সায়েম মাহমুদের নিস্ফল দ্বৈরথ – অধ্যায় ১

সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান

আমার কৈফিয়ত

কোন প্রাণীর জন্ম তার নিজের ইচ্ছায় হয় না। জন্মের সময় মানবশিশু থাকে পবিত্র। অথচ পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকে ধর্ম ও ন্যায়-নীতি শিক্ষা আরম্ভের সাথে সাথেই মানুষকে বলা হয় সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে। শেখানো হয় তার জানা-অজানা সকল অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাইতে ‘তওবা’ পড়তে। যে কোনই অপরাধ করেনি, তাকেও ‘তওবা’ পড়তে বলা হয়- কমপক্ষে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে। ইশ্বর আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন লোভ, হিংসা, ঈর্ষা, কামুকতা, অহংকার, ক্রোধ প্রভৃতি পাপের আবর্তে। সেই সাথে ঈশ্বর বলছেন এ সব অপরাধ থেকে দূরে থাকতে আর তওবা করতে। ‘চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বকের সাহায্যে যে জানা-অজানা অপরাধ মনের গহীনে প্রতি মুহূর্তে ঘটে যাচ্ছে, তার জন্যে ক্ষমা চাও।’ মৃত্যু মুহূর্তেও ঈশ্বর বলছেন ‘ক্ষমা চাও, আমাকে স্মরণ করো, আমার দিকে ফেরো।’ যে মানুষ মৃত্যুর সময় ইশ্বরকে স্মরণ করতে পারলো, উচ্চারণ করতে পারলো ঈশ্বরের নাম, সে সম্পূর্ণ মুক্তি পেল।

এ বইটি লেখার জন্যে আমি প্রত্যেকের কাছে ক্ষমা চাইছি। যদিও আমি জ্ঞানত কোন অপরাধ করিনি এ আত্মবিশ্বাস আমার আছে, আত্মার দৃঢ়তা আছে। এ জন্য আমি এ বইটি আরম্ভের আগে উচ্চারণ করেছি ‘যাহা বলিব সত্য বলিব . . .’।

যত কটূবাক্যই হোক না কেন, সত্য সকল সময়ই সত্য এবং তা’ অবশ্যই প্রকাশযোগ্য এবং সর্বান-করণে গ্রহণ করা একজন সৎ মানুষের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। এ বইয়ের প্রতিটি শব্দ আর বাক্য সত্য এবং সঠিক। এতে কোন অতিশয়োক্তি করা হয়নি, কোন সত্যবিচ্যূতি বা তথ্যবিকৃতি নেই, অতিরিক্ত বিশেষণও ব্যবহার করা হয়নি। যে ঘটনা ঘটেছে এবং যে কথা উচ্চারিত হয়েছে তা’ সঠিকভাবে লেখার চেষ্টা করেছি। এজন্যে কারও আঘাত পাওয়ার কথা নয়। তারপরও যদি কেউ দুঃখবোধ করেন, তবে আমি তার কাছে আন-রিকভাবে ক্ষমা চাচ্ছি। সেই সাথে তাকে অনুরোধ করবো, তিনি যেন এ বইয়ে বর্ণিত তার সকল কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ক্ষমা আমার কাছে না। যার প্রতি মানুষ অপরাধ করে, সে ক্ষমা না করা পর্যন- ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করতে পারবেন না, এটা ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি। তিনি যা করেছেন, তার জন্য সম্ভবত ঈশ্বরও তাকে ক্ষমা করতে পারবেন না, কারণ তার যত অপরাধ ফিহার কাছে। আর ফিহার কাছ থেকে আর কোনদিন কেউ কিছুই পাবে না।

অনেকেই বলবেন, আমি আমার একমাত্র সন-ান শাহ মোহাম্মদ সায়েম মাহমুদ ফিহার তিরোধানে ব্যাথিত ও দুঃখিত হয়ে এ বই আমি লিখেছি, যেমন ইউরোপীয় কবিরা ‘এলিজি’ বা শোকগাথা রচনা করতেন। আমার এ লেখা সে ধরনের লেখা নয়। কেউ বলবেন, আমার প্রয়াত সন-ানকে গৌরবান্বিত করার জন্য এ লেখা। এটা তেমন কোন লেখা নয়। ফিহা যে অন্য আর দশটা ছেলে চেয়ে পৃথক ছিল, তা আমি কোনদিনই বলিনি। তার সাথে যিনি একবার কথা বলেছেন, যিনি তার আচার-আচরণ দেখেছেন, সকলেই বলেছেন, তার মতো ভাল ছেলে তাদের নজরে পড়েনি। তার অসুস’তার সংবাদ শুনে কেবল ঢাকাতেই নয়, দেশের অনেক জায়গায়, দেশের বাইরে বিদেশের অনেক শহরে ওর রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা হয়েছে, তার তিরোধানের কথা শুনে বহু লোকে কান্নায় ভেঙে পড়েছে, এরা কেউই ফিহার আত্মীয় ছিল না। এখনও ওর কথা উঠলে অনাত্মীয় অনেকেই তাদের অশ্রু সংবরণ করতে পারেন না। কিন’ আমি আমার কিছু আত্মীয়ের চোখে কোন অশ্রু দেখিনি, বরং তাদেরকে স্বসি-র শ্বাস ফেলতে দেখেছি।

ফিহা মাত্র এগারো মাস ক্যানসারের সাথে প্রাণান- যুদ্ধ করে মারা যায়। ক্যানসার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ প্রভৃতি রোগ কালান-ক ব্যাধি। এর মধ্যে সত্তর ভাগ ক্যানসারই অত্যন- ভয়াবহ। এ সব ক্যানসার হলে অবধারিত মৃত্যুর পথে রোগীর ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া রোগীর আত্মীয়-স্বজনের আর কিছুই করার থাকে না, ডাক্তারের শিক্ষা, জ্ঞান, বুদ্ধি, কিছুই কাজে লাগে না। ডাক্তাররা অনায়াসে বলে বসেন, ‘আর কিছু করার নেই, রোগীকে বাসায় নিয়ে যান।’

করার কিছু না থাকলেও তো রোগীর জন্যে একটি কাজ করার থাকে। মানুষ তো মানুষের জন্যেই। আমাদের দেশের ডাক্তাররা যেটা জানেন না, জানতে চেষ্টাও করেন না, সেটা হলো, রোগীকে সর্বোত্তম দৈহিক ও মানসিক শানি- দেওয়া। যে চলে যাবার সে যাবে, কিন’ তাকে বিকারহীন মানসিকতায় আস-াকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে না দিয়ে, একটু শানি- তো চিকিৎসকরা তাকে দিতে পারেন। রোাগীর কাছ থেকে কেবল ভিজিটের টাকা হাতিয়ে নিয়ে ‘মৃত্যু তো অবধারিত, মেনে নিতেই হবে’ জাতীয় কথা বলে দায়িত্ব শেষ করা নয়। আজকাল আমাদের মেডিকেল কলেজগুলোতে শেখানো হয়, চিকিৎসক হতে হলে হৃদয়হীন হতে হবে, আবেগাপ্লুত হলে চিকিৎসা করা যায় না। কিন’ ডাক্তার মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেছিলেন, ‘তুমি অসুস’ হলে অন্যের কাছ থেকে যে আচরণ তুমি নিজে প্রত্যাশা করো, রোগীর সাথে তুমি তেমনই আচরণ করো।’ ডাক্তারদের প্রতি আমার বক্তব্য হলো, ‘রোগী যে রোগে কষ্ট পাচ্ছে, তা’ যদি আপনার সন-ানের হয়, তবে আপনি কি কাজটি করবেন, তা’ মনে রেখে তার চিকিৎসা করুন।’

ফিহা যে অপরিসীম আর দুঃসহ কষ্ট পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করেছে, তা’ কেবল কিছু চিকিৎসকের অপরিসীম অবিমৃষ্যকারিতা, চরম অবহেলা, গুরুত্বহীনতা আর ব্যাধি সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণেই ঘটেছে।

ক্যানসার বিশেষায়িত রোগ। বর্তমানে এর জন্য উন্নতমানের বিশেষায়িত হাসপাতাল বাংলাদেশেই আছে, তাদের পরিচর্যা ব্যবস’া এবং চিকিৎসাজ্ঞান বিদেশের কোন নামকরা হাসপাতাল থেকে কম নয়। ইন্টারনেটের যুগে এ কাজটি আরও অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। তাই এ সকল রোগের জন্য কোন সাধারণ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে কোন সাধারণ ডাক্তারের পরামর্শে (তা’ তিনি যত অভিজ্ঞই হোন না কেন) রোগীকে না রেখে, দ্রুত একটা ক্যানসার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানাই। মৃত্যু অবধারিত, কিন’ রোগীকে সর্বোত্তম প্রশানি- দেয়াই হবে আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোত্তম উপহার।

যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য ব্যতিত মিথ্যা বলিব না, সত্য গোপন করিব না বা বিকৃতও করিব না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর ‘দু্‌ই বিঘা জমি’ কবিতায় লিখেছিলেন,

‘শুধু বিঘে দুই, ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে

বাবু কহিলেন, বুঝেছ উপেন এ জমি লইব কিনে।

কহিলাম আমি, তুমি ভূস্বামী ভূমির অন- নাই,

চেয়ে দেখ মোর, আছে বড় জোর মরিবার মত ঠাঁই।’

সারা জীবনে কোন সঞ্চয়, সম্পদ, সম্মান, প্রতিপত্তি, অহঙ্কার করার মতো কোন কিছুই আমি অর্জন করিনি। পৃথিবীর এক কোণে অত্যন- দীন-হীনভাবে অবনত মস-কে আমার দিন অতিবাহিত করতাম। প্রতিটি মুহূর্ত অপরের স্বাচ্ছন্দ্যবিধানে সন’ষ্ট ছিলাম। একটি মাত্র ছোট্ট প্রদীপ অত্যন- ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলো আমার ক্ষুদ্র সংসারে- আমার একমাত্র সন-ান। সেই ক্ষুদ্র প্রদীপটির দিকে তাকিয়ে আমি আমার সমস- অন-ঃকরণ দিয়ে ছোট একটু আশা মনের গহীনে লালন করতাম। আমার বৃদ্ধ বয়সে আমার সন-ান আমাকে আশ্রয় দেবে এমন প্রত্যাশা কোনদিনই করিনি। ক্রমে ও একটা প্রকৃত নক্ষত্র হয়ে উঠছিলো দেখে আনন্দে পরিতৃপ্ত হতে চেয়েছিলাম। কোনো কিছু প্রাপ্তির আশায় নয়, বরং পূর্ণ বিকশিত চাঁদ কিংবা দীপ্তিমান উজ্জ্বল সূর্যের আভায় ও ওর চারপাশের সকলকে সুখী, আনন্দিত আর উদ্ভাসিত করতে আরম্ভ করছে দেখে, সকলকে ও পরিতৃপ্ত করছে দেখে, আমি অত্যন- পরিতৃপ্তি বোধ করতে আরম্ভ করেছিলাম।

ঈশ্বর আমার সেই চাহিদাশূন্য আনন্দ, প্রাপ্তিহীন তৃপ্তি আর নির্লোভ সুখটাকে নির্মমভাবে কেড়ে নিয়ে আমাকে স্বজনহীন, বান্ধবহীন বিশাল পৃথিবীটাতে দুমড়ে-মুচড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। আমার ক্ষুদ্র দুই বিঘা জমির বিনিময়ে নিঃসঙ্গ বিশাল পৃথিবীটা আমার হাতে তুলে দিলেন, যার কোন মূল্যই আমার কাছে কখনও ছিলো না।

আমাদের একমাত্র সন-ান শাহ মোহাম্মদ সায়েম মাহমুদ ফিহা মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে গত ৮ এপ্রিল ২০০৯, বুধবার, বেলা একটা চল্লিশ মিনিটে আমাদের ছেড়ে চলে গেল চিরদিনের জন্যে। প্রতিটি মুহূর্তে যখনই মনে হয়, ফিহা আমাদের মাঝে নেই, তখনই আমার মসি-ষ্কবিকৃতি দেখা দেয়, মনের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণাবোধ সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে, হৃদয়ে অসহ্য রক্তক্ষরণ হতে থাকে।

ফিহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগে ২০০৮ সালের সম্মান শ্রেণীর শেষ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স’ান লাভ করে স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিলো। একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র! সম্মান শ্রেণীর প্রথম বর্ষ থেকেই ক্লাসে ওর সরব উপসি’তি, বুদ্ধিদীপ্ত সম্পুরক প্রশ্ন করা আর যে কোন প্রশ্নের দ্রুত ও সঠিক জবাব দেওয়ার কারণে বিভাগের প্রতিটি শিক্ষকের নজরে পড়ে গিয়েছিল ও।

প্রতিটি পরীক্ষায়, ক্লাস পরীক্ষায় ফিহা উল্লেখযোগ্য নম্বর অর্জন করতো। অত্যন- ভালো ফ্রেঞ্চ শিখেছিলো, পরিসংখ্যানে অর্জন করেছিলো গভীর বুৎপত্তি, কম্পিউটারে ছিলো ওর অসাধারণ দক্ষতা- বাংলা আর ইংরেজী সমান দক্ষতা ও দ্রুততায় কম্পোজ করতে পারতো। কম্পিউটারের ভিজুয়াল বেসিক ও এসপিএসএস প্রোগ্রামে তার ছিল উল্লেখযোগ্য নৈপুন্য। হার্ডওয়ার আর সফটওয়ার দুটোতেই সে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলো। সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধূলা সংক্রান- বিষয়ে ওর গভীর জ্ঞান ছিলো, ছিলো প্রখর স্মৃতিশক্তি আর সর্বোপরি ও ছিলো অত্যন- সরল, অসম্ভব বিনয়ী, পরোপকারী আর ওর ব্যবহার ছিলো অত্যন- নম্র আর মধুর।

ফিহা ওর বিভাগের সব ক’জন শিক্ষার্থী সহপাঠীকে সমানভাবে পড়াশুনাতে সহায়তা করতো। ওদের প্রশ্নের উত্তর তৈরী করতে ও নোট করে দিতে সহায়তা করতো, পরীক্ষার আগে সাম্ভাব্য প্রশ্নের সূত্র বলে দিয়ে শিক্ষার্থীদের বেশী নম্বর পাওয়ায় সাহায্য করতো। বিভাগের সব শিক্ষকের সাথে ছিলো ওর যথেষ্ট ঘনিষ্টতা এবং তাদের প্রত্যেকের প্রতি ওর ছিলো গভীর শ্রদ্ধাবোধ। বিভাগের অফিসের সকল কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের সাথেও সব সময় মধুর ব্যবহার করতো ও।

ফিহা আমার আর ওর মায়ের উভয় দিকের সকল আত্মীয়-স্বজনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো, তাদের বাসায় ও নিয়মিতভাবে যেতো। ওদের সবার সাথে অদ্ভুত সখ্যতা বজায় রাখতো। সকল আত্মীয়ের যে কোন সমস্যায় ও গিয়ে হাজির হয়ে তাদের সহায়তা দিতো, তাদের সকল অনুষ্ঠানে ও ছিল অবিচ্ছেদ্য অংশ।

স্কুলের দশ বছর আর কলেজের দুই বছরে ফিহা খুব একটা সামনের সারির ছেলে ছিলো না, বরং বেশ একটু নিষপ্রভ ছিলো। অত্যন- শান-, অনাকর্ষণীয় অথচ নির্লোভ জীবন যাপন করতো। সে সময়ে মেলামেশাতে ও খুব একটা চৌকশ ছিলো না।

অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা আরম্ভ করার পর থেকে ও হঠাৎ সবার নজর কাড়তে আরম্ভ করলো। ওর আচার-আচরণ, আলাপ-ব্যবহার, বন্ধুত্ব আর শ্রদ্ধাবোধ সব কিছুতেই ও চারপাশের আর দশটা ছেলেমেয়ের চেয়ে সম্পূর্ণ অনন্যসাধারণ হয়ে উঠলো। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে চার বছরেই না, ফিহা কখনোই ওর চারপাশের কারো হিংসা কিংবা ঈর্ষার পাত্র হয়ে ওঠেনি। সে সকলের চোখের মনি হয়ে উঠেছিলো। ক্লাসে ওর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিলো ওর ঘনিষ্ট বন্ধু। এত অল্প সময়ের মধ্যে নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের একটা অতি সাধারণ ছেলে এত অসাধারণ সাফল্য কিভাবে অর্জন করলো?

ফিহা আমার আর আমার স্ত্রী পপির একমাত্র সন-ান। বড় আদর করে আমি ওর নাম রেখেছিলাম শাহ মোহাম্মদ সায়েম মাহমুদ। ‘শাহ’ শব্দটা আমার জানা মতে আমার দাদার উপাধি। যিনি আজ থেকে প্রায় দেড়শ’ বছর আগে এদেশে এসেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। পরে অবশ্য বড় একজন আধ্যাত্মিক নেতা হয়ে ওঠেন। ওর সায়েম নামটা নিয়েছিলাম ওর দুই চাচাতো ভাইয়ের নামের সাথে মিলিয়ে। ওর বড় ভাই সাবের, যার আদি শব্দ ‘সবর’ অর্থাৎ সহ্যগুণ আর ছোট ভাই সাজেদ, যার আদি শব্দ ‘সজ্‌দা’ অর্থাৎ প্রণতি। সায়েম শব্দের আদি শব্দ সিয়াম অর্থাৎ পবিত্রতা।

আজ মনে পড়ছে ৭ অক্টোবর ১৯৮৩ তারিখটার কথা। ফিহার জন্ম দিন।

দুপুরে অফিস থেকে ফিরে বাসায় আসার পর গোছল সেরে ভাত খাওয়ার পর যখন বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি তখন পপি পাশে বসে মিনমিন করে বললো ওর কেমন যেন লাগছে।

আমি তখনই লাফ দিয়ে উঠে বসেছি, ‘কেমন লাগছে মানে? ঠিক করে বলো কেমন লাগছে?’

পপি আরও অস্পষ্ট গলায় বলেছিল, ‘ঠিক বুঝছি না। তলপেটটা কেমন ভার ভার লাগছে। খালি বাথরুম পাচ্ছে, অথচ পিশাব ঠিকমতো হচ্ছে না, কেমন ভিজে ভিজে. .’

আমি ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে প্রায় ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঠিক কখন থেকে এরকম বোধ হচ্ছে?’

ও অনেক অস্বসি-র সাথে বলেছিলো, ‘মানে . . গতকাল থেকেই . .’

আমি অত্যন- আতঙ্কিত হয়ে বলেছিলাম, ‘গতকাল থেকে তোমার এরকম অবস’া আর আজ বিকালে বলছো? তুমি পাগল নাকি? এ সময়ে প্রত্যেকটা মুহূর্তে অবস’া জটিল হতে পারে, বলেছিলাম না?’

ও আর কি বলবে শোনার অপেক্ষা করলাম না। আমার অবচেতন মন বলে উঠেছে অবস’া ভাল না। আমি লাফ দিয়ে উঠে সোনালীর ঘরে গিয়ে দরজায় টোকা দিতে যেতে পপি পিছন থেকে আবার মিন মিন করে বলেছিল, ‘থাক না, ওরা সবে বিশ্রাম নিচ্ছে, আর একটু না হয় দেখি।’

আমি ওর কথা শুনিনি, দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলেছি, ‘তরিক তোমার মামির মনে হয় সময় হয়ে গেছে।’

তরিকও সময় নেয়নি, তক্ষুনি ঘরে থেকে বের হয়ে এসেছে। সোনালী আমার ঘরে ঢুকে পপিকে ওদের মেয়েলি সাঙ্কেতিক ভাষায় কি জিজ্ঞেস করেই দ্রুত পপির দুই তিনটা কাপড় একটা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে বলেছে, ‘এখুনি চলো।’

আমরা সন্ধ্যের আগেই মগরেবের আজানের সময় পপিকে নিয়ে পিজি হাসপাতালে নিয়ে এলাম। ওকে তখনই আমার কাছ থেকে আলাদা করে ভিতরে নিয়ে গেল। আমি বারান্দায় বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম।

অনেক পরে তরিক ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে বললো, ‘ছেলে হয়েছে। কিন’ একটু জটিলতা দেখা দিয়েছে। মামির রক্ত বন্ধ হচ্ছে না।’

আরও বেশ কিছুক্ষণ পর আমি ঐ ঘরের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে যা দেখেছিলাম তাতে আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল।

পপি তখনও ডেলিভারী টেবিলে নিস্পন্দ শুয়ে আছে, আর পুরো ঘরের মেঝেতে লেপ্টে থাকা রক্ত একটা আয়া ঝাড়- দিয়ে পরিষ্কার করছে। আমার চিন-াশক্তি একেবারে ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। আমি স’ানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম বারান্দায়। আমার সময় জ্ঞান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, আরও কতক্ষণ পর বলতে পারবো না, এক সময় তরিক এসে বললো, ‘মামা চলেন তো ব্লাড ব্যাংকে রক্ত পাওয়া যায় কি না দেখি।’

পিজি হাসপাতালের অন্য ইউনিটের অনেক এদিক ওদিক করে ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে তরিক হাঁফ ছাড়লো, ‘মামা পাওয়া গেছে এক ব্যাগ, এটা দেই এখন, দেখি পরে কি করা যায়।’

আরও অনেক পরে রাত নটার দিকে সোনালী একটা পোটলা নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বললো, ‘নাও ধরো।’

পোটলাটার মধ্যে তাকিয়ে দেখি একটা ছোট্ট মুখ। পপির বার্থ ক্যানেলটায় কোন সমস্যা ছিলো বলে মাথাটা একটু বেঢপ লম্বা। কিন’ কি সুন্দর আর মিষ্টি ঐ মুখটা! চোখদুটো শক্ত করে বন্ধ করা। বেশ বড় একটা নাক আর ছোট্ট দুটো ঠোঁট। ছোট্ট বুকটা ওঠানামা করছে দ্রুত। মাঝে মাঝে একটু নড়ে উঠছে। এখনও ঐ মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে আসে।

শিশু সব সময়ই আমার অত্যন- প্রিয়- নবজাতক আরও বেশি প্রিয়। ইশ্বরের সবচেয়ে সুন্দর উপহার- সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার! আর তার ওপর আমার হাতে ধরা এ নবজাতকটি আমারই সন-ান।

আমি খুব আসে-, প্রায় অস্ফুট স্বরে ওর কানে আজান শোনালাম। বললাম, ‘তুমি আমার সর্বস্ব সম্পদ। বাবা, আমি আমার সমস- জীবন আর শক্তি দিয়ে তোমাকে সুখে রাখতে চেষ্টা করবো। তোমাকে সব সময় আনন্দে ভরিয়ে রাখবো।’

অনেক রাত। সারা হাসপাতাল প্রায় শুনসান। নীচের গেটের কাছে একটুখানিক জটলা- দুই চার জন। সামনে বিশাল চওড়া ময়মনসিংহ রোড প্রায় শূন্য। বারান্দায় আমি দাঁড়িয়ে আছি আমার নবজাতক পুত্রকে পরম মমতায় হাতের মধ্যে জড়িয়ে।

আরও অনেক পরে পপিকে একটু সুস’ করে, ওর বিদ্ধস- দেহকে কিছুটা স্বাভাবিক অবস’ায় নিয়ে এসে যখন বেডে আনলো, তখন ওর কাছে যাওয়ার অনুমতি মিললো আমার। আমি আমাদের সন-ানকে নিয়ে ওর বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

ও রক্তশূন্য, ক্লান- চোখ খুলে আমার দিকে তাকালো।

আমি ঝুঁকে পোটলাটা ওর পাশে রেখে বললাম, ‘তোমার ছেলে।’

ও একটু ম্লান হাসলো। অসম্ভব রকম রক্তস্রাবের পর তখনও ওর অবস’া তখন প্রায় ‘কোমা’তে চলে যাওয়ার মতো। আমি ওর পাশে ছেলেকে শুইয়ে রেখে বেরিয়ে এসে হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের অপেক্ষায় থাকলাম।

Leave a Reply