রংধনু এডভার্টাইজার্স – সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সুলতানের ঘুমটা চটকে যায়। বিরক্তিতে মনটা একেবারে তেতো হয়ে ওঠে ওর। গতরাতে বাসাতেই ফিরেছে সাড়ে বারোটার সময়। তারপরও ঘুমটা কায়দায় আনতে আরও ঘন্টাখানেক অহেতুক সময় নষ্ট করে, শেষে না পেরে ঘুমের বড়ি গিলে প্রায় রাত দু’টার দিকে ঘুমিয়েছে ও। আজকাল প্রায়ই ঘুমটাকে নিয়ে এমনি সাধ্য-সাধনা করতে হয় ওকে। তাই সকালের দিকের ঘুমের এই মিষ্টি মধুর আমেজটা নষ্ট হয়ে গেলে কার না খারাপ লাগে?

বিড় বিড় করতে করতে পাশ ফিরে কোলবালিশটা জাবড়ে ধরে ও, ‘নাড়ূক কড়া, কিছুতেই উঠবো না এখন।’
কিন্তু এবার দরজার ওপাশ থেকে মেয়েলি গলায় ডাক শোনা গেল, ‘আব্বা, ও আব্বা, ওঠ দেখি এবার। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।’
সুলতানের বাসার কাজের মেয়েলোকটার গলা। বয়েস বছর ত্রিশেক, আঁটো- স্বাস’্যবতী শরীর, কিন’ মুখটা দারুণ রকমের ছেলেমানুষীতে ভরা। মুখের দিকে তাকালে বিশ বছরের বেশী মনেই হয় না।
শুয়ে শুয়েই মুচকি হাসে সুলতান। আগামী জুনের চার তারিখে সাতাশে পড়বে ও। এখনই বাবার ভূমিকায় গম্ভির হয়ে থাকতে হচ্ছে ওকে।

যেদিন ও সবার সাথে সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলে এই ফ্ল্যাটে এসে উঠেছিল, সেদিন নিজের রান্না নিজেই করতে গিয়েছিল। ভাত রাঁধতে গিয়ে হাঁড়ির তলা পুড়িয়ে, সবচেয়ে সহজ উপায়ে ডিম ভাঁজতে গিয়েও যখন প্রায় গলদঘর্ম হয়ে উঠেছিল, ঠিক তখনই দরজায় কাড়া নাড়ার শব্দে গিয়ে দরজা খুলতে এই মেয়েটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। সঙ্গে একটা ছেলে, বছর দশেক বয়স। বিরক্ত হয়ে উঠেছিল, ‘কি চাই?’
অভাবী, অভুক্ত চেহারা তখন ওর। বলেছিল, ‘আমার জন্যে কিছু চাই না বাবা, আমার এই ছেলেটাকে কিছু খেতে দাও। ও কিছু খায়নি দু’দিন।’
প্রচলিত ভঙ্গিতে বলেছিল সুলতান, ‘কাজ করো না কেন?’
মাথা নিচু করে বলেছিল মিঠুর মা, ‘কারও বাড়ীতে কোনদিন কাজ করিনি এর আগে। কি বলবো বাবা দুঃখের কথা। স্বামীর বাড়ী থেকে বের হয়ে এসেছি, ছেলের বাপ আর একটা বিয়ে করেছিল তাই।’
সুলতান প্রশ্ন করেছিল, ‘বাপের বাড়ীর কেউ নেই?’
মাথা নেড়ে উত্তর দিয়েছিল মিঠুর মা, ‘আমার পোড়া কপাল, বাপ-মা কেউ নেই, সৎভাইয়ের ঘরেও টিকতে পারিনি দশটা দিন।’
সুলতানের মায়া হয়েছিল। মুখ দেখে কেন যেন মনে হয়েছিল ওর, মেয়েটা হয়তো সত্যি কথা বলছে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, ‘আমার এখানে থাকবে?’
ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেছিল মিঠুর মা। ‘তুমি আমার বাবা। দু’বেলা খেতে দিও, মাথা গোঁজার ঠাই দিও, তোমার জন্যে আমি জীবন দিয়ে দেবো বাপ, আমি আর কিছু চাই না।’

আজ সাত বছর ওর কাছে আছে মিঠুর মা। একটা কথা দু’বার কোন দিন বলতে হয়নি ওকে। নারীর সহজাত প্রবৃত্তিতে কেমন করে ঠিক বুঝে নিয়েছে সুলতানের কখন কি দরকার, কি পছন্দের, আর কোনটা অপছন্দের।
আজ ওর অনুপসি’তির কথা ভাবতেও পারে না সুলতান।
একদিনের জন্যেও কোথাও যায়নি।
সৎভাই কিভাবে খবর পেয়ে এসেছিল বোনের খোঁজ নিতে, মুখের উপর বলে দিয়েছে, তোমাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। এখানে আর কোনদিনও আসবে না তুমি।
স্বামীও এসেছিল ওকে সংসারে ফেরত নিয়ে যেতে। তাকেও একই ধরণের কথা বলে দিয়েছে, ‘তোমাকে স্বামী হিসাবে মানি না আমি। আমার এজেন ছাড়া যখন তুমি বিয়ে করছো, তখন তোমার সাথে আমার সম্পর্ক শেষ।’

ভাইটা খুব একটা ঝামেলা না বাঁধালও, ঝামেলা বাঁধিয়েছিল ওর স্বামী। নানা আজে-বাজে কথা রটিয়ে ওকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিলো। বিবাহিতা স্ত্রীকে আটকিয়ে রেখেছে সুলতান, এটা প্রমাণ করতে দুই একজন স্বাক্ষী নিয়ে দুই একবার বাসায় এসে চিৎকার চেঁচামেচিও করেছিল। পাড়ার থানার সাথে একটু পরিচয়ের সূত্র ধরে ও সব ঝামেলা বেশ কষ্ট করে চুকিয়েছিল। যদিও এ ব্যাপারে মিঠুর মা যথেষ্ট শক্ত হয়ে থাকায় ওর স্বামী বেশি ঝামেলা পাকাতে পারেনি।

পরে সুলতানকে ধরে তালাকনামা পাঠাবার ব্যবস’া করতে বলেছিল ও। অনেক জেদও ধরেছিল। বলেছিল সে হয়তো বার বার ঝামেলা পাকাতেই থাকবে। সুলতানই ওকে বুঝিয়েছে ওসব খেয়াল বাদ দিতে। বলেছিল, ছেলে বড়ো হোক, তারপর দেখা যাবে। মিঠুর মা উল্টে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমার মিঠুকে যদি নিয়ে যায়? আইনে তো আছে।’
সুলতান অবাক হয়েছিল মিঠুর মার কথা শুনে, ‘কি করে জানলে তুমি, তোমার স্বামী মিঠুকে নিয়ে যাবে?’
মিঠুর মা উত্তর দিয়েছিল, ‘আমার আব্বার কাছে শুনেছি। আব্বা উকিলের মহুরী ছিলেন তো? আইনের অনেক কিছু তার কাছে শুনেছি।’
বলেই চুপ করে যায়। অবাক হয়ে সুলতান প্রশ্ন করে, ‘তোমার আব্বা মহুরী ছিলেন?’
নিঃশব্দে মাথা নাড়ে মিঠুর মা।
‘তুমি লেখাপড়া করেছিলে?’
এবারেও নিঃশব্দে মাথা নাড়ে মিঠুর মা।
‘কতদুর?’
‘ক্লাস নাইন অবধি পড়েছিলাম।’
‘কি বলো তুমি?’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিল সুলতান।
‘পনেরো বছর বয়েসে ঐ লোকের কথায় ভুলে বাড়ী থেকে পালিয়ে চলে
গিয়েছিলাম তো। আমাকে যে রাস্তায় নামিয়ে দেয়নি, এই আল্লাহ্‌র শোকর।’
‘তাহলে ওকে ছাড়লে কেন?’
‘ওর স্বভাব খুব খারাপ ছিল। বিয়ের আগে থেকেই খারাপ পাড়ায় যেতো, বিয়ের পরে জানতে পেরেছি। আমি বাধা দিলে শুনতো না, বলতো, তুমি ঘরের বউ, ঘরে থাকবা। আমি বাইরে কি করি, না করি তা দিয়ে কি দরকার তোমার। তাও হয়তো মেনে নিতাম, জেনে শুনেই চলতাম। খারাপ পাড়ার একটা নষ্ট মেয়েকে নিয়ে যখন ঘরে তুললো আমার মাথায় আগুন উঠে গেল। ওর জন্যে ফেরেস্তার মতো বাপের মনে কষ্ট দিলাম, আর সে মানুষই কি না আমার সাথে এমন বেইমানী করলো। তাই তো এক কাপড়ে বের হয়ে গিয়েছিলাম ওর বাড়ী থেকে।’

তখন থেকে সুলতান আর মিঠুর মাকে ঠিক চাকর হিসাবে ব্যবহার করতে পারেনি। আগেও অবশ্য তেমন কোন অশ্রদ্ধার কথা বলতো না, পরে আরও কিছুটা সমীহ করে চলতো। এখন ওকে আর সংসারের আলাদা হিসেবে মনে করে না সুলতান। ওর সব মনের কথা মিঠুর মা-র জানা হয়ে গেছে। তা’ছাড়া মিঠুর মা ওকে বড় বোনের মতোই স্নেহ করে – একেবারে নিজের বারো বছরের ছেলে মিঠুর মতো মনে করে। ও নিজেও এক অব্যক্ত আকর্ষণ অনুভব করে মিঠুর মা-র প্রতি। অনেকটা তার নিজের মায়ের মতো।
নিজের চার পাশের আর দশজনের উপরে বীতশ্রদ্ধ আর বিরক্ত হয়ে কয়েকবার বাড়ী ছেড়ে চলেও গিয়েছিল ও, ফিরবে না প্রতিজ্ঞাও করে ফেলেছিল প্রায়। কিন’ পারেনি- ফিরতে হয়েছে। যখনই একা হয়েছে, তখনই ঐ ভারী স্বাস’্যবতী, মায়ের মতো কমনীয় একটা বিষন্ন মুখের ছবি চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, চোখ দুটো আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছে ওর সামনে। ঐ চোখ দুটো এক দুর্বোধ্য ব্যাথায় যেন ছলছল, টলটল করেছে বারবার।

ছবিটা একবার বাস্তবে দেখেছিল সুলতান- বছর পাঁচেক আগে। মানসিক অসি’রতায় সবার উপরে বিরক্ত হয়ে জীবনের উপর সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলে যখন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল ও।
স্টমাক পাম্প করে গাদাখানেক ঘুমের বড়ির গুঁঁড়ো বের করে দিয়ে বিদ্ধস্ত শরীরটা হাসপাতালের বিছানায় এনে রাখার পর লজ্জায় চোখ বুঁজে পড়েছিল ও। ফোঁপানীর শব্দে চোখ মেলতেই সামনে ঐ মুখ দেখেছিল। প্রথমে অসহায় রাগে ধাক্কা দিয়ে ওকে বের করে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল সুলতানের।
ওর জন্যেই মরতে পারেনি সুলতান। ওর চিৎকার আর আহাজারী শুনে পাশের ফ্ল্যাটের টিভির প্রযোজক আনোয়ারুল হক ছুটে এসে এম্বুলেন্স আনিয়েছিলেন।
কিন’ রাগ করতে পারেনি। মিঠুর মা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘কেন ঐসব খেতে গেলে বাবা? কথা দাও, এ সব আর খাবে না, এ রকম আর করবে না।’
কথা দিতে হয়েছিল। আর ওর জন্যেই অনেকটা সুলতান এখনও যা ইচ্ছে তাই করতে পারে না। যদিও আট ফ্ল্যাটের এই চারতলা বাড়ীটার উত্তরাধিকার সুত্রে ওর মায়ের মৃত্যুর পর নানার কাছ থেকে পেয়েছে। বাকী সাতটা ফ্ল্যাটের ভাড়াতে বড়লোকী চালে থাকতে পারে ও। তবুও হয়তো নষ্ট হয়ে যেতো। কার জন্যে বেঁচে থাকা? কিসের জন্যে বাঁচা? – ২

Leave a Reply