সায়েম মাহমুদের নিস্ফল দ্বৈরথ অধ্যায় ১০

পরের দিন সকালে উঠে নাস্তার পর আমরা তিন জনে বের হলাম জুরং বার্ড পার্ক দেখতে। ট্যাক্সিতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তাই সকালে উঠে পপি বললো, খুঁজে দেখো কোথায় থেকে ওদিকে যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। কোন পথের বাস কোথায় স্টপেজ তা যখন জানি না, তখন কোন স্টপেজে গিয়ে কত নম্বর বাসে চড়বো, তা’ বুঝবে কেমন করে। এদিক ওদিক ঘুরে শেষে আমিই বললাম বুগিস মোড়ে যাওয়া যাক। র‌্যাফেলস্‌হাসপাতালে যাওয়ার সময় দেখেছি বুগিস স্টপেজে অনেক ধরনের চেহারা বাস থামে। ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে পথ পাওয়া যাবে। অতএব হেটে বুগিস পর্যন- গেলাম। অল্প একটু পথ তা িবেশী সময় লাগলো না। ওখানে বাস স্টপেজে একে ওকে জিজ্ঞেস করে বুঝতে পারলাম এখান থেকে জুরং বার্ড পার্কে যাওয়ার সরাসরি বাস নেই। বাস বদল করতে হবে। একজন বললো, আমরা কেন এমআরটিতে যাচ্ছি না। আমার মনে মনে সেটাই সখ ছিলো কিন’ পপির কারণে সম্ভব হচ্ছিলো না। আমি বিরক্ত হয়ে ফিহাকে বললাম, ‘এমআরটিচতে গেলে অসুবিধা কোথায়। চেষ্টা করে দেখি না।’

পপির তখনও ঘোর আপত্তি। কিন’ ফিহা আর কোন বিকল্প না পেয়ে অবশেষে রাজি হলো। আমরা রাস-াটা পার হয়ে বুগিস এমআরটি ঘরের দরজা পেরিয়ে নিচে নামার এসকেলেটার বেয়ে নেমে এলাম এক বিশাল হল ঘরে। এসেই এর চারপাশের বৈভব আর জনারণ্যের দ্রুত আসা-যাওয়া দেখে হতভম্ভ হওয়ার জোগাড়।

আমি একটু জোর করেই এখানে নেমেছি তাই পপি বেশ একটু বিরক্ত। আমাকে একটু ঠেস দিয়েই বললো, ‘নাও এখন কি করবে করো।’

আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি একটা কাউন্টারে দুই-তিনজন মেয়ে বসে আছে। ওটা ইনকোয়ারী। এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আই ওয়ান্ট টু গো টু জুরং বার্ড পার্ক।’

একটা মেয়ে আঙুল উঁচিয়ে হলঘরটার এক কোণায় ইঙ্গিত করে বললো, ‘বাই টিকিট ফর বুন লে।’

সে দিকে তাকিয়ে দেখি বিশাল একটা আলোকোজ্জ্বল কম্পিউটার প্যানেল। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম আসলেই বেশ সোজা ব্যাপার। একটা ম্যাপ দেয়া আছে তাদের দুই-তিন দিকে দুই-তিনটা রেখা চলে গিয়েছে। খুঁজে খুঁজে দেখি ঠিকই একটা রেখার শেষ মাথার দিকে লেকা জুরং ইস্ট, চাইনিজ গার্ডেন, লেক সাইড তারপর বুন লে। ওখানে আবার ছোট একটা পাখির ছবি। যা আছে কপালে বলে বুন লে বোতামটাতে দিলাম টিপ।

পপি পাশে থেকে রাগ করে উঠলো, ‘না বুঝে কোথায় কি টিপ দাও তার ঠিক নেই।’

ওর কথা শেষ হওয়ার আগে পর্দায় ফুটে উঠলে ‘পে ডলার ২.৭৫ ইচ।’

নিচে নোট আর কয়েন দেওয়ার ফুটো আছে। ফিহার হাতে টাকা। ও দশ ডলারের একটা নোট ঐ ফুটোর মধ্যে দিয়ে তিন সংখ্যায় টিপ দিলো। টাকাটা সাথে সাথে ভিতরে চলে গেল। মিনিট খানেকের মধ্যে নিচের আর একটা ফাটল থেকে তিনকে নীল রঙের কার্ড আর কিছু খুচরা কয়েন বেরিয়ে এলো।

কার্ড আর কয়েন নিয়ে ফিহা হিসাব করে দেখে মেশিনটা একেবারে নিখুঁত হিসাব করে দিয়েছে।

কার্ডটার দুই পাশে নানা কিছু লেখা। ছুটে চলা লোকদের পিছন পিছন প্লাটফর্মের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে পড়ে দেখি কার্ডটার এক পাশ সামনের বন্ধ গেটের সামনের সেনসরে বসাতে হবে। তবেই গেট খুলবে। ওপাশে যাওয়ার পর কার্ডটা সঙ্গে রাখতে হবে। এটা ঠিক চিরচরিত টিকিট না। এই কার্ড আবার ঐ ইলেকট্রনিক প্যানেলে জমা দিয়ে ডিসকাউন্ট ফেরত পাওয়া যাবে।

প্রত্যেক জনকে গেটের কাছে আলাদাভাবে কার্ডটা সেনসরে বসিয়ে পৃথকভাবে গেট খুলে ভেতরে যেতে হবে। ফিহা আর পপি ভালবাবেই ঢুকে গেল। আমার কার্ডটা সেনসরে লাগাতে গেটটা খুললো না। দুই তিনবার চেষ্টা করেও ফল পেলাম না। তার পর খেয়াল হতে কার্ডটা উল্টিয়ে বসাতেই গেট খুলে গেল।

এখন প্লাটফর্মে গাড়ির অপেক্ষায় দাড়িয়ে থাকা। দু’মিনিটের মধ্যেই পরের গাড়িটা এসে প্লাটফর্মে থামলে দরজাটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যেতে শত শত যাত্রী বের হয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। এবার আমাদের ওঠার পালা। ফিহা এতক্ষণ আমার কাজকর্ম সমর্থন না করলেও এখন ওর মাকে দ্রুত গাড়িতে উঠতে। গাড়ি খুব অল্প সময় দাঁড়ায় আর দ্রুত দরজা বন্ধ হয়ে যায়। দেরী হলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

আমরা দ্রুতই গাড়িতে উঠলাম। গাড়ির দুই দেওয়ালে লম্বা বেঞ্চের মতো অল্প কয়টা সিট। বাকী সবাই ওপরের হ্যাণ্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা কেউই বসার জায়গা পেলাম না। কারণ যদিও এটা টার্মিনাল, তা সত্ত্বেও আমরা ওঠার আগে আর যারা আগে উঠেছে অনেকেই বসার সুযোগ পেয়েছে। প্রচুর ভিড়। এক সেকেন্ড পরে ইংরেজী ও চীনা ভাষায় গাড়ি ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলো। বেশ দ্রুত গতি, কিন’ কোন রকম ঝাঁকুনি নেই। এটাও ফিহার জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতা। কেবল ফিহাই না, এটা আমাদের জীবনেরও প্রথম অভিজ্ঞতা।

সম্পূর্ণ বিদ্যুতে চলা এ বাহনটির গতি অত্যন- দ্রুত, দুলতে দুলতে চলছে। প্রথমে এটা অস্বসি’ লাগলেও মানিয়ে নিতে দেরী হলো না। একটুক্ষণ পর পর মাইকে ঘোষণা হচ্ছে সামনে কোন স্টেশন। গাড়িটা টানেলের মধ্যে চলছে বলে বাইরেটা অন্ধকার হলেও গাড়ির মধ্যে উজ্জ্বল আলো। এক একটা স্টেশন পার হচ্ছে। যাত্রী নামছে, উঠছে। এর মধ্যে যাত্রী নেমে যাওয়ায় পপি, ফিহা আর তার পর আমি বসার সিট পেয়ে গেলাম। কোন রকম ঠেলাঠেলি নেই। সব কিছুই সুশৃঙ্খল।

হঠাৎ দেখি গাড়ির দুই পাশের অন্ধকার হঠাৎ করে আলোকময় হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি মাটির তলা থেকে গাড়িটা বেরিয়ে এসে এবার আকাশমুখি হলো। রাস-ার অনেক ওপর দিয়ে পিলারের ওপরে বসানো লাইনের ওপর দিয়ে গাড়িটা এবারে ছুটে চললো। এতক্ষণ খালি যাত্রীদের মুখশ্রী ছাড়া আর কিছু দেখার ছিলো না। এখন গাড়ির দুই পাশের পরিবর্তিত দৃশ্যপট দেখতে বেশ মজাই লাগছিলো।

চলতে চলতে এক সময় মাইকে ঘোষণা দিলো সামনে বুন লে। আমরা একটু নড়ে চরে বসতেই গাড়ি এসে থামলো বুন লে স্টেশনে। আমরনা তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম। স্টেশনথেকে বাইরে বের হতে আর কোন ঝামেলাই নেই।

বাইরে বেরিয়ে এসে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম বার্ড পার্ক কিভাবে যাবো। ভদ্রলোক বললেন বাস স্টেশনে গিয়ে ১৯৫ নম্বর বাসে উঠলে ওটা নিয়ে যাবে বার্ড পার্কে।

এমআরটি স্টেশনের পাশেই বিশাল বাস স্টেশন। কয়েক বিঘার ওপর অবসি’ত বাস স্টপে অনেকগুলো সরু সরু পথ।

জিজ্ঞেস করা লাগলো না। সরু সরু পথের সামনে সামনে উঁচু শেডের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ক্রমিক নম্বর ঝোলানো আছে। ঐ ক্রমিকের বাস ঐ পথে এসে দাঁড়াবে। টিকিট কাটার ঝামেলা নেই। কেবল লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলেই হলো।

একটুক্ষণ পরেই নির্দিষ্ট ক্রমিকের বাস এসে দাঁড়ালো। ড্রাইভারের পাশে একটা বাক্স। ওখানে ভাড়া দিতে হবে। লেখা আছে কোথাকার কত ভাড়া। খুচরা সঙ্গে নিয়ে উঠতে হবে। বিদেশী বলে ফিহার বড় নোটের ভাঙানী ড্রাইভার ফিহার হাতে দিলো নিজের পকেট থেকে। তারপর ফিহা বাক্সের গর্তে সঠিক ভাড়া দিতে তিনটে টিকিট বেরিয়ে এলো। সময় হতেই বাস অর্ধেক ভরার আগেই বাস ছেড়ে দিলো।

ফিহাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এদের বাস অর্ধেক খালি থাকতেই তো চলতে আরম্ভ করলো। এরা ব্যবসা করে কি করে?’

ফিহা বললো, ‘সেটার চেয়ে বড় বিষয় হলো, এদের বাস কত সুন্দর আর নতুন দেখ। ঢাকার এক একটা বাস তো আশি সাল থেকে চলছে। ছাল-বাকল সব উঠে গেলেও।’

বিভিন্ন পথ ঘুরে আধা ঘন্টা পর বাস বার্ড পার্কে এসে থামলো।

পার্কে ঢুকে ফিহার যে কি আনন্দ! আমি পাখি দেখবো কি ওর দিকেই তাকিয়ে থাকি। যা দেখে তারই ছবি তোলে। কখনও ওর মাকে পাশে দাঁড় করায়, কখনও আমাকে বলে দাঁড়াতে। আমি আবার জোর করে ওর কয়েকটা ছবি তুললাম। একা, ওর মা-র সাথে। সবগুলেঅর পটভূমিকায় জুরং পার্কের পাখি।

দুপুরের পর ওখান থেকে ফিরে এলাম। আমিই একটু তাড়া দিলাম ফেরার জন্যে। খেয়াল করলাম ফিহা বেশ ক্লান- হয়ে গেছে দেখে।

আরও দুটো দিন হোটেলেই প্রায় শুয়ে-বসে সময় কাটালাম।

৩১

২৭ তারিখে র‌্যাফেলস্‌থেকে জানানো হলো ২৮ তারিখে প্রফেসর রিপোর্ট নিয়ে ‘সাইমের’ সাথে কথা বলবেন।

দুরু দুরু বক্ষে সময় মতো র‌্যাফেল্‌সে গেলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা্‌করার পর প্রফেসরে ঘরে ডাক পড়লো।

প্রফেসর পেট স্ক্যানের রিপোর্ট আর ছবিগুলো বের করে রবোটের গলায় জানালেন, যে জায়গায় সার্জারী করা হয়েছিলো সেখানে একটুখানি অবশিষ্টাংশ রয়ে গেছে। ঐ স’ানটা দেড় সেন্টিমিটারের মতো।

আমি শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন আমাদের কি করনীয় কিছু আছে?’

প্রফেসর বললেন, ‘ঢাকায় যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, সেটা সঠিক চিকিৎসা চলছে। তবে এর সাথে আর দুটো ওষুধ সংযুক্ত করা যেতে পারে। অপারেশনও করা যেতে পারে ঐ অবশিষ্টাংশটুকু বের করে দেওয়ার জন্যে।’

তিনি আরও বললেন আমরা যদি মনে করি তবে এক ডোজ ওষুধ ওদের তত্ত্বাবধানে দিতে পারি। এবং ওরা অতিরিক্ত যে ওষুধের প্রস-াব ওরা করছেন তা ওরা দিয়ে দিতে পারেন। সেই সাথে ফিহাকে প্রফেসর জিজ্ঞেস করলেন ঢাকায় চলা ওর চিকিৎসা এবং চিকিৎসকের ওপর ফিহার আস’া আছে কি না।

ফিহা বেশ জোরের সাথে বললো, ‘আই হ্যাভ এভরি কনফিডেন্স এন্ড রেসপেক্ট অন মাই অঙ্কোলজিস্ট।’

ওর এ রকম মনের জোর দেখে প্রফেসর ওকে ধন্যবাদ জানালেন। বললেন, অনেকেই তার ডাক্তারের ওপর আস’া থাকে না। তারপর প্রফেসর ফিহাকে শুভেচ্ছা জানালেন। আমাদের এপয়েন্টমেন্ট শেষ হলো।

বাইরে বেরিয়ে এসে ফিহা কাউন্টারে গেল ওদের হিসাব-নিকাশ মিটাতে।

এই ফাঁকে পপি আমাকে জিজ্ঞেস করলো প্রফেসর কি বলেছে। ও ইংরেজী বুঝেছে, কিন’ সবটা বোঝেনি। ওকে সব বুঝিয়ে দিতে ওখানেই পপি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। ওকে সামলাতে আমার গলদঘর্ম অবস’া। আমি নিজেকে সামলাবো কি, ওকে সমালাতেই আমার অনেক বেশী কষ্ট হলো। বার বার করে বোঝাতে থাকলাম, শান- হতে। ফিহা দেখলে কষ্ট পাবে, ভয় পাবে।

অনেক কষ্টে ওকে সামলালাম। হোটেলে ফিরে এসে ফিহা ল্যাব এইডের প্রেসক্রিপশন বের করে দেখতে লাগলো র‌্যাফেলস্‌যে ওষুধের কথা বলেছে সেটা ঢাকায় পাওয়া যায় কি না। একটু খুঁজে ও দেখালো দু’টো ওষুধই ল্যাব এইডের তালিকায় আছে। ও হেসে বললো, তা’হওে তো এখান থেকে ওষুধ কিনে নিয়ে যাওয়ার দরকার পড়বে না। তাই না আব্বু!

এই রাতেই আমি মাহবুব সাহেবকে ফোন করে বললাম আমরা পর দিনই ঢাকায় ফিরে যেতে চাই। মাহবুব সাহেব আগেই বলেছিলেন যে দিন যখন ফিরতে চান আমাকে বললেই সে দিনই ব্যবস’া করে দেবো।

পর দিনই ২৫ সেপ্টেম্বর বিমানে উঠে রাত দেড়টায় ঢাকায় ফিরে এলাম। বুকের মধ্যে আতঙ্ক আরও চেপে বসেছে। এতদিন যে কথা জানতাম না, এখন সেটা জানলাম। পেট স্ক্যান থেকে জানা গেল ফিহার দেহের আর কোথাও ক্যানসারের কোন চিহ্ন না থাকলেও যেখানটায় অপারেশন করা হয়েছে সেখানে ক্যানসারের একটু খণ্ডিত অংশ, মাত্র দেড় সেন্টিমিটার রয়ে গিয়েছে। এর থেকে কি হতে পারে? ফিহার ক্যান্সারের এ ধরনটার গতিধারা কি, এটা থেকে নিরাময় কিভাবে হবে কিছুই জানি না।

ঢাকায় আসার পর অবশ্য সোনালী ফিহাকে বোঝালো, যে কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছিলো, তার সাথে সিঙ্গাপুরের র‌্যাফেলস্‌হাসপাতাল আরও শক্তিশালী কেমোর যে ওষুধ যোগ করতে বলেছে, তাতে শরীরের ওটাকে বেঁধে ফেলতে হবে। বলা যায় না, এতেই ও মুক্ত হয়ে যেতে পারে। তারপরও যদি না হয়, তা’হলে রেডিওেয়শন থেরাপি দিয়ে একেবারে নির্মূল করা যাবে।

ফিহা সেই কথায় বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠলো। শিক্ষিত ছেলে, যে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে তার সব ক’টাই সে নিজে দেখছে, আগেরটার সাথে মিলাচ্ছে। তাই কোন কিছুই তো গোপন করা তো যাবে না ওর কাছ থেকে। পেট স্ক্যানের রিপোর্ট আর ফিল্মটাও ও ভাল করে দেখেছে। ওর কাঁধের কাছের ব্যাথাটা যে আর কিছুই না কেবল ক্যানসারের ব্যাথা, এটা ও বুঝে গেছে। ওর মুখ দিয়ে এক মুহূর্তের জন্যে কোন আওয়াজ বের হয় না। সব কিছু ও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে।

ওর যে কেমন যন্ত্রণা করছে আমি পাশে বসে টের পাই। রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে ঘুমের মধ্যে ওর মুখ থেকে কেবল অস্পষ্ট গোঙানীর শব্দ শুনতে পাই আমি। আর যখন জেগে থাকে তখন ওর ডান হাতটা ক্ষত স’ানে আলগাভাবে বোলাতে থাকে।

৩২

ঢাকা ফেরার এক দিন পরে তৃতীয় কেমোথেরাপি দেওয়ার তারিখ নির্ধারণ করলেন ওর ডাক্তার ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) মোফাজ্জল হোসেন। এবার দিনে দিনে দেওয়া নয়, পাঁচ দিন ধরে একটানা দিতে হবে। তাই হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে।

পরদিনই তৃতীয় কেমোথেরাপি দেওয়ার জন্যে ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি করা হলো ফিহাকে। সোনালী খুঁজে পেতে জানলার পাশের সেই বেডটাই জোগাড় করলো, যেখানে অপারেশনের পরে ও দু’দিন ছিলো। ডাক্তার সাহেব এসে প্রথমে সেই আগের ডক্সোরুবিসিন পুশ করলেন ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে। তারপর হলোক্সান নামে একটা নতুন ওষুধ আর তার সাথে মেজনা নামে আর একটা ওষুধ একই সাথে চলতে থাকলো স্যালাইনের মাধ্যমে। ঘন্টায় বারো ফোঁটা।

ফিহা পরম ধৈর্যে বিছানায় চুপ করে শুয়ে থাকলো। কোন প্রতিবাদ না, কোন অভিযোগ না, কোন আপত্তি নেই। একেবারে নিঃশব্দ, নিশ্চুপ। চোখের দৃষ্টিতে যেমন কোন চঞ্চলতা থাকলো না, শরীরেও কোন অসি’রতা নেই। দিনে-রাতে পূরোটা সময় আমি আর পপি ভাগ করে নিয়ে ওর পাশে চুপ করে বসে থাকি, কখন ও কিছু চায়। এসি দেওয়া ঘর, তাই বাইরের উত্তাপটা টের পাওয়া যায় না। সকালে হাসপাতাল থেকেই নাস-া দেয়। চাপাতি আর ভাজি, একটা ডিম সেদ্ধ, কর্নফ্লেক্স আর দুধ। কেমোথেরাপি চলছে, তাই ফিহার খাওয়ার চাহিদা একেবরে কমে গিয়েছে, তার ওপরে বমির ভাব ওকে আরও বিব্রত করে রাখে।

বুদ্ধিমান ছেলে, ওকে তো আর জোর করে ধমক দিয়ে খাওয়ানো যায় না। তার ওপর অত্যন- ব্যক্তিত্বশালী হয়ে উঠেছিলো ইদানিং। আমরা কোন কিছুই বলতাম না ওকে। ও ওর পছন্দমতোই কাজকর্ম-চলাফেরা করতো। কিন’ কোন দিনই এমন কোন আচরণ বা কাজ করেনি কিংবা কথা বলেনি, যাতে আমাদের মনে এক বিন্দুও কষ্ট হয়। এতো সুন্দর আর নমনীয় ব্যবহার ছিলো ওর, যে কোন বাবা-মার মনের সর্বোত্তম শানি-তে মন ভরে থাকার মতো সন-ান ছিলো ও।

ও নিজেও বুঝতো কিছু একটা খেতে হবে, না হলে ও দুর্বল হয়ে পড়বে। এক সময় নিজেই বলতো খাবারটা এগিয়ে দিতে। নিজে নিজেই একটু একটু করে খেতো, নিতান- অনিচ্ছায়। হয়তো দিনের মধ্যে একবার দুইবার বমির ভাব হতো, বমিও হতো এক-দুই বার। আমি বেডের নিচে রাখা গামলাটা তুলে ওর মুখের কাছে ধরতাম, যাতে ওর কষ্ট কম হয়। ও বমিটাকে ও খুব ভয় পেতো, কেন কে জানে। বমি করতে সবারই কম-বেশী কষ্ট হয়, ও যেন বেশী কষ্ট পেতো। ও সারা শরীর ঝাঁকিয়ে বিকট শব্দ করে বমি করতো। আমি পিঠের ওপর একটা হাত দিয়ে একটু চাপ দিয়ে রাখতাম, যাতে বমির সময় ও একটু স্বসি- পায়। কখনও নাভির ওপর একটু চাপ দিয়ে রাখতাম বেগটা যাতে একটু কম হয় এই মনে করে। তার মধ্যেও ও চেষ্টা করতো কিভাবে শব্দ কম করা যায়। পাশের বেডে আর একজন রোগী আছে, তার কথাটাও ও ভাবতো। ও আসলে সবার কথা ভাবতো। সবার জন্যে কিছু করতে চাইতো। অন্যের সুবিধা হবে কিসে, সে সব বিষয়ও ওর চিন-ার মধ্যে থাকতো।

প্রতি দিন শেষ বিকালে ওর বড় খালা আর বড় খালু বড় টিফিন কেরিয়ারে করে যখন নানা রকম খাবার নিয়ে আসতো তখন ও খুব খুশি হতো। জামান সাহেব পাশে বসে নিচু গলায় ওর সাথে ধীরে ধীরে কথা বলতেন। ফিহাও ওর সাথে একটু একটু কথা বলতো। হাসপাতাল থেকে প্রতি রোগীকে যে খবরেরর কাগজ দিতো তার খবর নিয়েও আলোচনা করতো। তবে ও সবচেয়ে পছন্দ করতো ওর বড় খালাকে। স্বল্পবাক এ মহিলাটি ফিহার পাশে বসে কোন কথা না বলে ওর হাত, পা, কাঁধ শরীর প্রায় সব জায়গা ধীরে ধীরে মাসাজ করে দিতেন। সেই সাথে নিঃশব্দে দোয়া-দরুদ পড়ে ওর গায়ে ফুঁ দিতেন। ওরা রাত নয়টা-দশটা পর্যন- হাসপাতালে ফিহার বিছানার পাশে থাকতেন। শেষে আমি প্রায় জোর করে ওদেরকে ঠেলে বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম।

পরে দুই এক দিন শুনেছিলাম, অত রাতে বাসায় ফিরতে ওদের বেশ বেগ পেতে হতো। তা’ সত্তেবও ওরা প্রতি দিনই সন্ধ্যার আগে আগে এসে হাজির হতেন। ফিহা যে ওদের দেখে খুশি হয়, একটুখনি মুচকি হাসে, এই হাসিটুকু দেখার জন্যেই স্বামী-স্ত্রী প্রতি দিনই বহু কষ্ট করে হাসপাতালে চলে আসতেন। অথচ কাছেই আরও দুই-এক ঘর আত্মীয়-স্বজন ছিলেন, যারা এক-আধা ঘন্টার জন্যে একটু বুড়ি ছুঁয়েই চলে যেতেন তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপে। এক দিনের জন্যেও তারা তাদের নিয়মিত রুটিন বদল করেননি।

কেমোথেরাপি দেওয়ার পর তিন দিন সোনালীদের বাসায় থাকতে হতো, কারণ ওর পরে পর পর তিন দিন তিনটা ইনজেকশন দিতে হয়। শেওড়াপাড়া থেকে অতদূর সায়েন্স ল্যাবরেটরীর পাশে ল্যাব এইড হাসপাতাল পর্যন- গিয়ে ইনজেকশন দেওয়া ফিহার পক্ষে কষ্টকর হতো।

ইনজেকশন দিয়ে শেওড়াপাড়ায় ফিরে এলাম। এর পরের কেমোথেরাপির তারিখ পড়লো বিশে অক্টোবর। আঠারো দিন বাসায় বিশ্রাম করতে হবে। খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। বিশ দিনের মাথায় রক্ত পরীক্ষা করে রিপোর্ট পাওয়ার পর পরের কেমো।

সারা দিন ফিহা চুপ করে বিছানায় শুয়ে থাকে। প্রয়োজনে টয়লেটে যাওয়া ছাড়া তেমন কোথাও বের হয় না। কেমো দেওয়ার পাঁচটা দিন ও সব সময় ওর মোবাইলটা বাজলে ধরতে চাইতো না। আমি ধরলে হয়তো নাম শোনার পর ওকে বলতাম, ও উত্তর দিতো, ‘বলো, আমি ঘুমাচ্ছি।’

আসলে ও ওর কষ্টের কথা অন্য কারো সাথে ভাগ করে নিতে চাইতো না। নিজের কষ্ট অন্যকে জানিয়ে তার মনে কষ্ট দিতে চাইতো না। ওর ভার্সিটির বন্ধুদের কাউকেই আমি তখন চিনতাম না। চেনার মধ্যে বাড়ির কাছে শাহজাদা আর কচ্চিৎ কখনও মিজান আসতো। আমার মনে হয় ওর ভার্সিটির বন্ধুদের অনেকই বহুদিনই জানতে পারেনি ওর আসলে কি হয়েছে। জানলে নিশ্চয়ই ছুটে আসতো ওর পাশে, যেভাবে ওরা পরে ছুটে এসেছিলো।

৩৩

পরের কেমোথেরাপি দেওয়ার সময় আগের বেডটা পাওয়া গেল না। তা’ছাড়া এই দীর্ঘ পাঁচ দিন বেডের পাশে চেয়ারে একেবারে সোজা হয়ে বসে থাকা আমার আর পপির দুজনেরই প্রচণ্ড কষ্ট হতো। পপির কষ্ট হতো সবচেয়ে বেশী। কারণ রাতের বেলা ফিহা ওর মাকে পাশে দেখতে পছন্দ করতো। ও বুঝতো ওভাবে বসে থাকা আমার পক্ষে অত্যন- কষ্টকর হতো।

এবারে একটা শেয়ারড্‌কেবিন পাওয়া গেল। সামনের দিকটায় আর একজন রোগী, আর পিছনের দিকটা ফিহার জন্যে বরাদ্দ। ওর জনৌ বেশ ভালো হলো। অত্যন- নিরিবিলি। আর ওর বেডের পাশে একটা সোফা, তাতে পপি একটু লম্বা হয়ে শুতে পারবে। প্রথম রাতের পর আমি সকালে হাসপাতালে যেতেই পপি আমাকে অনুরোধ করলো, আমি যেন রাতে থাকি ওর সাথে। সরু একটা সোফা, তার ওপর লম্বায়ও বেশ খাটো। কি আর করা ভাবলাম সাথে থাকলে ফিহারও হয়তো একটু ভাল লাগবে। সন্ধ্যার দিকে নিয়ম করে জামান ভাই আর বুবু এসে হাজির হন। তবু একটু মানসিকভাবে আরাম পাই আমরা দু’জন। ফিহাও বেশ খুশি হয় ওদের দেখলে।

এর মধ্যে প্রথম ফিহার ভার্সিটির দুই বন্ধু এসে হাজির হলো। সম্ভবত ফিহাই ওদের খবর দিয়েছিলো। ওদের সাথে ফিহা একটু হেসে হেসে কথা বললো। অন্যান্য বন্ধুদের কথা জিজ্ঞেস করলো। কবে পরীক্ষার ফল বের হবে তাই নিয়ে জল্পনা করলো কিছুক্ষণ। ওরা চলে যেতে বুকের মধ্যে চেপে বসে থাকা অবরুদ্ধ কষ্টটা একটু যেন গলেছে বলে মনে হলো।

এক একটা দিন যে কতো কষ্টকরভাবে পার হচ্ছে আমাদের তা কেবল আমি আর পপি অনুধাবন করি। আমি সেই সাথে ভাবি ফিহার মনের মধ্যে কি ভয়াবহ ঝড় বইছে, যার বিন্দুমাত্রও ও আমাদের টের পেতে দিচ্ছে না। যত দৈহিক কষ্ট না হয় দাঁত চেপে সহ্য করছে, উচ্চারণ করছে না বিন্দুমাত্র যন্ত্রণা। কিন’ প্রতি মুহূর্তে নিদারুণ মানসিক বেদনা কিভাবে সে একা বইছে? এ কথা যে মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে তখনই আমি প্রায় উন্মাদের মতো হয়ে পড়ি।

সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পর দ্বিতীয় কেমোথেরাপিটাও মোটামোটি নির্বিঘ্নে শেষ হলো। আবার তিন দিন তিনটে ঐ বিশেষ ইনজেকশনটাও দেওয়া হলো।

এই রকম সময়ে হঠাৎ সোনালী আমাকে ডেকে পাশের বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বললো, ‘মামা আমরা ফিহাকে আর ধরে রাখতে পারবো না। ওর যে ধরনের ক্যানসার হয়েছে তার সময় মাত্র কয়েক মাস।’

আমার বুকের ভিতরটা হীম হয়ে গেল। বুকের মধ্যে তো একটা জগদ্দল পাথর অনেক আগেই চেপে বসে ছিলো, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতো আমার। এখন মনে হলো আমার সামনের সমস- পৃথিবীটা নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবে গেল।

আমি খালি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কিছুই কি করার নেই?’

ও মাথা নেড়ে বললো, ‘না। খালি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হবে, ও চলে যাচ্ছে।’

আমি আর কিচ্ছু বলতে পারলাম না। সৃষ্টিকর্তা যদি আমাকে এতবড় শাসি-র বিধান করে থাকেন তা’হলে তো আমার বলার কিছু নেই। মাথা নীচু করে সেটা গ্রহণ করতেই হবে আমাকে। যে কাজটা এখন আমার সবচেয়ে প্রধান সেটা হলো ওকে কতোটা আরাম আর আনন্দ দেয়া যায়, সেটা দেখা।

মনে করতে পারবো না সেই দিন অথবা তার পরের দিন, খাবার সময় ফিহা ঘর থেকে বেরিয়ে সে আমার চেয়ারের পাশে দাড়িয়ে বললো, ‘আমার অনার্সের রেজাল্ট বেরিয়েছে।’

আমি প্রচণ্ড আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি খবর?’

ও একটু লাজুক হেসে বললো, ‘ফার্স্ট ক্লাস সেকেণ্ড।’

আমি বলতে পারবো না ঐ তিনটি শব্দ আমাকে কী অপরিসীম আনন্দিত করলো। আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লাম। জীবনে এতো আনন্দ কোন দিনই পাইনি আমি। কিন’ আমার চারপাশের আর সবার অত্যন- শীতল অভিব্যক্তি দেখে আমার মুখ থেকে কোন উচ্ছাস প্রকাশ করতে সাহস পেলাম না আমি।

আর সব লোকের সন-ানদের নিতান- সাধারণ বার্ষিক পরীক্ষার ফল বের হওয়ার খবর শুনেই আমি আর পপি প্রচুর মিষ্টি আর উপহার নিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে গেছি। অথচ আমার সন-ান আজ এত বড় সাফল্য অর্জন করলো, কেউ হেসে শুভেচ্ছাও জানালো না। ওরা যে আলোচনা করছিল সেটা একটু থামিয়ে ‘ও তাই?’ বলে আবার সেই পূর্বেও আলেচনায় ফিওে গেল। একটা ছোট উপহারও কিনেও দিলো না এই ভাগ্য বিড়ম্বিত ছেলেটিকে।

পরে ও যখন ঘরে এলো, আমি ওর হাত ধরে বলেছিলাম, ‘বাবা, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ তুমি আজ আমাকে দিয়েছো।’

আমার মনে সন্দেহ ছিলো ওর রেজাল্ট নিয়ে, তেমন গুরুত্ব দিয়ে পড়াশুনাও ও তো করতো না। বাসায় ও প্রায় পড়তোই না। তবে অনেক সময় ধরে লাইব্রেরী করতো আর গাদা-গাদা বইয়ের পৃষ্ঠা ফটোকপি করে আর ইন্টারন্টে থেকে কি সব জিনিষ দিস-া দিস-া প্রিন্ট করে ঘর ভরে ফেলতো। বাসায় থাকলে ঐ সব কাগজে বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখ বুলাতো।

আমি সব সময় মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম, ও কোন রকমে ফার্স্ট ক্লাস পেলেই আমি খুশি হয়ে যাবো। জানতাম প্রথম ও হতে পারবে না। কারণ যে প্রথম হয়েছে, সে আগাগোড়াই ওর সাথে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছে। মেয়েটি এক অধ্যাপকের মেয়ে, তাই কিছুটা ‘ফেভার’ অধ্যাপকদের কাছ থেকে ও তো পাবেই।

যখন পরীক্ষা দিচ্ছিল তখনও ওকে কোন টেনশন করতে দেখিনি। পরীক্ষ দিয়ে এসেও ও কোন রকম দুশ্চিন-া দেখায়নি।

৩৪

বিশে জানুয়ারী ওর শেষ কেমোথেরাপি দেওয়ার তারিখ। সোনালী বললো, ‘শেষ কেমোটা আর একটু আরামে ওকে দিতে হবে। একটা সিঙ্গল কেবিন নেই কি বলো? আমি মানা করবো কেন? আমিও তো চাই ও একটু বেশী আরাম পাক। টাকাটা তো আমার কাছে কখনই মূল্যবান হয়ে দেখা দেয়নি। তারপর তো একমাত্র সন-ানের চিকিৎসা। বেশ একটু খুঁজে ল্যাব এইডের সবচেয়ে বড় আর ভাল কেবিনটা নেওয়ার ব্যবস’া করলো সোনালী।

বিশাল বড়ো ঘর। দুই পাশে দেয়াল জোড়া কাঁচ পর্দা দিয়ে ঢাকা। পর্দা সরিয়ে দিলে পুরো মিরপুর রোড আর পাশের আর একটা ছোট রাস-া পুরোটা দেখা যায়। ঘরে টিভি ফ্রিজ, খাবার আর কাপড় রাখার আলাদা কাবার্ড। সহযোগীর থাকার জন্যে সুন্দর একটা সোফা, ভাঁজ খুললে দু্‌ই জন অনায়াসে শুতে পারে।

ফিহা বিছানায় শোয়ার পর দুই ধারের পর্দা সরিয়ে দিতে মনে হলো আমরা যেন মিরপুরের রাস-ায় দাঁড়িয়ে আছি। বিকালে প্রফেসর ঘরে ঢুকে ফিহাকে দেখে বললেন, ‘কি ইয়ং ম্যান, কেমন আছো। এই ভিআইপি কেবিন কেমন করে জোগাড় করলে। এখানে তো আমি সাবিনা ইয়াসমিনের চিকিৎসা করেছি।’

এমন একটা ঘরে আসতে পেরে ফিহা মানসিকভাবে খুব খুশি হলো। এখানে আসার পরই এক জন দুই জন করে ফিহার বন্ধু আর বান্ধবীরা আসতে আরম্ভ করলো। এই প্রথম ওদের সাথে আমাদের পরিচয় হলো। ওদের দেখে ফিহাও বেশ খুশি হয়ে উঠতো।

যখন বাইরের কেউ থাকে না তখন মাঝে মধ্যে টিভি খুলে খেলা দেখে একটু, খবরটা দেখে বেশ মনোযোগ দিয়ে। তা’ছাড়া অধিকাংশ সময় চুপ করে চোখ বন্ধ করে অসীম ধৈর্যে পড়ে থাকে। হাতের শিরায় সমান গতিতে মিনিটে বারো ফোটা করে ক্যানসারের ওষুধ রক্তের সাথে মিশে যাচ্ছে। পরম ধৈর্যের সাথে ও প্রতি মুহূর্ত আশা করছে ওর শরীরের ক্যানসার হয়তো বা একটু একটু করে নিরাময় হয়ে যাচ্ছে।

তৃতীয় দিন ওর বেশ কয়েকজন বান্ধবী ওকে দেখতে এলো, সঙ্গে নিয়ে এলো বেশ কয়েকটা ঝলমলে সার্ট। ওদেও সাথে ও বেশ সহজভাবে কথা বললো, রসিকতা করলো, ওদেরকে ওর রোগ সম্পর্কে চিন-া করতে মানা করলো। বললো, ‘আর কয়েক দিনের মধ্যেই আমি তোদেও সাথে মাস্টার্স-এর ক্লাস করবো, চিন-া করিস না।’

এক সময় ওর থেরাপি দেওয়া শেষ হলো। থেরাপি চলার তৃতীয় দিন থেকেই আমার কাছে মনে হলো ওর অপারেশনের জায়গাটা যেন আবার একটু ফুলে উঠেছে, একটু বেশী জায়গা নিয়ে ফুলে উঠেছে।

আমার মনটা একটু ছোট হয়ে গেল, মনে হলো এটা আবার কোন উপসর্গ?

কেমোথেরাপি শেষ হলে আবার তিন দিনে তিনটা ইনজেকশন দেওয়া হলো।

এর মধ্যে ঐ ফোলাটা যেন ধীরে ধীরে বাম বগোল আর বাম কাঁধের দিকে ছড়িয়ে যেতে লাগলো। জিনিষটা এত দ্রুত হতে থাকলো যে মনের মধ্যে আতঙ্ক ভর করতে বাধ্য। জায়গাটা একটু বেশী গরম বোধ হয়। আমি পপির দিকে তাকাই, ও আমার দিকে তাকায়। আমাদের দুজনের চোখেই অশ্রু ভরে ওঠে।

তা’ সত্ত্বেও ওর সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করি। দুপুরে কি খাবে, রাতে কি খাবে? টিভিতে কি অনুষ্ঠান আছে? এই সব নানা অপ্রয়োজনীয় কথা বলি, ওর মনটাকে চাঙ্গা রাখতে। ফিহা আমাদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও ওর মুখটা ক্রমে বিমর্ষ হয়ে উঠতে থাকে, বুঝতে পারি। ও ক্রমে আরও গম্ভির হয়ে উঠতে থাকলো।

নির্দিষ্ট সময়ে মোফাজ্জল সাহেবের সাথে দেখা করলাম। ফিহাকে দেখে একটু হেসে চিরাচরিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘কি ইয়াং ম্যান কেমন আছো?’

ফিহা ওর বাম দিকে ফুলে যওয়া যায়গাটা দেখালে ওর মুখ মেঘের মতো কালো হয়ে গেল। সাথে সথে তিনি একটা এমআরআই পরীক্ষা করাতে বললেন।

আমি পরদিনই এমআরআই পরীক্ষার ব্যবস্থা করলাম।

এমআরআই-এর রিপোর্ট সন্তোষজনক পাওয়া গেল না। বুকের বাম দিকটার বেশ কিছু জায়গায় নতুন কিছু বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেল।

রিপোর্টটা নিযে আমরা কয়েক জন কনসালটান্টের পরামর্শ নিলাম। একজন বললেন এখনই রেডিয়েশন দেয়া আরম্ভ করতে হবে, আবার আর একজন বললেন, ‘প্যালিয়েটিভ মেডিসিন আরম্ভ করতে। প্যালিয়েটিভ কথাটার অর্থ আমি জানতাম না তখনও।

Leave a Reply