৬ এপ্রিল ডেলটা হাসপাতালে ভর্তি হলো ফিহা।
ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমি তাড়াতাড়ি এসিটা চালিয়ে দিলাম। ওর কাছে গিয়ে বললাম, ‘এখন তোমার একটু ভাল লাগবে, সোনা বাবা।’
ও কোন কথা বললো না, কেবল ফাঁকা বড় বড় চোখ মেলে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ বুঁজিয়ে ফেললো।
ঢাকা মেডিকেলের আড়াই দিন ওর জীবনের ওপরে যে ভয়াবহ অমানবিক অত্যাচার করা হয়েছে, তার ধকল ও আদৌ কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে হলো না। আমি শুধু একটু আরাম তো দিতে পারবো।
ও ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে ডাক্তার এসে ওকে ভাল করে দেখে নিয়ে এক গাদা ওষুধ আর ইনজেকশন এনে দিতে লাগলো একটা পর একটা। ঢাকা মেডিকেলের দুই রাত আড়াই দিনের মধ্যে দুই তিন জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পাঁচ মিনিটের জন্যে এসে ওকে দেখে আমাকে বললেন, ‘বুঝতেই পারছেন, এখন তো আর কিছু করার নেই আমাদের।’
এই দীর্ঘ সময় ওরা কেবল হাতে একটা নরমাল স্যালাইন আর নাকে অক্সিজেনের নল ঢুকিয়ে ওদের ডাক্তারী কর্তব্য শেষ করে ফেললো।
ডেলটা হাসপাতালে ফিহাকে ভর্তি করার পরপরই ডাক্তার অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মরফিন ট্যাবলেট খেতে মানা করে দিলো। ‘ওর তো মরফিনের প্রয়োজন ছিলো না। কে দিয়েছেন এ ওষুধ?’
আমি প্রফেসরের নাম বলতে ওরা আর কোন মন্তব্য করলো না। এ সময়ে আমি ফিহাকে যে জোমেটা ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিলো সে কথা বলে সে সম্পর্কেও ওদের মন্তব্য চাইলাম। ওরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবে দেওয়া হয়েছে জোমেটা।’ আমি আহমেদ মেডিকেলের কাগজপত্র বের করে দিতে তারা সমস্ত ফাইল খুঁজে জোমেটা দেওয়ার কোন তথ্য পেলেন না।
পাশে একজন জুনিয়র ডাক্তার ছিলেন। ও মন্তব্য করলো ‘এত দামী একটা ওষুধ দেওয়া হলো, অথচ কোন ম্যানেজমেন্ট রেকর্ড নেই! এই একটা ব্যাপারেই আপনারা ঐ ডাক্তারকে আদালতে দাঁড় করাতে পারেন। এমন পেশেন্টকে কখনই জোমেটা দিতে নেই।’
আমি আর কি বলবো!
ফিহার দু’জন বন্ধুও ওর সঙ্গে ছিলো। ওরা সাথে সাথে আর সব বন্ধুদের খবর দিয়ে দিলো। ফিহার অবস্থা আমি সব বুঝতে পারলেও, কেমন নির্বোধের মতো এক একবার মনে হতে লাগলো ফিহা আবার সুস্থ হয়ে উঠবে। আবার ও ইউনিভার্সিটিতে যাবে। মাস্টার্সটা শেষ করবে। আবার ও একটা অসাধারণ ফল করবে।ফিহার দু’জন বন্ধুও ওর সঙ্গে ছিলো। ওরা সাথে সাথে আর সব বন্ধুদের খবর দিয়ে দিলো। ফিহার অবস্থা আমি সব বুঝতে পারলেও কেমন নির্বোধের মতো এক একবার মনে হতে লাগলো ফিহা আবার সুস্থ হয়ে উঠবে। আবার ও ইউনিভার্সিটিতে যাবে। মাস্টার্সটা শেষ করবে। আবার একটা অসাধারণ ফল করবে।
ও ডেলটা হাসপাতালে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই পারভেজ কেবিনে ঢুকে ওর হাত ধরে পাশে বসলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন আছিস?’
পারভেজকে দেখে হঠাৎ ফিহা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। ওর হাত ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো। ওর সারা জীবনে এই দ্বিতীয় বার ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না।
তারপরেই নিজেকে সামলে নিয়ে পারভেজকে বলেছিলো, ‘এভাবে কেঁদে ওঠা আমার ঠিক হয়নি। আই এম স্যরি, দোস্ত। কাউকে আবার বলে দিস না যেন।’
পারভেজ আবার কি বলবে, ও নিজেই তো প্রাণপণ চেষ্টা করছে ফিহার সামনে না কাঁদতে। সন্ধ্যার আগেই কেবিনটা ওর বন্ধু-বান্ধবে ভরে গেল।
ফিহা কিছুক্ষণ পর পর টয়লেট করতে চাচ্ছিলো। বেশ কয়েক দিন ও ভালভাবে মল ত্যাগ করতে পারেনি শরীরের যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে কাজ না করায়। মিল্ক অব ম্যাগনেশিয়া, ল্যাক্সেনা, গরম দুধ দেওয়া হলেও কোন ফল হচ্ছিল না। এর জন্য ও বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলো। তাই বার বার টয়লেটে যেতে চাচ্ছিলো।
ওকে টয়লেটে নেওয়াটা ছিলো বেশ কষ্টকর কাজ। কষ্টটা আমার বা পপির না। কাজটা কয়েক ধাপে করতে হতো, যেটা ওর জন্যেই ছিলো কষ্টকর।
স্যালাইন বন্ধ করতে হচ্ছে, অক্সিজেন বন্ধ করতে হচ্ছে। কোমরে যাতে ব্যাথা না লাগে তার জন্যে শক্ত বেল্টটা পরাতে হচ্ছে। তারপর কাঁধের নীচে চাপ দিয়ে শরীরটা তুলে বসাতে হচ্ছে। তারপর আমার কাঁধে ভর দিয়ে ও দাঁড়াচ্ছে অনেক কষ্ট করে।
এখানে আসার পর লক্ষ্য করলাম সহজভাবে হাঁটতেও পারছিলো না ও। বিছানা থেকে টয়লেট পর্যন্ত অল্প পথটুকু পার হতে ওর বেশ কষ্ট হতো। কেমন যেন টলতে টলতে হাঁটতো। ফলে আমাকে ওর শরীরটাকে আমার শরীরের সাথে বেশ শক্ত করে লাগিয়ে ধরে রাখতে হতো।
টয়লেটে গিয়ে ওকে কমোডে বসানোর আগে পাজামাটা খুলে তবে ওকে বসাতে হতো। অনেকক্ষণ বসে থেকে ও যখন বুঝতো ও মলত্যাগ করতে পারছে না, তখন বলতো ওকে ধরে তুলতে। আমি আবার শক্ত করে ধরে ফিরে এসে বিছানায় বসিয়ে দিতাম। এক মিনিট বসে হাঁপাতো, তারপর ও শুয়ে পড়তো। সে সময়ও ওকে ভাল করে ধওে ধরে শুইয়ে দিতে হতো। এত কিছু কর্মকাণ্ড ও অত্যন- শান-ভাবে কোন বিরক্তি প্রকাশ না করে পালন করতো।
সন্ধ্যের পর হঠাৎ ফিহা বলে উঠলো, ‘আব্বু, মশারী টাঙিয়ে দাও।’
ঘরে মসকিউটো রিপেলেন্ট জ্বালানো ছিলো। মশারীর প্রয়োজন ছিলো না। আমি ওকে বললাম, ‘এখন তো সবে সন্ধ্যে, রাত হোক তখন দেবো।’
কিন্তু ও বেশ অস্থিরভাবে বার বার মশারী টাঙাতে বলতে লাগলো। শেষে আমি সিষ্টারকে বলে একটা মশারী আনিয়ে টাঙিয়ে দিলাম।
কয়েক মিনিট পরেই ও মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে বলে উঠলো, ‘মশারীর ওপরে ওটা কি?’
আমি বললাম, ‘ওপরে তো কিছু নেই বাবা।’
ওর গলায় কেমন একটা অস্বস্তিকর স্বর। কেমন যেন অস্থিরতা ওর সারা শরীরে।
ওকে শান্ত করার জন্য আমি মশারীটা খুললাম, উজ্জ্বল আলোটা জ্বেলে দিয়ে বললাম, ‘দেখো বাবা, ওখানে কিছু নেই, তুমি ঘুমাও।’
এতক্ষণে ও একটু শান্ত হলো।
এর মধ্যেও ও নিজের শরীর সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পোষণ করতো। একবার আমাকে বললো, ‘কোমরের ব্যাথার জন্য চাপ দিতে পারছি না আব্বু, এ জন্য হাগু হচ্ছে না। ব্যাথাটা কমলেই সব ঠিক হয়ে যেতো।
রাত দশটার দিকে ও আবার টয়লেটে যেতে চাইলো। আমি সব সময় চেষ্টা করেছি ওর সব ইচ্ছে পূরণ করতে। এবারও ওকে সেই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় তুলে দাঁড় করিয়ে গায়ের সাথে গা লাগিয়ে পিঠের পিছন দিকে থেকে জড়িয়ে ধরে টয়লেটের দিকে নিয়ে যেতে থাকলাম। তখন লক্ষ্য করলাম ও আর স্বাভাবিকভাবে পা ফেলে হাটতেও পারছে না। ওর পায়ের পাতা দুমড়ে যাচ্ছে। আমার বুকের মধ্যেটা মুচড়ে উঠলো। সময়ের সাথে সাথে এক একটা অঙ্গ অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। টয়লেট থেকে ওকে বেডে আনার সময় পপিকে ইশারা করে বললাম ওর পায়ের অব্স্থা।
ফিহাকে শুইয়ে দিয়ে পপিকে ব্যাপারটা খুলে বললাম, ‘আমাদের সোনা বাবা আর হাঁটতে পারছে না। ওকে টয়লেটে নিয়ে যাওয়াও এখন বিপদের হবে। কখন ও আমার হাত ফসকে পড়ে যায়। নিজের ওপর তো কোন নিয়ন্ত্রণ নেই ওর।’
পপির মুখটা আরও অন্ধকার হয়ে গেল। ও কি বলবে? কারো তো কিছু বলার নেই করারও নেই। কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর গুমরে গুমরে সহ্য করা।
৪০
রাত সাড়ে বারটার দিকে হঠাৎ ও বললো, ‘আম্মু টয়লেটে যাবো।’
সারা সন্ধ্যায় কয়েকবার টয়লেট করার নিষ্ফল প্রচেষ্টায় ও যে কষ্ট পেয়েছিলো, তার ওপর ওর পায়ের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই ওর মা বললো, ‘সকাল হোক তার পর যেয়ো। এখন ঘুমাও।’
ও তবু কয়েকবার বললো, ‘প্লিজ মা, একবার আমি টয়লেটে যাবো। প্লিজ নিয়ে চলো।’
ওর মা রাজি হলো না। ও একই কথা বলেছিলো, ‘সকাল হোক। তারপর যেয়ো।’
তারপরও ফিহা আরও কয়েকবার আর্তস্বরে অনুরোধ করলেও পপি রাজি না হওয়াতে ও চুপ করে গিয়েছিলো।
রাত তিনটার দিয়ে পপির কান্না শুনে আমি লাফ দিয়ে উঠেছি। ও ফোঁপাচ্ছে আর বলছে, ‘কেন আমি তোর কথা শুনলাম না রে, বাবা।’
আমি উঠে দেখি ফিহা বিছানাতেই অবচেতনভাবে মল ত্যাগ করে ফেলেছে। পপির কথা শুরে ও নিতান্ত করুণ স্বরে বললো, ‘আম্মু, তোমাদের বলেছিলাম না আমার টয়লেট হবে। তোমরা আমার কথা শুনলে না। এখন দেখো তো তোমাদের কত কষ্ট হবে।’
ছেলের আর্তকণ্ঠ শুনে আমার চোখে পানি এসে গেল। ফিহা তার শেষ অবস’াতেও চিন্তা করছে, ওর এই অসতর্ক কাজের কারণে ওর বাবা আর মায়ের কষ্ট হবে। বাবা-মার প্রতি এত গভীর ভালবাসা যে বিবেচক একটা সন্তানের মনে জমা হয়ে থাকে, তার জন্য বাবা-মায়ের সমস- স্নেহ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো সেই সন্তানের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়বে না তো আর কি হবে?
আমি তাড়াতাড়ি উঠে ওর কাছে গিয়ে বললাম, ‘না, বাবা। লক্ষী সোনা বাবা আমার। আমাদের কোন কষ্ট হবে না, বাবা। তুমি তো আমাদের বাবা, তুমি তো ইচ্ছে করে হাগু করোনি, বাবা। আমার শত সৌভাগ্য যে তোমার মতো সন্তানকে আমি পরিষ্কার করতে পারছি। তুমি তো অসুস্থ, বাবা। আমরাই তো গাফিলতি করেছি। তুমি যে হাঁটতে পারছিলে না। তোমার হাঁটতে যে কষ্ট হচ্ছিলো, বাবা। আমি, এখনই তোমাকে পরিষ্কার করে দিচ্ছি।’
আমি দ্রুত ওকে ভালভাবে পরিষ্কার করে ওর কাপড়-চোপড় বদলে দিলাম। পরনের কাপড় টয়লেটে নিয়ে ভাল করে ধুয়ে দিলাম। সমস্ত সময়টা ও অত্যন্ত কুণ্ঠা আর অপরাধী মুখ নিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকলো।
ঐ তার সব শেষ স্পষ্টভাবে কথা বলা।
এরপর থেকে ওর কথা জড়িয়ে গেল। দুপুরে আমাকে কি একটা বলতে গিয়ে ওর কথা একেবারে জড়িয়ে গেল। একটা শব্দও আমি বুঝতে পালাম না।
ওকে আর টয়লেটে নেওয়ার মতো অবস্থাও ছিলো না।
ভোরের দিকে ফিহা আর একবার মল ত্যাগ করলো। আর এমন কাজ করে ফেলার সাথে সাথেই অস্বস্তিতে কেঁদে উঠলো। আমি বুঝতে পেরেই ওর কাছে গিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে কথা বলে যত দ্রুত পারি ওকে পরিষ্কার করে দিলাম।
দ্বিতীয়বারের পরই আমার কেন জানি মনে হলো ফিহার এমন অবস্থা আরও হবে। আমি দ্রুত হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রাস্তার ওপারের বিডিআর শপে গিয়ে যত রকম ছোট বড় টিস্যু পেপার পেলাম কিনে নিয়ে এলাম। সোনালীকে ফোন করে ফিহার এই অবস্থার কথা বলে ওকে অনুরোধ করলাম বড়দের ব্যবহারের ডায়পার যদি পায় যেন নিয়ে আসে।
সোনালী ঘন্টাখানেকের মধ্যে এডাল্ট ডায়পার আনার আগেই ফিহা আরও তিন বার মল ত্যাগ করলো। ওর শরীর ক্রমে আরও কাহিল হয়ে পড়ছিলো। ও চোখ বুজে নিথর পড়ে থাকলো। বুকের নিচের দিকে মানুষ নামাজের সময় যেভাবে হাতদুটো বুকের কাছে বেঁধে রাখে সেভাবেই ওর হাতদুটো রেখেছিলো।
ডায়পার আনার পর ওকে পরিষ্কার করে দেওয়া আমার পক্ষে বেশ সহজ হয়ে গিয়েছিলো। প্রায় সারা দিনে ও আরও আট-দশ বার মল ত্যাগ করে গেল। আমি বুঝতে পারলাম গত দশ-পনের দিনেরও বেশী ওর ভালভাবে পেট পরিষ্কার হয়নি। এতোদিনের যত জমে থাকা ময়লা ওর স্নায়ুগুলো শিথিল হয়ে যাওয়ায় এখন বের হয়ে যাচ্ছে। যত বার ও এ কাজ করে ফেলছে ততোবারই ওর বাম হাতটা দিয়ে ও ডায়াপারের ফিতে খুলে ফেরার চেষ্টা করছে আর অস্বস্তিতে মুখ থেকে শব্দ করছে। আর তখনই আমি বুঝে যাচ্ছি ওর শরীর ময়লা হয়ে গেছে আর দেরী না করে সাথে সাথেই আমি ওকে পরিষ্কার করে দিচ্ছিলাম।
সন্ধ্যার পর থেকে ও আরও নিস্তেজ হয়ে পড়লো। ওর ডায়পার বদল করা লাগছিলো না। তবু মাঝে মাথে ও হাত নমিয়ে ডায়পারের টেপ খোলার চেষ্টা করলে আমি টেপ খুলে যখন দেখতাম ওর ডায়পার পরিষ্কার আছে, ওকে সে কথাটা বললে ও আবার শান্ত হয়ে যেতো।
সারা দিন ও কিছু খায়নি দেখে রাতের দিকে পপি একটা ছোট বাটিতে করে একটু জাউ ভাত নিয়ে ওকে খাওয়াতে গেল।
তরিক ছিলো কাছে বললো, ‘ওকে কি খাওয়াতে চাচ্ছেন মামী?’
পপি বললো, ‘সারাটা দিন তো কিছুই খায়নি। একটু কিছু দেই।’
তরিক বললো, ‘না দেওয়াই ভালো। ওর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে। এখন কিছু দিতে গেলে খাবার শ্বাসনালিতে চলে গেলে বিপত্তি হতে পারে।’
পপি বিমর্ষ হয়ে বাটিটা সরিয়ে নিয়ে গেল। তরিক বললো, ‘মুখে শ্বাস নিচ্ছে তো। কেবল ওর ঠোঁটের পাশটায় একটু একটু করে সাবধানে পানি দেন। খেয়াল রাখবেন একবার গিললে আর একবার দেবেন। আর এক সাথে বেশী করে দেবেন না।’
এর পর থেকে বেশ কিছুক্ষণ পর খেয়াল হতে আমি এগিয়ে গিয়ে ওর ঠোঁটের নিচে এক চামচ পানি দিলাম। ও দেখি ঢোঁক গিললো। ও পানি খেতে চাচ্ছে বুঝতে পেরে আরও একটু পানি দিলাম, ও একইভাবে ঢোঁক গিললো। এমনি করে ওকে দশ-বার চামচ পানি খাওয়ালাম। ও আমার হাত থেকে বেশ স্বচ্ছন্দে পানি খেলো অনেক ক্ষণ তারপর এক সময় মুখটা অন্য দিকে একটু সরালো।
আমি বুঝলাম ও আর পানি খেতে চাইছে না। আমিও ওকে আর পানি দিলাম না। ফিহা আমার হাতেই ঐ শেষবার আগ্রহের সাথে অনেক ক্ষণ ধরে পানি খেলো। এরপর আর ও আর ঢোঁক গিলে পানি খেতে পারলো না।
৪১
আট তারিখ সকাল থেকেই ওর শ্বাসকষ্ট আরও বেড়ে গেল। নাক দিয়ে ও পর্যাপ্ত শ্বাস নিতে না পেরে মুখ হা করে শ্বাস নিতে থাকলো। সম্ভবত এ সময় ও প্রায় কোমাতে চলে গিয়েছিলো। ওর শ্বাস নেওয়ার ধরন দেখে আমার কেমন সন্দেহ হলো। ওর মুখের কাছে কান নিয়ে স্পষ্ট শুনতে পেলাম ওর প্রতি শ্বাস নেয়ার সাথে সাথে ‘আল্লাহ’ শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওর এই ‘আল্লাহ’ জিক্র ওর অন্তিম সময় পর্যন্ত চালু ছিলো।
সারা সকাল আর দুপুর পর্যন্ত ও নিমিলিত চোখে আচ্ছন্নের মতো পড়ে থাকলো আর নির্দিষ্ট বিরতিতে একই ভঙ্গিতে ও শ্বাস নিতে থাকলো। আমি মাঝে মাঝে ড্রপারে করে ওর দুই ঠোঁটের ওপর অল্প অল্প করে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি দিয়ে ঠোঁটের ওপরটা ভিজিয়ে দিতে থাকলাম। যাতে গলা দিয়ে শ্বাস টানতে গিয়ে ওর গলাটা শুকিয়ে না যায়। ওর বিছানার চারপাশে ওর পাঁচ-ছয় জন বান্ধবী। কেউ কোরান পড়লে, কেউ বা দোয়া-দরুদ পড়ছে। বন্ধুরা বারান্দায় ভিড় করে আছে। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে দেখছে।
যখনই আমি ওর ঠোঁটের কাছে কান নিয়ে যাচ্ছিলাম তখনই ওর প্রতি শ্বাস গ্রহণের সাথে সাথে একই নিয়মে ‘আল্লাহ’ শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।
বেলা দেড়টার সময় আমি হঠাৎ দেখি ওর বামহাতটা আবার ওর ডায়াপারের কাছে চলে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম ওর নিশ্চয়ই প্রশ্রাব করেছে অথবা মল ত্যাগ করে ফেলেছে।
আমি দ্রুত ওর কাছে এসে কথা বলে উঠলাম, ‘ঠিক আছে, আমার সোনা বাবা, আমি এখনই তোমাকে পরিষ্কার করে দিচ্ছি।’
ডায়পার খুলে দেখি ও কেবল প্রস্রাব করেছে। আমি ডায়াপারটা সরিয়ে যৌনাঙ্গসহ ওর নিতম্বের ওপর-নীচ সবটুকু জায়গা ভালভাবে পরিষ্কার করে দিলাম। শুকনা টিস্যু পেপার দিয়ে আবার সমস্ত জায়গা মুছে দিয়ে সব জায়গায় ভালভাবে পাউডার ছড়িয়ে দিয়ে নতুন ডায়পার পরিয়ে দিলাম।
ও ওর হাতটা আবার পেটের কাছে ডান হাতের পাশে এনে রাখলো।
আমি, ওর মাথা ধারে এসে বসলাম। দেখি ওর কপালটা বেশ ঘামছে। আমি টিস্যু দিয়ে ওর কপালের ঘামটা মুছে দিয়ে টিসুটা ওয়েস্ট বাস্কেটে ফেরার জন্য ঝুঁকেছি এমন সময় ওর বান্ধবী মৌসুমী চিৎকার করে বলে উঠলে, ‘ওকি, আঙ্কেল দেখেন।’
তাকিয়ে দেখি ফিহার সারা দেহ ঝাঁকি দিয়ে উঠলো একবার। আমি প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে ওর কানের কাছে ঝুঁকে চিৎকার করে কলমা পড়তে লাগলাম, যাতে ও শুনতে পায়। আমি কেন যেন বুঝতে পারলাম, ও চলে যাচ্ছে।
ওর শরীর দ্বিতীয় বার ঝাঁকি দিয়ে উঠে কেমন যেন শান্ত হয়ে গেল। ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। সেকেণ্ড দুই পরে কেবল ওর বুকটা দুই বার ঝাঁকিয়ে উঠলো।
তারপর চিরদিনের মতো শান্ত হয়ে গেল।
ফিহার জন্মের সময় আমি ওর কানে আজান শুনিয়ে ছিলাম, কলমা শুনিয়ে ছিলাম; ওর অন্তিম সময়েও ওর কানে কলমা শোনানোর সৌভাগ্য আমার হল।
আমি কলমা পড়া বন্ধ করে কেবল ফিস ফিস করে নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সব শেষ হয়ে গেল? আমার সোনা বাবা চলে গেল?’
আমার চোখ দিয়ে বাঁধভাঙা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকলো। আমি আর কোন কথা বলতে পারলাম না।
আরও মিনিট দুই-তিন পরে দেখি ওর টুকটুকে গোলাপী ঠোঁটদুটো ধীরে ধীরে একেবারে ধবধবে সাদা হয়ে গেল। ওর শরীরে সব রক্ত জমে গেল।
বেলা ১.৪০ মিনিটে চোখের সামনে আমার একমাত্র সন্তান, শাহ মোহাম্মদ সায়েম মাহমুদ, যাকে আমি বড় আদর করে ফিহা বলে ডাকতাম, অত্যন্ত শান্তভাবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।
আমার বড় দুর্ভাগা, বাধ্য, অনুগত, নিরীহ আর শান্ত ছেলেটা আমাদের সকলের ওপর অভিমান করে চিরদিনের জন্য শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
ও আর কোনদিনই আমাকে আব্বু বলে ডাকবে না। ভিড়ের বাসে চড়ার জন্য আমাকে বকা দিয়ে আর বলবে না, ‘আব্বু এখন তোমার বয়স হয়েছে, ভিড়ের মধ্যে কেন কষ্ট করে বাসে যাওয়া-আসা করবে। এখন থেকে সিএনজি বা ট্যাক্সিতে চলাফেরা করবে।’
আমি সেদিন হেসে ফেলে বলেছিলাম, ‘তোর পড়ালেখা শেষ করে ড্রাইভিংটা শিখে নিস, একটা গাড়িই কিনে ফেলবো।’
ও থাকতেই একটা গাড়ি কেনার সামর্থ আমার হয়েছিলো। ভেবেছিলাম পরীক্ষাটা শেষ হলে ওকে ড্রাইভিং শিখে নিতে বলবো আর গাড়িটাও কিনে ফেলবো।
সেই গাড়ি চালানোর লোকটাই এখন চলে গেছে আমাদের ছেড়ে।’
এখন আর প্রতিদিন ফিহা ওর মাকে মনে করিয়ে দেবে না, ‘মা, প্রেসারের ওষুধ খেয়েছো?’
উপসংহার
তিন দিনের মিলাদ শেষ করে আমি আর পপি শেওড়াপাড়ার বাসায় চলে এসেছিলাম। তখন সন্ধ্যে। ঘরে ঢুকেই পপি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলো। আমার চোখেও তখন অঝোর ধারা। কে কাকে সান্ত্বনা দেবো। এক মাস আগে এই ঘর থেকেই ফিহা শেষবার হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলো। তখনও ও ভেবেছিলো, আরও একটু চিকিৎসার পর ও ভালো হয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে।
আজ ফিহা নেই। বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে।
একজন ভেঙে পড়লে অন্যজনকে তো একটু শক্ত হতে হয়। আমি কোন রকমে ঘর বারান্দা ঝাড়ু দিলাম, মুছলাম। রান্না ঘরে গিয়ে এক কৌটা চাল ধুয়ে চুলায় বসিয়ে দিলাম, রাতে তো একটু কিছু মুখে দিতে হবে। আসার সময় কেউ তো আর ভাত তরকারী রেঁধে আমাদের সঙ্গে দিয়ে দেয়নি, অন্ততঃ আজ রাতটা যাতে আমাদের কষ্ট করতে না হয়।
সন্তান হারানোর মাত্র তিন দিনের মাথায় আমি নিজেদের ঘর নিজে পরিষ্কার করে, বিছানায় পরিষ্কার চাদর পেতে দিলাম। খাবারের ব্যবস্থা করলাম। ফিহা যে ঘরে থাকতো সে ঘরটাও ভাল করে ঝাড়ু দিলাম। ও যে বিছানায় শুতো সেটা পরিষ্কার করে একটা পরিষ্কার চাদর পেতে দিলাম। অনেক দিন ধরে বন্ধ হয়ে থাকা গুমোট ঘরে এয়ার ফ্রেশনার দিলাম।
অন্ততঃ মনে একটু সান্ত্বনা পেলাম- ওর আত্মা, যদি সত্যিই তেমন কিছু থেকে থাকে, এবং যেমন শুনেছি, চল্লিশ দিন সেটা ঘনিষ্ট জনের চারপাশে ঘোরাঘুরি করে, এ ঘরে এসে দেখবে ওর ঘরটা সুন্দরভাবে গোছানো আছে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ওর ঘরে আলোটা জ্বেলে রাখলাম।
ফিহা চলে যাওয়ার পর থেকে অনেকেই ফোন করে বলেছে, ‘তোমরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করো, কাজ কর্মে ডুবে যাও।’
কিন্তু যে দম্পতি তাদের জীবনের অন্তিম লগ্নে তাদের একমাত্র সন্তান – ফিহার মতো একটা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো সন্তানকে হারায়- তারা কিভাবে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে? তাদের জীবনে আর চাওয়া-পাওয়ার কি কিছু থাকতে পারে?
এই সময়টা আত্মীয়ের মধ্যে কেউ একজন এক বাটি ভাত আর তরকারী কিংবা শুধু তরকারী রেঁধে বাসায় নিয়ে আসেনি, বলেনি, ‘এমন সময় পপি কিভাবে রাঁধবে? এই তরকারী নিয়ে এসেছি দুটো ভাত ফুটিয়ে খেয়ো।’
শুধু এই সময়ই নয়; সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পর তিন বারে পাঁচ দিন ধরে হাসপাতালে ফিহার যে কেমোথেরাপী চলেছে, সে সব সময়ে কখনও আমার আপন কেউ এক বাটি তরকারী রেঁধে হাসপাতালে নিয়ে আসেনি।
আমাদের অপেক্ষা করে থাকতে হয়েছে সন্ধ্যার পর কখন ফিহার খালু টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার আনবে তার ওপর। এই স্বল্পবাক লোকটি এবং তার স্ত্রী অর্থাৎ পপির বড় বোন এই দীর্ঘ এগারো মাসের প্রতি দিনের ক্যনসারের সাথে আমাদের একক যুদ্ধে সন্ধ্যে হলেই বড় টিফিন কেরিয়ারে করে ভাত-তরকারী ভরে নিয়ে হাজির হতো হাসপাতালে। দীর্ঘ সময় বসে থেকে নানা আলাপ করতো। ফিহার খালা এই সময়টা ফিহার পাশে বসে ওর গায়ে হাত দিয়ে বসে থাকতো। দোয়া-দরুদ পড়ে ফুঁ দিতো।
অথচ আমার বেশ কয়েকজন আত্মীয় হাসপাতালের অনেক কাছে থেকেও একটু কিছু খাবার নিয়ে আসেনি। পাশে বসে সান্তনা দেয়নি।
হঠাৎ করে ফিহা চলে যাওয়ার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই একদিন দেখলাম আজ পপি সবার কাছে খারাপ হয়ে গেছে। তার সাথে কেউ কথা বলে না। ওর সাথে সাথে আমিও খারাপ হয়ে গিয়েছি। আমার সাথেও আমার আত্মীয়-স্বজনরা কথা বলে না, ফোন করে খবর নেয় না, আমাদের দিন কিভাবে চলছে। কিন’ আমার কি দোষ? আমার কি করার আছে? কি করার ছিলো?
২০০৬ সাল পর্যন্ত কিন্তু পপি সবার কাছে ভাল ছিলো। সে নিজে থেকে সবার সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখতো, কথা বলতো। সবার সকল অনুষ্ঠানে আমাকে সঙ্গে নিয়ে, ফিহা যখন ছোট ছিলো তখন ফিহাকে নিয়ে হাজির হতো। তারিখ মনে রেখে দেখে দেখে বিয়ে, জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতো। পরীক্ষার ফল বের হলে মিষ্টি নিয়ে বাসায় যেতো। ততদিন পপি খারাপ ছিল না।
বড় ভাইরা যতবার ঢাকায় এসে আমাদের বাসায় উঠেছে, পপি সব সময় বহু রাত জেগে তাদের জন্য সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেছে। অফিস থেকে আসার সময় ওদের জন্য বিকালের নাস্তার জোগাড় করে আনতো। আর বড় ভাইয়ের বড় ছেলে সাবেরের বিয়ের সময় সে কি অমানুষিক পরিশ্রম করেছে সেটা আর একটা ইতিহাস।
যখন আমরা ফার্মগেটের বাসা ছেড়ে শেওড়াপাড়ায় এলাম তখনও বহু দিন সোনালীদের বহু অনুষ্ঠানে পপি গ্রীন রোডে সোনালীর বাসায় গিয়েছে। নানা খাবার তৈরী করে নিয়ে গিয়েছে। ওর ছেলে আর মেয়ের জন্মদিনে নানা রকম খাবার রান্না করে নিয়ে গেছে। তখনও কিন্তু পপি খারাপ ছিল না।
২০০৬ সালে আমার অপারেশনের পর ডাক্তারদের অবহেলা কিংবা অসর্তকতায়, যা-ই বলি না কেন, আমার ফিস্টুলা দেখা দিলো। নিদারুণ কষ্ট পাচ্ছিলাম (এখনও কষ্ট পাচ্ছি)। আমি অনেক এলোপ্যাথি-হোমিওপ্যাথি-কবিরাজি-হাকিমী- সব ধরনের ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছি। কেউই আমাকে বলেনি যে অপারেশন করলেই সেরে যাবে। সবাই বলেছে, আপনাকে সহ্য করতে হবে। এ ছাড়া গত্যন্তর নেই।
তা’ও আমি হয়তো সার্জারী করাতে রাজী হতাম। কিন্তু তখন ফিহা সেকেন্ড ইয়ার শেষ করে থার্ড ইয়ারে উঠেছে। ভাল রেজাল্ড করেছে, ফ্রেঞ্চ কোর্স করছে। খুবই ব্যস্ততার মধ্যে ওর দিন কাটে। সামনে ওর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। এ সময়ে বাপ হয়ে ওর ওপর অন্য কোন মানসিক চাপ দিতে আমার মন সরেনি। হাসপাতালে আমাকে দেখাশুনা করতে ও আর ওর মা ছাড়া আর কেউ তো আমার পাশে আগের তিনবারে থাকেনি। পরের বারে যে কেউ এগিয়ে আসবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? কেউ তো কারো জন্য করে না। তা’ ছাড়া বাবা হাসপাতালে ভর্তি হবে, অপারেশন হবে আর ফিহা সব ছেড়ে ক্লাস করবে, এমন ছেলে তো ফিহা ছিলো না।
আমি ভেবেছিলাম ওর অনার্স পরীক্ষা শেষ হোক, ততদিন না হয় আর একটু কষ্ট করি। ও বের হলে আমি আমার সার্জারীতে যাবো। (সে সময়টা আর আমি পেলাম না!)।
এমন সময়েরই ঘটনাটা – আপা হঠাৎ কোন রকম আগাম কথাবার্তা না বলে আমাকে আর পপিকে যা নয় তাই বলে গালাগাল করলো। পপিকে তার শেষ কথা হলো, ‘আমার ভাইকে তো আমি ক্যানসার হয়ে মরে যেতে দিতে পরি না।’
আপার এমন অস্বাভাবিক ব্যবহারে পপি হতবুদ্ধি হয়ে একেবারে গুঁটিয়ে গেল। এ নিয়ে সোনালী সব কিছু জানা সত্ত্বেও পপিকে কোন প্রকার সান্ত্বনা দিলো না, বা এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্যও করলো না, বরং সেও পপির সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। পপি কারও কাছ থেকে কোন প্রকার কোন সহায়তা না পেয়ে সবার সাথেই যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিলো।
এর আগে পর্যন্ত একমাত্র পপিই সবার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো- বাসায় গিয়ে, টেলিফোন করে। পপি আমাকে বলেছিল, ‘আমি যখন তোমাকে হাসপাতালে না নিয়ে এতোই অপরাধ করেছি, তা’হলে এখন থেকে আর কারো সাথে যোগাযোগ রাখবো না।’
সেই ২০০৭ সাল থেকে ফিহার অসুস্থতা দেখা দেয়া পর্যন্ত, ২০০৮ সালের মে পর্যন্ত এই এক বছর এ জন্যই পপি কারো সাথে সম্পর্ক রাখেনি। অন্য কেউ তো এ বিষয়টা নিয়ে পপির সাথে যোগাযোগ করতে পারতো। ও তো সবার চেয়ে ছোট। ওর কোন ভুল হয়ে গিয়ে থাকলে অভিভাবক হিসেবে তো কারো এগিয়ে আসা উচিৎ ছিল, কিন্তু সবাই পপির সাথে সাথে আমার সাথেও সম্পর্ক রাখা বন্ধ করে দিল।
ফিহা বড় হওয়ার পর, বিশেষ করে অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই আমাদের সম্মতি ও অনুরোধেই ফিহা তার চাচা আর ফুফুর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে আরম্ভ করলো। সবার প্রয়োজনে, কাউকে তার বাপের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া, কারো ডিগ্রি ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দেওয়া, বাজার করে দেওয়া, জন্ম দিন, পরীক্ষার ফল বের হওয়া, বিবাহ বার্ষিকী- এমন বহু কাজে ফিহা সবার ডাকে নির্দিষ্ট সময়ে হাজির হয়ে যেতো। পালন করতো ভাবী আর বোনের আবদার, ভাগনা আর ভাইপোদের নানা ছোট-বড় অনুরোধ। সব কাজে ফিহা হয়ে উঠেছিলো অবধারিত এক নিয়ামক শ্রমিক। এমন একটি সুন্দর ছেলের মা হিসাবেও কি পপি কারো সহানুভূতি পেতে পারে না?
তার পরও আমরা নেহায়েত অভদ্রের মতো, বেহায়ার মতো আমাদের একমাত্র সন্তানের চিকিৎসার জন্যে সোনালী আর তরিকের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। অথচ ফিহার চিকিৎসার ব্যাপারটা নিয়ে ওরা যেভাবে আমাদের সাথে প্রহসন করলো, সেটা অবিশ্বাস্য।
একটা সুস্থ স্বাভাবিক যুবক হিসাবে ফিহার যদি কারো প্রতি আকর্ষণ তৈরী হয়েও থাকতো, হয়ে থাকাটাই তো স্বাভাবিক। বিষয়টা যদি তার কোন আত্মীয়ের অপছন্দনীয় হয়ে থাকতো, তবে সে বিষয়টা তার বাবা-মাকে অবহিত করাটাই কি বেশী সমীচীন হতো না? অথচ তা না করে বাবা-মাকে বিষয়টা সম্পূর্ণ গোপন রেখে নিজেদের মধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে লেবু চটকে এমন বিশ্রী অবস্থায় নিয়ে গেল তার বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি বা ফিহার মা ব্যাপারটা সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে থেকে গেলাম। অথচ বাড়িতে এটা অশালীন পরিবেশের সৃষ্টি করা হলো।
অসুস্থ হওয়ার আগে ফিহা আমাকে জানিয়েছিলো, একটা মেয়ের সাথে ওর ঘনিষ্টতা ছিলো বেশ কিছুকাল যাবত। ওরা অত্যন্ত ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলো। এর মধ্যে ফিহা ওর সম্পর্কে একটু বেশী স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলো, এর মধ্যে মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে ফিহা মেয়েটার সাথে বিষয়টা নিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে আলোচনা করেছে। ওর বাবার বিরুদ্ধে দাড়ানোর শক্তি ছিলো না মেয়েটার। তা’ছাড়া ফিহা তখনও কেবল অনার্সের ছাত্র। আর যে ছেলেটার সাথে মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছে সে তখনই একটা বড় চাকরীতে ঢুকে গেছে। এটা তো সিনেমা না, যে মেয়েটা অনির্দিষ্টের পথে পা বাড়াবে?
ওরা দুজনে মিলে ঠিক করেছে এ ব্যাপারটা দুজনেই ভুলে যাবে। ওরা বন্ধু হয়েই থাকবে। ফিহা আমাকে বলেছিলো, ও ব্যাপারটা ওর মাকেও জানিয়েছে। ওর মা ব্যাপারটা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছে এবং ফিহার বিচক্ষণতায় ওকে সমর্থন দিয়েছে।
বিবেকহীন যৌন তাড়নায় বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ নয়, সত্যিকারের প্রেমে পড়া কাকে বলে তা’ আমি জানি। তাই আমি ফিহাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি মেয়েটার বাবার সাথে কথা বলবো কি না এ বিষয়টা নিয়ে। ও তখন বলেছিলো, না ব্যপারটা ওরা দুজনে মিলেই নিষ্পত্তি করেছে।
আমি আর এ নিয়ে আর কোন কথা বলিনি। এ নিয়ে ঘাটাঘাটিও করিনি। ছেলে মেয়েরা এক সাথে পড়তে গিয়ে ঘনিষ্ট হয়, বন্ধু হয়- অনেক সময় প্রেমেও পড়ে। তার মানে তো এই নয় যে তাদের মধ্যেকার সম্পর্কেও একমাত্র সমাধান বিয়ে। নারী-পুরুষের মধ্যেকার সম্পর্কেও আরও তো অন্য পরিসমাপ্তি থাকতে পারে। প্রকৃত বন্ধু আর পারস্পরিক সমমর্মিতা নিয়ে সারা জীবন পরস্পরের থেকে দূরে থেকেও ভাল থাকা যায়।
অসুস্থ অবস্থায় ফিহা কয়েকবার ওর সাথে হয়তো কথা বলতে, দেখা করতে চেয়েছিলো কারো মাধ্যমে। সেটা নেহায়েতই অন্য অনেকের সঙ্গেই তো ফিহা দেখা করতে চেয়েছিলো, বিশেষ করে, যখন ও হয়তো বুঝতে পেরেছিলো বেশীদিন ও আর পৃথিবীতে নেই। এ বোধটা যে ফিহার মতো বুদ্ধিমান আর বিচক্ষণ ছেলের মনে আসেনি তা কে বলতে পারে?
কিন্তু তার সেই অসুস্থ অবস্থায় গ্রীন রোডে কেন এ বিষয় নিয়ে গালাগালী তাকে করা হলো? ঐ বাড়ির সবাই তো অনেক আগেই জানতো ফিহার আয়ু আর কত দিন? যে দিন থেকে ফিহা সারকোমায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো, তখন থেকেই তো ঐ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরিবার জেনে গিয়েছে ও আর বেশী দিন নেই। আমরা না হয় নির্বোধ বাবা-মা, প্রকৃত তথ্য জানার পরও অবুঝ হৃদয়ে বার বার মনে হয়েছে, হয়তো কোন অসম্ভব একটা ঘটনা ঘটে যাবে, ফিহা সুস্থ হয়ে উঠবে। জীবনে আমি আর পপি কারও কোন ক্ষতি করিনি, চাকরী জীবনের প্রতি দিন হাসপাতালে আসা কত লোকের কত উপকার করেছি আমরা দু’জন। পপি কত শিশুর ভর্তি জন্যে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিয়েছে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের বুক খালি করতে পারেন না! অথচ কত সহজে ওরা সকলে মিলে ফিহাকে নানাভাবে কটুক্তি করেছে। আমাদের দু’জনের সামনে তো করেছেই, আড়ালে কত না খারাপ কথা বলেছে তার তো কোন হিসেব নেই। এমন কি তার মৃত্যুর দু’দিনের মাথায়ও এ বিষয়টা নিয়ে এমন ঘটনার অবতারণা করা হলো বাড়ি ভর্তি লোকজনের সামনে, যে কুৎসা ছড়ানো হলো আর কাদা ছোড়াছুড়ি করা হলো- কোন মানসিকতায় এ সব করা হলো, কোন তৃপ্তিতে এ সব করা হলো, তা আমার মাথায় আসে না।
মানুষ এমন পরিস্থিতিতে কতটা কুটীল আর বিবেকবর্জিত হতে পারে কল্পনা করা যায় না। আমি জানি না এ ঘটনার সূত্রপাত কোথা থেকে এবং কেন হলো?
পপির সাথে আমার বিয়ের পর থেকেই এডজাস্ট হয়নি। প্রথম দিকে ব্যাপারটা আপাকে আর সোনালীকে বহুবার বলেছি। কিন্তু ওরা কেউই বিষয়টা পাত্তা না দিয়ে বরং পপিকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে। ফিহার পাঁচ-ছয় বছর হওয়ার পর বহু দিন আপা আর সোনালীকে অনুরোধ করেছি আর একটা বাচ্চা নেওয়ার জন্যে পপিকে রাজি করাতে। উল্টে আপা আর সোনালী সব সময় আমাকে উপহাস করেছে, নানাভাবে অপদস্ত করেছে পপির সামনেই আর পপিকে আমার বিরুদ্ধাচরণ করতে প্ররোচিত করেছে। সোনালীর প্ররোচনাতেই পপি আমার প্রতি আরও বিরূপ হয়েছে। ফলে পপিকে কোন দিনই আমি আমার মতো করে তুলতে পারিনি।
শেষ প্রৌঢ় বয়সে- আমার প্রায় বৃদ্ধকালে পপি সবার বিরুদ্ধে চলে গেছে বলে তাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে এমন পরামর্শ কিভাবে আমার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে থেকেই আসতে পারে? শুধু তাই না, ফিহা যখন ক্যানসারে আক্রান্ত, প্রায় শেষ সময়, বড় ভাই যখন বাড়ি বিক্রি করা তিন ভাগের এক ভাগ টাকা আমাকে দিলো, তখনও আমাকে শুনতে হয়েছে, ও টাকা যেন আমি ফিহাকে বা পপিকে না দেই! কি অবিশ্বাস্য ব্যাপার, ভাবা যায়!
এই সব কথা শোনার পর একটা মানুষ কিভাবে ঠিক থাকে? এই সব আত্মীয়ের প্রতি পপির শ্রদ্ধাবোধ কোথায় দাঁড়ায়? সবার উপরে যখন ঐসব আত্মীয় আমারই রক্তের, তখন আমার প্রতি পপির সম্মানবোধটা কোন অতলে তলিয়ে যায় এটা কি কেউ কি কখনও ভেবে দেখেছে?
আজ ফিহা নেই। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ও মারা গেছে। আজ আপাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, তিনি তার ‘ভাইকে ক্যানসার হয়ে মরে যেতে দিতে’ চাননি, ভাতিজাকে ক্যানসারের হাত থেকে কি তিনি রক্ষা করতে পারলেন? তার কাছে আমার আরও জানতে ইচ্ছে করে যাদের প্ররোচনায় তিনি ও সব নোংড়া কথা বলেছিলেন, তারাও কি পারলো ফিহাকে রক্ষা করতে?
পপির সাথে আমার যে সমস্যা সেটা একান-ই আমার বলে আমি সারাটা সময় চুপ করে সহ্য করে এসেছি। কিন’ যে মেয়েটি বিশ-বাইশ বছর ধরে আর অন্য সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলো, মাত্র একটি ঘটনার পর সে কেন খারাপ হয়ে যাবে? তার অপরাধের কি কোন শেষ নেই? আমার ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কারোরই কি একবার এ কথাটা জানতে ইচ্ছে করলো না? যারা ওর অভিভাবক – বড় ভাই, ভাবী, সোনালী – সবাই কেন এ বিষয়ে চুপ করে থাকলো, কেন কেউ এগিয়ে এসে এটা ফয়সলা করলো না?
এত কিছু সত্ত্বেও ফিহা বড় হওয়ার পর, আমি আর পপি দুজনেই ফিহাকে বলেছি, দেখ আমাদের সাথে আমার আত্মীয়-স্বজনের সাথে মনোমালিন্য থাকতে পারে, সেটা আমাদের বিষয়- একসময় হয়তো সব ঠিক হবে। তাই বলে তুমি ওদের থেকে দূরে সরে যেয়ো না। ওদের সকলের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রাখবে। সবার বাসায় যাবে।
ফিহা সব আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতো। সবার সকল প্রয়োজনে, ভাইদের সকল সমস্যা, ভাবীদের সব ধরনের আবদার, ভাগনা-ভাগ্নীদের জন্মদিন- রেজাল্ট- সকল অনুষ্ঠানে তার ছিল সরব উপস্থিতি।
এর পরও আমাকে শুনতে হয়েছে, আমরা কেউই ফিহার প্রতি নজর দেইনি, ওকে অবহেলা করেছি। সোনালী বলেছিলো, ‘তোমরা কতোটা ফিহাকে দেখেছো? ওর সারাটা জীবন তো অবহেলা করেছো- তুমি তোমার অফিস নিয়ে আর ছোট মামী তার অফিস নিয়ে মশগুল ছিলে।’
শুনে আমি হতবাক হয়েছি। হ্যাঁ আমরা হয়তো অবহেলা করেছি। হয়তো ওকে বেসুমার খেলনা, জামা-কাপড় দেইনি, সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক বেড়াতে নিয়ে যেতে পারিনি, ওর হাতে গাদা গাদা টাকা তুলে দিতে পারিনি খরচের জন্যে, কিন্তু কোন দিন তো ওর সাথে দুর্ব্যবহার করিনি। পপি অফিসের শত পরিশ্রমের পরও ফিহার পছন্দের খাবার রাঁধতো। ফিহা কোনদিনই আমাদের কাছে কিছু চায়নি, আবদার করেনি।
তোমাদের কি মনে হয়নি, এ সব কিছু আড়ালে আমাদের দুজনের, বিশেষ করে ফিহার মা-র সমর্থন না থাকলে ফিহা কি কখনো এ সব কাজ এমন প্রাণ দিয়ে করতো? এমন একটা সুন্দর ছেলের মা হিসাবেও কি পপি তোমাদের সহানুভূতি আর সমর্থন পেতে পারে না? তোমরা কি করে ব্যবহার করা সেনিটারী ন্যাপকিনের মতো ওর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলে?
আমি এখন অসুস্থ, খুবই অসুস্থ। আমার প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডে জটিলতা দেখা দিয়েছে, বাম কিডনির সাথে বড় হচ্ছে একাধিক সিস্ট- একটা তো প্রায় ৬ সেন্টিমিটার বড়। বাম কিডনি সব সময় ব্যাথা করে – পিন ফুটানোর ব্যাথা। প্রস্রাব হতে কষ্ট হয়। ফিস্টুলার সমস্যা তো গত দুই বছর ধরে আছেই- যে কোন সময়ে যা কিছু ঘটতে পারে। বারডেমের ডাক্তার আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেছে। ফিহার অসুস্থতা নিয়ে যে প্রহসন চলেছে- ফিহাকে আহমেদ মেডিকেল সেন্টারে একবার আর একবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আর একবার- যেভাবে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে গিয়েছিল ফিহার শুভানুধ্যায়ীরা, তারপর সকল চিকিৎসকের উপরই আমার আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। আর আমি কোন ডাক্তারের অধীনে চিকিৎসা নিতে চাই না। আমার যা হবার হবে।
আমার আজ একটা বিষয় অবাক লাগে, চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কে যাদের কোনই ধারণা নেই তারা সকলেই আমাকে সমানতালে গালাগাল করেছে, কেন আমি আহমেদ মেডিকেলে দীর্ঘ পাঁচ দিন একজন নির্বোধ হৃদয়হীন অপদার্থ প্রফেসারের কথায় একটা বাতাসশূন্য গুদামঘরে মৃত্যুপথযাত্রী এই অসহায় রোগীটাকে ফেলে রেখেছিলাম, যে দিনের মধ্যে কেবল একবার পাঁচ মিনিটের জন্য এসে এক নজর দেখে গেছে আর ঠিকই পাঁচ শ’ টাকা করে কনসালটেন্সী ফি নিয়ে গেছে। অথচ বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও আর কোন ওষুধ তো দূরে থাক, একটা ব্যাথা কমানোর ওষুধও দেয়নি। অথচ পরে আমি সব জায়গায় শুনেছি ক্যানসার রোগীর শেষের দিককার একটিমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে তার ব্যাথা উপসম করা।
একই ঘটনা ঘটেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও। সবাই আমার চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করেছে টাকা আমার কাছে এত মূল্যবান হয়ে গিয়েছিলো যে, আমি আমার মৃত্যুপথযাত্রী সন্তানকে, অমন একটা অসহায় রোগীকে ঐ রকম একটা জল্লাদখানায় ফেলে রেখেছিলাম। এ কথাটা আরও উঠেছে যখন এই আমি ডেলটা হাসপাতালের এসি ঘরে ফিহাকে এনে রাখলাম, তখন। সকলেই আমার নির্বুদ্ধিতার জন্যে আর কিছু অবিবেচক জন্তু-জানোয়ারের কথা শুনে ফিহাকে আহমেদ মেডিকেলের মতো জায়গায় অকারণে এবং তার ঐ অন্তিম সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলাম। সবাই আমাকে বলেছিলো, ঐ দুই জায়গায় অমানুষের তত্ত্বাবধানে ফিহাকে না নিলে ও আরও দুই-চার দিন আমাদের বুকের কাছে থেকে এ পৃথিবীর বাতাসে শ্বাস নিয়ে আর একটু আরামে প্রাণত্যাগ করতে পারতো।
আমার আজ কেবলই মনে হয়, ১৯৫৭ সালের যে দিন আপা সোনালীকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছিল, সে দিন থেকে দুর্ভাগ্য আমাকে রাক্ষসের মতো তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমার সারাটা জীবন ধ্বংশ হয়ে গেল, ভিন্ন পরিবারের একটি মেয়ের জীবনও একইভাবে ধ্বংস হয়ে গেল। আর সেই অভিশাপে এত সুন্দর একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র অকালে ঝরে গেল। আমার জীবনের সেই দুর্ভাগ্যের পরিসমাপ্তি হয়তো খুব শিগ্রীই হবে।
আমি নিজেকে নিয়ে কখনও অতীতে ভাবিনি, আজও ভাবি না, ভবিষ্যতেও ভাবতে চাই না। আমি সারা জীবন কেবল খারাপ পরিবেশের মধ্যে দিয়ে, খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করেছি। আর তাই আমি মানসিকভাবে সকল সময় সব ধরনের খারাপ অবস্থার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকি।
কেবল তোমাদের কাছে অনুরোধ আজ পপি অত্যন্ত অসহায়। সন্তানহীন প্রৌঢ়া এই মেয়েটির সব আশা, আকাঙ্ক্ষা আর অবলম্বন নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। ওর কাছে আজ কেউ নেই। ও শুধু আমারই মতো পরিস্থিতি আর ষড়যন্ত্রের শিকার। এখন ওর অর্থের প্রয়োজন নেই, তা ওর যথেষ্ট আছে। তোমরা একটু ওর পাশে এসে দাঁড়াও।
আমার বিজ্ঞ, সম্পদশালী আত্মীয়-স্বজনদের র কাছে আমি কোন দিনই কিছু চাইনি, আজও আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।