৭
‘ব্যস, এইটুকুই কি যথেষ্ট নয়?’ বাধা দেয় সুলতান।
‘না আরও আছে, তোমার সাথে একটা মেয়ে দরকার। পার্ল টয়লেট্রিজ আর লোকস্বাস’্য দুই প্রতিষ্ঠানই তাদের প্রোডাক্টের জন্যে নতুন মুখ চায়। তুমি নতুন মেয়ে আনবে।’
‘অবজেকশন, হুসেন ভাই। আপনি খুব অশালীনভাবে মেয়ে আনবে, মেয়ে আনবে করছেন। আমাকে কি বাজে পাড়ার দালাল পেলেন? তা’ছাড়া, আপনার প্যানেলে অনেক মেয়ে আছে না?’
‘না, প্যানেলে নতুন কোন ফেস নেই। তুমি ইয়াংদের সাথে ঘোরাফেরা করো, তোমার নজর ভালো। আর যারা মডেলিং-এ আসছে, মিডিয়াতে একবার যাদের চেহারা দেখা গেছে, আমি তাদেরকে দিয়ে কাজ করতে চাই না। আমি একেবারে আনাড়িদের নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি। আর যারা একেবারে নোভিস আর নিডি তাদেরকে ব্রেক দিতে চাই আমি। তোমার পক্ষে এদের খোঁজ পাওয়া যতো সহজ, আমার পক্ষে নয়। আমি ওদিকে নজর দিলে আমার বাড়ীর লোক আমাকে ডিভোর্স করবে, তখন এই বুড়ো বয়সে কোথায় যাবো বলো দেখি। যাক, শোন তুমি এখনই লোকস্বাস’্য থেকে ঘুরে এসো। পার্লের স্পেসিফিকেশন পেয়ে গেছি। লোকস্বাসে’্যর স্পেসিফিকেশনটা তুমি কালেক্ট করে আনবে- এন্ড ব্রিং এ সুইট গার্ল টুমরো।’
‘এমনভাবে কথাগুলো বলছেন যেন মেয়ে আমার বাড়ীর বুক শেল্ফে সাজানো আছে, তুলে নিয়ে আসবো, তাই না? এতো তাড়াতাড়ি সম্ভব নয়। দেরী হবে।’
‘আছে, আছে, তোমার বাড়ির বুকশেলফেই আছে, তোমার অসাধ্য কিছু নেই, তা আমি জানি। নাউ গেট লস্ট।’
‘এই মেয়েটাকে নেন না কেন?’ সুলতান একটু খোঁচা দেয় আলী হুসেন সাহেব সম্পর্কে ভালভাবে জানে বলেই।
আলী হুসেন খামটা সুলতানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ছবিগুলো দেখ, তারপর মন্তব্য করো।’
ছবিগুলো খাম থেকে খুলে চোখ রাখতেই একেবাবে আঁতকে ওঠে সুলতান। তারপর ছবিগুলো আবার খামের মধ্যে ঢুকিয়ে বলে, ‘এর চেয়ে একেবারে নগ্ন হলেই তো ভাল ছিল।’
আলী হুসেন বলেন, ‘একবার এক আর্টিস্টের বিরুদ্ধে ভালগারিটির অভিযোগ আনা হয়েছিল। তিনি মেয়েদের খোলামেলা ছবি আঁকতেন। এ নিয়ে তুলকালাম কান্ড আদালতের পক্ষ থেকে আর্টিস্টের কাছে ব্যাখা চাওয়া হলো। নানা হ্যাপা। শেষে এক বিখ্যাত চিত্রকরের কাছে এ সম্পর্কে মন্তব্য চাওয়া হলো। চিত্রকর, যে ছবি নিয়ে এত কান্ড সেটা ভাল করে দেখলেন। ছবিটাতে একটা মেয়ে নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে, চোখের ওপর একটা হাত দিয়ে মুখটা আধা ঢাকা। চিত্রকর অনেকক্ষণ ছবিটা দেখে তার ব্যাগ থেকে একটা তুলি আর কিছু রঙ বের করে মেয়েটির নগ্ন দেহের দুই একটি স’ানে উল্কি চিহ্ন আর পায়ে একটা মোজা এঁকে দিয়ে বিচারককে বললেন, এতক্ষণ ছবিটা ভালগার ছিল না। চমৎকার আর্ট ছিল। আমি এই সুন্দর দেহটিতে উল্কি চিহ্ন আর পায়ে মোজা এঁকে দিয়ে এটাকে ভালগার করে দিলাম।’
সুলতান মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বলে, ‘একজন মা কি করে তার মেয়েকে অন্যের চোখে এভাবে তুলে ধরতে পারেন?’
আলী হুসেন মিষ্টি হেসে বলেন, ‘দায়ে ঠেকে। কি করবেন বলো। মেয়ে আয় না করলে তো না খেয়ে মরবেন ওরা স্বামী-স্ত্রী। স্বামীটা পঙ্গু।’
‘তাই বলে এভাবে নিজেকে পণ্য করে ফেলতে হবে। কোন অঘটনও তো ঘটে যেতে পারে। পা পিছলানো আছে, প্রতারকের খপ্পরে পড়া আছে।’
‘হ্যাঁ। দেখি ওকে কোন একটা সিরিয়ালে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় কি না। তা’ হলে তো অন্তত বেঁচে বর্তে থাকবে। আর যদি ভাল করে, দাঁড়িয়ে যায়। তবে তো রক্ষে।’
‘কিছু টাকা লাগবে আমার।’
‘তোমার তো বেশ কিছু বিল পাওনাও আছে, আমার যতদূর মনে পড়ছে। এখন কতো হলে চলবে?’
‘আমি কি সে সব হিসাব করেছি কখনও। এখন হাজার বিশেক হলেই চলবে।’
কাগজ টেনে খশ্ খশ করে লিখতে লিখতে আলী হুসেন বলেন, জানি সুলতান, সেই জন্যেই তোমাকে এতো স্নেহ করি। এই নাও, একাউন্টস্ থেকে নিয়ে নাও।’
লোকস্বাসে’্য আরও কয়েকবার গিয়েছে সুলতান। কয়েকটা আর্ট ওয়ার্ক করিয়ে দিয়েছে। সেই সুবাদে ওদের এক্সিকিউটিভদের সাথে বেশ ভাল পরিচয় আছে। আজ সেখানে যাওয়ার পথে নতুন মেয়ের কথা ভাবতে থাকলো। কাকে নেওয়া যায়? কুমকুমকে দিয়ে হবে না- ও একটু বেশি স্লিম -বাংলাদেশের লোক অতো বেতস লতার মতো পাতলা শরীর পছন্দ করবে না। তাছাড়া কুমকুমের বুক বলতে প্রায় কিছু নেই বললেই চলে। ওর নিজেরই পছন্দ হয় না, তা অন্যের হবে কি করে। মেয়েটা অবশ্য ওকে খুুব চায়, আকারে ইঙ্গিতে বহুবার বোঝাতে চেয়েছে।
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে যেন কি কথা আছে – গুরু নিতম্বিনী, গজেন্দ্রগামিনী, পীনোন্নত পয়োধরা, শঙ্খভাঁজ গ্রীবা, তার উপরে আবার অন্ধকার বিদিশার নিশা মার্কা ঝর্ণাধারা লম্বা চুল, স্বাভাবিক অথচ পাতলা ভ্রু, ঘন আর মোটা হলে চলবে না। যন্ত্রণা কি কম? এমন মেয়ে খুঁজে আনার চেয়ে কাগজে এঁকে দেয়া সহজ।
আচ্ছা, একটু নতুনত্ব আনলে কেমন হয়? একটা পুরোপুরি এনিমেটেড কার্টুনে করলে, কেমন হবে? আফজাল কিছু কিছু কাজ করেছেন কার্টুনের উপরে, খুব এক্সট্রা-অর্ডিনারী কিছু না হলেও, ভালো। কিন’ ওর একার পক্ষে তো এতো বড়ো কাজ করা প্রায় দুঃসাধ্য। দেশের বাইরে থেকে করিয়ে আনা যায়, কিন’ সুলতান নিজে দেশের বাইরে থেকে কোন কাজ করিয়ে আনতে আগ্রহী না। নিজের ক্ষমতার ওপর ভরসা করেই থাকতে চায়, তাতে যা হয় তাতেই সন’ষ্ট হতে চায় ও। তাছাড়া সাধারণ লোকের মনে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এনিমেটেড্ কার্টুন হয়তো খুব একটা আকর্ষণীয় নাও হতে পারে।
এই সব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আজ সকালে ওর বাড়ীতে সিঁড়িতে দেখা মেয়েটার কথা মনে পড়ে যায় সুলতানের। বেশ সুন্দর, সাধারণ, অথচ আকর্ষণীয় চেহারা। যদি রাজী হয়, তবে ওকে দিয়ে কিছু কাজ করানো যেতে পারে। কিন’ কার কাছে এসেছে মেয়েটা, আগে তো দেখেনি।
উপর তলায় আছেন শাহরিয়ার আজাদ, বিমানের পারসোনেল ম্যানেজার। পঞ্চাশের কোঠায় বয়েস, বউ নেই, দুই ছেলে, দুজনেই আমেরিকায়। ভদ্রলোক খুবই অমায়িক নীতিবাদী আর সরল। অন্য ফ্ল্যাটে থাকেন আন্তরাষ্ট্র ট্রাভেলস্-এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর আফজাল বেগ। ইনিও একা থাকেন। দিনে তো বটেই, রাতের অধিকাংশ সময়ই বাইরে থাকেন। চলাফেরা সুলতানের মোটেই পছন্দের নয়। এক এক সময় মনে হয় উঠিয়েই দেয়। কেমন ঘোলা ঘোলা চোখের দৃষ্টি, তেলতেলা চেহারা – দেখলেই ওকে একটা গিরগিটির মতো মনে হয়। সবচেয়ে বিশ্রী ওর হাসিটা – কেমন যেন টেনে টেনে অশ্লীল হাসি।
এ দুইজনের কার কাছে এসেছে মেয়েটা? কবে থেকে আছে? কি সম্পর্ক? যতই চিন-া করছে ততোই সন্দেহ মনের মধ্যে বাসা বাঁধছে। আজ ফিরে গিয়েই আলাপ করবে বলে মনে মনে ভাবলো, কিন’ কি বলবে?
এই এক ঝামেলা; কোনদিনই মেয়েদের সাথে সহজ হয়ে মিশতে পারে না ও। এড্ভার্টাইজিং-এর সাথে জড়িয়ে পড়ার পর টিভি আর সিনেমায় ওকে কয়েকবারই অভিনয় করতে হয়েছে। আর তাতে করেই ইউনিভার্সিটিতে ওর পরিচিতি বেশ ভালোই। ছেলে-মেয়ে অনেকেই ঘনিষ্ট হতে চায়। যদি কোন সুযোগ জুটে যায়, এই কথা ভাবে বোধ হয়। অন্য কেউ হলে সুযোগের সম্পূর্ণ সদ্ব্যাবহার করতো। কিন’ মেয়েদের সাথে কথা বলাতেই ওর যতো আপত্তি আর অস্বস্তি।
ধ্যুর! চুলোয় যাক ওসব, এখনকার সমস্যাটাই প্রধান, ভাবে সুলতান। তারপর গাড়ীটা ঘুরিয়ে লোকস্বাস’্য লিমিটেড-এর সামনে দাঁড় করায়।
লোকস্বাস’্য লিমিটেড্-এর রেহানা জায়গীরদার ওকে চেম্বারে ঢুকতে দেখেই বললেন, ‘আরে সুলতান, অনেকদিন পর। কেমন আছো, ভালো? দরকার না পড়লে বুঝি আসতে নেই?’
‘আর বলেন না, খুব ঝামেলায় ছিলাম কয়েক মাস। আপনাদের জরুরী তলবে থাকতে না পেরে আসতে হলো।’
আমি তোমাকে কোন হেল্প করবো না এবার। শাহেদ সাহেব দেখছেন এই কাজ। চলো ওর ওখানে।’