ফিহার অপারেশন শেষ হলো সাড়ে চার ঘন্টা পর। ওটির দরজার ফাঁক দিয়ে ট্রলিতে শোয়ানো ফিহার অসহায় অচেতন আর কম্পনরত শরীরটা একটুখানি দেখতে পেলাম। আমার চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকলো। সোনালী আবার আমাকে ধমক দিয়ে বললো, ‘এখন কেঁদে কি হবে?’ আমি চমকে উঠলাম ওর কথা শুনে। যেন আমাদের কোন অন্যায়ের কারণে ফিহার এই অপরিসীম কষ্ট! মাত্র এক মিনিট তারপর ওরা ওকে পোস্ট অপারেটিভ এলাকায় নিয়ে গেল।
ফিহার চেতনা ফিরে এলো হাসপাতালের অন্য একটা বিছানায়। ওর একটু মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। আগের বিছানাটা ছিল বিশাল কাচে ঢাকা জানালার ধারে। চোখ মেললে আকাশটা, পাশের বাড়ির এটা গাছের সবুজ পাতাওয়ালা একটা ছোট ডাল দেখতে পেতো আর এটার চারদিক ঢাকা।
বিছানায় শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অপারেশনের জায়গাটায় ভয়াবহ ব্যাথা ওকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে থাকলো। প্রথমে ও ওর চিরাচরিত অসম্ভব কঠোর সহ্য ক্ষমতা দিয়ে ব্যাথাটা চাপার চেষ্টা করলো। তারপর আর পারলো না ও, অসহ্য যন্ত্রণায় পশুর মতো গোঙাতে থাকলো। যন্ত্রণার সে অস্বাভাবিক গোঙানী যে কোন মানুষকে ভেঙে ফেলতে পারে। আমি ছুটে গিয়ে নার্সকে বললাম ব্যাপারটা। ওরাও বেশ দ্রুততার সাথে ব্যবস’া নিলো। তিন মিনিটের মধ্যেই একজন ওয়ার্ড বয় ফিহার নিতম্ব উন্মুক্ত করে ভলটারিন সাপোজিটারী মলদ্বারে ঢুকিয়ে দিলো। ও তখনও অসহ্য যন্ত্রণায় গুঙিয়ে যাাচ্ছে। একটু পরে ব্যাথাটা ধীরে ধীরে সহনীয় হয়ে আসায় ও ঘুমিয়ে পড়লো।
ওর ঘুম ভাঙার আগেই ওর ডাক্তার এসে ফিহাকে ভিতরের বেডে দেখে সিস্টারদের ওপর খুব রাগ করে বললো এ পেশেন্টকে আগের বেডে দিয়ে দিতে। চেতনা ফিরে পাওয়ার পর ফিহা দেখে ওকে আবার সেই আগের জানালার পাশের বেডে নিয়ে আসা হয়েছে। একটুখানি নীল আকাশ, একটা গাছের একটুখানি সবুজ পাতাওয়ালা ডাল আর একটা বাড়ির একটুখানি কার্নিশ- আর কিছু দেখা যায় না, তা’ হলেও ওদিকে তাকিয়ে থাকতে ওর ভাল লাগে।
তিনদিন পরই ফিহাকে সোনালীর গ্রীনরোডের ফ্যাটে নিয়ে এলাম। ওর জায়গা করে দেয়া হলো উত্তরের একটা ঘরে। বড় বিছানা, পাশে বড় জানালা, পায়ের ধারে একটা বুক শেল্ফ আর পাশে একটা নিচু ওয়ার্ডরোব। আমি আর পপি বিছানার পাশে নিচে মেঝেতে শুই রাতে ফিহা যাতে একটু ছড়িয়ে শুতে পারে।
১৯
বুকের উপরের দিকটা, বাম গলার কাছটায় কাঁধের অপারেশনের জায়গাটায় বিরাট একটা ব্যান্ডেজ। প্রথমে দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে থাকলো ওষুধের প্রভাবে। এক দিন পর একটু স্বাভাবিক হলো। অধিকাংশ সময় ব্যাথাটা থেকেই গেল। কখনও কম থাকে, তবে কেউ বুঝতে পারুক আর না-ই পারুক ওর মুখের ভাব দেখে আমি বুঝতে পারি মাঝে মধ্যে ব্যাথাটা অত্যন- তীব্র হয়। নিজের অজানে-ই গুঙিয়ে ওঠে ও।
রাতের বেলা অন্ধকারে মাঝে মধ্যেই গোঙানীর শব্দে জেগে উঠে ওর মুখের ওপর ঝুঁকে জিজ্ঞেস করি, ‘কষ্ট হচ্ছে, বাবা?’
অধিকাংশ সময় চুপ করে থাকে, আমার কথার উত্তর দেয় না। ব্যাথার কথা প্রকাশ করলে আমি যে অসি’র হবো, সেইটুকু কষ্টও ও আমাদের দিতে চাইতো না। মাঝে মাঝে অসহ্য ব্যথা সত্ত্বেও ও উত্তর দিতো, ‘একটু।’
ওকে একটু আরাম দেয়ার জন্যে ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দেই, মাথায় হাত রাখি। দোয়া-দরুদ পড়ে ফুঁ দেই।
টিউমারসহ যে কোন অপারেশনের পরের অবধারিত কর্তব্য হচ্ছে কেটে ফেলা বস’টির হিস্টোপ্যাথলজি বা বায়োপসি পরীক্ষা করা। অপারেশনের পরেই হাসপাতাল থেকেই ওটা পরীক্ষা করতে দেয়া হয়েছিলো। সোনালী বলেছিলো, ‘আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আরও দুই জায়গাতেও পরীক্ষা করতে দেয়া হয়েছে।’
রিপোর্ট আসার কথা যেদিন সে দিন সকালে সোনালী রাজশাহীতে গেল তরিকের কাছে। সন্ধ্যায় সোনালীর ছেলে আশিক দিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আসবে। সন্ধ্যায় ও বাসায় ফিরতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘রিপোর্ট পাওয়া গেছে?’
ও কেমন একটু তোতলাতে তোতলাতে বললো, ‘স্যার তো একটু বাইরে গিয়েছে। রিপোর্ট পেতে আরও দু’দিন লাগবে।’
কথাটা বিশ্বাস হলো না। ল্যাবরেটরী থেকে সময় মতোই রিপোর্ট দেয়ার কথা। আমার মনে সন্দেহ বাসা বাঁধলো। মনে হলো নিশ্চয়ই কোন গোলমাল আছে। আর সাথে সাথে অবচেতনভাবে বুঝে গেলাম টিউমারটা নিশ্চয়ই ভাল না। সে রাতের পুরোটা আর পর দিন সারা দিন ছটফট করলাম। করার কিছু নেই। বিছানায় ফিহা কষ্ট পাচ্ছে ব্যাথায়। হাসপাতাল থেকে এন্টিবায়োটিক, সাধারণ ব্যাথা কমানোর আর ওমিপ্রাজল জাতীয় ওষুধ দিয়েছে। তাই চলছে।
পরদিন যখন তিনটা রিপোর্টই হাতে পেলাম তখন জানতে পারলাম আমাদের একমাত্র সন-ান, এত ভাল একটা ছেলে মরণ ব্যাধি ক্যানসারে আক্রান-। যে স্ফীতিটা ডাক্তার কেটে ফেলে দিয়েছে, সেটা আসলে সারকোমা- ফাইব্রোসারকোমা। আমাদের সামনে সারা পৃথিবীটা সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে গেল। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। মনে হলো আমি নিজেই মরে যাচ্ছি। অথবা এ খবরটা শোনার আগে আমি মরে গেলাম না কেন?
বিকেলের দিকে সোনালী ফিহার কাছে এসে ওর মাথাটা কোলের উপর তুলে নিল। ফিহা একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলো। সোনালী একটু হাসার চেষ্টা করলো, তারপর বললো, ‘ফিউ, তুমি অত্যন- সাহসী আর বুদ্ধিমান ছেলে। সব কিছু বোঝ। তোমার কাছে আমি সত্যি কথা বলবো। তোমার যেখানে অপারেশন হয়েছে সেখানে কিছু খারাপ কোষ পাওয়া গেছে। আমাদের যুদ্ধ করতে হবে। আমরা সবাই তোমার সাথে যুদ্ধ করবো। কিন’ তোমাকে অত্যন- সাহসী হতে হবে।’
ও হঠাৎ করে যেন সব কিছু বুঝে ফেললো। জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘এটা কি ক্যানসার?’
সোনালী একটু মাথা ঝাঁকিয়েছিলো। তারপর বলেছিলো, ‘আমাদের সাথে তোর একটা ম্যারাথনের দৌড় দিতে হবে। তোর প্রতিপ তোর এই রোগ। আমাদের এ প্রতিযোগিতায় জিততে হবে। আমাদের সাথে থাকবি না ভাই?’
ও হাসিমাখা মুখ নিয়ে বলেছিলো, “আমি আপনাদের সাথে যুদ্ধ করবো, সোনাদি। যা বলবেন তাই শুনবো। কোন প্রতিবাদ করবো না।”
ক্যানসার সম্পর্কে কিছু কিছু কথা কানে এসেছে। এ নিয়ে কোন দিন পড়াশুনা তেমন করিনি। বারডেমে থাকতে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির জটিলতা – এই সব বিষয় নিয়ে বেশ একটু জ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো, সহকর্মী ডাক্তারদের গবেষণাপত্র তৈরী করতে করতে। ক্যানসার নিয়ে কোন গবেষণা এখানে হতো না বলে এ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। এ রোগ সম্পর্কে কেমন একটা ভীতি কাজ করতো- শুধু আমার মধ্যেই না, আমার জানা মতে সকলের মনেই।
সেই রোগ শেষে আমার একমাত্র সন-ানকে ধরলো? কিভাবে এ রোগ হয় জানি না। বংশগত, না জন্মগত, নাকি ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া এগুলোর সংক্রমণে? এ নিয়ে কাকে কি জিজ্ঞেস করবো? ওর সামনে যতক্ষণ থাকি মুখের চেহারাটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করি। বুকের মধ্যে সব সময় ঝড় বয়ে যায়। কেমন একটা অসহায়ত্ব আমার আর পপির বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসলো। যখন বাথরুমে যাই বুকের মধ্যে থেকে কান্না ঢুকরে ঢুকরে ওঠে। সকল সময় প্রার্থনা করি ও যেন এ রোগ থেকে মুক্ত হয়। নামাজ পড়তে পড়তে কেঁদে কেঁদে বলি, ‘আল্লাহ্, আমি বহু বছর বেঁচেছি, আর বাঁচতে চাই না। আমাকে তুলে নিয়ে ওকে সুস’ করো। ও তো জীবনটাকে দেখতেই পেলো না ভাল করে। ওকে আর একটু- অন-তঃ আর তিন-চারটা বছর ওকে জীবনটাকে দেখার সুযোগ করে দাও।’
সোনালী বলেছিলো, ‘একটা মিটিং বসাবো। বড় মামা আর ফিহার বড় খালুকে খবর দাও। সাবের আর সাজেদও আসুক। এক কথা আমি জনে জনে আলাদা করে বলতে পারবো না।’
সবাই হাজির হলে সোনালী বেশ কায়দা করে ফিহার রোগ সম্পর্কে সব কিছু ব্যাখ্যা করে বললো, ‘সামনে আমাদের অনেক বড় যুদ্ধ করতে হবে। ছোট মামা আর মামীকেই এ যুদ্ধ পার করতে হবে। তাদেরই বেশী ছুটাছুটি করতে হবে। এর অনেক খরচ। সবাইকে এটা ভাগ করে নিতে হবে। সবাই মিলে খরচ দেবে। আমি গায়ে খেটে দেবো। তবে বড় খাটনী, ছোট মামা আর মামী, তোমাদেরকেই করতে হবে।’
সোনালীর কথা শুনে আমি একেবারে স-ম্ভিত হয়ে গেলাম। আমাদের সবার চেয়ে বেশী সম্পদশালী যে, সে বলছে সে গায়ে খেটে দেবে!
অপারেশনের আগেই অপারেশন বাবদ সোনালীর হাতে আমি তুলে দিয়েছিলাম চল্লিশ হাজার টাকা। আমার হাতে আরও দশ হাজার টাকা ছিল। আমি জানতাম না অপারেশনে কত টাকা লাগবে। এই মিটিঙে সোনালী জানালো অপারেশনে মোট ষাট হাজার টাকা মতো খরচ হয়েছে। এর মধ্যে বড় ভাই পনেরো হাজার টাকা, আপা দশ হাজার টাকা দিয়েছিলো। বড় ভাতিজা সেনাবাহিনীর মেজর সাবের জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘বাইরে, কলকাতা, ব্যাঙালোর কিংবা সিঙ্গাপুরে নিয়ে . . ‘
ওর কথা শেষ না হতেই সোনালী বলে উঠেছিলো, ‘ঠিক আছে, তোমাদের সবারই ইন্টারনেটে বসার সুযোগ আছে। খোঁজখবর নাও, নিয়ে আমাদের জানাও এর চিকিৎসায় কোথায় যেতে হবে, কত টাকা লাগবে, কিভাবে এপয়েন্টমেন্ট করতে হবে।’
আমার বলতে ইচ্ছে হলো, যে কাজটা একজন ডাক্তার হিসাবে তরিকের আধা ঘন্টার কাজ সেটা সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ লোক কিভাবে কতদিনে করবে? কিন’ এ কথা বলবো কিভাবে? আমার সন-ানের ক্যানসার হয়েছে, সে এখন শয্যাশায়ী, ব্যাথায় কাতর। অথচ আমার চারপাশের সকলের ব্যবহার দেখে আমার কাছে মনে হতে লাগলো আমার সন-ানের এই ভয়াবহ পরিসি’তির জন্যে যেন আমি আর পপিই দায়ী।
প্রায় প্রতিদিনই আমাদের শুনতে হচ্ছে আমাদের অবহেলার কারণে ফিহা এই ভয়াবহ ব্যাধির শিকার। আমি এমনিতেই স্বল্পবাক, পপিও কথা বলে কম। আমরা আরও গুঁটিয়ে যেতে থাকলাম। অশ্রুতে চোখ ভরে এলেও আমাদের শুনতে হচ্ছে, ‘চুপ করো, এখন কেঁদে কি হবে?’
সোনালী মিটিঙে সবার সামনে বলেছিলো, ‘কেমোথেরাপীর খরচ আমি দেবো।’
২০
চৌদ্দই আগস্ট ফিহার কেমোথেরাপী আরম্ভ হয়ে গেল। আবার ল্যাব এইড হাসপাতালে- অঙ্কোলজি স্পেশালিস্ট লে. কর্নেল (অব) মোফাজ্জল হোসেনের অধীনে। আউট পেশেন্ট হিসাবে ফিহা হাসপাতালে গেল। একটা বেডে শুইয়ে স্যালাইনের সাথে ডক্সোরুবিসিন মিশিয়ে দিয়ে ফিহার রক্তে ফোঁটায় ফোঁটায় দেয়া হলো। ঘন্টাদেড়েকের মতো লাগলো। ফিহা সম্পূর্ণ নিঃশব্দে ওর এই নতুন চিকিৎসা ব্যবস’াকে গ্রহণ করে নিলো।
কেমোথেরাপী দেয়া শেষ হলে ও সোনালীর বাসাতেই ফিরে এলো। কেমো দেওয়ার এক দিন পরই হঠাৎ দেখি ও দ্রুত উঠে টয়লেটে গিয়ে একেবারে পানি যাওয়ার ঝাঁঝরির কাছে গিয়ে বিপুল শব্দে বমি করতে আরম্ভ করলো। আমি ছুটে গিয়ে ওকে ধরলাম। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকলাম। সকালে যে নাস-া খেয়েছিলো, তারই অবশিষ্টাংশ বেরিয়ে এলো। তার পর যখন ওর উদ্বেগটা একটু কমে এলো, তখন পানির কলটা খুলে দিলাম। ও ধীরে ধীরে কুলি করলো কয়েকবার, মুখ ধুলো। তার পর আমি ওকে ধরে ঘরে নিয়ে এসে শুইয়ে দিলাম।
ওর বমির শব্দে পাশের ঘর থেকে সোনালীও বেরিয়ে এসেছিলো। সোনালী আমার কাছে এসে বললো, ‘কেমো চলাকালীন এ রকম বমি হবে। ওটা ঐ ওষুধের প্রতিক্রিয়া।’
প্রথম কেমোথেরাপিটা দেয়ার পর দুই সপ্তাহ বিশ্রাম। এর মধ্যে প্রতি দিনই দুই-একবার ওর বমি হলো। বমির পর স্বাভাবিকভাবেই ও অত্যন- দুর্বল হয়ে পড়তো। টয়লেট থেকে ফিরে এসে চুপ করে শুয়ে থাকতো। কেমোথেরাপীর আরণে ওর খাওয়ার চাহিদা কমে গেল, রুচিও কমে গেল। মাত্র ছয় সাত লোকমার বেশী খেতে পারতো না। মাছ-মাংস ছুঁতেও পারতো না। কখনও ডিম ভাজি, কখনও ভেন্ডি ভাজি দিয়ে কোন রকমে একটু খেয়ে টেবিল থেকে উঠে পড়তো।
দুই সপ্তাহ পার হলে একবার রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার পরের কেমোথেরাপী দেয়া হবে।
পাঁচ দিনের মাধায় আমরা শেওড়াপাড়ার বাসায় ফিরে এলাম। আর কতো দিন অন্যের বাসায় থাকা যায়? নিজের ঘরে থাকলে হয়তো ফিহা একটু অন্য রকম স্বসি- পাবে, একথা ভেবেই আমরা নিজের বাসায় চলে এলাম। কিন- ওর অপারেশনের জায়গাটায় ব্যাথাটা কমই হয় না। সব সময় কাঁধের ঐ ক্ষতস’ানে একটা অস্বসি’কর যন্ত্রণা, কখনও কম, কখনও বেশী। আবার কখনো যন্ত্রণার পাশাপাশি জায়গাটা খুব জ্বালা করে, জায়গাটা অত্যন- গরম হয়ে ওঠে। এমন সব বিভিন্ন উপসর্গ একটা না একটা লেগেই থাকে। অধিকাংশ সময় অত্যন- ধৈর্যের সাথে ও মুখ বুঁজে সহ্য করে। অস্ফুট শব্দে ‘উহ্, উহ্’ শব্দ ছাড়া মুখ থেকে আর কোন শব্দ ও বের করে না।
আমি ঠিকই টের পাই কখন ও বেশী কষ্ট পাচ্ছে। যখন ও একটু বেশী ছট্ফট্করছে, যখন ও ওর ক্ষতস’ানটা আঙুল দিয়ে স্পর্শ করছে বার বার, যখন একটু বেশী অসি’র হয়ে ওঠে, মুখটা ওর যখন একটু বেশী কালো হয়ে থাকছে আর ওর দু’টো ঘন ভ্রুদুটো যখন বেশী কুঁচকে যায়, বুঝি ও নিদারুণ কষ্ট পাচ্ছে। তখন আমার তো আর কিছু করার থাকে না, কেবল দোয়া-দরুদ পড়ে ফুঁ দেই। ওর ব্যাথা কমিয়ে দেওয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুল প্রার্থনা করি।
নানা জনের নানা মন-ব্যে ক্যানসার সম্পর্কে যে সব কথা শুনেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী শুনেছি, ক্যানসারের কারণে দেহে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। রোগী অনেক সময় চিৎকার করে, বিছানায় গড়াগড়ি করে যন্ত্রণার প্রকোপ সহ্য করাতে না পেরে। অথচ ফিহা এক দিনের জন্যেও ওর ব্যাথার কথা মুখ ফুটে বলতে চাইতো না। যন্ত্রণার প্রকাশ তো করতোই না।
এর মধ্যে অনেকেই আমাকে বলেছিলো কেমোথেরাপির প্রভাবে ফিহার মাথার চুল পড়ে যাবে। ফিহার মাথায় অপূর্ব সুন্দর ঘন কালো চুল ছিলো। আর ওর এই চুল নিয়ে একটু বেশি দুর্বলতা ছিলো।
একদিন ফিহা বিছানায় শুয়ে আছে এক সময় মাথায় হাত দিয়ে বললো, ‘আব্বু, দেখ চুল উঠছে।’
পপি এগিয়ে এসে ফিহার হাতের এক গোছা চুল দেখে বললো, ‘এক কাজ করো। রোজ একটু একটু করে চুল উঠতে দেখলে তোমার আরও মন খারাপ হবে। তুমি মাথাটা একেবারেই কামিয়ে ফেলো।’ মার কথা শুনে ও বাইরে গিয়ে মাথা কামিয়ে এলো।
ছোট্ট বেলায় দুই একবার ওর মাথার সব চুল ফেলে দেয়ার কর্মকাণ্ড পপিই করেছিলো। একটু বড় হওয়ার পর ওকে কখনও আমরা টাক করে দেইনি। ও যে কী পরিমান কষ্ট পেলো তা ওর মুখ দেখে আমি বুঝতে পারলাম।
প্রথম কেমোথেরাপি দেয়ার পর থেকেই শুনতে পাচ্ছিলাম ফিহার পেট স্ক্যান (চঊঞ ঝপধহ) করা দরকার শরীরে আর কোন জায়গায় এ রোগটা আছে কি না সেটা স্পষ্টভাবে দেখতে পারলে চিকিৎসা দেয়া সুবিধা হবে।
ফিহার অঙ্কোলজিস্ট মোফাজ্জল হোসেন বললেন, মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে যোগাযোগ করতে, ওখানে নাকি পেট স্ক্যান করা যায়। ওখানকার খরচও তুলনামূলকভাবে কম হবে। ওদের অঙ্কোলজিস্টদের পরামর্শও নেয়া যাবে। আমি যোগাযোগের ঠিকানার কথা জানতে চাইলে তিনি বললেন ইন্টারনেটে ওদের ওয়েব সাইট থেকে পাওয়া যাবে।
আব্বা তিপ্পান্ন থেকে পঁয়ষট্টি পর্যন- কলকাতায় পাকিস-ান ডেপুটি হাইকমিশন অফিসে কাজ করতে বলে আমার স্কুল জীবন ওখানেই কেটেছে। অত্যন- ঘনিষ্টভাবে ওদের জীবনধারা আর আচার আচরণ আমি দেখেছিলাম। তাতে আমার যে তীক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তাতে ব্যক্তিগতভাবে দেশ হিসাবে আমি ভারতকে পছন্দ করতাম না। এখন ছেলের জন্যে ওখানে যেতে হবে এ বিষয়টা মানতে পারছিলাম না।
তা’ সত্ত্বেও ফিহার চিকিৎসার জন্যে ওর রোগের সকল বিবরণ লিখে ওখানে পেট স্ক্যান করার সম্ভাব্য তারিখ, মানে এপয়েন্টমেন্ট চেয়ে আমি সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে টাটা মেমোরিয়ালে ই-মেইল করলাম।
এদিকে ভারতে কিভাবে যাবো সেটা নিয়েও চিন-া-ভাবনা করতে থাকলাম। বিষয়টা নিয়ে আমার একজন ডাক্তার বন্ধুর সাথে কথা বলতে তিনি আমাকে বললেন, ‘বম্বে দুইভাবে যাওয়া যাবে, সরাসরি প্লেনে ঢাকা থেকে বম্বে চার ঘণ্টা লাগবে। আর অন্য পথ হলো, ঢাকা থেকে বাসে কলকাতা, ওখানে লাগবে একদিন আর সেখান থেকে ট্রেনে বম্বে যেতে লাগবে সাড়ে তিন দিন- এই মোট পাঁচ দিন। তা’ও যদি কলকাতা-বম্বে ট্রেনের টিকিট অগ্রিম কাটার ব্যবস’া করা যায় তবে। চিন-া করে দেখেন অসুস’ ছেলে নিয়ে এই কষ্ট করতে পারবেন কি না। খরচ অবশ্য বেশ কম হবে। আর একটা কথা, ঢাকা বম্বে প্লেন টিকিট আর ঢাকা সিঙ্গাপুর প্লেনের টিকিট প্রায় একই খরচ।’
ভারতের ভিসা কিভাবে পেতে পারি এ নিয়েও খোঁজ নিতে গিয়ে সেই সময়ের খবরের কাগজে আর টেলিভিশনের সংবাদে যে কথা শুনলাম তাতে আতঙ্কিত হয়ে গেলাম। টিভিতে দেখালো, ভারতীয় ভিসা অফিসের সামনে ভিসাপ্রার্থী লোকজন তিন-চার দিন খোলা আকাশের নীচে শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছে। এর মধ্যে চিকিৎসাপ্রার্থী অসুস’ রোগীও আছে। ভারতীয় ভিসা অফিসের কর্মকর্তারা এ বাবদে নির্বিকার।
ডাক্তার বলেছিলেন, ‘একটা কেমোথেরাপি দেওয়া শেষ হওয়া থেকে অন্যটা শুরুর আগে এই আড়াই সপ্তাহের মধ্যেই পেট স্ক্যান করিয়ে আনতে হবে। কেমো দেওয়ার তারিখ যেন কোন মতেই পার হয়ে না যায়।’
এদিকে প্রতি দিন সকালে একবার আর বিকালে একবার করে সাইবার কাফে গিয়ে আমার ই-মেইল একাউন্ট খুলে পরীক্ষা করে দেখি বম্বে থেকে কোন উত্তর আসে কি না। সব সময়ই আমার ইনবক্স খালি পাই। বিষয়টা নিয়ে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করতে তিনি বেঙ্গালোরের আর একটা হাসপাতালের ঠিকানা দিলেন যোগাযোগের জন্যে। আমি সেখানেও ই-মেইল পাঠালাম।
ল্যাব এইড হাসপাতালে ফিহাকে যখন কেমো দেওয়া হচ্ছে আর আমরা বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছি, তখন পাশে বসা আর এক রোগীর অভিভাবকের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম দিল্লীর ইন্দিরা গান্ধি হাসপাতালেও পেট স্ক্যান করা হয়। ঠিকানা নিয়ে সেখানেও ই-মেইল করলাম এপয়েন্টমেন্ট চেয়ে।
এর মধ্যে একদিন বড়ভাতিজা সাবের আর ছোট ভাতিজা সাজেদের দুই বউ গাজিপুর থেকে এলো ফিহাকে দেখতে। ওদের দুজনের সাথে ফিহার অত্যন- ঘনিষ্টতা ছিলো। ওরা এসে ফিহার বিছানায় বসে গল্প করতে থাকলো। আমার দেখে বেশ ভাল লাগলো। অন-তঃ অন্য রকম কথাবার্তা হলে ফিহার মানসিকভাবে একটু স্ফুর্তিতে থাকবে।
গল্পগুজব করে ওরা চলে গেল সন্ধ্যের কিছু আগে। ও বাড়িতে সংক্ষিপ্ত চায়ের আসর বসে সন্ধ্যের পর। আমি চা পছন্দ করি না। কিছু হালকা খাবার থাকে টেবিলে তাই একটু দাঁতে কাটি। এ সময়ে সোনালীর ছেলে আশিক টেবিলে এসে বসলো। তারপর হঠাৎ অন্য কোন রকম কথা না বলে ও আমাদেরকে দোষারোপ করে গালাগাল আরম্ভ করে দিলো, কেন ফিহার বিছানায় বাইরের লোক বসেছিলো।।
প্রায় আধা ঘন্টা ধরে সে যে সব কথা বলে গেল, তার আরম্ভটা বেশ নাটকীয়, ‘ছোট নানা-নানী, আপনাদের একটা কথা বলি। ফিহার পাশে আর বিছানায় বাইরের লোকজন এসে বসার কারণে যদি ফিহার দেহে কোন সংক্রমণ দেখা দেয় তখন কোন ওষুধ ওর দেহে কাজ করবে না। আমরা কেবল চেয়ে চেয়ে দেখবো ফিহা পরপারে চলে যাবে। বাইরের লোকজনকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব আপনাদের। কেন আপনাদের চোখের সামনে বাইরের লোকজন ফিহার খাটে বসলো, কেন আনারা মানা করলেন না। এ কারণে ফিহার যদি কোন অঘটন ঘটে যায় তা’হলে আমাদের কারোরই তো কিছু করার থাকবে না . .’ ইত্যাদি।
আমি ঘাড় গুঁজে কেবল নাতির সেই দীর্ঘ গালাগাল হজম করে গেলাম। সৃষ্টিকর্তা আমাদের একমাত্র সন-ানকে কালান-ক ব্যাধি দিয়ে আমাদের মাথাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। এখন কেবল ক্রীতদাসের মতো সকলের চাবুক খেয়ে যাওয়ার সময়।
পপিও এই সব আক্রমনাত্মক কথা শুনে অবাক হয়ে ওদের মা-বেটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
‘বাইরের লোক’ বলতে তো সাবের আর সাজেদের বউ। তারা তো তাদেরও আত্মীয়। ফিহার সাথে দেখা করতে এলেও ওরা এসেছে সোনালীদের বাড়িতে। আমরা সেই সোনালীদের বাড়িতেই ওর সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধানে রয়েছি। ফিহার চিকিৎসা ওদের তদারকিতেই হচ্ছে। ওর জন্য কি করতে হবে, ও কি খাবার খাবে, কোন ওষুধ কখন খাবে- সব কিছুই তার তদারকিতেই হচ্ছে। ওর বাসায় কে কখন আসছে, কখন যাবে, কি খাবে, রাতে থাকলে কোন ঘরে থাকবে- এর সব কিছুই তার পরিকল্পনা মোতাবেক হচ্ছে।
সেখানে ফিহার ঘরে কে ঢুকবে বা তার বিছানায় আদৌ বসা যাবে কি না তার কোন কিছুই আমাদের মতামতে চলছিলো না। আর যে দুজন ফিহার ঘরে ঢুকে ওর বিছানায় বসেছিলো, তাতে যদি কোন বড় কোন অঘটন ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা থাকতো, তা’ আমাদেরকে আগে থেকেই বলে দেওয়া উচিৎ ছিলো। আমরা তো এ রোগ সম্পর্কে একেবারেই অনভিজ্ঞ। তাছাড়া ওরা তো সোনালীর বাসাতেই এসেছে, ওদেরকে নিয়মের কথা বলা ওদের পক্ষে যতটা সহজ ছিলো, আমাদের পক্ষে ততোটা না।
সবচেয়ে মজার ঘটনা ঘটলো এর মাত্র কয়েক দিনে পরেই। তরিকের এক ভাগ্নে ফিহাকে দেখতে এসে সোজা ফিহার ঘরে ঢুকে বললো, ‘ফিহা, ওঠো আমি তোমার সাথে বুক মিলাবো।’ ফিহা বিছানার ওপর হাঁটুতে ভর দিয়ে সোজা হতে ও ফিহাকে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রায় দশ মিনিট কি সব দোয়া-দরুদ পড়লো। সদ্য হজ্জ্ব করে এসেছে, ওর কীর্তি-কানুনই আলাদা। আমরা আবার হতবাক হলাম। একজন আত্মীয় ফিহার বিছানায় বসেছিলো বলে আধা ঘন্টা ধরে নাতির গালাগাল শুনলাম। অথচ সেই নাতির মামাতো ভাই যে ফিহাকে পনেরো মিনিট তার বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। তার কিছুই হলো না।
২১
সিঙ্গাপুরে ফিহাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস’া নেয়ার অংশ হিসাবে পপির পাসপোর্ট করতে হলো একদিনের মধ্যে। আমি এর মধ্যে একদিন ওয়াহিদের অফিসে দিয়ে আমাদের তিনজনের পাসপোর্ট দিয়ে এলাম।
এর মধ্যে ফিহার দ্বিতীয় কেমোথেরাপি দেওয়ার তারিখ এসে গেল। সেপ্টেম্বরের চার তারিখে আবার আমরা ফিহাকে নিয়ে ল্যাব এইড হাসপাতালে গেলাম। থেরাপী আরম্ভ হয়েছে, আমি সামনে দর্শনার্থীদের বসার জণ্যে রাখা চেয়ারগুলোর একটা এসে বসলাম। তখন মনে পড়লো, আজ আমার জন্মদিন। আমাদের বাসায় কখনও আমার জন্মদিন পালন করা হয় না। এ দিনটা কারো মনে থাকে না। সব সময়েই নিঃশব্দে এ দিনটা পার হয়, অথচ আজ এদিনটা একটু বিশেষভাবে আমার জীবনে দাগ কেটে থাকলো, আমার একমাত্র সন-ানের দ্বিতীয় কেমোথেরাপী দেওয়ার দিন হয়ে এটা আমার বাকী জীবনে তীক্ত অভিজ্ঞতার আঁচড় রেখে গেল।
ঘন্টা দুইয়ের মধ্যে থেরাপি দেওয়া হয়ে গেল। আমরা ফিহাকে নিয়ে আবার সোনালীর বাসায় চলে এলাম। এরপর তিন দিন যে তিনটা ইংজেকশন দেওয়া হবে সেগুলো প্রতি দিন শেওড়াপাড়া থেকে ল্যাব এইড হাসপাতালে গিয়ে দেওয়া একটু ঝামেলা হবে মনে করে সোনালীর ওখানেই থাকা মনস- করেছিলাম। পরের তিনদিন সেই বিশেষ ইংজেকশনটা দেওয়া হলে আমরা আবার শেওড়াপাড়ায় চলে এলাম।
ওয়াহিদ এর মধ্যে ফোন করে জানালো ভিসা হয়ে গেছে আর পর দিন টিকিটের জন্যে বিমান অফিসে আর ফরেন কারেন্সী অনুমোদনের জন্যে ব্যাংকে যেতে হবে।
ওয়াহিদ ধারণা দিয়েছিলো লাখ চারেক লাগতে পারে। অত টাকা ওর একাউন্টে আছে কি না পপির জানা ছিলো না। আমি অবশ্য ওকে বলেছিলাম আমার সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে ফেলি, পপি বললো, ‘দেখি না একাউন্টে কতো আছে। ঠেকে গেলে তো ভাঙাতেই হবে, যতণ না ভাঙিয়ে থাকা যায়। ওটাই তো শেষ সম্বল। তাছাড়া পরে আরও লাগলে, না হয় প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে ধার নেওয়া যাবে।’
পপি আমাকে নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে জানতে পারলো ওর একাউন্টে লাখ পাঁচেক টাকা আছে। ম্যানেজারকে আমাদের বিপদের কথা বলতে, ম্যানেজার কোন আনুষ্ঠানিকতার ধার দিয়ে গেলেন না। বললেন, ‘কোন অসুবিধা হবে না। আগাম নোটিস লাগবে না। আমি তো জানলাম। এ কাজ করেন, দুটো সাদা কাগজে সই দিয়ে যান। বাকিটা আমি ব্যবস’া করে নেবো। আপনারা আপনাদের যাওয়ার ব্যবস’া করেন।’
পপি বরাবরই আমার ওপর একটু আস’াহীন। নিজেও অত্যন- মানসিকভাবে দুর্বল, বিশেষ করে এই সময়ে। এ সময়ে ও অত্যন- অসহায় বোধ করছিলো। একদিন খাওয়ার টেবিলে পপি নিরুপায় হয়ে সোনালীকে বলেছিলো, ‘সোনালী, তোমার মামার ওপর তো আমি ভরসা পাই না। তোমার টিকিটের টাকা আমি দেবো, তুমি আমাদের সাথে চলো।’
সোনালী প্রায় চিৎকার করে বলে উঠেছিলো, ‘কি যে বলো না মামী। বিদেশে সন-ানের বেলায় বাবা-মা আর বয়স্কদের বেলায় স্ত্রী বা স্বামী ছাড়া আর কাউকে হাসপাতালে ঢুকতেই দেবে না।’
আমি ওর এ কথাটা শুনে কোন মন-ব্য করলাম না। আমার এখন দুঃসময় যাচ্ছে। কথায় বলে দুঃসময়ে হরিণ বাঘের গাল চেটে দেয়। বারডেমে থাকতে আমার অনেক কলিগ বিদেশে চিকিৎসা করতে গেছে। এদের অধিকাংশই গেছে স’ানীয় ডাক্তার আর বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে। ওদের স্ত্রীরা বিদেশে যাওয়ার মতো স্মার্ট ছিলো না বলে, কিংবা ছেলেমেয়েদের দেখাশুনার জন্যে।
যাই হোক আমরা সিঙ্গাপুরে যাওয়ার মানসিকতা নিয়ে পর দিন ফিহাকে একা বাসায় একা রেখে আমরা দুজনে ওয়াহিদের অফিসে গেলাম। ওয়াহিদ খুব সমাদর করে বসিয়ে সাথে সাথে ওর অফিসের একজন স্টাফকে বিমান অফিসে পাঠিয়ে দিলো। আমি যেতে চাইলাম, কিন’ ওয়াহিদ বললো, ‘আপনার দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না। আমার কাছে বসেন।’ বলে ও আমাকে আর পপিকে নানা পরামর্শ দিতে থাকলো। বিদেশের মাটিতে প্রথম যাচ্ছি, এ বাবদে একেবারেই আনাড়ি আমরা দু’জন, তা ওপরে আমাদের দুজনের যে মানসিক অবস’া তাতে নিজেরাই না কোন সমস্যায় জড়িয়ে পড়ি। হোটেলে কি করবো, পথে-ঘাটে, দোকানে কেমন করতে হবে। কোথায় কোথায় বেশী খরচ হবে- এই সব আর কি।
এর মধ্যে ওয়াহিদ সরাসরি সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ বিমানের কান্ট্রি ম্যানেজার মাহবুব সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে বললো, ‘আমার খালাতো ভাই আর ভাবী ওদের ছেলের চিকিৎসার জন্যে যাচ্ছে। যতরকম সাহায্য লাগে দেবেন।’
ও সরাসরি র্যাফল্স হাসপাতালে সেই উর্ধতন নীতিনির্ধারকের সাথে কথা বলে আমাদের সব ধরনের সহায়তা দেয়ার কথা বলে দিলো। সিঙ্গাপুরে নেমেই যাতে আমাদের ডলার ভাঙাতে অসুবিধা না হয় এর জন্যে বেশ কিছু ক্যাশ সিঙ্গাপুর ডলারও হাতে ধরিয়ে দিলো।
এর মধ্যে বিমান অফিসে যাওয়া কর্মকর্তাটি ফোন করে জানালো টিকিট কনফার্ম হয়ে গিয়েছে। ওয়াহিদ হিসাব-নিকাশ করে আমাদের জানালো হোটেল ভাড়া, খাওয়া আর হাসপাতালের খরচ বাবদ তিন ল নব্বই হাজার টাকা লাগবে।
পপি বললো, ‘তা’হলে পুরো চারই দেই?’
ওয়াহিদ বললো, ‘না, বেশী দেবেন কেন, তিন নব্বইই দেন।’
পপি বরাবরই বেশ একটু ভিতু, তাই ব্যাংক থেকে নগদ টাকা আনেনি। ওয়াহিদের কথা শুনে ও চেক বের করে ওয়াহিদকে নগদ টাকা না আনার কথা বললো। ওয়াহিদ ওর দুইজন স্টাফকে ডেকে এ বিষয়টা কিভাবে ফয়সলা করা যায় জিজ্ঞেস করলো। অফিসের নিয়ম-কানুন বলে কথা। টিকিট, হাসপাতালের এপয়েন্টমেন্টের টাকা সাধারণত নগদই দেওয়ার নিয়ম। অথচ আমরা চেকে দিতে চাচ্ছি।
টাকাটার কিছুটা বিমানের টিকিটের খাতে যাবে, হোটেলের খাতে যাবে আর হাসপাতালে খাতে যাবে। কর্মচারীদের পরামর্শ ওয়াহিদের পছন্দ হলো না। ও শেষে অন্য একটা একাউন্টে চেকটা লিখে দিতে বললো আর একাউন্টেনকে বললো এর বিনিময়ে অফিসের ক্যাশ থেকে টাকাটা আমাদেরকে দিয়ে দিতে।
ঐ সমস্যা মিটে যেতে ওয়াহিদ ওর আর এক কর্মকর্তাকে আমাদের সাথে দিয়ে সাথে গাড়ি দিয়ে বললো, তাড়াতাড়ি যেন আমরা ব্যাংকে গিয়ে ডলার এন্ডোর্সমেন্ট করাতে। ততণে বিমান থেকে ওর আর এক কর্মকর্তা ভিসা লাগানো পাসপোর্টগুলো নিয়ে এসেছে। ওগুলো নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে শুনি কাস্টমার লেনদেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে, আজ এন্ডোর্সমেন্ট আর হবে না। একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসার অবস’া। পরদিন ফ্লাইট। আরও অনেক গোছগাছ করতে হবে।
ওয়াহিদের এই অফিসারটি অত্যন- করিতকর্মা লোক একে-ওকে অনুরোধ করে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এন্ডোর্সমেন্টের ঝামেলা চুকিয়ে ফেললো। একটু বেশী মূল্য দিয়ে ডলার কিনতে হলো। ব্যাংকের আলাদা একটা সার্ভিস চার্জ আছে।
আমরা যখন ব্যাংকের ঝামেলা নিয়ে ব্যতিব্যস-, তখন দেখি ফিহা ফোন করেছে। এপাশ থেকে আমার সাড়া পেয়ে ও জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমরা কোথায়?’
ওর গলার স্বর কেমন যেন লাগলো আমার কাছে, ভালো লাগলো না। আমি ওকে জটিলতা সম্পর্কে ওকে কোন ধারণা না দিয়ে কাজের ধাপগুলো সম্পর্কে বলতে ও জিজ্ঞেস করলো, ‘আরও অনেক সময় লাগবে?’
আমি, ওর কথাটার উত্তর না দিয়ে শুধু বললাম, ‘কাজ শেষ হলেই চলে আসবো, বাবা।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি কিছু খেয়েছো?’
আমি তো জানি ওকে গুছিয়ে দেবোর মতো বাসায় কেউ নেই। যা কিছু খেতে হবে, ওকে নিজেরই গুছিয়ে নিতে হবে। ও কেমন যেন দ্রুততার সাথে বললো, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, খেয়েছি। একটু তাড়াতাড়ি চলে এসো।’
আমি বুঝতে পারলাম একা একা ওর নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগছে। আমাদের তো কিছু করার ছিলো না। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন- আমরা তো নড়তে পারছি না। আর অতিরিক্ত কেউ নেই যে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। কথাটা পপিকে বললাম। পপি অসহায়ের মতো বললো, ‘এখন আমরা কি করবো বলো? কাজ শেষ না করে কীভাবে যাই?’
ব্যাংকের কাজ শেষ হতে আমরা আবার ওয়াহিদের অফিসে ফিরে এলাম। ওয়াহিদকে বললাম, ‘ব্যাংক তো মাত্র তিন পাসপোর্টের জন্য তিন কুড়ি ষাইট ডলার দিলো। আর তো দিলো না।’
ওয়াহিদ বললো, ‘ব্যাংক এর চেয়ে বেশী দেবে না। আমাদের মানি এক্সচেঞ্জারের কাছ থেকে নিতে হবে।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা অনিয়ম হলো না?’
ওয়াহিদ বললো, ‘দেশের যা নিয়ম তাই তো মানতে হবে।’
ও সাথে সাথে একজন মানি এক্সচেঞ্জারকে ওর অফিসে আনার জন্যে ওর অফিসারকে বললো। একটা অল্পবয়ষ্ক ছেলে এসে ওর পায়ের মোজার মধ্যে থেকে সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো আমেরিকান ডলার নোট বের করে দিলো। দুই মিনিটের মধ্যে লেনদেন শেষ হতে ওয়াহিদ জিজ্ঞেস করলো, এই সব ভিসা লাগানো পাসপোর্ট ডলার নিয়ে আমরা এখন কোথায় যাবো।
আমার আর পপির দুজনের মাথায় তখন ফিহার কাছে ফিরে যাওয়াটাই মূখ্য। তাই বললাম, ‘ফিহা বাড়িতে একা আছে। আমরা শেওড়াপাড়াতেই যাবো।
ওয়াহিদ রমজানের দিনের শেষ সময় মতিঝিল থেকে অতদূর পথ এত সব মূল্যবান জিনিষ নিয়ে যাওয়াটা সমর্থন করলো না। একটু চিন-া করে ডা. ফরহাদের গাড়িতে আমাদের তুলে দিলো। ফরহাদ সাহেব তাঁর লালমাটিয়ার বাড়িতে ফিরবেন।
ডা. ফরহাদ আমাদেরকে একেবারে বাড়ির গেট পর্যন- পৌঁছে দিলেন। আমরা গাড়ি থেকে নামছি তখন ড্রাইভারটা বললো, ‘ম্যাডাম, আমি আপনাদের বাসায় আর একবার এসেছি। আমি ছেলেকে আপনার হাসপাতালে ভর্তি করার সময়। সে সময় আপনি যা করেছিলেন, তা আমি কোন দিনও ভুলবো না। দোয়া করি আপনার ছেলে ভাল হয়ে ঊঠুক।’
বাসায় আসার পর দেখি ফিহার মুখটা খুব শুকনো, দরজা খুলে আমাদেরকে ঘরে ঢুকতে দিয়ে বললো, ‘এতো দেরী হলো, তোমাদের? সব কাজ শেষ হয়েছে?’
ওর গলার স্বরটাও কেমন যেন খুব ক্লান– আর অবসন্ন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে বাবা। শরীরটা ভালো ছিলো না?’
একটু চুপ করে থেকে ও বললো, ‘এগারোটার দিকে খুব জ্বর এসেছিলো। বিছানা থেকে উঠতেই পারিনি। এই একটু আগে জ্বর কমেছে।’
ওর কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিতে গেলে ও বললো, ‘না, এখন জ্বরটা নেই।’
দুপুরে ওকে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করাতে ও যেভাবে ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, খেয়েছি’, বলেছিলো, তখনই আমার মনে সন্দেহ ছিলো। এখন জিজ্ঞেস করলাম আবার, ‘দুপুরে কি খেয়েছিস?’
ও চুপ করে থাকলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি দেখে শেষে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বললো, ‘কিছু খাইনি।’
আমি নীচু গলায় বললাম, ‘ভয় পেয়েছিলি খুব?’
ও কোন উত্তর দিলো না। আমি বুঝতে পারলাম, শুধুমাত্র একা ছিলো বলেই আতঙ্কে ওর জ্বর এসে গিয়েছিলো।
আমার চোখ ফেটে পানি পড়তে থাকলো। এতোই দুর্ভাগ্য আমাদের, যে আমাদের কাছে দ্বিতীয় আর কোন প্রাণী নেই যে এই দুর্দিনে এই অসহায় ছেলেটিকে সঙ্গ দেবে! এ সময় বড়ভাই থাকে গাজিপুরে। সোনালীরা অবশ্য থাকে গ্রীন রোডে। সারা শহর জুড়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আত্মীয়-স্বজন। কিন’ এমন একজনও কেউ নেই, যে তার একটু সময় বের করে নিয়ে ছেলেটির পাশে থাকবে। অন-তঃ এক গ্লাস হরলিক্স কিংবা মালটোভা তৈরী করে ওকে খেতে দেবে।
পপি ঐ ক্লান- অবস’াতেই তাড়াতাড়ি ফিহার জন্য খাবার তৈরী করতে লেগে গেল। আমাদেরও কিছু খাওয়া হয়নি সারা দিন। পপি না হয় রোজা ছিলো। আর আমি কোথায় কি খাবো, এই মনে করে সময় পার করেছি। দ্রুত কিছু রান্না করতে করতেই মগরেবের আজান হয়ে গেল। আমাদের তিন জনেরই সারাদিন রোজাই থাকা হয়ে গেল যেন। আমরা আজান শেষ হতে ইফতারী করতে বসলাম।
অবশ্য সোনালীদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেই ওদের সহায়তা পাওয়া যেত। কিন’, ওদের কাছে কেন বার বার উপযাচকের মতো গিয়ে হাজির হবো? আল্লাহ্আমাদের তিন জনকে এ পৃথিবীতে নিঃসঙ্গ, নিঃসহায় আর নির্বান্ধব করে রেখে এই বিপুল পৃথিবীতে একলা চলতে, সংগ্রাম করতে ছেড়ে দিয়েছেন, আমাদেরকে একলাই চলতে হবে। না হলে তো, এই ক্যানসারে আক্রান- ছেলেটির পাশে আরও দুই-চার জন সহমর্মী, সমমর্মী কাউকে পেতাম, যে তার কিছুটা সময় এই নিঃসঙ্গ ছেলেটির পাশে এসে থাকতো।
সন্ধ্যে হতেই দুর্দান- বেগে ঝড়-বৃষ্টি-বর্জ্রপাত আরম্ভ হয়ে গেল। সোনালী বলে রেখেছিলো, ‘রাতে আমাদের এখানে চলে এসো, সকালে গাড়িতে করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবো।’ কিন’ এখন গ্রীন রোডে যাবো কিভাবে? ঘরের বাইরে দশ সেকেন্ড গেলেই একেবারে গোছল হয়ে যাবে, এমন বৃষ্টি, সেই সাথে ঝড় সমান তালে । বড় রাস-ায় গিয়ে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করবো। তার জন্যেও তো একটা রিক্সা নিতে হবে। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি রাস-ায় জনপ্রাণী নেই, রিক্সার প্রশ্নই আসে না। রাস-ায় পানিও জমে গেছে অনেক।
হঠাৎ দরজায় বেল বাজলো খুলে দেখি আমার মামাতো ভাই আরিফ। ঢাকায় থেকে সিএ করছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কি ব্যাপার তুমি এ সময়?’
ও একটু লাজুক হেসে বললো, ‘ফিহা, একটা ক্যামেরার কথা বলেছিলো, সেটা দিতে এসেছি। সারা দিন এতো ব্যস- ছিলাম, যে সময়ই করতে পারিনি।’
আমি হেসে বললাম, ‘তুমি আসলেই দেবদূত। এখন আমাদের এই দূর্ভোগ থেকে রক্ষা করো।’
পপি বললো, ‘ট্যাক্সি, সিএনজি, যা পাও, যত চায় না করো না।’
ও ছাতা নিয়ে আবার ভিজতে ভিজতে বের হলো। পনেরো মিনিটের মধ্যে অসাধ্য সাধন করলো ও, একটা ট্যাক্সি নিয়ে এলো।
আমরা ভিজতে ভিজতে কোন রকমে ঐ ট্যাক্সিতে উঠে সোনালীদের বাসায় এলাম তখন প্রায় রাত দশটা বাজে।