সায়েম মাহমুদের নিস্ফল দ্বৈরথ অধ্যায় ৯

বেলা একটার দিকে পপি আমাদেরকে ডেকে তুললো, এখন না বের হলে মোস-ফা মার্কেটে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে র‌্যাফেলস্‌হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছাতে দেরী হবে। আমরা গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ফিহা যাবার সময় কাউন্টারে চাবি জমা দিলো।

বাইরে বেরিয়ে দেখি বেশ রোদ হলেও বিব্রতকর না। আমি জিজ্ঞেস করলাম ট্যাক্সি নেবো কি না। ফিহা বললো, ‘চলো হেঁটে দেখি কতদূরে মোস-ফা মার্কেট।’

হোটেল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি যে পথে গিয়েছিলো, সে পথে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকলাম। ফুটপাথগুলো অনেক চওড়া আর ফুটপাথের পর বেশ অনেকটা জায়গা নানা রকমের ফুল আর পাতাবাহারের গাছের বাগান। গাছের চারপাশ বার তলাগুলো দেখে বোঝাই যায় এ বাগানগুলো নিয়মিত দেখভাল করা হয়ে থাকে। অনেক গাছে প্রচুর ফুল ফুটেছে, কিন’ তুলে নেওয়ার কেউ নেই। এক একটা ফুটপাথের পাশে এক এক রকম গাছ আার ফুলের কেয়ারী- কোন না আমাদের দেশেরই ফুল- রঙ্গন, কস’রী আরও দুই এক ধরনের পরিচিত ফুল।

হোটেল থেকে প্রথমে বায়ে গিয়ে বেশ কিছুদূর হাটা তার পর রাস-া পার হয়ে সেরাঙ্গন রোডে যেতে হবে। রাস-া পার হতেই লক্ষ্য করলাম একটা খাল। বেশ চওড়া খালের পাগ শুন্দর বাঁধানো দুই পাড়ে তালসুপারী জাতীয় গাছ দিয়ে সাজানো। চমৎকার!

ফিহার হাতে ক্যামেরা, সমান তালে শাটার টিপেই যাচ্ছে। ওর সখ পুরণ করতে গিয়ে আমরা দু’জন এখানে ওখানে দাঁড়াচ্ছি- ফুটপাথের বাগানের পাশে, দোকানের শো-রুমের সামনে। অত সুন্দর একটা খাল দেখে ওটারও ছবি তুললো ও কয়েকটা।

হঠাৎ খালের পানির দিকে নজর আমার নজর গেলে আমি ফিহাকে ডেকে খালের পানির দিকে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, ‘ফিহা, দেখ, এটা কিন’ সাধারণ কোন খাল না। এটা স্যুয়ারেজ লাইন।’

ফিহা কিছুক্ষণ ওটার পানির দিকে তাকিয়ে থেকে অবাক হয়ে বললো, ‘আশ্চর্য ব্যাপার! একটা স্যুয়ারেজ পানির খালও কত সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে!’

রাস-া পার হয়ে আমরা সেরাঙ্গন রোডে পড়লাম। এই রাস-াতেই মসজিদে আঙ্গুলিয়া আর মোস-ফা মার্কেট। এখানেই আমরা দুপুরের খাবার খাবো।

হাঁটছি তো হাঁটছি। মসজিদও দেখি না, মোস-ফা মার্কেটও না।

ফিহা হাসতে হাসতে বললো, ‘আব্বু তুমি দাদার যে গল্পটা বলতে সে রকম অবস’া।’

আমি গল্পটা জানতাম তবু জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোনটা?’

ফিহা হেসে বললো, ‘ঐ যে, ঘর সে নদী নজদিক, মগর নদীসে নদী বহুত দূর। হোটেল থেকে সেরাঙ্গর রোড কাছেই, অথচ সেরাঙ্গন রোডের মসজিদ আর মোস-ফা সেন্টার অনেক দূর।’

এই সব কথা বলতে বলতে অবশেষে আঙ্গুলিয়া মসজিদও দেখা গেল আর মোস-ফা মার্কেটও। মার্কেট পার হয়ে ডান দিকে ঘুরে ছোট্ট বাঙালী রেস্টুরেন্টটা দেখতে পেলাম। বারান্দায় বেশ কয়েকটা টেবিল পাতা। রেস্টুরেন্টের ভিতরে জায়গা বেশ কম, মাত্র দুটো টেবিল- চার চার আট জন বসতে পারে। সে তুলনায় বাইরে ফুটপাথে ছয় সাতটা টেবিল। পাশের গলি পথে আরও কয়েকটি হেইনিকেন বিয়ারের বিজ্ঞাপন দেওয়া ছাতা লাগানো টেবিল সাজানো।

সঙ্গে মহিলা দেখে রেস্টুরেন্টের ভিতরের একটা টেবিল খালি করে দিলো দোকানের একজন। তাকিয়ে দেখি দোকানের সামনে শো কেসে মাছ, ডিম, মুরগি, সবজী, ডাল – নানা রকম তরকারী সাজানো।

বিরাট বিরাট চুলোর কারণে ঘরের ভিতরটা বেশ গরম। আমি ওদেরকে বললাম ঐ ছাতা লাগানো টেবিলে বসা যাবে কি না। ছেলেটা হাসলো। বললো, ‘স্যার, ওটা স্পেশাল টেবিল। ওখানেও আমরা খাবার দিতে পারবো, তবে আপনাদেরকে সেই সাথে বিয়ারের অর্ডার দিতে হবে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি আসলেই ওখানে যারা বসে আছে তাদের সবার সামনে বিয়ারের বোতল অথবা ক্যান।

ফিহা একটু মিচকি হেসে বললো, ‘আব্বু তুমি বরং ওখানে গিয়ে বসো। শেরাটন, সোনারগাঁওয়ে গিয়ে অভ্যাস হয়েছে না তোমার?’

দেখেশুনে ওর মা-র সাথে আলোচনা করে তিন প্লেট ভাত, ভিণ্ডি ভাজি, ডাল আর মুরগীর মাংস অর্ডার দিলো ফিহা।

একটু পরেই গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত আর গরম, গরম ভাজি, মুরগী আর ডাল দিয়ে গেল। খাবার খুব গরম, তারপর চারপাশটাও গরম। তার মধ্যে দেখি ফিহা হাপুস-হুপুস করে খাচ্ছে। বোঝাই গেল বেশ খিদে পেয়েছিলো ওর। আমি তো এমনিতেই কম খাই। আমার এক প্লেট ভাত শেষ করতেই হাঁফ ধরে গেল। খেতে খেতে ফিহা নীচু গলায় মন-ব্য করলো, ‘কম মসলায় রান্না বলে খাবারের স্বাদ কিন’ ঢাকার রেস্টুরেন্টের তুলনায় খুবই ভালো। তাই না?’

আমার কাছেও স্বাদটা ভালই লেগেছে। মাথা নেড়ে ওর কথায় সমর্থন করলাম।

খাওয়া শেষ করে বিল দিয়ে ফিহা বললো, ‘সাড়ে চার ডলার।’

প্রায় আড়াই শ’ টাকা! চার জনের খাবারের। সিঙ্গাপুরের পরিবেশে অবাক করার মতো কম দাম। ঢাকার তুলনাতেও যথেষ্ট কম।

তাকিয়ে দেখি টেবিলের ওপর মোটা ভারি কাগজের ওপর ভাত রেখে অপূর্ব দক্ষতায় প্যাকেট করছে ওদের একজন কর্মী। ফিহা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে জানলো, ঐ প্যাকেটগুলো বিভিন্ন বাসায় সরবরাহ করা হবে।

ফিহা আমাকে বললো, ‘তা’ হলে তো আমরা এক বেলা খেয়ে পরের বেলার জন্যে ভাত নিয়ে হোটেলে বসে খেতে পারি।’

পপির সব বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করা অভ্যাস। বললো, ‘হোটেলওয়ালারা যদি আপত্তি জানায়।’

ফিহা বলে উঠলো, ‘আমরা ঘরে বসে যা করি না কেন, ওদের আপত্তি কোথায়। ঘরের এক কোনায় একটা ঝুড়ি দেখেছো না। ওর মধ্যে লেফট্‌ওভার ফেলে দিলেই হলো।’

২৮

এর মধ্যে র‌্যাফেলস্‌হাসপাতালে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমরা আর দেরী না করে রেস্টুরেন্ট থেকে রাতের খাবার দুই প্যাকেট ভাত, এক প্যাকেট ভাজি, এক প্যাকেট মুরগীর তরকারী আর এক প্যাকেট ডাল নিয়ে হেটে হেটে হোটেলে ফেরত এলাম।

রুমে খাবার রেখে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের হলাম। মিনিট পনেরোর মধ্যে হাসপাতালের ফয়্যারে গিয়ে হাজির হলাম।

ফিহা রিসেপশনে গিয়ে বললো, ‘উই হ্যাভ কাম ফ্রম বাংলাদেশ। হ্যাভ এন এপয়েন্টমেন্ট উইথ ডক্টর। প্লিজ ইনফর্ম চরনজিত কাউর।’

একটুক্ষণ পরেই সিঙ্গাপুরের সিংটেলের সিম লাগানো আমার মোবাইলে রিং হতে ধরলাম। ওপাশ থেকে চরনজিত জানালো মিনিট পনেরো অপেক্ষা করতে। ও এসে আমাদের নিয়ে যাবে।

ফয়্যারের এ পাশে কয়েকটা সোফা রাখা আছে ওখানে গিয়ে গা এলিয়ে দিলাম। মিনিট পাঁচেক পরে আমাদের পাশে একজন বৃদ্ধা মহিলা সহ দুই জন ভদ্রলোক এসে বসলেন। ওরা বাংলায় নিজেদের মধ্যৌ কথা বলছিলো। তখন মনে হলো ডা. ফরহাদ বলেছিলেন ঢাকা থেকে একজন মহিলা যাবেন পরীক্ষার জন্যে, সঙ্গে দুই ছেলে- এরকজন কানাডা প্রবাসী। ওদের সাথে একটু পরে আলাপও হলো।

এক সময় দেখি একজন মহিলা অত্যন- দ্রুত পায়ে সোফার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘আই এ্যাম চরনজিত। ফলো মি।’

মহিলার পিছু পিছু ফয়্যারের আর এক কোনায় অনেকগুলো লিফট্‌। তার একটাতে করে উপরে উঠলাম তের তলায়। লিফট থেকে বেরিয়ে এ করিডোর ও করিডোর পার হয়ে অঙ্কোলজী বিভাগে ঢুকতে দেখি একটা ছোট ঘরের একপাশে কাউন্টার আর বাকিটাতে কয়েকটা সোফা রাখা। চরনজিত সোফাতে বসতে বলে ফিহার কাছে রাখা রিপোর্টের বিরাট বাণ্ডিলটা নিয়ে ভিতরে চলে গেল।

বিশেষজ্ঞের কাছে আরও দুই তিন জন রোগী অপেক্ষা করছে। এক জন এক জন করে ভিতরে ডাকছে।

প্রায় এক ঘন্টা পরে আমাদের ডাক এলো। ভিতরে আরও ছোট একটা ঘরে একজন চীনা চেহারার এপ্রন পরা মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বসে। ইনিই অঙ্কোলজিস্ট। চরনজিত ফিহাকে রোগী হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিলো। প্রফেসর সরাসরি ফিহাকে জিজ্ঞেস করলেন ও ওর রোগ সম্পর্কে বিস-ারিত বলতে পারবে কি না।

ফিহা একটু নার্ভাস হয়ে গিয়ে আমার দিকে একবার তাকালো।

আমি ওকে বললাম, ‘তুমিই কথা বলো। আটকে গেলে তো আমি আছি।’

এর পর প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে প্রফেসর ওকে যত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো সব কটার উত্তর ও সঠিকভাবে আর গুছিয়ে বলে গেল। ওর ইংরেজী বলার ধরণ আর গতি দেখে আমি একেবারে অভিভূত হয়ে গেলাম।

ও যখন ইন্টারমেডিয়েট পাশ করে অনার্সে ভর্তি হয়েছিলো, তখনও ও ইংরেজীতে বেশ কাঁচা ছিলো। অনার্সের প্রথম বছর ওর অনেক নোট আমি সংশোধন করে দিতাম। পরে দেখেছি ওর লেখার ধরন বদলে গিয়েছে। ভাষায় বেশ দখল এসে গেছে। সে সব তো লেখার ব্যাপার।

অথচ আজ আমি অবাক হয়ে দেখলাম কী অদ্ভুত দক্ষতায় সুন্দর গুছিয়ে ও ওর রোগের পুরোটা ইতিহাস, চিকিৎসার বিবরণ, সমস্যা আর জটিলতাগুলো বলে যাচ্ছে। ভুল যে করছে না তা নয়, কিন’ সেটা ধর্তব্যের মধ্যে না। বাংলা পরিবেশের বাইরে ও মাস দুই থাকলে ওর এই ছোটখাটো ভুল সংশোধন করে ফেলতে পারবে।

খালি দুই একটা প্রশ্নের উত্তর, যা ফিহার জানার কথা না- যেমন, ওর পূর্বপুরুষের কারো হাঁপানি, ক্যান্সার প্রভৃতি রোগ ছিলো কি না, আমিই বলে দিলাম।

সব শুনে প্রফেসর বললেন, ‘আপনারা তো পেট স্ক্যান করতেই মূলতঃ এসেছেন। তাই আপাতত আমরা আপনাকে আগামী কালই পেট স্ক্যান করার এপয়েন্টমেন্টের ব্যবস’া করে দিচ্ছি। এর রিপোর্ট পেলেই আমরা বাকি বিষয়গুলো আলোচনা করবো।’

আমাদের নির্ধারিত এপয়েন্টমেন্ট শেষ হয়ে গেল। পরদিন পেট স্ক্যান করার এপয়েন্টমেন্ট করে ওরা আমাদেরকে কোথায় যেতে হবে তা’ ওরা বলে দিলো।

আমরা আগের মতোই হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেলে ঢোকার পথে বিরাট বড় পথ বাজার হওয়ায় এই বাজারের শতেক ছোট ছোট দোকানে সাজিয়ে রাখা হাজারো পণ্য দেখতে দেখতে অনেক সময় পার করলাম। হোটেলে ফিরে ফিহা আবার ওর মাকে নিয়ে হিসাব করতে বসলো। আমিও ওদের আলোচনায় যোগ দিলাম। ওরা র‌্যাফলস্‌হাসপাতালে সেদিন যে টাকা দিলো পেট স্ক্যানের জন্যে আর কনসালট্যান্টের ফি বাবাদ সে টাকা বিয়োগ করে নিয়ে ফিহা হেসে বললো আমাদের তো আর খুব বেশী খরচ নেই। সিঙ্গাপুরে বেশ আরাম করে বেড়ানো যাবে। ওর খুশি দেখে আমি আর পপি দুজনেই খুব খুশি হয়ে গেলাম।

ঠিক এমন সময় র‌্যাফেলস্‌থেকে ফোন এলো, ওপাশ থেকে জানানো হলো আমরা ওদেরকে যে ওয়াক্স কিউব জমা দিয়েছি, সেটা ওরা পরীক্ষা করে দেখতে চায়।

আমি পপির সাথে আলাপ না করে ওদের কিছু বলতে চাইলাম না। তাই ওদের বললাম আমি এ বিষয়ে দশ মিনিট পরে জানাচ্ছি।

ফিহার অপারেশন থেকে পাওয়া খন্ডাংশ- ওয়াক্স কিউব ঢাকার ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে নিয়ে আসা হয়েছিলো এখানকার হাসপাতালে লাগবে বলে। ওটা আমরা দুপুরে এপয়েন্টমেন্টের সময় জমা দিয়ে ছিলাম।

আমি পপির সাথে ব্যাপারটা নিয়ে এক মুহূর্ত আলাপ করলাম। পপি বললো, পরীক্ষা করলে যদি ফিহার চিকিৎসায় উপকার হয় তবে পরীক্ষা করতে বলো।

আমি ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম পরীক্ষা করতে কত লাগবে। ওরা যে খরচের কথা বললো, তা শুনে এক মুহূর্তের জন্যে আমার মাথা ঘুরে উঠলো। ফিহা যে উদ্বৃত্তের কথা এটু আগে জানাালো তার সিংহভাগই চলে যাবে পরীক্ষার ব্যয় মিটানোর জন্যে।

আমি রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে পপিকে খরচের কথাটা বললাম। শুনে ফিহা আর ওর মা দুজনেরই মুখ কালো হয়ে গেল। পপি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘আমরা এসেছি ফিহার পরীক্ষার জন্যে, প্রয়োজন হলে তো খরচ করতেই হবে। বলে দাও পরীক্ষা করুক।’

আমি সেই কথা মতো ওদেরকে পরীক্ষাটা করতে বললাম।

ওদেরকে কথাটা বললেও পপিকে আমি পরীক্ষাটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলাম। বললাম, ‘ঢাকায় তো একবার পরীক্ষা করে দেখেছে ওরা। এখানে আবার আর কি পরীক্ষা করে দেখবে?’

পপি বললো, ‘তুমি তো ডাক্তার না। তুমি কি বুঝবে? ওরা মনে করেছে পরীক্ষা করতে হবে। করুক। হয়তো এই টুকুর জন্যে ঢাকায় গিয়ে সবাই অসন’ষ্ট হবে, যদি না পরীক্ষা করতে রাজী হই।’

তবু আমার মনের খুঁতখুতিটা গেল না।

সিঙ্গাপুরে যে টাকা নিয়ে এসেছিলাম তার তিন ভাগের দুইভাগ আগেই দিয়েছিলাম কনসালটেন্সী আর পেট স্ক্যানের বিল দিতে এখন পুরো টাকার আশি ভাগই খরচ হয়ে যাবে এই পরীক্ষার ব্যয় যোগ করলে। ফিহার ভাল করে ঘোরা-ফেরার সখটা আর পুরণ হবে না। ওর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। মন আমারও খারাপ হয়ে গেল ফিহার অন্ধকার মুখ দেখে।

তা সত্ত্বেও পরের দিন পেট স্ক্যান করতে যেতে হবে। তাই ওটা কোন দিকে সেটা ঠিক করতে ম্যাপ দেখে ফিহা বললো এবারের গন-ব্য একটু বেশী দূরে। তাই ওখানে যেতে ট্যাক্সি নেওয়াই সিদ্ধান- হলো।

২৯

পরের দিন সকালে নাস-া খেয়েই হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা একটা ট্যাক্সি নিলাম। ওয়াটারলু স্ট্রিটের মোড় থেকে ট্যাক্সি নিয়ে ফিহা বললো, ‘অর্চার্ড রোড, শ’ হাউস।’

ড্রাইভার আর দ্বিতীয় কথা না বলে বাস বাসাহ রোড পার হয়ে অর্চার্ড রোডে পড়লো। আমি ফিহাকে ফিস ফিস করে বললাম, ‘অর্চার্ড রোডে তো এসেই গেলাম হেঁটে এলেই তো হতো।’

একটু পরেই আমার ভুল বুঝতে পারলাম, যখন অর্চার্ড রোড ধরে ট্যাক্সি একই গতিতে না থেমে প্রায় মিনিট বিশেক চলার পর স্কট স্ট্রিটের মোড়ে এসে ঠিক শ হাউসের সামনে এনে ট্যাক্সি থামালো। পপি আর ফিহা তো বটেই, যে দূরত্ব অতিক্রম করে ট্যাক্সিটা আমাদের এখানে আনলো, সেটা আমার মতো পাঁড় হাঁটিয়েরও হেঁটে আসতে যথেষ্ট কষ্ট হতো। আমার মনে হলো বিমান বন্দর থেকে আমাদের হোটেল যতদূর এ দূরত্বটা তার অর্ধেকের চেয়ে কম হবে না। মিটারে দেখি উঠেছে তের ডলার। ফিহা ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে নামার পর ওর সাথে এ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলাম। ও স্বীকার করলো ব্যাপারটা। রিসেপশন কাউন্টার থেকে অফিসটা কোন দিকে জিজ্ঞেস করে ফিহা নিশ্চিত হলো ট্যাক্সি ঠিক জায়গাতেই নিয়ে এসছে আমাদের।

একটা নির্দিষ্ট তলা পর্যন- উঠে গিয়ে দেখি ওটা একটা কার পার্ক। এদিক ওদিক উঁকি মেরে দেখি কার পার্কটা পার হয়ে ভবনের আর এক মাথায় গিয়ে দেখি ভবনটার আর এক পাশে নিরিবিলি কোনায় ওদের সেন্টারটা। ভিতরে গিয়ে চমৎকৃত হলাম। আসলেই একটা আন-র্জাতিক মানের ডায়াগ্‌নস্টিক সেন্টার এটা। কাউন্টারে গিয়ে ফিহা নিজের পরিচয় দেওয়ার সাথে সাথে ওর পাসপোর্ট চাইলো। র‌্যাফেলস্‌হাসপাতালেও চেয়েছিলো। এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়পত্র। আমরা যে দেশীয় নই সেটার প্রমাণপত্র। কারণ সিঙ্গাপুরী নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র দেখালে চিকিৎসা পরীক্ষা ব্যবস’া অত্যন- কম মূল্যে আর তার জন্যে সরকারও অনেক ভর্তুকি দেয়।

পাসপোর্ট আর ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া সব কাগজপত্র জমা নিয়ে অপেক্ষা করতে বললো। মিনিট পনেরো পর একজন এপ্রোন পরা এটেন্ডেন্ট এসে একটু মিষ্টি হেসে ফিহাকে বললো, ‘চলেন আমার সাথে।’ আর ও আমাদের বললো ওখানেই বসে অপেক্ষা করতে।

র‌্যাফেলস্‌অথবা এই এশিয়ামেডিক ডায়াগ্‌নস্টিক কোথাও রোগীর সাথে কে এসেছে তা জিজ্ঞেসও করলো না। ওদের সাথে রোগীর সম্পর্ক আর যে বিল পরিশোধ করতে পারবে তার সম্পর্ক। এখানে বাবা কিংবা মা, স্ত্রী অথবা স্বামী তা নিয়ে ওদের কোন মাথা ব্যাথা নেই।

প্রায় দুই ঘন্টা চুপ করে বসে থাকার পর ঐ এটেন্ডেন্টটা আমাদের কাছে এসে বললো, আপনারা এখন ওর সাথে দেখা করতে পারেন।’

এ করিডোর ও করিডোর পার হয়ে একটা ঘরে ঢুকে দেখি ফিহা একটা ধবধবে সাদা হাটু পর্যন- ঝুলের লাউঞ্জ টাওয়েল পরে বসে আছে। কী সুন্দর যে ওকে লাগছিলো তা বলার না। মনে হচ্ছিলো হলিউডের কোন সুপুরুষ নায়ক! মাথায় চুল নেই তো কি হয়েছে? হলিউডের নায়কদের অনেকেই তো টাক করে অভিনয় করে। ফিহার হাতে একটা বড় ধোঁয়াওঠা মগ। ও মাঝে মাঝে ওতে চুমুক দিচ্ছে।

পরে শুনেছিলাম পেট স্ক্যান করার ঘরটা অত্যন- ঠাণ্ডা বলে স্ক্যান করার পর রোগীর শরীরকে একটু চাঙ্গা করে দেওয়ার জন্যে ওরা রোগীকে গরম কোকো আর হাই প্রোটিন বিস্কুট খেতে দেয়।

এরপর ওরা বললো রিপোর্ট আর আমাদের সব কাগজপত্র ওরা দুদিন পর র‌্যাফেলস্‌এই পাঠিয়ে দেবে।

তারপর ফিহা কাপড় বদল করলে আমরা আবার হোটেলে ফিরে এলাম।

এর পর থেকে প্রতিদিন আমাদের দৈনন্দিন সূচী প্রায় একই দাঁড়ালো। সকালে উঠে প্রাতঃকৃত সেরে নাস-া খাওয়া। সকালের বেশ কিছুক্ষণ সামনের চত্তরে ঘোরাফেরা করা অথবা চার-পাশের পথগুলো ধরে আধা মাইল এদিক ওদিক যাওয়া আর ফিরে আসা। হোটেলে ফিরে এসে দুপুর পর্যন- বিছানায় শুয়ে-বসে ঝিমানো অথবা অর্থহীন কথাবার্তা বলা। তারপর মোস-ফা মার্কেট পর্যন- হেঁটে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে রাতের খাবার কিনে আবার হেঁটে হেটে হোটেলে ফিরে ঘুমানো। বিকালে সন্ধ্যে পর্যন- আবার চত্তরটার এদিক ওদিক হাঁটা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে হোটেলে ফিরে আসা।

পেট স্ক্যান আর ওয়াকস্‌কিউব পরীক্ষা বাবদ আমাদের সিংহভাগ টাকা আলাদা করে রাখতে হলো। এর পর আবার কনসালটেন্ট ফি দিতে হবে। তারপর যদি আরও কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা ওরা বলে তার জন্যে অন্য কোন কাজে টাকা খরচ করতে ভয় হলো- পাছে পরে বিদেশ-বিভূঁইয়ে টাকা নিয়ে টানাটানিতে পড়ে যাই।

প্রতিদিনই একবার র‌্যাফেলস্‌এ ফোন করি, রিপোর্টের কি খবর? ওখান থেকে বলা হচ্ছে রিপোর্ট পেতে দেরী আছে, কনসালট্যান্টের এপয়েন্টমেন্ট এখনও করা যাচ্ছে না, কিংবা জনস-হপকিন্স হাসপাতালে সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে- এই সব। অপারেশনের পর বায়োপসি রিপোর্ট পাওয়া নিয়ে নিয়ে যে একটু অন্য রকম ঘটনা ঘটেছিলো- হঠাৎ ব্যাপারটা আমার কাছে সে রকম মনে হলো।

কিন’ এ নিয়ে পপির সাথে কিংবা ফিহার সাথে কোন আলাপ করি না। রোজ ঢাকার সাথেও কথা হয়। ওখান থেকে ওয়াহিদও বলে অপেক্ষা করতে। ওরা বলে, সময়টা ঘরে বসে না থেকে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করো, জুরং বার্ড পার্কে যাও, মেরলায়ন পার্কে যাও, চিড়িয়াখানায় ঘুরে আসো, সিঙ্গাপুর ফ্লায়ারে উঠে সারা সিঙ্গাপুরটা দেখো- এই সব। কিন’ ক্যানসারে আক্রান- সন-ানের বাবা-মা-র মনে সব সময় যে কি ঝড় বয়ে যায়, সে কথা ওদেরকে কিভাবে বোঝাই? তা’ছাড়া ফিহা নিজেও তো খুব উচ্ছল প্রকৃতির ছেলে না, ও শান- ছেলে। তার ওপর ক্যানসারে আক্রান- হয়ে আরও ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। ও তো অনেক আগে থেকেই সারাক্ষণ চুপ করে শুয়ে-বসে থাকতেই পছন্দ করতো। এখন ও আরও চুপ করে থাকে। আগে কোনদিনই আমরা ওর ওপর কোন জোর-জবরদসি- করতাম না, এখন কিভাবে করি?

পপি অত্যন- নার্ভাস ধরনের মেয়ে। ঢাকায় থাকলেও পথে বের হলে সব সময় অসি’র থাকে না জানি কি ঘটবে সেটা মনে করে। এখন এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এদিক ওদিক বের হলে না জানি কি হয়, এই ভয়ে হোটেলের চারপাশের তিন-চারটা রাস-ার বাইয়ে ডাইনে-বাঁয়ে আর কোন দিকে যেতেও ও নারাজ। আর ফিহা নিজেও ওর রোগ নিয়ে বেশ বিব্রত- একে তো অসুস’তাজনিক কষ্ট তো আছেই, তার ওপর যেটা ওর কাছে বড়, ও নিজে থেকে না বললেও আমি বুঝতে পারি- সেটা হলো, ও অসুস’ হয়ে আমাদেরকে- ওর বাবা-মাকে, ও যে অপরিসীম অসুবিধায় ফেলেছে, এই মানসিক কষ্টটাও ওকে আরও বিব্রত করে রাখে সব সময়। কেমন একটা হীনমন্যতায় ডুবে থাকে ও সব সময়।

এই দুই জন অনিচ্ছায় ডুবে থাকা মানুষকে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে চালণনা করা আমার পক্ষে সত্যিই দুঃসাধ্য। এদিকে র‌্যাফেলস্‌থেকে যদি রিপোর্ট সম্পর্কে কিংবা এপয়েন্টমেন্ট সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট করে কিছো বলতো তা’ হলেও একটা পরিকল্পনা করা যেতো। তা’ও পাওয়া যাচ্ছে না।

ঢাকার আত্মীয়-স্বজনের চাপে শেষে একদিন পপি আর ফিহা সিদ্ধান- নিলো জুরং বার্ডূ পার্কে বেড়াতে যাবে।

ম্যাপ দেখে ফিহা বললো, ‘জুরং বার্ড পার্কটা শহরে আর এক কোনায়। হোটেল থেকে বহু দূর। ট্যাক্সিতে অনেক ভাড়া উঠবে। কিভাবে যাওয়া যায়।’

পপির অকারণে এত টাকা ট্যক্সির পিছনে ব্যয় করাটা অপচয় ছাড়া আর কিছু না। ও বললো বাসে যাওয়া যায় কিনা সেটা দেখতে।

আমি এবার বলতে চেষ্টা করলাম বড় বড় শহরে পাতাল রেলের ব্যবস’া আছে, যার ভাড়া অন্য সব বাহনের চেয়ে অনেক কম। সিঙ্গাপুরে এ বাহনটার নাম এমআরটি। এই গাড়িতে চড়তে পারলে দ্রুতও যাওয়া যেন, ব্যয়ও কম ততো।’

পপি বিরক্ত হয়ে বললো, ‘সিঙ্গাপুরের কোথায় সেই বাহন তুমি তো জানো না।’

আমার সব ব্যাপারেই পপির প্রচুর সন্দেহ। তার ধারণা আমি এ যুগে একেবারেই অচল মানুষ। তাই এবারেও চুপ করে থাকলাম।

Leave a Reply