৃতি আর অসাম্ভাব্যতার অমানিশায় ডুবে যাচ্ছে। আর এ জন্যই সম্পূর্ণ ভুলে যাবার আগে ঘটনাটা লিখে যাবার আগ্রহ বোধ করলাম। যারা এ ঘটনা পড়বেন, আমার মতো যাদের পাহাড়ে চড়ার আগ্রহ থাকবে, তারা হয়তো এ লেখা পড়ে বিষয়টা সম্পর্কে তাদের নতুন মত আর যুক্তির অবতারণা করতে পারবেন।

আর একা সতর্কতার কথা বলতে চাই। ইউরোপে অনেক পর্বতশৃঙ্গ আছে এর অনেকগুলোর নামই হয়তো মন্টে ভেরিটা। এগুলোর কোনটা হয়তো সুইজারল্যান্ডে, ফ্রান্সে, স্পেনে, ইতালীতে কিম্বা টাইরোলে। আমাদের এই মন্টে ভেরিটা ঠিক কোথায় সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে চাই না। দু’টো মহাযুদ্ধের পর পৃথিবীর কোন পর্বতশৃঙ্গই আর অগম্য নেই। সব কয়টা চুড়াতেই গিয়ে হাজির হওয়া যায়। সঠিক সতর্কতা অবলম্বন করলে কোনটাই দুর্গম কিম্বা ভীতিপ্রদ নয়। আমাদের এই মন্টে ভেরিটা উচ্চতা, তুষারের ঘণত্ব আর জমাট বরফের কারণে কিন্তু অগম্য ছিল না, এর শিখরে ওঠার পথটা কোন সতর্ক আর সচেতন পর্বতারোহীর পক্ষেই কঠিন নয়, এমনকি হেমনে-র অন্তিম নিগুলোতেও। কেবল মনের গভীরের আতঙ্ক আর ভীতিই এই পাহাড়ের চুড়ায় ওঠার ইচ্ছাকে দমন করে রাখতো, কোন পর্বতারোহীই চেষ্টা করে দেখেনি।

আজ কোনই সন্দেহ নেই যে, এত দিনে সব মানচিত্রেই আর সব পর্বত শৃঙ্গের মতো এই শৃঙ্গটাকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। এতো কিছু সত্ত্বেও ভাবতে ভাল লাগে ঐ জমজ শৃঙ্গের পরম পবিত্রতা কোনদিনই কেউ নষ্ট করতে পারবে না। মাঝরাতে যখন পূর্ণিমার চাঁদের দুধ সাদা আলোয় সারা বিশ্ব ধারা স্নান করবে, তখন এই মন্টে ভেরিটা থাকবে নিষ্কলঙ্ক আর অপরিবর্তনীয়। শীতকালে যখন বরফ আর তুষারে আবৃত হবে চারদিক, তীব্র শীতল বায়ুপ্রবাহে সমস- এলাকা হবে নীরব, নিস-ব্ধ আর স’পিকৃত মেঘপুঞ্জের আড়ালে হারিয়ে যাবে চুড়ায় ওঠার পথের সব চিহ্ন, তখন এই মন্টে ভেরিটার জমজ শৃঙ্গ দু’টো সূর্যের দিকে মাথা উঁচু করে নৈশ্বব্দ্য আর অনুকম্পায় নিচের অন্ধ, স্বার্থপর পৃথিবীর দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে থাকবে।

এক সাথে আমাদের কৈশোর কালটা কেটেছে, আমাদের মানে আমার আর ভিক্টরের। মার্লবরোতে আমাদের স্কুল জীবন শেষ করে একই সাথে কেম্ব্রিজে ভর্তি হয়েছিলাম। সেই সময়ে আমি ছিলাম ওর ঘনিষ্টতম বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর অবশ্য আমাদের দেখা সাক্ষাত কমে গিয়েছিল; কারণ দুজনে দু’টো ভিন্ন ভুবনের বাসিন্দা হয়ে পড়েছিলাম। কর্তব্যের টানে আমাকে অধিকাংশ সময় দেশের বাইরে থাকতে হতো। অন্যদিকে ভিক্টর শ্রপশায়ারে নিজের খামার দেখাশুনাতে ব্যতিব্যস- থাকতো।

কিন’ যখনই আমাদের দেখা হতো, তখনই ভুলে যেতাম যে আমরা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। আমাদের বন্ধুত্বের উত্তাপ কখনও কমে যায়নি এতটুকুও। আমার কাজ আমাকে যেমন ব্যস- রাখতো, তেমনই ওর কাজও ওকে শ্বাস ফেলতে দিতো না। কিন’ আমাদের দু’জনের হাতেই খরচ করার মতো যথেষ্ট অর্থ আর অবকাশ গ্রহণের মতো সময় বের করে নিতে করতে কোন অসুবিধা হতো না। সেই সময়টা আমরা ব্যয় করতাম আমাদের সবচেয়ে পছন্দনীয় সখ চরিতার্থ করার জন্য। আর সেটা হলো পাহাড়ে ওঠা। আজকালকার অত্যাধুনিক উপকরণসমৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ নেয়া দক্ষ পর্বতারোহীরা আমাদেরকে সম্পূর্ণ আনাড়ী আর সৌখিন হিসাবে মনে করবে, কারণ আমি বিশ্বযুদ্ধের আগের সোনালী দিনগুলোর স্মৃতি রোমান’ন করেছি। সেই দিনগুলো ছিল স্বপ্নময় আর রঙীন। আসলে আমাদের এই দুই সদ্য কৈশোর পার হয়ে আসা যুবকের মধ্যে কোন পেশাদারিত্ব ছিল না। আমরা তখন কেবল আমাদের দুই হাত আর পায়ের উপর ভরসা করে কাম্বারল্যান্ড আর ওয়েল্‌স্‌-এর মাথা উঁচু করে থাকা ছোট ছোট পাহাড়গুলোর দাঁত বের করে থাকা পাথর আঁকড়ে চুড়োগুলোতে বেয়ে ওঠা শিখেছিলাম, পরে কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জন করে দক্ষিণ ইউরোপের একটু দুর্গম চুড়োয় ওঠার অভ্যাস করেছিলাম।

ধীরে ধীরে আমরা আমাদের ছেলেমানুষী আর বোকামিগুলো কাটিয়ে উঠে একটু বেশী অভিজ্ঞ আর ধীরসি’র হয়ে উঠলাম। পাহাড়ে ওঠাকে কেবল নিছক ছেলে খেলা হিসাবে না দেখে এটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে শিখলাম – তখন পাহাড় আমাদের কাছে পরাভবযোগ্য শত্রু না হয়ে অর্জনযোগ্য বন্ধু হয়ে উঠলো। আমি আর ভিক্টর বিপদকে প্রত্যক্ষ করার জন্য পাহাড়ে উঠতাম না, উঠতাম আমাদের শৃঙ্গবিজয়ের তালিকায় আরও বেশী পাহাড়ের নাম যোগ করার জন্য। আমরা দুজন আবেগে আপ্লুত হয়ে পাহাড়ে উঠতাম; কারণ যে পাহাড়টার চুড়ায় আমরা উঠতে পারতাম সেটাকে আমরা ভালবেসে ফেলতাম।

পাহাড়ের মেজাজের কোন অন- নেই, আর সেই মেজাজ অত্যন– দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায়, যে কোন মেয়ের মনের চেয়েও দ্রুত এটা বদলে যায় – কখনো তাতে থাকে আনন্দ, কখনো বিষাদ, কখনো ভীতি, আর এ সব কিছুর সাথে অবিচলিত প্রশানি- মিলেমিশে থাকে। পাহাড়ে ওঠার অনুভুতিটা কোনভাবেই অন্যকে ব্যাখ্যা করা যায় না। সম্ভবত প্রাচীনকালে তারার রাজ্যে চলে যাবার মতো দুর্বোধ্য। আজকাল কারো এমন খেয়াল হলে সোজা বিমানের টিকিট কিনে আকাশে পাড়ি দিতে দিতে ভাবতে পারবে সে বিশ্বের সম্রাট হয়ে গিয়েছে। তা’ সত্ত্বেও তার পায়ের তলায় তখন কোন পাথর থাকবে না, চোখে, নাকে, মুখে আছড়ে পড়বে না হীম-শীতল বাতাস। সবচেয়ে বড় কথা হলো পাহাড়ে না চড়লে পবিত্র নিস-ব্ধতাকে অনুভব করতে পারবে না কেউ। আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়, আমাদের যুবককালের সোনালী সময়টাই আমরা পাহাড়ে কাটিয়েছি। দেহের মূল্যবান শক্তি আর চিন-া কেন্দ্রীভুত করেছিলাম কেবল ঐ পাহাড়ে চড়ার আগ্রহে। সবই ছায়ার মতো মিলিয়ে গিয়েছে আজ।

আমরা – আমি আর ভিক্টর – এর নাম দিয়েছিলাম পর্বত-জ্বর। তবে আমার চেয়ে ভিক্টরই অনেক আগে এই উত্তেজনা কাটিয়ে উঠতে পারতো। ও অনেক শান-ভাবে চারদিক বুঝে নিয়ে নামার সহজ পথ খুঁজতে চেষ্টা করতো, অথচ আমি সেই সময়টা এক অদ্ভত আবেগে আপ্লুত থাকতাম, এক অদ্ভুত আর দুর্বোধ্য স্বপ্নের ঘোরে ডুবে থাকতাম। কঠোর ধৈর্য্য আর সহিষ্ণুতার বিনিময়ে এক-একটা শৃঙ্গ আমাদের করায়াত্ব হতে থাকতো, তবু, কি একটা অপ্রকাশ্য, অস্পষ্ট কিছু একটা অজেয় রয়ে যেতো আমার কাছে। যে অভিজ্ঞতা আমি সব সময় অর্জন করতে চেয়েছিলাম তা আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতো – আর আমার মনে হতো এ অক্ষমতা আমার অন-রের। সে সবই আমাদের সেই সোনালী দিনের স্মৃতি – আমার জানা মতে সবচেয়ে সুন্দর।

Leave a Reply