রংধনু এডভার্টাইজার্স – সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান ৫


হাসলেন শাহনাজ। নিঃসংকোচে উত্তর দিলেন, ‘অধিকার নেই একথা মিথ্যে, আছে। চেষ্টাও করেছিলাম অনেক, কিন’ পারলাম কই? পারলে কি আর তোমাকে বলি? যতবার ফেরাতে গেছি উনি কি বলেছেন জানো?’
শাহনাজ থামলেন। সুলতান তাকিয়ে থাকে।
‘শুনবে? বলেন, একমাত্র ছেলে আমার, আমাকে ভুল বুঝে সে-ই যখন আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, আমাকে ঘেন্না করে- তখন আমার আর চাওয়ার কি আছে?’
শাহনাজের গলা ভারি হয়ে আসে। সুলতান তাকিয়ে দেখে চোখদুটো ব্যথায় চিক্‌ চিক্‌ করছে। ওকে বলতে হলো না, শাহনাজ কান্না চাপছেন। কেন যেন অবিশ্বাস্য মনে হয় সুলতানের কাছে।
শাহনাজকে যে ধরনের মহিলা বলে মনে করতো ও, তাদের কাছে এ ধরনের অনুভূতি সত্যিই অবাস্তব মনে হয়। কেমন উল্টে পাল্টে যায় ওর হিসাব। শাহনাজ কিছুক্ষণ চুপ করে আবার মুখ খোলেন, ‘আমার কি মনে হয় জানো? তোমরা দু’জনেই দু’জনকে ভুল বুঝছো। অন্ততঃ তুমি যে তোমার বাবাকে বুঝতে পারছো না, কিংবা বুঝতে চাইছো না, এতে কোন সন্দেহ নেই আমার। বলতে পারো, ওর উপরে তোমার এতো কিসের অভিযোগ, কিসের অভিমান? তুমি কেন এভাবে সবার কাছ থেকে, নিজের কাছ থেকে সরিয়ে রেখে কষ্ট পাচ্ছো? কোন লাভ হচ্ছে? তুমি তো নিজেই কম জ্বলছো না, তোমার নিজের মনেও তো শান্তি দরকার? দরকার না?’
নিজেকে কেমন যেন দুর্বল মনে হয় সুলতানের, প্রতিরোধের অস্ত্রগুলো যেন তেমন জমজমাট আর শাণিত মনে হচ্ছে না ওর। এতকাল ব্যবহার না করে করে তার যত আক্রোশ যেন হালকা আর হাস্যকর হয়ে উঠেছে। নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে এখন ওর। মুখের উপর ঠাস্‌ ঠাস্‌ করে কথা শোনাতে পারছে না বলে। ও কি বলবে – আপনি চলে যান, বেরিয়ে যান এখান থেকে, আপনার কোনও কথা শুনতে চাই না আমি, ফালতু উপদেশ দিতে আসবেন না। কোন অশালীন মন্তব্য কিংবা কোন অশোভন আচরণ কি করে বসবে ও এখন?
কিন’ এসব কিছুই বলার বা করার প্রবৃত্তি হয় না ওর। এ সব আচরণ সব সময়ই মনে প্রাণে ঘৃণা করে এসেছে ও। শাহনাজের দিকে চোখ পড়তেই দেখতে পারছে কেমন সুন্দর সরল মিষ্টি হাসিমাখা মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন উনি, চোখের তারায় স্নেহ। আর কিছু বুঝতে পারুক আর নাই পাুক, সত্যিকার স্নেহ আর সরলতাটা সুলতান কেন জানি বুঝতে পারে।
নাকি এ সবই ছলনা, যারা পথভ্রষ্ট তারা বুঝি এমন হয়? বন্ধুবান্ধবদের সাথে বারে-ক্লাবে গিয়ে যাদের দেখেছে, তাদের থেকে শাহনাজ যেন অনেক আলাদা। পথের মেয়েদের স্বার্থের সাথে শাহনাজের স্বার্থ ঠিক যেন মেলে না। বাবার সাথে ওর সহজতা আর স্ব্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে শাহনাজের কি লাভ? শাহনাজকে খারাপ ভাবতে পারছে না বলেই নিজের উপর বিরক্ত হয়ে ওঠে সুলতান।
‘আমি কোন মন্তব্য করবো না, কোন উপদেশ দেবো না, শুধু শুনবো। প্লিজ আমাকে বলো, তোমার সব কথা শুনতে ইচ্ছে করছে আমার।’
শাহনাজ সুলতানের দিকে ঝুঁকে মৃদু গলায় বলেন।
অভিমানের সুর ফুটে ওঠে সুলতানের গলায়, ‘কি লাভ তাতে, বলুন?’
‘কোন লাভ হবে না। তবু, সাপের বিষের থলে যখন ভরাট হয়ে যায়, তখন সেটা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে ছট্‌ফট করে ও। সেই বিষ ঢেলে ফেলার জন্যে অসি’র হয়ে কাউকে, কোন কিছু, না পেলে শেষে একগোছা ঘাসের উপরেই সেটা ঝেড়ে ফেলে আরাম পায়। তোমারও, তোমার মনের তীক্ততা ঝেড়ে ফেলে দেবার সময় এসেছে, না হলে অসুস’ হয়ে পড়বে তুমি। তোমার মনের তীক্ততা, আর ক্ষোভ না হয় আমাকেই শোনালে। আমার কথা রাখো, দেখো সত্যিই তোমার ভালো লাগবে, শান্তি পাবে। প্রত্যেক মানুষের মনের ভার মুক্ত করার জন্যে একজন শ্রোতা দরকার। প্লিজ, আমাকে তুমি বলো, তুমি যদি না চাও, তৃতীয় কোন ব্যক্তিও জানবে না তোমার মনের কথা।’
সুলতান মাথা নিচু করে থাকে। ভিতরে ও যতই দুর্বল হয়ে পড়ছে, ততোই নিজের উপরে রাগ হচ্ছে। কিন’ এতদিনের অবদমিত ক্ষোভ চেপে রাখতে ও পারে না। তাছাড়া এভাবে ওর সাথে কখনও কেউ কোনদিন কথা বলেনি। শাহনাজ একটু ঝুঁকে সুলতানের একটা হাত ওঁর হাতের মধ্যে তুলে নেন, ‘বাবার ভালোবাসা আর মায়ের স্নেহ যখন যতটুকু পাওয়ার কথা তোমার, তুমি তা পাওনি। আমি জানি। বাবাকেও বাবার মতো করে পাচ্ছো না। আমি কারও অভাব পুরণ করতে পারবো না, তবু কিছুটা নির্ভরতা, বিশ্বাস, শান্তি দিতে পারবো বলে আমার মনে হয়।’
সুলতানের বিক্ষুব্ধ বিরুপ মন ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকে। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে শাহনাজ আরও আপন করে নিতে চেষ্টা করেন ওকে। একটু থেমে একইভাবে আবার বলেন, ‘মানুষ তো ভুল করবেই, কিন’ সব ভুলেরই কি একই শাস্তি দেবে তুমি? না বুঝে বোকামী করে, জেদ ধরে অনেক রকমই তো ভুল আছে। ভুল ধরিয়ে দিয়ে ফেরাতে চেষ্টা করাই তো সবচেয়ে বড় মহৎ কাজ, তাই না? এই আমাকেই দেখো না এই দশ বছর ধরে মানুষটাকে ফেরাতে চেষ্টা করছি। একটু আগে তোমাকে তোমার বাবা সম্পর্কে একটু মিথ্যে কথা বলেছিলাম। আমি ওকে মদ খাওয়া ছাড়াতে পেরেছি, ক্লাবে যাওয়া ছেড়েছেন, সিগারেট কমিয়ে দিয়েছেন, আর কতটুকু করতে পারি আমি? এরপর তো তোমার কাজ, তুমি দায়িত্ব নেবে না? একজনকে তো না বুঝে হারিয়েছো আর একজনকে বুঝেও হারাবে তুমি? আর কটা দিনই বা বাঁচবে লোকটা? এ কটা দিন না হয় হাসিমুখে কাটাও তোমরা দুজনে?’
শাহনাজ চুপ করেন। তিনি বুঝতে পারেন তিনি জিতেছেন। স্বামীর প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের আস’া আর বিশ্বাস অর্জন করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। তাঁর সন্তানহীন সত্ত্বার ভেতরে অবদমিত, আকাঙ্খিত মাতৃত্বের আবেগ মনে ঢেউ তোলে। তাঁর সারা অবয়ব, আচরণ দিয়ে ফুটে বের হতে চায় সেই আবেগ। কিন’ এখনই সেইসব আবেগ প্রকাশ করার মতো নির্বোধ নন তিনি। আরও বিশ্বাস, আস’া আর শ্রদ্ধা অর্জন করতে হবে ওর।
সুলতান মুখ তুলে তাকায়, ‘একটা সন্তান তার মায়ের কাছ থেকে, বাবার কাছ থেকে সবচেয়ে বড় জিনিষ কি চায় জানেন আপনি?’
মাথা ঝাঁকান শাহনাজ, ‘ভালবাসা আর নিরাপত্তা।’
‘আর সেটাই যদি না থাকে?’ সুলতান প্রশ্ন করে।
‘সেটাই শিশুর জীবনে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা।’
‘আর সেই দুর্ঘটনার জন্যে যখন শিশুর কিংবা শিশু যদি বুঝতে পারে তার বাবা বা
মায়ের কোন হাত নেই, সেটা ভবিতব্য, তখন তা’ প্রতিহত করার জন্য নিজেই শক্তি অর্জন করে নেয়। তাই না?’
মাথা নাড়েন শাহনাজ।
‘কিন’ শিশু যদি কোনক্রমে বুঝতে পারে এটা তার ভবিতব্য নয়, এর জন্যে একজনকে দায়ী করা যায়, তখন তার অসহায়ত্বের জন্যে সে কাকে দায়ী করবে?’
শাহনাজ কোন কথা বলেন না। কেবল তার হাতের মধ্যে টেনে ধরে রাখা হাতের উপরে অন্য হাত দিয়ে চাপ দেন।
এবার ও ওর সব অনুভূতির কথা বলবে। শাহনাজের সব কথা শোনা দরকার।

Leave a Reply