রংধনু এডভার্টাইজার্স – সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান ৯


হঠাৎ সকালে সিঁড়িতে দেখা মেয়েটার কথা মনে পড়ে যায় সুলতানের। মিঠুর মার কাছে কি কোন খবর পাওয়া যাবে? খেয়ে উঠে বেসিনে হাতমুখ ধুতে ধুতে মিঠুর মাকে সুলতান বলে, ‘বাসনপত্র গুছিয়ে, ঘরে এসো একটু, কথা আছে।’
বলেই মনে হয় মিঠুর মা তো খায়নি। ও না খেলে মিঠুর মা কখনো খায় না। তাই আবার বলে, ‘খেয়ে নিয়ে আসবে, কিন’।’

ঘরে ঢুকে ক্যাসেটটা চালিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে ও, কেমন যেন আলস্য লাগছে ওর, অন্য দিন হলে বই নিয়ে বসতো। আজকে কেন যেন অন্য রকম লাগছে, খুব শ্রানি-, খুব অবসাদ সারা দেহ জুড়ে আছে।
ক্যাসেটে গান বাজতে থাকে-
‘সখি, ভাবনা কাহাকে বলে, সখি যাতনা কাহাকে বলে
তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালবাসা, ভালবাসা
সখি ভালবাসা কারে কয়? . . . .’

মিনিট পনেরো পরে মিঠুর মা ঘরে ঢুকতে সুলতান উঠে বসে।
‘তোমাকে একটা কাজ করতে হবে, এখন।’
‘কি কাজ, বাবা?’
‘উপর তলায় একটা মেয়ে এসেছে, দেখেছো?’
‘হ্যাঁ, দিন চারেক হলো এসেছে. আফজাল সাহেবের বাসায়।’
‘আফজাল সাহেবের বাসায়? তুমি ঠিক জানো?’ সুলতান অবাক হয়।
‘হ্যাঁ, আমার সামনে দিয়েই তো এলো। আমার সাথে ওর কথাও হয়েছে।’
‘মেয়েটাকে এখানে আসতে বলবে, বলবে সকালে যার সাথে দেখা হয়েছিল সিঁড়িতে সে কথা বলতে চায়। আফজাল সাহেব যদি না থাকে তাহলেই বলবে।’
‘এখন ডাকবো?’
ঘড়ির দিকে তাকায় সুলতান, তিনটে বাজে।
‘এখন যদি পারে ভালো, না হলে কখন সময় হবে শুনে আসবে।’

মিঠুর মা চলে যেতে ঘরের চারদিকে চোখ বোলায় সুলতান। এখানে? না ড্রইংরুমে বসে কথা বলবে ভাবলো একটু। তারপর যেমন ছিল, তেমনি বসে থাকলো।
মিনিট পাঁচেক পরে মিঠুর মা-র পিছনে পিছনে মেয়েটি এসে ঘরে ঢোকে। পরনে গোলাপী একরঙা শাড়ী, একই রঙের ব্লাউজ, চুল ছাড়া। পাতলা স্যান্ডেল ছাড়া দেহের আর কোথাও কোন গহনা নেই। এখন ওকে আরও সুন্দর লাগছে।
সুলতান উঠে দাঁড়ায়, ‘বসুন, সকালে আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর আপনার সাথে একটু আলাপ করতে ইচ্ছে হলো। খবর পাঠালাম বলে কিছু মনে করেননি তো?’
সামনের চেয়ারে আলতো করে বসতে বসতে মিষ্টি করে হাসলো মেয়েটি, ‘নাহ।’
মিঠুর মার দিকে তাকিয়ে সুলতান বলে, ‘কিছু স্ন্যাক্‌স্‌ দাও আর ঠান্ডা লস্যি বানাও ভালো করে।’
‘ও সব কিছু লাগবে না। আমি এখন কিছু খাবো না।’ মেয়েটি বলে।
মিঠুর মা যেতে যেতে বলে, ‘আপনি মেহমান, কিছু না খেলে বাড়ীর অকল্যাণ হবে না?’
সুলতান হেসে বলে, ‘তা’ হলেই বুঝুন।’
মিঠুর মা চলে যেতে কিভাবে কথাটা বলবে বুঝে পায় না সুলতান।
‘আমি সুলতান মাহমুদ। মানে . . .’
‘আপনার নাম জানতাম না, তবে আপনাকে আমি চিনি।’ মৃদু গলায় মেয়েটি উত্তর দেয়।
‘কি ভাবে?’
‘টিভিতে আপনাকে দেখেছি, ইসুজুর বিজ্ঞাপনে।’
‘ওটা আমার সবচেয়ে বাজে ছবি। আরও কয়েকটা আছে।’
‘আমারও খুব সখ মডেলিং করি।’
‘করতে চান?’ খুশি হয়ে ওঠে সুলতান।
‘হ্যাঁ, কাজটা একটু অন্য রকম। মানে – আমাকে টিভি, সিনেমাতে দেখা যাবে, একথা মনে করে কিন’ বলছি না, কিংবা অনেক টাকা পাওয়া যাবে বলেও না। কাজটাই – আসলেই বেশ একটু আলাদা রকম – ব্যতিক্রমী – তাই না?’
‘সেইজন্যেই আমি এর মধ্যে কাজ করি। আপনি মডেলিং করতে চান, সত্যি?’
‘আপনার কোন সোর্স আছে?’
‘সোর্স মানে? জানেন . . ’
একটু থামে সুলতান, ‘মানে, আপনার নাম কিন’ আমি জানি না। কি বলে ডাকবো আপনাকে?’
হেসে ফেলে মেয়েটি, ‘আমি রায়না। রায়না নাসরিন।’
‘জানেন রায়না, আজ সকালে আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর আপনার কথা বার বার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কেন তা বলতে পারবো না। তারপরেই, কি আশ্চর্য জানেন, হাতে একটা বড়ো কাজ পেয়ে গেলাম। রংধনু এড্‌ভার্টাইজার্স-এর সাথে আমি বহুদিন ধরে কাজ করছি। ওরা নতুন চেহারা খুঁজছে। আমাকে ওরা বললো একজন মেয়ে ওদের দরকার। আপনি যদি সত্যিই আগ্রহী হন, তা’হলে আপনাকে একটা ব্রেক দিতে পারি।’
একটু ইতঃস্তত করে রায়না, ‘কিন’ . . .’
সুলতান বলে, ‘আফজাল সাহেব আপত্তি করতে পারেন বুঝি, আমি না হয় ওর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবো, ওর পারমিশন নিয়ে নেব। আমি অবশ্য ওকে খুব একটা পছন্দ করি না।’
রায়না কেমন যেন বেশ সস্ত্রস্ত্র হয়ে ওঠে, ‘না, না ওকে কিছু বলবেন না আপনি। ওকে যা বলার আমিই বলাবো।’
‘তা’হলে কাজটা করতে আগ্রহী আপনি?’ সুলতান প্রশ্ন করে।
রায়না উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ, আপনি যদি সহযোগিতা করেন।’
‘অবশ্যই করবো।’

মিঠুর মা প্লেটে কিছু নিমকি আর চানাচুর আর দুই গ্লাস লস্যি বরফ দিয়ে নিয়ে আসে। নিমকির প্লেটটা রায়নার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সুলতান বলে, ‘নিন। কাজটা কিন’ খুব একটা ছোট না। পার্ল কস্‌মেটিকস্‌ এর নাম তো শুনেছেন – ওদের কয়েকটা প্রডাক্ট আর লোকস্বাস’্য লিমিটেড-এর কয়েকটা প্রেডাক্ট। কাল যদি আপনার সময় হয়, তবে আমার সাথে চলুন, পরিচয় করিয়ে দেবো ওদের সাথে, ঐ সাথে কন্টাক্টও সাইন করে আসবেন।’
রায়না অবাক হয়ে জিঞ্জেস করে, ‘সাথে সাথে কন্টাক্ট সাইন হয়ে যাবে?’
‘অবশ্যই। আমি যাকে রেকমেন্ড করবো, তাকে ওরা নেবেনই। ইন ফ্যাক্ট ওরা সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। কালকে কখন যেতে পারবেন?’
‘এই, সাড়ে দশটা – এগারোটা নাগাদ হলে চলবে?’
‘ঠিক আছে, আপনি তৈরী হয়ে থাকবেন, আমি খবর দেবো, যাবার আগে। এইরকম সিম্পল পোষাকেই আসবেন। কোন মেকআপ নেবেন না। চুল যেন ভিজে না থাকে আর আজকের মতো ফ্ল্যাট স্যান্ডেল পরবেন। ঠিক আছে?’
ঘাড় নেড়ে উঠে দাঁড়ায় রায়না, ‘আমি আসি তা’হলে?’
সুলতান বলে, ‘আর একটু বসবেন না?’
হাসে রায়না, ‘আজ না, আর একদিন। চলি।’

ফ্ল্যাটে ঢুকে রায়না সোজা শোবার ঘরে এসে বিছানার উপরে ধুপ করে বসে পড়ে। কোথা থেকে কি হয়ে গেল। অবাক হয়ে ভাবে ও ।

গত পনেরো দিনের ঘটনাগুলোর দ্রুততা আর অস্বাভাবিকত্বে কেমন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো ও। এখন ডুবন্ত মানুষের মতো যে কুটোটা ধরার জন্য হাত বাড়ালো আজ, সেটা যদি সত্যিই একটা তুচ্ছ কুটো হয়? তা’ছাড়া হাতই বা ও নিজে বাড়ালো কোথায়? মাত্র তিন-চার দিনের মধ্যেই এধরনের একটা বিকল্প ব্যবস’া, একটা নিশ্চয়তার ক্ষীণ আশ্বাস, সত্যিই অবিশ্বাস্য।
একবার মনে মনে ভাবলো, এখনই গিয়ে সুলতানকে সব ঘটনা খুলে বলে। এই দুর্বিসহ অবস’া থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। আফজাল সাহেবের কাছ থেকে ও যে কয়েকটা দিন ভিক্ষে চেয়েছে, তার আগেই যদি মুক্তি পাওয়া যায়? যে অতল গহ্বরে ও আর দু’দিন পরেই তলিয়ে যাবে তার থেকে কিভাবে নিজেকে বাঁচাবে ভাবতে গিয়ে বুকে ভেতরটা হীম হয়ে আসে ওর। শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে কয়দিন ঠেকাবে আফজাল সাহেবকে? তিন দিন, পাঁচদিন? তারপর?

কলিং বেলের শব্দে চমকে ওঠে রায়না। ঘড়ির দিকে না তাকিয়েই বোঝে আফজাল সাহেব এসেছেন। উঠে দরজা খুলে দেয় রায়না।
ওর দিকে তাকিয়ে চোখদুঠো চক্‌চক্‌ করে ওঠে আফজালের। খশ্‌খশে গলায় বলেন, ‘ইউ আর রিয়ালী বিউটিফুল।’
হাত বাড়িয়ে রায়নার কাঁধের উপরটায় চাপ দেয় আফজাল।
কাঁধটা ছাড়িয়ে নিয়ে শান্ত গলায় রায়না, বলে, ‘আমি আমার কথা রেখেছি আর আপনারটা রাখতেই বুঝি আপনার কষ্ট হচ্ছে?’

Leave a Reply