সায়েম মাহমুদের নিস্ফল দ্বৈরথ অধ্যায় ৭

পর দিন সকালে সোনালী গাড়িতে করে বিমান বন্দরে পৌঁছে দিলো। নিজেও সঙ্গে থাকলো বহুক্ষণ।

বোর্ডিং পাস নেওয়ার জন্যে লাইনে দাঁড়ালাম। বেশ লম্বা লাইন। পরে দেখি একজন কর্মচারী এগিয়ে এসে পাশের প্রায় ফাঁকা লাইন দেখিয়ে বললো, ‘আপনারা এপাশের লাইনে দাঁড়ান।’

দূর থেকে আমাদের বড় সরির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সোনালী ঐ কর্মচারীকে অনুরোধ করাতে লোকটি এগিয়ে এসে আমাদের এই সুবিধা করে দিলো।

অবশেষে বোর্ডিং পাস পাওয়া গেল অতি অল্প সময়েই। এর পর ইমিগ্রেশনের জন্যে লাইনে দাঁড়ানোর পালা। বহুণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আমাদের সারির কর্মকর্তা এসে পাসপোর্ট চেক করা আরম্ভ করলেন। একে একে আমরা বুথের দিকে এগাতে থাকলাম। অবশেষে আমাদের সময় এসে গেল। আমি পপিকে বলেছিলাম, প্রত্যেকের পাসপোর্ট আর আনুসাঙ্গিক কাগজপত্র আলাদাভাবে প্রত্যেকের হাতে দিতে যাতে তদারকি তাড়াতাড়ি হয়। কিন’ ও সব একসাথেই অফিসারের হাতে দিলো। ভদ্রলোক অনেকণ পাসপোর্ট আর কাগজপত্র দেখে হঠাৎ বলে বসলেন, ‘আপনারা একই পরিবারের সদস্য অথচ আপনাদের ঠিকানা আলাদা এটা কি ব্যাপার?’

আসলেই কথাটা ঠিক। আমাদের তিন জনের পাসপোর্টের স’ায়ী ঠিকানা তিন রকম। তিন জনে তিন সময় পাসপোর্ট করার কারণে আর সারা দেশে আমাদের সত্যিই কোন স’ায়ী ঠিকানা নেই বলে, এক একজনের স’ায়ী ঠিকানা পৃথক হয়ে গিয়েছে।

অফিসার মহা ঝামেলা বাঁধিয়ে বসলেন। না, এটাতো হতে দেওয়া যায় না। আমরা যত বলি আমরা আমাদের ছেলের চিকিৎসার জন্যে বিদেশে যাচ্ছি, আমাদের কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই। কে শোনে কার কথা। ভদ্রলোক আরও দু’জন অফিসারকে ডেকে আনলেন। তারা নানা বিরূপ মন-ব্য করতে থাকলেন। এর মধ্যে পপি ভয় পেয়ে কাঁদতে আরম্ভ করেছে। ফিহা মুখও শুকনো। কি বলবে ও বুঝে উঠতে পারছে না। এমন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ওর কোন ধারণা ছিলো না। কারোরই এ বিষয়টা মাথায় ছিলো না।

শেষে অফিসারটি আমাদেরকে সাথে নিয়ে অন্য একটি ঘরে গেলেন, তার উপরের কর্মকর্তার সাথে বিষয়টা আরও জটিল করার জন্যে। এ অফিসারটি একজন মহিলা। সব কথা শুনে, পাসপোর্ট পরীক্ষা করে, পপির কান্না দেখে আর আমার যথাসাধ্য বিষয়টার ব্যাখা দেওয়ার প্রচেষ্টা দেখে তার কী মনে হলো, তিনি অফিসারকে বললেন বর্হিগমনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে দিতে।

ভদ্রলোকটি অত্যন- অসন’ষ্ট মুখে বেশ অনেক সময় ধরে পঁচা মাছ যেমন করে উল্টে-পাল্টে দেখে সেভাবে সব কাগজপত্র অনেকবার দেখেশুনে তারপর নিতান- অনিচ্ছায় পাসপোর্টে বর্হিগমনের অনুমতি সিল বসিয়ে পাসপোর্ট ফেরত দিলো। আমি মনে মনে হাঁফ ছাড়লাম- একটা জটিল বৈতরণী পার হলো।

ওখান থেকে রক্ষা পেয়ে আমরা অবসন্ন দেহে পাশের এটা চেয়ারে একটু বসেছি। এর মধ্যে আমাদের আর সব সহযাত্রী কোন দিকে গেল তা খেয়ালই করিনি। মনে করলাম মাইকে হয়তো বলবে কোন দিকে যেতে হবে। মিনিট পাঁচেক পর একজন কর্মকর্তা আমাদেরকে ওখানে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন আমরা কোথায় যাবো। সিঙ্গাপুরের কথা শুনে একটু অসন’ষ্ট হয়ে বললেন, ‘তা এখানে বসে আছেন কেন। ঐ করিডোর দিয়ে সামনে শেষ পর্যন- চলে যান।’

সেই পথে এগিয়ে গিয়ে দেখি, ঠিকই আর সব যাত্রী একটি হলের শেষ প্রানে- গিয়ে সাজিয়ে রাখা চেয়ার দখল করে বসে আছে। আমরাও তিনটা চেয়ার খালি পেয়ে বসে পড়লাম। এখন আমাদের আর কিছুই করার নেই বিমানে ওঠা ছাড়া।

এক সময় বিমান এলো। অন্য সব যাত্রী হুড়াহুড়ি করে বাইরে যাওয়ার দরজায় গিয়ে ঠেলাঠেলি আরম্ভ করে দিলো। পপি বললো একটু হালকা হোক তার পর এগোনো যাবে। মিনিট দশেকের মধ্যে ভিড় একটু হালকা হলে আমরা এগিয়ে গেলাম। অধিকাংশই নানা পেশার শ্রমিক। পপিকে দেখে ওপাশ থেকে এক অফিসার বললো, মহিলাকে আগে আসতে দেন। পপি এগিয়ে গেল, তার সাথে সাথে ফিহা আর আমি- মহিলার সঙ্গী হিসাবে। এক মিনিটের মধ্যেই গ্যাংওয়ে পার হয়ে বিমানের পেটের মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম।

আসন পেলাম বিমানের একবারে নাকের কাছটায়। সিটে বসে সামনের এক চিলতে দরজা খোলা থাকায় পাইলটের কার্যকলাপ দেখা যেতে থাকলো। কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বিমান আকাশে উড়াল দিলো। আমরা তিন জন এক সাথে প্রথম জীবনের বিদেশ ভ্রমণে রওনা হলাম।

২৩

আমি বাহাত্তর-তিহাত্তরের দিকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোলে পড়তাম তখন স্টুডেন্টস্‌কনসেশন পাওয়ার কারণে অনেক অল্প টাকায় ঢাকা থেকে যশোরে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছিলাম- কখনও ফকার, আবার কখনও ডিসি প্লেনে। সে সব প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা। পপি একবার বন্যার সময় নব্বইয়ের দিকে রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসেছিলো, ফিহা তখন বেশ ছোট।

আমাদের তিন জনের এটাই প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। প্রথমবার আমরা তিনজনে বিদেশে যাচ্ছি! এ ভ্রমণটা কত আনন্দের, উত্তেজনার আর উচ্ছাসের হতে পারতো! কিন’ কী নিদারুণ অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক আর ভীতি মনে মধ্যে নিয়ে আমাদের এ যাত্রা তা ভাষায় প্রকাশের নয়।

আমি আর পপি জানালার পাশের সিট পেয়েছিলাম। আর ফিহা বসেছিলো মাঝের সারির একেবারে ধারে আমার সিটের পাশে। এর মধ্যে আমি ফিহাকে বললাম জানালার পাশে এসে বসতে। ও কিছুক্ষণ জানালার পাশে বসে বিমানের উড়াল দেয়া দেখলো, তারপর নিজের সিটে বসে সিটটাকে যতটা সম্ভব নামিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো। ওর মুখটা একেবারে রক্তশূন্য। আমি বুঝতে পারলাম, অত্যন- বেশী মানসিক আর শারীরিক চাপে ও অনেকটাই বিপর্যস- হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশনের ঐ মানসিক অত্যাচারে ও বেশ বিপর্যস- হয়ে পড়েছিলো।

এর মধ্যে খাবার সরবরাহ করা হলো। খাবারের গন্ধে টের পেলাম আমরা সবাই কতটা পরিমাণ ক্ষুধার্ত। প্রায় গোগ্রাসে খাওয়া শেষ করলাম। খাওয়ার পর দেখি ফিহার মুখে কিছুটা রঙ ফিরে এসেছে। ও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।

ঘন্টা দেড়েক পর মাইকে ঘোষণা হলো আমরা ব্যাংককে কিছুক্ষণের যাত্রাবিরতি করবো। খথাটা শুনে আমি বেশ মজা পেলাম। ফিহা তখনও আচ্ছন্নের মতো সিটে চোখ বন্ধ করে আছে। আমি ফিহাকে ডেকে বললাম, ‘ফিহা আমরা এক টিকিটে দুটো দেশ দেখতে পারছি- প্লেনের জানালা দিয়ে হলেও তো প্লেনের জানালার বাইরেটা তো আর একটা দেশ!

প্লেনটা যখন ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো তখন ব্যংকক শহরটা, ওর দালান-কোঠা, পথ-ঘাট, রাস-ায় ছুটে চলা গাড়ি দেখতে দেখতে সুবর্ণভূমী বিমান বন্দরে প্লেনটা নামলো। রানওয়ের দুই ধারে নানা আকারের থাই এয়ারওয়েজ আর অন্য অনেক রকম বিমান সংস’ার প্লেন দাঁড়িয়ে আছে। ওগুলো দেখতে দেখতে ফিহার চোখে-মুখে অদ্ভুৎ আনন্দ আর উত্তেজনা লক্ষ্য করে আমার খুব ভাল লাগলো। মনে মনে সি’র করলাম, ও ভালো হয়ে উঠলে আমরা আবার বিদেশে বেড়াতে যাবো। হায়, সে আশা যে আর কোন দিন পূরণ হবে না, তা’ এক মুহূর্তের জন্যেও আমার মনে আসেনি।

বিমান থামতে প্রথমে বেশ কয়েক জন যাত্রী নেমে গেল। তার পর কয়েক জন নানা বয়সের থাই মেয়ে-পুরুষ প্লেনের মধ্যে ঢুকে অত্যন- দ্রুত প্লেনের ভিতরটা পরিষ্কার করে ফেললো। এর পর আরও কিছু যাত্রী প্লেনে এসে উঠলো। এ সব কার্যক্রম সম্পর্কেও আমাদের কারো কোন অভিজ্ঞতা ছিলো না।

প্রায় আধা ঘন্টা পরে বিমান আবার নড়ে উঠে আকাশে উড়াল দিলো। এবার আমাদের আসল গন-ব্য সিঙ্গাপুর।

বাকিটা পথ ফিহা গায়ের ওপর একটা পাতলা কম্বল জড়িয়ে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলো। ককপিট থেকে যখন ঘোষণা দিলো, ‘এখন আমরা সিঙ্গাপুরের চাঙি বিমানবন্দরে নামতে যাচ্ছি’, তখন ও চোখ খুলে তাকালো। জানালা দিয়ে সিঙ্গাপুর শহরটা দেখা গেল, সাগরটা দেখা গেল। তারপর ধীরে ধীরে বিশাল রানওয়ে বেয়ে বিমানটা নেমে টার্মিনাল ভবনের কাছে এসে থামলো।

যাত্রীরা তাড়াহুড়ো করে বাইরে যাওয়ার দরজায় ভীড় করলো। পপি বললো, ‘আমরা না হয় একটু পরেই বের হই। পৌঁছে তো গিয়েছি।’

আমি হেসে বললাম, ‘তা বটে, প্লেন থেকে এক্ষুনি না নামলে আমাদেরকে তো আর ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না।’

ফিহা আমার কথা শুনে ওর চিরাচরিত স্মিত হাসি হাসলো।

আমরা বিমান থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়েছি প্লেন থেকে নেমে আসা যাত্রীদের অনুসরণ করে। এমন সময় সুন্দর স্যুট পরা একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক সামনে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান?’

আমি উত্তর দিলাম, ‘জ্বি!’

‘আমি মাহবুব, বাংলাদেশ বিমানের। আসেন আমার সাথে।’

কথা কয়টা বলেই ঘুরে হাঁটতে আরম্ভ করলেন। আমরা ওঁকে অনুসরণ করলাম। কিছুদূর হাঁটতে হয় আবার কিছুদূর চলন- এসকেলেটর। পা বড়িয়ে দাঁড়ালেই হলো, নির্দিষ্ট গতিতে প্লাটফর্মটা এগিয়ে চলছে ক্রমাগত আর মালপত্র নিয়ে যাত্রীরা বিনা কষ্টে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারী মালামাল দিয়ে দ্রুত দীর্ঘ পথ হাঁটার কষ্ট নেই। মনে মনে ভাবলাম আমাদের দেশের কথা। এক একটা সরকার আসে আর যায়। সাধারণ নাগরিকের দুর্ভোগ বাড়ে বই কমে না। যে দীর্ঘ পথ একটার পর একটা এসকেলেটর ওয়ে পার হলাম, তাতে মনে হলে পথটা দুইকিলো মিটারের কম হবে না। ফিহাকে ব্যপারটা বলতে সেও আমার কথার সায় দিলো। ও কেবল অবাক বিষ্ময়ে চারপাশের পরিবর্তিত দৃশ্যপট দেখছে। নিজে কষ্ট করে হাঁটলে তো কেবল পায়ের দিকে চেয়ে চেয়ে হাঁটতে হতো। চারপাশের দৃশ্যপট দেখতে পারতো না।

অনেকদূর পার হওয়ার পর মাহবুব সাহেব যখন আমাদেরকে যে নীচে নামার এসকেলেটারের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন সেটা দেখে আমার মাথা ঘুরে উঠলো। নীচের মেঝেটা কমপক্ষে তিন তলা নিচে।

আমার এমনিতেই এসকেলেটরের চড়তে অস্বসি- লাগে, বিশেষ করে প্রথম ধাপে পা রাখাটাই আমার কাছে সবচেয়ে ভয়ংকর সময়, নিচে তাকালে আমার চোখের সামনে একটার পর একটা ধার বেরিয়ে নেমে অথবা উঠে যাচ্ছে, ওদিকে তাকালেই চোখে ধাঁধা লেগে যায়, পা বাড়তে চায় না কিছুতেই। মনে হয় যখন পা বাড়াবো তখন পা-টা দুই ধাপের মধ্যে পড়বে আর আমি হুমড়ি খেয়ে পড়বো।

এখন এই তিন তলা উঁচু অবস’ান থেকে দ্রুত নেমে যাওয়া ধাপগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার দ্বিগুণ মাথা ঘুরে উঠলে। সম্ভবতঃ আমার উচ্চতা ভীতি এর জন্যে দায়ী। দ্রুত কলমা পড়তে পড়তে পা বাড়িয়ে দিলাম বেরিয়ে আসা ধাপটার দিকে . . পা পড়লো পরের বেরিয়ে আসা ধাপটাতে। কোন রকমে পড়তে পড়তেও রক্ষা পেলাম। সম্ভবত আমার পূর্বপূরুষের পূণ্যির জোরে বিদেশ-বিভূঁয়ে বেইজ্জতি হওয়া থেকে রক্ষা হলো। সম্ভবত অবচেতন মনে অসুস’ ছেলেটির কথাও মনে এসেছিলো। আমি যদি বেকায়দায় পড়ি ছেলেটা আরও বিপদে পড়বে।

যা হোক, হুমড়ি খেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে তিন তলা থেকে নীচের তলায় না পড়ে বহাল তবিয়তে নেমে মাহবুব সাহেবের পিছন পিছন দৌড়াতে থাকলাম।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে মাহবুব সাহেব বললেন, ‘লাইন যে বেজায় বড়। দেখি কি করা যায়।’

ওর কথামতো সে দিকে তাকিয়ে দেখি এক এক লাইনে কম পক্ষে বিশ-ত্রিশ জন দাঁড়িয়ে- খুব তাড়াতাড়ি করলেও ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদেরন আধা ঘন্টা লাগবে লাইনের যাত্রীদের পাসপোর্টে সিল দিতে- যদি অন্য কোন সমস্যা তাদের মোকাবেলা না করতে হয়।

মাহবুব সাহেব একটু ঘুরে ঘরের অন্য প্রানে-র টেবিলে বসা চোস- ইউনিফর্মপরা একজন মহিলার কাছে এগিয়ে ইংরেজিতে বললেন, ‘চিকিৎসার জন্য এ রোগি আর তার অভিভাবক এসেছেন। যদি অনুগ্রহ হয় . .’ ইত্যাদি।

মহিলা এক নজর ফিহার দিকে তাকিয়ে অত্যন- অভিব্যাক্তিহীন মুখে পাসপোর্ট তিনটে হাতে নিয়ে পাসপোর্টের ছবি আর আসল যাত্রী অর্থাৎ আমাদের দিকে দেখে নিয়ে তিন পাসপোর্টে তিনটে সিল দিয়ে আমাদের দিকে প্রায় ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, ‘ওয়েলকাম ট্যু সিঙ্গাপুর।’

২৪

ব্যাস! মাত্র দেড় মিনিটের ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমরা আগামী কয়েকদিন সিঙ্গাপুরের বাসিন্দা হয়ে গেলাম। দীর্ঘশ্বস ফেলে মাত্র চার ঘন্টা আগে ঢাকার ইমিগ্রেশনের তীক্ত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করলাম। আরে বাবা, পাসপোর্ট অফিস, গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি অফিস) যদি দেখেশুনে আমাদের আমাদের তিন জনকে তিন রকম ঠিকানায় পাসপোর্ট দিয়ে থাকে। আর আমরা তিন জন তিন ঠিকানার লোক এক সাথে ভ্রমণ করি তাতে অসুবিথা কোথায়? স্বামী, স্ত্রী এবং সন-ান পৃথক ঠিকানার বাসিন্দা হলে সরকারের অসুবিধা কোথায়? আর আমরা দেশের বাইরে গেলে অসুবিধা কোথায়। এ তো না দরিদ্র দেশে বেকার মানুষ ঢুকে দেশের অন্ন ধংশ করবো। যে আধাঘন্টা অফিসারটি আমাদের অহেতুক ঝাঁকালেন, তা যে একেবারেই অমূলক, কেবল অকারণে মানুষকে অপদস- করা তা বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা কেবল নিজের কর্তৃত্ব আর অহঙ্কার প্রদর্শন করা। অথবা এরকম মোচড় মেরে কোন কিছু আদায় করার সখ তা ছিলো কি না কে জানে। লাগেজ সেকশনের দিকে যেতে যেতে ফিহা সাথে এগুলো নিয়েই আলোচনা করলাম।

মাহবুব সাহেব এবার তেমনি দ্রুততায় আমাদেরকে নিয়ে লাগেজ এলাকায় গিয়ে হাজির হতেই দেখি আমাদের তিন জনের পরিচিত কাপড়ের ব্যাগটা মালপত্র বহনকারী চলমান রেইলের ওপর দিয়ে দুলতে দুলতে এগিয়ে আছে। ওখানেও আমাদের দু’মিনিটের বেশী সময় লাগলো না। কেবল ব্যাগটা তুলে নেওয়া, আর কিছু না।

মাহবুব সাহেব বললেন, ‘আমার কাজ শেষ সিদ্দিকভাই। পরে আবার কথা হবে। আমার এখানে কাজ আছে। যে বিমানটা এলো,তাকে আবার আকাশে তুলে দিয়ে তবে আমার ছুটি। আমি আপনাদের সাথে একজন অভিজ্ঞ অফিসার দিয়ে দিচ্ছি। কোন চিন-া করবেন না। ও আপনাদের হোটেল পর্যন- পৌঁছে দেবে।’

লাগেজ এলাকার পাশের গেটের দিয়ে হাত বাড়িয়ে ইঙ্গিত করতে সে দিকে তাকিয়ে দেখি রোগা মতো একজন ভদ্রলোক হাত উঁচিয়ে বিপুল বেগে হাত নাড়ছেন। পাশে দাঁড়িয়ে আছে আমার বড় ভাতিজা সাবের। ঢাকাতে ওয়াহিদের অফিসে শুনেছিলাম, বিমানেরই এক তদনে-র কাজে সাবের সিঙ্গাপুর যাচ্ছে। সে দিন ওয়াহিদের অফিসে ওর সাথে দেখা হতে ও বলেছিলো, আমি একদিন আগে যাচ্ছি, চিন-া করেন না। ওখানে আমি থাকবো।’

আগে থাকতেই মাহবুব সাহেবের সাথে সাবেরের পরিচয় হয়েছিলো আর বিমান অফিসের শীল বাবুর সাথেও তার পরিচয় হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। শীল বাবুর সাথে আরও একজন কর্মকর্তা ছিলেন, যদি প্রয়োজন হয় এ জন্য। আমাদের জন্যে এত সব আয়োজন দেখে সাবের একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলো। ও হেসে ফিহাকে বললো, ‘তোরা দেখি ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পাচ্ছিস।’

বর্হিগমনের দরজা পার হতেই দেখি সামনে একেবারে ফাঁকা একটা চত্তর। চত্তরটার ওপাশে দুই-তিনটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। শীলবাবু অত্যন- করিতকর্মা লোক। হাত তুলে ইশারা করতেই প্রথম যে ট্যাক্সিটা ছিলো সেটা এগিয়ে এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালো। ফিহার হাতে তখন হোটেলের ঠিকানা লেখা একটা চিরকুট। ওতে লেখা সাইথ ইস্ট এশিয়া হোটেল, ১৯০ ওয়াটার, সিঙ্গাপুর। ও সেটা ড্রাইভারের দিকে বাড়িয়ে দিতে লেখাটা ভাল করে পড়ে নিয়ে ড্রাইভার পিছনের দরজাটা খুলে দিলো। কোনও কথাবার্তা হলো না। ভাড়া নিয়ে দরদাম হলো না। আমরা ট্যাক্সিতে উঠতেই ও গাড়িটা চালিয়ে দ্রুত বিমান বন্দর এলাকা থেকে বেরিয়ে এলো। এক মিনিটের মধ্যেই শহরের দিকে যেতে বিশাল আট লেন বিশিষ্ট ‘আপ’ রাস-া দিয়ে ছুটে চললো শহরের দিকে। আট লেনের রাস-ার ডানে আইল্যান্ড, ফুলের সুন্দর ঝোপালো গাছ। আইল্যান্ডের ওপাশে শহর থেকে বিমান বন্দরের দিকে আসা আবার আট লেনের রাস-া। আইল্যাণ্ডটা এত উঁচু যে ওপাশের রাস-ার গাড়ি দেখা যায় না।

ফিহা আমার পাশে বসে নিচু স্বরে বললো, ‘দেখেছো আব্বু, রাস-া, চলন- গাড়ি আর আইল্যাণ্ড সব কেমন সুন্দর? কোন জায়গায় একটু ধুলো-ময়লা নেই। ঝক ঝক করছে। আর আমাদের বিমান বন্দরের রাস-া কেমন বিবর্ণ, শ্রীহীন, ধুলা-ময়লায় ভরা, কাদা আর পানি জমে আছে, বাস আর গাড়িগুলো ভাঙাচোরা। এমন কি দামী কোটি টাকার গাড়িগুলোও ধুলোয় আচ্ছন্ন, অপরিচ্ছন্ন। এখানে যে কটা গাড়ি চোখে পড়লো সব কটাই যেন আজকেই শোরুম থেকে বের করে আনা।’

আমি হাসলাম ওর আনন্দ উত্তেজনা দেখে মন ভরে গেল। বললাম, ‘আসলে আমাদের জাতীয় মানসিকতাই অপরিচ্ছন্ন, তাই দেশটাও অপরিস্কার হয়ে গেছে।’

রাস-া প্রায় ফাঁকা, যানজট নেই, ঢাকার মতো সেকেন্ডে সেকেন্ডে ট্রাফিক লাইট নেই। যে কটা গাড়ি রাস-া দিয়ে যাচ্ছে সব কটা একই গতিতে সারিবদ্ধভাবি চলছে, ওভারটেক করে দ্রুত যাওয়ার প্রতিযোগিতা নেই। ওভারটেক হচ্ছে না বলে উৎকটভাবে হর্ন দেওয়ার প্রতিযোগিতাও নেই। কোন অতিরিক্ত শব্দ নেই, শব্দ দূষণও নেই। রাস-া একেবারে মসৃণ কোন গর্ত, ঢিবি নেই, স্পিডব্রেকারও নেই।

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আমরা ক্রমে শহরে ঢুকলাম। ফিহা দুই চোখ ভরে দু’পাশের বদলে যাওয়া দৃশ্য প্রাণভরে দেখছে।

হঠাৎ জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বিশাল ভবনের শীর্ষে ‘র‌্যাফেলস্‌হাসপাতাল’ লেখা নিওন সাইন। ওয়াহিদের অফিসের নানা ব্রোশিওরে এ ভবনটার ছবি দেখেছি। আর এখানেই ফিহাকে আসতে হবে। তাই সচেতন হয়ে খেয়াল করতে লাগলাম ট্যাক্সিটা এখান থেকে কোন দিকে কতদূর যায়।

মাদ্র দুই মিনিট পরই একটু বামে ঘুরে ট্যক্সিটা একটা সরু গলির পাশে এসে থামলো। জানালা দিয়ে ডান দিকে তাকিয়েই দেখতে পেলাম সাউথ ইস্ট এশিয়া হোটেলের সাইনবোর্ড। অবাক হয়ে গেলাম ট্যাক্সি ড্রাইভারের হিসাব দেখে। চিরকুটে ১৯০ ওয়াটার লেখা থাকলেও হোটেলটা আসলে ওয়াটারলু স্ট্রিটের শেষ মাথায় একটা বিশাল চত্তরের একপাশে অবসি’ত। ট্যাক্সি থেকে নেমে দশ-বারো পা হেঁটে হোটেলের দরজায় পৌঁছালাম। এ পথটুকুতে কোন গাড়ি চলে না।

Leave a Reply