৬ সমরখন্দ
১
বাবরের সৈন্যদল সমরখন্দ অবরোধ করে রইল সারা গ্রীষ্ম ও শরৎকাল। গোটা সাতমাস ধরে বাইসুনকুর শহরের তোরণদ্বার বন্ধ রেখেছে। শেষে ক্ষুধা এবং অন্যান্য যে দুঃখকষ্ট সহ্য করছিল সমরখন্দবাসীরা সেসব দৃশ্য আর সহ্য করতে না পেরে বাইসুনকুর শীতের এক হিমজর্জর রাতে গোপনে শহর ছেড়ে পালালো এবং তার আত্মীয়পরিজন আর বিশ্বস্ত লোকেরাও দলে দলে পালালো হিসারের দিকে। সমরখন্দের বেগরা যখন তাদের শাসকের পলায়নের কথা জানতে পারল তখনি শহরের তোরণদ্বার খুলে দিতে আদেশ দিল।
বাবরের অস্ত্রশস্ত্রসজ্জিত তিনহাজারের বেশী সৈন্য- সমরখন্দের দিকে পরিচালিত বিশাল জনসমুদ্রের এক অংশ ঢাকের সানাইয়ের জোর আওয়াজের তালে তালে শহরে এসে ঢুকলো। পাঁচ বছর বয়সে বাবর প্রথম এই অপূর্ব দেশটি দেখেন- আর এখন, এই দ্বিতীয় বার। সমরখন্দের কোথায় কি তা তার ভাল মনে নেই। চোখের সামনে আকাশে নীল হিমবাহের মত ভেসে বেড়াচ্ছে অপূর্ব গম্বুজগুলি। বাবর কাসিম বেগকে নিয়ে বিবি খানুমের মাদ্রাসার সামনে থামলেন। কেল্লার দেয়াল বরাবর সৈন্যদল দাঁড়িয়ে পড়েছে, বাবর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছেন গোর-এ-আমীরের অপূর্ব সুন্দর গম্বুজ। এ হল তার মহান পূর্বপুরুষদের সমাধি। তাদের কথা শুনে শুনেই তারও যশলাভের আকাঙ্খা হয়। এই গম্বুজটা তিনি নিজেই চিনতে পারলেন কেউ বলে দেবার আগেই। সমাধিসৌধটির শোভা আর তার নিখুঁত অলঙ্করণ বাবরকে চমৎকৃত করল।
যে টিলাটার ওপরে শহরের কেল্লাটা তৈরী হয়েছিল সেখান থেকে বাবর একসঙ্গে দেখতে পেলেন শহরের বারান্দাসমেত বাড়ীগুলি। রাস্তা আর গলির সারি। এসব দেখতে দেখতে হঠাৎ তার মনে হল তার বাগদত্তাও এখন এই অগুনি- বাড়ীগুলির কোন একটির জানলার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে, বিজেতার দিকে। বেচারী বন্দীজীবনের দুর্দশা থেকে রেহাই পেল, তার অপেক্ষায় আছে। তবে এত যোদ্ধার মাঝে তাকে চিনতে পারবে তো সে?
ঘোড়াকে ধাক্কা দিয়ে বাবর কাসিম বেগের কাছে এগিয়ে গেলেন, ‘বন্দীদের সম্বন্ধে জানতে কাউকে পাঠিয়েছেন?’
এই প্রশ্নের গোপন অর্থ কাসিম বেগ সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল না।
‘কোন্ বন্দীদের কথা বলছেন, হুজুরে আলী?’
বাবর কাসিম বেগকে তার বাগদত্তার কথা মনে করিয়ে দিতে লজ্জা পেলেন (বয়সে তার বাবার সমান)। অদ্ভুত লজ্জা পেয়ে গেলেন, চোখ নামিয়ে নিলেন। কাসিম বেগ আন্দাজ করলেন, ‘ও বন্দী… বন্দিনী! বন্দিনী!’ বাবরের জিভের ডগায় আটকে যাওয়া কথাটা উচ্চারণ করলো সে। ‘আপনার নুয়ান কুকলদাসকে পাঠিয়েছি সুলতান আহমদের মেয়ের খবর জানতে। সন্ধ্যানাগাদ খবর পাবেন, হুজুর আলী।’
কেল্লার ভিতরে গিয়ে ঢুকলেন তারা- তার ভেতরে সর্ববৃহৎ যে সৌধটি তা হল চারতলাবিশিষ্ট নীল প্রাসাদ- কোক-সরাই। এই কোক-সরাইয়ে অনেক শাহেরই মৃত্যু হয়েছে, স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক দু’ধরণেরই মৃত্যু, প্রাসাদটি বহুদিন ধরেই লোকের মনে ভয় জাগায়, তাই সমরখন্দের শেষ কয়েকজন শাসক সেখানে আর থাকতেন না। ‘কোকতাশে’ আরোহণ অনুষ্ঠান হবার পরেই প্রাসাদ ছেড়ে যেতেন। বাবরও কেল্লার ডানদিকে, বুস্তান-সরাই প্রাসাদে থাকার সিন্ধান্ত নিলেন।
যখন সন্ধ্যাবেলার বুস্তান-সরাইয়ে বাতি জ্বালা হলো, তখন বাবরের জন্য নির্দিষ্ট শয়নকক্ষে নুয়ান এসে ঢুকল। সারা ঘরটা গিলটি করা সোনায় সাজানো, কিন’ ভীষণ ঠান্ডা ঘরটিতে। অনেক কম্বলের আসন এনে পাতা হয়েছে তবুও গরম পোশাক ও টুপি পরেই কথাবার্তা বলতে হচ্ছে।
নুয়ান কুকলদাসের গলা ক্রমশ উষ্ণ, স্বাভাবিক হয়ে এল। যে দিন থেকে বাবর শাসক হয়েছেন সেদিন থেকে নুয়ানের মত সমবয়সী সহচররা অনেক পিছনে পড়ে গেছে, বাদশাহ্কে ঘিরে থাকে বেগরা, বন্ধুরা নয়, এই নিয়ম। কিন’ আজ বাবর ও নুয়ান আবার কাছাকাছি হয়েছেন- এতে দু’জনেরই আনন্দ। নুয়ান উত্তেজিত হয়ে বলে চলেছে, ‘বাদশাহের তরফ থেকে… আমরা দিয়ে এলাম, সোনার কঙ্কণ, নানা ধরনের জামাকাপড়, আর খুবানী ও বাদামের মিঠাই। আপনার বড় খালাজান মেহের নিগর-খানম নিজে এসে অভ্যর্থনা জানালেন…’
মেহের নিগর-খানম হলেন কুতলুগ নিগর-খানমের বড় বোন আর মরহুম সুলতান আহমদের বড় বেগম। আয়ষা বেগমের মা অল্প বয়সেই মারা যান, মেহের নিগর-খানমের কোন সন্তান না থাকায় তিনি মেয়েটিকে নিয়ে মানুষ করেন, এখনও তিনি নিজের মায়ের মতই তার দেখাশোনা করেন। বাবরের ভাবতে মজা লাগল: বেশ হল- খালা আর শাশুড়ী দুই-ই হবে।
‘চেহারা কী খারাপ হয়ে গেছে,’ টেনে টেনে বলল নুয়ান, ‘খিদেয় কষ্ট পেয়েছে ওঁরা দারুণ, অনেকদিন রুটি দেখেন নি। সোনা ফেলেও আটা জোগাড় করা যায় নি কোথাও, খানম একথা বললেন। কাঁদছিলেন, খুব কাঁদছিলেন। বললেন, ভূষির রুটি খেয়ে থেকেছেন। আগুন জ্বালাবার কাঠ নেই, শীতে কাঁপছে। বাইসুনকুর মেয়েদের প্রতিও এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন নাকি?
‘মির্জা বাইসুনকুর নিজেও শেষ ক’দিন পেটভরে খেতে পাননি।…সাতমাস অবরোধে বসে থাকা, তামাসা নাকি! রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে আছে। অকাল পড়েছে, অকাল। বেচারীরা গাধাকুকুরের মাংস খেয়েছে আমরা তো এত সব কথা জানতাম না.,..
ওদের ওখান থেকে ফিরে কাসিম বেগকে সংক্ষেপে সব কথা বললাম। এক গাড়ী আটা-ময়দা আর চাল, একগাড়ী কাঠ, দশটা ভেড়া এসব আমি নিজে নিয়ে গিয়ে খানমকে দিয়ে আসি। তারপরেই কেবল আমার এখানে আসার অনুমতি মিললো।’
নুয়ান কুকদাস কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল, রহস্যভরা মৃদু হাসি একটু দেখা গেল তার মুখে, এবার আয়ষা বেগমের কথা বলবে, বাবর অধৈর্য হয়ে হাত নাড়িয়ে বললেন, ‘বল, নুয়ান, বল…’
সোনা দিয়ে সাজান এই ঘরটার মতই একটা ঘর, নুয়ান ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘সফেদ জালিদার পরে সামনে এলেন আয়ষা বেগম,’ আবার থামল নুয়ান। সত্যি বলতে কি আয়ষা বেগমকে তার পছন্দ হয় নি, মুখ ঢাকা থাকায় দেখতে পায় নি সে, কিন’ দেহটা ভীষণ ছোটখাট, রোগা, ক্ষীণদেহী একেবারে- একেবারেই…. রোগা বলে মনে হল। ‘সুস্বাগতম! বললেন আমায়! গলার স্বর এত কোমল, মিষ্টি, পরিষ্কার।’
এ মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়, ভাবলেন বাবর। আয়ষা বেগমের কথা মনে করে তিনি আন্দিজান থেকে এখানে ছুটে এসেছেন, কিন’ তাকে সঙ্গে সঙ্গে দেখার উপায় নেই। তাদের দেখা হওয়া নিয়মবিরুদ্ধ, নিন্দা ছড়াবে তাহলে, তার অধীরতায় তিনি তার আপনজন এই মেয়েটির মনে কষ্ট দিতে পারেন।
নুয়ান কুকলদাসের মুখে পড়া যাচ্ছে যে তার কাছ আছে এই অযৌক্তিকতার ঔষধ। নুয়ান জামার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বার করে আনল সাদা রেশমের ছোট্ট একটা তামাকের থলি।
‘আয়ষা বেগমের পক্ষ থেকে মেহর নিগর-খানম এই থলিটি দিয়েছেন।’
বাবর থলিটি হাতে নিয়ে চেপে দেখলেন। মনে হচ্ছে যেন কিছু নেই, কিন’ যখন তিনি থলিটির গলায় বাঁধা দড়িটি ঢিলে করে হাতের ওপর উপুর করে দিলেন সেটি, দুটি ছোট হীরা গড়িয়ে পড়লো তার হাতের ওপর। দুটি হীরাই ভোরের শিশিরকণার চেয়ে সামান্য বড়, কিন’ সে তুলনায় বেশ ভারী। ঝকঝক করছে হীরাগুলি- কোমল ও উজ্জ্বল তাদের দ্যুতি।
‘থলেটার ভিতরটা উল্টো করে দেখুন।’ বলল নুয়ান।
সুন্দর সুন্দর পুঁতি লাগানো ছিল থলিটির উপর আর ভিতর দিকে লাল রেশমীসুতো দিয়ে সেলাই করা ছিল একটি কথা যা বাবর প্রথমে লক্ষ্য করেন নি। একটাই কথা, কিন’ কি মিষ্টি! ‘উদ্ধারকর্তাকে’, একটি কথাই বাবরের কাছে মনে হল প্রেমের কবিতার চেয়েও মিষ্টি। তার মানে এটি আয়ষা বেগম আগেই সেলাই করে রেখেছিলেন, নুয়ানের সামনেই তো এমন সেলাই করতে পারেন না। তাহলে তিনি এই বিশ্বাস নিয়ে ছিলেন যে বাবর এসে তাকে উদ্ধার করবে।
‘মির্জা, যে হীরাগুলো আপনি হাতে ধরে আছেন তাদের ইতিহাস শুনুন,’ সরলভাবে বলে চলল নুয়ান। ‘জানেন কোথা থেকে এই হীরাদুটো পাওয়া যায়? সুলতান আহমদ যখন সমরখন্দের তখ্তে বসে ছিলেন তখন তার উষ্ণীষে শোভা পেত হীরাদুটি। … তার কন্যার ইচ্ছা এই হীরাদুটি আপনার সঙ্গে আবার সমরখন্দের সিংহাসনের শোভা বাড়াক। মির্জা, ওদুটো আপনার মাথায় শোভা পাবে আরো একশ’ বছর।’
সুলতান আহমদ নাম শুনে বাবরের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল: এই তো সেদিন সে বেঁচে ছিল, বাবরকে পরাজিত করে, তার সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করতে হয় বাবরকে। পরাজয়ের পরে সন্ধি। কিন’ হীরাদুটি থেকে এমন স্বচ্ছ আলো ফুটে বেরোচ্ছে যে মনে হচ্ছে যেন সেই রশ্মি কনেবধুর চোখের আলোর ঝিকিমিকি। কনেবধু তার অপেক্ষায় আছেন!… তাছাড়া- তিনি তো জয়লাভও করেছেন।
‘আয়ষা বেগমের যা ইচ্ছা তাই হবে!’ বলে বাবর হাতে তালি দিয়ে ডাকলেন তার তোশাখানার তত্ত্ববধানকারীকে।
লোকটি হীরাদুটি সেলাই করে চমৎকারভাবে বসিয়ে দিল সেই উষ্ণীষটিতে যেটি বাবর সাধারণত উৎসব-অনুষ্ঠানে পরেন…
সেইদিন সন্ধ্যায় বাবর তার না-দেখা প্রেমিকা ও বাগদত্তাকে দেখবার অদম্য ইচ্ছায় পুড়তে পুড়তে গজল লিখতে আরম্ভ করলেন,
চন্দ্রাবদনা, তোমার রূপের কত কথা বলে লোকে”
কবে যে জীবন সার্থক হবে দর্শনে নিজ চোখে…
২
শীতের ঠান্ডা হাওয়া হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। শৃঙ্খলাবদ্ধ বন্দীদের তাড়িয়ে আনা হয়েছে সমরখন্দের রেগিস্তান চকে, শহরের কাজী তাদের কী বিচার করেন তা শোনার জন্য, ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক জড়িয়ে শীতে কাঁপছে তারা।
বিশ্বাসযোগ্য কর্মচারীরা প্রমাণ করেছে, এরা গুরুতর অপরাধে- প্রতারণার অপরাধে অপরাধী। সমরখন্দ অবরোধের সময় তারা বাবরের কাছে এই প্রস্তাব দিয়ে লোক পাঠিয়েছিল, রাতের বেলায় সমরখন্দের ফিরোজা দরওয়াজার কাছে আসুন, আমরা দরজা খুলে দেব। দশজন বাহাদুর সিপাহী যেই ফিরোজা দরওয়াজার কাছে গোরি আশিকানের কাছে গিয়ে পাঁচিলে উঠতে আরম্ভ করেছে, অমনি ওরা ওদের ধরে বাইসুনকুরের সিপাহসালারের হাতে তুলে দেয়।
‘আমরা না, আমরা না… যারা আপনাদের সিপাহীদের ধরিয়ে দিয়েছে তারা পালিয়েছে।’ আতঙ্ক দমন করে অপরাধীদের একজন চীৎকার করে বলল। কিন’ তার কথায় কেউ কান দিল না।
শাহী ফরমান অনুযায়ী এবং দুশমনদের শাসি- দেবার যে পদ্ধতি অবলম্বন করতেন পূর্বপুরুষরা, সে অনুযায়ী জল্লাদ অপরাধীদের হাত পিছমোড়া করে বেঁধে একজন একজন করে নিয়ে চলল এই উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে খোড়া গর্তগুলির কাছে, জোর করে তাদের বসিয়ে দিতে লাগল নতজানু হয়ে, মাথা নীচু করে। ঘাড়ের ওপর তরবারির এক আঘাতে দন্ডিতদের গরম রক্ত পড়ছিলো চকের পাথরের ওপর, ঠান্ডায় গরম রক্ত পড়ে উষ্ণ বাষ্প উঠছিল।
গর্তটা বুুঁজিয়ে দেওয়া হয়। সারারাত ধরে পড়তে থাকা তুষার চোখধাঁধান সাদা চাদরে ঢেকে দিলো এই মৃত্যুদন্ডের সমস্ত চিহ্ন।
পরের দিন দুপুরের দিকে ঠান্ডা একটু কমল, নীল গম্বুজের ওপর তুষার গলতে আরম্ভ করলো।
জোহরের নামাজের পর মির্জা বাবর ঘোড়ায় চড়ে সমরখন্দের দোকানপাট দেখতে বেরোলেন। তার পাশে পাশে চলছে- কাসিম বেগ, তার পিছনে একটু দূরে আহমদ তনবাল আর খান কুলি নামে আরেক জন বেগ, কয়েকজন সিপাহী। তাদের সঙ্গে চলেছিলেন সমরখন্দের বৃদ্ধ কবি জওহরী যিনি সমরখন্দের কোথায় কী ভাল জানেন।
তারা পেরিয়ে গেলেন পথিক পর্যটনকারীদের আবাস খানকাহ। উলুগ বেগের সময়ে এর ওপরে বিরাট গম্বুজ তৈরী করা হয়। জওহরী একটা রাস্তা দেখালেন যেটা গেছে পুব দরওয়াজার দিকে।
মির আলিশের যখন সমরখন্দে আসতেন, তখন অনেকবার গেছেন এই রাস্তা দিয়ে। এই রাস্তার শেষে এখনও দাঁড়িয়ে আছে সেই বাড়িটি যেটিতে মির আলি শেরের ওস্তাদ আবদুল্লাহ কাজ করতেন।
মির আলিশেরের আলোচনাসভায় থেকেছেন আপনি?’ বাবর জিজ্ঞাসা করলেন।
হ্যাঁ, আমরা দু’জন সমবয়সী, কিন’ তাকে আমি আমার ওস্তাদ বলে মনে করি। তাকে আমার কবিতা পড়ে শুনিয়েছি, তিনি সর্বদা আমাকে উপদেশ দিতেন। উনি কিন’ আমায় ভুলে যান নি, তার প্রখ্যাত সৃষ্টি মজালিস্তউন্তনফাইস এ তিনি এই অধমের নামও উল্লেখ করেছেন।’
সাদাদাড়ি জওহরীর (তার ভ্রুগুলিও সাদা হয়ে গেছে) প্রতি কিঞ্চিৎ ঈর্ষা হল বাবরের। বাবর যদি অমন কবি হতে পারতেন যিনি নবাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কবিতাছন্দ নিয়ে একটু নাড়াচাড়ার বেশী আর কিছু হল না তার, আর যা লেখেন তাও অন্যদের দেখাতে সঙ্কোচ বোধ করেন। এই হল ব্যাপার, তবুও কবি হবার আশা ছাড়ব না আমি, সেই কারণেই আজ, একটু হাসলেন বাবর, সঙ্গে সমরখন্দের প্রতিপত্তিশালী বেগদের নিই নি, নিয়েছি এই বৃদ্ধ কবিকে যিনি আলিশের নবাইয়ের সমবয়সী, তার সঙ্গে কথাবার্তা করেছেন।
জওহরী তাদের নিয়ে গেলেন রুটিওয়ালাদের মহল্লায়। রাস্তাঘাট খাঁ খাঁ করছে। রাস্তায় জমে থাকা বরফের ওপরে এখনও কারো পা পড়ে নি, কোন কোন খানে বরফ জমা এত উঁচু হয়ে উঠেছে যে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা লোকেদের জুতো ঠেকে যাচ্ছে বরফে। ছায়ায় ঠান্ডা হাওয়া যেন পুড়িয়ে দিচ্ছে মুখ, কিন’ যেখানে বাড়ীগুলির পাঁচিল বা দেওয়ালের কাছে রোদ পড়েছে সেখানে বরফগলা জল জমা হয়েছে।
নীচু নীচু বাড়ীগুলির সমান ছাদগুলি লক্ষ্য করলেন বাবর। সেগুলির ওপর থেকেও বরফ সারিয়ে ফেলা হয় নি। একজন লোকও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। রুটির দোকানগুলির দিকে এগিয়ে চললেন তারা। সেখানেও একই অবস্থা, সব দোকান বন্ধ। বাবরের বিস্ময় আরো বেড়েই চলল, ‘আচ্ছা মওলানা, রুটিওয়ালারা অন্য শহরে চলে গেছে নাকি?’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জওহরী, ‘হুজুরে আলী, তিনমাস ধরে বাজারে রুটি আসছে না। আটা নেই। ঘেরাওয়ের সময় এদের অনেকে মরেছে না খেয়ে। লোকেরা একেবারে নির্জীব হয়ে পড়েছে। ছাদে উঠে বরফ পরিষ্কার করার মত অবস্থা নেই।’
বাবরের মনে হল যেন এই দুর্ভাগ্যের জন্য জওহরী বাবরকে খোঁটা দিলেন। কাসিম বেগের দিকে তাকালেন বাবর যেমন সবসময় তাকান সমর্থনের আশায় অথবা না বলা প্রশ্নের উত্তর চেয়ে। কাসিম বেগ ভর্ৎসনার সুুরে কবিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তবুও হয়তো কিছু রুটিওয়ালা এখনও বেঁচে আছে, কী বলেন মওলানা?’
আছে ,আছে … বেঁচে আছে হয়ত। কিন’ তাদের যাহায্য করা দরকার। এখন যদি বাদশাহের হুকুম হতো ওদের আটা দিতে… তাহলে হয়ত দোকানপাট খুলতো, আর লোকেরা সমরখন্দের বিখ্যাত রুটি খেতে পেত…
কাসিম বেগ দেখল, বাবর অবিলম্বে তা করতে প্রস্থত।
‘হুজুরে আলী, আমাদের নিজেদেরই সামান্য দানা আছে, আর সৈন্যদের জন্য রসদ প্রয়োজন। বিক্রী করার জন্য আটা দেবার মত সংস্থান নেই। পরে দেওয়া যাবে হয়ত…’
বৃদ্ধ কবি আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন বাবরের দিকে। বৃদ্ধের হাড় বার করা কাঁধে কালো কাপড়ের চোগার জন্য নাকি, জওহরীর ছোট করে ছাটা দাড়ির জন্য কে জানে কবির চেহারা বাবরকে মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল মাহ্মুদ মুজাহবের তৈরী নবাইয়ের প্রতিকৃতির কথা। যদি বাবর মওলানা জওহরীর আশা পূরণ করতে সক্ষম না হন তার মানে নবাইয়ের আশানুযায়ী কাজও তিনি করতে পারবেন না। রেকাবে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে কর্তৃত্বব্যঞ্জক সুরে বাবর বললেন, ‘দানা ও আটা দিতে আদেশ করছি ব্যবসায়ীদের নয়, রুটিওয়ালাদের একজন বিশ্বস্ত লোক এর দেখাশোনা করুক। রুটিওয়ালারা রুটি তৈরী করে আমাদের নামে বিতরণ করুক সব থেকে যারা কষ্ট পাচ্ছে ক্ষুধায় তাদের মধ্যে। পাঁচ-ছয় বস্তা নিলে ফৌজের রসদে টান পড়বে না। কাল অথবা পরশু জিজাক থেকে দানা নিয়ে এসে পৌঁছবে কারাভান।’
‘খোদা আপনার মঙ্গল করুন, হুজুরে আলী!’ আনন্দিত হয়ে বললেন জওহরী।
আনন্দিত হলেন কিন’ তিনি একাই। আহমদ তনবাল তার শক্তিমান স্বাস্থ্যবান ঘোড়ার লাগাম টেনে বেশ শুনিয়েই গজগজ করল, ‘এত আটা কোথায় পাওয়া যাবে যে বাইসুনকুরের ফেলে যাওয়া এত ক্ষুধার্ত লোকের ক্ষুধা মেটান যাবে? আমরা তো এখানে ওদের খাওয়াতে আসি নি।’
ওশে পাঠান ঘটকেরা বাবরের কাছ থেকে শূন্যহাতে ফিরে আসায়, খানজাদা বেগমকে স্ত্রী হিসেবে না পাওয়ায় আহমদ তনবাল গোপনে বাবরের বিরুদ্ধে কার্যকলাপ আরম্ভ করে। কিন’ বাবরের প্রতি আক্রোশ ঢাকার চেষ্টা করে আমার বেনজীর হুজুরে আলী, প্রভৃতি মনভোলান কথা দিয়ে।
‘খুদাবন্দ বেগ’, বাবর আরো উদ্ধত ভঙ্গীতে সোজা হয়ে বসলেন ঘোড়ায়। আমরা সমরখন্দকে খাওয়াবার জন্য আসি নি ঠিকই, কিন’ আমরা তাকে লুঠ করতেও আসি নি।’
তনবাল এই ইঙ্গিতে ভয় পেয়ে গেল- গতকাল তার লোকরা জহুরীর দোকান ভেঙেছে। বেগের চোখ গোল হয়ে গেল, কিন’ তখুনি আবার নিরুদ্বেগ ভাব আনার চেষ্টা করল মুখে।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন, আমার আজীম, বেনজীর হুজুরে আলী,’ বলল সে। ‘কিন’ আমি জিজ্ঞেস করতে চাই এই শহরে লড়াইয়ের সময়কার কিছু শিকার পাওয়ার হক আছে কিনা আমাদের- এরই জন্য না এত সিপাহী কুরবান দিলাম আমরা? লুঠের মাল নেওয়ার অধিকার বিজেতার আছে, এ আমাদের পুরানো রেওয়াজ।’
তনবালের ভাল লাগল সৈন্যদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা খান কুলির- তার মাথা নাড়াতে, হাসিতেই তা বোঝা যাচ্ছে। বেশীর ভাগ সিপাহীরই তনবালের কথা ঠিক বলে মনে হল। যদি সব বেগই এমন ভাগ না পায় যাতে তারা সন’ষ্ট হতে পারে, তাহলে সমরখন্দ বিজেতা সাধারণ সিপাহীদের হাতে আর কীই না আসবে? অথচ জয় করা হল সমরখন্দ- কোন একটা ছোটখাটো গ্রাম নয়।’
বাবর জানতেন তার সৈন্যদলে অনেকে অসন’ষ্ট। কিন’ বেগদের ইচ্ছামতো কাজ করতে দিলে সমরখন্দবাসী অনাহারে মারা যাবে। কিন’ এরা তো তার প্রজা, এখন তারই প্রজা। অথচ এদের অনাহারে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে গেলে তার বেগ আর যোদ্ধারা চীৎকার করবে, ওদের কেন দেওয়া হচ্ছে আমাদের ভাগ?
বাবর কাসিম বেগের দিকে তাকালেন। উজীর যেন অন্যসনস্কভাবে অন্যদিকে তাকিয়েছিলেন।
‘অনাহারের কারণ তো কেবল বাইনসুনকুর নয়, ঠিক কিনা?’ নরম সুরে বাবর বললেন। ‘যদি আমরা সাতমাস সমরখন্দ অবরোধ না করতাম…’
বাবর ঘৃণ্য তনবালের সামনে কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করেন কাসিম বেগের তা ভাল লাগলো না। উজীর একমাত্র উপায় দেখল এ কথাবার্তা বন্ধ করে দেওয়ার, ‘হুজুরে আলীর হুকুম আমাদের কাছে আইন! তর্ক করার প্রয়োজন নেই। কালই রুটি তৈরীর জন্য ময়দা দেওয়া হবে, আমি নিজে ক্ষুধার্তদের মধ্যে রুটি বিতরণের তদারক করবো।’
বাবর উজীরের দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালেন।
‘যাক, এব্যাপারে ফয়সালা হলো,’ বললেন তিনি নিশ্চিন্তসুরে। তারপর কবির দিকে ফিরে বললেন, ‘চলুন এবার বইয়ের দোকানগুলো দেখা যাক।’
মওলানা জওহরী আঁকাবাঁকা অলিগলি দিয়ে নিয়ে বললেন তাদের। হঠাৎ তারা এসে পড়লেন একটা খেলামেলা জায়াগার সামনে যেখানে বইয়ের দোকানের সারির সবগুলি দোকানই বন্ধ। হঠাৎ একটা গোলমাল, কী এক দুর্বোধ্য চীৎকার শোনা গেল, দোকানগুলির পিছন থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল এক বৃদ্ধা মাথায় কোন ওড়না নেই, খালি-পা, চোখে উম্মাদদৃষ্টি, আর তার পিছনে মধ্যবয়সী কৃশদেহী এক পুরুষ।
‘হায়! আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলল, মরণ হোক আমার।’
অশ্বারোহীদের দলটিকে দেখে বৃদ্ধ ও পুরুষমানুষটি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পুরুষমানুষটি কিছুতেই তার হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছে না, মহিলাটি কিন’ আবার চীৎকার করে শাপশাপান্ত করতে লাগল। ‘খোদা নিজেই মারুক ঘেরাও করে! মরুক না খেতে পেয়ে আমার ছেলের মতই। মরুক।
মোল্লা কুতুব উদ্দিন, কি হয়েছে?’ চেঁচিয়ে জওহরী জিজ্ঞাসা করলেন পুরুষ মানুষটিকে। এতক্ষণে সে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ছুটে এসে, দুর্বল, ক্ষীণদেহী বৃদ্ধাটির হাত ধরে সহজেই টেনে নিয়ে গেল দোকানের পিছনে বাড়ীর আঙ্গিনার মধ্যে। তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে বুকের ওপর হাত জোড় করে ঘোড়ওয়ারদের কাছে ফিরে এলো।
‘মাফ করবেন, হুজুর মাফ করবেন আমায়। সন্তানের মৃত্যুতে আমার ভাইয়ের স্ত্রীর মাথার গোলমাল হয়ে গেছে। না খেয়ে থাকতে হয়েছে আমাদের। খিদের জ্বালা সইতে না পেরে আমার ভাইপো খইল খায়, তাতে সারা শরীর ফুলে ওঠে, মারা যায়।’
শ্বাসরোধকারী নিস্তব্ধতা নেমে এল।
এই হতভাগ্য লোকগুলোকে আরো কষ্টে ফেলতে চায়, লুঠপাটের কথা ভাবা হচ্ছে আবার। কারোর দিকেই তাকালেন না বাবর। কিন’ আহমদ জওহরী তাকে চুপিচুপি বললেন তার কাছে কে এসেছেন, কী জন্যে এসেছেন, মোল্লা কুতুবুদ্দিন ব্যস্ত হয়ে দোকান খুললেন তাড়াতাড়ি। ঘোড়া থেকে নামলেন বাবর, মওলানার সঙ্গে গিয়ে ঢুকলেন দোকানের ভিতর। দোকানী ধীরেসুসে’ তাক থেকে নামিয়ে আনতে থাকে দুষপ্র্রাপ্য বইগুলি, দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ধুলো মুছতে থাকে। বাবরের দিকে এগিয়ে দেয় বইগুলি, সেগুলির সম্পর্কে অল্প দু’চার কথা বলে। … দামী সোনার জলে কাজ করা মলাটে মাহমুদ কাশগরী আর আবদুর রহমান জামীর বই।.. এখানে নানা রকমের আঁকা ছবিসমেত আবদুর রজ্জাক সমরখন্দীর বই।…. আর এ হল আরুজের ওপর নবাইয়ের লেখা ‘মেজান-উল-ওজান’। এই বইটাই বহুদিন ধরে খুঁজছেন বাবর, সবাইকে জিজ্ঞাসা করেছেন কোথায় কেনা যায় বইটি। এখানে তিনি দেখতে পেলেন এমন অনেক বই যা তার গ্রন’গারের শোভা বাড়াবে, যাদের মূল্য তার কাছে সোনাদানার থেকেও অনেক বেশী। ধুলোভরা এই দোকানঘরে বাবরের মনে হল তিনি যেন রূপকথার গল্পের গুপ্তধনের গুহায় পৌঁছে গেছেন।
‘আর কী আছে? আর কী?’ উত্তেজিত হয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন।
মোল্লা কুতুব উদ্দিন একটার পর একটা অমূল্য বই দেখিয়ে যেতে থাকল তাকে। কাসিম বেগও মওলানার পিছন পিছন ভিতরে চলে এসেছেন সবার অলক্ষ্যে, ভাল করেই জানেন তিনি দক্ষ লিপিকরের হাতে লেখা, সূক্ষ্ম অলঙ্করণে ভূষিত এই গ্রন’গুলির কত দাম হতে পারে। সমরখন্দের ধনভান্ডার শূন্য, তিনি তা আগে থেকেই অনুমান করেছিলেন, আন্দিজান থেকে সে সোনা তারা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন তা এমন কিছু বেশী নয়, আর অভিযানে সোনা সঙ্গে করে আনা হয়েছে বইপত্র কেনার জন্য নয়। এদিকে বাবরের নির্বাচিত বইয়ের স্তূপটা ক্রমশ বড় হয়ে চলেছে- গোটাদশেকের বেশীই হবে। কাসিমবেগ তার কানের কাছে বলল, ‘হুজুরে আলী, আমাদের সঙ্গে খাজাঞ্চী নেই।’
বাবর সেকথার অর্থ ঠিক ধরতে পারলেন না, তখন তিনি বিচরণ করছেন কেবল বইয়ের জগতে, বহির্জগতের অসি-ত্ব ভুলে গেছেন।
‘খাজাঞ্চী? খাজাঞ্চীকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে,’ বলে বইয়ের দোকানীকে তার বেছে নেওয়া বইগুলি দেখিয়ে বললেন, ‘হিসাব করবেন, আমার গ্রন’াগারের রক্ষণাবেক্ষণকারী আর খাজাঞ্চী এসে দাম দিয়ে নিয়ে যাবে এগুলি।’
যার উদারতা এবং আরো অনেক অনেক গুণের কথা সবাই জানে সেই সমরখন্দের শাসকের সেবা করতে পেরে যে খুশি হয়েছে তা জানাবার জন্য মোল্লা কুতুব উদ্দিন কুর্ণিশ করল। কিন’ বাবরের মনে হল বই ব্যবসায়ী যেন আরো কিছু বলতে চায়, অথচ সাহস পাচ্ছে না।
‘কী চান আপনি মোল্লা? বলুন, সঙ্কোচ করবেন না….. আপনার বইগুলো সমস্ত মূল্যেরও ঊর্ধ্বে।’
‘হুজুরে আলী,’ বই ব্যবসায়ী সাহস সঞ্চয় করে বলল, ‘এ সময়ে অর্থের বিনিময়ে খাদ্য কেনা অসম্ভব, এগিকে ছেলেরা কাদঁছে সারাদিন ক্ষুধার তাড়নায়, শুনে বুক ফেটে যায়, যদি সম্ভব হয় অন্তত সামান্য একটু আটা ….’
‘ঐ বৃদ্ধা আর এই ইজ্জতদার মানুষটি…ক্ষুধার তাড়নায় জর্জরিত অবরোধের ফলে একেবারে ক্ষীণদেহ হয়ে পড়েছে। আর আমি বলছি অর্থের কথা, বইয়ের কথা,’ নিজেকে ধমক দিলেন বাবর, কিন’ রুটির দোকানের সারির কাছে কাসিম বেগের বলা কথা মনে করে কিছু বললেন না (কেবল ঘাড়টা নাড়লেন একটু), ভাবলেন চালাকি করতে হবে। পরে, বেগদের কোন অসনে-াষ না জাগিয়ে শাহীর বাবুর্চি গোপনে সব ব্যবস্থা করবে।
‘খুদা হাফিজ ! দুচিন্তা করবার কোন প্রয়োজন নেই !’ যেন উদাসীন সৌজন্য দেখিয়ে বলে বাবর দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন চত্বরে, যেখানে আহমদ তনবাল বিষণ্নমুখে অনুচরপরবৃত হয়ে বসেছিল নিজের ঘোড়ার উপর।
সেই দিনই সন্ধ্যেবেলায় অতি গোপনেই বইয়ের ব্যবসায়ীর বাড়ীতে একবস্তা আটা, একটি নধর ভেড়া আর কিছু অর্থ পৌঁছে দেওয়া হলো, কিন’ তা হলেও পরের দিন ভোরবেলাতেই সে সম্বন্ধে জানতে আর কারুরই বাকী রইল না। ঠিক তেমনিভাবেই ছড়িয়ে পড়ল এ খবর যেমন ছড়িয়ে ছিল রুটির দোকানীদের এক গাড়ীভর্তি আটা এনে দিয়েছিল কাসিম বেগের লোকের সে কথা। একদিন বরফঢাকা অবস্থায় পড়ে থাকা তন্দুরগুলিতে আগুন জ্বালাল রুটি কারিগররা। গরম গরম, টাটকা তৈরী করা রুটির গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে শহরময়। ঘোড়সওয়ার সৈন্যরা সত্যি সত্যিই বাবরের নামে রুটি বিতরণ করল সবার মধ্যে।
সমরখন্দবাসীরা বাবরের প্রতি যতখানি সন’ষ্ট তাঁর বেগ আর অনুচররা তাঁর প্রতি ততখানিই অসন’ষ্ট লুঠতরাজ করতে না পারায়। সমরখন্দের ক্ষুর্ধাত দীনহীন রূপ দেখে দেখে যাদের মনে ঘৃণা ধরে গিয়েছিল সেই সব বেগরা সিদ্ধান্ত নিল বাবরের অনুমতি না নিয়েই তারা ফিরে যাবে উষ্ণ ও প্রাচুর্যভরা ফরগানাতে।
যে সব সৈন্য তন্দুরে সবেমাত্র তৈরী গরম গরম রুটি বস্তাভরে এনে অনাহার ক্লিষ্ট সমরখন্দবাসীদের মধ্যে বিতরণ করছিল তাদের একজন ছিল তাহের। প্রথমে তারও রাগ হয়েছিল এই আদেশ মানতে, ‘যারা রাবেয়াকে লুঠ করে নিয়ে গেছে তাদের সেবা করতে এসেছি নাকি?’
কিন’ মানুষের দুঃখদুর্দশা দেখে তারও প্রাণ গলে গেল, সামনে যখন সে দেখল কাথাঁকানিপরা লোকগুলিকে, দেখল যুবকের যাদের ঘাড়গলা চুলের মত সরু হয়ে গেছে, ক্ষুধায় নির্জীব বৃদ্ধবৃদ্ধাদের, তখন তার সেই অসনে-াষের আর একটুকুও অবশিষ্ট রইল না। তাছাড়া তার মাথায় আর একটা কথা এলো, হয়ত এই অভাগাদের মধ্যে কষ্ট পাচ্ছে তার রাবেয়াও। হয়ত এদের মধ্যে এমন কেউ আছে যে রাবেয়াকে জানে, দেখেছে তাকে?
তাহেরের মাথায় শিয়ালের চামড়ার টুপি, গায়ে খাটো চামড়ার কোর্তা, গত কয়েকমাস ধরে অনবরত ঘোড়ার চড়েই চলাফেরা করেছে, ফলে তার হাঁটার ধরণ পাল্টে গেছে। ভালুকের মত করে বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে পা ফেলে হাঁটে সে। কিন’ হাতগুলো তার চটপট রুটি বার করে আনতে লাগল।
ক্ষুধায় জর্জরিত লোকগুলির বিস্ফারিত দৃষ্টি কিন’ দেখছিল কেবল তাহেরের হাত আর তার এগিয়ে দেওয়া রুটির দিকে, তাহেরের মুখের দিকে দেখছিল না ওরা। রুটির বস্তার দিকে এগিয়ে আসছিল তারা সাবধানে, ছোট ছোট পা ফেলে যেন পা ঘষে পথটা অনুভব করতে চাচ্ছে। অবাক হয়ে তাহের দেখতে লাগল যে লোকগুলি এমন দুর্বল হয়ে পড়েছে যে পা তুলে একটা ছোট্ট নালা পার হতেও পারছে না; দাঁড়িয়ে পড়ে অপেক্ষা করছে তাদের থেকে আর একটু বেশী শক্তি যাদের আছে তারা সাহায্য করবে এই আশায়।
প্রত্যেককে ভাল করে লক্ষ্য করতে লাগল। এদের মধ্যে কি কেউ নেই যে রাবেয়াকে দেখেছে বা তার সম্বন্ধে কিছু জানে?
এই যে চোগাপরা এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধাকে ধরে আর নিজেও ভর দিয়ে আছে বৃদ্ধার গায়ে।
‘খালাজান, আপনাদের মধ্যে আন্দিজান বা কুভার মেয়ে কেউ আছে নাকি?’
‘না বাছা, তেমন কেউ নেই!’ তাজিকভাষায় উত্তর দিল মহিলাটি!
বহুবার বলা সেই কথাগুলিই আবার আউড়ে গেল তাহির, ‘আমার বোনটিকে খুঁঝছি। চার বছর হল সুলতান আহমদের সৈন্যরা তাকে ধরে নিয়ে যায়।’
‘বেচারী !’ বলল মহিলাটি। বৃদ্ধাটি তার হাত থেকে রুটি নেবার সময়ে নীচু হয়ে কৃতজ্ঞতা জানালো।
একটু দূরে একজন লোক দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুটির বস্তার দিকে আর অধৈর্য হয়ে ঢোঁক গিলছে। অল্প গোফদাড়ি তার মুখে, লম্বাচেহারা, বয়স বছর পয়ঁত্রিশ হবে।
‘সুলতান আহমদের দলে কাজ করেছিল আগে কখনও?’
লোকটি একমুহূর্ত চুপ করে রইল ভয়জড়ানো স্বরে বলল, ”করতাম, কেন?’
‘কতদিন আগে?’
‘সে অনেকদিন হল।’
‘আন্দিজান গিয়েছিলি?’
”না… যাবার পথেই ফিরতে আসতে হয়েছিল।’
তার কথা বলার ধরন আর মুখচোখ সেই বদমাশদলের লোকগুলোর মত। কেপেঁ উঠল তাহের। এ কি তাদেরই একজন নাকি?
রুটির দোকানের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সামান্য কয়েকটি রুটি সমেত ডেকে তাহের তার হাতে ধরিয়ে দিল পড়ে থাকা সামান্য কয়েকটি রুটিসমেত বস্তাটা তারপর আবার এগিয়ে গেল সেই স্বল্পগোঁফদাড়ি, অনাহারে স্ফীত মুখমন্ডল লোকটির কাছে। তাকে সঙ্গে নিয়ে সরে গেল একপাশে। ভীষণ ভয় পেয়ে গেল লোকটি।
‘আরে ভাই, কী চাই আমার কাছে? গরীব লোক আমি! যেতে দাও আমায়! এসেছিলাম কেবল রুটির জন্য… রুটির জন্য!’
ও চিনতে পেরেছে নাকি তাহেরকে? হয়ত ওর কাছে মিলবে সেই সূত্র যা ধরে তাহের রাবেয়ার কাছে পৌঁছে যাবে? আরো একটু নরমসুরে কথা বলতে হবে ওর সঙ্গে।
‘রুটি পাবে তুমি। বেশী করেই দেব রুটি। সত্যিকথা বল কেবল। তার মানে সুলতান আহমদের সৈন্যদলে কাজ করতে?’
‘বললাম তো করতাম…’
‘কুভা নদীর পুল পেরিয়ে গিয়েছিলে?
‘কোন পুল? যেটা ভেঙে পড়ায় আমাদের দলের লোকজন মারা পড়ছিল?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটাই!’ রাগ আর আনন্দ দুই ঢাকবার চেষ্টা করতে লাগল তাহের। তার মানে, এই সেটা বদমাশটা! তলোয়ারের এক খোঁচায় প্রাণটা বার করে দিলে হয়। কিন’ রাবেয়ার খোঁজ পাওয়া যাবে কেমন করে? লোকটির পোশাকটা আঁকড়ে ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিল তাহের, ‘রাবেয়া কোথায়? বল শীগগির!’
অনাহারে দুর্বল লোকটি আর একটু হলে পড়েই যাচ্ছিল তাহেরের পায়ের কাছে, মনে হল যেন এখুনি তার দেহটি টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়বে।
‘কো… কোন রাবেয়া?’ তোতলাতে তোতলাতে কোনরকমে বললো সে।
‘রাবেয়া, রাবেয়া! কুভার সেই মেয়েটিকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিলে তোমরা? কোথায় এখন সে? সত্যি কথা না বললে মাথাটা কেটে ফেলব তোর! বল্ সব কথা!’
‘আরে ভাই! রাবেয়া নামের কোন মেয়েই আমি কখনও দেখি নি, ভাই। মেরে ফেলতে চাও-মারো, কিন’ শুধু শুধু ভেব না যে আমি ও কাজ করেছি। তখন মেয়েদের দিকে তাকাবার মত মনের অবস্থা ছিল না আমার, ভাইটা আমার পড়ে গেল পুল থেকে, নদীর স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ওকে, তিনদিন ধরে খুঁজেছি নলখাগড়ার ঝোপের মধ্যে, কিন’ পেলাম না… কিছুই পেলাম না.. লাশটাও না। জলায় ডুবে গেছে।’
লোকটিকে একটু সরিয়ে দিল তাহের হাতের ধাক্কায়, কিন’ তার জামার হাতাটা ধরে রইল। মনে পড়ছে, সেই লোকগুলির একজন অন্যজনকে ডাকছিল জুমান বলে।
‘তোর নাম কী?’ তাহের আবার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল লোকটির চোখের দিকে।
‘নাম? মামাত।’
‘জুমান নয়?’
‘কাউকে ডেকে জিজ্ঞেস করে নিলেই ত পার। এই মহল্লার সবাই জানে আমার নাম মামাত, আমি চমড়া তৈরী করি।’
তাহের ভাবল, ওর ভাই যেহেতু কুভাসাইয়ে ডুবে মারা গেছে সেই হেতু ওরও অধিকার আছে আমার গলা চেপে ধরার! যেমন চট্ করে জ্বলে উঠেছিল তার রাগ তেমনই হঠাৎ নিভেও গেল সে রাগ।
‘জুমানকে তুমি জান নাকি ভাই?’
হঠাৎ মামাত মাথা চেপে ধরল, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও… ছিল বটে আমাদের মাঝে এক জুমান মাইমাক। শুনেছি দুটি মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিল ও। তার মানে তোমাদের ওখান থেকেই নিয়েছিল।’
‘সমরখন্দে এনেছিল তাদের?’
‘মেয়েগুলোকে? তা তো জানি না… আমি ওরা-তেপার কাছে ঐ যে অক্সুব নদীটা আছে, জান তো, ঐ পর্যন্ত যাই। অক্-সুব পর্যন্ত যাবার পরেই আমাদের মির্জা মারা যান। তখন আরম্ভ হলো গোলমাল। বিরক্তি ধরে গেল আমার। … ছেড়ে দিলাম সৈন্যদলের কাজ।’
‘এখন জুমান মাইমাক কোথায়?’
‘তা বলতে পারব না। বছর তিন-চার হল দেখি না আর তাকে। কিসি-বাজ লোক ছিল, মরে গেছে নাকি অন্য মির্জার কাছে কাজ করছে কে জানে। মির্জাও তো আশেপাশে কম নয়। তাশখন্দে মাহমুদ খান, তুর্কীস্তানে শয়বানী খান। হিসারে একজন।’
‘চুলোয় যাক এই লড়াই-হাঙ্গামা,’ প্রচন্ড রাগে বলে উঠল তাহের। ‘তুমি কারিগর আর আমি ছিলাম চাষী। এ কী সময় এল বল দেখি যে আমরা একে অন্যের সঙ্গে লড়াই করছি?’
এবার তাহেরের মুখটা ভালো করে লক্ষ্য করল মামাত, একটা ক্ষতচিহ্ন দেখতে পেল, ঘাড় নাড়াল সে, ‘মেয়েটি তোমার কে হয়, ভাই? বোন?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাহের, বলে ফেলল হঠাৎ, ‘সবার চেয়ে প্রিয় সে আমার । আমার চোখের মণি ছিল সে।’
মামাত তাহেরকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল, ‘পাবে, খুঁজে পাবে ওকে। এখানে আমার চেনাজানা, বন্ধু অনেক। জিজ্ঞাসা করব সবাইকে। আমার বিবিকে বলব। সে মেয়েদের মধ্যে খোঁজ নেবে।’
তাহের বুঝলো মামাত তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে অন্তর থেকেই।
‘চল মামাত।’ যখন তারা রুটির দোকানে এসে ঢুকল তাহের রুটিভরা বস্তা থেকে চারটি রুটি তুলে নিল। ‘এই নাও। রুটির জন্যই তো এসেছিলে।’
কাঁপা কাঁপা হাতে রুটিগুলো নিয়ে জামার ভিতরে ঢোকাবার আগে কয়েকবার শুকল গরম আটার গন্ধ দম বন্ধ করে আসতে লাগল তার। যত ক্ষুধার্তই হোক না কেন তাহেরের সামনে সে আত্মসংযম হারিয়ে রুটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল না। কেবল রুটির গন্ধে যেন মাতাল হয়ে গিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, ‘রুটির থেকে… দামী আর কিছু নেই রে ভাই। খোদা যেন তোমাকে এমন কোন দিন… দেন না যা আমরা ভোগ করেছি…. একটু খেয়ে নিয়ে একটু বল পেলেই নিজের গ্রাম পর্যন্ত যাব। ঐ পাহাড়ের ওপাশে আমাদের ভাইরা থাকে। … ঘোড়া ছিল একটা, শরৎকালে সেটাকে কেটে খেয়ে ফেললাম। পায়ে হেঁটে পাহাড়ে উঠতে ভয় পাচ্ছিলাম- যদি পড়ে যাই, শীতে জমে যাই। এখন ভয়ের আর কী আছে….’
‘তোমায় কোথায় খুঁজে পাব?’ তার কথার মাঝখানেই বলল তাহের।
‘মুচীপাড়ায়.. আমার একটা বাড়ী আছে। মামাত বলে জিজ্ঞাসা করলেই যে কেউ দেখিয়ে দেবে। পালোয়ান-মামাত.. একসময় জোয়ান চেহারা ছিল রে ভাই। আর এখন কোনক্রমে হাঁটি..’
‘ভুলো না! ওর নাম রাবেয়া… আর আমি- কাসিম বেগের দলের সৈন্য। নাম তাহের।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, তাহের বেগ, যদি কিছু জানতে পারি তো খুঁজে বার করব আপনাকে। আমাদের লোকেরা আপনার এমন ক্ষতি করেছে আর আপনি আমার মঙ্গল করলেন। কখনও ভুলব না একথা, এর প্রতিদান দেব নিশ্চয়ই। চলি তাহলে।’
তাহিরের দৃষ্টি অনুসরণ করল তাকে। কার দোষে ওর ভাই মরেছে জানতে পারলেই…
রুটির দোকান থেকে একটু দূরে চলে গিয়ে মামাত তাড়াতাড়ি হাত ঢুকিয়ে দিল জামার ভিতর, গরম রুটির এক টুকরো ছিঁড়ে নিল, চোরের মত সন্ত্রস্তভাবে ঠেসে দিল সেটা মুখে।
সমরখন্দ দখল করে নিলেই সব গোলামাল মিটে যাবে। ভেবেছিল আন্দিজানের বেগ আর সৈন্যরা। কিন’ তা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। তিনহাজার সৈন্যের দলের জন্য লাগে প্রায় দুই হাজার ঘোড়া। এই হাড়কাঁপান শীতে, অবরোধের ফলে শূন্য এই শহরে একই সঙ্গে শহরবাসীদের খাওয়ানো, সৈন্যদলের জন্যে যথেষ্ট খাদ্যসংগ্রহ করা ও ঘোড়ার আহার জোগান অসম্ভব। শহরদ্বার উন্মুক্ত, ওরা-তেপা আর কার্শির দিকে বাহিনী পাঠানো হয়েছে কঠোরভাবে কর আদায়ের জন্য-পুরনো, নতুন যত কর হতে পারে- দানাশস্যের মাধ্যমে, শুধু দানাশস্যের মাধ্যমে গ্রহণের জন্য। শহরের বাজারগুলি নতুন করে খোলার জন্য সবরকম চেষ্টা চালান হচ্ছে। তবুও মাভেরান্ নহরের রাজধানীর জীবন স্বাভাবিক হচ্ছে না কিছুতেই। প্রতীক্ষার আছে সমরখন্দ, চুপ করে আছে, দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সমরখন্দ। গত কয়েক বছরে বড় ঘন ঘন মালিকবদল হয়েছে তার, এক লোভী হাত থেকে আর এক লোভী হাতে গিয়ে পড়েছে- তারা সবাই ভেবেছে কেবল নিজের স্বার্থের কথা, শহরের কথা কেউ ভাবে নি।
ধৈর্য ধরতে হবে আমাদের। বৈঠকে বেগদের বোঝাতে লাগলেন বাবরের ওস্তাদ খাজা আবদুল্লাহ। বসন্তকাল এলো বলে, খোদার ইচ্ছায় ফসল তোলার সময় আসা পর্যন্ত যদি টিকে থাকতে পারে তো সব দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা যাবে। দুর্দশা কেটে গিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে এক শক্তিশালী- কার্শি আর শাহ্রিসাব্জ থেকে উজগেন্দ পর্যন্ত একচ্ছত্র সল্তানত। আল্লাহ্র দোয়ায় আমাদের দখলে আসবে এক বিশাল দেশ, এমন রাজধানী যখন আমাদের দখলে! আমাদের বাদশাহ মির্জা বাবরের স্বপ্ন যেন গোটা মাভেরান্নহর ঐক্যবদ্ধ হয়, যেমন ছিল উলুগ বেগের সময়, যাতে মাভেরান্নহরে পুরনো খ্যাতি ফিরে আসে, সেই সুখের দিনগুলো যেন পুনরুজ্জীবিত হয়। আমাদের বাদশাহের এই অভিলাষই হল আমাদের পাক মকসদ। সেই উদ্দেশ্যসাধন করার জন্য আল্লাহ শক্তি দিন আমাদের।’
খান কুলি বেগ ও আহমদ তনবালের বিরক্তি লাগছিল। কিন’ মনের ভাব গোপন রেখে অন্যান্য বেগদের মত তারাও হাত উপরে তুলে বলে উঠল, ‘শক্তি দিন আল্লাহ! ইলাহী আমিন!’
তারপর বৈঠক থেকে যে যার বাড়ী চলে গিয়ে আবার দু’জন তিনজন করে মিলিত হতে লাগল। বলাবলি করতে লাগল, ‘তাহলে আমাদের মির্জা উলুগ বেগের মতই আজীম বাদশাহ্ হতে চান, কি বলেন আহমদ বেগ?’ ব্যঙ্গের হাসি হাসে খান কুলি।
চুলার কাছে উষ্ণতায় বিছান মখমলের ওপর বসে তারা সন্ধ্যার আহারপর্ব সারছিল। আহমদ তনবাল ছুরি দিয়ে একটুকরো মাংস কেটে নিয়ে বিদ্রুপ করে বলল, ‘নওজওয়ান মির্জার আজীম বাদশাহ্ হবার জন্য কেবল একটুখানি ঘাটতে থেকে যাচ্ছে।’
‘কী সেটা? অ্যাঁ?’
‘শুনলেন না আজ বৈঠকে। সমরখন্দের চাষীরা তাদের বীজদানা সব খেয়ে ফেলেছে। আমাদের বীজদানা থেকে দিতে হবে…. ঐ যা কার্শি থেকে নিয়ে এসেছে কারাভান… দিতে হবে ধার হিসেবে। … যখন ফসল তুলবে ওরা তখন নাকি সুদেমুলে ফেরত দেবে।’
‘বোঝ ঠ্যালা। গোদের ওপর বিষফোঁড়া।’
‘আরে খান কুলি বেগ! সহ্য করতে হবে, খোকাবাবু যে শাহানশাহ্ হতে চাচ্ছেন। এখান থেকে নড়বেন না উনি। উনি যে সমরখন্দের জামাই হন! এখানে ওর কনে রয়েছেন… তাই এই ‘রাজাধনীর’ ভিখারীগুলোর কাছে নিজেকে ভালো মহৎ প্রতিপন্ন করতে চাচ্ছেন। আটা বিলোচ্ছেন, আবার প্রতিসপ্তাহে কবিদের ডেকে মুশায়রা হচ্ছে।’
‘শোনা যাচ্ছে উনি কবি হতে চান, তা সত্যি নাকি?’
‘তা নয় তো কী! সেই জন্যই তো চতুর্দিক থেকে কবিদের ডেকে এনে জড় করেছেন, কিন’ তাদেরকে তো খাওয়াতে হবে- তাতেই নিঃশেষ হয়ে যায় লড়াইয়ে পাওয়া ধনসম্পত্তি, যা আসলে আমাদেরই প্রাপ্য। বই কেনার জন্য কোষাগারের সব সোনা ব্যয় করতেও পিছপা নন উনি। সেও আমাদের ঘাড় ভাঙা হল!’
খান কুলি তার স্বল্পদাড়িতে হাত বুলোল।
‘আন্দিজান চলে যাব ভাবছি। কিন’ মির্জা যেতে অনুমতি দিচ্ছেন না,’ বলল সে। ‘কী ঘেন্না ধরে গেছে যে আমাদের মির্জার ওপর, তা খোদাই জানেন।’
আহমদ তনবাল উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, দরজাটা হুড়কো লাগিয়ে বন্ধ করে দিয়ে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসল।
‘মোহতরম খান কুলি বেগ! বেগরা যদি না থাকে তো বাদশাহ্ কী করবেন?… বেশীর ভাগ সৈন্যই আমাদের সঙ্গে যাবে এ আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি। লড়াইতে জিতলাম আমরা। কষ্ট সহ্য করলাম আমরা। আর এখন…. ঐ কচি ছেলেটার কাছে অনুমতি চাইতে হবে কেন?’
‘ঠিক বলেছেন!’ ফিসফিস করে বলল খান কুলি বেগ। ‘আমাদের বেগদের প্রত্যেকেই তার নিজের কাছে বাদশাহ… অনুমতি না দেয় তো ভারী বয়ে গেল, চলে যাব আমি ঠিকই।’
‘আমিও অতটুকু কচি ছেলেটার কাছে আর মাথা নীচু করব না। বেঁচে থাকলে অন্য বাদশাহ্ খুঁজে নেব। এই তো আখসিতেই রয়েছেন মির্জা জাহাঙ্গীর। বুখারাতে সুলতান আমি মির্জা। আরে, রাজাবাদশার তো আর অভাব নেই কোথাও। আর তাদের সবারই প্রয়োজন এই আমাদের মত লড়ায়ে বেগদের… কেবল একটা কথা বলি আপনাকে- আন্দিজানে বেশীদিন থাকার দরকার নেই। বিপদে পড়ার ভয় আছে ওখানে।’
‘আখসি যেতে বলেন?’
‘হ্যাঁ। আখসি গিয়ে উজুন হাসানের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করুন। ও আপনাকে জাহাঙ্গীরের কি সাহস হবে ভাইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার।’
‘দাঁড়াবে। …. তার দলে তেমন বেগের সংখ্যা বাড়লে চাপ দেওয়া যাবে তার ওপর। তখ্তের ওপর নজর আছে তার। বিশ্বাস করুন…।
পরের দিন সন্ধ্যায় যখন আহমদ তনবালের বিশ্বাসী লোকেরা প্রহরায় ছিল তখন খান কুলি বেগ তার পঞ্চাশজন অনুচর নিয়ে চুপিসারে ফিরোজা দরওয়াজা দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল। একসপ্তাহ বাদে আহমদ তনবাল নিজেও চলে গেল- জামিনে কারাভান নিয়ে যাচ্ছে এই অজুহাতে। সেই যে গেল আর ফিরল না সমরখন্দ। সোজা রওনা দিল আখসির দিকে। এরপর বিভিন্ন প্রয়োজনে শহরের বাইরে যাওয়া আর কোথায় যেন হারিয়ে যাওয়া বেগ আর তাদের অনুচরদের সংখ্যা বেড়ে চলল খুব তাড়াতাড়ি। ফটকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলে রাতের অন্ধকারে কেল্লার পাঁচিল পেরিয়ে পালাতে লাগল সবাই। শীতকাল শেষ হবার মুখে বাবরের সঙ্গে সমরখন্দ আসা বেগদের সংখ্যা কমে অর্ধেকে দাঁড়ালো। বাবর তার একজন বিশ্বাসী লোককে আন্দিজান পাঠালেন পালিয়ে যাওয়া বেগদের ফিরিয়ে আনতে। কুড়ি দিন বাদে খবর পাওয়া গেল যে আহমদ তনবাল আর তার দলের লোকরা খোলাখুলি বিদ্রোহী হয়ে বাবরের দূতকে আন্দিজান আর আখ্সির মাঝামাঝি কোথায় ধরে মেরে ফেলেছে।
কাসিম বেগের পরামর্শ অনুযায়ী বাবর খাজা আবদুল্লাহকে আন্দিজান পাঠালেন। কিন’ উজুন হাসান ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীরা, যারা আগে খাজা আবদুল্লাহর উপদেশ মানতো- তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার তার মুরিদও ছিল- এবার কিন’ তারা তার উপদেশ-অনুরোধে কানও দিল না। আর সোজাসুজি আক্রমণ করে বসলো আন্দিজান যার ফলে তাদের মুরশিদ খাজা আবদুল্লাহ আর বাবরের বিশ্বাসী বেগদের দুর্গদ্বার বন্ধ করে অবরুদ্ধ হয়ে থাকতে হলো।
ফরগানা উপত্যকায় অশানি- ঘনিয়ে এল।
৫
নিয়তির অপ্রত্যাশিত আঘাত- তরুণ মির্জার কঠিন রোগ বিশ্বাসঘাতক বেগদের বাধিয়ে তোলা গোলমালকে আরো বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করলো। বুস্তান-সরাই মহলের দোতলার বিশ্রামকক্ষে শুয়ে ছিলেন বাবর। প্রচন্ড জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তার দেহ।..
আন্দিজান থেকে দূত এসে বাবরের দেহরক্ষী প্রধানকে দেখাল গালার মোহরছাপ দিয়ে আঁটা গোল করে পাকান একটা চিঠি, কিন’ চিঠিটা তার হাতে দিল না সে।
‘মালিকা সাহেবা, বাদশাহের ওয়ালিদা সাহেবা আদেশ দিয়েছেন কেবলমাত্র স্বয়ং বাদশাহের হাতেই দিতে হবে এ চিঠি।’
বাবর প্রতিদিনই জিজ্ঞাসা করেন, আন্দিজান থেকে দূত এসেছে কিনা। সেই জন্য দেহরক্ষী প্রধান দূতকে উপরে নিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। কিন’ বিশ্রামকক্ষের দরজায় পথরোধ করলেন বৃদ্ধ হাকিম।
‘এই বার্তা আগে পড়বেন উজীরসাহেব। যদি ভাল খবর হয় তো বাদশাহকে জানান হবে।’
‘বাদশাহের ওয়ালিদা সাহেবা আর তার ওস্তাদ খাজা আবদুল্লাহ সাহেবের আদেশ যেন কেবল তিনিই…’
‘দুঃসংবাদ হলে তা হুজুরে আলীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে. দুঃখিত’, কিন’ দৃঢ়স্বরে তাদের বাধা দিলেন হাকিম। ‘কয়েকেদিন আগেই তিনি বেশ সেরে উঠেছিলেন, কিন’… দায়দায়িত্ব মানুষের কষ্ট বাড়ায় হে, আর তারই ফলে অসুখবিসুখ হয়। পুরোপুরি সেরে ওঠার আগেই উনি বিছানা ছেড়ে উঠেছিলেন- তাই আজ আবার প্রচন্ড জ্বর উঠেছে।’
‘আন্দিজানের বিপদ,’ দূত শেষ যুক্তির আশ্রয় নিল। ‘এ চিঠি এখুনি তার হাতে না দিলে দেরী হয়ে যাবে। রেগে যাবে হুজুরে আলী।’
‘না, না, পারা যাবে না, মাফ করবেন।’
‘কিন’ হাকিম সাহেব…’
‘না! না!’
এই তর্কাতর্কি বাবরের কানে গেল। কনুইতে ভর দিয়ে উঠে যতটা পারলেন জোরে চীৎকার করে বললেন, ‘যদি দূত হয় তো ভেতরে আসতে দিন। আমার হুকুম।’
বিশ্রামকক্ষের একেবারে শেষ প্রানে- নরম বিছানা পাতা। সেই বিছানা থেকে খানিক দূরে থামল দূত, তারপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে হাঁটু ঘষে ঘষে আরো কাছে এগিয়ে গিয়ে চিঠিটা দু’হাতে ধরে বাবরের দিকে এগিয়ে দিল।
বিছানার উপর উঠে বসলেন বাবর, জ্বরে মুখচোখ লাল, কাঁপুনি বন্ধ হচ্ছে না, মাথা রাখলেন উঁচু করে রাখা বালিশের উপর। মোহর ভেঙে পাকানো চিঠিটা খুললেন। প্রথম চিঠিটার মধ্যে আর একটি ছোট চিঠি। দুটি চিঠির মূল কথা একই। আন্দিজানকে অবরোধ করা হয়েছে, খুবই সংকটজনক অবস্থা। বাবর ছাড়া আর কেউ বাঁচাতে পারবে না তাদের এমন সময়। দুটি চিঠিরই শেষে অনুরোধ যেন বাবর যত শীঘ্র সম্ভব এসে পৌঁছান।
আন্দিজান অবরুদ্ধ। বিশ্বাসঘাতক বেগরা আন্দিজানের সিংহাসনে জাহাঙ্গীরকে বসাতে চায়। তার মানে, সেনাদলের নেতা করতে চায় আহমদ তনবালকে, ছিনিয়ে নিতে চায় বাবরের পিতৃগৃহ! তিনি ভেবেছিলেন ওরা বিশ্বাসী- হোক লোভী, স্বার্থপর, কিন’ তা বলে এতখানি? কাঁপুনির ফলে বাবরের মাথাটা বালিশ থেকে পড়ে গেল, ভার সামলাতে পারলেন না তিনি। এবার সব শেষ।
তনবাল আর জাহাঙ্গীর যদি আন্দিজানের যুদ্ধে জয়লাভ করে তো তার দলের বেশীর ভাগই সেদিকে চলে যাবে। তার কাছে তাহলে কে থাকবে? হয়ত এখনই, যখন তিনি শয্যাশায়ী তার দলের লোকেরা ছুটছে…. ঐ…. তনবালের দলে যোগ দিতে? আর কাসিম বেগ? ভীষণ আশংকা জাগল বাবরের মনে। সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে লাফিয়ে উঠে বসলেন বিছানায়।
‘কাসিম বেগ কোথায়?’
‘এখুনি আসবেন, উজীরের কাছে লোক পাঠান হয়েছে,’ নরম সুরে বললেন হাকিম। ‘শুয়ে পড়ূন হুজুরে আলী, আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন।’
বাবরের রোগজর্জরিত মসি-ষ্কের কল্পনায় হঠাৎ দেখা দিল তরবারি হসে- তনবালের মূর্তি। সেই তরবারি। ওশে হঠাৎ ঐ তরবারি চুম্বন করে, শপথ করে যে আমৃত্যু তার সেবা করবে… সেই তনবাল তরবারিটি তুলে নিয়ে বাবরের মাথার ওপর ঘোরাতে আরম্ভ করল… তনবালের পায়ের কাছে- মানুষের কাটা মুন্ডুগুলো বস্তা থেকে বেরিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেগুলির একটি… হায় আল্লাহ্।…. ও যে মায়ের মাথা…’
সেই ভয়ংকর দৃশ্য ধাক্কা দিয়ে তুলে দিল বাবরকে বিছানা থেকে। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন তিনি, নগ্নপায়ের নীচে অনুভব করলেন নরম গালিচার রোঁয়ার স্পর্শ। চেষ্টা করলেন দাঁড়িয়ে থাকার।
‘আমার তলোয়ার এনে দাও!’ চীৎকার করে বললেন বাবর। ‘এখুনি! তলোয়ার দাও!’
হাকিম শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন ঝটকান দিতে থাকা তরুণদেহটি। ‘আপনি অসুস্থ হুজুরে আলি, আপনার শুয়ে থাকা উচিত।’
হাকিম বাবরকে এগিয়ে দিচ্ছেন তনবালের তরবারির কোপের নীচে, বাছুরের মথো বেঁধে রেখেছেন তার পা। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাবর টলতে টলতে ছুটে গেলেন দরজার দিকে।
‘ঘোড়া নিয়ে এস! আন্দিজান যাচ্ছি আমি! আমার তলোয়ার কোথায়? বেগদের বল তৈরী হতে।’
হাকিম দৌড়ালেন তার পিছু পিছু। পোশাকের জিম্মাদার কায়দা করে পশুলোমের আঙরাখাটা বাবরের কাঁধে ফেলে দিল। মুহূর্তখানেক ইতঃস্তত করে জুতোও পায়ের কাছে এনে রেখে দিল। একপা জুতোর মধ্যে গলালেন বাবর, অন্য পাটি গলাতে পারলেন না আর। মাথা ঘুরে গেল, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল আর একটু হলে।
‘বিশ্বাসঘাতক!’ এইটুকুই কেবল বলতে পারলেন তিনি তনবালের প্রতি, রক্তমাখা খোলা তরবারি হাতে যার মূর্তি তার সামনে তখনও নাচানাচি করছিল, ‘রক্তপিপাসু ঘাতক।’
হঠাৎ বাবর হোঁচট খেয়ে গিয়ে জ্ঞান হারালেন।
গভীর রাতে চোখ মেললেন তিনি। চোখ মেলে দেখতে পেলে হাকিমকে, মাথার কাছে দাড়িয়ে তুলোয় করে ফোঁটা ফোটা জল ফেলছেন বাবরের মুখে ঠোঁটে। জিভটা এমন ফুলে গেছে যে প্রচন্ড ভারী হয়ে গেছে। সারা দেহের ওপর যেন কী একটা ভার লাগছে।
বাবর চোখ মেলেছেন দেখে কাসিম বেগ তার মাথার কাছে এগিয়ে গেলেন।
‘আল্লাহ্র রহমত!… আপনি আমাদের এমন ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন!’
কী যেন বলতে চাইলেন বাবর, কিন’ প্রচন্ড ভারী হয়ে যাওয়া জিভটা নাড়াতে পারলেন না; চোখ ভিজে উঠল তার।
‘এখন কেমন বোধ করছেন, হুজুরে আলী?’
আবার নীরব বাবর। চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার, কিন’ কথা বলতে পারছেন না। কাসিম বেগ বুঝলেন বাক্শক্তি হারিয়েছেন বাবর।
মুখ ঘুরিয়ে নিলেন উজীর, যাতে ষোল বছর বয়সী বাকহারা তরুণটি তার অবলম্বন, সিপাহী আর উজীরের চোখের জল দেখতে না পায়।