শিল্পী বিমান মল্লিকের সাথে একশ’ মিনিট

বিমান মল্লিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন ডাকটিকিটের নক্সাকার। বাংলাদেশের ডাকটিকিটের নক্সাকারদের মধ্যে তাঁর নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়ে থাকে।

আমার এক ফিলাটেলিস্ট বন্ধু সিরাজুল করিম বশির কয়েক মাস আগে একদিন ফোন করে আমাকে বললেন, ‘বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশের বিষয় নিয়ে কিছু তথ্যগত ভুল ধরা পড়েছে, যা নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম আটটি ডাকটিকিটের নক্সাকার শিল্পী বিমান মল্লিক আপত্তি জানিয়েছেন।’ বন্ধুটি আমাকে বললেন, ‘আপনি তো বিষয়টা নিয়ে একা কাজ করে যাচ্ছেন, তাই এই ভুলটি ঠিক করার দায়িত্ব আপনার। আমি পড়তে ভালবাসি, লেখালেখি ভাল বুঝি না। আমি কি লিখতে গিয়ে কি লিখবো তার কোন ঠিক নেই। আপনি নিজে বরং বিমান মল্লিকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেন।’

বশির আমাকে বিমান মল্লিকের যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক সম্পর্কে তথ্য দিলেন। আমি একটু ঢিলে প্রকৃতির মানুষ তাই ঠিকানা পেলেও যোগাযোগ করতে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। তবে আমি ইতিমধ্যে যেটা করলাম সেটি হলো শিল্পী বিমান মল্লিক ঠিক যে বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন, সেটা খুঁজে দেখলাম, সেটা যেখানে রয়েছে সেটি খুঁজে বের করলাম, আর ভুলগুলো ঠিক করার ব্যবস্থা নিলাম। তারপর একদিন বিমান মল্লিককে জানালাম যে তার আপত্তির বিষয়গুলো ঠিক করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আর এভাবেই বাংলাদেশের প্রথম আটটি ডাকটিকিটের নক্সাকার শিল্পী বিমান মল্লিকের সাথে আমার পরিচয়ের আরম্ভ। তিনি কি বিষয় নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন সেটা সবার জানা প্রয়োজন।

বিমান মল্লিকের জবানীতেই বলি,

‘ঢাকার একটি পত্রিকায় সমপ্রতি প্রকাশিত সাযযাদ কাদিরের “স্টোনহাউস বনাম প্রিয় পাথর বাড়ি’ শীর্ষক নিবন্ধে বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকেট নিয়ে কিছু বিভ্রানি-কর তথ্য রয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘ওই সেটের ডিজাইনার বিমান মল্লিককে স্টোনহাউসই পরিচয় করিয়ে দেন গণসংস্কৃতি সমিতির সভাপতি ড. এনামুল হকের সঙ্গে।’ এ তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। মি. স্টোনহাউস আমাকে ‘মুজিবনগর’ সরকারের বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুুরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁরা আমাকে ডাকটিকেট প্রকল্পের সম্পূর্ণ ভার গ্রহণ করার অনুরোধ করেন। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে সে ভার গ্রহণ করি। এ প্রসঙ্গে জানাই, ড. এনামুল হক নামের কোন মানুষের সঙ্গে আজ পর্যন- আমার পরিচয় হয়নি।

জনাব কাদির লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের জুন মাসে বিমান মল্লিক আটটি ডাকটিকেটির একটি সেট ডিজাইন করে দেন ড. হককে। তিনি তা পৌঁছে দেন মুজিবনগর সরকারের সংস্লিষ্ট দপ্তরে।’ বলা বাহুল্য এ ‘তথ্য’টিও সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি বিচারপতি চৌধুরীর উপস্থি’তিতে মি. স্টোনহাউসকে ডাকটিকেটের ডিজাইনগুলো পেশ করি। তারা দুজনেই ডিজাইনগুলো অনুমোদন করেন এবং চূড়ান- সিদ্ধানে-র জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ডিজাইনগুলো মি. স্টোনহাউসের বন্ধু ডোনাল্ড চেস্টওয়াথ বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার কাছে পৌঁছে দেন।’

আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি প্রকৃতপক্ষে ভুলটা সাযযাদ কাদিরের নয়। ভুল তথ্য ছাপা হয় ২০০৭ সালের জুনে Journal of the Asiatic Society of Bangladesh পত্রিকায়। ঐ সংখ্যায় একজন ইসতিয়াক আহমেদ খান Postal Administration of Mujibnagar Government প্রবন্ধে যে কথা লিখেছেন সাযযাদ কাদির তা-ই সম্ভবত তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। বিমান মল্লিক বিষয়টি নিয়ে প্রবন্ধ রচয়িতা ইসতিয়াক আহমেদ খানের সাথে যোগাযোগ করে তার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু’ প্রবন্ধকার তার কোন উত্তর দেননি। কারণ তিনি তখন ক্যান্সারে আক্রান্ত। অবশ্য এর কিছুকাল পরেই ইস্তিয়াক মারা যান।

গবেষণা পত্রিকার অথচ এসব রচনার বহু আগেই প্রথমবারের মতো আমি ১৯৮৮ সালে Postal History of Bangladesh গ্রন্থে’, ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের ডাকব্যবস্থা এবং ২০০৮ সালে বাংলাদেশের ডাকব্যবস্থা (২য় সংস্করণ) গ্রনে’ এ বিষয়টি নিয়ে সঠিক তথ্য উল্লেখ করেছিলাম। ১৯৯১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির দ্বিবার্ষিক জাতীয় সম্মেলনে আমি Postage Stamps during the Liberation War of Bangladesh নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করি, যা Bangladesh Historical Studies, Vols. XV-XVI সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, ১৯৯১-১৯৯৫ সালে (পৃষ্ঠা ১১৩-১২৬)।

বাংলাদেশের ডাকব্যবস্থা ও ডাকটিকিট নিয়ে গত পঁচিশ বছর ধরে আমি একা লেখালেখি করে যাচ্ছি। যদিও বাংলাদেশের গবেষকদের ধারণা ডাকটিকিট নিয়ে কিছু করা বা লেখা ‘কৈশোরিক ক্রীড়া’, তাই গবেষকরা এ নিয়ে মোটেই মাথা ঘামান না। এ সব কেউ পড়েও দেখেন না, অথবা পড়লেও আমার মত এক অভাজনের লেখা তেমন গুরুত্ব বহন করেনি। এমন কি আনোয়ারুল কাদির যখন ২০০৯ সালে ‘সখের রাজা ফিলাটেলি সংগ্রহ’ বইটি লিখলেন, তখনও তিনি দয়া করে ঐ তথ্যগুলো কোথা থেকে পেয়েছেন তা’ উল্লেখ করতে লজ্জা বোধ করেছেন। অথচ গবেষণা গ্রন’ লেখার পূর্বসর্ত হচ্ছে তথ্যটি সম্পর্কে পূর্বে কোন কোন গ্রন’ বা পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে তা’ বলা।

ঐ যোগাযোগের সূত্র ধরে বিমান মল্লিকের সাথে আমার অল্প সময়ের মধ্যেই আমার যথেষ্ট হৃদ্যতা গড়ে উঠলো এবং মাঝে মাঝে আমরা মত বিনিময় করতাম।

মার্চের ২০ তারিখ নাগাদ ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা থেকে আমি জানতে পারলাম বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ও সমর্থনকারী বিদেশী বন্ধুদের সংবর্ধনা দেবেন। এই তালিকায় আমি বিমান মল্লিকের নাম ‘মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু সম্মাননা’ গ্রহণকারী ব্যক্তিদের তালিকায় দেখতে পেয়ে খুবই খুশি হলাম। সাথে সাথেই তাকে ই-মেইল করে এ সুখবরটি জানালাম। তিনি আমায় জানালেন এ সম্পর্কে তিনি তখনও কোন সংবাদ পাননি। তিনি আমাকে তথ্যটির সূত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে আমি ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার সূত্র উল্লেখ করলাম ও অনুরোধ করলাম তিনি ঢাকায় এলে আমি যেন তার সাথে দেখা করতে পারি সেটা যেন তিনি নিশ্চিত করেন।

বিমান মল্লিক পরের মেইলে জানালেন, তাঁর ঢাকায় আসা নিশ্চিত হয়েছে এবং ঢাকায় তাঁর কর্মকাণ্ডের তথ্য যার কাছে থাকবে তার ফোন নম্বর আমাকে জানিয়ে দিলেন। আমি উক্ত ভদ্রলোকের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পেলাম বিমান মল্লিকের জন্য রূপসী বাংলা হোটেলের একটি কক্ষ বরাদ্দ করা হয়েছে। তিনি আমাকে আরও জানালেন ২৪ মার্চ তিনি ঢাকায় এলে বিকেলে আমি তাঁর সাথে দেখা করতে পারবো হোটেল লবিতে।

অধিকাংশ লোক কোন লাভের কাজ করতে গেলে গোপনে করে, যাতে তার লাভ অন্য লোকে না পেতে পারে। আমি আবার তেমন লাভের কাজ সবাইকে বলে, সবাইকে নিয়ে করতে ভালবাসি। তাই বিমান মল্লিকের ঢাকায় আসার সংবাদ আমার পরিচিত সকল ফিলাটেলিক সমিতির কর্মকর্তাদের জানালাম ও বললাম বিমান মল্লিককে ফিলাটেলিস্টদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দিলে ভাল হয়। তারা যদি চান তবে এ কাজটি যেন সবাই মিলে আমরা করতে পারি তার ব্যবস’া নিয়ে আমাকে জানাতে। আমি এদের সকলের চেয়ে বয়সে বড়, তাই একটু জ্যাঠামি করতে ইচ্ছে হলো। কিন’ ওরা কেউ আমার সাথে আর যোগাযোগ করলেন না। তাই ঠিক করলাম ‘একলা চলো’। কিন’ তাতেও মন সরলো না, তাই বাংলাদেশের একজন আন-র্জাতিক পুরষ্কারপ্রাপ্ত ফিলাটেলিস্ট শেখ শফিকুল ইসলামকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, বিমান মল্লিকের সাথে দেখার করতে চাইলে তিনি যেন রূপসী বাংলা হোটেলে চলে আসেন। আমি সেই সাথে আমার একজন ফিলাটেলির সাগরেদ আব্দুস সামাদ ও যিনি আমার সাথে বিমান মল্লিকের সাথে প্রথম যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন সেই বশিরও বললাম আসতে।

যানজটের কারণে হোটেলে পৌঁছাতে আমার অল্প কয়েক মিনিট দেরী হওয়ায় জানতে পারলাম তারা বেরিয়ে গেছেন। মনটা দমে গেল। তিনি কোথায় গেলেন হোটেলের লোক তা বলতে পারলো না। কাছেই সুহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিজয় মঞ্চ, ওখানে যেতে পারে মনে করে আমরা সেদিকে ছুটলাম। বারডেম ভবন ঘুরে ঢাকা ক্লাবের কাছে যেতে যেতে ফোন করে জানতে পারলাম দলটি বিজয় মঞ্চ নয়, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে গিয়েছেন।

অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের দিকেই ছুটলাম। গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড। প্রচুর লোক, প্রচুর দর্শক, টিভি কোম্পানীর প্রতিবেদক, ক্যামেরাম্যান আর অনেক অনেক আলোকচিত্র শিল্পী। এর মধ্যে বিমান মল্লিকের দেখা পাব কিভাবে? একে ওকে জিজ্ঞেস করে এঘর ওঘর ঘুরে একটি ঘরে ঢুকে দেখি একজন হালকা-পাতলা লোক গায়ে জহর কোট পরে দাঁড়িয়ে আছেন। কেন যেন মনে হল আমি এঁকেই খুঁজতে এসেছি।

এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমি সিদ্দিক। তিনি উচ্ছসিত হয়ে আমার হাত ধরলেন। যেন কতকাল আগে হারিয়ে যাওয়া ভাই! করিডোরে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। আমার লেখা কয়েকটা বই তাঁকে দিলাম। তিনি বললেন স্বাক্ষর করে দিতে। আমি কি লিখে দিয়েছিলাম এখন মনে নেই।

ওকে নিয়ে তখন টানাটানি পড়ে গিয়েছে। আমি তার সাথে আরও কিছু সময় কাটানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম। অবশেষে ২৬ মার্চ রাতে সময় পাওয়া গেল। আমি ওর হোটেল কক্ষে গিয়ে পৌঁছলাম রাত সাড়ে নয়টায়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের ডাকব্যবস্থা এবং ডাকটিকিটের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যবনিকা উত্তোলিত হয় ১৯৭১ সালের ২৯শে জুলাই অর্থাৎ ১২ই শ্রাবণ ১৩৭৮। এই দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি বিশ্ব জনমত ও সহানুভূতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে মুজিবনগর সরকার আটটি ডাকটিকিট প্রকাশ করার সিদ্ধান- নেন। এই আটটি ডাকটিকিট প্রকাশের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একজন প্রভাবশালী সদস্য ও ব্রিটিশ ডাকব্যবস’ার পোষ্টমাস্টার জেনারেল জন ষ্টোনহাউজ মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ব্যরিষ্টার মওদুদ আহমদকে বৈদেশিক প্রচারণার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে ডাকটিকিট প্রকাশের পরামর্শ দেন এবং এই পরামর্শের ভিত্তিতেই এই ডাকটিকিটগুলি প্রকাশের সিদ্ধান- নেওয়া হয়।

বাংলাদেশের প্রথম আটটি ডাকটিকিট সম্পর্কে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ গ্রনে’ এ সম্পর্কে লিখেছেন;

“ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সদস্য জন ষ্টোন হাউজ . . . . প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমদ এবং অন্যান্য মন্ত্রীর সাথে আলোচনার সময় ডাকটিকিট প্রকাশনার সিদ্ধান- গ্রহণ করা হয়। এই ব্যাপারে জন ষ্টোন হাউজ সরাসরি মুজিবনগর সরকারের নির্দেশ ও দায়িত্বে কাজ করছিলেন। . . . ডাকটিকিটগুলো ষ্টোনহাউজ মুজিবনগর সরকারের নিকট পাঠিয়েছিলেন এবং ইউরোপ বিতরণের ব্যবস’া করেছেন। একটি ডাকটিকিটে তৈরীর প্রতিষ্ঠানের দ্বারা তিনি সকল কাজ করেছেন, এর খরচও ঐ প্রতিষ্ঠান বহন করেছে।”

বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশের কথা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর আত্মজৈবনিক গ্রন’ ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি ও জন স্টোন হাউসের ÔDeath of an IdealistÕ গ্রনে’ উল্লেখ আছে। ডাকটিকিট সংগ্রান- সংবাদ সম্মেলনের সংবাদ ২৭ তারিখের ‘লন্ডন টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

সকল আনুষ্ঠানিক সম্পন্ন হওয়ার পর ডাকটিকিটগুলির প্রকাশের তারিখ ২৯ জুলাই ১৯৭১ নির্ধারণ করা হয়। ইতিপূর্বে ২৬ জুলাই লণ্ডনের ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হাউজের হারকোর্ট কক্ষে ডাকটিকিট প্রকাশ সংক্রান্নত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপসি’ত ছিলেন ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউস, এমপি পিটার শোর, ডোনল্ড চেস্টওয়ার্থসহ অন্যান্য গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী তার ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ গ্রনে’ উল্লেখ করেছেন-

ছাব্বিশে জুলাই বৃটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সের হারকোর্ট কক্ষে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ডাকটিকিটের প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই টিকেট প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দিক ছিল। এই টিকেট প্রকাশের দ্বারা মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন বিদেশে এরূপ ধারণা সমর্থন পায়।

অনুষ্ঠানে পিটার শোর, জন স্টোনহাউস এবং আরও কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সমর্থন করে বক্তৃতা করেন। বৃটিশ পার্লামেন্ট ভবনে অন্য দেশের স্বাধীনতা সমর্থনে এরূপ বেসরকারী সভার নজির নেই।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ ডাকবিভাগের প্রথম মহাপরিচালক জনাব আবু মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ বাংলাপেক্স’ ৯২ স্মরণিকাতে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের ডাকটিকেট আদী ইতিহাস ও কিছু প্রাসংঙ্গিক কথা’ প্রবন্ধে মন-ব্য করেছেন:

“একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন সত্তার বাহ্যিক প্রকাশ যা জনসমক্ষে সহজে ও কার্যকরভাবে ধরা পড়ে তা’ হলো সে দেশের নিজস্ব ডাকটিকিট ও মুদ্রাব্যবস’া। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন-র্জাতিক স্বীকৃতি লাভের উদ্দেশ্যে বস’ত মুজিবনগর সরকার নিজস্ব ডাকটিকিট চালু করে। বিভিন্ন নক্সার আটটি ডিনোমিনেশনের এই সিরিজটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ফিলাটেলী জগতে ডাকটিকিটের এই সিরিজটি একটি অমূল্য সম্পদ হিসাবে বিরাজমান।”

এই ডাকটিকিটগুলি একই সাথে ইংল্যান্ডের লন্ডন, ভারতের কলিকাতা এবং বাংলাদেশের মুজিবনগর থেকে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশের ব্যবস’া নেওয়া হয়। কলকাতাস’ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব হোসেন আলী ২৬ জুলাই ১৯৭১ বাংলাদেশ মিশনের ৯ সার্কাস এভিনিউ কার্যালয়ে আয়োজিত এ সংক্রান- এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন।

এই ডাকটিকিট প্রকাশিত হওয়ার সংবাদ সারা বিশ্বে যে কতটা প্রভাব বিস-ার করতে সক্ষম হয়েছিল তা ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ঞযব অসবৎরপধহ চযরষধঃবষরংঃ-এর ৮৫বর্ষ ৯ম সংখ্যায় পত্রিকায় নিউইয়র্ক টাইমসের প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড লিডম্যান লিখিত ‘ইধহমষধফবংয: ঞৎবধফ রিঃয ঈধঁঃরড়হ’ প্রবন্ধটি পাঠ করলে অনুধাবন করা যাবে। ঞযব অসবৎরপধহ চযরষধঃবষরংঃ ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ডাকটিকিট সংগ্রহ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান অসবৎরপধহ চযরষধঃবষরপ ঝড়পরবঃু-র মাসিক মুখপত্র।

ডেভিড লিডম্যান লিখেছিলেন :

On July 26 in London, so-called stamps of Bangla Desh appeared. A “first day” ceremony was staged for this so-called ‘definitive’ series. The site was the House of Commons and John Stonehouse, MP, until recently Britain’s Postmaster general and Abu Sayeed Chowdhury, vice chancellor of Dacca University, in East Pakistan, were the principals involved. . . . . these are not postage stamps. They are propoganda labels intended to broadcast East Pakistan’s difficulties to the world. . . . . but they are souvenirs of a dream.

ডেভিড লিডম্যান বিষয়টি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন সাংবাদিকের নিকট জানতে চাইলে নিউইয়র্ক টাইমস্‌-এর নিউদিল্লী ব্যুরো সাংবাদিক সিডনী শনবার্গ জানিয়েছিলেন:

Bangla Desh officials in India insist that the stamps will actually be used as postage in “Liberated areas” of East Pakistan, replacing Pakistani stamps . . . The Bangla Desh officials say a Bangla Desh postal service is already operating in these areas, . . . The Bangla Desh diplomatic mission says it will begin negotiations with the Universal Postal Union to get international recognition for the stamps so that they can be used externally.

নিউইয়র্ক টাইমস্‌-এর ঢাকা ব্যুরো সাংবাদিক ম্যালকম ব্রাউন জানিয়েছিলেন-

Letters bearing Bangla Desh postmarks from Mujibnagar have reportedly appeared in Dacca, presumably delivered by clandestine couriers . . although no one doubts that rebel organization has good internal communications.

নিউইয়র্ক টাইমস্‌-এর লন্ডন ব্যুরো সাংবাদিক এন্তনি লিউইস লিখেছিলেন:

A spokesman for the Steering Committee of Bangla Desh, United Kingdom, observed that the stamps were a symbol of the authority of the Bangla Desh Government over the territories they hold. They claim 78% under their control.

The American Philatelist-এর সম্পাদক বিষয়টি নিয়ে পত্রিকাটির একই সংখ্যায় তার মন-ব্য দেন:

Editors of the Stanley Gibbons Catalogue have announced that pending full investigation they have no present intention to list the Bangla Desh provisional overprints nor the definitive issue which has been promoted through the establishment of agencies in various countries.

উল্লিখিত উদ্ধৃতাংশগুলি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ২৯শে জুলাই ১৯৭১ প্রকাশিত ঐ আটটি ডাকটিকিট কিভাবে বিশ্বের বিভিন্ন স-রের জনমনে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল যা একদল রাষ্ট্রদূতদের দ্বারা এত দ্রুত এবং এতো ব্যপক প্রচারণা করা সম্ভব হতো কি না সন্দেহ।

স্মরণ করা যেতে পারে ইতিপূর্বে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাকামী জনগণ, যেমন, ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণ মালাক্কা প্রজাতন্ত্র (জবঢ়ঁনষরশ গধষঁশঁ ঝবষধঃধহ), নাগাল্যান্ড তাদের স্মাধীনতা সংগ্রামের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সময়ে ডাকটিকিট প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে তাদের সংগ্রাম সফল না হওয়ায় প্রকাশিত এ সব ডাকটিকিট আর আন-র্জাতিক বৈধতা পায়নি। আবার রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেয়ে ও ডাকটিকিট প্রকাশ করেও তা ধরে রাখতে পারেনি এমন দেশও আছে এ পৃথিবীতে, যেমন, আফ্রিকার দেশ বায়াফ্রা।

যদিও স্বাধীন বাংলাদেশের অসি-ত্ব রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল কিন’ প্রকাশের দিন থেকেই এ ডাকটিকিটগুলি সাধারণ জনগণ ও ডাকটিকিট সংগ্রাহকদের মধ্যে অত্যন- জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। বিদেশে, বিশেষ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানীতে সরকারী পর্যায়েও এই বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট সচেতনতার সৃষ্টি হয়।

এ পর্যায়ে জন স্টোনহাউজ মওদুদ আহমদকে একটি চিঠি লিখে অনুরোধ জানান মুজিবনগর সরকার যেন এই সকল ডাকটিকিট লাগানো খামে করে বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে চিঠি লেখেন। জন স্টোনহাউজ তার এই চিঠিতে কয়েকটি ঠিকানাও দেন। তার অনুরোধের ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টের সদস্য ও সরকার প্রধানদের চিঠি পাঠানো হয়। ব্রিটেনের হাউজ অব কমন্‌স সভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কতিপয় পার্লামেন্ট সদস্য মুজিবনগর থেকে প্রেরিত এই সব ডাকটিকিট লাগানো খাম অন্যান্য সদস্যদের দেখাতে থাকেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারকে স্বীকৃতি ও সমর্থন প্রদান, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে অন্য দেশে আশ্রয় গ্রহণকারী বিপুলসংখ্যক স্মরণার্থীদের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান ও তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস’া গ্রহণের জন্য জোর দাবী উত্থাপন করতে থাকেন।

জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলির প্রতিনিধিদেরও এইসব ডাকটিকিট লাগানো খাম দেখিয়ে বাংলাদেশের অসি-ত্বের সমর্থনে দাবী উত্থাপন করা হয় এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে এবং দখলদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত অত্যাচারের কারণে উদ্ভুত সমস্যার সমাধানের জন্য বিভিন্ন সদস্যরাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালানো হয়। এইভাবে এই আটটি ক্ষুদ্র ডাকটিকিট ঐ সময়ে সারা বিশ্বে যথেষ্ট সচেতনতার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনে এই ডাকটিকিটগুলির ভূমিকা হয়ে দাঁড়ায় অত্যন- বলিষ্ঠ।

প্রশ্ন উঠতে পারে জনমানুষের মধ্যে কেন এত উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল এই আটটি ডাকটিকিট? কারণ এই ডাকটিকিটগুলোর বিষয়বস’। ডাকটিকিটগুগুলোর বিষয়বস’র ধারাবাহিকতা মানুষকে বিষ্মিত ও চমৎকৃত করেছিল। এই ডাকটিকিটকগুলোর মধ্যেদিয়ে বিধৃত হয়েছে একটা জাতির ইতিহাস একটা রাষ্ট্রের কথা।

আটটি ডাকটিকিটের মূল্যমান ও নক্সার বিষয়বস’ ছিল নিম্নরূপ:

১০ পয়সার ডাকটিকিটে বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান দেখানো হয়েছে। বিশ্বের জনগণকে চেনানো হয়ছে বাংলাদেশটি কোথায় অবসি’ত।

২০ পয়সা ডাকটিকিটে ওপরে ছোট অক্ষরে লেখা ‘ম্যাসাকার এট’ আর হলুদ অক্ষরে বড় বড় করে লেখা আছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকাণ্ড), এই বড় অক্ষরের ঢাকা ইউনিভার্সিটি শব্দ কটিতে গুলির ফুটো ও রক্ত ফুটে বের হচ্ছে। নীচে আবার একই ছোট অক্ষরে লেখা ‘অন ২৫ – ২৬ মার্চ ১৯৭১’। অত্যন- সাধারণভাবে নক্সা করা এই ডাকটিকিটের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে ভয়াবহ নারকীয়তার কথা।

বিমান মল্লিক বলেছিলেন, ‘খবরের কাগজ ও টেলিভিশনের কল্যাণে পূর্ব বাংলার পরিসি’তির সঙ্গে বেশ ভাল রকম পরিচয় ছিল। মনের মধ্যে একটা বারুদ জমা হচ্ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হত্যাযজ্ঞের ঘটনাটা অবশ্যই অনুপ্রেরণার বারুদে একটুকরো অগ্নিকণার কাজ করেছিল। আটটি ডাকটিকিটের মধ্যে ওটাই আমার সব থেকে প্রিয়।

৫০ পয়সা ডাকটিকিটে বলা হয়েছে বাংলাদেশ একটি ‘৭৫ মিলিয়ন (সাড়ে সাত কোটি) মানুষের দেশ।

১ রুপি মূল্যের ডাকটিকিটে স’ান পেয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা,

২ রুপি ডাকটিকিটে দেখানো হয়েছে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল, যেখানে বলা হয়েছে ৯৮ শতাংশ ভেটি পেয়েছিল আওয়ামী লীগ (অথচ শাসনভার দেয়া হয়নি তাদের হাতে),

৩ রুপি ডাকটিকিটে বলা হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস’ার ঘোষণা দেয়া হয় ১০ এপ্রিল ১৯৭১ আর বিচ্ছিন্ন শৃংখলের মাধ্যমে স্মীকৃত হল পাকিস-ানী শাসনের অবসান,

৫ রুপি ডাকটিকিটে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অবিসম্বাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রতিকৃতি, এবং

১০ রুপি ডাকটিকিটের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানানো হয় “বাংলাদেশকে সমর্থন করুন”।

এ উপলক্ষে যে বিশেষ উদ্বোধনী খামটি উজ্জ্বল কমলা-লাল রঙে লণ্ডন থেকে ছাপিয়ে নেয়া হয়। খামটির বাম পাশে বড় অক্ষরে বাংলায় আড়াআড়িভাবে দুই শব্দে ‘বাংলা দেশ’, খামটির উপরে ইংরেজীতে ‘ÔOfficial First Day CoverÕ এবং নীচে ‘First Issue of stamps from the Government of Bangla Desh’ ছাপা হয়।

কলকাতা থেকে ছাপানো খাম গাঢ় সবুজ রঙে কলকাতার স্বরস্বতি প্রেস থেকে ছাপিয়ে নেয়া হয়। কলকাতার খামের কাগজের মানের তুলনায় ইংল্যাণ্ড থেকে ছাপানো খামের কাগজ লক্ষ্যণীয়ভাবে পৃথক ছিল। যদিও বিমান মল্লিক এ বিষয়ে আপত্তি করেছেন।

আটটি ডাকটিকিট ও লন্ডন থেকে প্রকাশিত খামের নক্সা বিমান মল্লিক করলেও কলকাতা থেকে প্রকাশিত খামটির নক্সা তাঁকে দিয়ে করানো হয়নি, এমনকি এ বিষয় নিয়ে তাকে কোন কিছু জানানোও হয়নি। যতদূর জানা যায়, কলকাতা থেকে প্রকাশিত সবুজ রঙে ছাপা এ খামটি কলকাতার একজন ফিলাটেলি ব্যবসায়ী তৈরি করেন এবং এর সব বিক্রয় ও বিপনন তার মাধ্যমেই পরিচালিত হয় এবং সম্ভবত ডাকটিকিট ও উদ্বোধনী খামের বিক্রয়লব্ধ সমস- লাভ তিনিই আত্মসাৎ করেন। কারণ স্বাধীনতার পর ডাকটিকিট বিক্রয় সংক্রান- কোন অর্থ বাংলাদেশের কোষাগারে জমা হওয়ার কোন তথ্য নেই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই জন স্টোনহাউস বিমান মল্লিককে বাংলাদেশের প্রথম ব্যাংক নোট নক্সা করতে বলেছিলেন।

বিমান মল্লিক বললেন, খবরটা প্রথমে তিনি পেলেন কলকাতার তাঁর এক বন্ধুর মাধ্যমে যিনি দি স্টেটসম্যান পত্রিকার ২৪ ডিসেম্বর সংখ্যাটির বরাত দিয়ে জানালেন, ‘আপনি নাকি বাংলাদেশের ব্যাংক নোটের নক্সা করছেন?’ বন্ধুটি রসিকতা করে পরের বাক্যটি জুড়ে দিয়েছিলেন, ‘তা’হলে তো আপনার অর্থকষ্ট ঘুঁচে যাবে।’

বিমান মল্লিককে কয়েকদিন পরে জন স্টোনহাউজ যোগাযোগ করে বাংলাদেশের ১ টাকা, ৫ টাকা ১০ টাকা ও ১০০ টাকা মূল্যের ব্যাংক নোট নক্সা করে দেওয়ার জন্যে। বিমান মল্লিক বললেন, ‘আমি ব্রিটেনের প্রথম বিদেশী নক্সাকার, সম্মান ও পুরস্কারও পেয়েছি এর জন্যে। বাংলাদেশের ডাকটিকিট নক্সা করেছি মনের আবেগে। এর জন্যে কোন পারিশ্রমিক নিতে আমার মন সরেনি, আমি নেইওনি। কিন্তু ব্যাংক নোট নক্সার অভিজ্ঞতা ছিল না। কারণ ব্যাংক নোট নক্সা করার সময় কিছু নান্দনিক, অথচ কিছু প্রাযুক্তিক দিক লক্ষ্য রাখতে হয়। স্টোনহাউস বিমান মল্লিককে ব্রিটেনের বিখ্যাত টমাস ডি ল্যা রু নিরাপত্তা ছাপাখানায় যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন, যাতে বিমান মল্লিক ব্যাংক নোট নক্সার বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন। এখান থেকেই ১৮৪০ সালে ব্রিটেনের, ১৮৫৪ সালে ভারতের এবং ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম ডাকটিকিট ছাপা হয়েছিল।

বিমান মল্লিক বললেন, ‘এক টাকার ডিজাইনে এঁকেছিলুম বাঘের মুখ, দুই টাকার ডিজাইনে এঁকেছিলুম দুটি আম, পাঁচ টাকার ডিজাইনে এঁকেছিলুম পদ্মানদীতে পালতোলা নৌকা, আর দশ টাকার ডিজাইনে এঁকেছিলুম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। তখন একশ’ টাকার ডিজাইন করিনি।’

অবশেষে, বিমান মল্লিক স্টোনহাউজকে চারটি নোটের প্রেজেন্টেশন রাফ ডিজাইন করে দিলেন। হাতে ধরলে মনে হবে প্রকৃত নোট। কিন্তু এর সাথে যুক্ত করতে হবে নানা প্রযুক্তিগত বিষয়। ডিজাইনগুলো তাঁর ভাল লেগেছিল।

স্টোনহাউস নক্সাগুলি নিয়ে কি করলেন, তা আর জানা গেল না। আদৌ তা ঢাকার মন্ত্রীসভার কাছে অথবা বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উর্ধদন কর্মকর্তার বরাবর উপস্থাপিত হয়েছিল কি না, তাও জানা গেল না। পুরো বিষয়টা একেবারেই হারিয়ে গেল।

স্বাধীনতার পর জন স্টোনহাউজ ১৯ ডিসেম্বর হেলিকপ্টর যোগে ঢাকায় এসে উপস্থিত হয়ে তাজউদ্দিন আহমেদের সাথে দেখা করলেন, তাকে বাংলাদেশের প্রথম আটটি ডাকটিকিট ও ‘বাংলাদেশের মুক্তি’ অতিরিক্ত ছাপ দেওয়া তিনটি ডাকটিকিট দেখালেন। তার সম্মতিতে স্টোনহাউস বাংলাদেশ ডাকবিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সর্বোচ্চ কর্মকর্তা এ.এম. আহসানউল্লার সাথে দেখা করে ডাকটিকিটগুলি জমা দিলেন। তিনি তড়িঘড়ি করে বিমানে এসেছিলেন বলে সঙ্গে করে এই ডাকটিকিটগুলির অতি অল্প পরিমান আনতে পেরেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন শীঘ্রই বাকী ডাকটিকিটগুলি ঢাকায় পৌঁছে দেওয়া হবে।

বিমান মল্লিক বললেন, ‘১৭ ডিসেম্বর আমার জন্মদিন। ঐ দিন সকালে স্টোনহাউজ জানালেন, বাংলাদেশ মুক্ত স্বাধীন (Liberated) হয়েছে। আমার মনে হলো এ সংবাদ আমার জন্মদিনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। যারা এতকাল বাংলাদেশের আটটি ডাকটিকিটকে ‘লেবেল’ বার ‘স্টিকার’ বলতো, তারা আজ স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে এগুলি এখন স্বাধীন দেশের ডাকটিকিট।’

বিমান মল্লিকের হোটেল কক্ষ থেকে সেদিন বের হয়ে এসেছিলাম রাত তখন প্রায় বারটা। তাঁর ব্যবহারে আমি মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে ছিলাম। আমার ধারণা ছিল একজন চিত্রশিল্পী ও এতবড় ইতিহাসের একজন শ্রষ্টার তার ‘গরমে’ বোধ হয় কেবল দুই-একটি তথ্য অবজ্ঞাভরে জানিয়েই পত্রপাঠ বিদেয় দেবেন। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট ও কাগজি মুদ্রা সংক্রান্ত যে বিপুল তথ্য আমি পেলাম তা সত্যিই অবিশ্বাস্য! আমার ডাকটিকিটের ইতিহাস বইটির মুক্তিযুদ্ধকালীন অংশটি আবার নূতনভাবে লিখতে হবে। সংযোজিত করতে হবে অনেক অজানা তথ্য।

পরিশেষে উল্লেখ করতে চাই, এখনও বিমান মল্লিক আমাকে ই-মেইলের মাধ্যমে নানা তথ্য দিয়ে চলেছেন। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে তাঁর হাত দিয়ে যে বাংলাদেশের অনন্যসাধারণ ইতিহাস রচিত হয়েছিল তাঁর সে বদান্যতায় তাঁকে ধন্যবাদ। জাতি চিরজীবন তাঁকে স্মরণ করবে শ্রদ্ধায়, ভালবাসায়।

Leave a Reply