রংধনু এডভার্টাইজার্স – সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান ৮


শাহেদের সাথে আগেও আলাপ ছিল সুলতানের। বেশ হাসিখুশী, তাই ভাল লেগেছিল। কিন’ আজ ওর গম্ভীর নির্লিপ্ত ব্যবহারে বিরক্ত হলো ও। ভাবলো না হয় প্রমোশন পেয়ে বড় অফিসার হয়েছেন, তাই বলে আমি তো আর আপনার কর্মচারী নই যে, আমার সাথে এভাবে ব্যবহার করবেন উনি। কাজগুলো বুঝে নিয়ে অহেতুক বাক্য ব্যয় না করে আবার রেহানার চেম্বারে এলো সুলতান। বসতে বসতে এই কথাটাই জিজ্ঞেস করলো সুলতান, ‘ভদ্রলোকের বুঝি ডিসপেসশিয়া হয়েছে?’
‘এ কথা কেন?’ রেহানা হেসে ফেলে।
‘ওর ব্যবহার আমার কাছে খুব খারাপ লাগলো আজ।’
‘হায়ার অথরিটির সাথে গোলমাল বেঁধেছে ওর।’
একটু থেমে রেহানা আবার বলে, ‘তোমাকে একটা কথা বলি সুলতান, সব সময়ে মনে রাখবে কথাটা, ভবিষ্যতে বহু লোকের সাথে মিশতে হবে, কাজ করতে হবে তোমাকে। যদি ন্যয়নীতি মেনে চলতে চাও, তাহলে কোনও মতেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে না, গোলমাল বাধবেই। যদি এই সব গোলমাল রেজিস্ট করার, প্রতিহত করার ক্ষমতা থাকে, সহ্য করার মতো মনের জোর থাকে, তাহলে ভালো, ন্যায়নীতিকে ধরে রাখতে কষ্ট হবে না তোমার, বিবেকের কাছেও ভালো থাকবে। কিন’ যদি গোলমাল আর ঝামেলা এড়াতে চাও কিংবা এগুলো প্রতিহত করার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে ন্যায়নীতি বিসর্জন দিতে হবে। যেটাতে তোমার উন্নতি, আর্থিক বলো, সামাজিক বলো, সেটা করতে গিয়ে, যা ইচ্ছে তাই করতে হবে- অবশ্য বিবেকের তাড়ানায় তোমাকে ক্ষত বিক্ষত হতে হবে অথবা বিবেকটাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে হবে, হতে হবে অমানুষ।’
সুলতান বলে, ‘বুঝলাম, ভদ্রলোক তার বিবেককে মেরে ফেলতে পারেননি?’
রেহানা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘এক্‌জাক্‌ট্‌লি।’
সুলতান পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘আপনার?’
কপালে ভাঁজ পড়ে রেহানার, ‘আমার মানে?’
‘আপনি কোন দলে?’
রেহানা হাসে, ‘আমি নিজেকে রবোটের মতো করে ফেলেছি। ন্যয়, নীতি, ধর্ম, আদর্শ, বিবেক, কোন কিছু বুঝি না আমি। আমার সামনে কাজ আসবে, যেভাবে করতে বলবে, সেভাবেই করবো। আমার কাছে কাজ – ইজ্‌ – কাজ। জুতো সেলাই বলো আর কোরান পড়াই বলো। কাজ ভালো, কি মন্দ, সৎ. কি অসৎ, কিছু দেখবো না।’
আপনি ‘র্যা শনালিটির দাম দেবেন না?’
‘র্যা শনালিটি? মাই ফুট! প্রাণী জগতের প্রধান কাজ জীবনধারণ করা, যেভাবে হোক বেঁচে থাকা, খাদ্য গ্রহণ করা। কিভাবে, সেটা গরুও দেখে না- বাঘ, সাপ, শেয়ালও দেখে না। মানুষ কি তার থেকে খুব একটা আলাদা ধরনের প্রাণী?’
‘পেটে খাবার ঢোকানোই কি মানুষের একমাত্র কাজ?’
‘নয় কেন? খাবার ছাড়া তুমি বাঁচবে? দুই বেলা ঐ পাকস’লীর গর্তের ভেতরে ছাইপাশ ঢোকাতেই হবে তোমাকে, যা পারো, যেভাবে পারো। যদি না পারো সব মানুষই তোমাকে ঘৃণা করবে- তোমার বাবা-মা-স্ত্রী-বন্ধু- সবাই। না খেয়ে মরবে তো শুধু পশুরা। ওখানেই তো মানুষের র্যা শনালিটি -টু ফিল ইট্‌স্‌ বেলী -বাই হুক অর বাই ক্রুক। ওখানেই মানুষের মসি-ষ্কের শ্রেষ্ঠত্ব। ন্যায়, নীতি, ধর্ম, আদর্শ, বিবেক দিয়ে কি করবে মানুষ, যদি দু’বেলা নিজের পেটই না ভরাতে পারলো?’
সুলতান মন-ব্য করে, ‘তবু তো প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে?’
‘যেমন?’
‘যেমন অন্য পশুর মতো তো যা’ তা’ খেতে পারে না মানুষ . . ’
সুলতানকে থামিয়ে দিয়ে রেহানা বলে, ‘আরে, সেই জন্যেই তো ঐ র্যা শনালিটির কথা আসছে। পশুর চেয়ে মানুষ পৃথক এখানেই। হি হ্যাভ টু ডু এনিথিং, বিকজ হি ওয়ান্টস টু ফিল হিজ বেলি উইথ কুক্‌ড্‌ ফুড। যাকগে, বাদ দাও ওসব কথা। স্পেসিফিকেশন তো পেয়ে গেলে- আমরা জুলাই-এর মধ্যে প্রডাক্টগুলো বাজারে ফ্লোট করতে চাই, তার আগেই – ধরো বাই মিড্‌ জুন তোমার জিনিস তেরী হতে হবে, ওকে?’
‘ধরে নিন, তৈরী হয়ে গিয়েছে।’ সুলতান হাসে।
‘আই নো সুলতান, ইউ আর প্রম্পট এন্ড এফিসিয়েন্ট। মাঝে মাঝে কাজ ছাড়া
আসবে কিন’। আই শ্যাল এক্সপেক্ট ইউ, অল দ্য টাইম।’
‘আসি রেহানা আপা।’
‘এসো।’

রেহানার সাথে সুলতানের এই আপন সম্পর্ক ওর সাথে পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই। বছর দুই আগে যখন ও প্রথম লোকস্বাস’্য লিমিটেড-এ গিয়েছিল ওখানকার কোন কাজ ধরা যায় কিনা দেখতে। অফিস থেকে রেহানার সাথে দেখা করতে বলাতে ও রেহানার টেবিলের সামনে গিয়ে দেখে রেহানা ঘাড় নিচু করে একটা ফাইলে কিছু লিখছে।
কেউ এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পেরে ওকে অফিসের পিয়ন মনে করে মাথা না তুলেই রেহানা বলেছিল, ‘এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো তো কাদের, তাড়াতাড়ি।’
রাগ না করে সুলতান রসিকতা করেছিল, ‘পানি আনবো, গ্লাস কই।’
অসন’ষ্ট হয়ে রেহানা মুখ না তুলেই বলেছিল, ‘গ্লাস কি আমি বাসা থেকে এনে দেবো?’
সুলতানও তেমনিভাবে উত্তর দিয়েছিল, ‘আমার বাসা থেকে গ্লাস আনতে হলে এখন আমাকে লালমাটিয়ায় যেতে হবে, অতদুর এখন যেতে পারবো না যে।’
এতক্ষণ পর মাথা তুলে সুলতানকে দেখে অপ্রস’ত হয়ে যায় রেহানা, ‘সরি, আমি একদম খেয়াল করিনি, প্লিজ মাফ করবেন। আমি -মানে- এতো আনমাইন্ডফুল ছিলাম।’
‘না, না, ঠিক আছে, আমার খুব ভালো লাগছিল। আমাকে তুমি বলার লোক তো তেমন নেই খুব একটা। তবু আজ একটা হলো।’
‘আপনি কিছু মনে করেন নি তো?’
‘করবো, যদি আবার আপনি বলেন, আপনি আমার বড় বোনের মতো, আমার বোন ভাই কোনটাই নেই, আপনি সেই জায়গাটা দখল করলে আমি খুব খুশী হবো।’
প্রায় না হওয়া কাজই সুলতান পেয়ে গিয়েছিল। রেহানাই ওর হয়ে অনেক খেটেছিল। অবশ্য ওর কাজ দেখে পরে ঐ অফিসের সবাই খুশী হয়েছিল। সবচেয়ে বেশী খুশী হয়েছিল রেহানা। বলেছিল, ‘আমারও কোন ভাই-বোন নেই, তোমাকে পেয়ে খুব খুশী লাগছে।’
ঘটনাটা মনে করে এখনও মাঝে মাঝে অবাক হয় সুলতান, কার সাথে যে কখন কিভাবে পরিচয় হয়ে যায়!

মিনি অস্টিনটা গ্যারেজে ঢুকিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ে সুলতান, কাপড়-জুতো না খুলেই। অনেক দিন পর আজকে মনটা খুব হালকা লাগছে। দু’মিনিটেই চোখ বুজে এলো ওর।
মিঠুর মা দরজা খুলে দিয়েছিল সুলতান আসাতে। ওকে ঘরে যেতে দেখেই টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছিল। কতক্ষণ পর কোন সাড়া-শব্দ না পেয়ে অবাক হলো। অন্যান্য দিন বাসায় ফিরে মুখ-হাত না ধুয়েই খেতে বসে সুলতান। আজকে এতক্ষণ ঘরে কি করছে?
এগিয়ে গিয়ে ঘরের পর্দা সরাতেই ওর চোখে পড়লো বিছানার হাত-পা ছড়িয়ে প্রায় নিস্পন্দভাবে পড়ে আছে সুলতান। শঙ্কিত হয় মিঠুর মা। গত কয় বৎসর ও একদিনের জন্যও সুলতানকে দুপুরে বিছানায় শুতে দেখেনি ও। শরীর খারাপ?

দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে কপালে হাত রাখে ও।
চমকে ওঠে সুলতান, ‘কে? ও, মিঠুর মা? কি ব্যাপার?’
‘শরীর খারাপ লাগছে? শুয়ে আছো কেন?’
‘নাহ্‌। শরীর ভালোই আছে।’ ঝিমানো গলায় সুলতান উত্তর দেয়, ‘ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তাই না?’
‘কখনও তো দিনের বেলায় শুতে দেখিনি, তাই মনে হলো নিশ্চয়ই শরীর খারাপ
হয়েছে। এখন খাবে?’
‘হ্যাঁ, চলো যাচ্ছি।’
উঠতে উঠতে সুলতান জিজ্ঞেস করে, ‘ওরা খেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, দাদা সকাল সকাল খেয়ে বাইরে গেছেন। আর উনি আছেন ঘরে।’
একটু হেসে মিলনের মা-র সাথে রসিকতা করতে ইচ্ছে হয় সুলতানের, ‘এখন থেকে উনি, তিনি বলবে না। এখন থেকে দাদী বলবে, দাদী।’
মিঠুর মাও হেসে ফেলে, ‘আচ্ছা। তাই হবে।’
টেবিলে খেতে বসতে মিঠুর মা গ্লাসে পানি ঢেলে দিতে দিতে বলে, ‘কিছু বাজার করতে হবে যে, বাবা, তুমি সময় না পেলে, টাকা দাও আমি বিকালে গিয়ে নিয়ে আসবো।’
মিঠুর মা-ই সাধারণত কাঁচা বাজার করে আনে, সুলতান খেয়াল-খুশী মতো যায় কখনও কখনও।
খেতে খেতে সুলতান বলে, ‘ওরা তো কদিন থাকবেন, বিকালে আমিই যাবো, তুমি বিকালে কিছু ডালপুরী ভেজে চায়ের সাথে দিও। কেমন?’
‘বিকালে আর কোথাও যাবে তুমি, বাবা।’
‘নাহ, বাসাতেই থাকবো।’

Leave a Reply