ফিহার চার বছর বয়সে আমাদের একটু আরাম হলো। আমরা একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমাদের এই চরম দুরবস’ার কথা আপা অনেক দিন ধরেই জানতেন কিন’ তিনিও কোন সমাধান বের করতে পারছিলেন না। হঠাৎ তিনি রাজশাহীর গ্রামের থেকে একটা কাজের মেয়ে পেয়ে আমাদের পাঠিয়ে দিলেন। আপা আমার অফিসে ফোন করে বললো, ‘একটা মেয়েকে পাঠালাম। খুবই অভাবী। তোদের সুবিধা হবে। আজকের গাড়িতে পাঠাচ্ছি। ও ঢাকার কিছুই চেনে না। গাবতলী স্ট্যান্ডে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিস।’
রাজশাহী থেকে সাধারণত গাড়ি সাড়ে তিনটা-চারটার দিকে আসে। আমি বাসায় এসে গোছল করে খেয়ে তিনটে নাগাদ রওনা হয়ে সাড়ে নিটায় গাবতলীতে গিয়ে যে গাড়িতে আসবে সে গাড়ির নাম ধরে খুঁজে খুজে দেখি ঐ দিন গাড়ি তিনটারও আগে এসে হাজির হয়েছে। গাড়ির মধ্যে একজন ভারী শরীরের মেয়ে একটা সিটে বসে কাঁদছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছো?’ ওর কান্না বেড়ে গেল। শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো। আমি বললাম, ‘চলো। আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’
মেয়েটা যেন প্রাণ হাতে পেলো। ওর সঙ্গে ছোট্ট একটা পোটলা। একটা রিকসা করে ওকে বাসায় নিয়ে এলাম। আর এভাবেই সালেহা নামের এই মেয়েটি সেই ছিয়াশি সাল থেকে দুই হাজার সাল পর্যন- দীর্ঘ পনেরো বছর আমাদের সাথে ছিলো।
আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, যে ভয়াবহ পরিসি’তিতে সাড়ে তিন বছর আমাদের কেটেছিল তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো না।
সালেহা এসে আমাদের পুরো সংসারটা জাদুর স্পর্শে বদলে দিলো। ফিহার দেখাশুনা, ওকে সময় মতো গোছল করানো, খাওয়ানো, কাপড় বদলানো, সঠিক সময়ে ঘুম পাড়ানো- সব কিছু তো ঘড়ির কাঁটার মতো হতে থাকলো। আমরা বাড়ি ফিরে টেবিলে গরম ভাত, দুই-তিন রকম তরকারী, ঘর-দুয়ার ঝাড় দেয়া, মোছা, বিছানা-বালিশ, কাপড় পরিষ্কার করা- সব কিছু নির্বিবাদে হতে থাকলো।
ফিহার ছয় বছর বয়েসে স্কুলে দেয়া নিয়ে আমি অত্যন- দুশ্চিন-ায় পড়ে গেলাম। আমার সহকর্মীদের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে কোন একটা সাধারণ স্কুলেই বিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা ডোনেশন না দিলে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করা যাবে না। আর সরকারী বিদ্যালয়ে তো আরও অসম্ভব।
ঠিক এমন যখন অবস’া। তখন এরশাদ সরকারের সময়। শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ হঠাৎই সে বছর ঘোষণা দিলেন সারা দেশের সরকারী বিদ্যালয়গুলিতে প্রথম শ্রেণীতে শিশু ভর্তি করা হবে একক সমন্বিত পরীক্ষার মাধ্যমে- ঠিক এসএসসি পরীার মতো। একই প্রশ্নপত্রে।
পপি তার শাহ আলম নামের এক সহকর্মীর সহায়তায় শের-এ-বাংলা নগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটা ফর্ম জোগাড় করলো। পরীার সিট পড়লো ফার্মগেটের সরকারী বিজ্ঞান কলেজের ক্যাম্পাসে।
এর অনেক আগে ফিহা যে কিভাবে বাংলা আর ইংরেজী বর্ণমালা শিখে গিয়েছিলো, তা বলতে পারবো না। ফিহার ছোট বেলা থেকে আমি ওকে আর কিছু কিনে দেই আর না দেই, প্রচুর ছবির বই আর বর্ণমালার বই কিনে দিয়েছিলাম। ও কেমন করে জানি না অর চিনে ফেললো, সংখ্যা চিনে গেল। শব্দ বানানোও শিখে গেল।
ঐটুকু বাচ্চা কিভাবে যে পরীক্ষা দেবে আমি ভেবে পেলাম না। পরীক্ষার আগের দিন হঠাৎ মিয়াভাই ঢাকায় এসে হাজির। পরীক্ষার দিন সকাল বেলা ফিহাকে সাজিয়ে-গুজিয়ে পরীক্ষাস’লে নিয়ে গেলাম।
ওর এডমিট কার্ডটা কিভাবে ওর সাথে দেবো বুঝে পাচ্ছিলাম না, ছেলে মানুষ, কোথায় রাখবে, হারিয়ে ফেলবে না তো? এ সব কথা ভেবে বেশ দুশ্চিন-ায় পড়ে গিয়েছিলাম। শেষে বড়ভাই এই জটিলতার সহজ সমাধান বের করে ফেললো। একটু খুঁজে পাশের একটা দোকান থেকে একটা পেপার ক্লিপ কিনে ওর জামার সাথে ওটাকে আটকে দিলেন। আমাদেরকে ক্যাম্পাসের বাইরে রেখে ছেলেগুলোকে ভিতরে নিয়ে গেল।
হঠাৎ আমার মনে পড়লো ও তো বেঞ্চে বসে কাগজে লিখতে পারবে না। কোন মতে গেটম্যানকে অনুরোধ করে ছুটে গেলাম ভিতরে। ফিহা কোথায় খুঁজে বের করতেই সময় গেল বেশ একটু। এক ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি ও ঘরের একেবারে ভিতরে বসার বেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। আমি ইশারা করতে ও আমার দিকে তাকিয়ে একটু ম্লান হাসলো। সারা মুখে এমন একটা অস্বসি-। আমি জোরে জোরে বললাম, ‘বাবু, বসে বসে লিখতে অসুবিধা হলে দাঁড়িয়ে লিখো কেমন।’ ও ঘাড় নেড়েছিলো। মনে হয় আমাকে দেখে ওর একটু সাহস হলো।
এখন মনে করতে পারবো না, পরীক্ষা এক ঘন্টা না দুই ঘন্টা হয়েছিল। অনেকক্ষণ পরে এক সময় পরীক্ষা শেষ হলো। আমার একটু আতঙ্ক হলো ওকে এত শিশুর মধ্যে কিভাবে খুঁজে বের করবো। কিন’ ওদের ব্যবস’াটা ছিলো বেশ সুশৃংখল। একটা একটা করে বাচ্চা ঘর থেকে বের করছে। বাবা কিংবা মা-রা হাত তুলছে। বাচ্চাটা তার অভিভাবককে চিনতে পেরে যখন হাত তুলে নিজেকে জাহির করছে, তখন তাকে এগিয়ে দিচ্ছে। অনেক ক্ষণ পর ফিহা বেরিয়ে এলো। আমাদের দুজনকে দেখে হাসলো। আমরা ওকে নিয়ে বাসায় চলে এলাম।
দিন পাঁচেক পর পপি বাসায় এসে বললো ফিহা ওর জীবনের প্রথম পরীক্ষা ভালভাবেই পাশ করেছে। কিন’ প্রথম পঞ্চাশ জনের মধ্যে ওর নাম নেই। ফিহা যে ঠিকমতো পরীক্ষা দিতে পেরেছে এতেই আমি খুশি ছিলাম। প্রথম পঞ্চাশ জনের নাম তালিকা করে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। ওর নাম বাকী এক শ’ জনের নাম ওয়েটিং লিস্টে স’ান পেয়েছে, ওর নাম ছিলো বাষট্টিতম।
আমি পপিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন আমাদের কি করতে হবে?’
পপি বললো, ‘শাহ আলম ভাই বলেছেন, কিছু খরচ করতে হবে।’
আমার মনটা একটু দমে গেল। আবার সেই ডোনেশন? না, জানি এখন কত চাইবে। কিন’ যে দেশে যে নিয়ম, কি আর করা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কত দিতে হবে?’
পপি বললো, ‘ভাই বলেছেন পাঁচ দিলেই হবে।’
আমার বুক থেকে ভারি বোঝা নেমে গেল। আমি হাঁফ ছেড়ে বললাম, ‘ঠিক আছে দিয়ে দাও। কোন দ্বিধা করো না। পাঁচ হাজার হলে তো অনেক কমই।’
পপি তখন বললো, ‘না পাঁচ হাজার না, ভাই বলেছেন পাঁচ শ’ টাকা।’
আমি লাফ দিয়ে উঠলাম, ‘বলো কি! এ তো আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া! জানো তো না, প্রাইভেট স্কুলে ভতি হতে অনেক সময় লাখ টাকা খরচ করতে হয়।’
মাত্র পাঁচ শ’ টাকা ডোনেশন দিয়ে ফিহা শের-এ-বাংলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেল। প্রথম দিন থেকেই ওকে স্কুলে নিয়ে যেত সালেহা। ওকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে সালেহা বসে থাকতো স্কুলের সামনে। স্কুল ছুটি হলে ফিহাকে নিয়ে বাসায় এসে ওকে গোছল করিয়ে খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতো।
আমাদের আরও সুবিধা হয়েছিলো ফিহার শিফট ছিল সকাল দশটা থেকে বেলা একটা। তাই ফিহার সকালের ঘুমটা একটু নিশ্চিনে- ঘুমাতে পারতো, আর আমরাও নিশ্চিনে- অফিসে যেতে পারতাম। সালেহা ফিহাকে স্কুল থেকে আনার পর অনেকটা সময় পেতো বাড়ির সব কাজ গুছিয়ে রান্না-বান্না করতে। সকালেও ও বাড়ির অনেক কাজ সকালের দিকে নির্বিঘ্নে গুছিয়ে ফেলতে পারতো। সালেহারও সুবিধা হতো ফিহাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার পর সব কাজ সামলে আমাদের রান্নাবান্নাও ও ভালভাবে করতে পারতো। কারোরই কোন অসুবিধা হতো না।
১২
স্কুলের প্রথম শ্রেণী থেকেই ফিহা ক্লাসের তিন কি চার নম্বরের ছাত্র হয়ে গিয়েছিলো। পড়াশুনাতে ফিহাকে কোনদিনই কোন কোচিং করাতে হয়নি। ও নিজের পড়া নিজেই করতে পারতো। আমাদেরকে খুব একটা দেখিয়ে দিতে হতো না। মাঝে মধ্যে দুই একটা লেখা আর একটা-দুটো অংক ওকে বুঝিয়ে দিলেই হয়ে যেতো। ঐটুকু বাচ্চা কিভাবে ক্লাসের পড়া নিজে নিজেই সব বুঝে যেতো ভাবলে অবাক লাগে আমার।
ওর যখন আট-নয় বছর বয়স তখন থেকে আমি বাসায় কম্পিউটার ব্যবহার করি। নানা রকম বাংলা-ইংরেজী কম্পোজের কাজ করি, পাওয়ার পয়েন্টের কাজ করি। আমি যখন কম্পিউটারে নানা রকম কাজ করতাম, তখন ফিহা প্রায়ই আমার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আমার কাজ করা দেখতো। তবে কম্পিউটার খোলা আর বন্ধ করা সহ দুই একটা প্রাথমিক জ্ঞান ওকে দিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে মুখে মুখে ওকে বলতাম, কোন কি-বোর্ডের কি কাজ।
তখন তো আজ-কালকার কম্পিউটারের মতো হরেক রকম বিনোদনধর্মী খেলা আর সফটওয়ার পাওয়া যেত না, কম্পিউটারটা রঙীনও ছিলো না। কম্পিউটার মানে কেবলই কাজের জিনিষ। ওর মতো ছয়-সাত-আট বছর বয়সী শিশুদের আকর্ষণ করার কিছুই ছিলো না সেই সব কম্পিউটারে। অথচ ও কিভাবে যেন জানি না, কম্পিউটারটা চালানো শিখে গেল। শুধু যে শিখলো যে তাই না, অত্যন- ভালোভাবে শিখে গেল যখন ওর নয়-দশ বছর বয়স। বাংলা আর ইংরেজী দুই ভাষার কম্পোজও ও অনায়াসে শিখে গেল। এত ভাল শিখলো যে, আমার অবর্তমানে কোন জরুরী কাজ কম্পিউটারে খুলে বাসায় আসা গ্রাহকের চাহিদা মতো ছোটখাটো সম্পাদনা ও সংস্কার করে প্রিন্ট আউটও দিতে পারতো। বড় ভাইয়ের অনেক কাজই আমার অবর্তমানে ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করে দিতে থাকলো। ধীরে ধীরে সে কম্পিউটারে আরও অনেক বেশী দক্ষতা অর্জন করতে থাকলো।
কম্পিউটারে ওর আগ্রহ দেখে পাড়ার একটা কম্পিউটার ফার্মে ভর্তি করে দিলাম। ও ধীরে ধীরে মাইক্রেসফ্ট অফিসের অন-র্গত সব কটি প্রোগ্রাম শিখলো, ভিজুয়াল বেসিক প্রোগ্রাম শিখলো। ভিজুয়াল বেসিক এত ভাল শিখলো যে ও ওর এক খালাতো ভাইয়ের সাথে করে একটা এইচএসসি ধাপের ইংরেজি গ্রামারের এমসিকিউ ভিত্তিতে চমৎকার ইন্টারএকটিভ প্রোগ্রাম বানালো। ওর ইন্টারভিউ প্রকাশ হলো, বাংলাদেশ টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার প্রচার হলো। সেই সফটওয়ার লোকেরা বাসায় এসে ফ্লপি ডিস্কে করে প্রচুর পরিমানে নিয়ে যেতে থাকলো। আমরা তো ওর এই অদ্ভুত কাজ দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। এত কিছু করার পরও ওর মধ্যে কোন উচ্ছাস, কিংবা কোন গর্ব বা অহঙ্কার দেখা যায়নি। যেন একটা অত্যন- সাধারণ কাজ করেছে ও।
আমার কোন দিনই উচ্চাশা ছিল না বলে ছেলের প্রতি বছরের প্রোগ্রেস রিপোর্টে সব বিষয়ে ওকে পঞ্চাশের উপরে নম্বর পেতে দেখে কোন দিনই ওকে আরও ভাল করতে বা বেশী নম্বর পাওয়ার চেষ্টা করতে বলিনি। যা নম্বর পেয়েছে তাতেই আমি খুশি হয়েছি।
ফিহা কখনই কোন কাজে বা কথায় উচ্ছলতা দেখাতো না। লাফালাফি করা কিংবা দুরন-পনা করা ওর স্বভাবে ছিল না। ঘরের একপাশে ও চুপ করে বসে থাকতো আর গভীর মনোযোগে সব কিছু দেখতো। বাইরে নিয়ে গেলে ও আমাদের সাথে সাথে নিঃশব্দে ঘুরতো পায়ে পায়ে। দীর্ঘ সময় ধরে যখন আমরা কেনা-কাটায় সময় কাটিয়েছি ও সাথে সাথে ঘুরেছে আমাদের সাথে, কখনও বলেনি খিয়ে পেয়েছে, কিংবা তৃষ্ণা পেয়েছে। ও কোন কিছুর জন্যে আবদার করতো না। জীবনে সে একটা খেলনা, জামা বা জুতো বা কোন খাবার বা অন্য কোন কিছু চায়নি।
ওকে কোন কিছু কিনে দিতে গেলে বলতো, ‘লাগবে না, আমার আছে।’ তবে কিছু কিনে দিলে খুব খুশি হলেও এর জন্যে কখনোই উচ্ছলতা প্রকাশ করতো না। একটু লাজুক মিস্টি হাসিতে ওর সারা মুখ ভরে যেতো। ওর এই অভ্যাসটা ওর জীবনের প্রথম দিন পর্যন-ও ছিলো। ও কোনদিনই উচ্চকণ্ঠে হাসতো না। ও কোন উচ্চাশাও প্রকাশ করতো না।
ক্রমে ক্রমে একটা একটা করে বছর পার হয়েছে আর ও একটা একটা করে ক্লাস টপকে পরের ক্লাসে উঠেছে- কোন সময় ও কোন বিষয়ে সত্তরের ঘরের নম্বর ছাড়া কম পায়নি। ক্লাস সিক্স পর্যন- আমাদের সেই কাজের মেয়েটাই ওকে স্কুলে আনা-নেওয়া করতো। সমস- সময়টা স্কুলের সামনে বসে থাকতো। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর ফিহা যখন প্রাইমারী সেকশন থেকে আগরগাঁওয়ের মোড়ের বড় মাধ্যমিক স্কুলে ভতি হয়ে গেল, তখন থেকে ও একা একাই স্কুলে যাওয়া আরম্ভ করলো। আমি কিংবা পপি এক দিনের জন্যেও ওর প্রাইমারী স্কুলে কিংবা হাই স্কুলে যইনি। ওর স্কুলের শিক্ষকরা ফিহার অভিভাবকদের দেখেনি। ও নিজেই নিজের ভর্তি ফি, মাসিক ফি, পরীক্ষার ফি সব কিছু দিতো। বাড়িতে সন্ধ্যবেলা ও বলতো পর দিন স্কুলে কত টাকা কোন খাতে লাগবে। আমি কিংবা পপি টাকাটা গুছিয়ে ওকে দিলে ও নিজেই এ সব কাজ করতো। এমন কি ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করা, পরীক্ষার প্রস’তি নেওয়া, পরীক্ষা দেওয়া সব ও একাই করেছে। আমাদের কোন সাহায্য নেয়নি। খালি বলেছে বৃত্তি পরীক্ষার একটা গাইড কিনে দিতে। ক্লাসের বইপত্র কিংবা খাতাপত্র ও নিজেই কিনতো আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে। কিভাবে যেন ফিহা এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে গেল।
এ সময়েই পড়ার চাপ আর বইপত্রের জটিলতা বুঝতে পেরে আমরা একজন টিচার রেখে দিয়েছিলাম ওকে গাইড করার জন্যে। বিশেষ করে বিজ্ঞান আর অংকটা ও ছোটবেলা থেকে একটু ভয় পেতো, ঠিক ভালোভাবে বুঝতো না। কখনও কখনও দুই একটা বিষয়ে নম্বর কম পেলে আমার চেয়ে ওর মুখটাই বেশী বিষণ্ন হয়ে থাকতো।
প্রোগ্রেস রিপোর্টের কার্ডটা আমার সামনে এগিয়ে দেয়ার সময় ওর মুখটা সঙ্কোচে আরও বেশী মলিন হয়ে থাকতো। আমি কিন’ কখনো ওর কম নম্বর পাওয়া নিয়ে অসস’ষ্ট বা রাগ হতাম না। বরাবরই ওকে উৎসাহ দিতাম। কোন বিষয়ে কম নম্বর পেলে শুধু বলতাম, ‘সামনের বারে আর একটু ভাল করতে হবে, কেমন, পারবি না?’ ও কোন উত্তর করতো না।
বড় হওয়ার পর ও যা কিছু চাইতো সবই ওর পড়াশুনাকেন্দ্রীক-পরের ক্লাসে ভর্তি ফি কিংবা পরীক্ষার ফি, ফ্রেঞ্চ কোর্স করার খরচ, ডেমোক্রেসি ওয়াচের একটা কোর্স করবে, এই রকম কিছু- তা-ও দুই-তিন কিংবা বড়জোর চার হাজার টাকা। সব মিলিয়ে দশ হাজার টাকাও সারা বছরে কোন দিন চায়নি ও। আর এই চাওয়ার ব্যাপারটাই ওর কাছে একটু যেন বিব্রতকর ব্যাপার ছিলো। মনে হয় ও সব সময় মনে করতো আমরা ওর জন্যে ঐ পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে সক্ষম হবো না। এই অসি’তিশীল মনোভাব ও সারা জীবনে কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
২০০১ সাল থেকে তো ফিহা আরও একটু বেশী স্বাবলম্বী হয়ে উঠলো যখন ওর ফুফু তার বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর সব ভাতিজাদের মতো ওকেও এক ল টাকা উপহার দিলো। ছেলে আমার সে টাকা ব্যাংকে জমিয়ে রেখে তার থেকে পাওয়া লভ্যাংশ দিয়েই হাত খরচ চালাতো। টাকা দিতে গেলে বললো, ‘লাগবে না। আছে আমার কাছে।’ ওর সাথে কোথাও বের হলে আমিই বরং বিপদে পড়তাম, ও কখনও আমাকে বাস কিংবা ট্যাক্সি ভাড়া দিতে দিতো না।
ওর জন্মের পর ওকে ওর মায়ের পাশে শুইয়ে দিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যে সকালের অপেক্ষা আমি করেছিলাম। আমার সেই আসল সকাল আর আমার জীবনে এলো না।