পিরিমকুল কাদিরভ “মোগল সিংহ বাবর” ১০ * অনুবাদঃ সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান

১০ তাশখন্দ, ওরা-তেপা, ইসফরা


তাশখন্দ… গত পনের বছর ধরে এই শহরকে যুদ্ধের কবলে পড়তে হয় নি, শহরের বারটি প্রবেশপথই সর্বদা খোলা, যে-কোন সময়েই শহরে এসে প্রবেশ করা যায় বা বেরিয়ে যাওয়া যায় শহর থেকে।
শরৎকাল, শানি- আর আরামের সময়।… বজসুব আর সালার খালের তীরবর্তী বাগানগুলিকে স্নান করিয়ে দিয়েছে উষ্ণ বৃষ্টিধারা। খুবানী আর আলুবখরা গাছের পাতগুলি গাছ থেকে বিদায় নেবার আগে লালরঙে রাঙিয়ে উঠেছে। দূরে দৃশ্যমান চাত্‌কাল পাহাড়ের উপরে জমে থাকা তুষারও চোখকে আনন্দ দেয়।
তাশখন্দের ফলেভরা শরৎ ঋতু, এখানের উর্বরা মাটি, এর উপত্যকার সৌন্দর্য, পাহাড় থেকে বয়ে আসা মিষ্টি হাওয়া- এ সব বাবরকে মনে করিয়ে দিলো তার তরুণ বয়সের দিনগুলির কথা। ষোল বছর বয়সে প্রথমবার তিনি এখানে আসেন, কাদরার নীচে পবিত্র উকাশ জলধারার জল পান করেন প্রাণভরে, উকচি মহল্লার প্রখ্যাত কারিগরদের কাছে তীর, ধনুক, ছিলা তৈরীর ফরমাশ দেন। তখনই শাইখান তাউরে নিজের পিতামহ ইয়ুনুস খানের সমাধি প্রদর্শন করেন।
মেঘহীন সেই দিনগুলি এখন কত দূরের বলে মনে হচ্ছে। ধূলিভরা দেহ, ক্লানি-তে অর্ধমৃত, বুকে পাকাপাকিভাবে বাসাবাঁধা ব্যথা নিয়ে বাবর, চল্লিশজন বেগ ও অনুচর সমেত (বাকীদের তিনি তেপাতে তার অপেক্ষায় থাকতে বলেছেন) বেশ-আগাচ দরওয়াজা দিয়ে প্রবেশ করে কারাতাশ মহল্লা পেরিয়ে চললেন তার মামা মাহ্‌মুদ খানের প্রাসাদের দিকে। মামার সঙ্গে তার বিশেষ ভাল সম্পর্ক ছিল না, তবু গতবার বাবর যখন আসেন মাহ্‌মুদ খান আদেশ দিয়েছিল যাতে নগররক্ষক শহরের একেবারে প্রবেশপথেই বাবরকে অভ্যর্থনা জানায়।
কাসিম বেগ হতাশা, উদ্বিগ্নস্বরে জানালেন, ‘এবার দারোগা আসে নি।’
তিক্ত হাসি ফুটল বাবরের মুখে, ‘কাসিম বেগ, এবার আমরা এসেছি সবকিছু হারিয়ে ফকির হয়ে, ভিক্ষার আশায়! বিশেষ সম্মান, এমন কি আতিথ্যলাভেরও আশাও করবেন না।’
প্রকৃতই মাহ্‌মুদ খানের প্রাসাদে বাবরকে অত্যন্ত সৌজন্যহীন অভ্যর্থনা জানানো হলো। তার অনুচরদের প্রাসাদে প্রবেশ করতে দেওয়া হল না। কাসিম বেগের মুখ আরও অন্ধকার হয়ে গেল।
‘সমরখন্দে আমরা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে এগিয়ে গিয়েছিলাম, মৃত্যুতেই আমরা দুঃখকষ্টের শেষ খুঁজেছিলাম। তার সঙ্গে কি তুলনা করা চলে এই ছোটখাট খোঁচার, যা আমাদের অহংকারে ঘা দেয়? তার তুলনায় এ একেবারেই তুচ্ছ হে বন্ধু! কাল পথে আমি একটি বয়েৎ রচনা করি, শুনুন,
অলীক একটা ক্ষমতার ঘোরে জ্বালা রেখো নাকো কিছু,
অনিত্য এক সম্মান তরে মাথা কোরো নাকো নিচু।
‘ঠিক তাই, জাঁহাপনা। এই নশ্বর দুনিয়ায় কোন কিছু নিয়েই দুঃখ করা উচিত নয়।’
খানের দেওয়ানখানায় অপেক্ষা করতে হলো বাবরকে। জরির চোগা পরা একজন মোটা চেহারার লোক, হাতে সানাবাঁধান হাতলওয়ালা লম্বা লাঠি- সে উৎসব-আড়ম্বরের তদারককারী কর্মচারী, উদ্ধতভাবে জানাল যে শাহানশাহ মাবদৌলত মাহ্‌মুদ খান গাজী, খলিফা মাবদৌলত শয়বানী খানের দূতের সঙ্গে আলাপে নিযুক্ত।
উৎকণ্ঠা বোধ করলেন বাবর। সমরখন্দ হারাবার পরে তিনি যে মাস দুই ওরা-তেপাতে নিজের খালার কাছে ছিলেন তখন যেসব অপ্রীতিকর গুজব তার কানে এসেছে সে কি সত্যি তা’হলে? তখন তিনি জানতে পারেন যে শয়বানী খান তার মামার কাছে এক দূত পাঠিয়েছে দামী দামী উপহারসমেত, মাভেরান্‌নহরকে ভাগ করার প্রস্তাব দিয়ে, ফরগানা উপত্যকা সে ছেড়ে দেবে মাহ্‌মুদ খানকে, তার পরিবর্তে সে ওরা-তেপা দখল করতে চায়। যদি এ গুজব সত্যি হয় তাহলে বাবরের পা রাখার জায়গা নেই কোথাও। মাভেরান্নহর ছেড়ে যেতে হবে চিরকালের জন্য।
তিনি এদিকে আশা পোষণ করছিলেন মাহ্‌মুদ খানকে বুঝিয়ে বলবেন ধূর্ত শয়বানীর উচ্চাকাঙ্খার কথা, ভিন্নগোত্রীয় ঐ দখলদারের বিরুদ্ধে যৌথ লড়াইতে নামতে রাজী করাবেন।
শেষে সোনার হাতলওয়ালা লাঠিহাতে কর্মচারীটি মাহ্‌মুদ খানে কাছ থেকে আদেশ পেল বাবরকে তার কাছে যেতে দিতে, শয়বানীর দূত কিন’ তখনও সেই ঘরেই রয়েছে। ঘরে ঢুকেই বাবর দেখলেন দাবার ছক সামনে সাজিয়ে বসে আছে বিশালকায়, স্থূলদেহ জানি বেগ সুলতান। দেহসৌষ্ঠবসম্পন্ন গোঁফদাড়ি আঁচড়ান মাহ্‌মুদ খানের মুখে আত্মতৃপ্তির হাসি, আর জানি বেগ দুঃখিতভাবে মাথা নাড়ছে, তাশখন্দের শাসক জিতে নিয়েছেন দানটি। আরও লাল হয়ে উঠলো বাবরের মুখচোখ। তিনি মাহ্‌মুদ খানের ভাগনে, এতক্ষণ ধরে বসে রইলেন দেওয়ান খাসে। চার বছর তাদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ নেই, দুর্দশায় পড়ে তিনি এসে উপসি’ত হয়েছেন আত্মীয়ের কাছে, আর আত্মীয়টি এদিকে তারই শত্রুর দূতের সঙ্গে দাবাখেলায় মত্ত!… বুঝলেন বাবর- না বোঝারই বা কী আছে এ ঘটনার গূঢ় অর্থের কথা? মাবদৌলত মাহ্‌মুদ খান দূতকে দেখিয়ে দিলেন যে মাবদৌলত শয়বানী খানকে বিজেতা হিসেবে তিনি নিজের ব্যর্থ ভাগ্নের থেকেও বেশী সম্মান করেন।
সব বুঝলেন বাবর কিন’ আত্মসম্বরণ করলেন, এমন ভাব দেখালেন যেন এতে অপমানের কিছুই দেখছেন না তিনি, দূতের দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন কেউ নেই সেখানে।
‘মাবদৌলত খান, মামুজান। আপনাকে সুস্থ দেখে আমি খুব খুশি। আপনার শত্রুও যেন আপনার স্বাসে’্যর ক্ষতি করতে না পারে।’
জানি বেগ সুলতানের চলে যাবার অপেক্ষায় রইলেন বাবর আর কোন কথা না বলে। মাহ্‌মুদ খান দূতকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বিশেষ সম্মান দেখালেন। তারপর বাবরকে নিজের ডানদিকে জরির আসনে বসতে আহ্বান জানালেন।
‘খোশ, আমদীদ, মির্জা!… দুঃখ কোরো না, এখন তোমার যে অবস্থা তাতে ভেঙ্গে পড়া উচিত নয় তোমার। এ দুঃখের দিন কেটে যাবে। তোমার বয়স কম, বাছা আমার, তোমার জীবনের ফুলবাগিচার দশটি ফুলের একটিও এখনও ফোটে নি।’
‘আমার ফুলবাগিচার অনেক ফুলই ফুটে ওঠার আগেই ঝরে গেছে, মামুজান। আহমদ তনবারের জ্বালানো আগুনে আমার একটা পাখনা জ্বলে গেছে আর অন্যটি জ্বালিয়ে দিয়েছে শয়বানী। আল্লাহ্ না করেন যে আপনিও ঐ দুই সর্বধ্বংসী আগুনের মাঝে না পড়েন।’
মাহ্‌মুদ খান এ কথার অর্থ ধরলেন নিজের মত করে, ‘ঠিক, একই সময়ে দু’জন শাসকের সঙ্গে শত্রুতা করা বিপজ্জনক। সেইজন্যই তনবারের দূতকে গ্রহণ করি নি আমরা, গ্রহণ করেছি শয়বানী খানের দূতকে।’
‘কিন’ শয়বানী আপনার পক্ষে তনবালের চেয়ে শতগুণ বেশী বিপজ্জনক। তনবাল একটা ছোট জানোয়ার, ফরগানা উপত্যাকাটা নিয়ে পালিয়ে গিয়েই খুশী। এদিকে শয়বানী হাত বাড়িয়ে আছে গোটা মাভেরন্‌নহরকে দখল করার জন্য। আর শুধু তাই নয়, সে আরো দখল করতে চাচ্ছে খোরাসান আর গোটা ইরানও। আপনি কখনও ভেবে দেখেছেন ওর খেতাবটা- গাজী খলিফা, পয়গম্বর- কেমন? ওকে দ্বিতীয় সিকান্দর বললে খুশী হয়। সিকান্দর জুলকারনাইনের মতো সারা দুনিয়ার ওপর হাত বাড়িয়েছে। আর দখল নিয়েছে সব মুসলমানের মনেরও- হবে না,উনি খলিফা, ধর্মীয় নেতা।’
যে আবেগ আর যুক্তি নিযে বলছিলেন বাবর মাহ্‌মুদ খানের উপর তার প্রভাব পড়লো। কিন’ তা প্রকাশ করলেন না তিনি, গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন যেন… শয়বানীর দূত যা বলেছে তাকে, তা মনে করলেন।
‘ধরলাম, শয়বানী খান আমাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে না। সবদিক বিচার করে মনে হয় যে তার নজর পড়ে আছে দক্ষিণদিকে, হিসার তারপর খোরাসান আর ইরানের দিকে।’
‘জাঁহাপনা, মামুজান ঐ সব গাঁজাখুরি গল্প দিয়ে দূত আপনার সতর্কতাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। ইতিহাস মনে করে দেখুন, কোন্ সেনানায়ক তাশখন্দ ও ফরগানা দখল করার আগে খোরাসান, ইরান অভিযানে গিয়েছে? চেঙ্গিজ খান? না! আমীর তৈমুর? না! সমরখন্দ, তাশখন্দ, আন্দিজান দখল করে, শক্তি বাড়িয়ে নিয়ে তারপরই কেবল খোরাসান, ইরানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। শয়বানী কি তা বোঝে না নাকি?’
শয়বানীর তাশখন্দ আক্রমণের সম্ভবনায় ভয় মাহ্মদ খানেরও ছিল। সেই জন্যই তিনি ইসিককুলের ওপারের এলাকাগুলির শাসক, নিজের ছোট ভাই আলাচা খানকে ডেকে পাঠিয়েছেন। পনের হাজার সৈন্যের দল ইতিমধ্যে বেরিয়ে পড়েছে পথে, মাসখানেকের মধ্যেই আলাচ খান পৌঁছে যাবে তাশখন্দে। শয়বানীর লোকেরা অবশ্যই ভাইদের এই চুক্তির কথা জানতে পেরেছে। সেজন্যই শয়বানী দূত এসেছে তাশখন্দ, যুদ্ধ এড়াতে চায়, এটা পরিষ্কার। এ দিকে মাহ্‌মুদ খানও জানেন শয়বানী খানের সৈন্য পরিচালন ক্ষমতা, তাই তার সঙ্গে যুদ্ধ তিনিও চান না। কিন’ বাবরের ধারণায় যুদ্ধ অনিবার্য। এর কারণ কী? শয়বানী তাকে হারিয়ে দিয়েছে তাই সেই প্রতিশোধ আকাঙ্খাতেই কি বাবর এমন ভাবছেন?
ভাগিনার উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে জানার জন্য মাহ্‌মুদ খান জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঠিক আছে, মির্জা, ধরলাম শয়বানী আমাদের আক্রমণ করবেই! তখন আমাদের কী কর্তব্য?’
‘আমরা সবাই, যারা তার বিরুদ্ধে, একাট্টা হয়ে আপোসে সমঝোতা করবো! যাতে এক হাতের মুঠি দিয়ে তাকে আঘাত করা যায়।’
ধূর্ত কটা চোখ দিয়ে মাহ্‌মুদ খান বাবরকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার চুক্তি করতে হবে, তাই তো, মির্জা?’
‘কেবল আমার সঙ্গেই নয়। আমার আর একজন মামাও আছেন, আপনার ভাই আলাচ খান।’
‘আচ্ছা, আলাচ খানের ফৌজের সঙ্গে যোগ হবে আমার ফৌজ- সব মিলে দাঁড়াবে ত্রিশ হাজার সৈন্য। তারপর, তোমার ফৌজ যোগ হলে- কততে গিয়ে দাঁড়াবে সৈনসংখ্যা?’
বাবরের আছে মাত্র দু’শ পঞ্চাশজন লোক, মাহ্‌মুদ খান তা জানেন। বাবরের যুদ্ধের আগ্রহ ঠান্ডা করে দিতে চাইলেন তিনি, চাইলেন প্রকৃত খানদের মাঝে ভাগিনার জায়গা কোথায় তা দেখিয়ে দিতে।
আবার বাবরের মুখ লাল হয়ে উঠলো, মামার দেওয়া আঘাতটা ঠিক জায়গাতেই বাজল। কিন’ আত্মমর্যাদা হারাতে চাইলেন না বাবর।
‘জাঁহাপনা! ভাগ্য আমার সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করার আমার জীবনে এই দুর্দিন এসেছে। কিন’ মনে করুন, পরাজয়ের বিষপান করার আগে আমরা জয়ের সুমিষ্ট পানীয়ও উপভোগ করেছি। সে কারণেই আমি আপনার সামনে মন খুলে কথা বলতে, আপনার সঙ্গে চুক্তির প্রস্তাব করতে সাহস করেছি।’
‘তুমি যে মন খুলে কথা বলেছ যে খুবই ভাল কথা। আচ্ছা বল তো, যদি তেমন সম্ভাবনা আসে তুমি শয়বানীর সঙ্গে আবার নামবে নাকি লড়াইতে?’
এই প্রশ্নের সাহয্যে মাহ্‌মুদ খান পরীক্ষা করতে চাইলেন ভাগিনাকে, তাছাড়া এর মধ্যে তার প্রতি বিদ্রুপও ছিল। কথায় বলে, কুসি-তে ক্লান্ত হয় না কেবল সে-ই, যে বারবার মাটিতে পড়ে।
‘তার সঙ্গে আবার যুদ্ধে নামার কারণ আছে আমার, অবশ্যই আছে,’ দৃঢ়স্বরে বললেন বাবর। ‘আর যদি বলতে হয়…. কুসি-র কথা তো প্রচলন আছে – যদি একবার মাটিতে পড়ো, তো পরের বার তুমি মাটিতে ফেল।’
‘ঠিক, ঠিক!’ খুশী হয়ে উত্তর দিলেন মাহ্‌মুদ খান।
মনে মনে ভাবলেন, যদি আমাদের ত্রিশ হাজার সৈন্যর নেতৃত্বে শৌর্যবান বাবরকে রাখা যায় তো শয়বানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের তার যে অভিজ্ঞতা তার সাহায্যে আমরা হয়ত জয়লাভ করতে পারি। অবশ্য একথা ঠিক যে যদি বাবর শয়বানীকে পরাস্ত করে তো লোকেরা পরে বাবরেরই জয়গান গাইবে, মাহ্‌মুদ খানের নয়। তখন বাবর তাশখন্দে ক্ষমতাদখল করবে না তো? যার অধীনে সেনাদল তারই জয়জয়কার, আর যার জয়জয়কার তারই হাতে ক্ষমতা এ কথা আর কে না জানে।
এই সব ভেবে ধূর্ত ও সাবধানী মাহ্‌মুদ খান ভাগিনাকে সেনাদলের নেতৃত্ব বসালেন না।
‘হায়, হতভাগিনী খানজাদা বেগম!… কী দুঃখে দিন কাটাচ্ছে সে এখন!’ পারিবারিক সমস্যার দিকে কথা ঘোরালেন মাহ্‌মুদ খান। শয়বানী খানটা একেবারে ধূর্ত শিয়াল, ঠিক কিনা? খানজাদা বেগম মায়ের দিক থেকে আমাদের বংশধর, আর ওয়ালিদের দিক থেকে তৈমুরের বংশের। জানে যে সত্যি সত্যি যদি বিয়ে করে তাকে তো কত আত্মীয় পরিজন হবে তার।… শুনলাম, বিয়ে করেছে নাকি যেমনটি হওয়া দরকার, সমরখন্দে এক বিরাট ভোজও দিয়েছে।’
বাবর বুঝিয়ে বলতে চাইলেন সব ঘটনাটা, কিন’ মাহ্‌মুদ খান ভাগিনার কথায় গুরুত্ব দেবেন না বলে সি’রই করেছেন, এবার আর একটি নিষ্ঠুর আঘাত হানলেন তিনি তার উপর।
‘লজ্জার ঘটনা হয়ে দাঁড়ালো, এ আমাদের সবার কলঙ্ক।’
তারপর সেই আঘাতটা একটু ঠান্ডা করার জন্য বলতে লাগলেন যে বাবর, তার মা ও তার দুর্বল হয়ে পড়া পত্নী আয়ষা বেগম (তারা আগেই এসে পৌঁছেছেন) – আমাদের অত্যন্ত প্রিয় অতিথি। যা দুর্ভোগ তাদের ভোগ করতে হয়েছে তার পরে তাদের বিশ্রাম প্রয়োজন। আমোদ আহ্লাদ করতেও কোন বাধা নেই। এই তো কালকেই শয়বানী খানের দূতের সম্মানে ভোজোৎসব হবে, তোমরাও তাতে যোগ দাও…’
বাবরের এত যুক্তি সবই বিফলে গেল। বোঝাই গেল যে মাহ্‌মুদ খান ভয় পাচ্ছেন শয়বানীকে, তাকে তোয়াজ করে গাজী-খলিফার মতে মত দিয়ে শানি- কিনতে চাচ্ছেন। কিন’ হায়, বড় ভুল করছেন মামা, মস্ত বড় ভুল।… এখন তাশখন্দে যে শানি- বিরাজ করছে তা মনে করিয়ে দেয় সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা। সেই ঝড় এগিয়ে আসার আগেই মা আর স্ত্রীকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। কিন’ কোথায় নিয়ে যাবেন?


ইতিমধ্যে দু’মাস হল আয়ষা বেগম তাশখন্দে আছেন।
সন্তান হারিয়ে, সমরখন্দের অবরোধের সময়ের দুঃখকষ্ট ভোগ করে তিনি একেবারেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আয়ষা বেগমের ভগিনী, মাহ্‌মুদ খানের প্রিয় স্ত্রী, রাজিয়া সুলতান তাকে প্রাসাদে নিজের কাছে রেখেছে। ভাল ভাল হাকিম তার চিকিৎসা করছে, ভাল ভাল ওষুধ দিচ্ছে। এর ফলে শেষে আয়ষা বেগম উঠে দাঁড়ালেন।
বাবর খানের স্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য গেলেন, নিজের স্ত্রীর কাছে যাবার আগেই। কথায় কথায় বললেন শীঘ্রই স্ত্রীকে ওরা-তেপাতে নিয়ে চলে যাবার পরিকল্পনার কথা। রাজিয়া তার ঘন কালো চোখে চমৎকার ঝলক তুলে হাত নাড়িয়ে বলল, ‘আরে না, না, মির্জা, অনেক কষ্ট ভোগ করেছে আয়ষা বেগম। ওকে কোন গ্রামে গঞ্জে যেতে দেব না আমরা।’
‘যদি আমাদের ভাগ্যে এই লেখা থাকে, তো কী করা যাবে, বেগম?’
‘মাফ করবেন, মির্জা, প্রত্যেকের ভাগ্য তার নিজের কপালে লেখা থাকে।’
‘কিন’ এক নৌকায় পার হতে থাকা যাত্রীদের ভাগ্যও একসঙ্গে বাঁধা থাকে, তাই নয় কি?’
‘চমৎকার আপনাদের ‘একসঙ্গে বাঁধা ভাগ্য….’ বেচারী বোনটিকে আমার এত দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয়েছে… আর ঐ যে ‘একসঙ্গে বাঁধা ভাগ্য’ এ আপনি ওর দশ করেছেন। যথেষ্ট হয়েছে, অনাহারক্লিষ্ট সমরখন্দ থেকে এসে পৌঁছল কাঠির মত রোগা চেহারা নিয়ে। সেরে উঠল- আবার সেই পথে নামা, কী দরকার?’
বিভিন্ন ধরনের খোঁচা সহ্য করার জন্য আগে থাকতে প্রস্থত হয়েই ছিলেন বাবর। কিন’ জেষ্ঠ্য শ্যালিকার মধুর সৌজন্য প্রকাশের পরেই অপ্রত্যাশিত তীক্ষ্ণ ভৎর্সনা আরম্ভ করলো- ঠিক যেমন খান সমপ্র্রতি বিদ্রুপ মিশ্রিত ইঙ্গিতে বলেছিলেন। বাবরের ধৈর্যচূতি হলো।
‘সোজাসুজি বলুন বেগম, আপনার ইচ্ছা, আপনার বোনের সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ ঘটাতে?’
‘তা বলি নি আমি! কিন’… যথেষ্ট হয়েছে আপনারও কষ্টভোগ করা। তাশখন্দে আমাদের কাছেই থেকে যান। বরাবরের মত, শানি-তে।’
‘গলগ্রহ হয়ে থাকা মানেই গলগ্রহের মত আচরণ করা। নিজের ওজন বুঝে চলা।’
‘এই প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ। কিন’ আমার নিজের ও আমার স্ত্রীর ব্যাপারে আমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে দিন।’
নিভৃতে আয়ষা বেগমের কাছে দুঃখ জানালেন, ‘কথায় বলে, কোন্ জিনিস কোথায় থাকবে মালিকই জানে ভাল। রাজিয়া সুলতান বেগম আমাদের চেয়ে বেশী জানেন না আমাদের সম্পর্কে, তিনি আমার আপনার ব্যাপারে মাথা না ঘামালেই ভাল হয়।’
‘মির্জা, আমি বোনকে আমার সব দুঃখের কথা জানিয়েছি।’
‘স্বামী-স্ত্রীর গোপন কথাও কি কিছু থাকতে নেই?’
স্ত্রীর আগেকার সেই ভীরুতা কোথায় গেল? রাজিয়ার মতই হঠাৎ উদ্ধতভাবে উত্তর দিলেন, ‘আপন বোনের কাছ থেকে লুকাবার কিছুই নেই আমার। লুকাবার কোন কারণই দেখি না।’
বাবরের মনে পড়লো স্ত্রীর আগের সেই আদর-প্রশংসা মাখানো ডাক ‘আমার আজীম শাহ।’ এখন তিনি খানের মত নিস্পৃহ সৌজন্য দেখিয়ে কেবল ‘মির্জা’ বলে ডাকছেন। এত দ্রুত বদলায় মানুষ!
‘তার মানে স্বামীর চেয়েও বোনকে তোমার বেশী প্রয়োজন?’ তিক্ত বিদ্রুপ মিশিয়ে চাইলেন বাবর কিন’ বেরোল না সে সুর।
‘আপনি আমার স্বামী, মির্জা।’
‘তাই যদি হয়…,. আমি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে চলে যাব। যাত্রার জন্য প্রস্থত হও।’
ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন আয়ষা বেগম, ‘আবার ওরা-তেপায় যেতে হবে? সে পথের কথা মনে করলেই আমার শরীর কেমন করে! পথে পথে ঘুরে ঝালাপালা হয়ে গেছি আমি একেবারে। আর আপনিও তা জানেন। জানেন তবুও নিজের কথা বলে চলেছেন। যদি সমরখন্দ যাত্রার ফলে আর লড়াইয়ের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়তাম, হায়…. আমার মেয়ে, মানিক আমার মারা পড়তো না। এখন তার এক বছর বয়স হত হেঁটে চলে বেড়াতো।’
সন্তানশোক কোন মা’ই ভুলতে পারে না। কিন’ আয়ষা সত্য বলছেন না। মনে করলেন বাবর শিশুসন্তানের কাছে বিদায় নেবার সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তটি, মৃত্যুর হিমনিঃশ্বাস মনে হলো যেন তার মুখের ওপর পড়লো। তর্ক মন্তব্য সবকিছু শুনতে শুনতে ফিরে আসতে হয়েছিলো তখন। প্রতারণা করবেন না কি? বলবেন এ মিথ্যা?
‘মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার নেই, বেগম,’ কঠোরস্বরে বললেন তিনি। ‘যতদিন মৃত্যু মানুষের নাগাল পাবে, ততদিনে বহুবার সূর্য তার দিকে হাসিমুখে তাকাবে, বহুবার দুঃখ ভেঙে পড়বে তার মাথায়। আমাদের বয়স কম, কিন’ এ দুই-ই আমরা যথেষ্ট ভোগ করেছি।’ নরম হয়ে এল তার স্বর। ‘আমরা সুখের দিন দেখবোই, দেখো বেগম, খোদা আমাদের সন্তান উপহার দেবেন।… আর বিশেষ করে দুঃখের দিনে পরস্পরকে ছেড়ে থাকা উচিত নয়। চল আমার সঙ্গে আমার অনুরোধে…’
‘আমি আপনার সঙ্গে ঘুরেছি এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে সেখান, তাতে হয়েছে কী? সে সময় আপনার আমার কথা মনে থাকতো, আমার দিকে তাকাবেন আপনি, মির্জা? না! রাজ্যের চিন্তা, অভিযান, যুদ্ধ.. মাসের পর মাস আপনি আমাকে দেখেন নি- মনে করেন নি। উপযুক্ত নই! যে স্ত্রী ভালবাসা পায় না তেমন স্ত্রী থাকার দরকার কী?’
‘… সত্যি আমি স্ত্রীর প্রতি উদাসীন ছিলাম। কিন’ আমার চিন্তাভাবনার জন্য তো তার কোন মাথাব্যথা ছিল না? ও কি সেইসব চিন্তাভাবনার কথা জানতো? … এখনও ওকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাচ্ছি তাও বোধাহয় এই কারণে নয় যে ওকে ভালবাসি, ওকে ছেড়ে থাকতে পারি না। কিন’ স্বামী ছাড়া স্ত্রীলোকের থাকা কি ভাল দেখায়?
নিজেকে আরও একটি যুক্তি দেখালেন বাবর, যে শহর আর কিছুদিন বাদেই তার চরম শত্রু শয়বানীর হাতে পড়বে, সেখানে স্ত্রীকে রেখে যাওয়া উচিত নয়।
‘ভাগ্য নিষ্ঠুর আমাদের ওপর। খানজাদা বেগমকে রক্ষা করতে পারি নি আমরা। তার কুরবানীর ঘটনায় আমার বিবেক অহরহ কষ্ট পাচ্ছে।… যে বিপদ এগিয়ে আসছে তা থেকে, শয়বানী খানের কাছে থেকে অনেক দূরে তোমায় নিয়ে চলে যেতে চাই আমি।’
‘আমার কাছে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হল তাশখন্দ।’
‘এ সাময়িক বেগম! বিশ্বাস কর, শয়বানী এ শহরের ওপরও ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্থত।’
‘বোনের আশ্রয়ে আমি কোন কিছুকেই ভয় পাই না। আপনার কাছ থেকে এসে পৌঁছেছিলাম অর্ধমৃত অবস্থায়, এখানে আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছি।’
‘স্বীকার করছি, তা সত্যি! কিন’…. আমাদের সুখের দিনও তো গেছে। মনে নেই?’
‘কোন ভাল কিছুই আর তার মনে নেই এখন।’
‘সুখের দিন? আপনার মির্জা?… অভিযান, বিপদ, পরাজয়- এই ছিল কেবল। আর- আমার প্রতি আপনার চিরকালের হৃদয়হীনতা।’
এমন অসত্য অপমান বলে মনে হলো বাবরের কাছে।… প্রথমবার যখন তিনি সমরখন্দ দখল করে হীরাসমেত থলিটির গায়ে সূচীশিল্প দিয়ে ও-ই কি লেখে নি ‘রক্ষাকর্তাকে’? আর দ্বিতীয় জয়ের পরে কে ফিসফিস করে বলেছিল ‘শাহানশাহ, আমার গর্ব হয়…’ মনে করিয়ে দেবেন নাকি? নাঃ তাতে আত্মমর্যাদা ক্ষুন্ন হয়।
‘তুমি সব ভুলে গেছ, বেগম?’
‘না, দুঃখযন্ত্রণাই আমি সারা জীবনেও ভুলে যাব না।’
‘কেবল দুঃখযন্ত্রণাই কি ছিল আমাদের মিলিত জীবনে?’
আর কী?… আর হ্যাঁ, আমার চোখের তিক্ত জল, আপনার প্রত্যাখ্যান আমার অনুরোধের। এখন আমি আমার বোনের দয়ায় জীবিত। যথেষ্ট কষ্টভোগ হয়েছে। অপমান! আমিও শাহজাদী।’
কাঁপা কাঁপা হাতে বাবর কোমরবন্ধে ঝোলান চামড়ার থলিটি খুলে কী যেন খুজতে লাগলেন, কিন’ খুঁজে না পেয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। তাঁর অনুচরদের জন্য নির্দিষ্ট বাসস্থানে ঢুকে দেখলেন তার পোশাক-আশাক তদারককারী সিন্দুক থেকে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক বের করে ঝাড়ছে, ইস্ত্রি করছে। রেশমী পোশাক, সোনা মণিমানিক গাঁথা… বাবর আন্দাজ করলেন- কালকের ভোজের জন্য। শয়বানীর ঐ ভুঁড়িওয়ালা দূতের সঙ্গে এক সঙ্গে ভোজে থাকতে হবে আর অবহেলাপূর্ণ ইঙ্গিত আর অন্যায়- অপমানকর খোঁচা সহ্য করতে হবে, যেমন বলেছে স্ত্রী আর শ্যালিকা।
বাবর শুনতে পেলেন বিশ্বস্ত কাসিম বেগের গলা, ‘আগামীকাল যে ভোজ হবে তাতে সে-পের ঐ দূত জানি বেগ সুলতানকে আপনার চেয়ে উচ্চস্থানে বসানো হবে। কী করে এদের এমন সাহস হয়, জাঁহাপনা?’
আরে কাসিম বেগ! এখনও সে নিজেকে বাদশাহ বাবরের সুলতানের উজীর আজম বলে মনে করে, আর উজীর হিসাবে সে কেবল বাবরের প্রধান পরামর্শদাতাই নয় জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবরের মহান নামের প্রধান রক্ষাকর্তা। কিন’… বাবরের তো আর নিজের রাজ্যই নেই। উজীরও নেই।
বাবর গলগ্রহও হয়ে থাকবেন না, শাহ্ আর নন তিনি!
‘হয়েছে! যথেষ্ট হয়েছে।’ ক্ষিপ্ত হয়ে বাবর চীৎকার করে উঠলেন হঠাৎ। ‘সবকিছু থেকে সরে আসতে চাই আমি। কাসিম বেগ সাহেব, আমি আর শাহ্ নই। এ সবকিছু দূর করে দিতে হবে, দূর করে দিতে হবে….’
ভৃত্যের হাত থেকে জরির কাজ করা চোগাটা ছিনিয়ে নিযে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন মাটিতে, টেবিলের উপর থেকে তুলে নিলেন দামী পাথর বসানো মহামূল্য উষ্ণীষটি, কোন এক সময়ে আয়ষা বেগমের দেওয়া উপহার হীরাদুটি খুলে নিলেন তার থেকে তারপর উষ্ণীষটি দরজার বাইরে ছুড়ে ফেলে দিলেন। উষ্ণীষটির পাক খুলে গিয়ে দোরগোড়ায় পড়ে রইল সাদা সাপের মত।
হতবুদ্ধি কাসিম বেগ বাবরের কাঁধে হাত রাখলো, ‘জাঁহাপনা, কী হয়েছে আপনার?… জাঁহাপনা, সি’র হোন।’
মুখমন্ডল রক্তশূন্য,হাঁপাতে হাঁপাতে চীৎকার করতে লাগলেন বাবর, ‘সবশেষ! চিরকালের জন্য! দরবেশের জীবনযাপন করতে চাই!… কাসিম বেগ আমার ওয়ালিদা সাহেবাকে এ সংবাদ জানাবেন! এখুনি রওনা দিতে চাই ওরা-তেপাতে। তখ্‌তের দাবী অস্বীকার করছি আমি। কে আমার সঙ্গে যেতে রাজী- চল, অবিলম্বে রওনা দেব। বাকীদের আমি ধরে রাখবো না।’
হীরাদুটি মুঠিতে চেপে ধরে বাবর প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন দুর্গের উঠানে। তার কানে বাজছে কেবল সেই কথাগুলি ‘যে স্ত্রী ভালবাসা পায় না, তেমন স্ত্রীর থাকার দরকার কী?’ ঠিক! ঠিক! তিনিও আয়ষাকে ভালবাসেন না, আয়ষাও তাকে ভালবাসেন না। বেগমকে তার ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এই স্ত্রীলোকের অন্যায় নিষ্ঠুরতা, তার আত্মকেন্দ্রিকতা তার মন বিষিয়ে দিয়েছে।
বাঁক নিয়ে ঘুরে বাবর তেমনি দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন, যে সিন্দুকে তার কবিতার খাতাগুলি রাখতেন, তার তলা থেকে আয়ষার উপহার দেওয়া ছোট্ট থলিটি তুলে নিলেন। থলিটির সাদা কাপড়ে সময়ের প্রকোপে হলুদ ছোপ ধরেছে- যেন নোংরা হয়ে গেছে কিন’ তাতে অলঙ্করণের মাধ্যমে লেখা- আমার রক্ষাকর্তাকে- পরিষ্কার পড়া যাচ্ছে।
আয়ষা বেগমের কাছে আবার যখন এলেন বাবর প্রায় শান্ত হয়ে এসেছেন তিনি, ‘এক সময় তুমি আমাকে রক্ষাকর্তা বলে মনে করতে, আর দুটো হীরা উপহার দিয়েছিলে। তোমার ইচ্ছা জানিয়েছিলে যে আমি তখ্‌তে বসে হীরাদুটো তাজে লাগিয়ে পরি। এখন আমার তখ্তও নেই, তাজও নেই…. দরবেশেরর মত পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে চাই আমি। তুমি- শাহজাদী….হীরাগুলো ফেরত নাও।…. ওগুলো উপহার দিতে পার… কোন নতুন রক্ষাকর্তাকে।’
আয়ষা বেগম কিন’ অপ্রস্থত হলেন না একটুও, থলিটি নিয়ে ইচ্ছাকৃত ঠান্ডা কুটিল স্বরে আবার আঘাত হানলেন, ‘আপনি আবারও আমায় ছেড়ে যাচ্ছেন, তাহলে আমায় বরং সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে যান।’
‘তাই নাকি? তালাক চাও তুমি? ঠিক আছে, তোমার ওপর অধিকার ত্যাগ করলাম আমি! আজ থেকে তুমি আর আমার স্ত্রী নও। তোমায় তিন তালাক দিলাম আমি।’
ওরা-তেপার দক্ষিণে গিরিমালার পাদদেশে বসন্ত দেরী করে আসে। কেবলমাত্র হমল মাসের শেষ দিকে বলদ নিয়ে চাষ আরম্ভ হয় সেখানে।
দহকত গ্রামটি চারদিক থেকে পাহাড় ঘেরা, তাই হাওয়ায় তার তেমন ক্ষতি হয় না, গ্রামটিতে খুবানী ফলতে আরম্ভ করে সবর মাসের কাছাকাছি। এই পাহাড়ের বেড়ের ওপর দেখা যায় চিরতুষার আবৃত অপূর্ব পিরিয়াখের চূড়া।
গ্রামের প্রানে- পশ্চিমদিকে খাড়া চড়াই উঠে গেছে, সেই চড়াইয়ের একেবারে উপর প্রান্ত থেকে গ্রামটির দিকে তাকালে মনে হয় সেটি অবসি’ত খাদের একেবারে গভীরে।
ঐ চড়াইয়ের ওপাশে পাহাড়ের ঢালেও চাষের কাজ চলছে। তাহের অন্য কৃষকদের মতই খালি পায়ে একজোড়া বলদ তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। তার পিছনে চলেছে এককানওয়ালা মামাত, পোশাকটা উঁচু করে গুটিয়ে ডান হাত ঘুরিয়ে বীজ ছড়াতে ছড়াতে। বাবরের সিপাহী হওয়ার পর থেকে সে তাহেরের সঙ্গেই রয়ে গেছে। সামান্য দূরে দহকত গ্রামের চাষীরাও চাষ করছে। নরম জমি, পরিষ্কার আবহওয়া, কাজ করা সহজ। মনমেজাজ ভাল সবারই। গত কয়েক বছর ধরে তাহের কেবল দেখেছে যুদ্ধ আর অভিযান। মাটির জন্য কেমন করতো তার। মনের আনন্দে চাষ করছে সে, মাঝে মাঝে গুনগুন করে কি সুর ভাঁজে।
খাড়া ঢাল বেয়ে উঠে এলেন বাবরও। দেখলেন খালি-পা যুবকের দল গরুভেড়ার পাল চরাচ্ছে, জমি চাষ করছে। গরীব মানুষ জুতো সবসময় পরে না, এখানকার পাথুরে পথে মুহূর্তে জুতোজোড়া ক্ষয়ে যাবে। পোশাক-আশাক অত্যন্ত সাধারণ কিন’ হাসিখুশী স্বভাব। আর যখন পেটভরে খাওয়া জোটে তখন তাদের দারুণ ফুর্তি।
তাদের সঙ্গে নিজের তুলনা করেন বাবর, তিনিও সুস্থ, শক্তসমর্থ বিশ বছর বয়সী যুবক কিসে তিনি এই গ্রাম্যযুবকদের চেয়ে খাটো? মনে শানি- নেই তার, তাই এমন চমৎকার পর্বতমালার মাঝে প্রকৃতির অংশ হয়ে জীবন উপভোগ করতে পারছেন না তিনি।
হায়, খালিপায়ে চলতে পারলেই যদি সবকিছু মিটে যেত।
পায়ের জুতো খুলে ফেলে কর্ষিত জমির ওপর দিয়ে খালিপায়ে হাঁটতে লাগলেন বাবর। মাটি মখমলের মত নরম, তা থেকে বেরোচ্ছে বসন্ত আর যৌবনের সুবাস। পৃথিবীর ধূলিকণা থেকেই খোদাতালা মানুষের সৃষ্টি করেছেন- বোধহয় এমনি বাসন্তী, প্রত্যাশায় পূর্ণ নরম জমি থেকে।
অনুচররা চাষীরা খুশী মনে দেখতে লাগল শাহ্র সরল তামাশা- খালি পায়ে মাটির উপর দিয়ে চলা। কিন’ বাবর জুতো ফেলে রেখে নেমে চললেন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। ধারালো পাথরে পা পড়ে ব্যথা লাগছে। পথ কমাবার জন্য তিনি লাফ দিলেন নীচে- রক্ত বেরিয়ে এলো পায়ের তলায়। কী দরকার এর? অবাক হয়ে ভাবল চাষীরা। দাঁতে দাঁত চেপে নেমেই চললেন বাবর খালি পায়ে। তাহের বাবরের জুতোটা হাতে নিয়ে দৌড়ালো তাকে ধরার জন্য। ঢালের মাঝামাঝি পৌঁছে তার নাগাল পেল।
‘জুতো পরে নিন, জাঁহাপনা!’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল তাহের। ‘থামুন। পাথরে পা জখম হবে।’
থেমে পড়ে বাবর তাহেরের চওড়া পায়ের গোছের দিকে তাকালেন। মাটিতে কালো হয়ে গেছে সে পা, বললেন, ‘তোমার পায়ে তো কাটাছড়া কিছু নেই?’
‘খালি পায়ে চলা আমাদের অভ্যাস, জাঁহাপনা।’
‘আমিও অভ্যাস করে নিতে চাই।’
‘কেন?’
‘যাতে তোমাদের দেখে ঈর্ষা না বোধ হয়,’ বলে আবার এগিয়ে চললেন বাবর। তার পিছন পিছন চলতে চলতে মৃদু হেসে তাহের বললো, ‘বাদশাহ্ সামান্য চাষীকে ঈর্ষা করেন না।’
বাবর প্রতিবাদ করলেন, ‘তার মানে তুমিও আমায় বিশ্বাস করলে না? আমি তো তোমাদের বলেছি যে এখন আমি আর বাদশাহ্ নই, আগের সবকিছু থেকে আমি সরে এসেছি।’
তিনি অবশ্যই জানেন কাসিম বেগ আর অন্যান্য যে সব বেগ তার সঙ্গে আছেন আর ভৃত্য, অনুচররা তো বটেই- ধরে নিয়েছে যে তাশখন্দে সেই দিন কথাগুলি উত্তেজনাবশে বলা, তাই দু’শ পঞ্চাশ জন লোকই আর তার মা কুতলুগ নিগর-খানমও সবাই এখন আছেন তার সঙ্গে এই গ্রামে। কিন’ দেখিয়ে দেবেন তিনি তাদের সবাইকে, দেখিয়ে দেবেন…
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাহের বললো, ‘জাঁহাপনা, আপনাকে আমি নিজের চেয়েও বেশী বিশ্বাস করি। কিন’ শাসকের দায়িত্ব থেকে রেহাই পাবেন না আপনি।’
‘কেন? এমন কেউ কি নেই যার রাজবংশ জন্ম অথচ সিংহাসনে না বসেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছে? এমন কোন শাহ্র কথা কি শোনা যায় নি যিনি সিংহাজনের দাবী ছেড়ে দিয়েছেন?’
‘জানি না, হয়ত ছিলেন এমন শাহ্… কিন’ আপনি সে দলের নন।’
‘আমি সেই দলের একজন যারা চিনেছে ক্ষমতার ছলনাময়, প্রলোভনকারী রূপ, জেনেছে শাসকের জীবনের ব্যর্থতা ও ব্যস্ততা।… যদি জামশেদ আর সিকান্দর-জুলকারনাইনের মতো বাদশাহরাও যদি দু’দিনের বাদশাহ মাত্র হয়ে থাকে, যদি তাদেরও অগাধ ধনসম্পত্তি ছেড়ে শুধু এক টুকরো সাদা কাপড় নিয়ে কবরে যেতে হয়েছে….’ অসাবধানে পা ফেলে টলে উঠলেন বাবর। তাহের তাকে ধরবার জন্য হাত বাড়িয়েছিল, কিন’ বাবর নিজেই সামলে নিলেন।
যে পাহাড়টা দহকত গ্রামটাকে আড়াল করে রেখেছে হালে তার অপরদিকে এসেছিলেন বাবর, আববুরদান গ্রামে পৌঁছেছিলেন। তখনও তিনি জামশেদের কথা বলছিলেন, আদেশ দিয়েছিলেন নদীর কাছে পাথরে যেন জামশেদের পক্ষ থেকে খোদাই করে লেখা হয় তাজিক ভাষায় এক কবিতা। কবিতাটি রচনা করেন তিনি নিজে।
কবিতার দুটি পংক্তি মনে থেকে যায় তাহেরের-
পরাজিত ধরা পদানত হলো মোর মহা রণরঙ্গে
বৃথাই! দুনিয়া কবরেতে যেতে পারে কভু মোর সঙ্গে

একটু থামলেন বাবর, বিশ্রাম নেবার জন্য, কথা বলেই চলেছেন ওদিকে- যতটা না তাহেরের উদ্দেশ্যে তার চেয়ে বেশী নিজের সঙ্গে, ‘সবই নশ্বর, বড় বড় রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় যেই তার প্রতিষ্ঠাতা মারা যায়। কন’ কবিদের সৃষ্টি যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে।’
‘বুঝলাম, হুজুর আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, কিন’ আমাদের সঙ্গে বেগরা রয়েছে….’
‘ছেড়ে দেব বেগদের, নিজেদের প্রয়োজনে লড়াই করতে যাবে ওরা…’
বাবর প্রমাণ করে দিতে চাইলেন যে বেগদের ছেড়ে দেবার মত মনের জোর তাঁর আছে, তাই এবার আর পথ খুঁজে চলবার চেষ্টা না করে ধারালো পাথরগুলির উপর দিয়েই চলতে লাগলেন। ব্যাথা লাগছে তাঁর, তা বোঝা যায় হাঁটার ধরনে আর মুখভঙ্গীতে। আবার তাঁর পিছু ধরলো তাহের, আবার অনুরোধ করতে লাগলো জুতা পরার জন্য।
‘হায় আলম্পনা! খালি পায়ে চলা লোকদের ঈর্ষা করবেন না। খোদা যেন কোনদিনই তাদের অবস্থায় না ফেলেন আপনাকে।’
‘তাদের অবস্থা কি আমার চেয়ে ভাল নয়?’
‘আবার বলি হুজুর, আল্লাহ্ না করেন আপনাকে ভোগ করতে হয় ঐ নাঙ্গা লোকগুলির জীবন…’
‘আশ্চর্য কথা! ওই লোকগুলো কি মানুষ না?’
‘মানুষ। কিন’ আপনি তো জন্মেছেন বাদশাহ হয়ে…’
‘তাহলে আবার বলি বাদশাহ কি মানুষ নয়?’
কেমন করে এসব আলোচনা চালাতে হয় তা জানে না তাহের কিন’ জানে যে সাধারণ সৈন্য বা চাষী আর বাদশাহ্র মাঝখানে আছে এক উঁচু দেয়াল এই পাহাড়ের চেয়েও উঁচু দেয়াল। এক লাফে এই পাহাড় পেরিয়ে যেতে চাচ্ছেন বাবর। তা কী করে হবে? কী কারণে বাবরের হঠাৎ এই ইচ্ছা দেখা দিয়েছে তাও তো পরিস্কার, মভেরান্‌নহরের শাসক হবার আশা হারিয়েছেন বলেই তো। এর থেকে অন্য কিছু আর এল না তাহেরের মাথায়।
যাই হোক, অন্যান্য শাসকদের থেকে বাবর আলাদা ধরনের অনেক কিছুতেই…
‘হুজুর’, বাবরের উদ্দেশ্যে বললো তাহের, ‘যদি আপনি সত্যিই রাজ্য শাসন করার চেয়ে কবিতা লেখাই বেশী পছন্দ করেন, তাহলে আমার….আমারই বা সিপাহী হবার দরকার কি?… আমি পরিবার নিয়ে চাষাবাসের কাজ করতে পারি, সারাজীবন তা’হলে আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।…কিন’ তা বোধহয় হবার নয়?’
শেষ পর্যন্ত বাবর তাহেরের হাত থেকে জুতোজোড়া নিলেন।
‘এ সম্ভব।… তুমিও চাষবাসের কাজে লাগবে’। অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন বাবর, ‘পরে বলব কবে কেমন করে আমাদের পরিকল্পনা কার্যকরী করব। এবার যাও- বলদগুলোর কাছে, যাও, একটু একা থাকতে দাও আমাকে ।’
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো তাহের বেশ খুশী মেজাজে। বাবর তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গের মত কথা বলেছেন, যদিও সামান্য অদ্ভুত ধরনের কথাবার্তা সে সব। না, বাদশাহ্ কখনও চাষী হতে পারেন না, কবি হওয়া হয়তো বা সম্ভব, কিন’ তাতেও সন্দেহ হয়। প্রত্যেকের নিজস্ব পথ আছে। বাবরের তেমন শান্ত স্বভাব নয় যে, এক কোনায় বসে সারা জীবন কাটিয়ে দেবেন। আর পায়ে হাঁটা শাসকের পক্ষে ছেলেমানুষি। কবিদের অনেকরকম ছেলেমানুষিই থাকে। নীচের দিকে তাকাল তাহের।
বাবর তখনও জুতোজোড়া হাতে ধরে খালি পায়ে চলেছেন। পায়ের ব্যথাটা বেড়েই চলেছে, তা সত্ত্বেও বাবর ঝরণাটা পযন্ত এগিয়ে গেলেন জুতো না পরেই। এর পরে আরম্ভ হয়েছে নরম মাটির পায়ে-চলা পথ, পথটা গ্রাম পর্যন্ত চলে গেছে।
জুতো পরে নিলেন বাবর এবার। হঠাৎ বাবর বুঝতে পারলেন এই অদ্ভুত আচরণ করা তাঁর নিজের পক্ষেই ভাল নয়। গ্রামের মোড়ল তাঁর জন্য নিজের বাড়ী ছেড়ে দিয়েছে, বেগরা, ভৃত্যরা তাঁকে ‘জাহাপনা’, ‘মির্জা’ বলে সম্বোধন করে, কুণির্শ করে, তাঁকে নিজেদের থেকে অনেক উচুঁতে মনে করে, তিনি যে নিজেকে তাদের সমান করে তোলার চেষ্টা করছেন তাতে তারা বিশেষ গুরুত্ব দেয় না।
ভাল শাসক হোন, চাষীদের দলে একজন লোক বাড়ার চেয়ে তা আরও বেশী দরকার-এই ইঙ্গিত করেছিল তাহের। বাবর যদি ঐ গরীব লোকগুলির মত খালি পায়ে হাঁটতে থাকেন তাহলে বেগদের মনে হবে কোন গরীব মানুষকে কুর্ণিশ করার দরকার কি? তাঁর এই খেলায় বেগদের সম্মান ও অহঙ্কারেও আঘাত লাগবে।
পরস্পর বিরোধী এই সব চিন্তাধারায় বাবরের মাথা গুলিয়ে গেল। ওদিকে পায়ের ব্যথাটা কমে আসছে ধীরে ধীরে।
দিন যায়। খালি পায়ে চলেন বাবর পাহাড়ে পাহাড়ে, ক্রমশ তাঁর পাগুলিও অভ্যস্ত হয়ে উঠলো পাহাড়ী পথে চলার জন্য।


দহকত থেকে ক্রোশখানেক দূরে খাড়া পাহাড়ের নীচে, লোকে যার নাম দিয়েছে কালো খাত, বয়ে যাচ্ছে আক্‌সুব যার অর্থ হল সাদা নদী। নদী জলে পরিপূর্ণ, এমন স্রোত তাতে যে কোন লোক অসাবধানে তার স্রোতে পড়ে তো টেনে চলে যেতে পারে অতি সহজেই। তারপর ডানদিতে বাঁক নিয়েছে নদীটা, সেখানে তার ধারা আরও বিস্তৃতি হয়ে গিয়েছে। সেখানে এক মোটামুটি শান্ত জায়গা দিয়ে হেঁটে পার হওয়া যায় নদী।
পাইন বন পার হয়ে, পাহাড়ের গা দিয়ে নীচে চলে গেছে পায়ে চলা পথ। সেই পথ ধরে বাবর দ্বিপ্রহরের কাছাকাছি এসে পৌঁছলেন নদীর সেই অংশের কাছে- আর তখনই দেখতে পেলেন নদীর যেখানে কম জল সেখানে দিয়ে আসছে জনাকুড়ি অশ্বারোহী। যে জন সামনে ছিলো তার লাল চামড়ার মস্তকাবরণ দেখে নিজের বিশ্বস্ত কাসিম বেগকে চিনলেন।
কাসিম বেগ আর তার অনুচররা যে বাবরকে খালি পায়ে দেখে, তা চাইলেন না বাবর, তাই পথ থেকে একটু সরে গিয়ে একটা গাছের ছায়ায় বসলেন তিনি।
কিন’ কাশিম বেগ ইতিমধ্যেই দেখতে পেয়েছে তার মির্জাকে। ঘোড়া থামিয়ে নামলো, লাগামটা ধরিয়ে দিলো কাছের অনুচরটির হাতে, এগিয়ে চললো বাবরের দিকে। অন্যান্য সৈন্যরাও নেমে পড়ল ঘোড়া থেকে। কাসিম বেগের চোখে বিষণ্ন দৃষ্টি। নীচু হয়ে কুর্ণিশ করে মৃদু স্বরে বাবরকে বলল, ‘গোলামের অপরাধ, মার্জনা করবেন হুজুর। আপনার জন্য দুঃখের খবর নিয়ে এসেছি তাশখন্দ থেকে।’
বাবর তাশখন্দ ছেড়ে আসার পরে সেখানে যা ঘটেছে তা কল্পনা করলেন তিনি। বাবরের মামা মাহমুদ খান শয়বানীর দূতের সম্মানে ঘন ঘন জাঁকজমকপূর্ণ ভোজের আয়োজন করে শেষে নিজের উদ্দেশ্যে সফল করলেন- গাজী খলিফার সঙ্গে সন্ধিচুক্তি হলো। ওরা-তেপাতে মাহমুদের অধিকার স্বীকার করে নিল শয়বানী, আর নিজে সৈন্যসামন্ত নিয়ে হিসারের দিকে রওনা দিল। মাহমুদ কিন’ ওরা-তেপাতে ঢুকতে চাইলেন না শক্তি প্রয়োগ করে (সেখানে শাসন করছেন তারই আত্মীয়া) ভাব দেখালেন যে জায়গাটি এমনিতেই তার অথবা তার বংশের, নিজের ভাই আলাচ খানের সঙ্গে মিলে আহমদ তনবালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেলেন। তনবালের কাছ থেকে ‘পৃথিবীর স্বর্গ’ ফরগানা উপত্যকা ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। তাশখন্দ রাজ্য প্রসারে বিরোধিতা করে নি শয়বানী।
প্রায় মাসতিনেক কাসিম বেগ বাবরের কাছে ছিল না- সংবাদ আনতে গিয়েছিলো।
‘শয়বানী প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করেছে, জাঁহাপনা। প্রায় ছ’মাস ধরে আপনার মামা ফরগানাতে লড়েছে তনবালের সঙ্গে, কাবু করতে পারে নি তাকে, তার সৈন্যদলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এমন সময় হঠাৎ শয়বানী তাকে পিছন দিক থেকে আক্রমণ করে বসে। তনবালের সঙ্গে গোপন চুক্তি ছিল শয়বানীর। দু’জন শত্রুর সঙ্গে একসঙ্গে পারবেন কী করে আপনার মামা? ধ্বংস হয়ে গেল তার সৈন্যদল। শয়বানীর হাতে বন্দী হলেন তিনি।’
লাফিয়ে উঠলেন বাবর, ‘হায় আল্লাহ্! তাশখন্দের পতন হয়েছে?’
‘আর বলবেন না, হুজুর। তাশখন্দে ছিল দু’হাজার সৈন্য, গোলাবারুদ অস্ত্রশস্ত্র, আর অন্ততঃ ছ’মাসের মত খাবারদাবার। শহর বাঁচানো যেতো। কিন’ বন্দী মাহমুদ খান লজ্জার কাজ করে বসে। শয়বানী খানের সমস্ত শর্ত মেনে নিয়ে নিজের জীবন বাঁচায়, তাশখন্দের প্রতিরক্ষায় যে বাহিনী ছিল চিঠি লিখে তাদের হুকুম দেয় তারা যেন বিনাযুদ্ধে কেল্লা ছেড়ে চলে যায় আর কোষাগার আর খানের হারেম কেল্লায় রেখে যায়- যারা জিতেছে তাদের জন্য।’
‘গোটা হারেম শায়বানী হাতে পড়েছে?’
‘ঠিক তাই, জাঁহাপনা! শয়বানীর ফৌজ তিনদিন ধরে শহর লুঠ করলো। সুন্দরী দৌলত বেগম- আপনার মামার ছোট বোন- মনে হয়, শয়বানীর ছেলে তৈমুর সুলতানের হারেমে তার তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে স্থান পেয়েছে। শয়বানীর নিজে নিয়েছে মাহমুদ খানে ষোল বছরবয়সী মেয়ে মোগল-খানমকে। এই প্রৌঢ় বয়সে। আর রাজিয়া সুলতান বেগম ঐ মোটা জানি বেগ সুলতানের স্ত্রী হয়েছে।’
‘হায় আল্লাহ্! ঐ লোকটা ধূর্ত, নিজেকেই নিজে ধোকা দিল। গত বছর আমার বোনের ব্যাপারে, অমন করে ভৎসনা করলো, আর এখন একবার চাইতেই মেয়ে, স্ত্রী, বোন সব সঁপে দিলো। আপন শহর আজীম শাশ দিয়ে দিলো।’
‘নিজের নামে যে কালি লেপেছে সে তার জন্য সারা তাশখন্দ তাকে অভিশাপ দিচ্ছে,আবার কাসিম বেগের গলা শুনতে পেলেন বাবর।
কাসিম বেগ এতক্ষণ আয়ষা বেগমের কথা কিছু বলল না কেন? বাবর তার প্রতি উদাসীন এখন, তার সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে, তবুও যৌবনের প্রথম নারী, তার স্ত্রী ছিলেন, একসময় তার বিরহে কষ্ট পেয়েছেন। তিনিও খানজাদার মত শয়বানীর হারেমে গেলেই হলো।
আশঙ্কাপূর্ণ চোখে বাবর কাসিম বেগের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আয়ষা বেগমও কি …. সেও আমার বোনের সঙ্গে?’
‘না, মালিক!’ কাসিম বেগ বুঝল কী কারণে কষ্ট পাচ্ছেন বাবর, না… কিন’ বলতে জিভ সরে না… আয়ষার নিকাহ হয় খানের পঞ্চান্ন বছর বয়স্ক চাচা কুচকিনচির সঙ্গে।
মুখে হাতচাপা দিলেন বাবর, ‘হায় কী নীচতা।’
রাগ হচ্ছে না তার, কষ্ট হচ্ছে আয়ষার কথা ভেবে, এমনকি ঐ দেমাকী কারাকুজ রাজিয়ার জন্য, মোটা জানি বেগ যার ওপর অত্যাচার করছে। কে জানে, হয়ত ঐ ভূঁড়িওয়ালা দূত যখন মাহমুদ খানের কাছে দাবা খেলায় হেরে দিয়েছিল। তখনই খানের প্রিয় স্ত্রীকে দেখে হয়তো ভেবেছিল অন্যভাবে এ হারের শোধ নেবার কথা।
কাসিম বেগ দুঃখিতভাবে মাথা নাড়লো, ‘নিজের বন্দীজীবন রক্ষা করার জন্য এমন লজ্জাজনক কাজ করে বসা… তা সত্ত্বেও তার জীবনরক্ষা হল না।’
‘মেরে ফেলেছে মামাকে?’
প্রথমবার যখন তিনি বন্দী হন তখন শয়বানী খান তাকে মেরে ফেলে নি। নানারকম অপমান-অত্যাচার মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর রকম,তারপর তাকে তাড়িয়ে দেয় মাভেরন্‌নহরের বাইরে- পুর্বদিকে। মাহমুদ খান সেখানে কিছু লোক সংগ্রহ করতে সমর্থ হন। সেই সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে লড়াই হয়। এবারও পরাজিত ও বন্দী হন মাহমুদ খান, তার দুই ছেলেও বন্দী হয় সেই সঙ্গে। শয়বানী খান তাদেরও দয়া করে নি, তাদের হতভাগ্য বাপকেও নয়।
‘হায় কপাল…’ একটুও রাগ হল না বাবরের মনে এবারও, যদিও তিনি ভাবতে পারতেন তার প্রতি নিষ্ঠুর ভাগ্য, যারা তার সঙ্গে নির্দয় ব্যবহার করেছে, তাদের প্রতিও নিষ্ঠুর। যা শুনলেন তা তার কাছে মনে হল ভয়ংকর, বিশ্রী। যারা তার মন্দ চেয়েছে তাদের কারো জীবনেই এমন দিন আসুক তা তিনি চান নি।
কাসিম বেগ দেখল বাবরের মুখমন্ডল একবার রক্তিমাভা ধারণ করছে, একবার মৃতের মত পান্ডুর দেখাচ্ছে, কাঁপছে গালের পেশী, হাতের আঙুলগুলি। উঠে দাঁড়িয়ে শূন্যচোখে তাকিয়ে রইলেন বাবর।
কাসিম বেগ বললো, ‘বসুন, হুজুর, যারা মারা গেছেন তাদের জন্য মোনাজাত করি আল্লাহ্র কাছে।’
বাবরের হাঁটুগুলি যেন কাঁপতে লাগলো, আগের জায়গায় বসে পড়লেন তিনি, মাথা হেলান দিলেন পাইন গাছের গুঁড়িতে। কাসিম বেগ পা মুড়ে বসলো তার বিপরীত দিকে। অন্যান্য অনুচররাও এগিয়ে এসে অর্ধবৃত্তাকারে বসলো। কাশিম বেগ উপর দিকে হাত তুলে সুরেলা কণ্ঠে অনেকক্ষণ ধরে পড়ল কোরানের সুরা। সামান্য আত্মস্থ হয়ে বাবর হাটু পর্যন্ত নগ্ন পাগুলি চোগার প্রান্ত দিয়ে ঢাকলেন। কোরান পড়া শেষ হলে অনুচররা আবার সরে গেল, যাতে বাবর আর কাসিম বেগ কথা বলতে পারেন একানে-।
কাসিম বেগ বাবরের কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘শয়বানী খান, তার ছেলে আর সিপাহসালাররা এবার এক যুদ্ধে গোটা মাভেরন্‌নহরকে দখল করতে চায়। এখন তাদের নজর আন্দিজানের উপর। সেইসঙ্গে আজ হোক কাল হোক সে ওরা-তেপাতেও এসে হাজির হবে। এখানে আর থাকা বিপজ্জনক। পাহাড় পেরিয়ে হিসার চলে যেতে হবে।’
‘হিসারের শাসক খসরু শাহ্ একসময় বাবরের জ্ঞাতিভাই বাইসুনকুর মির্জার তখ্ত কেড়ে নেয়, আর তৈমুরের অন্য এক বংশধরের চোখ জ্বলন্ত অগ্নিশলাকা দিয়ে ফুঁড়ে অন্ধ করে দেয়, যাতে তখ্‌তের ওপর সে আর নজর না দিতে পারে। সেকথা মনে আছে বাবরের।
‘কাসিম বেগ, চোরের হাত থেকে পালিয়ে ডাকাতের হাতে পড়ার আমার দরকার কি বলুন?’
‘না, জাঁহাপনা, খসরু শাহের কাছে আশ্রয় চাওয়ার কথা আমি বলছি না। আপনার ফরমান বরদার খাদিম গতবছর থেকেই গোপনে আলোচনা চালিয়েছে হিসারের বেগদের সঙ্গে। তাদের বেশীর ভাগই সন’ষ্ট নয় খসরু শাহের উপর। ওরা বলে, ও হল নীচ বংশের., এক ধূর্ত নোকরের বংশধর, হিসার শাসন করার অধিকার তার নেই। আমরা যদি সেখানে যাই তো বেগরা আপনার পক্ষ নেবে।’
‘আবার তখ্ত নিয়ে কামড়াকামড়ি? না, কাসিম বেগ, যথেষ্ট হয়েছে। আমার প্রয়োজন নির্জন কোন জায়গা, যেখানে গুহাবাসীর মত একানে- বসে কাব্যরচনা করতে পারি। আর কিছু চাই না আমি।’
বাবরের সঙ্গে দেখা হওয়ার সময় থেকেই কাসিম বেগ চেষ্টা করছিল বাবরের নগ্ন পায়ের দিকে না তাকাতে। বাদশাহ, যার উদ্দেশ্যে লোকে মাথা নোয়ায়, তিনি খালি পায়ে চলছেন- এ কী আশ্চর্য ব্যবহার?
‘জাঁহাপনা, আমাদের কথা কি আপনি ভেবে দেখেছেন? আপনার অনুগত দু’শ পঞ্চাশজন বেগ, সৈন্য ও দাসেরা আপনার সাফল্য কামনা করে দোয়া করছে খোদাতালার কাছে, আশা করছে যে আপনি আবার তখ্‌তে বসবেন, আগের চেয়েও বেশী ক্ষমতা হবে আপনার। এই আশাতেই তারা আপনার সঙ্গে পাহাড়ে, মরুভূমিতে ঘুরে কষ্ট ভোগ করছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সে সবের কোন অর্থই নেই?
অকপট কাসিম বেগ বাবরকে বুঝতে দিলো যে যদি তিনি সত্যি সত্যিই দরবেশ হতে চান তো পাশে এত বেগ আর সেনার ভীড় রেখে লাভ কী? তাদের ছেড়ে দিলে হয় না কি?
মাথা নামিয়ে নীরব হয়ে রইলেন বাবর অনেকক্ষণ।
‘আমার এমন হৃদয়হীনতা মাফ করবেন, জাঁহাপনা, বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হলো।’
‘আপনি… ঠিকই বলেছেন। আমার যারা অনুগত, তাদের কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় আমার। বলুন দেখি খসরু শাহ কি আপনাকে ডেকেছে তার কাছে কাজ করার জন্য?’
‘দু’বার ডেকেছে।’
অপলক, বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন বাবর কাসিম বেগের সাহসভরা মুখের দিকে। তার উজীর আজম, তার অবলম্বন কাসিম বেগের দাড়িতে ইতিমধ্যেই সাদার ছোঁয়া লেগেছে, বয়স তো চল্লিশও পূর্ণ হয় নি এখনও।
‘জানেন কাসিম বেগ আপনার সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়া অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার আমার পক্ষে। যে দিন আমি পিতৃহারা হয়েছি সেদিন থেকেই পিতৃস্নেহে আপনি আমাকে দেখাশোনা করেছেন। আমার সব অন্তরঙ্গ জনের মধ্যে আপনিই আমার সবচেয়ে বিশ্বাসী ও সবচেয়ে অন্তরঙ্গ। আপনাকে সম্মান দেখিয়ে আমি ছেড়ে দিচ্ছি… আমাদের প্রত্যেকেই যার যার নিজের পথে চলে যাক। আপনার পথ গেছে হিসারের দিকে।’
‘এ সব কথা শুনতে কষ্ট হয় আমার।… কষ্ট হয়ে আপনাকে ছেড়ে যেতে হুজুর! চলুন একসঙ্গে যাওয়া যাক।’
‘না, না, কাসিম বেগ, এখনি আমাকে শাহ্র জীবনের শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। এখনই, পরে আর হবে না। প্রকৃত শাহের মতো সঙ্ঘবন্ধ, শক্তিশালী, প্রতিপত্তিসম্পন্ন রাজ্য স্থাপনের যে স্বপ্ন আমার ছিল, তেমনটা গড়ে তুলতে পারলাম না আমি। কাসিম বেগ, চুনোপুটির জীবন চাই না আমি। আমি জানি শৃঙ্খলের এক দিক আমার উপর নির্ভরশীল লোকেদের সঙ্গে লাগানো, আর অন্যদিক -আমি নিজেই, আমার আগের অভ্যাসগুলি আমার অহংকার। যারা আমার উপর নির্ভরশীল শৃঙ্খল থেকে তাদের মুক্তি কী করে পাব আমি জানি না। এখন আমি চাই প্রকৃতির কোলে শৃঙ্খমুক্ত হয়ে বাঁচতে, কাসিম বেগ।
কাসিম বেগও যে চোখের জল ফেলতে পারে এই প্রথম দেখলেন বাবর….


এই উঁচু পাহাড়গুলির মধ্যে দিয়ে অবিরাম ঘুরে ঘুরে সকালসন্ধে যে চিন্তা তার মন কুরে কুরে খাচ্ছে তা যদি নীচে ছুড়ে ফেলে দিতে পারতেন অথবা ছড়িয়ে দিতে পারতেন ঐ সীমাহীন আকাশের মধ্যে… কিন’ মনের যন্ত্রণাকে তিনি নিজের থেকে আলাদা করতে পারেন না, যেমন পারেন শৃঙ্খল থেকে বিছিন্ন হতে- তিনি নিজেই তো সেই শৃঙ্খল। যন্ত্রণা হাওয়ায় মিলিয়ে দেওয়া বা ছুঁড়ে ফেলা নয়… সেগুলি প্রকাশ করতে হবে কবিতার মধ্যে। একমাত্র কবিতাই পারে তাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে নিতে যাতে তার অন্তরের একগুয়ে কান্নার বহিঃপ্রকাশ-
শুধিও না দোস্ত কী হল আমার, আমি কাহিল,
প্রাণ থেকে দেহ দুর্বল, আর অসুস্থ দিল।
নিজেই জানি না কী যে লিখে চলি ব্যথার গান,
শতেক লোহার বেড়ি থেকে ভারি এ বোঝা পাষাণ।

একের পর এক রচিত হতে থাকে গজলের পরে রুবাই-
কোথায় শরাব যাতে হতে পারি ঘোর মাতাল?
সাধু-সনে-র পথটা আমার জন্যে নয়!
নেই কিছু যাতে ধরা যাবে উচ্ছন্নের খাল,
ইচ্ছাশক্তি নেইকো, পুণ্য কী করে হয়।

প্রায়ই তার মনে সন্দেহ দেখা দিতো, তিনি কি প্রকৃতই দরবেশ হতে পারবেন, খাদ্যপানীয় পোশাক-আশাক, বাহ্যিক প্রলোভন পরিত্যাগ করাই শুধু নয়, জীবনের স্বাদ ভোগ করা, রূপের অনুভূতি, ক্ষমতা ও খ্যাতি অর্জনের চেষ্টা ইত্যাদি আন্তরিক প্রলোভন কাটিয়ে ওঠা কি সম্ভব তার পক্ষে।
দীন দরবেশ আমি, চুপচাপ থাকি কোনো এক কোণে,
স্বপ্নের পথ নেই, উদ্ধার নেই কোনো প্রলোভনে,
কী যে করি আমি? কোথায় বা যাই? ধর্মের নীড় কিসে?
পথহারা আমি, দুই দরজার মাঝে পাই নাকো দিশে।
দ্রুত জন্ম নেওয়া পংক্তিগুলির মধ্যে তিনি অনুভব করেন কবিতার উত্তাপ। তার মনে হতে থাকে যদি দুনিয়ার সব দরজাও তার সামনে বন্ধ হয়ে যায়, একটি দরজা অন্ততঃ খোলা থাকবে- কবিতার দেশে, অর্থাৎ লোপ করা চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে কখনো কখনো কোন ক্ষয় না হওয়া শক্তি লক্ষ্য করে আনন্দও হয়, সেই সব মুহূর্তগুলিতে মনে পড়ে বিদায় নেওয়ার কালে খানজাদা বেগম বলেছিলেন, আমি বিশ্বাস করি আপনার মহান ভবিষ্যতে, অন্যেরা জানে না কিন’ আমি জানি, আপনার মত এমন বড় প্রতিভা কচিৎ জন্ম নেয় পৃথিবীতে।
গতকাল আকসুর নদীর তীরের একটি গ্রামে ভোজ চলছিল। সেখানে সাধারণ একজন পথচারীর মতো পথ দিয়ে যেতে যেতে বাবর হঠাৎ শোনেন এক যুবক গায়ক সুরেলা গলায় গাইছে তার রচিত গজল- নিজেকে ছাড়া তো তুমি প্রাণের সখা তো কোনো পেলে না…
হৃদপিন্ডটা লাফিয়ে উঠল বুকের মধ্যে, সেই শক্তি, যাকে তিনি ভয় পান আবার যাতে খুশীও হন তা যেন প্রকাশ হবার আকুলিবিকুলিতে বিদীর্ণ করে দেবে তার বুক।
দহকত গ্রাম থেকে সামান্য দূরে আসমান গোচরণ পাহাড়ের চূড়া থেকে যে ঝরণাধারাটা নেমেছে তা দেখতে ভাল লাগে তার। পাহাড়গুলীতে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে অনেক প্রস্রবণ। কিন’ বাবর এখানে প্রথম দেখতে পেলেন এমন এক প্রস্রবণ যা বাজপাখীর মতো তীক্ষ্ম ডাক ছেড়ে সোজা চূড়া থেকে বেরোচ্ছে।
দক্ষিণে ঝলকায় চিরতুষারাবৃত মহামহিম পিরিয়াখ পর্বত। পিরিয়াখ আর আসমান পাহাড়ের মাঝে- গভীর গিরিখাত, উঁচু উঁচু টিলার সারি। বাবর ভাবলেন তার প্রিয় ঝরনা জল পায় পিরিয়াখের তুষার থেকেই। তার মানে পিরিয়াখের উপর থেকে জলকে নীচে নেমে আমার উপরে আসমান গোচারণে,ওঠার ;জন্য গভীতে ঢুকতে হয়, পাহাড়গুলির মাঝের খাদের থেকেও আরো গভীরে। এর জন্য অত শক্তি কোথা থেকে পায় ঝরণাটি? নিজের ওজনেই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে নেমে যায় যে, কিন’ পাহাড়, পাথরের চাই ভেঙে অত উঁচুতে উঠাচ্ছে তাকে কে? হয়ত আগে সেটিও বইতো পাহাড়ের পাদদেশে কিন’ কোন এক ভূমিকম্পে ধস নেমে আগের সে পথ বন্ধ হয়ে যায়? আর তখন নতুন শক্তিতে…
নিজের জীবনটাকে এইরকম ঝরণাধারার সঙ্গে তুলনা করতে ভাল লাগে বাবরের। ধসের নীচে পড়েছেন তিনি। আখসির খাড়া পাড়ের সেই ধস নামার মত, ঝরণারধারার উৎস বন্ধ হয়ে গেল। শয়বানীর জয়লাভ- আরও এক ধস। আরো কত ধস নেমেছে। কিন’ ঝরণার অন্তর্নিহিত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায় নি, আবার সে পাথর ভেদ করে বেরিয়ে আসতে আরম্ভ করেছে। কুলকুল করে সে পাথরের মাঝে নিজের পথ খুজে চলে।
ঝরণাটি যদি পাহাড়ের উপরে উঠতে পেরে থাকে তো তার মানে বাবরেরও ভেঙে পড়া উচিত নয়, উচিত নয় আশা হারান। তার জীবন, তার শক্তিও ফুঠে বেরোবে এই ঝরনাটির মতন। হয়ত কবিখ্যাতির চূড়ায় উঠবেন? নাকি কেবল কবিখ্যাতিই নয়?
… একদিন দুপুর গড়িয়ে গেছে, বাবর ‘আসমান গোচারণ’ পাহাড়ের চূড়ায় ঝরণার কাছে বসে এই সব চিন্তায় মগ্ন, এমন সময় তার সামনের এসে দাঁড়াল এক মেষপালক, সঙ্গে দুটি নেকড়ে শিকারী কুকুর। পায়ে চারিক* পরা, মাথায় সাদা গরমকাপড়ের তেকোণা টুপি, তাতে লাল পাড় দেওয়া। তার কোমরবন্ধে ঝুলছে, একটা বড় ছুরি, হাতে শক্ত লাঠি। কোন কথা না বলে সে তাকালো বাবরের দিকে, ঝরনার কাছে বসে আঁজলা করে জল খেলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে, হাতগুলো বগলে ঢুকিয়ে ঘরে তৈরী মোটাকাপড়ের আলখাল্লায় মুছে নিলো।
‘কি ভাই, এমন কিপটে হয়ে গেছে তোমার বাদশাহ্, যে পাহাড়ে পাহাড়ে খালি পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস?’
মেষপালকের এই ‘তুই তোকারি’ যেন কেটে বসল বারের গায়ে, কিন’ আত্মসংযম বজায় রেখে তিনি বললেন, ‘কে আমার বাদশাহ?’
‘শুনলাম দহকতে বাবর এসে আছে। তুই তো তার দলের লোক?’
পাহাড় উপত্যকায় ঘুরে বেড়ান বাবর পুরোন পোশেকে, রোদের তাপে মুখের রং জ্বলে গেছে, কিন’ মুখচোখ দেখে বোঝা যায় যে তিনি উঁচু বংশের লোক। সেই কারণেই মেষপালকটি ধরে নিয়েছে যে তিনি বাবরের অন্তরঙ্গদের একজন। এলোমেলো কিছু বলে ফেলার ভয়ে বাবর কেবল বললেন, ‘সেইরকমই…’
লাঠিতে চওড়া বুক ভর দিয়ে মেষপালকটি সন্ধানী দৃষ্টিতে চেয়ে রইল বাবরের দিকে, আর একের পর এক প্রশ্ন করেই চলল, ‘তুমি বোধহয় তোমার বাদশাহের খুবই ভক্ত, তাই না?’ মৃদু হাসলেন বাবর।
‘যদি আমার নিজের ওপরে ভক্তি থাকে তাই যথেষ্ট।’
‘কিন’ তুমি এমন দৈন্যদশায় পড়েছ যে তোমার বাদশাহ তোমাকে আর দয়া দেখাচ্ছে না।’
এবার বাবরও ভাল করে লক্ষ্য করলেন মেষপালককে। অন্য যে-কোন বিশ বছর বয়সী যুবকের মতই সে, গালে তখনও ভাল করে খুরের ছোঁয়া পড়ে নি। কিন’ গর্তে ঢোকা চোখগুলি বিষাদপূর্ণ। এমন দেখেছেন বাবর কেবল পঞ্চাশ বছর বয়সী লোকদের, যারা জীবনে অনেক কিছু দেখেছে।
‘তুমি বাদশাহ্ সম্বন্ধে এ কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন? তোমার কোন প্রয়োজন আছে তার কাছে?’
‘এইখানে, পাহাড়ে তার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হতো যদি…’
‘যদি দেখা হত… কী জিজ্ঞেস করতে?’
রাগে চোখ কুঁচকে মেষপালকটি বললো, ‘জিজ্ঞেস করতাম, সে আমার বড় ভাই আর বাবার মুন্ডুটা নিয়ে কী করেছে?’
‘মুন্ডু নিয়ে? বাবর? তুমি… তুমি কোথাকার লোক?’
‘আমি চাগ্রাক।’
বাবরের মনে পড়লো আন্দিজানের পাহাড়ে বসবাসকারী তুর্কী উপজাতির চাগ্রাক রাখালের কথা। বিস্মিত হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানেও চাগ্রাকরা আছে নাকি?’
‘ওশের ওদিক থেকে এখানে পালিয়ে আসি আমরা। তখন আমার বয়স চৌদ্দ বছরও হয় নি। বাবর এসে একদিন ভেড়া ঘোড়ার পাল নিয়ে নিতে চাইলো। রাখালরা উত্তরে বলেছিল, দেব না! তখন… সবাইকে মেরে ফেললো বাবর আর তাদের কাটা মুন্ডগুলো সঙ্গে করে নিয়ে গেল। মা আর আমি এসে দেখি- বিশটা লাশ পড়ে আছে। মাথাকাটা…. মাথাকাটা দেহ দেখে মানুষকে চেনা মুশকিল। কাঁদতে কাঁদতে মা একবার একটা তারপর অন্য আরেকটা লাশ জড়িয়ে ধরছেন।’
ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য যা এক সময় বাবরকে তাড়া করে বেড়াতো, স্বপ্নে দেখা দিতো, আবার সেটা আবার জীবন্ত হয়ে উঠলো তার সামনে। আহমদ তনবালের হাতে ধরা রক্তামাখা থলি, লাল ঘন্টাফুলগুলির উপর গড়িয়ে পড়ছে মানুষের কাটামাথাগুলি….
আতঙ্কে লাফিয়ে উঠলেন বাবর। তাড়াতাড়ি বললেন, ‘বাবর ও কাজ করেনি।’
বুকের কাছ থেকে লাঠিটা সরিয়ে নিয়ে শেষপালকটি তার দিকে এগিয়ে এলো, ‘তুমি… কী করে জানলে… দেখেছ মাথাগুলো?’
‘হ্যাঁ… পাহাড়ে চারণভূমিতে আহমদ তনবাল দেখিয়েছিলো। ছ’বছর কাটলো তারপর।…. চাগ্রাকরা বিদ্রোহ করেছিল, তিন-চারজন সেপাইকে মেরে ফেলে। তারই প্রতিশোধ নেয় তনবাল।’
‘না তনবাল নয়, লোকেরা দেখেছে, আমাকে বলেছে। আমার বাবার মাথা কেটে নিয়ে গিয়েছে বাবর।’
‘তোমায় মিথ্যা বলেছে লোকে। আমি… ঠিক জানি। আমারও বয়স তখন ছিল তোমারই মতো। আহমদ তনবাল পাহাড়ে গিয়েছিল আর আমি ছিলাম ওশে,’ তাড়াহুড়ো করে যেন দোষ স্খালন করার জন্য বলতে লাগলেন বাবর। তার এই ব্যস্ততা কেমন যেন সন্দেহ জাগায়।
মেষপালক ক্রুদ্ধস্বরে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি কে? বাবর নাকি?’
মালিকের কথা বলার ধরনে কুকুরদুটি বুঝল যে এই অপরিচিত লোকটি বিপজ্জনক। গরগর করে উঠে তারা বাবরের উপর লাফিয়ে পড়ার জন্য প্রস্থত হয়ে রইল। আপনা থেকেই বাবরের হাতটা গেল কোমরের কাছে। কিন’ কোমরবন্ধে এখন ছোরা, তরবারি কিছুই নেই। নিরস্ত্র হয়ে ঘুরে বেড়ান তিনি।
মনে হলো কুকুরগুলো এখুনি তার খালি পাগুলি কামড়ে ধরবে। ভয়ে তার মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠলো, কিন’ মেষপালকের দিকে গর্বিতভাবে সোজাসুজি তাকিয়ে বললেন, ‘আমি বাবর।’
মেষপালকটি তার খালি পায়ের দিকে তাকালো, বিশ্বাস করলো না।
‘তুমি … এমনি?… বাদশাহ্‌রা এমনি হন না…’
‘ঠিক, এখন আমি বাদশাহ্ নই। সে জীবন শেষ করে দিয়েছি। এখন আমি- শায়ের বাবর।’
গতকাল গ্রামের এক ভোজ-উৎসবে মেষপালকটি বেশ উপভোগ করেছিল বাবরের গজল। গজলের শেষে সাধারণত কবি নিজের নাম উল্লেখ করেন-
নিজেকে ছাড়া তো তুমি কোনো প্রাণের সখা পেলে না বাবর
নিজেতে ব্যস্ত থেকে খাঁটি পীরিতের দেখা মেলে না বাবর।

এই লোকটি একা একা পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সত্যিই কেউ ওর বন্ধু নেই। কুকুরদের উদ্দেশ্যে চীৎকার করে উঠল ছেলেটি, ‘শুয়ে থাক। বুইনাক, তুর্তকুজ শুয়ে থাক।’
কুকুরদের শান্ত করে আবার বাবরের উদ্দেশ্যে বলল, ‘যদি তুমি সত্যি সত্যি শায়ের বাবর হও, নিজের গজলের একটি অন্ততঃ বল দেখি… আমি বাবরের অনেক গজল জানি, ধরতে পারবো ঠিক।
মুখ নীচু করে এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন বাবর তারপর মাথা তুলে বললেন, ‘এটা জান? শোন দেখি,
আপনেরা চেনে না আমায়, পরজন করছে তাড়না,
হিংসুকেরা পিছে লাগে শুধু, প্রিয়তমা বিমুখবদনা।
চেয়েছিলে ভালো করতে কিছু হতে শুচি শান্ত সদয়,
লোকের স্মৃতিতে তুমি শুধু হীন পশু, শুনে কষ্ট হয়।

যে উত্তাপ আর বেদনা নিয়ে বাবর এই ছত্র ক’টি পড়লেন তা সঞ্চারিত হল মেষপালকের মধ্যেও, প্রতিফলিত হল তার চোখে।
‘হ্যাঁ… দেখছি… তোমার জীবন খুব সহজ নয়, শায়ের,… যাক গে… তুমি যখন সত্যি বলছো যে আমার বাবাকে বাবর মারে নি, মেরেছে তনবাল।’
‘তনবাল মেরেছে…. কিন’ আমাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে আমার আগের বেগদের কাজকর্মের জন্য। তাই…. এখন প্রায়শ্চিত্ত করছি।’
‘তোমার এ কথাগুলোও বিশ্বাস করতে চাই। বিশ্বাস যদি না করতাম তো আমার বাবা-ভাইয়ের রক্তের প্রতিশোধ নেবার জন্য কুকুরদুটোকে লেলিয়ে দিতাম, তোমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতো। বিদায়… শায়ের বাবর।’
বাবরের মনে নেই কেমন করে ঐ দিন তিনি ‘আসমান গোচারণ’ পাহাড় থেকে দহকত গ্রামে নেমে এসেছিলেন। অতীত, শাসকের জীবনের দুর্ভাগ্যগ্রস্ত অতীত, তার সমস্ত অন্যায়, রক্ত, নোংরা নিয়ে তাড়া করে ফিরছে তাকে। বেগরা নিষ্ঠুর কাজ করেছে আর লোকে বলে তার নামে। মেষপালকের ঐ ভয়ঙ্কর কুকুর দুটির মতই বিবেক গরগর করছে বাবরকে, কামড়াচ্ছে তার হৃদয়কে।
বিবেককে শান্ত করবেন কী করে?
দহকতে তার জন্য অপেক্ষা করেছিল আরও ভয়ঙ্কর খবর।
শয়বানীর সৈন্যদল ইতিমধ্যেই ওরা-তেপাতে এসে পৌঁছেছে। গ্রামের শহরে গিয়েছিল বাজারে কেনাকাটি করতে,তাকে ধরে সৈন্যরা বাবর কোথায় লুকিয়ে আছে দেখিয়ে দেবার জন্য জোরজবরদসি- মারধোর করতে থাকে।
মুখময় চাবুকের রক্তাক্ত ডোরা ডোরা দাগ নিয়ে তাজিক মোড়লটি বাবরকে বললো, ‘এমন হীন নই আমি যে নিজের মেহমানকে ধরিয়ে দেব। আপনার দুশমনদের অকতাংগি পাহাড়ী খাতে নিয়ে গিয়ে ঝোপেঝাড়ে গা ঢাকা দিলাম নিজে। ওখান থেকে বেরিয়ে আসা খুব সহজ হবে না ওদের পক্ষে, আমি উঁচু উঁচু পাহাড়ী পথ বেয়ে এসে পৌঁছেছি।’
অকতাংগি- দহকত থেকে ক্রোশ আষ্টেক পুবে। একথা পরিষ্কার যে কালপরশুর মধ্যেই খানের লোকেরা দহকতে এসে পড়বে। শয়বানী তাল মাথার বদলে বিরাট পরিমাণ সোনা দেবে ঘোষণা করেছে।… পালাতে হবে।
সে কথা বলতে লাগলেন বাবরের মা কুতলুগ নিগর-খানমও, ‘বাবরজান, এখন আমাদের সবার ভরসা কেবল তুমিই। এখন দরবেশ হওয়া চলে না, বাছা।…. সবাই তোমাকে রাজ্যছাড়া বাদশাহ্ বলেই মনে করে, অন্য কিছুতে তারা বিশ্বাস করে না, বড় বড় বেগরা হিসারে আর অন্যান্য জায়গায় তোমার অপেক্ষা করছেন। শয়বানীর লোকেরা তোমায় খুজে বেড়াচ্ছে তখ্‌তে তোমার হক আছে বলেই।…. দহকত এতদিন আশ্রয় দিয়েছে আমাদের, তাই তোমার কর্তব্য এই গ্রামটিকে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দুর্দশা থেকে রক্ষা করা।’
‘সবই ঠিক, যুক্তিযুক্ত। তাকে আবার নেতৃত্ব দিতে হবে তাদের, যারা তার ক্ষমতায় বিশ্বাস করে, অস্ত্র তুলে নিতে হবে হাতে।’
খালিপায়ে ঘুরে ঘুরে তিনি ভাগ্যর হাত থেকে রেহাই পাবেন না।
‘শেরিম বেগ! আপনাকে আমার উজীরে আজম করলাম…’ (এত বছরের বিশ্বস্ত সেবার পর অবশেষে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আনন্দে দরবারী প্রথা অনুযায়ী নীচু হয়ে কুর্ণিশ করে ধন্যবাদ জানালো) ‘সমস্ত বেগ আর নোকরদের আমাদের ইচ্ছা জানাবেন। অবিলম্বে রওনা দেবার আয়োজন করা হোক। আজ রাতেই দহকত ছেড়ে যেতে হবে।’
আবার বর্ম পরেছেন বাবর, অস্ত্র ঝুলিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের। সেই রাতেই তার দল রওনা দিলো পূবে- যেদিক থেকে সূর্য ওঠে সেদিকে। ইসফরার দিকে।


নীচে পাথরে ধাক্কা খেয়ে আওয়াজ করতে করতে কলকল করে ছুটে চলেছে ইসফরা নদী। উঁচু একটা পাহাড়ের ঢালে বসে বাবর তাকিয়ে আছেন সুদূরের দিকে। ধূসর রঙের মেঘগুলি খজেনে-র ওদিকে কোথায় যেন ভেসে যাচ্ছে, পাগাড়ের চুড়া আর ঢালে পড়ছে তাদের ছাড়া। তুষারবৃত পর্বতচূড়া থেকে হিম নেমে আসছে। বসন্তকালীন উপত্যকা উষ্ণ সবুজ চাদরে ঢাকা।
দিগনে- বিছানো আকাশের নীল রেশমী পর্দার ওপাশে কোথায় যেন অনেক দূরে আছে চাতকাল পর্বতমালা আর এক সময়ের জমকালো, বর্তমান লুণ্ঠিত, নিস্তব্ধ তাশখন্দ শহর। বাবরের মনের চোখে এরপর ভেসে ওঠে জিজ্জাখ, সমরখন্দ, মার্গিলান ও আন্দিজানের ছবি। একসময় এই সমস্ত এলাকা দিয়ে তিনি ইচ্ছামত ভ্রমণ করেছেন।
কিন’ এখন মাভেরান্‌নহরের কোথাও তার আশ্রয় নেই, এমন একটুও জায়গা নেই যেখানে তিনি শানি-তে ক’টা দিন কাটাতে পারেন। তনবাল আর শয়বানীর হাতে চলে গেছে গোটা মাভেরান্নহর। শেরিম বেগ বৃথাই বলছেন না বাবরকে খোরাসানে চলে যেতে।
রাজী হচ্ছেন না বাবর, আগে থাকতেই বুঝতে পারছেন তিনি মাভেরান্নহর ছেড়ে গেলে তিনি জন্মের মত মাতৃভূমিহারা হবেন, আর কোনদিনই ফিরে আসা হবে না। মাতৃভূমির প্রতি এমন অনুভূমি এর আগেও কখনও হয় নি তার।
মাভেরান্নহর। তোমার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত চষে বেড়িয়েছি আমি, তোমার বুকের উপর দিয়ে চলে যাওয়া প্রতিটি পথে ঢেলে দির্য়েছি আমি অন্তরের আলো, ছড়িয়েছি আমার ইচ্ছার বীজ। আমার মূল- তোমার দেহের মধ্যে, আমার প্রিয় মাতৃভূমি। সেই মূলকে উপড়ে ফেলার মত শক্তি কোথায়? তোমার বিরহ কি আমি সহ্য করতে পারব?
আহমদ তনবাল ও শয়বানী খান- মিত্রবাহিনী এখন পরস্পরের টুঁটি কামড়ে ধরতে চায়। ক্ষমতালোভীরা শানি-তে বাঁচতে পারে না কিছুতেই, মাভেরন্‌নহরে আবার যুদ্ধের উৎপাত আরম্ভ হয়েছে। ওরা দু’জনেই যদি মরতো, ওই লোভী কুকুর দুটো, তাহলে বাবরের পথ খুলে যেতো হয়তো..
বাবরের মনে তখনও ক্ষীণ আশা রয়েছে যে হয়ত থেকে যাবেন মাভেরান্‌নহরে তাই আন্দিজানে লোক পাঠিয়েছেন যুদ্ধের গতি কোনদিকে জানার জন্য। এখন অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছেন তাদের ইসফরাতে ফিরে আসার।
দেড়মাস কাটলো চরেরা ফিরে আসে নি এখনও। কী অসম্ভব ধীর গতিতে কাটছে দিনগুলি!… মনে হল বাবরের। সারাদিন পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান বাবর।… কী করবেন? কী করারই বা আছে? বুদ্ধিমান কাসিম বেগ হিসার চলে না গেলে হয়ত কোন ভাল পরামর্শ দিতে পারতেন। কিন’ তিনি এখানে নেই। সাহসী যোদ্ধা ও সঙ্গী নুয়ান কুকলদাসও নেই- গতবছর আহনগরানে তনবালের সৈন্যদের হাতে মৃত্যু হয় তার, তারা খাদে ছুঁড়ে ফেলে দেয় তাকে।
কতজনই তো আজ কাছে নেই- মারা পড়েছে, চলে গেছে, দুর্বলতার বশবর্তী হয়ে শত্রুদলে গিয়ে যোগদিয়েছে। প্রথম দলের লোকদের জন্য হয় দুঃখ আর দ্বিতীয় দলের জন্য রাগ।
এখন কাব্যপ্রতিভাও তাকে বঞ্চনা না করলে হয়। চেষ্টা করছেন কবিতা রচনার কিন’ হচ্ছে না কিছুতেই, ছন্দ মেলাবার মত মনের অবস্থা নেই।

সন্ধ্যার সময় পাহাড়গুলো কুয়াশায় ঢেকে গেল। কুয়াশাভরা পায়েচলা পথ দিয়ে বাবর উপত্যকায় নদীর তীরের কাছে নেমে এলেন। সেখানটা কেমন ঠান্ডাবিষণ্ন, আর ঘন কুয়াশার এমন দেয়াল তৈরী হয়েছে যে নদীর স্রোত দেখা যাচ্ছে না, কেবল নদীর প্রচন্ড আওয়াজে বোঝা যাচ্ছে যে ইসফরা নদী এখানে, অদৃশ্য হয়ে যায় নি, পাথর ঠেলতে ঠেলতে বয়ে নিয়ে চলেছে জল।
নদীতীরে একটা খোলা প্রশস্ত জায়গায় তারা ছাউনি গেড়েছেন। মাঝখানে সামান্য উঁচু যে জায়গাটা আছে সেখানে খাটানো হয়েছে লাল দামী কাপড়ে তৈরী বাবরের তাবুটি। কাছেই আটকোণা সাদা তাঁবুটি কুতলুগ নিগর-খানমের। এই প্রধান ছাউনিগুলি থেকে সামান্য তফাতে বাকী ছাউনিগুলি।
বাবরের মনে হল তাঁবুগুলি যেন পরস্পরের থেকে দূরে সরে গেছে; কুয়াশা একেবারে ঢেকে ফেলেছে সেগুলিকে। লোকদের মুখোমুখি হচ্ছেন তিনি, তারা তাকে অভিবাদন জানাচ্ছে, যেমন জানানো হয়, উত্তরে বাবর সামান্য মাথা হেলাচ্ছেন দরবারী প্রথা অনুযায়ী।
বাবর চললেন তার কিতাবখানায় তদারককারী মামদ আলির তাবুর দিকে। বিরল হাতে লেখা অনেক বই রাখা আছে চামড়ামোড়া বিশেষ ধরনের সিন্দুকে যাতে ভিজে না যায়। পাঁচ-ছটা উটের পিঠে এই সিন্দুকগুলি বওয়া হয়, মামদ আলি সব অভিযানেই থাকে বাবরের সঙ্গে। মুখেচোখে অসুস্থতার ছাপ তার। মা যেমন করে তার শিশুর তদারক করে তেমনিভাবেই বৃদ্ধ বইগুলির যত্ন করে। কী ধরনের বই পড়তে চান বাবর এখন? আচ্ছা, ইতিহাসের ওপর কিছু। মামদ আলির অভ্যাস ছিল বইতে হাত দেবার আগে হাত ধুয়ে নেওয়া।
‘আপনার খাদিম আপনার তাঁবুতে অবিলম্বে পৌঁছে দেবে বইগুলি, জাঁহাপনা।’
প্রখ্যাত সেনানায়ক ও দক্ষ শাসকদের জীবন নিয়ে লেখা বইগুলির পাতা উল্টাচ্ছিলেন বাবর। অলঙ্কারবহুল বাক্যগুলি,উপমাগুলি পড়তে পড়তে মুখ কুঁচকে যাচ্ছিল বাবরের, সত্য ঘটনাকে তার সঙ্গে জড়িত গল্পকথা থেকে বিছিন্ন করে দেখবার বর্ণনা করা হয়েছে বিজয়ের চিত্র, কেবলমাত্র সফল শাসকদের বিজয়লাভের কাহিনী বর্ণনা করা হযেছে।
শয়বানী খানের সম্বন্ধেও নিশ্চয়ই এখন লেখা হচ্ছে এমনি ফোলানো ফাঁপানো প্রশংসা ভরিয়ে। বাবর জানতে পেরেছেন বিনই আমার শয়বানীর দলে যোগ দিয়েছেন। বিনই আর মুহম্মদ সালেহ্ দু’জনেই আলাদা আলাদাভাবে লিখছে ‘শয়বানী নামা’। বাবর আর শয়বানীর মধ্যে যে লড়াই হয় সে সম্বন্ধে তারা কী লিখবে? বিজেতাকে প্রশংসায় ভরিয়ে আকাশে তুলবে আর বাবরকে সব দিক থেকে সমালোচনা করবে, অতীত ও কল্পিত অপরাধের বোঝা চাপাবে বাবরের কাঁধে- কোথা থেকে প্রকৃত ঘটনা জানবে লোকে?
বিজেতাদের জয়োৎসবের আড়ম্বরপূর্ণ বর্ণনা দেওয়া বইগুলি সরিয়ে রাখলেন। যে রেশমী রুমাল দিয়ে মামদ আলি সযতনে মুড়েছিল বইগুলি, সেটিকে গুঁটিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন। উঠে এগিয়ে গেলেন যে সিন্দুকে নিজের কাগজপত্র রাখতেন সেটির কাছে। দাঁড়িয়ে ভাবলেন খানিকক্ষণ। ‘অতীত’ নাম দেওয়া খাতাটি বার করলেন।
দেখ কান্ড, সে খাতাতেও বাবর লিখেছেন কেবল কেমন করে তিনি শয়বানীর কাছে থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন সমরখন্দ, তারপরে আর একবারও ছোঁন নি খাতাটি। অর্থাৎ তিনি নিজেই কাউকে এমনকি নিজেকেও জানাতে চান নি তার পরবর্তী পরাজয়গুলি আর দুর্দশা সম্বন্ধে। সেসব কাগজকলমে লেখা নেই ঠিকই কিন’ তাদের থেকে পালাবার উপায় নেই, সেগুলি আছে তার মাথার মধ্যে, যাঁতাকলের ভারী পাথরের মত মাথার মধ্যে সেগুলি ঘুরছে আর যন্ত্রণা দিচ্ছে। কথায় বলে ‘রোগ লুকোবার চেষ্টা করলে কী হবে, জ্বর উঠে রোগ ঠিকই প্রকাশ হয়ে পড়বে।’ এই খাতায় সমস্ত ঘটনা খুটিনাটি যথাযথ লিখে রাখলে ভাল হয় না কি? তাহলে হয়ত মনের জ্বালাটা বাইরে বেরিয়ে এসে মনটা হালকা হবে।
বাবর তাড়াতাড়ি করে লিখতে লাগলেন বিবেকের কাছে জবাব দেওয়ার জন্য। সহজ ভাষায় সত্য ঘটনা লিখছেন, কারণ জানেন এখুনি ঐ বইগুলিতে যেমন দেখেছেন সেই অলঙ্করবহুল ফোলান ফাঁপানো ভাষার তার মনোভাবে প্রকাশ করা যাবে না। কোন অন্তরঙ্গ ব্যক্তিকে নিজের সম্বন্ধে সব বলছেন যেন এমনিভাবে লিখছেন। তার জীবনের গোপন কথা এখন জানলো খাতাটি। অর্থাৎ তিনি নিজে। অকারণে তিনি তার গজলে লেখেন নি নিজেকে ছাড়া তো তুমি প্রাণের সখা তো কোনো পেলে না…
খোলাখুলিভাবে আর নিজের আত্মমর্যাদা ক্ষুন্ন না করে নিজেকে সব ঘটনা জানাতে থাকলেন।
তনবালকে তার উপহার দেওয়া তরবারিটি সম্বন্ধেও… দুর্ভাগা চাগ্রাকদের সম্বন্ধেও… তার জুতোহীন পাদুটো কেমন ধারাল পাথরে ভর্তি পাহাড়ী পথে চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সেকথাও। সব কিছুই স্থান পেল খাতাটিতে, লিখতে লিখতে বাবর অনুভব করলেন কী অনুপ্রেরণার জোয়ার লেগেছে তার মনে, যেন মত্ত হয়েছেন কবিতা রচনায়।
শাসনকর্তা বংশে জন্মলাভ করার কারণে শাসনকর্তা ভাগ্য থেকে রেহাই যখন পেলেনই না তখন তার সমস্ত দুঃখকষ্ট যন্ত্রণার সত্যনিষ্ঠ বর্ণনাই দেবেন তিনি। যে সব শাসককে জানেন বাবর তাদের কেউই খোলাখুলিভাবে এসব কথা বলেন নি কখনও। কিন’ সত্যকথা জানার জন্য লোকে সর্বদাই আগ্রহী। আর যদি সে আগ্রহ সামান্য একটুখানিও মিটাতে পেরে থাকেন তাহলে খোদাতাল তাকে যে প্রতিভা দিয়েছেন তা বৃথা যাবে না আর লোকেও শিক্ষা নিতে পারবে তার অসফল জীবন থেকে।
লোকেরা, অন্যরা… কিন’ তাহলে কেবল নিজের জন্যইম নিজের বিবেককে শান্ত করার জন্যই লিখছেন না তিনি? তা’হলে এও হল কবিতা, কবিতাও রচনা করা হয় নিজের হৃদয়ের আকাঙ্খা মিটানোর জন্য, যা অন্যের হৃদয়কে আকর্ষণ করে, যা গান হয়ে দাঁড়ায় সবার জন্য এই কি সুখ নয়? তরবারির ভয় দেখিয়ে দখল করলে তরবারির ভয়ে ছেড়ে দিতেও হয়। কিন’ কবি বা সত্যসন্ধানী ইতিহাসকারের কলমের লেখা কিছুতেই ছিনিয়ে নেওয়া যায় না।….
ভৃত্যেরা কখন বাতি জ্বলিয়ে এনে রেখে গেছে তা লক্ষ্যই করেন নি বাবর। প্রায় সারারাত খাবার কিছু ছুঁলেন না, লিখে চললেন।….

ভোর হবার আগে এসে পৌঁছল তাহের।
বাবর তখনই তাকে ডেকে পাঠালেন আন্দিজানের ঘটনাবলী জানার জন্য। বাবরের তাবুতে বসে বাতির আলোয় তাহের অনেকক্ষণ ধরে বলতে লাগল। প্রধান খবর হল- আন্দিজান শয়বানীর দখলে, শহর লুণ্ঠিত, শহর পুরোপুরি দখলে চলে যাওয়ার পরে মারা পড়ে অনেক আন্দিজানবাসী। বাবরের দ্বিতীয় চরও মারা পড়ে তখন।
তাহের এত ক্লান্ত যে টলছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। বাবর বসে তাকেও বসতে বললেন।
সব ঘটনা এমনভাবে জানলো কি করে তাহের? আন্দিজানের কাছে খাজাকাত্তা গ্রামে এক জমিদারের কাছে গাড়োয়ানের কাজ নিয়েছিলো সে। সে যে আসলে কে তা বুঝতে পারে নি জমিদার। সব কথাবার্তা মন দিয়ে শুনতো তাহের, সতর্কভাবে জিজ্ঞেস করতো সবাইকে। আর যখন শহরে জমিদারের দোকানে মাল নিয়ে গেলো, তখন নিজের চোখেই দেখলো অনেক কিছু।
আন্দিজানের কাছে যুদ্ধক্ষেত্রে হার স্বীকার করে তনবাল দুর্গের মধ্যে বন্ধ হয়ে বসে থাকে। আরম্ভ হল অবরোধ। দুর্গে দেখা দিলো খাদ্যাভাব, রোগের প্রকোপ, মতবিরোধ। (যেমন দেখা দেয় সমরখন্দে, ভাবলেন বাবর)। যে বেগরা একসময় বাবরকে ছেড়ে তনবালের কাছে গিয়ে যোগ দিয়েছিল, তারাই এখন তনবালকে ফেলে পালিয়েছে শয়বানী খানের কাছে।
খানের সেনাদল শেষ পর্যন্ত ঢোকে শহরে। আহমদ তনবাল তার ভাই আর অন্তরঙ্গদের নিয়ে দুর্গে লুকিয়ে থাকেন, আন্দিজানের দুর্গ শহরের বাড়ীগুলি থেকে বেশী দূরে নয়, আশেপাশের বাড়ীগুলির ছাত থেকে দুর্গকে আক্রমণ করা সহজ। শয়বানীর মত আহমদ তনবালও তা জানে। এক বৃদ্ধকে খানের কাছে পাঠায় এই কথা বলতে আদেশ দিয়ে, গাজী খালিফা আর মোকাদ্দম ইমামকে আমি দিয়ে দেবো আমার সঞ্চিত সমস্ত ধনসম্পদ, গোটা হারেম, তার খেদমতগার হন, আমার জীবন রাখুন!
বৃদ্ধ ফিরে এলো না। আরম্ভ হল আক্রমণ . . . আতঙ্কিত তনবাল ও তার ভাইয়েরা দুর্গের ফটক খুলে বাইরে এলো, তরবারিগুলি কাঁধে ঝুলছে- অর্থাৎ তারা আত্মসমর্পণ করছে। তৈমুর সুলতান অনুচরদের আদেশ দিলো: বন্দী করে নিয়ে যাবার দরকার নেই, মাথা কেটে ফেলো। তনবাল আর তার ভাইদের টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হলো। কাটা মাথাগুলো বস্তায় ভরা হল। হয়তো শয়বানীকে দেখাবার জন্য।
কথাগুলো বলে শেষ করল।
‘খোদাতালা সত্যদ্রষ্টা!’ বেরিয়ে এল বাবরের মুখ থেকে।
কেমন প্রতিশোধ! বিশ্বাসঘাতক তার ওপর, বাবরের ওপর, তরবারি তুলেছিলো, আর এখন নিজেই কাটা পড়ল তরবারির ঘায়ে। …. নিষ্ঠুর তনবাল খাজা আবদুল্লাহকে ঝুলিয়ে দিয়েছিলো ঐ দুর্গের ফটকেই, তার শোধ, সেই ফটকের কাছেই তাকেও যন্ত্রণাকর মৃত্যুবরণ করতে হলো।… বেচারী চাগ্রাকদের মাথাগুলোর শোধ উঠলো- বস্তা থেকে গড়িয়ে পড়লো তনবাল ও তার ভাইদের মাথাগুলো। আর শয়বানী- ঘৃণাভরে সেগুলোকে দেখছে, জুতোর ডগা দিয়ে ঘুরিয়ে।… কল্পনা করলেন বাবর।
কোনটা এদের মধ্যে সেই হোৎকা, আহমদ তনবাল, যাকে নিয়ে এত ঝামেলা, দেখাও তো, তার মুখ দেখি নি তো কখনও, সুযোগ হয় নি। কিন’ ঘৃণা হবে শয়বানীর সে মুন্ডুটা হাতে নিতে- হনুর হাড়দুটো অসম্ভব উঁচু, সামান্য কয়েকগাছি দাড়ি।
এই দৃশ্য কল্পনা করে এমন অভিভূত হয়ে পড়লেন যে বারবার বলতে লাগলেন, ‘সত্যদ্রষ্টা খোদা।’
নিষ্ঠুর ন্যায়বিচার? প্রতিশোধ? কিন’ নিষ্ঠুরতায় শয়বানী আহমদ তনবালকেও ছাড়িয়ে গেছে! প্রতিশোধের তরবারি এমন রক্তপিপাসু খানের হাতে কেন তুলে দিলেন খোদা?
আবার অন্যদিক থেকে ভাবলে- বিছিন্ন, বিভক্ত মাভেরান্‌নহরকে একত্রিত করার যে মহান উদ্দেশ্য ছিল বাবরের, অবিভক্ত, শক্তিশালী মাভেরান্নহর, তার, বাবরের- তা কি এখন করতে পারল শয়বানী খান? তাহলে কেন তিনি পারলেন না বাবর? কিসে শয়বানী খান বেশী শক্তিশালী? খলতা, নিষ্ঠুরতায়?
ঠিক, এই নশ্বর দুনিয়ায়- বিজেতা হতে গেলে এখন শয়বানীর মত অমনই হতে হবে। আর তিনি, বাবর হতে চেয়েছিলেন জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত শাসক, অনেক সময় ও শক্তিব্যয় করেছেন, বাক্য, শিল্প ও স্থাপত্যের পিছনে, চিন্তা করেছেন মানবতার কথা, এই সব কারণেই তিনি হেরে গেছেন শয়বানীর কাছে। কিন’ কোনটি বেশী গুরুত্বপূর্ণ-মানবতা না ক্ষমতাদখল সে যদি ঐক্যবদ্ধ মাভেরান্‌নহরেও হয় তাহলেও? এ তো পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছে।
‘জাঁহাপনা,’ তাহেরের ডাকে ছিন্ন হল তার চিন্তাসূত্র। ‘শুনেছি, খানের লোকরা আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে হন্যে হয়ে। হয়ত তারা ইতিমধ্যেই ইসফরা এসে পৌঁছেছে।’
হ্যাঁ, জীবন বাঁচাবার কথা ভাবতে হবে। আর ভাবতে হবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার কথাও। তনবালের পরাজয় তার স্বপ্নের ঝরণাধারার ওপর নামা আর একটি ধস। ঝরণার বাইরে বেরিয়ে আসার সব পথই বন্ধ হল…. এখানে, তার স্বদেশে। এই পর্বতশ্রেণী পার হয়ে অবিলম্বে খোরাসান পৌঁছাতে না পারলে শয়বানী শেষ সম্ভব পাথটাও বন্ধ করে দেবে।
বাবর ভুলে গেলেন যে তার সামনে বসে এক সামান্য নোকর। হতাশসুরে বললেন, ‘কম কষ্ট সহ্য করেছি নাকি এখন আবার স্বদেশ ছেড়েও চলে যেতে হবে?’
বাবরের চোখে জল দেখে তাহের কষ্টে আত্মসংবরণ করল, কাঁপা ঠোঁটে বলল, ‘আলম্পনা, বিদেশে জীবনধারণ করা যে-কোন লোকের পক্ষেই কষ্টকর, সে শাহই থোক, সৈন্যই হোক বা চাষীই হোক। … আমি আর ফিরতে পারব না কুভাতে, ফিরতে পারব না আমার জন্মস্থানে। কারণ আপনার কাছে কাজ করার জন্য, প্রতিশোধ নেবে আমার উপর। আর তাছাড়া আরও এই কারণে… আপনাকে ছেড়ে যেতে পারব না….আন্দিজান থেকে এখানে আসার পথে আমি অনেক ভেবেছি। আপনার সঙ্গে থাকব আমি, সর্বত্র সর্বদা।’
বাবর বহুদিনই জানেন যে তাহের সৎ, সাহসী যোদ্ধা আর সরল, বিশ্বাসপ্রবণ কৃষক। সে এমন লোক যার দৃঢ় বিশ্বাস যে সমস্ত হিংসা ও অন্যায়ের অবসান ঘটাতে পারে একমাত্র ন্যায়পরায়ণ শাসক।
‘কিন’ আমি তো তোমাদের সবার মনমতো শাসক হতে পারি নি।’ হঠাৎ বললেন বাবর যেন নিজের চিন্তাধারার উত্তরেই। ‘ভবিষ্যতেও আমি তা হতে পারব কি না- তাও জানা নেই।..’
চুপ করে রইল তাহের। বাবরও নীরব হয়ে গেলেন। এইভাবে পরস্পরের মুখোমুখি তারা বসে রইলেন- বিতাড়িত শাসক ও তার ভৃত্য। তাঁবুর মোটা কাপড় ভেদ করে শোনা যাচ্ছে প্রস্থানোদ্যত রাতের নীরবতায় ক্রুদ্ধ ইসফরা নদীর গর্জন-ক্রন্দন।
তাদের দু’জনের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকলেও দুর্ভাগ্য কাছে টেনেছে তাদের। এতবছর ধরে একসঙ্গে লড়েছে তারা বিভিন্ন যুদ্ধে, কখনও এমন অকপটভাবে মনের কথা খুলে বলে নি পরস্পরের কাছে। যেকথা অন্যসময়ে বাবরকে বলতে পারত না তাহির, তা এখন সে বলতে লাগল বাদশাহের আধোঅন্ধকার তাঁবুতে বসে, ‘হুজুর, আমি একজন সামান্য নোকর, কিন’ আপনার কাছে কেমন যেন বাঁধা পড়ে গেছি। আপনার কবিতা, সাহস, দয়া…. আমি… জানি আপনার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। যারা আপনার ক্ষতি করেছে, তাদের অনেকেই মরেছে।… কতবড় ভয়ঙ্কর বিপদ থেকেও আপনি রক্ষা পেয়েছেন- এও বড় ভাগ্যের কথা।’
তাহের যেন এখন বড় ভাইয়ের ভূমিকা নিয়েছে, বিপদের সময়ে ছোট ভাইকে চাঙা করে তোলার চেষ্টা করছে। সত্যি বাবরের চেয়ে সে সাতবছরের বড়।
‘ভাগ্য আপনার সঙ্গে সৎমায়ের মতই ব্যবহার করেছে। নিষ্ঠুর লোকেদের জয় হয়েছে। তাদের দিন শেষ হবে, এমন দিন আসবে যখন আপনার মূল্য বুঝবে সবাই, জাঁহাপনা, আর এখন,’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল সে, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইসফরা ছেড়ে চলে যাওয়া দরকার। হীরাটও আপনার পর নয়। হুসেন বাইকারা আপনার আত্মীয়। হীরাটে আমার মামা মোল্লা ফজল উদ্দিনও থাকার কথা।’
যে পাহাড়গুলি পেরিয়ে যাবার দরকার, তাদের তুষারাবৃত চূড়াগুলি আকাশের নীল ঝলক দিয়ে মুগ্ধ করে চোখকে; সমতলের নিরাপদ দূরত্ব থেকে দেখলে বোঝা যাবে না সেই খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে ওঠা কত কঠিন। উপরে উঠলে চূড়ার সাদা তুষার মানুষের কাছে মনে হবে যেন কাফন আর বিশাল হিমবাহগুলি যেন মৃত্যুর চিরআশ্রয়।
‘এই বিপজ্জনক পথে যাত্রার সময় নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রথম খোদার ওপর, তারপর তোমার ওপর, তাহের বেগ…’
তুষরাবৃত ধারালো চূড়াসমেত বিশাল কালো কালো পাহাড়গুলির দিকে তাকিয়ে বাবরের আবার মনে পড়ল ধসে চাপা পড়া ঝরণার কথা। এই পাহাড়ের সারি পেরিয়ে ওপাশে পৌঁছতে পারবেন কি? সারি একটা নয়! এই বিশাল পর্বতমালার পিছনে পামির। পামিরের পরে হিমালয় আর হিন্দুকুশ।..

Leave a Reply