রহস্যময় এক দ্বীপ হাতিয়া। সম্পদে ভরপুর হাতিয়ার রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। রয়েছে হাজারও সমস্যা। অফুরন্ত সম্ভাবনার হাতিয়াকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বেশকিছু দস্যুবাহিনী।
প্রমত্তা মেঘনা আর বঙ্গোপসাগরের মিলনের বিশাল জলরাশির প্রচণ্ড দাপটের মুখে গড়ে ওঠা খনিজ ও প্রাণিজ সম্পদ আর হাজারো রকম উদ্ভিদে ভরপুর এক দ্বীপ হাতিয়া। যেন সাগরের বুকে আরেক খণ্ড বাংলাদেশ। এই দ্বীপের পত্তন কখন হয়েছিল তা আজও রহস্য। কিন্তু প্রকৃতির ভাঙা-গড়ার খেলায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে এই দ্বীপের মানচিত্র। দূর থেকে দেখে দ্বীপটিকে মনে হয় বিস্তর জলরাশির মধ্যে নৃত্যরত এক ডলফিন। মূল ভূখণ্ডের চারদিকে জেগে ওঠা অন্তত ৩৫টি ছোট-বড় চর সে কথাই জানান দেয়। সমুদ্রের লোনা পানির মধ্যে দ্বীপের ভেতরকার জলাশয় ও খালগুলো আবার মিঠাপানির সংরক্ষণাগার। তাই রহস্যদ্বীপ হাতিয়া যেন স্রষ্টার অপার এক রহস্যময় সৃষ্টি।
হাতিয়ায় প্রকৃতির ভাঙা-গড়ার কারণে এক থেকে দেড়শ’ বছরের পুরনো কোনো নিদর্শন অবশিষ্ট নেই। দীর্ঘদিন ধরে দেশি-বিদেশি অনেক গবেষক হাতিয়ার ওপর গবেষণা করেছেন। তাদের মধ্যে সুরেশ চন্দ্র দত্ত কিছু যুক্তি দিয়ে হাতিয়ার বয়স অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। দক্ষিণবঙ্গের ভূ-ভাগ সৃষ্টির রহস্য নিয়ে তার গবেষণায় তিনি উল্লেখ করেছেন, প্রতি ১৩৬ থেকে ১৪০ বছর সময়ের মধ্যে এক মাইল স্থলভাগ সৃষ্টি হয় হাতিয়ায়। তার এ তথ্য আমলে নিয়ে হাতিয়ার বর্তমান আয়তনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে হাতিয়ার বয়স সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার বছর বলে ধারণা করা হয়।
বর্তমানে নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত হাতিয়ার চৌহদ্দি নিরূপণ করলে দেখা যায়, হাতিয়ার উত্তরে সুধারাম, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে সন্দ্বীপ এবং পশ্চিমে মনপুরা ও তজুমদ্দিন উপজেলা। এক সময় সন্দ্বীপের সঙ্গে হাতিয়ার দূরত্ব ছিল খুবই কম। ভোরবেলায় হাতিয়া থেকে মোরগ ডাকলে সন্দ্বীপের মানুষ শুনতে পেত। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই দূরত্ব এখন ৬০ মাইল ছাড়িয়েছে। ক্রমাগত ভাঙনই এ দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। হাতিয়ার ভাঙা-গড়ার খেলা চতুর্মুখী দোলায় দোদুল্যমান। উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম দিক দিয়ে ভাঙছে। আবার দক্ষিণে গড়ছে, পাশাপাশি আবার মূল ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে আশপাশে ছোট-বড় নানান ধরনের চর জেগে উঠছে। ভাঙা-গড়ার এই খেলায় হাতিয়ার ভূ-ভাগ কমছে না, বরং দিন দিন বাড়ছে একটু একটু করে। হাতিয়ার আশপাশে জেগে ওঠা চরগুলোর মধ্যে রয়েছে—চরবাটা, চর আমানুল্লা, চর নাগালিয়া, চর ক্লার্ক, চরযাত্রা, চর এলাহী, বুড়িরচর, মনপুরা, কাঙালির চর, চর দর্জি, চর বালুয়া, চর লেংটা, চর অ্যাঙ্গুইড্যা, টুম, মগ্নি, জোগিনী, সাহেবানীর চর, চর বসু, জাহাজমারার চর, রাঙাবালির চর, চর আফজাল, চর আকরাম উদ্দিন, চর আলেকজান্ডার, চর জুবলি, চর লালমোহন, চরচেঙ্গা, কমলার চর, কালির চর, বৃকচচু। দ্বীপের মূল ভূখণ্ডসহ চরগুলোকে কেন্দ্র করে হরণী-চানন্দী, সুখচর, নলচিরা চর ঈশ্বর, চর কিং, তমরদ্দি, সোনাদিয়া, বুড়ির চর এবং জাহাজ মারা—এ নয়টি ইউনিয়ন নিয়ে হাতিয়া উপজেলা। এর মধ্যে হরণী ও চানন্দী দুটি পৃথক ইউনিয়ন ছিল। ১৯৯০ সালের ভাঙনে এ দুটি ইউনিয়ন সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু হাতিয়ার ঐতিহ্যবাহী ইউনিয়ন দুটির নাম টিকিয়ে রাখার জন্য কিছু ছোট ছোট চর একত্র করে হরণী-চানন্দী নামের একটি ইউনিয়ন গঠন করা হয়েছে। সম্প্রতি এই ইউনিয়নের প্রশাসনিক স্বীকৃতিও মিলেছে।
ওয়েব স্টার নামের একটি সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৮৯০ সাল থেকে হাতিয়ার আদি ভূখণ্ডের উত্তর ভাগের ভাঙন শুরু হয়। বিরাট আয়তনের জমি নদী ও সাগরের ভাঙনে বিলুপ্ত হলেও একই সময় দ্বীপের উত্তর দিকে হাতিয়ার আয়তন ভাঙনের প্রায় ২ থেকে ৫ গুণ হারে বাড়তে শুরু করে। সেই সময় এ অঞ্চলের জেগে ওঠা চরের যে হিসাব পাওয়া যায় তা হলো : ফেনী নদীর মুখে ৫টি, হাতিয়া দ্বীপের সম্প্রসারণ ১৮টি, হাতিয়া চ্যানেলে ৫টি, মেঘনার বুকে ৩টি ও ডাকাতিয়া নদীর মুখে ৩৫টি চর সৃষ্টির প্রক্রিয়া হাতিয়ার মোট আয়তনকে পরিবৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে। ১২০ বছরের ব্যবধানে হিসাব-নিকাশে ঢের পরিবর্তন এসেছে। অনেক চর মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, কিছু কিছু আবার ভাঙনের কবলে পড়ে হারিয়ে গেছে। ক্রমাগত ভাঙনের কারণে সঠিক আয়তন নির্ধারণ করা কঠিন হলেও উপজেলা পরিষদের হিসাব মতে হাতিয়ার বর্তমান আয়তন ২১শ’ বর্গকিলোমিটার বলে উল্লেখ আছে।
হাতিয়ার বিভিন্ন সংগঠন থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন, সাবেক উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আমীন রচিত ‘তিলোত্তমা হাতিয়া : ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ বই ও দ্বীপের প্রবীণদের কাছ থেকে হাতিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে জানা গেছে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ শতাব্দীর দিকে বঙ্গোপসাগর আর মেঘনার মোহনায় গড়ে ওঠা সবুজে ঘেরা দ্বীপটি মানুষের নজরে আসে।
কিংবদন্তি রয়েছে, পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে বার আউলিয়া নামে খ্যাত বারজন আউলিয়া মাছের পিঠে সওয়ার হয়ে বাগদাদ থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে হাতিয়ায় বিশ্রাম নিয়েছিলেন। বিশ্রামকালে সন্দ্বীপ-হাতিয়ার অনেক মানুষ তাদের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। হজরত সুলতান ইব্রাহীম বলখি মাহীসাওয়ারও মাছের পিঠে চড়ে হাতিয়ায় এসেছিলেন। বিখ্যাত সাধক বায়েজিদ বোস্তামী এবং হজরত শাহ আলী বোগদাদি হাতিয়ায় কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। এর পর থেকে হাতিয়ায় প্রচুর আরব সাধক এসেছিলেন। সর্বশেষ একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের চারশ’ বছর আগে ৭ম শতাব্দীতে কিছু আরব বণিক ধর্ম প্রচারের জন্য সমুদ্রপথে চট্টগ্রামে যাওয়ার সময় মনোরম এই দ্বীপটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দ্বীপে কিছুকাল অবস্থান করেন। এসব আরব বণিক ও সাধক দ্বীপে বসবাসরত কিরাত সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষদের মাঝে ইসলামের আলো ছড়ান। ইতিহাসে বাংলাদেশে ইসলামের প্রবেশদ্বার হিসেবে চট্টগ্রামকে ধরা হলেও হাতিয়াতেই ইসলামের সূত্রপাত হয় বলে বিশ্বাস করেন দ্বীপের মানুষেরা। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে এখানে একটি বৃহত্তম জামে মসজিদ গড়ে ওঠে। এটিই ছিল হাতিয়ার ঐতিহাসিক প্রথম জামে মসজিদ। নির্মাণের প্রায় ৮০০ বছর পর ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৮ সালে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মজিদের নকশায় পুরনো সেই মসজিদের আদলে মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন হিসেবে এখানে আরেকটি মসজিদ গড়ে তোলা হয়। হাতিয়াবাসীর গর্ব আর পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত মসজিদটি অক্ষত ছিল।
প্রাচীনকাল থেকেই দ্বীপবাসী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী। তবে দ্বীপের শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নে আজাহার মিয়া, আফাজ মিয়া, মফিজ মিয়া, নবীর উদ্দিন সাফদার ও তাদের পরিবারের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। পুরো হাতিয়ায় তারা ১০০টিরও বেশি মসজিদ, ২০টিরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২টি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাছাড়া এই পরিবার হাতিয়ার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত অনেক মাদরাসা, মক্তব, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বিনির্মাণ, প্রচার ও প্রসারে সাহায্য করেছেন। শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে এদের আধুনিক হাতিয়ার পথিকৃত বলা যায়। হাতিয়াবাসীও শ্রদ্ধাভরে তাদের স্মরণ করেন। হাতিয়ার মানুষ খেলাধুলার প্রতি খুবই আগ্রহী এবং অনুরক্ত। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে হাতিয়ায় ফুটবল খেলার প্রচলন শুরু হয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে এখানে ক্রিকেট খেলাও হতো। ক্রিকেট, ফুটবল ছাড়াও হাতিয়ায় অন্য যেসব খেলার প্রচলন ছিল সেগুলোর মধ্যে ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, বলী খেলা, মোষের লড়াই, হা-ডু-ডু, বউমারানি, মানদুরুস, ছুডাছুডি, ডংছাডা, ছাগুলাইরে ভাই, টুগুলি, এচকিমেচকি, ভাইটাগুলি, বাগকাডাকাডি, হাঁইতাঁহাঁইতি, মোনকামানী, চাঁরাখেলা, নুনগুজানি, একাদোকা খেলা অন্যতম।