যেদিন থেকে পপি আমার এ সংসারে নিয়ে এসেছিলো, সেদিন সেই ১৯৮২ সাল থেকে ও কিন’ নিজের আত্মীয়-স্বজনের চেয়ে আমার আত্মীয়-স্বজনের সাথে বেশী ঘনিষ্ট ছিলো। বিয়ের মাত্র দুই মাস পরেই আমার আব্বা মারা যান। তার মাত্র অল্প কয়েক দিন আগে আমরা ঢাকায় নতুন সংসার পেতেছি। যদিও আমার এত তাড়াতাড়ি নিজের সংসারে ঢোকার ইচ্ছে ছিল না। বিয়ের কারণে হাত একেবারে খালি হয়ে গিয়েছিল। একটু দুই-চার মাস আয় রোজগার করে একটু সঞ্চয় করার পরিকল্পনা ছিল আমার।
কিন- এই সময় আমার ভাগ্নি, বড় আপার একমাত্র মেয়ে সোনালীর স্বামী ডাক্তার হয়ে পিজি হাসপাতালে যোগ দিলো আর একই সাথে সোনালী আরব বাংলাদেশ ব্যাংকে একটা চাকরীও পেয়ে গেল আমাদের সেই মহাউপকারী দুলাভাইয়ের বদৌলতে। ডিসেম্বরে পারিবারিকভাবে সিদ্ধান- হলো ওরা দুজনেই যখন ঢাকায় চাকরী করবে তখন সিদ্দিকের বউও যাক না। ওরা একসাথে ঘর-সংসার করুক।
পপি আপার কাছেই ছিল। আব্বা-মা আর আপা- এই ওদের সংসার। আব্বা আর মা দুজনেই বেশ অসুস’। মা একেবারে শয্যাশায়ী আর আব্বা অন্ধ আর সেই সাথে হৃদরোগে আক্রান-। এর মধ্যে পপির সাথে আমার বিয়ে হওয়ায় পপি এই সংসারের একজন হয়ে গেল। অল্প কয়েকদিনেই ও আব্বা আর মা-র বেশ আপন হয়ে উঠেছিল। আব্বা ওকে খুব পছন্দ করতেন। এর মধ্যে পপি ঢাকায় আসবে শুনে আব্বা বেশ মন খারাপ করলেন। আর এই ঢাকায় চলে আসাটা এত দ্রুত আর আকষ্মিক সিদ্ধানে- হলো যে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনার কোন সুযোগই ছিলো না।
বলতে গেলে এটা কেবল সোনালী আর ওর স্বামী তরিকেরই সিদ্ধান- ছিলো, তবে প্রস-াব আকারে। আর কোন কিছু বলা বা করার কোন সুযোগই দেয়া হয়নি এই প্রস-াবের মধ্যে। মেয়ে আর জামাই ঢাকায় চাকরী করবে, এটাতো একেবারে অসম্ভব ব্যাপার। ওদের যত রকম সহায়তা দেয়া যায়। যেহেতু আর কোন বিকল্প প্রস-াব কেউ তুললো না, আর আমার মতামত দেয়ার কোন সুযোগ ছিলো না তাই প্রস-াবটা সর্ব সম্মতভাবে গৃহীত হয়ে গেল- সংসদীয় ভাষায় কণ্ঠভোটে পাশ।
পপি চলে আসার দিন আব্বা ছোট্ট শিশুর মতো হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকলেন। আমার খুব খারাপ লাগছিলো। কিন’ সর্বসম্মত সিদ্ধানে- আমার কিছুই করার ছিলো না। পপি আব্বার কাছে আরও কিছুদিন থাকলে ঐ অন্ধ বৃদ্ধ লোকটি হয়তো আরও কিছু দিন একটু শানি- পেতেন। আমি আমার পিতাকে সেই শানি-টুকু থেকে বঞ্চিত করেছিলাম। এ অপরাধবোধ সারা জীবন আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। আমি জানি পপিরও একেবারে সেই সময়ে নতুন সংসারে আসার তেমন কোন পরিকল্পনা ছিলো না।
পপির সাথে আমার বিয়েটাও এমনই হুটপাট করে হয়ে গিয়েছিলো। আমার মতামতের কেউ কোন মূল্য কেউ দেয়নি। আমার বড় বোন, বড় ভাই, ভাবী আর সোনালীর মধ্যে প্রায় সকল সময় কেমন যেন একটা ‘ধর-মার’ ধরনের মানসিকতা কাজ করতো।
এ ব্যাপারটা আমি আমার ছোট বেলা থেকেই ওদের মধ্যে দেখে এসেছি। সে তুলনায় আমি নিজেকে অনেক বেশী ধীর-সি’র মনে করি। যা কিছু করি, ভাবনা-চিন-া করে করি, একবার দুই পা ফেলি, তো পরমুহূর্তে এক পা পিছিয়ে যাই। এর জন্যে অবশ্য অনেক বড় বড় সুযোগও আমার হাতছাড়া হয়েছে। অনেক ক্ষতিও হয়েছে আমার। কিন’ আমি এরকমই। আর পপি তখন একবারে নতুন বৌ, নিজের মতামত দেয়ার মতো মানসিক জোর তৈরী করতে পারেনি।
৫
আমরা রাজাবাজারের একটা ছোট্ট একতলার বাড়ির পিছন দিকের বর্ধিত অংশে তিনটে ছোট ঘরে আমাদের সংসার পাতলাম- আমরা মানে, আমি আর পপি আর সোনালী আর তরিক। আমাদের সঙ্গে এলো বার-তের বছরের একটা মেয়ে- বুলু, আমাদের সাহায্যকারী। আমরা সংসার আরম্ভ করলাম একটা পুরাতন খাট আর কয়েকটি হাঁড়ি আর থালা-বাসন, চামচ দিয়ে।
পরদিন থেকেই আমার অফিস, সোনালী আর তরিকের কর্মক্ষেত্রে যোগদান। রাতে তরিক বললো, ‘মামী আপনি আমাদের এই সংসারের লিডার অব দি হাউজ। আমরা আপনার হুকুম বরদার। সংসারের সবকিছু- বাজার-হাট, রান্না-পরিবেশন সবকিছু আপনার দায়িত্ব।’
তিনটে ঘরের প্রথমটা আমাদের দুজনের, ভিতরের ঘরটা ওদের দুজনের আর পাশের ছোট ঘরটা আমাদের খাওয়ার ঘর। ও ঘরেই আনাজপাতি রাখা হলো আর বুলুর জন্য বরাদ্দ হলো। এই তিন ঘর থেকেই বাথরুমে যাওয়া যায়। মন্দ না।
আমার আর সোনালীর যে কয়জন হাতে গোনা আত্মীয় তখন ঢাকায় থাকতো তারা এত বড়লোক যে আমাদের এই ঘুপচি ঘরে তাদের আসার কথাই না। তবে তরিকের বোন-দুলাভাই, ভাগনা-ভাগনীরা আসা-যাওয়া করতে থাকলো। তরিকের হাসপাতালের বন্ধু-বান্ধব আর সোনালীর ব্যাংকের দুই-একজনও আসতো। বিকেল বেলাটা তেমন একা একা লাগতো না। খুব একটা খারাপ কাটছিলো না দিনগুলো।
এর মধ্যেই ঢাকায় আসার মাত্র কয়েক দিনের মাথাতেই রাজশাহী থেকে খবর এলো আব্বা নেই। খবরটা শুনে বুক ভেঙে যাওয়ার কথা। তার উপরে ঢাকায় চলে আসার দিন আব্বাকে যেভাবে শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছিলাম। আমরা চার জনেই ছুটে গেলাম রাজশাহীতে। আব্বা বলে গিয়েছিলেন ওর কবর যেন তাঁর আব্বার কাছে হয়। তাই একটা ট্রাক ভাড়া করে তাঁর কফিন নিয়ে আমরা যাত্রা করলাম ফরিদপুরের ব্রাহ্মন্দি গ্রামে। পুকুরিয়া, বাইশ রশি, আট রশি এ সব গ্রাম পার হয়ে আরও ভিতরে।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে দুপুরের পর পৌঁছে কবরের ব্যবস’া করতে না করতেই চট্টগ্রাম থেকে বড় ভাইও এসে হাজির হয়েছিলো সেখানে। নির্বিঘ্নে মাটি দেয়ার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সারা রাত ট্রাকে করে এসে পরদিন রাজশাহী পৌঁছলাম। পরদিন মিলাদ শেষ করে আবার কর্মস’ল ঢাকায় ফেরত এলাম আমরা।
ঢাকার বাসায় অসুবিধা দেখা দিলো দুই-তিন মাস পর থেকে। আমার অফিস ছিলো সকাল সাড়ে সাতটা থেকে দু’টো পর্যন– আড়াইটার মধ্যেই আমরা তিন জনে বাসায় হাজির হই। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর সোনালী আর তরিক ওদের ঘরের দরজা বন্ধ করে শোয় একটু- সোনালী বিকালে আবার ব্যাংকে যাবে, কাজ করবে সন্ধ্যে পর্যন-।
আমাদের দুজনের ঘরটা ছিলো পাশের ঘরের সাথে মেলানো- ড্রইং-কাম-ডাইনিং রুমের আদলে। ও ঘরে বুলু থাকে। ফলে আমরা দুজনে খুব একটা ‘একলা’ হতে পারি না। তাছাড়া দুই-চারদিন অন-রই বিকাল চারটার দিকেই তরিকের ভাগনাদের কেউ না কেউ এসে হাজির হয়। সোনালীদের ঘর বন্ধ থাকে। তাই আমাদের ঘরটাই ড্রইং রুম। দরজায় কড়া নাড়লে আমাদের দুজনের একজনকে উঠে দরজা খুলে দিতে হয়। আমরা আমাদের বিশ্রাম বাদ দিয়ে ওদের সঙ্গ দেই, যতক্ষণ না সোনালীদের দরজা খোলে। পপি এ বাবদে বেশ নরম স্বভাবের। পপি যে ওদের দরজায় গিয়ে টোকা দিয়ে বলবে, তোমাদের আত্মীয় এসেছে, তা বলতে সাহস পায় না।
এরও বেশ কিছুদিন পর পপি আর একটা ছোট সমস্যার কথা বললো আমাকে মিনমিন করে। ওকে আমি আর তরিক যে সংসার খরচ দেই, অতিথি আপ্যায়নের কারণে সেই তহবিলে টান পড়ছে। আমি ওকে এ বিষয় নিয়ে সোনালীর সাথে কথা বলতে চাইলাম, তাতেও পপির আপত্তি। কি ভাববে ওরা, এই সব ছোটখাট খরচের কথা বলে না আবার বড় কোন জটিলতায় পড়ি।
এ এক ধরণের হীনমন্যতা। অবশ্য এর জন্যে আমি কিছুটা দায়ী – কম মাইনে পাই, তরিক আর সোনালীর সম্মিলিত আয়ের চেয়ে অনেক কম। তাই কিছুটা হীনমন্যতা আমার মধ্যেও কাজ করতো। তার উপরে পপি যে বিষয়টায় বেশী ভয় পেত সেটা হলো, ‘আত্মীয়-স্বজন কে কি বলবে। আপা-মা কি মনে করবেন।’
বিয়ের দু’মাসের মধ্যেই ঢাকায় আসার পর পরই পপি গর্ভবতী হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের দুজনের অনভিজ্ঞতার কারণেই। ফিহা ভুমিষ্ট হয় আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর মাত্র তিন দিন পর।
এখন মনে পড়ে হাসি পায় প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে আমরা চার জনে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলে। সিনেমার নাম ছিলো দূরদেশ। সোনালী আর তরিক হলে ঢোকার সময় পপিকে ঠাট্টা করে বলেছিলো। ‘মামী, হলে চার জন ঢুকছি। বেরোনোর সময় যেন পাঁচ জন না হই।’
গর্ভবতী অবস’ায় সব মেয়েরই কিছু হরমোনের সমস্যা দেখা দেয়। পপি সারাটা সময় অত্যন- বিমর্ষ থাকতো। আসলে ও গর্ভবতী হতে চায়নি সে সময়ে, এত শিগ্রি। ও ঠিক মতো খেতো না। নিজের যত্ন নেয়া কাকে বলে সেটা জানলে তো করবে? আর তাকে কে পরামর্শ দেবে? সোনালীও এ বাবদে কম আনাড়ি না।
এ সময়ে এই ছোট্ট বাসাটা ছেড়ে আমরা পাশেই তিন তলাতে একটা একটু বড় ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম। এটা বেশ বড় আমাদের ঘরটা বিশাল বড়ো, দুই পাশেই জানালা। ঘরের সামনে বিশাল বারান্দা। পাশে সোনালীদের ঘর- সেটাও বেশ বড় আর বুলুর জন্যেও আলাদা ঘর কাম রান্না ঘর। বেশ ভালোই।
দুপুর বেলা আমাদের ঘরেই খাওয়া হয়। গরমের সময় খাওয়ার পর বুলু থালাবাসন সরিয়ে নেবার পর তরিক মেঝেতেই চিৎ হয়ে শোয়, সোনালীও কাত হয়। আমরা চার জন শুয়ে শুয়ে গল্প করি।
এর মধ্যে পপি ফিহা হওয়ার সময় ঘোষণা করলো। আমরা ওকে নিয়ে পিজি হাসপাতালে দৌড় দিলাম।
৬
সন-ান জন্ম দিতে গিয়ে যে বিশাল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলো পপি, সেটা কাটিয়ে উঠতে ওর অনেক দিন লেগেছিলো। সেই ক্রানি-কাল অতিক্রম করা আর একটি নবজাতককে পরিচর্যার অনভিজ্ঞতাটা কারও সাথে ভাগ করে নেওয়ার মতো, পরামর্শ পাওয়ার মতো কেউই ছিল না পপির পাশে। ফলে আমাদের সন-ান ফিহা পরিপূর্ণ পরিচর্যা আর আরাম পায়নি। বেশ কষ্ট পেয়েছে ও। সন-ান প্রসবের ভীতি ওর মনে এত বেশী প্রভাব ফেলেছিল যে, ও কোনদিনই ফিহাকে ওর বুকের দুধ দিতে পারেনি। সবচেয়ে বড় কথা যেভাবে একটি শিশুকে মায়ের দুধে অভ্যস- করাতে হয় প্রথম কয় দিন সে প্রক্রিয়াটা সে কোনদিনই জানেনি, শেখেনি আর এ সময়ে কোন অভিভাবকশ্রেণীর কেউ যে ওকে শেখাবে তাও কেউ ওর পাশে ছিল না। অনেক মেয়ে আপনা থেকেই শিখে যায়, পপি সেই প্রকৃতির মেয়ে ছিল না।
ফিহা প্রথম থেকেই গুঁড়ো দুধ খেয়েছে। ওর একমাত্র ব্র্যান্ড ছিলো রেড কাউ। মাঝ রাতের দিকে অবধারিতভাবে একবার একটু কুঁই কুঁই করে উঠতো- ঠিক কান্নার মতো না, কেমন একটু আপত্তি আর প্রতিবাদের সুর ওর গলায়। মাথার ধারে ছোট একটা শিশিতে একটু চিনি দিয়ে ফুটিয়ে রাখা পানি ভরা থাকতো। শিশির নিপলটা ওর মুখে ছুঁইয়ে দিতেই দুই হাতের বাহু দিয়ে ও শিশিটা ধরে চুক চুক করে তৃষ্ণার্তের মতো চুষতো তিন-চার মিনিট, তারপর মাথার উপর দিয়ে শিশিটা ফেলে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তো। দুধের শিশিটাও ও নিজে ধরে খেতো। আমাদের ধরে থাকতো দিতো না। ফিহার এ অভ্যাস গড়ে উঠেছিলো ওর দুই-তিন মাস বয়স থেকেই। আমরা প্রথম প্রথম অবাক হতাম- তারপর ওর ঐ বোতল ধরার ভঙ্গি দেখে দুজনে খুব হাসতাম।
শিশুকাল থেকেই দুধের পাশাপাশি আমরা ওকে কমলার রস খাওয়াতাম। তখন থেকেই ও কমলার রসটা খুব পছন্দ করে খেতো। জীবনের শেষ দিনগুলোতে, যখন ও তার ক্যানসারের সাথে আপ্রাণ যুদ্ধ করছে, তখনও ও কমলার রস খুব আগ্রহের সাথে খেতো। আমি মেগা শপ থেকে কমলার কনসেন্ট্রেটেড ড্রিংকের বোতল কিনে এনে ফ্রিজে রাখতাম ওর জন্য। ও ফ্রিজ খুলে বোতল থেকে জ্যুস গ্লাসে ঢেলে খেতো।
এ সময়েই তরিক এফসিপিএস পাশ করলো। আর সেই দিনই আমি অনেক অস্বসি- আর দ্বিধা নিয়ে ওদের বললাম, ‘আমরা আলাদা থাকতে মনস- করেছি।’ ওরা খুবই অপ্রস’ত হয়ে গিয়েছিলো। বিষয়টা ওদের কাছে যেন একটা অপমানকর কিছু ব্যাপার বলে মনে হয়েছিলো। কিন’ তেমন আপত্তি করলো না। অবশ্য আপত্তির কিছু ছিলোই না।
আমরা আবার সেই পুরানো বাড়িটার পাশের ছোট্ট এক রুমের ঘরে এসে উঠলাম। ঘর থেকে বের হওয়ার সাথে যে ছোট্ট এক চিলতে বারান্দা ছিলো সেখানে বুলুর শোয়ার জন্য একটা চৌকি পেতে দেয়া হলো। আর পাশে আর একটা বারান্দায় রান্নার ব্যবস’া, বারান্দার পাশে বাথরুম।
সোনালীদের কাছ থেকে সরে আসার পর থেকে এই পৃথক হওয়ার প্রভাব পপির উপর বহুদিন ছিলো। বার বার বলতো, ‘ওরা সবাই আমাকে খুব খারাপ ভাবছে। কিন’ কি করবো বলো, এ ছাড়া তো কিছু করার নেই। তুমি কম বেতন পাও, আমাদেরকে তো সেভাবেই চলতে হবে। ওরা তোমার জন্য ওদের নিজেদের মতো খরচ-পাতি করতে পারবে না, আত্মীয়তা করতে পারবে না।’
এই পৃথক হওয়ার ব্যপারে আমার খুব একটা সমর্থন ছিলো না, কিন’ যখন আমার কানে এলো আমার আত্মীয়-স্বজনেরা বলাবলি করছে, ‘সিদ্দিক তো ঢাকায় সংসার করতে পারতো না, নেহায়েত তরিক-সোনালীর সাথে থাকে বলেই না . .’ ইত্যাদি, তখন আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। ওদের সাথে না থাকলে আমি সংসার করতে পারতাম না? তার মানে, আমি সোনালীর আশ্রিত? আর এ কথার আমার কানে আসার পরই আমি পৃথক হওয়ার দ্রুত সিদ্ধান- নিলাম।
কিন’ এই পৃথক হওয়াটা আমার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিরাট প্রভাব পড়লো। আমার বড় ভাই, আপা আর সব আত্মীয়-স্বজন সবাই আমার সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠলো। প্রায় সব বাড়ির দরজা আমার কাছে বন্ধ হযে গেল। কেউ আমাদের বাসায় আসতো না। বড় ভাই ঢাকায় এলে সোনালীদের বাসায় উঠতো। আমার সাথে রাস-ায় দেখা করতো, আমার ছেলেকে দেখতে বাসায় আসতো না। সে এক বড়ই বিব্রতকর সময় কেটেছে আমাদের।
কেবলমাত্র আমাদের ছোট খালু হাবিবুর রহমান সাহেব আমাদের এ কাজে সমর্থন দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘তোমরা কোন অন্যায় করোনি। প্রত্যেকেরই একটা স্বকীয়তা আছে। আলাদা সংসার করার অধিকার আছে। তোমার কম রোজগার, তুমি কম খাবে। অন্যের সহায়তায় বেশি খাবে কেন?’
তিনি পপিকে খুব ভালবাসতেন। ওকে এই দুর্দিনে খুব সাহস দিতেন, বলতেন, ‘সাহস রেখো, দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। সবাই আবার তোমাদের সাথে যোগাযোগ করবে।’
৭
একটু বড় হতেই, প্রায় ঠিক ছ’মাসের মাথাতেই ফিহাকে খিচুড়ি আর পায়েসের অভ্যাস করিয়ে দিয়েছিল পপি। সেই সাথে বোতলে দুধ খাওয়ার ব্যাপারটা বাদ দিয়েছিল। শিশুদের বোতল ছাড়াতে মায়েদের কত না কষ্ট হয়। ফিহা কেমন যেন অদ্ভুতভাবে কোন রকম সমস্যা ছাড়াই বোতল খাওয়া ছেড়ে দিলো। প্রথম দিন যেদিন গ্লাসে ওকে দুধ খেতে দেয়া হলো একেবারে সেই প্রথম দিন থেকেই ও কেমন করে যেন বুঝে গেল। আর কোন রকম গাঁইগুঁই না করে চুমুক দিয়ে দুধ খাওয়া আরম্ভ করে দিলো। যেন ও জানতোই ওকে এখন থেকে চুমুক দিয়ে দুধ খেতে হবে।
শিশুকাল থেকেই ও একা একা খেলতো ওর হাত-পা নিয়ে। তার পর বসতে শেখা পর্যন- ঝুনঝুনি জাতীয় খেলনা নিয়ে নিজের মনেই খেলতো। ওর খেলনার সমাগ্রীর মধ্যে সেই সময়ে কেনা ভালুক আর বিড়ালের আকৃতির কমলার জ্যুসের প্লাস্টিকের শিশি, ছোট এক সেট প্লাস্টিকের লেগো, প্লাস্টিকের বর্ণমালা, একটা টেনিস বল, পিংপং বল একটা, একটা প্লাস্টিকের ক্রিকেট ব্যাট, আমার অফিস থেকে নিয়ে আসা অনেকগুলো খালি ইনসুলিনের শিশি আর সেগুলোর মুখ- এই সব আর কি। সবচেয়ে দামী একটা খেলনা আমি কিনে দিয়েছিলাম গোল করে চাকার ওপর ঘোরা একটা ব্যাটারী চালিত ট্রেন।
ফিহা কোনদিনই কোলে ওঠার জন্যে আবদার করতো না। কোলে নিতে চাইলে উঠতে চাইতো না। ও নেহাতই কোলে উঠতো এ ঘর থেকে ও ঘরে যাওয়ার জন্যে আর বাইরে বের হলে, সেটাও হাঁটতে শেখা পর্যন-।
কবে আর কিভাবে যে ফিহা হাঁটতে শিখলো বলতে পারবো না। হঠাৎ দেখি ও হাঁটছে। শিশুরা যেমন হাঁটতে আরম্ভ করেই একটা নতুন কিছু করতে পারার আনন্দে আত্মহারা হয়ে সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়ায়- ও তেমন কোনদিনই করেনি। যেন হাঁটতে পারার ব্যাপারটা তার কাছে অতি সাধারণ- যখন প্রয়োজন হাঁটছে, যখন প্রয়োজন নেই বসে থাকছে। ওর সবচেয়ে পছন্দের কাজ ছিল চুপ করে বসে তাকিয়ে দেখা- ওর চারপাশের সবকিছু ও গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতো। মুখটা থাকতো একটু গম্ভির- একটু অন্যমনষ্ক।
তারপর আবার মাত্র দেড় বছর বয়সে পপিকে চাকরী দেবার কথা বলেন আমাদের সবার শ্রদ্ধার রফিক দুলাভাই। একদিন তার বাড়িতে বেড়াতে গেলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর বউ সারা দিন বাড়িতে বসে কি করে?’
আমি বলেছিলাম, ‘কি করবে। দু’বেলা রান্না করে আর ফিহাকে দেখে।’
দুলাভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর মাইনেও তো বেশি না, তোর ছেলে আছে, ওর খরচ তো দিন দিন বাড়ছে।’
আমি আর কি বলবো, মাথা নিচু করে থাকলাম।
দুলাভাই হেসে বললেন, ‘পাঠিয়ে দিস তোর বউকে শিশু হাসপাতালে। ওর সাথে সারা দিন প্রেম করবো আমি।’
দুলাভাইয়ের মুখটা বরাবরই একটু পাতলা। দুলাভাই তখন শিশু হাসপাতালের ব্যবস’াপনা বোর্ডের চেয়ারম্যান।
আমি হেসে বলেছিলাম, ‘তাই সই। আমার কোন আপত্তি নেই।’
কারণ ক্রমে আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছিলো। যখন আমি সংসার আরম্ভ করি তখন মাত্র চৌদ্দ শ’ টাকা মাইনে পেতাম। সাত শ’ টাকা বাসা ভাড়া দিতাম আর সাত শ’ টাকায় খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি। ক্রমে ফিহা বড় হচ্ছে, গুঁড়ো দুধের খরচ বাড়ছে।
অবশ্য ফিহা হওয়ার এক মাস পরেই আমি বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতিতে যোগ দিয়েছিলাম। একটু মাইনে বেড়েছিলো, কিন’ সেই সাথে অফিসে নানা জটিলতা আর রাজনীতির শিকার হয়ে পড়লাম আমি। সেটা সামাল দিতে সব সময় বিব্রত অবস’ায় থাকতে হতো আমাকে। তার প্রভাব যে সংসারে পড়তো না তা নয়।
৮
ফিহা জন্ম থেকেই বেশ চুপচাপ থাকতো। শিশু অবস’াতেও ফিহা কাঁদতো কম, উৎপাত করতো কম, রাতে সুন্দর ঘুমাতো, কোন বিরক্ত করতো না। বেশিরভাগ সময় নিজে নিজেই ঘুমাতো, মা কিংবা আমাকে দেখলে কোলে ওঠার জন্যে কুতকুত করতো না।
অনেকে বলবে যথেষ্ট অনাদরে ফিহা বড়ো হয়েছে- না, আমি একথা মানতে রাজি না। ঠিক অনাদর বলবো না। আমরা দুজনে যতটুকু পেরেছি চেষ্টা করেছি, ওকে আদর দেয়ার চেষ্টা করেছি। যখন বাইরে গিয়েছি কখনও ফিহাকে বাড়িতে একা রেখে বাইরে যাইনি- ও সব সময় সকল জায়গাতেই আমাদের সাথে থাকতো। সিনেমা বা কোন অনুষ্ঠানে গেলেও ও সাথে থাকতো। কিন’ ঐ যে বললাম আমরা যেমন ওকে খুব বেশী কাছে টানিনি, ফিহাও কোন দিন আমাদের গায়ের কাছে আসেনি।
আমি নিজেও একটু চাপা স্বভাবের, অভিব্যক্তির প্রকাশভঙ্গি খুব কম। তা’ছাড়া বিয়ের পর থেকে পপির সাথে কেন জানি না আমি ঠিক মতো মিলিয়ে চলতে পারতাম না। আমার চিন-া-চেতনার সাথে ওরটা ঠিক মিলতো না। আমরা মাঝে মাঝেই ঝগড়া করতাম। জানি না, এ ব্যপারটা ফিহাকে কতটা প্রভাবিত করতো কি না। প্রভাবিত করেছিলো তো অবশ্যই। হয়তো বুদ্ধি হওয়ার পর কিংবা হয়তো তার আগে থেকেই ও নিজেকে একটা অসি’তিশীল পরিবেশে আবিষ্কার করে নিজের মধ্যেই নিজেকে গুঁটিয়ে নিয়েছিলো।
আমাদের মধ্যে- মানে পপি আর আমার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে কি হতো জানি না। কিন’ আমি কোনদিনই ওরকম চিন-া মাথায় রাখিনি। পপির সব বিরূপ আচরণ আমি মেনে নিতাম- যতোই ঝগড়া করি না কেন। আমি সব সময় মনে করতাম ও আমার সন-ানের মা- আমার কাছে ওর সব অপরাধ মাফ।
মাত্র চার বছর বয়স থেকে ফিহার জন্যে আলাদা বিছানা করে দিয়েছিলাম। পপিই বলেছিলো, ‘বেটা ছেলে, এখন থেকেই ওকে শক্ত হয়ে গড়ে উঠতে হবে।’ আলাদা শুতে কখনো কোনোদিন ফিহা আপত্তি করেনি। কেমন যেন স্বাভাবিকভাবে আত্মসমর্পন করে নিয়েছিলো। এক দিনের জন্যেও গুন গুন করে আপত্তি জানায়নি ও। সাধারণত এ রকম বয়সে শিশুরা যা করে- মাঝরাতে বালিসটা নিয়ে মায়ের গায়ের কাছে চলে আসা অথবা বাপের গা ঘেঁসে শুয়ে পড়া- এমন কাজ ও কোনোদিনই করেনি।
আমাদের সকালে অফিসে চলে যাওয়ার সময় ও একটু দূরে দরজার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতো, কোন কথা বলতো না- শুধু তাকিয়ে দেখতো। শিশুরা যেরকম বাবা-মার প্রতি ডিম্যান্ডিং হয়, আবদার করে, বাবা বা মা দেরী করে বাড়ি ফিরলে ঠোঁট ফোলায়, অনুযোগ করে- এমন কাজ ফিহা কোন দিনই করেনি।
ফিহার সাথে আমাদের গভীর কোন বন্ধন ছোটবেলা থেকেই গড়ে ওঠেনি। হয়তো আমরা ওকে যেমনভাবে আদর দেয়ার কথা সেটা দিতে পারিনি, হয়তো আমাদের দৈনন্দিন জীবন সংগ্রাম অথবা পপির সাথে আমার মনোমালিন্যের কারণে।
ফিহা সম্ভবত আমাদেরকে ছোটবেলা থেকে ভয় পেতো- জানি না কেন- হয়তো! কিংবা হয়তো একেবারে সেই ছোট্ট বেলা থেকেই অবচেতনভাবে বুঝে দিয়েছিল আমরা ওকে টানছি না কিংবা আমােেদর কাছে ও আসতে পারছে না! অথবা পপি বরাবরই একটু গম্ভির প্রকৃতির মেয়ে বলে ওর চরিত্রের কিছুটা গাম্ভির্য ফিহার মধ্যে জেনেটিগত কারণে বাসা বেঁধেছিলো অথবা ছোট বেলা থেকেই বঞ্চিত হতে হতে আমার মনের মধ্যে যে একটা হাহাকার বাসা বেঁধেছিলো সেটাই আমার এই সন-ানের মনের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিলো।
আজ ভাবি ও কেন ওর দাবী আমাদের কাছ থেকে আদায় করে, কেড়ে নিতে পারেনি? কেন ও চুপ করে খালি চেয়ে চেয়ে দেখতো? কেন এক দিন বলেনি, ‘আম্মু আজকে আমার কাছে থাকো।’ কেন ও জেদ ধরেনি? একবারও চিৎকার চেঁচামেচি করেনি কেন? দুরন-পনা করে অশান- হয়ে উঠতো না কেন ও?
আজ এ সব কথা বেশী করে মনে হচ্ছে কারণ অনার্সে মনোবিদ্যা পড়তে গিয়ে ও যে সকল বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতো, মাঝে মাঝে সে সব নিয়ে আমাদের সাথে আলাপ করতো। এ সব কথা ও যে ইচ্ছে করে আমাদেরকে বোঝানো জন্য বলতো তা বলতে পারবো না। তবে অনার্সের শেষ বছরের দিনগুলোতে বাবা-মা ও সন-ানের মধ্যেকার মিথস্ক্রীয়া আর তার প্রভাব নিয়ে ও বেশী আলোচনা করতো। বাবা-মার আচরণ ও ব্যবহার সন-ানের ওপর কতটা প্রভাব বিস-ার করে সে বিষয়টা নিয়ে ও আমাদেরকে মাঝে মাঝেই কথা বলতো। ওর ভাবীদেরকে ওদের সন-ানদের সাথে ওদের ব্যবহার নিয়ে নানা পরামর্শ দিতো। কি করে অনার্সে পড়তে পড়তে শিশু মনস-ত্ব নিয়ে মনোবিদ্যার জটিল তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয়গুলো ওর বোধগম্যতায় ঢুকে গিয়েছিলো ভাবলে অবাক লাগে। ওর ভাবীদের ও যে সকল পরামর্শ দিতো তা’ অত্যন- প্রাঞ্জল ও যৌক্তিকতায় পরিপূর্ণ।
যখন ও আলাদা শুতো, রাতে যদি ঝড়-বৃষ্টি হতো, বাজ পড়ার শব্দে ও বড্ডো ভয় পেতো। প্রথম দিকে ও ভয় পেয়ে ডাক দিতো। টের পেয়ে আমরা উঠে ওকে আমাদের কাছে নিয়ে আসতাম। ঝড়-বৃষ্টির সেই সব রাতে ও বালিসটা হতে নিয়ে আমাদের ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো। কোন দিনও নিজে থেকে আমাদের ঘরে ঢুকতো না, যতক্ষণ না আমরা ওকে ডাক দেই। প্রথম প্রথম দুই-একবার এমনই হয়েছে। আমরা হয়তো খেয়াল করিনি। বাজ পড়ার শব্দে জেগে উঠে দেখেছি ও দরজার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, ঘরে ঢোকার আমন্ত্রণের অপেক্ষায়। ডাক দেওয়ার সাথে সাথে ও অত্যন- সঙ্কোচে ধীরে ধীরে ছোট ছোট পা ফেলে আমাদের ঘরে এসে আমার আর ওর মার মাঝখানে গুঁটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়তো।
এ বিষয়টা আমরা যখন সহজেই বুঝে গেলাম, তখন ঝড় উঠলেই ওকে ডাক দিতাম, ‘ফিহা, আসো এ ঘরে আসো।’ বাজ পড়ার শব্দে ও জেগে গেলে আমাদের ডাকের অপেক্ষায় থাকতো। আর ডাক দেওয়ার সাথে সাথে সসঙ্কোচে আমাদের ঘরে চলে আসতো। যেন বড় একটা অপরাধ করেছে ও এমন ভাব। যেন ওর এই বাজের শব্দে ভয় পাওয়াটা ওর জন্য খুবই অনুচিত একটা কাজ।
বাজ পড়ার শব্দে ও অনেক বড়ো হয়ে যাওয়ার পরও ভয় পেতো। যখন স্কুলের উঁচু ক্লাসে কিংবা কলেজে পড়ে তখনও বাজ পড়ার শব্দে ও জেগে উঠে বসে থাকতো। আমরা টের পেয়ে ওর ঘরে গিয়ে জানালা বন্ধ করে দিতাম। অবশ্য বড় হওয়ার পর ও আর আমাদের ঘরে আসতে চাইতো না। তবে বাজের শব্দে জেগে দিয়ে নিজের বিছানায় উঠে বসে থাকতো। আমরা পাশের ঘর থেকে সাড়া দিতাম, কথা বলতাম, যাতে ও ভয় না পায়। যখন ও অনার্স পড়ে তখনও ঝড় হলে, বাজ পড়ার শব্দ হলে ও জেগে উঠে বসে থাকতো। আমরা আমাদের ঘর থেকে ওর সাথে কথা বলতাম, যেন ও ভয় না পায়। আমাদেরকে দেখলে কিংবা আমাদের কথা শুনলে ও স্বাভাবিক হয়ে যেতো।
৯
এর মধ্যে একদিন আমার ছোট খালা মেয়ে হেনা আপা, ব্যারিস্টার রফিকের স্ত্রী, আমাকে একা দেখা করতে বললেন। বিকালে ওদের পুরানা পল্টনের বাসায় যেতে তিনি আমাকে ওঁর ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘরের এক কোনা থেকে একটা নয় ইঞ্চি সাদা-কালো টেলিভিশন বের করে এনে একটা থলের মধ্যে ঢুকিয়ে বললেন, ‘বাসায় নিয়ে দেখ গিয়ে তোরা। যখন টেলিভিশন কিনতে পারবি এটা ফেরত দিস। আমি লন্ডনে পড়ার সময় স্কলারশিপের টাকায় এটা কিনেছিলাম। আমার খুব প্রিয় এটা। কাউকে ছুঁতেও দেইনি। চুপ করে নিয়ে যা কেউ যেন দেখতে না পায়।’
সেই টেলিভিশনটা বহু দিন আমাদের ঘরে একমাত্র বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হিসাবে ছিলো। এর মধ্যে দুই একবার খারাপ হয়ে যেতে আমি নিজে নিয়ে গিয়ে মেরামত করে এনেছিলাম। এই দীর্ঘ সময় ওটা ফিহারও সঙ্গী হয়ে উঠেছিলো। বিশেষ করে সকাল বেলায় শিশুদের অনুষ্ঠান আর বিকালে কার্টুন খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতো। তারপর নিজেরা একটা চৌদ্দ ইঞ্চি রঙীন টেলিভিশন কিনে ঐটা আবার আপাকে ফেরত দিয়ে এসেছিলাম। টিভি কেনার আগে অবশ্য এর চেয়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ একটা ফ্রিজ কিনে ফেলেছিলো পপি ওর মাইনের টাকা জমিয়ে।
আজকাল দেখি বড় বড় ছেলে-মেয়েরা ওদের মা কিংবা বাপকে জড়িয়ে ধরছে, গালে চুমা খাচ্ছে, ওদের গায়ে কিল-চাপড় দিচ্ছে, রাগ করছে, অভিমান করছে। ওদের সেই রাগ আর অভিমান ভাঙাতে বাবা-মাকে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। বাবা-মা বিছানায় শুয়ে থাকলে জোর করে ওদের মাঝখানে ঠেলে শুয়ে পড়ছে। ফিহা কোন দিনই এমন আহাদিপনা করেনি। কোনদিনই ওর মধ্যে এ রকম আহ্লাদিপনা ছিল না।
অথচ এমন ব্যবহার যে কোন কোনদিনই ফিহা দেখেনি তা তো না। চারপাশের অন্য শিশু বা কিশোরদের এমন করতে ও অনেক দেখেছে- কিন’ ও কেমন যেন ছোট্টবেলা থেকেই আমাদের থেকে দূরে থেকেছে। আমার অনেক সময় মনে হতো ও আমার কাছে আসুক, কিছু আবদার করুক, আমার সাথে রাগ করুক, অভিমান করুক।
সন-ানই তো বাবা-মার এই গাম্ভির্যের দেয়ালটা ভেঙে দিয়ে ঘনিষ্ট হয়- তা’ছাড়া অধিকাংশ পরিবারেই নানা-নানী, দাদা-দাদী, ফুফু, খালা, মামা, চাচা আর তুতো-ভাইয়েরা ছোটদের যেটুকু ঘাটতি সেটা পূরণ করে দেয়। ফিহার সেই সব অভাব দূর করে দেওয়ার মতো কোন পক্ষের কোন আত্মীয়-স্বজন ওর ধারে কাছে ছিলো না। আর তাই ফিহা সব সময়েই দূরে থেকেছে।
ফিহা বড় হওয়ার পর আমার কয়েকজন ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজনের মুখ থেকে যখন আমাকে শুনতে হয়েছে আমরা ফিহাকে অবহেলা করেছি, তখন নিজকে খুব ঘৃণ্য মনে হয়েছে, নিজেকে আমার বড়ই অপরাধী মনে হয়েছে; সেই সাথে আরও মনে হয়, আমার কি করার ছিলো? অন্য অনেকের মা থাকে, শাশুড়ি থাকে, বড় বোন, ছোট বোন, ফুফু, খালা, নানী, দাদী কতো রকম আত্মীয়-স্বজন থাকে, যাদের সান্নিদ্ধে কাছে সন–ান বড় হয়, আদর পায়। ফিহা কারো কাছ থেকে তেমন কিছুই পায়নি।
আমি ফিহার জন্যে কি করতে পারতাম? আমার জায়গায় অন্য কেউ, যারা এ সব কথা বলে, তারা হলে কি করতো? আমি তো ওর ছোট বেলায় মাঝে মাঝে কাছে টানতে চাইতাম। ও আমার পাশে বসে থাকতো আড়ষ্ট হয়ে- পৃথক সত্তা হয়ে – কখনই গায়ের সাথে মিশে যেতো না।ইশশুর পরিচর্যা দেওয়াার বাবদে পপির তেমন কোনই অভিজ্ঞতা ছিলো না। ছোটবেলা থেকেই শিশু তার কাছে ভীতিকর একটা জিনিষ। বিয়ের আগে কোন দিনই ও বাচ্চা কোলে নেয়নি। ফিহাকেও ও ভাল করে কোলে নিতে পারতো না। ফিহা বরং আমার কোলেই বেশী থাকতো। তা সত্ত্বেও ফিহার জন্যে পপি কিন’ যথেষ্ট করেছে ওর সাধ্যমতো।
১০
কিশোর কালটাও ফিহার কেটেছে নিস-রঙ্গভাবে। সোনালীর সাথে পৃথক হওয়ার কারণে ওর শিশুকালটায় তেমন কোন আত্মীয়-স্বজন আমাদের বাসায় আসেনি। আমার বড় আপা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে। আমার মা আপার সাথেই থাকতেন। প্রেসারের রোগী, স্ট্রোক হয়েছে দুই-তিন বার, তাই আপা সাহস করেনি মাকে আমাদের ছোট সংসারে ছাড়তে। কচ্চিৎ কখনও আপা রাজশাহী থেকে পরীক্ষা নিতে অথবা সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এলে অবশ্য আমাদের বাসায় উঠতেন। তা’ও দিনের অধিকাংশ সময় তার প্রাতিষ্ঠানিক কাজেই সময় কাটতো। সকালটা আর সন্ধেটায় ও বাসায় একটা অতিরিক্ত অন্য ধরনের চরিত্রের দেখা পেতো। ফিহা ওর ফুফুকে বেশ পছন্দ করতো। কারণ ফিহার ছোট্ট বেলা থেকেই আমরা প্রায় নিয়মিত রাজশাহীতে আপার বাসায় যেতাম।
মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, পপি কোন দিন তার বোন-ভাইদের কাছে যায়নি, এক দিনের ছুটি পেলেও মা-র পাশে গিয়ে হাজির হতো।। মা চলে যাবার পরও আমি আর পপি বহুবার রাজশাহীতে গিয়েছি,বিশেষ করে ঈদের ছুটিতে। সব সময়ই আমরা আপার বাসায় উঠেছি। রাজশাহীতে পপির ছোটবোন জলির শ্বসুরবাড়ি। ওখানে আমরা কেবল একবেলা বেড়াতে যেতাম। কোনদিনই ওখনে থাকিনি। আপা যতবার ঢাকায় এসেছে আমাদের বাসায় উঠেছে।
ফিহার জন্মের পর ও প্রায় নিয়মিত বছরের মধ্যে তিন-চারবার ফুফুকে আর অসুস’ দাদীকে দেখেছে। ওদের সাথে ফিহা বেশ ভালভাবেই মিশতো। দাদীকেও ও বেশ পছন্দ করেতো। রাজশাহীতে গেলে দাদীর পাশে চুপ করে বসে থাকতো।
ছোট্ট বয়সেই ফিহা বেশ কয়েকটা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়েছিলো। দেড় বছরের মধ্যে মা অফিসে যেতে আরম্ভ করলো। তার পর আমাদের সাথে যে মেয়েটি ছিলো সে চলে গেল। এর পর আমরা সত্যিই খুব বিপদে পড়লাম।
এর মধ্যে পপির এক আত্মীয়ের সাথে কথা বলে প্রচুর টাকা অগ্রিম দিয়ে একটা বড় বাসা নিলাম, যাতে তারা আমাদের সাথে থাকে। তারা এই বিপুল আর্থিক চাপ বহন করতে পারতো না বলে পপি এই অতিরিক্ত চাপ নিজের কাঁধে নিলো শুধু ফিহা যেন একা না থাকে।
আমাদের এ বাসাটায় যে কদিন ছিলাম ফিহার খুব অসুবিধা না হলেও সবচেয়ে বড় চাপ পড়লো আমাদের অন্যখানে। আগে বুঝিনি, বাড়ির মালিক গৃহকর্তী সারা দিনে একবার পানি ছাড়বেন তখন পানি ধরে রাখতে হবে। কিন’ সেই পানি তিনি কখন ছাড়বেন তার ঠিক ঠিকানা নেই- কখনও সকাল, কখনও বিকাল, কখনও বা মাঝ রাত। যদি কোন সময় তা বেখেয়াল হয়ে গেল, তো সারা ফ্ল্যাট চব্বিশ ঘন্টার জন্যে মরুভূমি হয়ে গেল। আর একটা বিষয় আমাদেরকে ব্যতিব্যস- করে রাখতো তা হলো অসম্ভব রকমের পিঁপড়ে। বিছানার চাদরের তলায়, তোষকের ভাঁজে ভাঁেজ, বালিসের ওয়াড়ের মধ্যে থিক থিক করতো পিঁপড়ে। কোন ওষুধ, কোন কীটনাশক দিয়ে কাজ হতো না।
সে সময়ে অতিরিক্ত কোন কিছু দিতে ভয় পেতাম, কখন তাতে ফিহার কোন ক্ষতি হয়। শেষে আবিষ্কার করলাম কেরাসিন দিলে কিছুটা কম থাকে পিঁপড়া। সারা বিছানা দিনের মধ্যে তিন-চার বার কেরাসিন দিয়ে সপসপ করে ভিজিয়ে রাখতাম। আমি যখনই অবসর পেতাম ডলে ডলে ঐ পিঁপড়ের ঝাঁক পিশে মারতাম। তাও এত সব অত্যাচার সহ্য করেও থাকতাম, কারণ ফিহা অন-তঃ একা থাকছে না এই ভেবে। যতক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতাম সব সময় কেরাসিনের তীব্র গন্ধ আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখতো। ঘুমের মধ্যেও সে গন্ধ টের পেতাম।
হঠাৎ একদিন সেই আত্মীয় ঘোষণা করলেন তারা এ ফ্ল্যাটে আর থাকবেন না। এদিকে অগ্রিম দেয়া টাকা তখন অনেক বাকি। এত বিশাল বড় ফ্যাটের কোন ঝুঁকি না নিয়ে ওরা এক দিনের নোটিসে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমাদের মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ার দশা। কম করে হলেও আমাদের আরও কয়েক মাস থাকতে হবে ঐ অগ্রিম টাকা খরচ করতে। ওর পুরো পরিবার বিকাল বেলা চলে গেল। ওরা একবারও চিন-া করে দেখলো না আমাদের কি হবে- ঐ শিশুটা কি হবে!
আমরা একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি। ঠিক সন্ধ্যের সময় দরজায় কড়া নাড়লো কে যেন। কে হতে পারে! আমাদের সব আত্মীয়-স্বজন তো আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন। আমাদের সব চেয়ে বড় অপরাধ ফিহা হওয়ার পর কেন আমরা সোনালী আর তরিকের সাথে একসাথে না থেকে আলাদা সংসার করতে আরম্ভ করেছি। এই আলাদা হয়ে যাওয়ার কারণে আমার সকল ঢাকার আত্মীয়রাও আমাদেরকে বিষবৎ পরিত্যাগ করেছে। ফিহার প্রথম তিন বছর আমরা একবারে নিঃসঙ্গ, নির্বান্ধব, নিসহায় অবস’ায় কাটিয়েছি। এই দীর্ঘ সময়ে কেউ একদিন আমাদের বাসায় এসে দেখা পযন-ও করেনি।
দরজা খুলে দেখি পপির বড় বোন, ওর স্বামী আর ওদের দুই ছেলে মালপত্র নিয়ে হাজির। কি ব্যাপার? না, ওদের হঠাৎ বদলী করে দিয়েছে। বদলীটা এতই তাড়াতাড়ি হয়েছে যে আগে কোন সংবাদ দিতে পারেনি। একবারে মালপত্র নিয়ে হাজির হতে হয়েছে।
আমরা তো হাতে চাঁদ পেলাম। মনে হলো ভদ্রলোকটার দুই গালে দুটো চুমা দেই। যে বিশাল গহ্বরের মধ্যে পড়তে যাচ্ছিলাম, সেখান থেকে কেউ একজন একেবারে হাত দিয়ে ধরে রক্ষা করলো। ফিহা ওর চেয়ে বছর দুইয়ের বড় আর বছর পাঁচেকের বড় দুই ভাই পেলো। মায়ের চেয়েও বেশী মমতাময়ী খালা পেলো। আমরা কথা বলার সঙ্গী পেলাম। ওদের এ সময়ের ঢাকায় বদলী হয়ে আসাটা আমাদের জন্য যে কতোটা শানি- আর আনন্দের হলো তা বলার অপেক্ষা থাকলো না। ওরা আমাদের সাথে থাকলো ছয় মাস।
আমার এই ভায়রা ঢাকায় এসে আসলে খুব একটা আরাম পাচ্ছিলেন না। জীবনের অধিকাংশ সময় মফস্বলে কাটানো মানুষ রাজধানীতে আরাম না পাওয়ারই কথা। তাই এসেই বদলীর চেষ্টা করছিলেন। মাস ছয়েকের মধ্যে তিনি বদলীর ব্যবস’া করে ঢাকা থেকে চলে গেলেন। তবে যাওয়ার আগে বেশ খোঁজাখুঁজি করে একটা দুই রুমের ফ্ল্যাট বের করলেন ইন্দিরা রোডেই।
বাড়ির কর্তী এই ফ্ল্যাটটির পাশেই লাগানো ফ্ল্যাটে থাকেন। দেয়ালের ওপাশে ছিল বাড়িওয়ালার পরিবার। স্বামী স্ত্রী, দুই ছেলে আর বড় ছেলের বউ। ওদের বারান্দার পাশের একটা জানালা দিয়ে আমাদের ঘরে উঁকি দেয়া যায়।
ফিহাকে দেখার মতো তখন কেউ নেই। প্রথম কিছুদিন ওকে ঘরে বন্ধ করে রেখে যেতো পপি। পপি ঐ জানালাটা খুলে রাখতো। আর গৃহকর্তীকে বলতো একটু নজর রাখতে। আমরা যখন চলে যেতাম অনেক দিন ফিহা জেগে থাকলেও অধিকাংশ দিনই ঘুমিয়ে থাকতো। ওর বিছানার পাশে দুই তিন রকমের খাবার সাজানো থাকতো একটা নিচু টেবিলের উপরে। ফিহা যেদিন জেগে থাকতো সে দিন না হয় পপি ওকে মুখ-হাত ধুইয়ে একবার খাইয়ে দিয়ে তার পর অফিসে যেতো।
টেবিলের উপরে সাজানো থাকতো দশটা-এগারোটার সময় খাবে এমন সব খাবার। যে দিন ঘুমাতো সে সব দিন ও ঘুম থেকে উঠে নিজে নিজেই মুখ ধুতো, বাতরুম করতো। তারপর নিজে নিজেই নাস-া করে ঘরে যে দুই-চারটা খেলনা থাকতো সেগুলো নিয়ে খেলতো। অধিকাংশ সময় পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতো। পাশের বাসার গৃহকর্তী মাঝে মাঝেই জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করতো, ‘ফিহা, তুমি কি করো?’ ‘তুমি খেয়েছো?’ যেন ওর মধ্যে একাকিত্বটা বেশী দুঃসহ না হয়। ফিহা সেই সময় থেকেই একাকিত্বে অভ্যস- হয়ে গিয়েছিলো।
উপায়ান- না দেখে পপি ওর অফিসের এক সহকর্মী নবদম্পতিকে বলেছিলো আমাদের সাথে থাকতে। যাতে ফিহা একা না থাকে। ওরা অল্প ক’দিন থাকার পর বউটির চাপাচাপিতে ছেলেটি ঢাকার চাকরী ছেড়ে মফস্বলে চলে গেল। ফিহা আবার একা হয়ে গেল।
এ সময় অধিকাংশ দিন পপি ঐ ভোরে ফিহাকে ঘুম থেকে তুলে হাত-মুখ ধুইয়ে সঙ্গে করে অফিসে নিয়ে যেত। নিজের টেবিলে পাশে দুটো চেয়ার জোড়া দিয়ে একটা চাদর পেতে শুইয়ে রাখতো ওকে। ঘুম ভাঙলে ওকে খেতে দতো। এ সময়গুলো ফিহা ঠিক একটা কাঁচের পুতুলের মতো চুপ করে বসে থাকতো। আটটা থেকে আড়াইটা পর্যন-। কোন আপত্তি করতো না। আব্দারও করতো না। যখন ঘুমাতো না তখন চুপ করে বসে ওর মা-র কাজ দেখতো। অফিস থেকে ফিরে প্রথমে ফিহাকে গোছল করিয়ে ওকে কিছু খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তারপর ঘরের বাকী কাজ সারতো পপি।
মাঝে মাঝে ফিহাকে আমি নিয়ে যেতাম আমার অফিসে। আমার রুমে একটা বড় সোফা ছিল- ওতে ওর শুতে বেশ আরাম হতো। এক দিনের জন্যেও ফিহা আমার অফিসে কিংবা পপির অফিসে কোন অসুবিধা সৃষ্টি করেনি। কেমন করে যেন বুঝে যেত কিভাবে ওকে চুপ করে থাকতে হবে। মাঝে মাঝে বলতো ‘আব্বু তা পেয়েছে, তা করবো।’
প্রস্রাব করাটাকে ফিহা ছোট বেলায় বলতো ‘তা করা’। আমি ওকে বাথরুমে নিয়ে যেতাম। ও নিজে নিজে প্রস্রাব করে চলে আসতো। কোনদিন কোন বিরক্ত করেনি। আমার অফিসের স্টাফরা সকলেই ফিহাকে চিনে ফেলেছিলো। ওকে সবাই খুব পছন্দ করতো ওর শান- ভাব দেখে। পপির অফিসের স্টাফরাও ফিহাকে খুবইা পছন্দ করতো। ও কোন দিনই অসময়ে, আমার বা পপির সাথে যখন অফিসে থাকতো তখন মল ত্যাগ করার কথা বলতো না। ও ঠিক কখন যে মল ত্যাগ করতো আমরা খেয়ালই করতাম না। ওর ঐ সব প্রাতঃকৃত সারার কাজ ও খুব অল্প বয়সেই নিজে নিজেই শিখে গিয়েছিলো।
ছোটবেলার আরও অনেক অদ্ভুত শব্দ শিশুদের থাকে, বড় হতে হতে ওরা কখনও অবচেতনভাবে কখনও সচেতনভাবে সে শব্দগুলো ব্যবহার বন্ধ করে ফেলে। ফিহার অন্য সব শব্দ, যেমন মাংসকে বলতো ‘আক্কু’ আর আলুকে বলতো ‘আন্নু’। কোথা থেকে এই শব্দ ও তৈরী করেছিলো, কে জানে! ওর ঐ অদ্ভুত ‘তা’ শব্দটা আমাদের দুজনের মনের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছে, যে এখনও অবচেতনভাবে আমি কিংবা পপি বলে ফেলি ‘তা পেয়েছে।’
ফিহাকে দেখাশুনা করার মতো কাউকে আমরা দীর্ঘদিন ধরে পাচ্ছিলাম না। ঐটুকু শিশুর ওপর যে কি অসম্ভব চাপ যাচ্ছে বুঝতে পেরেও আমাদের কিছুই করার ছিলো না।