সায়েম মাহমুদের নিস্ফল দ্বৈরথ অধ্যায় ৮

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে দেখি বামপাশে একটা উঁচু কাউন্টার। এটাই অফিস। দুজন প্রৌঢ়া মহিলা কাউন্টারের ওপাশে বেশ ব্যস- হয়ে কি সব করছে।

আমি ফিহাকে বললাম, ‘যে কয়দিন আমরা সিঙ্গাপুরে থাকবো, সব কথাবার্তা-কাজকর্ম তুমিই করবে। আমরা তোমার ল্যাংবোট।’

ফিহা এগিয়ে গিয়ে বললো আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমাদের বুকিং আছে- সিদ্দিক মাহমুদুর রহমানের নামে।

একজন মহিলা সাথে সাথে হোটেলের পরিচিতি দেওয়া একটা প্লাস্টিকের বড় টোকেন লাগানো রিঙের একটা চাবি এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘রুম নাম্বার থার্টি সেভেন। ব্রেকফাস্ট এট এইট ট্যু নাইন। চেক আউট টুয়েল্‌ভ ও কক। পেমেন্ট ইন এডভান্স। এনি প্রবলেম গিভ এ রিং অন ১০। দেয়ার উইল বি টি ইন ইওর রুম।’

আমাদের সঙ্গে আমেরিকান ডলার। তখনও ডলার ভাঙানো হয়নি। সাবের অবশ্য বলে দিয়েছে হোটেলে মালপত্র রেখে মোস-ফা মার্কেটে আসতে ডলার ওখান থেকে ভাঙানো সুবিধা।

ফিহা কাউন্টারের মহিলাকে বললো, ‘ক্যান উই পে ট্যু আওয়ারস্‌লেটার?’ আমাদের দুই-এক ঘন্টা দেরী হবে। ডলার ভাঙাতে হবে।’

ওরা বললো কোন অসুবিধা নেই। আজ রাত বারটার আগেই দিলে হবে।

কাউন্টারের ডান দিকে লিফ্‌ট আর লিফটের বাম পাশে সরু লম্বা একটা ঘর, তাতে কয়েকটা টেবিল পাতা। বুঝলাম ওখানে ব্রেকফাস্ট সরবরাহ করা হবে।

কাউন্টারের আর একপাশে একটা লিফট্‌। লিফটে উঠে তিন তলায় গেলাম। শীল বাবু আমাদের সাথেই আছেন। তিনি আমাদের সাথে সাথে লিফটে চললেন ঘর দেখতে। যদি প্রয়োজন হয় তাই।

চাবি দিয়ে দরজা খুললাম। ঘরটা অন্ধকার। পাশে হাতড়ে একটা সুইচবোর্ডও পেলাম। সুইচ টিপতে আলো জ্বললো না। এ কী দুর্ভোগ! আবছা আলোয় মনে হলো ঘরটা বেশ বড়ই। তিনটা সিঙ্গল বেড, পাশে ছোট ছোট নীচু বেডসাইড টেবিল, একটা বড় আয়না দেয়া ড্রেসিংটেবিলের মতো ফার্নিচার আর দেয়ালের সাথে লাগানো টিভি। ঘরে এসিও আছে। টেবিলটার ওপর একটা টেলিফোনও রয়েছে।

আমরা ঘরে ঢোকার প্রায় সাথে সাথে টেলিফোনটা বেজে উঠলো। আমি একটু অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরে কথা বলে উঠলাম, ‘হ্যালো।’

ওপাশ থেকে একটা মহিলা কণ্ঠ শোনা গেল, ‘আই এম চরনজিত কাউর অব র‌্যাফেলস্‌হসপিটাল।’

আমি উত্তর দিলাম, ‘আই এ্যাম সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান ফ্রম বাংলাদেশ।’

মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইজ ইওর সান সাইম মাহমুদ একম্প্যানিইং ইউ?’

আমি উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ। আমার পুত্র আর আমার স্ত্রী আছেন আমার সাথে।’

মহিলা বললেন, ‘আপনার ছেলে সাইম মাহমুদের আগামী কাল বেলা তিনটায় র‌্যাফেলস্‌হাসপাতালের স্পেশালিস্টের সাথে এপয়েন্টমেন্ট আছ্‌ে। আপনারা পৌনে তিনটায় র‌্যাফেলস্‌এর রিসেপশন কাউন্টারে হাজির হয়ে আমাকে খবর দেবেন।’

এর মধ্যে ফিহা এগিয়ে ১০ টিপে নীচের কাউন্টারে জিজ্ঞেস করলো কিভাবে আলো জ্বলবে। ওদের কথা একটু শুনে নিয়ে ফিহা আমার হাত থেকে চাবির রিংটা নিয়ে সাথে যে প্লাস্টিকের ট্যাগ রয়েছে সেটা সুইচ বোর্ডের ওপরের ছিদ্রে ঢুকাতেই ঘরে আলো জ্বলে উঠলো।

ফিহা হেসে বললো, ‘আর একটা নতুন জিনিষ শিখলাম এদেশে এসে। যতক্ষণ এই ট্যাগটা ঐ খোপে থাকবে, ততক্ষণ আলো জ্বলবে। ট্যাগ বের করে নিলেই আলো বন্ধ। এ ব্যবস’া বাংলাদেশে চালু করলে কত লক্ষ টাকার বিদ্যুৎ যে সাশ্রয় করা যাবে তা’ বোঝ একবার। কোন অফিসে গেলেই দেখা যায় ঘরে ফ্যান ঘুরছে, লাইট জ্বলছে, ঘরে লোক নেই।’

ঘরে মালপত্র রেখে আমরা আবার বের হলাম। মোস-ফা মার্কেটে কিভাবে যাবো তা জানা নেই। তবে সঙ্গে শীল বাবু আছেন, ভয় কি?

আবার ট্যাক্সি নিলাম। এয়ারপোর্ট থেকে হোঠেল আসতেই প্রায় ত্রিশ ডলার উঠেছিলো মিটারে। শীল বাবু বলেছিলোন, ‘দাদা, এটা ঢাকা না। ট্যাক্সি হাত দেখালেই থামবে, যেখানে যেতে চাইবেন সেখানেই যাবে। রাস-ার এ মোড় থেকে ও মোড়ে গিয়ে ছেড়ে দিলেও আপত্তি নেই। মিটারে যত টাকা ওঠে সেটাই দিতে হবে।’

ফিহার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ভাতিজা, সাদা ট্যাক্সির মিটারের চার্জ বেশী। তাই সাদা ট্যাক্সিতে দায়ে না ঠেকলে উঠবা না।’

মিনিট পনেরো পরেই ট্যাক্সি এসে থামলো এক জায়গায়। দেখি পাশে একটা মসজিদ। বড় করে লেখা ‘মসজিদে এ্যঙ্গুলিয়া।’ ভাড়া উঠলো মাত্র সাড়ে তিন ডলার। বংলাদেশের টাকায় একশ’ আশি টাকার মতো। হলেও ওখানে তো মাত্র চার ডলার, ভাবা যায়! ঢাকার ট্যাক্সি চার, দশ বিশ, চল্লিশ টাকা ভাড়ায় তো যাবেই না।

শীলবাবু বিমান বন্দর থেকে হোটেল পর্যন- আর এখন মোস-ফা মার্কেট পর্যন- সারাটা পথ আমাদের সাথে সাথে বক বক করে সিঙ্গাপুর সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার কথা বয়ান করতে থাকলেন আমাদেরকে একটুখানি অভিজ্ঞ করে দেওয়ার জন্যে।

ট্যাক্সি থেকে নেমে মোস-ফা মার্কেটের ফুটপাথে উঠে দাঁড়াতেই সাবের এসে হাজির হলো। যেখানে নেমেছি তার ডান দিকেই মোস-ফা মার্কেট। সাবের ফিহাকে দেখিয়ে দিলো ডলার কোথায় আর কি ভাবে ভাঙাতে হবে। সামনের ফুটপাথে দেখি একটা টেবিলের ওপর সাদা সাদা গোল কি যেন সাজানো। সাবের বললো, ‘ডাবের উপরের ছাল কেটে বরফ পানির মধ্যে চুবিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে ভিতরের পানি অতিরিক্ত ঠাণ্ডা হয়। শীল বাবু সহ আমাদের চার জনকে চারটা ডাব দিতে বললো।

এক পাশটা ফুটো করে স্ট্র লাগিয়ে এগিয়ে দিলো। সাদা বলের মতো ডাবটা ধরতেই পারছিলাম না, এতো ঠাণ্ডা। চুমুক দিতে মনে হলো কোকাকোলা, পেপসি জাতীয় পানি পন করছি। তবে ঢাকার কচি ডাবের মতো হালকা নোনতা না স্বাদটা। বেশ মিস্টি আর ঝাঁঝ। তাকিয়ে দেখি যাদের পানি পান করা হয়েছে তারা দোকানীকে দিয়ে ডাবটার খোল দুই টুকরো করে নিচ্ছে। ভিতরে বেশ পুরু শাঁস। এদেশের এটাই নিয়ম। কেবল এদেশ না মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশীয়া আর থাইল্যান্ডে ডাব এভাবেই খায়। কচি ডাব ও দেশে চলে না। আমি অবশ্য আর শাঁস খেলাম না। তাকিয়ে দেখি আর সবাই মজা করে খাচ্ছে।

সিঙ্গাপুরের মোবাইল কোম্পানীর একটা সিমও কেনা হলো। হঠাৎ আমার মনে হলো আমাদের মোবাইল চার্জারের মাথাটা তো গোল আর এখানকার বিদ্যুৎসামগ্রী সব কিছুই চেপ্টা। মোবাইল চার্জ দেবো কিভাবে? যাদের কাছ থেকে সিম কিনলাম তাদেরকে সমস্যার কথা বলতেই একটা কনভার্টার দিয়ে দিলো। বললেঅ, ‘যখন ফিরে যাবেন দিয়ে দিয়েন।’ আমরা কোথায় উঠেছি। কতদিন থাকবো, কিছুই জানে না ও। শুধু বাঙালী তাই দিল দরিয়া।

ফিহাকে বললাম, ‘ঢাকায় দোকানদারদের এরকম ব্যবহার ভাবাই যায় না।’

ও হেসে উত্তর দিলো, ‘সে আর বলতে। এই ফাঁকে এই কনভার্টার বিক্রি করতো নিদেন পক্ষে দুই শ’ টাকা দিয়ে।’

এর মধ্যে শীল বাবু চলে গেলেন, কাছেই ওর বাসা। যাবার আগে বললেন, ‘দৈনিক এক শ’ আঠারো ডলার দিয়ে দামী হোটেলে না থেকে অনেক সস-ায় অর্ধেকের কম দামে মোস-ফা মার্কেটের ধারে কাছে থাকলে সাশ্রয় হবে।’

আমরা বললাম, ‘দেখি দুই এক দিন।’

সাবের আমাদেরকে নিয়ে ওখান থেকে আর একটু এগিয়ে গিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে দিলো। বললো, ‘এখানে খুব সস-ায় ভাত ডাল আর মুরগী খেতে পারবেন। সবজি, ভাজি আর নানা রকম মাছও আছে। স্বাদ খুব ভাল।’

আমরা ঠিক করেছিলাম রাতে রেস্টুরেন্টের খাবার খাবো না। ব্যাংকক থেকে উড়াল দেওয়ার পর বিমানে যে প্রচুর খাবার দিয়েছিলো, তার বেশ কিছু আমি আমার ব্যাগে ভরে নিয়েছিলোম। কাজটা একটু ছেঁচড়ামির পর্যায়ে পড়ে, লজ্জা লাগছিলো। কিন’ এত খাবার আমরা তো খেতে পারছিলাম না। ফেরত দিলে সবটুকুই তো ওরা ফেলে দেবে। পরে অবশ্য দেখেছিলাম, হোটেলে সকালে যে খাবার দেয়া হতো যার যতটুকু নিজে তুলে নেওয়ার ব্যবস’া ছিলো। অধিকাংশ প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ বাসিন্দারা হাতের ব্যাগে ভরে নিয়ে যেতো, ঐ দিয়ে দুপুরের খাবারটার চালিয়ে নিতো।

সাবেরও চলে গেল আর আমরা আবার ট্যাক্সিতে করে ফেরত এলাম হোটেলে। যাওয়া আর আসার সময় আমি পথটা ভাল করে খেয়াল করতে বললাম ফিহাকে।

হোটেলে ফিরে প্রথম কাজ যেটা ফিহা করলো সেটা হলো হোটেলের আগামী তিন দিনের ভাড়া অগ্রিম দিয়ে দেওয়া। ঢাকা থেকে ঐ তিন দিনের বুকিংই করে দেয়া হয়েছিলো। এর পরে বেশী দিন থাকতে হলে আবার ওদের সাথে কথাবার্তা বলে ঠিক করতে হবে। আমাদের আলোচনার ফলে ফিহা অবশ্য ওদের সাথে সাত দিনের ভাড়ার হিসাব মিটাতে চেয়েছিলো। কিন’ ওরা বললো আগামী তিন দিন পর্যন- হোটেলের সব ঘর বুকড্‌হয়ে আছে। আর চতুর্থ দিন আমাদের ঘরটায় অন্য বুকিং দেওয়া আছে। তাই তিন দিন পরে যে ঘর খালি হবে সে ঘরটা আমাদের দেয়া হবে।

সিঙ্গাপুর আসার পর প্রাথমিক ঝামেলাগুলো মিটে যাওয়ার পর আমরা নিশ্চিনে- ঘরে এসে কাপড় বদলালাম। মুখ-হাত ধুলাম। ফিহা ওর মাকে শিখিয়ে দিলো কিভাবে কমোডে বসে মল ত্যাগ করার পর শরীর পরিষ্কার করতে হবে। আসলেই এটা একটা ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা, যা পপিকে কোনদিনই সম্মুখীন হতে হয়নি। আমি তবু দুই একবার ওয়াহিদের অফিসের কাজ করার সময় সোনারগাঁও আর শেরাটন হোটেলে তিন-চার দিন সকাল থেকে রাতপর্যন- কাটাতে হতো বলে কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছিলো।

ঢাকা থেকে অনেকেই আমাকে বলে দিয়েছিলো, হোটেলের টেলিভিশনে অনেক সময় পে চ্যানেল থাকে। আমরা যেন চ্যানেলগুলো সাবধানে দেখি। অনেক চ্যানেল বাবা-মা-সন-ান এক সাথে বসে দেখার না। তার পর তার আলাদা বিল আসবে গলা কাটা।

এই ভয়ে সে রাতে যতক্ষণ জেগে ছিলাম টেলিভিশন খুলতে সাহস পাইনি। ফিহা ওর মাকে কাগজ-কলম নিয়ে হিসাব করতে বসে গেল কত টাকায় কত আামেরিকান ডলার পাওয়া গিয়েছিলো, ঢাকা থেকে প্লেনে রওনা হওয়ার সময়।

আমাদেরকে প্লেনের টিকিট হাতে ধরিয়ে দেওয়ার সময় ওয়াহিদ বলেছিলো, ‘সিদ্দিক ভাই। তিন লক্ষ নব্বই হাজার টাকায় সাড়ে পাঁচ হাজার আমেরিকান ডলার হয়। পুরো ডলারই আপনাদের দিয়ে দিচ্ছি।’

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আর প্লেনের টিকিটের টাকা?’

ওয়াহিদ একটু হেসে বললো, ‘আপনারা আগে সিঙ্গাপুর থেকে পরীক্ষা করিয়ে আসেন। আপনিও আছেন আমিও আছি। ওটাকার হিসাব পরে করা যাবে। এখন ওটা নিয়ে আপনার চিন-া করার দরকার নেই।’

তারপর ও বলেছিলো এক আমেরিকান ডলারে দেড় সিঙ্গাপুর ডলার পাওয়া যেতে পারে। হোটেলে প্রতি দিন কত ডলার লাগবে, র‌্যাফেলস্‌হাসপাতালে প্রাথমিকভাবে কত ডলার দিতে হবে। পেট স্ক্যান করতে কত ডলার লাগবে। এ রকম বড় সব খরচের খাতগুলো ও বলে দিয়েছিলো।

রাতে বিছানায় শোয়ার আগে ফিহা ওর মাকে ভাল করে বুঝিয়ে দিলো ও কত আমেরিকান ডলার ভাঙিয়ে কত সিঙ্গাপুরী ডলার পেলো। যাতায়াতে কত খরচ হলো, খাবারে কথ লাগলো। এই সব খুঁটিনাটি হিসাব কাগজে লিখে লিখে বুঝিয়ে দিতে লাগলো। ফিহা আমাকেও বললো, ‘আব্বু তুমিও দেখে রাখো কোন খাতে কত ডলার খরচ হচ্ছে।’

যাই হোক এই সব কথাবার্তা আর হিসাব করতে করতে রাত গভীর হলে আমরা বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।

২৬

নতুন জায়গার কারণে বেশ সকালেই ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দেখি ফিহা আমার আগেই উঠে পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আমি মুখ-হাত ধুয়ে টয়লেট থেকে বের হতে বললো, ‘আব্বু এদিকে আসে দেখ।’

এগিয়ে গিয়ে দেখি আমাদের পাশের ভবনটা একটা মন্দির। ছাদটা চীনা গঠনরীতি অনুযায়ী ঢেউ খেলানো চৌচালা। ছাদের কার্নিশে নানা রকম ছোট ছোট ড্রাগন আর প্রাণীর মুর্তি। এক কথায় চমৎকার!

করিডোরে তখন হুটপাট শব্দ। ফিহা হেসে বললো, ‘বাসিন্দারা ছুটছে ব্রেকফাস্ট করতে।’

আমি বললাম, ‘চলো যাই, সিঙ্গাপুরী ব্রেকফাস্ট খেয়ে দেখি।’

পপি সবসময়েই একটু সাবধানী স্বভাবের, বললো, ‘দেখেশুনে, বুঝে খেয়ো, কিন’।’

আমরা জামাকাপড় পরে ফিটবাবু হয়ে লিফটে করে নীচে নামলাম। গিয়ে দেখি ঘর প্রায় ভরা। কোন রকমে তিনটে সিট পেয়ে প্রথমে বসলাম, তারপরে উঠে বুফে ধরনে একটা প্লেট নিয়ে খাবার রাখার জায়গায় গিয়ে দেখি এক একটা ডিশে এক এক রকম খাবার সাজানো। দুটো ডিশে বড়া ধরনের কি যেন, নাম-টাম লেখা নেই। তার পাশের আমাদেও দেশের ভাঁপা ধরনের কিছু, পরের দুটো ডিশে দুই ধরনের নুডুলস্‌অথবা চাওমিন। আরও দুই একটা জিনিষ।

আমি মনে মনে ভাবলাম, যা থাকে কপালে প্রত্যেকটা একটা করে নিয়ে দেখবো কোনটা কেমন। আন-র্জাতিক মানের হোটেল তাই কোন অখাদ্য ধরনের জিনিষ, অক্টোপাস, সাপ, ব্যাং, গিরগিটি- এসব নিশ্চয়ই থাকবে না।

খাবার তুলে টেবিলে এসে বসে ভাঁপাটা প্রথম ধরে দেখি ওটার চার পাশ পাতলা কাগজে মোড়ানো। খুলতে বেশ বেগ পেতে হলো। বড় করে হা করে অভদ্রের মতো তো খাওয়া ঠিক না, তাই কিছুটা খুলে ছুরি দিয়ে কেটে মুখে দিয়ে দেখি একেবারে বিস্বাদ- না ঝাল, না লবন, না মিষ্টি – কেমন একটা স্বাদ। পছন্দ লাগলো না। তবু কষ্ট করে অর্ধেকটা খেলাম। বড়া জাতীয় জিনিষগুলো তবু বেশ স্বাদের – ঝাল-ঝাল, মিষ্টি-মিষ্টি। মজাই লাগলো। ওরই তিন-চারটা খেলাম। ফিহা অবশ্য নডুলস্‌পেয়েই খুশি- সেটাই খেলো। আমি অবশ্য বেশ একটু শঙ্কিত থাকলাম ওকে নিয়ে কখন আবার বমি করে কেমোথেরাপির প্রভাবে।

খাওয়া সেরে হোটেল থেকে বাইরে বেরিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। হোটেলটার সামনে বিরাট একটা চত্তর। কাল সন্ধ্যার অন্ধকারে ভালমতো দেখতে পাইনি, তবে বোঝা গিয়েছিলো চত্তরটা বেশ বড়, ঠিক রাস-ার মতো সিমেন্ট বা পীচের তৈরী না। ইট বিছানো। রাতের একেবারে নির্জন চত্তরটা এখন একেবারে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। লক্ষ্য করে দেখলাম ওয়াটার লু স্ট্রীট যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই চত্তরটার আরম্ভ। চত্তরটার পূব দিকে প্রথমে ফরচুন সেন্টার, তারপর শ্রীকৃষ্ণন মন্দির আর গডেস অব মার্সি টেম্পল। এই টেম্পলটার গা ঘেঁষেই হোটেলটা। চত্তরটার পুরো পূব আর দক্ষিণ দিক জুড়ে অসংখ্য অস’ায়ী দোকান। একেবারে গুলিস-ানের মোড়ের মতো।

প্রচুর দোকানদার নানা রকম পসরা সাজিয়ে সারা চত্তরটা ভরে রেখেছে- কিন’ অত্যন- সুশৃঙ্খল, কোন চিৎকার করে লোক আকর্ষণ করা নেই, হৈচৈ নেই। চত্তরটাকে ঘিরে চার দিকে চারটা পথ বেরিয়ে গেছে। এ সব পথ কেবল পায়ে হাঁটা। গাড়ি চলার কোন নিয়ম নেই এখানে। চত্তরটার সবটা আর চার পাশের পথগুলোর দুই ধারে অন-তঃ কয়েক শ’ দোকান। বেশ কিছু বেশ বড় দোকান, আবার কতকগুলো বেশ ছোট। ছোটগুলো আবার বড় বড় রঙীন ছাতা দিয়ে ঢাকা। সারা চত্তর জুড়ে বেশ অনেকগুলো কবুতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। চত্তরটার চার ধারে উঁচু গাছ। রাতে কবুতর ওখানেই থাকে। বাড়িগুলেঅর কার্নিশে, ঘুলঘুলিতে বাসা বানিয়ে যে ওরা ডিম পাড়ে, বাচ্চা ফুটায় তা বোঝাই গেল। প্রায় সবকয়টাই আমাদের দেশের জালালী কবুতরেরই জাত বলে মনে হলো, এগুলোর মধ্যে একটা কি দুটো সাদা। একটা কালো রঙের বিড়াল, লেজটা বেশ মোটা আর খাটো, চত্তরটার এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছে। বেশ স্বাস’্যবান দেখে মনে হলে খাওয়া-দাওয়া ওর ভালোই হয়।

খোলা জানালা দিয়ে যে মন্দিরের ছাদ দেখেছিলাম সেটা চীনা কিংবা সিঙ্গাপুরীদের গডেস অব মার্সি টেম্পল। ওতে বুদ্ধমুর্তি আছে নানা মাপের নানা ভঙ্গির। আরও কয়েকটা নানা মাপের নানা চেহারার দেব দেবীর মুর্তি। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ‘লাফিং বুদ্ধ’ মুর্তি। হাসিমুখ বৃদ্ধ কিংবা প্রৌঢ় চেহারার স্বাস’্যবান পেট মোটা টাক মাথা মুর্তি। পরে শহরের বিভিন্ন দোকানে ছোট বড় নানা আকৃতির এ মুর্তি চোখে পড়েছে।

আমাদের হোটেলের ঠিক পাশে এরকম পিতল রঙের একটা বিশাল প্রায় সাত ফুট বড় মুর্তি রাখা আছে। পায়ের নীচে চাকা লাগানো, সন্ধ্যে হলে ঠেলে দোকানের মধ্যে নিয়ে রাখা যায়। সকাল বেলা অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে বের হওয়া প্রায় সব বয়সের লোক ঐ পথ দিয়ে যাওয়ার সময় মুর্তিটার সামনে থেমে মাথা বার বার ঝুঁকিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে। ভুঁড়ির নাভির কাছটা একটু ফুটো- সেখানে টাকা-পয়সা গুঁজে দিয়ে দিনটা যাতে ভাল যায় তার জন্য প্রার্থনা করছে হয়তো। দোকান থেকে বেশ উচ্চশ্বরে প্রার্থনা সংগীত বাজছে। অনেকেই মন্দিরের সামনে গিয়ে দোকান থেকে পদ্ম, গোলাপ, ক্রিসেনি’মাম প্রভৃতি ফুল আর অদ্ভুত ধরণের গন্ধের ধুপ কিনে সামনে একটা বড় ট্রেতে রাখা কাঠ কয়লার আগুনে গুঁজে দিয়ে বারবার নত হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করে দ্রুত কর্মস’লের দিকে দৌড় দিচ্ছে।

আমরা তিন জন বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঐ সব দোকানের পণ্য আর দৌড়ে চলা মানুষের দুই-তিন মিনিটের প্রার্থনা করার দৃশ্য দেখতে থাকলাম। তার পর আমি ফিহাকে বললাম, ‘বিমান বন্দর থেকে হোটেলে আসার পথে র‌্যাফেলস্‌হাসপাতালের ভবনটা দেখেছি। চলো তো একটু ঐ দিকে হেঁটে দেখি অল্প একটু হাঁটলে হবে, না ট্যাক্সি নিতে হবে।’

ফিহা জিজ্ঞেস করলো, ‘অল্প না বেশী দূর কি করে বুঝবে?’

আমি বললাম, ‘মিনিট দশ-পনেরো হাটবো, যদি এম মধ্যে পেলাম তো ভালো, না হলে বুঝবো হেঁটে পোষাবে না।’

ফিহা আর পপি দুজনেই রাজি হয়ে গেল। সকাল মাত্র নয়টা বাজে, সারা দিনই আমাদের সামনে। বিকালের আগে তো আমাদের করার কিছুই নেই।

আমার একটু মনে আছে কোন দিক দিয়ে ট্যাক্সিটা এসেছিলো। আমরা সেই দিকে রওনা হলাম। পথ-ফুটপাথ সব ঝক্‌ঝক্‌করছে। কোথাও একটু ধুলো বা ময়লা চোখে পড়লো না। কথাটা ফিহাকে বলতে ও চট করে বসে পড়লো। তারপর আঙুল দিয়ে ফুটপাথ আর রাস-ার ওপর ঘসা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তার পর আঙুলটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘দেখ আব্বু আঙুলে কোন ময়লা নেই, ধূলোও না। আশ্চর্য না?’

ওর চোখ চক চক করছে উত্তেজনায়। ওর আনন্দ আমার মধ্যেও সঞ্চারিত হলো। হোটেল থেকে বেরিয়ে সামনেই বিশাল টি বেনকুলেন ভবন। এটার প্রথম দুই তিন তলায় দামী মার্কেট আর উপরের তলাগুলোতে অফিস। ওখান থেকে সোজা হাঁটতে থাকলাম। প্রথম মোড় পার হয়ে দ্বিতীয় মোড়ের দিকে এগোতেই তাকিয়ে দেখি বামদিকে দূরে র‌্যাফেলস্‌হসপিটাল লেখা সাইনবোর্ড মাথায় করে দাঁড়িয়ে আছে একটা বড় ভবন। সামনে বুগিস জংশন। হাসপাতালটার কাছেই একটু ফাঁকা জায়গায় একটা এক তলা বাড়ি। ওটা যে আসলে তখনও বুঝতে পারিনি।

আমি হেসে বললাম, ‘ফিহা দেখ। ওখানে বিকালে আমাদের আসতে হবে। দশ মিনিও লাগবে না এ পথটা পার হতে।’

এবার হোটেলে ফেরার পালা। আর কোন কাজ নেই। ফেরার পথে দুপাশের দোকানে সাজানো হাজার হাজার মনোলোভা পণ্যসামগ্রী দেখতে দেখতো হোটেলে ফিরে এলাম। ব্রেকফাস্ট খেয়ে বের হওয়ার আগে অবশ্য ফিহা রিসেপশন কাউন্টারে ওদের জিজ্ঞেস করে জেনেছে টিভিতে কোন পে চ্যানেল নেই। ওটা একেবারে ফ্রি। ঘরে ঢুকে ফিহা একটু শুয়ে পড়ে টিভিটা চালিয়ে ইএসপিএন চালিয়ে খেলা দেখতে লাগলো। আমিও একটু কাত হলাম আমার বিছানায়। বেলা একটা পর্যন- তেমন কোন কাজকর্ম নেই। টিভি দেখতে দেখতে ফিহা এক সময় ঘুমিয়ে পড়তে আমি টিভি বন্ধ করে দিয়ে নিজেও একটু ঝিমিয়ে নিলাম।

Leave a Reply