পিরিমকুল কাদিরভ “মোগল সিংহ বাবর ৯ * অনুবাদঃ সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান

৯ আবার সমরখন্দে


নরম-সাদা চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে সমরখন্দের ঘরবাড়ির ছাদ, দেওয়ালে, গাছপালা গম্বুজগুলি।
বুস্তান-সরাই মহলের দ্বিতলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবর শহরের শোভা উপভোগ করছিলেন। সাদা তুষারের বুকে গাছের শাখাপ্রশাখার জড়াজড়ি তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল সাদা কাগজে নস্তালিক অলঙ্করণের কথা। যেমন আলিশের নবাইয়ের যে পত্রটি আজ তিনি পেয়েছেন হীরাট থেকে। আবার তার মন ভরে গেল গর্বে আর আনন্দে।
বাবর দুঃসাহসী প্রয়াসে শয়বানীর কাছ থেকে সমরখন্দ ছিনিয়ে নেওয়ার পর শায়েররা তার তারিফ করে ইতিমধ্যেই এই উপলক্ষে উৎকৃষ্ট শ্রেণীর তারিখ কবিতা রচনা করেছেন- সেগুলির প্রথম আটটি শব্দের সংখ্যা রাশি যোগ করলে বাবরের বিজয়ের সঠিক তারিখ দাঁড়ায়। কিন’ আলিশের নবাইয়ের অভিনন্দনবাণীটি গদ্যে লেখা হলেও অনেক বেশী আনন্দ দিয়েছে তাকে। হীরাট সমরখন্দ থেকে এত দূর, কত প্রখ্যাত ব্যক্তি আর গুরুত্ব ঘটনা নবাইয়ের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এখন দেখা যাচ্ছে মহান কবি তাকে, বাবরকে জানেন, অতদূর থেকে তার কার্যাবলীর প্রতি লক্ষ্য রাখছেন। এবার আপনি নিজের নামের উপযুক্ত বীরত্ব দেখিয়ে সমরখন্দ জয় করেছেন, লিখছেন নবাই- এতে বোঝা যায় যে তিনি জানেন বাবরের প্রথমবার সমরখন্দ জয়ের কথা আর এ ইঙ্গিতও পাওয়া যায় সে বাবরের শের নাম বৃথা যায় নি। হয়ত আলিশের নবাইয়ের কথায় আরও একটি ইঙ্গিত আছে: মির আলিশেরের মানবপ্রেম সুপরিচিত, তিনি হয়ত খুব ভাল চোখে দেখেননি বাবরের প্রথম সমরখন্দ দখল যখন সাতমাস অবরোধের ফলে সমরখন্দবাসীদের অনেক দুঃখকষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। সেবারের ঘটনাকে সিংহের আক্রমণ বলা যায় না কিছুতেই।
প্রশস্ত কক্ষের গভীরে গেলেন বাবর যেখানে সুদক্ষ শিল্পীর হাতে খোদাই কাজ করা দরজাসমেত আলমারিতে তার পুস্তক সংরক্ষিত ছিল। আলমারীর কাছেই রাখা আছে সুগন্ধি চন্দনকাঠ নির্মিত ছ’পায়াবিশিষ্ট একটি নীচু মেজ, তার উপর রয়েছে সোনালী সুতো দিয়ে বাধা একটি পত্র- এটিই তিনি পেয়েছেন নবাইয়ের কাছ থেকে। জরির আসনে বসে বাবর আবার একবার পড়তে আরম্ভ করলেন পত্রটি। পত্রের কয়েকটি অংশে এবারে বিশেষ অর্থ খুঁজে পেলেন, প্রথমবার পড়ার সময় যেগুলিতে বিশেষ গুরুত্ব দেন নি। আন্দিজানের এক স্থপতির কাছে নবাই জানতে পেরেছেন বাবরের কাব্যপ্রতিভার কথা তাই সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে বাবরকে আহ্বান জানিয়েছেন শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, আরও সাহস করে কবিতা রচনাতেও নিজের শক্তি পরীক্ষা করতে। ঐ স্থপতি নিশ্চয়ই মওলানা ফজল উদ্দিন- আন্দাজ করলেন বাবর। বোঝা যাচ্ছে তিনিই হীরাটে পৌঁছে নবাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, তাকে বলেছেন বাবরের কবিতা রচনার খেয়াল আর আরও অনেক কিছুর কথা।… বাবরের ইচ্ছা হলো পত্রের উত্তরের সঙ্গে একটি কবিতাও যোগ করে দিতে। সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতাটিই বেছে নিতে হবে অবশ্যই। কিন’ কোনটি?
অনেকক্ষণ ধরে পাতা উল্টিয়ে চললেন বাবর নিজের মোটা খাতাটার যেখানে তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন নিজের কাব্যপ্রচেষ্টা।
নিঃসঙ্গতার বিষাদ নিয়ে সেই যে গজলটি তিনি একসময় আরম্ভ করেছিলেন যখন তাকে একের এক এক বিশ্বাসঘাতকতার সম্মুখীন হতে হয়, সেটি পাঠালে কেমন হয়? তখন তার নিজেকে উপেক্ষিত ও পরিত্যক্ত মনে হয়েছিল। বাবর শুনেছেন যে এমন কি মহান মির আলিশেরকেও ভোগ করতে হয়েছে অন্তরঙ্গজনের বিশ্বাসঘাতকতার ফল, তার প্রিয় বন্ধু সুলতান হুসেন বাইকারাও তাকে সাহায্য করেন নি, মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করার যে আকাঙ্খা ছিল তার তাকে তৃপ্ত করতে দেন নি। বাবর যদি নিজের কবিতায় প্রকাশ করতে পারতেন নবাইয়ের অন্তরের কথা।
অসম্পূর্ণ সেই গজলটি সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করবেন নাকি? কিন’ তখনকার সেই নিঃসঙ্গতার অনুভূতি আর নেই এখন (শয়বানী আবার শহর ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করছে, সমরখন্দের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে ঠিকই, তবু বিজয় আর জনস্বীকৃতি লাভের আনন্দে এখন পরিপূর্ণ বাবরের মন)। তাছাড়া নোকর এসে তার কাব্যপ্রচেষ্টায় ব্যাঘাত ঘটালো।
‘অধীনের অপরাধ মাফ করবেন, জাঁহাপনা…’
‘কী হয়েছে?’ অসন’ষ্ট বাবরের ভ্রু কুঁচকে উঠলো।
‘আপনার ওয়ালিদা সাহেবা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।’
‘তাই নাকি?’ লাফিয়ে উঠলেন বাবর। ‘এসে পৌঁছেছেন!’
‘পৌঁছেছেন। আর বেগমও এসে পৌঁছেছেন।’
‘চমৎকার! উচ্ছ্বসিত বাবর কাগজকলম সরিয়ে রাখলেন।


প্রায় ছ’মাস হলো তাদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ নেই। কুতলুগ নিগর-খানম, খানজাদা আর আয়ষা বেগম এতদিন অপেক্ষা করছিলেন ওরা-তেপায়, যতক্ষণ না বাবর তাদের আনার জন্য বিশ্বস্ত লোক পাঠান।
নীচের তলার প্রশস্ত কক্ষে বাবর তাদের অভ্যর্থনা জানালেন। বাবরকে আলিঙ্গন করলেন মা, বাবর অনুভব করলেন কেমন যেন কৃশ তার দেহ, হাত বেশ হালকা হয়ে গেছে। বোনের গালে রক্তিমাভা- বোধহয় হিমের মধ্য দিয়ে আসার ফলেই। চোখ তার উদ্দীপনায় উজ্জ্বল: দীর্ঘপথ তাকে একটুও ক্লান্ত করে নি, খুশী, আরো সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। খানজাদা বেগম বাবরের ডান কাঁধ ছুঁলেন- মহিলার তার পুরুষ আত্মীয়কে এইভাবে অভিবাদন জানানোরই প্রথা। অত্যন্ত আনন্দ হলো বাবরের। আয়ষা বেগম সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আছেন নীরবে, মাথা থেকে পশমের আবরণটি খোলেননি তখনও।
‘আপনাদের এত দেরী হল কেন? কয়েক সপ্তাহ ধরেই আপনাদের অপেক্ষায় আছি।’
‘এর পিছনে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে ভাইজান, তাড়াহুড়া করার উপায় ছিল না আমাদের,’ বলে মৃদু হেসে খানজাদা ইঙ্গিতময় দৃষ্টি ফেরালেন আয়ষার দিকে।
সত্যি কথা বলতে কি স্ত্রীর বিরহে বিশেষ কাতর ছিলেন না বাবর, যদিও কোন এক সময় লিখেছিলেন যে তার পায়ের নীচে স্থান নিতেও প্রস্থত তিনি। তরুণ বয়সের সেই সব স্বপ্ন উধাও হয়েছে এখন। তবুও আয়ষা বেগমের প্রতি অমনোযোগী হতে পারেন নি এবং হতে চানও নি তিনি। সতের বছর বয়সী ক্ষীণকায়া স্ত্রীর কাছে এগিয়ে এসে ডান কাঁধ এগিয়ে দিলেন।
‘খুশ আমদীদ, বেগম!’
স্বামীর কাঁধের কাছে আয়ষা তুলে ধরলেন কনুইয়ের হাড় বেরকরা রুগ্ন হাতটি।
‘জয়লাভের জন্য মুবারক, বাদশাহ্।’
‘আর আপনাকেও মুবারক, বেগম, নিজের শহরে ফিরে আসার জন্য!’
‘ধন্যবাদ…’ চোখ নামিয়ে নিলেন আয়ষা বেগম।
‘আর পথেও বেচারী আয়ষা বেগমের খুব কষ্ট হয়েছে,’ বললেন খানজাদা। ‘এ সময় যাত্রা করা ওর পক্ষে বিশেষ কষ্টকর।’
‘এই তাহলে ব্যাপার!’ আয়ষা ক্ষীণদেহী হলেও হঠাৎ কেমন যেন স্থূলকায়া হয়ে গেছেন। পোশাক ফুঁড়ে উঁচু হয়ে আছে দেহের মধ্যভাগ। কৃশ মুখমন্ডলে হলদেটে ফুটকি কতকগুলি দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ বাবর পিতা হতে চলেছেন? মাস ছয়েকের অন্তঃসত্ত্বা হবে।
আগেও ঘোড়ায় চড়ে বা ঢাকা গাড়ীতে করে যাত্রা করলে আয়ষার কষ্ট হতো, মাথা ঘুরতো। আর এখন এই যাত্রায় তার কেমন কষ্ট হয়েছে কল্পনা করতে পারলেন বাবর। বেচারী আয়ষা।
‘এবার সব কষ্টের শেষ হয়েছে,’ বললেন তিনি। ‘আপনাদের জন্য গুছিয়ে রাখা হয়েছে আরামদায়ক ঘরদোর। আর যা কিছু প্রয়োজন হবে, আদেশ করবেন, বুস্তান-সরাইয়ে আমরা সবাই আপনাদের আদেশ পালনে প্রস্থত।’
খানজাদা বেগম খুশীতে হাসলেন, ‘ধন্যবাদ… ধন্যবাদ… আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমাদের অত্যন্ত আনন্দ হয়েছে।
‘আপনার অনুগত ভাইও আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য অধীর হয়ে পড়েছিল, বেগম… আপনারা গিয়ে বিশ্রাম নিন, এদিকে আমরা দস্তরখান বিছাতে বলি…. ঐ চূড়ায়, আকাশের একেবারে কাছে।’ বলে বাবর আঙুল দিয়ে দেখালেন ঘরের ছাতের দিকে আর হো হো করে হেসে উঠলেন ছেলেবেলার মত। তার সঙ্গে বাকী সবাইও হেসে উঠল। এমন কি আয়ষাও।
আজকের দিনটা যে কী আনন্দের। নিজের হৃদয়ের ধুকধুকানি শুনতে শুনতে বাবর ভাবলেন, এ তার ভিতরের বাঁশীতে সরু মিষ্টি সুরে বাজছে পিতা হবার নতুন অনুভূতি। আর আয়ষা বেগমের মুখে খয়েরীহলুদ ছোপ ভর্তি হলেও বাবরের তাকে অত্যন্ত প্রিয়, আপনজন বলে মনে হলো।
রাতের বেলায় যখন আলো নিভিয়ে দিয়ে তারা শয্যায় আশ্রয় নিলেন, আয়ষা কম্বলটা বুক পর্যন্ত টেনে দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলেন উপর দিকে- নিস্পন্দ হয়ে শুয়ে আছেন- অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন বোঝা যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ বললেন, ‘আপনার জন্য আমার গর্ব হয়, জাঁহাপনা।’
তার আর তার স্ত্রীর চিন্তাধারা এমন অপ্রত্যাশিতভাবে মিলে যাওয়ায় চমকে উঠলেন বাবর। এক সময় তিনি আয়ষাকে বলেছিলেন, ‘সমরখন্দে দেখা হবে- সে কথা তিনি রেখেছেন। স্ত্রীর গর্ব হচ্ছে তাকে নিয়ে।
আয়ষা আরও বলতে চাইলেন যে শীঘ্রই যে তিনি বাবরের সন্তানের মা হতে চলেছেন তাতেও তিনি খুশী ও গর্বিত। সেকথা বুঝে বাবর জিজ্ঞাসা বললেন, ‘কবে…. কবে আনন্দ করা যাবে, বেগম?’
‘তিনমাসও বাকী নেই… সময় যতই এগিয়ে আসছে ততই ভয় হচ্ছে।’
‘ভয়ের কী আছে গো…. এখুনি তো বললে যে ‘গর্ব’ হয় তোমার।’
‘বলেছি… যদি খোদা আমাদের পুত্রসন্তান দেন, তবে তার নাম রাখব ফখরুদ্দিন, কেমন?’
‘বাপের নাম জহিরুদ্দিন, বুদ্ধিমতী আয়ষা আর যদি কন্যাসন্তান হয় তো নাম রাখা হবে ফখরুন্নেসা, কেমন, বেগম?
আয়ষা বেগম চেয়েছিলেন পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর গর্ভধারিনী হতে। বাবরকে উত্তরে বললেন তিনি, ‘ঠিক আছে… কিন’ খোদার কাছে আমি কামনা করছি পুত্রসন্তানের জন্য।’
‘তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হয় যেন।’
‘ফখরুদ্দিন… ফখরুন্নেসা.. চমৎকার দুটি নাম। এ নাম যাদের হবে খোদা তাদের ভাগ্যে সুখ দেন যেন।’
দুঃখ যেমন একা আসে না, আনন্দও তেমনি।
একের পর এক সাফল্য আসতে লাগল বাবরের জীবনে। সমরখন্দ জয়ের পরে, পূর্বে উর্গুত আর পশ্চিমে সোগ্দ ও দাবুসিয়া শয়বানী খানের ক্ষমতাচ্যুত বাবরের বশ্যতা স্বীকার করলো। ভবিষ্যৎ লড়াইয়ের জন্য প্রস্থত হচ্ছে শয়বানী, তাই সমরখন্দের অবরোধ তুলে নিয়েছে। প্রধান সৈন্যদলটা নিয়ে সরে গেছে।
আজ আবার সুখবর এসেছে কার্শি আর গুজার থেকে- বাবরের সেনাদল ঐ শহরগুলি থেকে শয়বানীর অনুগত শাসকদের বিতাড়িত করেছে, নতুন সরকার বাবরকে পাঠিয়েছে প্রচুর উপহার আর তার অধীনে কাজ করার জন্য শত শত সৈন্য। যে বেগরা ঐ সৈন্যদের নিয়ে এলো বাবরের কাছে বাবরও তাদের ভরিয়ে দিলেন উপহারে, অর্থে, ভালো বাসস্থান দিয়ে…
গতকাল যে পত্রটি লিখতে আরম্ভ করেছিলেন বাবর মির আলিশেরকে আজ আর লেখার সময় পেলেন না, গ্রন’াগারে যাবার মর্মর পাথরের সিঁড়িতে বোনের সঙ্গে মুখোমুখি হলেন তিনি।
‘আপনি হীরাট থেকে বার্তা পেয়েছেন, একথা কি সত্যি জাঁহাপনা?’
‘সত্যি। মহান মির আলি শেরের কাছ থেকে।’
খানজাদা বেগম ও খবরে আনন্দ প্রকাশ করলেন, মনে হল যেন তিনি ভাইয়ের থেকে কী এক গুরুত্বপূর্ণ খবর শোনার প্রত্যাশায় আছেন, কেমন বিষণ্নভাব, ভাইয়ের প্রতি দৃষ্টিতে যেন প্রশ্ন। বাবর তখনও জানেন না সেটা ঠিক কী কারণে, কিন’ বুঝলেন বোনের মনে গভীর দুঃখ আছে। এক মুহূর্তে দ্বিধা করে দৃঢ়স্বরে বললেন তিনি, ‘চলুন আমার সঙ্গে …. আমি আপনাকে হীরাটের চিঠি দেখাবো।
আলি শের নবাইয়ের চিঠিটা পড়তে পড়তে খানজাদা বেগম যখন সেই জায়গায় পৌঁছলেন যেখানে আন্দিজানের স্থপতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, চোখদুটি তার ভিজে উঠলো।
‘আপনার চোখে জল, বেগম? আমি ভেবেছিলাম আমার বোনটিকে একটু খুশী করবো।’
‘এ চোখের জল… আনন্দের। … আমার ভাইয়ের খ্যাতি যে ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে আমি আনন্দিত।’
‘আমিও আমার প্রিয় বোনের সুখে সুখী হতে চাই।’
‘কী করা যাবে- মন্দ ভাগ্য বোনের…’
‘কিন’ বোনের ভাইটা তো সর্বক্ষমতাসম্পন্ন কৃতী,’ বাবর ঠাট্টার সুরে বলতে লাগলেন, ‘সেও কি সাহায্য করতে পারবে না?’
‘আমার জন্য এমনিতেই আপনার অনেক ঝামেলা সইতে হয়েছে, জাঁহাপনা। সে বছরে যদি… যদি তখন, ওশে, তনবালকে বিবাহ করতে সম্মত হতাম, তাহলে হয়ত সে আপনার সঙ্গে এমন শত্রুতা করতো না।’
খানজাদা এমনি অকপটে মনের কথা বলায় বাবর একেবারে নিরস্ত্র হয়ে পড়লেন, কী গভীর যে তার ভালবাসা বোনের প্রতি তা আরো একবার অনুভব করলেন। ইচ্ছে হল উদার হাতে বোনকে সুখে ভরিয়ে দিতে: তিনি ছাড়া আর কে তার আপন বোনকে সুখ এনে দিতে পারে, এ বোনটির থেকে বেশী প্রিয় তার কাছে তো আর কেউ নেই।
এখন তার সব আপনজনই, ভগিনী, মা, তার সন্তানের গর্ভধারিণী স্ত্রী সবাই এসে পৌঁছেছেন কত বাদশাহ্ আর তাদের বংশধররা। তাদের মধ্যে খুব অল্প কয়েকজনই লোকের মনে ছাপ রেখে গেছেন। আর স্থপতিদের তৈরী স্থাপত্য নিদর্শনগুলি আজও চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, চোখ আর মন দুই-ই জুড়ায় তা দেখে। তাহলে, দেখা যাচ্ছে, শত শত অকর্মণ্য রাজাবাদশার থেকে সুদক্ষ স্থপতির প্রয়োজন অনেক বেশী।
‘বেগম! তনবাল আমার শত্রুতা করেছে কেবলমাত্র আপানার কারণেই নয়।… এ নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। ও হল সাপ- সাপ কখনও তার স্বভাব ভুলতে পারে না, সে যাই হোক না কেন।’
‘আমি তোমার প্রতি… কৃতজ্ঞ বাবরজান,’ খানজাদার গলার স্বর শোনাল তাদের মায়ের মতো।
‘আজীম মির আলি শের এই বার্তা পাঠিয়েছেন আমাদের কাছ থেকে আমাদের প্রসংশার যোগ্য কাজের প্রত্যাশায়,’ আবার বাবর আধোঠাট্টার সুরে বলতে লাগলেন। ‘ঠিক আছে আমরাও এমন সব প্রাসাদ নির্মাণ করব যেগুলো যুগ যুগ ধরে দাড়িয়ে থাকবে। … যাতে খোরাসান মাভেরান্‌নহরকে ছাড়িয়ে না যায় সৌন্দর্যে।’
তারপর মৃদু হেসে যোগ দিলেন, ‘শ্রেষ্ঠ স্থপতিদের এখানে আমন্ত্রণ জানাতে চাই, বেগম। উপযুক্ত দূত মারফৎ উত্তর পাঠাবো মির আলি শেরকে… যদি ঐ স্থপতি, যার কথা মির আলি শের উল্লেখ করেছেন, আমাদের আন্দিজানের মওলানা ফজল উদ্দিন হন তো দূত তাকে সমরখন্দে আমন্ত্রণ জানাবে।’
খানজাদা বেগমের ভিজে চোখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল। তারপর হঠাৎ চোখ নামিয়ে লজ্জাজড়িত স্বরে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘আপনি মাভেরান্‌নহরের আকাশে…আমার আশার একমাত্র তারা, ভাইজান।’
‘আপাজান, খোদার কাছে দোয়া করুন যেন ঐ ক্ষেপা শয়বানীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরিয়ে দেন আমাদের পথ থেকে। খোদা করুন শিগ্রী যেন দীর্ঘস্থায়ী শানি- আসে। তখন আমরা স্বসি-তে কাজে লাগতে পারব, অসম্পূর্ণ গজল ও স্বপ্নের মাদ্রাসা ও মহল তৈরির কাজ সম্পূর্ণ করতে পারব। ওশে আমরা কেমন নির্মাণকাজ আরম্ভ করেছিলাম মনে আছে?’
‘মনে নেই আবার!’ খানজাদা বেগম এখনও সযতনে রক্ষা করছেন মওলানার সেই স্বপ্ন! ‘এ জন্য আমি দিনরাত্রি দোয়া করব।’
বোনের সঙ্গে এই আলোচনার পর বাবর যে লিপিপুস্তকে লিখে রাখতেন মাথায় আসা বিভিন্ন ভাবের খসড়া, অসম্পূর্ণ কবিতাগুলি, সেটি নিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইলেন। একটি দুই পংক্তির কবিতা মনে হল যেন তার বর্তমান মনে অবস্থা প্রকাশ করবে,
ইমানী ইমান খোঁজে, সেটাই যে পায়,
যে আনে যন্ত্রণা, তার যন্ত্রণাই দায়।
এই কবিতাই পাঠাবেন নাকি আলি শের নবাইকে? আর একটি পংক্তি যোগ দিলেন তিনি:
সুলোক হবেই সুখী ইমানদারে ঘেরা।
না বড় সহজ আর সোজাসুজি বলা হচ্ছে (কেটে দিলেন পংক্তিটা)। আবার ভাবনায় ডুবে গেলেন। তার প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো এই চিন্তাধারা যে, এই পাপেভরা পৃথিবীতে আলি শের নবাইয়ের মত এমন বিরল ব্যক্তি যারা মানুষের এত উপকার করেন, মৃত্যুর পরে মানুষের স্মৃতিতে স্থান পাওয়াই তাদের পুরষ্কার নয়, তাদের পুরষ্কার পাওয়া উচিত এই পৃথিবীতে, এই জীবনে অন্য সবার চেয়ে তাদের বেশী সুখী হওয়া উচিত। আর এই সুখ তাদের দিতে পারে তাদের চারপাশের মানুষজনের আনুগত্য ও সহৃদয়তা। কিন’ কেন কে জানে এ চিন্তাধারা তিনি কবিতায় প্রকাশ করতে পারছিলেন না কিছুতেই। আসলে এমনিই কি ঘটে না জীবনে? নিজেকেই প্রশ্ন করলেন বাবর, তারপর আবার একবার কেটে দিলেন পংক্তিটি। তার ওপরে আর একটি পংক্তি যোগ করলেন,
সুলোক না দেখে যেন কু আর বেইমানি।
আবার থেমে গেল কলম, না, হচ্ছে না। খাতা বন্ধ করে উঠে পড়লেন বাবর। অনেকক্ষণ ধরে পায়চারী করলেন। খুশী-হালকা মনের ভাব কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে।
যখন তাকে খবর দেওয়া হল যে শাহ্‌রিসাবজ থেকে কাসিম বেগ আর মোল্লা বিনই- কবি কামালুদ্দিন বিনই এসে পৌঁছেছেন, তখন বিষণ্ন চিন্তাধারা থেকে মুক্তি পাবার সম্ভাবনায় খুশীই হলেন তিনি। ওঁরা দু’জনেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান।
‘অপেক্ষা করার আর কী আছে? এখনই কথা বলা যাবে,’ সি’র করে দেওয়ানখানায় যাবার জন্য নামতে নামতে বাবর মনে করতে লাগলেন বিনইর সঙ্গে আগের সাক্ষাৎ পর্বের খুঁটিনাটি।


হীরাটের প্রখ্যাত কবি বিনইর সঙ্গে বাবরের প্রথম পরিচয় হয় তিনি যখন প্রথমবার সমরখন্দ দখল করেন। বিনইর ছিল শ্রেষ্ট খোশনবীসের নকল করা এক অতি দুষপ্রাপ্য গ্রন’। বাবরের গ্রন’প্রীতির কথা শুনে বিনই তাঁকে ঐ মুল্যবান গ্রন’টি উপহার দিতে মনস্থ করেন। বাবর এদিকে জানতেন যে সমরখন্দে বিনইর ঘরদোর বলতে কিছু নেই, থাকেন যেখানে যখন পারেন, দারিদ্র্যে দিন কাটে তাঁর তাই নি’র করেন গ্রন’টি কিনে নিবেন বিনইর কাছে। তিনি দুর্লভগ্রন’ ব্যবসায়ীদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন কীরকম দাম হতে পারে গ্রন’টি। উত্তর পাওয়া গেল, ‘সর্বোচ্চ মূল্য- পাঁচ হাজার দিরহাম।’
কিন’ সে অর্থ বাবর তাঁকে পাঠিয়ে উঠতে পারেন নি, কারণ সে সময় তিনি রোগে শয্যাগত হয়ে পড়েন এবং দুনিয়া থেকে প্রায় বিদায় নিতে বসেছিলেন।
সুস্থ হয়ে যখন বাবর তিনি আন্দিজান যাবার উদ্যেগ করতে লাগলেন তখন সেই গ্রন’টি তাঁর নজরে আসে (গ্রন’টির নাম ‘মাজমুয়াতে রশীদী*), তখন তাঁর মনে পড়ে যে বিনইকে গ্রন’টির মূল্য পাঠানো হয় নি। তখনই খাজাঞ্চীকে ডেকে পাঠালেন বাবর আর তাঁর বিশ্বস্ত লোকের হাতে কবির জন্য পাঁচ হাজার দিরহাম পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কিন’ লোকটি বিনইকে খুঁজে বার করতে পারে নি: বাউন্ডুলে কবি কোথায় উধাও হয়ে গেছে কে জানে। এদিকে মা আর মুরশীদকে রক্ষা করার জন্য রওনা দেওয়া দরকার বাবরের। বিনইকে খোঁজার সময় নয় তখন, কিন’ বাবর জিদ ধরে রইলেন, ‘এ ঋণ যতক্ষণ না পরিশোধ হয় সমরখন্দ ছেড়ে যাব না কিছুতেই।’
এরপর দূতেরা আর অনুচরেরা শহরের বিভিন্ন অংশে ধাওয়া করলো, বিনইকে খুঁজে বার করলো, তাকে জানানো হল কেন এ অর্থ প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয় (অভিযান স্থগিত হয়েছে) শেষে তার হাতে তুলে দেওয়া হল ঐ পাঁচ হাজার দিরহাম।
পরের ধন গ্রাস করতে আগ্রহী অনেক রাজাবাদশা দেখেছেন বিনই। ষোলবছর বয়সী বাবর-মির্জার সততা কবির মন ছোঁয়, এই ঘটনার স্মরণে তিনি এক কবিতা রচনা করেন। সুদক্ষ লিপিকরকে দিয়ে কবিতাটি নকল করিয়ে বাবর সমরখন্দ রওনা দেবার আগে তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
চুয়াল্লিশটি পংক্তি ছিল কবিতাটিতে। সেটিতে অবশ্য কাব্যসুলভ অতিশয়োক্তি ছিল,
আপন কর্মেতে তুমি শাহ্ ন্যায়পর,
ধরার গৌরব, জহিরুদ্দিন বাবর।
উদার হাসি হাসলেন বাবর: ভাব দেখ- ধরার গৌরব! ছোট্ট একটু সহৃয়তা উপযুক্ত সময়ে দেখানোর ফলে হয়তো, গোটা দুনিয়াটা অন্ততঃ এক মুহূর্তের জন্যও ন্যায়ের প্রতিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে!…
তারপর শয়বানী খান দখল করে সমরখন্দ।
খান এক মুশায়রার আয়োজন করে, যাতে বিনইও আমন্ত্রিত হন। সেই কবির লড়াইতে বিনই একটি কবিতা পড়েন, যেটি শয়বানীর ভালো লাগে। সে তাকে প্রচুর ধনসম্পদ দেয়, শাহী শায়রের পদও দেয়। তাকে দায়িত্ব দেয় নিজের বিজয়ের ইতিহাস লেখার। ঐতিহ্যমতো যেমন হওয়া উচিত। মোল্লা বিনই ‘শয়বানী নামা’ লিখতে আরম্ভ করেন, এই সময় সমরখন্দ আবার বাবরের হাতে চলে আসে। যখন শয়বানী সমরখন্দের চারপাশের অঞ্চলগুলি থেকে নিজের সৈন্যদলকে একে একে নিয়ে ক্রমশ শক্তিসঞ্চয়ের জন্য, নতুন করে লড়াইয়ের জন্য বুখারার দিকে পিছিয়ে যাচ্ছিল, তখন মোল্লা বিনই খানের শিবির থেকে পালিয়ে সমরখন্দ এসে পৌঁছান। বাবরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান তিনি। কিন’ কাসিম বেগ তাকে শয়বানীর সমর্থক বিবেচনা করে বাবরের কাছে যেতে দেয় নি, শাহ্‌রিসাবজে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে। বাবর কিন’ একথা জানতে পারেন নি তখন। সমপ্রতি তিনি কাসিম বেগকে এ ঘটনার জন্য খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘বৃথাই আপনি এমন করলেন। মোল্লা বিনই বেশ বড় কবি। নিজে থেকে যখন এলেনই তখন দেখা করতে দেওয়া উচিত ছিল আমার সঙ্গে।’
ইমানদার কাসিম বেগ বুঝিয়ে দিল, ‘আপনার বড় কবি শয়বানী খানের উদ্দেশ্যে প্রশংসা করে কবিতা লিখেছেন, জাঁহাপনা।’
মৃদু হাসি দেখা দিল বাবরে মুখে, ‘আপনি জানেন না, উনি আমার উদ্দেশ্যেও প্রশংসাসূচক কবিতা লিখেছেন।…. শাসকরা যদি প্রশংসার এতই ভক্ত হয় তো কবি কী করবে?’
কাসিম বেগ এবারে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘জাঁহাপনা, লোকটি শয়বানী খানের গোপন চর হতে পারে।’
একটু চিন্তা করে বাবর বললেন, ‘না, তা সম্ভব নয়। হীরাটে তিনি হুসেন বাইকরার চর হন নি। শয়বানীর দলে থেকে কেবল কবিতাই রচনা করেছেন.. তাও দীর্ঘদিনের জন্য নয়।’
‘কিন’ বিনই খাজা ইয়াহিয়ার বাড়ীতে থেকেছেন, তার নুন খেয়েছেন, তারপর যে শয়বানী খাজা ইয়াহিয়াকে খুন করে, খোলাখুলি তারই সেবা করতে থাকেন। চর যদি তিনি নাও হন, এ কি ভাল কাজ?’
‘মানছি, ভাল না। কিন’ আমাদেরই দেখিয়ে দিতে হবে তাকে কোন কাজটা ভাল।…. মোল্লা বিনইকে জীবিত, অক্ষতদেহে সমরখন্দে নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠান বেগ।’
এ ছিল আদেশ। আজ কাসিমবেগ সে আদেশ পালন করেছে।
নীচে নেমে বাবর এক বিশেষ দরজা দিয়ে দেওয়ানখানায় এসে প্রবেশ করলেন। একটু করে বিপরীত দিকের দরজা দিয়ে কাসিমবেগ আর মোল্লা বিনই এসে প্রবেশ করলেন।
তিনবছর আগে মোল্লা বিনইর চেহারা ছিল শক্তপোক্ত আর ব্যক্তিত্বপূর্ণ। এখন অত্যন্ত রোগা হয়ে গেছেন, যেন গুটিয়ে গেছেন। পরনের পোশাক-আশাকও জীর্ণ হয়ে গেছে। কিন’ বড় বড় চোখগুলিতে আগের মতই ফুটে বেরোচ্ছে আত্মসংযম আর অহংকার।
অভ্যর্থনাকক্ষের মাঝামাঝি বাবর কবির মুখোমুখি হলেন আর আসনগ্রহণ করতে বললেন তাদের। নিজের ডানদিকে বসালেন কাসিম বেগকে আর বাঁদিকে বিনইকে, কবির দিকে ফিরে কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। তাজিক ভাষায় দুই পংক্তির একটি কবিতায় বিনই তার জবাব দিলেন,
ক্ষেত থেকে অন্ন আমি কী করে যোগাই,
গাত্রবস্ত্র অন্ন হায় কোথা থেকে পাই।
এই পংক্তিগুলোর মধ্যে, বিশেষত ‘অন্ন’ ও অন্য’ শব্দটির মধ্যে, শ্লেষের আভাস পেলেন বাবর, খানের খিদমত করার ফলে কবির শোচনীয় ভাগ্যের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মৃদু হাসলেন।
সম্মতি জানিয়ে ঘাড় নাড়লেন বাবর, তারপর কপালে হাত রেখে নিঃশব্দে বসে রইলেন খানিকক্ষণ।
‘আচ্ছা! জাঁহাপনা কবিতার উত্তর কবিতায় দেবেন ঠিক করেছেন: কাসিম বেগ ইঙ্গিতে বিনইকে বলল, ‘অপেক্ষা করুন।’
একটু পরেই বাবর হাত নামিয়ে, উদারভঙ্গীতে বললেন,
তিলমাত্র দেরি না করে ক্ষমতা করবো জাহির
খাওয়াক তোমায় মন্ডা-মিঠে, কামিজে ঢাকুক শরীর।
মোল্লা বিনই আশা করেন নি এত শীঘ্র উত্তর পাবেন, তাজিক ভাষায় ‘গদ্যে’ জিজ্ঞেস করলেন (বাবরের কবিতা ছিল তুর্কী ভাষায়), ‘আর একবার বলুন জাঁহাপনা, ছন্দটা ভালো করে বুঝতে চাই।’
বয়াৎটি সামান্য অদলবদল করলেন বাবর,
ক্ষমতা আমার খাটাব ঠিকই, এইটে আমার ফরমান।
খাওয়াক তোমায় পেট ভরিয়ে, পোশাক করাক পরিধান।
‘আপনার প্রতিভায় আমি চমৎকৃত, জাঁহাপনা।’ বললেন মোল্লা বিনই, চুপ করে নিজের সাদার ছোঁয়াচ লাগা দাড়ির প্রান্ত টানতে টানতে উত্তর খুঁজতে লাগলেন। তারপর মনের মত উত্তর খুঁজে পেয়ে- চোখ তুলে সোজা হয়ে বসে তুর্কী ভাষায় বললেন:
এ মহাদানের অযোগ্য আমি, একেবারেই যে আশাতীত
তবু বলব, জীবনের কখনো ধন-দৌলত চাই নি তো।
বাবরও বিস্মিত হলেন। বিনই যে ফারসী ছাড়া তুর্কী ভাষায় কবিতা রচনাতেও দক্ষ তা তিনি ভাবেন নি। যদিও বিনই যথেষ্ট বিণয় প্রকাশ করেছেন যে তিনি এমনি ‘মহাদানের’ উপযুক্ত নন, কিন’ তা বোধহয় কবিতা রচনার সাধারণ প্রণালীর খাতিরে। হায় কবিতা, কবিতা, তুমি একই সঙ্গে চমৎকার চমৎকার কথা দিয়ে যেমন সত্যকে ঢাকতে পারো তেমনি আবার মেলে ধরতেও পার তাকে।
মুনসীকে ডেকে বাবর তুর্কী ভাষায় বিনইর বয়াৎটি লিখে ফেলতে আদেশ দিলেন।
বাবর আর বিনইর এই মুশায়রা শুনে কাসিম বেগ অভিভূত হয়ে পড়লো। সেই দিনই কাসিম বেগ কবির বাস করার জন্য খুঁজে দিল চমৎকার উঠানওয়ালা একটি ভাল বাড়ী, বাবরের নির্দেশে ময়দা, চাল, একটি মেষ ও লোমের পোশাক পাঠালো তার জন্য। অন্যান্য উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীর মত তার জন্যও নির্দিষ্ট হল- বেশ বড় অঙ্কেরই- মাসমাহিনা।
এই সাক্ষাৎকারের পর আরও বেশ কয়েকবার বাবর হীরাটের কবির সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছেন উপরতলায় নিজের মহলের ‘একান্ত নির্জনতায়’। প্রতিবারই উপাদেয় ভোজ্যবস্থ সামনে সাজিয়ে। প্রথমে বিনই ভেবেছিলেন যে শয়বানীর কাছে তিনি কেমন ছিলেন সেকথা বলতে হবে, তাই প্রস্থত হয়ে ছিলেন কিছুটা ব্যঙ্গের সুরে আর কিছুটা নিজের দুর্বলতাকে তিরষ্কার করে সে সব দিনের কাহিনী বলার জন্য। কিন’ বাবর জিজ্ঞাসা করতেন একেবারে অন্য কথা- হীরাটের কথা, নবাইয়ের কথা, দু’জন কবির মধ্যে প্রথমে খুব বন্ধুত্ব থাকার পরে তাদের যে বিচ্ছেদ ঘটে, সেই সব কথা।
বিনই বলতে থাকেন, ‘একবার আলি শের নবাইয়ের কান ব্যথা করছে খুব, ঠান্ডা হাওয়া কানে যাতে না লাগে সেজন্য একটা সবুজ রুমাল জড়ালেন মাথায়। একজন রেশমী কাপড় ব্যবসায়ী সে কথা শুনে ‘আলি শেরের মতো’ এ কথা লেখা সবুজ রুমাল বিক্রী করতে লাগলো। নবাইয়ের সামনে আমি মাথা নত করি, তিনি মহান কবি, মহান ব্যক্তি, কিন’ স্বার্থসন্ধানী লোকেরা যে নবাইয়ের নাম নিয়ে এইভাবে রোজগার করে লাল হয়ে যাবে, ছোটখাট, আজেবাজে, জিনিস বিক্রী করবে ‘আলিশেরের মতো’ নাম দিয়ে জিন তৈরী করতে দিই ইচ্ছা করেই হাস্যকর ধরনের, আর সেটির নাম দিই ‘আলিশেরের মতো’। সে জিনেরও খুব চল হয়ে দাঁড়ালো। … নিন্দুকে রটাতে লাগল: বিনই আলিশেরকে নিয়ে উপহাস করছে, সেই হলো আমাদের দু’জনের মধ্যে ভুল বোঝাবর্ুঝির কারণ, বিশ্বাস করুন, এতে আমি অত্যন্ত মর্মাহত। নবাইয়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা অসীম। তার বিরহে কাতর হয়ে পড়েছিলাম আমি।’
কথায় কথায় জানা গেল যে বিনই মির আলি শেরকে উৎসর্গ করেছেন একটি কাসিদা। যখন তিনি সেটা বাবরকে পড়ে শোনালেন বাবর চমৎকৃত না হয়ে পারলেন না।
বিনইর অত্যন্ত ইচ্ছা আলি শের জানেন এই কাসিদাটার কথা। বাবর সৌজন্যসহকারে প্রস্তাব করলেন তার যে দূত হীরাট যাবে তার সঙ্গে সেটিও পাঠিয়ে দেবেন।
বিনইর সঙ্গে আলোচনা বাবরকে বারবার মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল নবাইয়ের কাছে তার নিজের রচিত কবিতা পাঠাবার কথা। যে বিনইকে স্বয়ং নবাই একসময় বলেছিলেন ‘সমস্ত দিক থেকেই অতুলনীয়,’ তার কবিতার সঙ্গে নিজের ছত্রগুলি তুলনা করে বাবর বুঝলেন যে তিনি এখন পর্যন্ত সে পর্যায়ে পৌঁছতে পারেন নি, যাতে হীরাটের মহান কবির সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগাযোগ সম্ভব।
এটার পর একটা কবিতা বাতিল করলেন তিনি, প্রচুর অদলবদল করলেন। বাবরের কেমন যেন হল আগে যা ভাবতেন সাধারণ, সহজবোধ্য তা ক্রমশঃ হয়ে উঠতে দুর্বোধ্য -এমন কি মানুষের মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি করছে। যে কবিতা তিনি এতকাল লিখে এসেছেন তা জীবনের জটিলতাকে মেলে ধরতে পারে না, অনেককিছু প্রসঙ্গের উল্লেখমাত্রও নেই তাতে। যেমন, চিন্তাভাবনায় অনেক বড় যে মানুষকে ভাগ্য উঁচু আসনে বসিয়ে দিয়েছে, তার চারপাশের আত্মসর্বস্ব, চাটুকারী, খল-বিশ্বাসভঙ্গকারী লোকজনের মধ্যে পড়ে সে যে কষ্ট পায়, সেকথা কি আছে সেখানে? তার কবিতায় কি সেকথার উল্লেখ আছে সেখানে? তার কবিতায় কি সেকথার উল্লেখ আছে যে শাসক রাজ্যের কি ক্ষতি করে? সমস্ত ক্ষমতা হাতে নিয়ে চিন্তা করে কেবল নিজের কথা, কবি, স্থপতিদের নিজের চারপাশে সমবেত করেও ভাবে নিজের কথাই, নিজের খ্যাতি বিস্তার করার কথাই।… আলিশের নবাই আর মুল্লা বিনই, দু’জনেরই রাজদরবারের লোকজনের প্রতি আর শক্তিমান শাসকদের প্রতি অসন’ষ্ট হবার যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে।
পটোয়া দলের কাছে মঙ্গল হে প্রাণ কখনো জানো হে?
পংক্তি যেন মেলে ধরেছে তার মর্মবেদনাকে, জোরালো ভাষায় চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে মনের কথাকে। এক অন্তর্ভেদী সর্বজ্ঞতার অনুভূতি আন্দোলন তুলেছে বাবরের মনে। সেই মর্মভেদী দৃষ্টিতে তিনি এখন দেখতে পাচ্ছেন হীরাটি আলিশের নবাইকে, এখন মহান কবিকে কিছু বলার আছে তার।… যে লোক অন্যের কাছে মঙ্গলজনক কাজ আশা করে, যে লোক কেবল নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে, তা সে যত উঁচু স্তরের লোকই হোক না কেন- তাকে প্রতারিত হতে হবে, অবশ্যই হতে হবে।
মির আলিশের লোকের মঙ্গল করেন, সেই কারণে বাদশাহ্‌দের (সত্যি বলতে গেলে, তারা সবাই এই নশ্বর জগতে ক্ষণিকের অতিথি) আর খোদ নবাইয়ের চারপাশ যে ‘চাটুকারদের’ ভীড়, তাদের থেকে অনেক উঁচুতে তার স্থান। বাবরের মন চাইল তুলে ধরতে তার জীবনের উদ্দেশ্য- জীবনের উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয় তবেই এ দুনিয়ায় বেঁচে থাকার অর্থ আছে!
পেটোয়া দলের কাছে মঙ্গল হে প্রাণ কখনো জানো হে?
দরবারি তোষামুদেদের চেয়ে সং শাহ্ কেউ জানো হে?
স্বার্থবুদ্ধি নয় নয়, ওঠো এই পাজিদের উঁচুতে,
শুভের সেবায় আত্মনিয়োগে নিজেকে আদমী চিনো হে!
… এইভাবে একরাতে তিনি শেষ করলেন নবাইয়ের উদ্দেশ্যে লেখা তার কবিতা ও পত্র। দুদিন বাদে এক বিশেষ দূত সমরখন্দ থেকে হীরাট নিয়ে যাবে মহামূল্যবান উপঢৌকনসমেত সেই পত্রটি। বাবর ভাবলেন যে শীতকাল শেষ হবার আগেই তিনি নবাইয়ের কাছ থেকে উত্তর পাবেন। কিন’ যখন প্রথম বাসন্তী ফুল ফুটল, তখন হীরাট থেকে প্রত্যাশিত প্রত্যুত্তরের পরিবর্তে এসে পৌঁছাল শোকসংবাদ- শীতকালে আলিশের নবাইয়ের ইনে-কাল হয়েছে। কবির যখন জীবনাবসান হয় দূত তখনও রাস্তায়। কত বছর ধরে বাবর আশাপোশণ করেছেন যে মহান নবাই তার শিক্ষক হবেন। কিন’ তার সে আশা ধূলিসাৎ করে দিল ভাগ্য।…
এদিকে শয়বানীর সঙ্গে আবার যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।


মাটি থেকে সদ্য মাথা তুলেছিল যে ফুলের কলিগুলি সেগুলি দলিত হলো অশ্ববাহিনীর পদতলে।
শয়বানী খান পাহাড়ের উপরে ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে উঠে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো কেমন করে নীচ উপত্যকায় তার অশ্ববাহিনীর স্রোত এসে জড়ো হচ্ছে।
দেখে আনন্দ পাবার মতই দৃশ্য বটে, যদিও এই সেদিন….
সমরখন্দ আর বুখারার মাঝখানে দাবুসিয়া কেল্লাটা বসন্তকালের নীল আকাশ তলে খানের কাছে এখন মনে হচ্ছে যেন মানুষের হাতে গড়া এক ধ্যানগম্ভীর পাহাড়।
গত বছর শীতের মুখোমুখি এই কেল্লাটা যখন বাবরের দখলে চলে যায় তখন অবশ্য শয়বানী এমন চমৎকার উপমা খুঁজে পায় নি, খুবই সঙ্কটজনক অবস্থা তখন- তার দখলে কেবলমাত্র বুখারা। অবশ্য বলাই বাহুল্য, সে-পভূমিও। সে-পভূমি ছিল নিঃসীম, কিন’ সেখানে জনবল আর সেনাবল ছিল সীমিত। কোন কোন সুলতান ইতিমধ্যেই বলাবলি করছিল, এখনও সময় আছে তুর্কীস্তান সে-পে পালিয়ে বাঁচার। কিন’ শয়বানী শোনে নি সে কথা: নিজের ভাগ্যতারকার আর নিজের সে-পভূমির উপর বিশ্বাস ছিল তার। সমরখন্দ থেকে গুপ্তচর তাকে খবর এসে দিয়েছিল কবি ও বিদ্বান লোকেদের সঙ্গে আলাপে মগ্ন বাবর যুদ্ধ প্রস্থতিতে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছেন না। তাছাড়া গত কয়েক বছরে যে শহর এতবার হাতবদল হয়েছে, উপরি উপরি লুণ্ঠিত, নিঃস্ব হয়ে গেছে, বসনে-র মুখে সেখানে মহামারী আর দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।
শয়বানী এতটুকু ঢিলে না দিয়ে সেনাদল সংগঠন করে তালিম দিয়ে চললো। তারপর যখন তারা অতর্কিতে বুখারা থেকে বেরিয়ে দাবুসিয়া কেল্লার কাছে এলো, তখন কেল্লার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্থত। তীর আর পাথরবৃষ্টি আর তাদের ওপর ঢেলে দেওয়া ফুটন্ত তেলে বাহিনীর প্রচন্ড ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও তারা কেল্লার প্রাচীর বেয়ে ওপরে উঠেই চললো। আক্রমণ যখন তীব্র হয়ে পড়ল, সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়ল তখন খান নিজের ভাই মাহ্‌মুদ আর প্রিয়পুত্র তৈমুরের নেতৃত্বে আরও নতুন সৈন্যদল এগিয়ে দিতে লাগলো। সৈন্যরা যখন দেখলো যে খান ভাই বা সন্তান কারোর জন্যই মায়া করছে না তখন তারাও আরও দ্বিগুণ উৎসাহে আক্রমণ চালালো। লোক মরে মরে নীচে পড়তে লাগলো যেন গাছ থেকে ফল ঝরে পড়ছে। উপরে ওঠার জন্য মইগুলির ওপর থেকে মৃতদেহগুলি সরিয়ে ফেলা হতে লাগলো যাতে অন্যরা উপরে উঠতে পারে। কেল্লাপ্রাকারের উপরে হাতাহাতি লড়াই আরম্ভ হলো, নিষ্ঠুর মারামারি চললো, প্রাচীরের বেরিয়ে থাকা উঁচু অংশগুলির ওপর মৃহদেহ পড়ে থাকার ফলে প্রতিআক্রমণকারীদের পক্ষে নীচে তীর ছোঁড়ায় অসুবিধা হতে লাগল।
কেল্লার রক্ষীসৈন্যদলের চেয়ে শয়বানীর সৈন্যদল সংখ্যা ও শক্তি দুয়েতেই বেশী। দাবুসিয়া দখল হয়ে গেল, বিপরীতপক্ষের অবশিষ্ট, জীবিত সৈন্যদের গলা কেটে ফেলা হল খানের আদেশে।
কেল্লা থেকে সাহায্য চেয়ে বাবরের কাছে বার্তাবহ যখন ছুটল ততক্ষণে শয়বানী খানের শিবির বিজয়ের উৎসব শুরু হয়ে গেছে। গত শরৎকাল আর শীতকাল ধরে যে পরপর পরাজয় মেনে নিতে হয়েছে- তারপর এমন জয়ে অবশ্যই সাহস, আনন্দ বাড়ে। এবারে দাবুসিয়াকে অবলম্বন করে শয়বানী সেখানেই সমরখন্দের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্থতি চালাতে লাগল।….
নীচের ঘোড়ার দৌড়- খানের মনোরঞ্জনের জন্য নয়। এ হল অতি কঠোর যুদ্ধ-প্রস্থতি। বাবরের সঙ্গে যে চরম যুদ্ধে নামতে চলেছে শয়বানী বাবরের স্ত্রী কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে। তার নাম রাখা হয়েছে ফখরুণ্নেসা।
শয়বানী খান সপ্রশংস ও ছিদ্রান্বেষী দৃষ্টি নিয়ে নিজের অশ্বারোহী বাহিনীকে লক্ষ্য করতে করতে ভাবল, অহঙ্কার বাড়ল দেখি বাবরের। যাক্ শরৎকালের জয়ের কথা ভেবেই আনন্দ পাক, কবিতা লিখুক, ফখরুণ্নেসা ফখরুণ্নেসা হয়ে উঠুক। সেই ফাঁকে আমার বাজপাখীরা উড়তে আর দুশমনকে নখে ছিঁড়তে শিখুক। তাদের আঁচড়ে যে-কোন লোকেরই প্রাণ বেরিয়ে যাবে।
এর আগে কখনই আর কোন লড়াইয়ের জন্য এমন পাগলের মত প্রস্থতি চালায় নি শয়বানী। বাবরকে পরাস্ত করা তো খুব সহজ কাজ নয়। অল্পবয়সেই সে অভিজ্ঞ হয়ে গেছে। সফল, নির্ভীক, সাহসী। বেশ বুদ্ধিমানের মত কাজকর্ম চালায়, মাভেরান্‌নহরের অধিকাংশ শহর ও জনবসতিই তার প্রতি অনুকূল মনোভাব পোষণ করে।
বেগরা… আর, বেগরা তো বেগই। তারা অর্থলোভী, এ মুহূর্তে যে শক্তিশালী তাকেই ভয় পায়। সুলতান আলির অধিকাংশ বেগই গতবছর তার দলে এসে যোগ দেয়, তারপর আবার যখন বাবর সমরখন্দ দখল করে (দুঃসাহস দেখিয়েছে, কোন সন্দেহ নেই) তখন পালিয়ে গিয়ে যোগ দেয় বাবরের দলে, যার সৈন্যসংখ্যাও ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
এমন কি, আহমদ তনবাল নিজের ছোট ভাই সুলতান খলিলের সঙ্গে দু’শ সৈন্য পাঠিয়েছে বাবরের অধীনে কাজ করার জন্য, যারা ‘চির অনুগত’ থাকবে বলে শপথ নিয়েছিলো, ভয় পাচ্ছে তাকে। এমন যদি চলতে থাকে তো বাবরকে পরাস্ত করা কঠিন হবে।… কিন’ এ যে বসন্ত- গ্রীষ্মকাল তো নয়। গতবছরের শরতের আর পুনরাবৃত্তি হবে না। বাবরের শক্তিবৃদ্ধি হবার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।….
বুখারা আর দাবুসিয়াতে সৈন্যদল আর বিশ্বস্ত শাসক মোতায়েন রেখে শয়বানী দ্রুত এগিয়ে চলল সমরখন্দের দিকে, খোলাখুলিভাবে। তা’ ছাড়া আগে থাকতেই বাবরকে এক পত্র পাঠিয়েছে যাতে তরুণ সেনানায়ককে খোলাখুলি ‘ন্যায়যুদ্ধে’ নামতে আহ্বান জানিয়েছে। খান লিখেছে, বীররা পরস্পরের শক্তিপরীক্ষা করে রণক্ষেত্রে, কেল্লার ভিতরে বন্ধ থেকে নিরাপদে থাকতেই পারে তো কেবল শিশুও।
বাবর সমরখন্দ থেকে বেরিয়ে শয়াবানী সৈন্যদলের মুখোমুখি হবার জন্য এগিয়ে চললেন। কিন’ ক্রোশ দুয়েক দুরত্বে সারিপুলে এসে থামলেন, জরাফশান নদীর কাছে এসে ছাউনি খাটালেন, ছাউনি ঘিরে গভীর পরিখা কাটালেন, কড়িকাঠ আর গাছের ডালপালা দিয়ে দেয়ালে তোলা হল তীর যাতে ভেদ করতে না পারে।
না, তখনি যুদ্ধ আরম্ভ করার পরিকল্পনা ছিল না তাঁর, অপেক্ষা করতে হবে আরো সাহায্য এসে পৌঁছাবার, সেই সঙ্গে সেই সৈন্যদলেরও যারা শয়বানীর দলের পিছনদিকে আঘাত হানবে।
দূর তুকীস্থানের থেকে সৈন্য এসে পৌঁছানর অপেক্ষায় তারা আর নেই। আর বাবরের কাছে যে সাহায্য এসে পৌঁছবে তা জানতো শায়বানী। শাহ্‌রিসাবজ থেকে পাওয়া গোপন খবরে জানা গেল যে বাকি তরখান যেখানে দু’হাজার সৈন্য জয় করছে আরও এক হাজার সংগ্রহ করে যথাসম্ভব দ্রুত এসে পোঁছবে বাবরের সাহায্যে।
অবিলম্বে লড়াই আরম্ভ করতে হবে, সে যেভাবেই হোক না কেন, শয়বানীর দিনরাতের চিন্তা কী ক’রে তা সম্ভব।
ঢাকঢোল আর শিঙ্গার কানফাটানো আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে তীর বৃষ্টি আরম্ভ হলো। তাতে অবশ্য বাবরের দলের বিশেষ কোন ক্ষতি হল না। খানের অশ্ববাহিনী পরিখা পার হতে পারলো না। পার হওয়ার কোন উদ্দেশ্য অবশ্য তাদের ছিলো না। সৈন্যরা দারুণ হৈ হল্লা আরম্ভ করে দিলো, গোলমালের মধ্যে যেতে বিভিন্ন অপমানকর মন্তব্য-
‘লুকিয়ে পড়লে যে বড়? খোলা ময়দানে লড়তে চাও না বুঝি?’
‘ভীরু! কাপুরুষ!”
‘বাবর ভয়ে থরথর কাঁপছে, আমাদের খানের সামনে বেরোতে চায় না!’
‘এই, যে ভয় পায় না, মুন্ডুটা বার করুক দেখি!’
শয়বানী খান জানতো যে রাতের অন্ধকারে এমনি গোলামাল লোকের মনে অত্যন্ত জোর প্রতিক্রিয়া তৈরী করে। শতশত, হাজার হাজার অশ্বারোহী ছুটে বেড়াচ্ছে ছাউনির আশেপাশে, ঘোড়ার খুরের আওয়াজ আর বন্য চীৎকারে মাটি কেঁপে কেঁপে উঠছে, ডালপালা দিয়ে তৈরী করা প্রাচীরের ওপর এসে পড়ছে জ্বলন্ত তীর, এমন হৈ হল্লার মাঝে ছোট্ট আগুনের শিখাটাকেও দাবদাহ বলে মনে হয়। এমন সময় সত্যি সত্যি, বাবরের বাহিনীর ঘোড়ার খাবার জন্য জড়ো করে রাখা বিচালিতে আগুন ধরে গেলো, পরিখার অদূরে খাটানো তাঁবুর পমশী আচ্ছাদন থেকে ধোঁয়া উঠতে লাগলো।
রাতের অন্ধকারে এই ধূর্ত আক্রমণ যদিও প্রতিরোধ করা হলো, তবুও এতে আক্রমণকারীদের উৎসাহ বেড়ে গেল। আসলে এটা ছিল জ্যোতিষীর উদ্দেশ্যে সঙ্কেত, কাজ আরম্ভ করো, তাড়াতাড়ি।
কাসিম বেগ বারবার বাবরকে বোঝাতে লাগলো, শাহ্‌রিসাবজ থেকে সাহায্য এসে পৌঁছান পর্যন্ত অপেক্ষা করা দরকার। কিন’ বাবর সে কথা আর শুনছে না। নক্ষত্রের যোগ দ্রুত জয়ের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তাকে।
‘এই আটটি তারার দিকে দেখুন, জাঁহাপনা!’ গূঢ় রহস্য জানানোর ভাবে নীচুস্বরে শাহাবুদ্দিন বোঝাচ্ছিল বাবরকে। ‘অতি বিরল ঘটনা: আটটি তারাই এক সারিতে। এ অতি শুভচিহ্ন। তারাগুলো জয়ের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে আপনাকে, কেবল আপনাকেই। … দেরী করা চলে না। দু’তিন দিন বাদে, এই আটটি তারার কোনটি হয়ত দিগনে-র ওদিকে চলে যাবে যেখানে আছে আপনার প্রতিপক্ষ।
জ্যোতিষী মওলানা শাহাবুদ্দিন সাহায্য করলো। আগে সমরখন্দের প্রখ্যাত এই জ্যোতিষী শয়বানীর কাছে কাজ করতো। তারপর যখন খান জানতে পারলো পলাতক কবি বিনইকে বাবর কী পরম বিশ্বাসে গ্রহণ করেছেন, তখন সে নিজের বাহিনী থেকে জ্যোতিষীকেও পালিয়ে যেতে দিলো। মেরে তার রক্ত বার করে দিলো, পোশাক-আশাক ছিঁড়ে ফেলা হলো; সবার প্রতিই বাবরের বিশ্বাস, সহানুভূতি, তা ভাল করেই জানা আছে লোকের। তাই হলো। শয়বানীর চর বাবরের অন্তরঙ্গদের একজন হয়ে গেলো। তারাভরা রাতে আকাশের চাঁদোয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতেন দু’জনে, আর তখনই মওলানা শাহাবুদ্দিন নিজের উদ্দেশ্য সারতো- বাবরকে ভবিষ্যৎবানী করত দারুণ জয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
তাদের মধ্যে যোগাযোগরক্ষাকারী দরবেশের মাধ্যমে জ্যোতিষীকে জানানো হলো খানের আদেশ, এই সপ্তাহেই যুদ্ধ আরম্ভ করার জন্য বোঝাতে হবে বাবরকে। সকালবেলায় উত্তর পাওয়া গেল, শক্তিমান খলিফার ইচ্ছা অবশ্যই পূর্ণ হবে- কেবল এক শর্তে- আগামী কোন এক রাতে খানের সৈন্যদল আক্রমণ করবে বাবরকে, আসল যুদ্ধ নয়, একটুখানি হম্বিতম্বি করতে হবে যাতে তরুণ সেনানায়কের আত্মসম্মানে ঘা লাগে।
সে রাতগুলি ছিল অন্ধকার, কৃষ্ণপক্ষের রাত। এমনই এক অন্ধকার রাতে খানের অশ্ববাহিনী হুড়মুড় করে এসে পড়লো বাবরের ছাউনির কাছে।
সেই গোলামালভরা রাতে শয়বানী ঘুমোয় নি মোটেই, কেবল ভোরের দিকে ঘন্টাখানেকের জন্য চোখ বুঁজেছিলো। সেখান থেকে বাবরের ছাউনি আর সেদিকে যাবার পথ ভাল করে দেখা যায়। প্রতিআক্রমণ আরম্ভ হবার একটু আগে ঐ পথগুলির একটি দিয়ে বাবরের ছাউনিতে এসে পেীঁছালো, আল্লার রহমত, শাহ্‌রিসাবজের বাহিনী নয়- তাশখন্দ থেকে মাহ্‌মুদ খানের পাঠানো মোগলের দল- তিন-চারশ’ জন সৈন্যের একটি দল। এদের কোন ভয় নেই শয়বানীর; সে জানে সমরখন্দবাসীদের সঙ্গে মোগলদের বিশেষ সদ্ভাব নেই, আর বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহকরা এই সৈন্যের নিজেদের মধ্যেও খুব মিলমিশ নেই।
নিজের সমস্ত ক্ষমতা আর অভিজ্ঞতা নিঃশেষ করে শয়বানী দিনরাত যুদ্ধের জন্য প্রস্থতি চালাতে লাগলো। দিনের বেলা পর্যবেক্ষণ করে বেড়াতো ভবিষ্যৎ রণক্ষেত্রের প্রতিটি পাহাড়, প্রতিটি গুহা, ভেবে দেখতো কোনদিক থেকে সূর্যের আলো পড়বে, কোনদিকে হাওয়া বইবে।
যখন শয়বানী দেখলো যে বাবর তার সেনাদল সাজাচ্ছে, অর্ধচন্দ্রশোভিত ঝান্ডা তোলা হচ্ছে, তখন সে যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্থত।
নিজের প্রিয় ঘোড়ায় চড়ে শয়বানী তার সেনাদলের সারিগুলোর মধ্যে দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।
‘শোনা আমার আদরের বাজপাখীরা,’ মিষ্টি সুরেলা গলায় বলল সে, ‘আর কোন ভরসা নেই আমাদের। আমাদের পিতৃভূমি এখান থেকে অনেক দূরে, যদি দুশমন আমাদের হারাতে পারে, তা’ হলে আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারব না। তাই দুশমনকে হারাতে হবে আমাদের। খোদাতালার ওপর বিশেষ ভরসা আমার। আমরা- তার লস্কর।… স্বপ্নে আমি জেনেছি- জয় হবে আমাদের।’
‘ইনসা-আল্লা। সবই আল্লাহ্র হাতে।’ হাজার হাজার গলায় এক ধ্বনি উঠল।
যতটা সম্ভব আড়ম্বরে আর ধীর বিশ্বাস নিয়ে শয়বানী কোরানের একটি অনতিদীর্ঘ সুরা পড়লো নিজের সৈন্যদলের সামনে। কোরান পড়া শেষ করলো সে পরিষ্কার আর একই সঙ্গে জাদুমাখা স্বরে- প্রকৃত ইমামের মত স্বরে, ‘আল্লাহ্ আকবর! আমিন!’
‘আল্লাহ্ আকবর।’ হাজার হাজার কণ্ঠের চীৎকারে আকাশবাতাস কেঁপে উঠল। সৈন্যরা গাজী খলিফার বক্তৃতায়, তার ভবিষ্যৎবানীতে উত্তেজিত হয়ে একত্রে প্রচন্ড শক্তিতে এগিয়ে চলল শত্রুর দিকে। সে সৈন্যদল যেন একটা দেহ, যেন গুণটানা একটা ধনুক।
বাঁদিকে নদী। বাহিনীর গতি সামান্য রোধ শয়বানী ডানদিকের দলকে বাঁদিকের দলের থেকে বেশী দ্রুত চালালো। এখানটায় মাটি ঢালু হয়ে নীচে নেমে গেছে, সৈন্যদের পিঠে হাওয়া লাগছে পিছন দিক থেকে। আরো, আরো দ্রুত, অশ্ববাহিনী আরো দ্রুত ছুটতে সক্ষম।
শয়বানী তুলাগামা পদ্ধতিতে শত্রুপক্ষকে ঘিরে ফেলতে চায়, তার জন্য প্রয়োজন অত্যন্ত দ্রুত গতিবিধি। ডানদিকের দলে আগে থেকেই রাখা হয়েছিল বিদ্যুৎগতি অশ্ব আর সবচেয়ে দক্ষ অশ্বারোহীদের।
বাবর দেখলেন শত্রুপক্ষের ধনুকের বাঁদিকের অর্ধেকটা- শয়বানীর কাছে যেটা ডান দিক- বেঁকে এগিয়ে এসেছে। শত্রুর মুখোমুখি হবার জন্য নিজের ডানদিকের হাতার মুখ ফিরিয়ে সামনে এগিয়ে দিলেন- এবার নদীর দিকে পিছন করে দাঁড়াল তার বাহিনী।
খানের সৈন্যদল আসছে। তাদের সেনানায়ক কয়েকজন বাছা বাছা দেহরক্ষী সিপাহী আর আর পতাকাবাহীদের নিয়ে রয়ে গেল পাহাড়ের উপরে। ক্রোশখানেক দূরে ঐ রকমই আর একটা পাহাড়ের উপরে বাবর দাঁড়িয়ে। তার পেছনে জরাফশান নদী ঝলকাচ্ছে সকালের সূর্যের আলোয়।
শয়বানী খানের অশ্বারোহী বাহিনী ছিল বেশী বড়। বাবরের দলে ছিল উঁচু ঢাল, লম্বা বর্শা, আর বড় হাতলওয়ালা কুঠারসজ্জিত বিশালসংখ্যক পদাতিক সৈন্য। এমন ঢাল, বর্শা আর কুঠারের দেওয়াল ভেদে করে ছুটে চলা অশ্ববাহিনীর পক্ষে খুব সহজ নয়। কিন’ অশ্ববাহিনী থাকার সুবিধা হলো তার দ্রুত গতি। তুলগামার অর্থ হলো শত্রুবাহিনীর পাশ থেকে আক্রমণ করা, শত্রুদলের কেন্দ্রস্থল থেকে দূরে যে অংশগুলি দুর্বল সেখানে প্রাণঘাতী বর্শা আর তীক্ষ্ম তীর ছুঁড়তে থাকা।
বাবরের পদাতিক বাহিনী তখনও সিকি ক্রোশ দূরে- এমন সময় খানের আদেশানুসারে মাহমুদ সুলতান, জানি বেগ সুলতান ও তৈমুর সুলতান অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের অশ্বারোহীবাহিনীর মুখ ঘোরাল ডানদিকে, আরও ডানদিকে, পেরিয়ে গেল বাবরের সেনাদলের মধ্যভাগ ও বাম দিকের অংশ। শয়বানী ‘ধনুর’ বাম অংশে অভিজ্ঞ হামজা সুলতান ও মাহ্‌দি সুলতানও বামদিক থেকে তাই-ই করল একটু ধীরগতিতে: কেন্দ্রস্থলকে না ছুঁয়ে, শত্রুসেনাদলের বামদিক পেরিয়ে তাদের পিছনদিকে এগিয়ে চললো।
বাবর তার বাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী অংশকে রেখেছিলেন কেন্দ্রস্থলে, এখন অত্যন্ত দ্রুত তাদের কিছু কিছু অংশ নিয়ে আসতে হলো বামপাশে আর ডানপাশে। তুলগামার একটি অসুবিধাও আছে: ধনুর দুই অর্ধভাগ পরস্পর থেকে অনেক দূরে সরে যাবার সম্ভাবনা থাকে, কেবল দু’টি বিছিন্ন অর্ধাংশ। ‘ঝাপিয়ে পড়ো !’ শয়বানী বাহিনীর দুর্বল মধ্যভাগে আঘাত করলো বাবরের সৈন্য দল। সবকিছু এখন নির্ভর করছে অত্যন্ত দ্রুতগতির উপর!
খানের বাহিনী এগিয়ে গেল। বাবরের অশ্বারোহীবাহিনী ডান বা বাঁ কোন দিকে থেকেই তাদের পথরোধ করতে পারল না। মাহমুদ সুলতান পৌঁছে গেল বাবরের বাহিনীর পেছনে। হামজা সুলতানের বাহিনীও বাবরের বাহিনীর পাশ কাটিয়ে এসে মিলিত এসে মিলিত হলো সুলতানের বাহিনীর সঙ্গে। পিছনদিক থেকে অপ্রত্যাশিত আঘাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল বাবরের বাহিনী। শত্রপক্ষের তাড়া খেয়ে মধ্যভাগে অবসি’ত পদাতিক বাহিনীর উপর চাপ সৃষ্টি করলো নিজেদেরই অশ্বারোহী বাহিনী।
বাবর তাঁর নিজস্ব ঘোড়সওয়ার বাহিনীর সেরা শ’খানেক সৈন্যকে একটি মুঠিতে একত্রিত করলেন। রণক্ষেত্রের এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে তার অগ্নিশিখার মত শত্রুপক্ষের দুর্বল মধ্যভাগ ভেদ করে সোজা ছুটে চললো সেই দিকে যেখানে শয়বানী দাঁড়িয়েছিল। শ’খানেকের দলের এই আক্রমণ ছিল ভয়ংকর। কুপাকবির যতক্ষণে এগিয়ে আসবে ততক্ষণে ঐ ‘মুঠি’ শয়বানী খানকে ঘিরে থাকা সৈন্যদের বিনাশ করবে। শয়বানীর দলের মধ্যে সাড়া জাগলো। মোল্লা আবদুর রহিম যেন বিকারগ্রসে’র মত নিজের বাধ্য ঘোড়াটির ঘাড় জড়িয়ে ধরে কাকুতিমিনতি করতে লাগলো, ‘হুজুরে আলী, আমাদের মুকদ্দম ইমাম, নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়া উচিত আপনার। না হলে আর রক্ষে থাকবে না…’
শয়বানীর মুখ মড়ার মত ফ্যাকাশে হয়ে গেল। নিরাপদ জায়গায় সে নিজেই সরে যেতো, কিন’ এই পাহাড়ের উপর তার পতাকা উড়ছে। সে যদি পাহাড়ের ওপাশে নেমে যায় তো তার সৈন্যরা খলিফা বা তার পতাকা কিছুই দেখতে পাবে না। আতঙ্ক পড়বে তাদের মধ্যে যা ডেকে আনবে পরাজয়।
শয়বানী চীৎকার করে বলল, ‘মরে গেলেও পিছু হঠবো না।’
তার নিজের বাছাবাছা সৈন্যদের (খলিফার ব্যক্তিগত একশ’জন রক্ষী) আদেশ দিল কঠোরসুরে, ‘লড়ো সবাই! ধর ওদের, জান দিতে হলেও ধর।’
খানের শেষ ভরসা, একশ’জন সৈন্য যাদের তাকে রক্ষা করার, যে কোন বিপদ থেকে আড়াল করার কথা। মরণপণ শক্তিতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য। তাদের অনেকে মরলো কিন’ বাবরের ‘মুঠির’ জোরও কমে এলো, শিথিল হয়ে এলো। ততক্ষণে কুপাকবিও এসে পড়েছে, তার চারশ’ অশ্বারোহী সৈন্য বাবরের দলকে ঘিরে ফেললো। কিন’ বাবরের জনা দশ-বারো অতি চটপটে যোদ্ধা কুপাকবির সৈন্যদের হাত এড়িয়ে আবার এগিয়ে চললো যেখানে শয়বানী ছিল সেইদিকে। খানের লোকেদের কিছু অংশ পিছিয়ে গেল। খান নিজে কিন’ রয়ে গেল, একটা তীর ছুঁড়ল সে, যদিও তীরটা কারো গায়েই লাগল না, তবুও কুপাকবির সাঙ্গপাঙ্গরা দূর থেকে আনন্দ-উল্লাস করে উঠলো, বাবরের দলের লোকদের এক এক করে ধরে কেটে ফেললো তারা সবাইকে।
ওদিকে লড়াইয়ের প্রধান অংশে বিশৃংখলায় সাফল্যও অনুভব করা যাচ্ছে। পাদতিক সৈন্যরা আর বাবরের আদেশ পালন করতে পারছে না। তাশখন্দ থেকে সম্প্রতি যে মোগলরা এসে যোগ দিয়েছিলো, বাবর হেরে যেতে বসেছেন দেখে তারা পালিয়ে যেতে লাগলো আর চলে যাবার সময়ে লুঠ করে নিয়ে যেতে লাগলো সওয়ারী ছাড়া ঘোড়াগুলোকে। কোন কোন মোগল ঘোড়সওয়ার আর এই তালে গোলে আন্দিজানে আর সমরখন্দের যে সৈন্যদের সঙ্গে মিলে এতক্ষণ লড়াই করছিল তাদেরই ঘোড়ার পিঠ থেকে ফেলে দিতে লাগলো ঘোড়াগুলি নিয়ে নেবার জন্য।
মাহমুদ সুলতানের অগ্রণীদলগুলি ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল বাবরের দিকে।
অবশেষে বাবর তার দেহরক্ষী পরিবৃত হয়ে পাহাড়ের উপর থেকে নামতে লাগলেন নদীর দিকে। শয়বানী দেখল তার এই পিছু হঠে যাওয়া। কিন’ বাবরকে ধাওয়া করার আদেশ দিল না- ফাঁদে পড়ার ভয় হলো তার। আসলে এটা কিন’ বাবরের কোন কৌশলই ছিল না। নদীর স্রোতে ঘোড়া ছেড়ে দিলেন বাবর। তার কয়েকশত বীর সৈন্য তীরে প্রাচীর সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে রইলো, আক্রমণকারীদের রুখবার জন্য।
শয়বানী দু’হাত তুলল আকাশের দিকে, ‘তোমরা রহমত কোনদিন ভুলবো না, খোদা।’
বাবর নদীর দিকে পিছিয়ে গেছে দেখে নিজের হতবুদ্ধিভাব ঝেড়ে ফেলে শয়বানী একজন অনুচরকে বললো, ‘শীগগীরি ঘোড়া ছুটিয়ে যা, আমার বাজাপাখীদের বল গিয়ে যে বাবরের মাথা এনে দিতে পারবে আমায় সেই মাথায় সমান ওজনের সোনা পাবে সে।’
ঘোড়া ছোটাল অনুচরটি কিন’ শয়বানী আবার থামাল তাকে, ‘না, বল্ গিয়ে… বাবরকে জীবিত ধরে আনতে যে পারবে, সে বাবরের সমান উঁচু সোনার পাহাড় পাবে। যা শীগগীরি! ওকে আমার পায়ের তলায় দেখতে চাই- জীবিত বা মৃত যেভাবেই হোক।’
শয়বানী আবার হাত তুলল আকাশের দিকে। এমনিভাবেই স্থব্ধ হয়ে গেল। চোখের পাতা ভিজে অনুভব করল- এ হল আনন্দাশ্রু। মৃদু হেসে হাত নামিয়ে নিল আর সেই সঙ্গে দ্রুত চোখ মুছলো হাত দিয়ে।


গ্রীষ্মকালের সবচেয়ে গরম মাস সারাতান শেষ হয়ে আসাদ মাস পড়েছে।
শহরপ্রাচীরের ওপাশে গাছগুলি ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে, যেন অন্নদাত্রী মাটিকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। এদিকে শহরের মধ্যে বাগান বা আঙুরখেত সব শূন্য হয়ে গেছে: যে সব গাছপালা হলুদ হয়ে যায় নি, সেখানে দেখা যায় না একটিও পাকা আপেল বা মিষ্টিরসে ভরা পীচফল বা একগুচ্ছ আঙুর। পাঁচমাস ধরে অনাহারে কষ্ট পাচ্ছে সমরখন্দবাসীরা, অবরোধ ক্রমশঃ কঠিন, নিষ্ঠুর, নির্দয় হয়ে উঠেছে। শহরের সব প্রবেশপথই বন্ধ, শহরের একেবারে কাছেই শয়বানীর সৈন্যদল অবস্থান করছে। কেউ শহর থেকে বেরোতে পারছে না, ঢুকতেও পারছে না কেউ।
উলুগ বেগের মাদ্রাসার ছাদের ওপর সমান জায়গায় বাবরের সাদা ছাউনি খাটানো হয়েছে। এখান থেকে ভাল করে দেখা যায় প্রবেশপথ সমেত প্রাচীর ও তার আশপাশ। বাবরের নজর নিজের অজানে-ই নিবদ্ধ হয়ে থাকে ক্ষুধার্ত লোকেদের উপর- হায় আল্লাহ্, কার্ণিশের নীচে বাসা গেড়েছে যে পায়রাগুলো ওরা তাদের ধরার চেষ্টা করছে। পাখীরাও সাবধান হযে গেছে, শহরের রাস্তায় এখন আর পড়ে থাকে না রুটির টুকরো বা খাবারের উচ্ছিষ্ট- তাই পাখীদেরও খাবার কিছু নেই। কিন’ পাখী উড়ে যেতে পারে প্রাচীরের ওপাশে। আর লোকেরা কী করবে? কেউ যদি কুকুর বা বিড়াল ধরতে পারে তো দাঙ্গা বেধে যায়, তার কাছ থেকে শিকারটা কেড়ে নিতে চায় সবাই।
মাদ্রাসার পিছনেই বিরাট আস্তাবল। আগে সেখানে থাকতো প্রাসাদের শতশত ঘোড়া। এখন সেখানে আছে মাত্র গোটাদশেক- তার বেশী নয়। সারিপুলের লড়াইতে বিরাট ক্ষতি হয়েছে, তার থেকে আরও বড় ক্ষতি হয়েছে- এই আকালে। প্রাসাদের লোকেদের খাওয়ানোর জন্য কাটা হয়েছে একটার পর একটা ঘোড়া। এখন এই যে গোটা কয়েক ঘোড়া অবশিষ্ট আছে এগুলিও প্রায় একমাস দানা জোটে না। ঘাস খাওয়ানো হয়েছে কিছুদিন- তাও আর নেই। এমনকি গাছের পাতা খাওয়ানো হয়েছে ঘোড়া, উটদের। গাছের ছাল ভিজানোও।
ওপর থেকে, মাদ্রাসার ছাদ থেকে বাবর দেখতে পাচ্ছেন তাহের আর হলুদগোঁফ মামাত আস্তাবলে ঘোড়াদের খেতে দেবার যোগাড় করছে এই সব ধরনের খাবার। বেশ সাহসী এই তাহের। সারিপুলের লড়াইতে সেই সব বাছাবাছা সৈন্যরা, যারা লড়াইয়ে শেষে প্রাণ দিয়েছে বাবরকে নিরাপদে ফরাফশান নদী পেরিয়ে যেতে দেবার জন্য, এমনকি তাদের মধ্যেও তাহেরের কৃতিত্ব লক্ষ্য করার মতো। সম্প্রতি বাবর ওর বিবাহের কাহিনী শুনেছেন। অনেক দুঃখকষ্টের পর আবার ফিরে পাওয়া তার স্ত্রী রাবেয়া যাতে অনাহারে না মরে সেজন্য তাকে বাবরের মা কুতলুগ নিগর-খানমের পরিচারিকা নিযুক্ত করা হয়েছে।
মামাতও বাবরের অনুচর হয়েছে। গত সপ্তাহে সে জলের নালী দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল শহরের বাইরে বাগানের ফল পেটভরে খাবার জন্য সেখানে খানের সৈন্যদের হাতে পড়ে সে, ক্ষুধার্ত কারিগর বলে নিজের পরিচয় দেয়- ছাড়া পায় সে, কিন’ তাকে একটু ‘শিক্ষা দেবার’ জন্য একটা কান কেটে দেয় তার। ভাগ্য কখন যে সহায় আর কখন যে বিরুদ্ধে তা বোঝার উপায় নেই। অন্য যারা সাহস দেখিয়ে বাইরে গিয়েছিল কুপাকবির লোকরা তাদের নাক কেটে দিয়েছে।
এখন মামাত টুপিটা কান পযন্ত টেনে নামিয়ে চলাফেরা করে। কখনও কখনও নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয়, ‘কাটা কান তো তবু চাপা দেওয়া যায়, কিন’ কাটা নাক কী করে ঢাকতাম?’
‘হায় আল্লাহ্’, বাবর নিজে সাতমাস সমরখন্দ অবরোধ করে মামাতের মত এমন সাধারণ সমরখন্দবাসীদের কত দুঃখের কারণ হয়েছেন। বাবর ভুলে যান নি বইয়ের বাজারে সেই বৃদ্ধটির কথা, যার ছেলে খইল খেয়ে সার শরীর ফুলে মারা যায়, তার ফলে বৃদ্ধার মাথার গোলমাল হয়ে যায়। এখন প্রতিশোধ গ্রহণকারিণী নিয়তির রায় দেবার মত করে বাবরের বুকে বাজলো সেই বৃদ্ধার কথা, ‘আপনারও কপালে এমনি ঘটুক।’
দরিদ্রের কুটির থেকে দুভিক্ষ এবার গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চললো বেগদের বাড়ীর দিকে, তারপর বাদশাহের মহলের দিকেও। দশদিন হল বাবর নিজেও রুটি দেখেনি চোখে। আটা ফুরিয়ে গেছে। সোনার থালিতে করে তার সামনে রাখা হয় সকালে একমুঠো শুকানো আঙুর আর চা, সন্ধ্যাবেলায়- এক বাটি পুরনো শক্ত উটের মাংসের ঝোল। রুটিই যদি নেই তো দামী সোনার বাসনপত্র দিয়ে কি হবে? অন্তরের অন্তস্থল থেকে উঠে সোনার ছলনাময় প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিক্ততা ভরা কয়েকটি পংক্তি- কিন’ এখন কবিতা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই বাবরের।
কেঁদে কেঁদে গলা বসে গেছে ছ’মাসের ফখরুণ্নেসার: অত্যন্ত রুগ্ন হয়ে পড়েছে আয়ষা বেগম, তার বুকে দুধ নেই। তাই ফখরুণ্নেসাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য খুঁজে বার করা হলো সদ্য মা হওয়া এক মহিলাকে। এইভাবে বিপদ ডেকে আনলেন তারা নিজেরাই। স্তন্যদাত্রী মহিলাটির পরিবার ছিল বিসূচিকাগ্রস্ত। দু’দিনের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল।
সাদা কাফনের জড়ানো ছোট্ট দেহটি হাতে করে নিয়ে চললেন বাবর সমাধি দেবার জন্য। কাঁদছেন, ‘বিসূচিকা আমাকেও ধরুক, তাহলেই সব জ্বালাযন্ত্রণা জুড়োবে’ এই তিক্ত আশা নিয়ে বাবর শিশুকন্যার হিমঅধরে চুমো দিলেন। তার গর্ব, জয়ের প্রতীক ফখরুণ্নোকে সমাধি দেওয়া হলো। সারা দেহমন দিয়ে বাবর অনুভব করলেন যে সমাধি দেওয়া হচ্ছে তার জীবনের এক অংশকে আর গত বিজয়ের গর্বকে।
অবরুদ্ধ শহরের দুঃখকষ্ট যত বাড়ছে, শত্রুদের আনন্দ-উৎসবও ততই বাড়ছে। পাঁচমাস ধরে সমরখন্দ অপেক্ষা করে আছে কবে হীরাট থেকে বাবরের চাচা- শক্তিশালী হুসেন বাইকারা, তাশখন্দ থেকে চাচা মাহমুদ খান সাহায্য পাঠাবেন। তাদের চিঠি লিখেছেন বাবর, কাকুতিমিনতি করে। কিন’ কোন সাহায্য আসে নি। এখন কেবল নিজের ওপরই ভরসা করতে পারেন বাবর। সাহায্য আগেও কখনও পান নি আর পাবেন না। শয়বানী খানও তা বুঝেছে, প্রতি রাতে ঢাক আর শিঙা বাজিয়ে সে সমরখন্দবাসীদের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। ঘোষকরা দেয়ালের কাছে উঁচু ঢিপির ওপর উঠে দাঁড়িয়ে শহরবাসীদের আহ্বান জানায় শয়বানীর দলে যোগ দিতে, পেটভরে খেতে দেবার প্রলোভন দেখায়। বেগদের আর সৈন্যদের ভালো কাজ দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। কোন কোন বেগ অবশ্যই ছেড়ে যায় বাবরকে, গোপনে প্রাচীর পার হয়ে বা নালী দিয়ে বেরিয়ে যায়।
বাবরের ব্যক্তিগত রক্ষীদলের প্রধানও একদিন পালালো চুপিচুপি। এখন আর কার ওপর বিশ্বাস রাখা যায়? … এক রাতে তাহেরকে কাছে ডাকলেন বাবর।
‘তাহের বেগ, গোর-এ-আমীরের দেওয়ালে আরবীভাষায় লেখা আছে, দুনিয়া তোমার থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নেবার আগে তুমি নিজেই দুনিয়া ছেড়ে যাও। এবার সে সময় এসেছে। … বিসূচিকা যদি আমাকে নিতো তো সবারই মঙ্গল হতো । কিন’ নিলো না …
‘খোদা আপনাকে রক্ষা করুন, জাঁহাপনা। আপনিই আমাদের একমাত্র আশাভরসা।’
এমন রোগা হয়ে গেছে তাহের যে মনে হয় তার খোঁচা হয়ে বেরিয়ে থাকা কাঁধের হাড় যেন তার চোগা ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়বে: মুখের ওপরে পুরানো ক্ষতচিহ্নটা ফুলে উঠেছে, চোখ কোটরে বসে গেছে, তবুও ঝলক দিচ্ছে সাহস।
‘আশা-ভরসা ধ্বংস হয়ে গেছে তাহের বেগ। গতকাল দুই পংক্তির এক কবিতা লিখেছি-
পরলোকে যেতে বাবরের যদি সাধ হয়, তবে দোষ দিও না যেন,
যন্ত্রণা ছাড়া আর কি’বা আছে এই দেশে, সেটা দ্যাখো না কেন।
তাহির মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘এ-সত্যি, জাঁহাপনা, আজকের দিনে আমাদের জন্য আছে- কেবল বিষাদ! কিন’ প্রতিমাসে থাকে অর্ধেক কৃষ্ণপক্ষ, অর্ধেক শুক্লপক্ষ। আমাদের বাহুতে এখনো আছে শক্তি, কোমরবন্ধে তরবারি….’
‘কি করা যায় তাহলে?’
মনিব-গোলাম, দুই যোদ্ধা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দু’জনের হয়ে বাবর বললেন, ‘শেষ পথ বেছে নিতে হবে।…. যত শক্তি আছে তা সংগ্রহ করতে হবে এক মুঠিতে, উপযুক্ত মুহূর্ত যেই আসবে অমনি অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের শেষ দিন যদি এসে না থাকে তো,আল্লাহ্র রহমতে, বেরিয়ে যাব, আর যদি এসে গিয়ে থাকে তো তরবারি হাতে নিয়েই মরবো।’
‘আল্লাহ্ দিন যেন এ অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে যাই আমরা, জাঁহাপনা।’
‘আপাততঃ এই গোপন পরিকল্পনার কথা জানেন কেবল কাসিম বেগ। তুমিও এ কথা গোপন রেখো। … তৈরী হও, বন্ধুরা, তৈরী হও।’
রাতের বেলায় তাহের মিলিত হলো কাসিম বেগের সঙ্গে। প্রাচীরের ছিদ্র দিয়ে তারা অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করতে লাগলো শয়বানীর ছাউনির মশালগুলির অবসি’তি: ভাল করে দেখে তারা বুঝল শত্রুদলের শক্তির বেশীটাই নিযুক্ত করা হয়েছে ফিরোজা দরওয়াজা আর চাররাহ দরওয়াজা এই দুই প্রবেশপথের কাছে, ওদিকে শেখজাদা প্রবেশপথের কাছে ছড়া-ছিটানো জ্বলছে কয়েকটি মাত্র মশাল। সৈন্য আর সবচেয়ে সক্ষম ঘোড়া প্রস্থত রাখতে হবে, প্রস্থত হতে হবে…


তার নিজের হাতে নিহত শত্রুসৈন্যের স্তূপের ওপর পড়ে তরবারি হাতে মরা বাবরের ভাগ্যে লেখা ছিল না। দূর্গ থেকে বেরোবার প্রস্থতি চলছে যখন খুব জোরে, তখন বাবরের বিশ্রামকক্ষে কোন খবর না দিয়েই এসে ঢুকলেন তার মা আর দাদী, তাদের পিছন পিছন হতবুদ্ধি কাসিম বেগ।
‘নাতি, আমার জাঁহাপনা,’ গত কয়েক মাসে এসান দৌলত বেগম একেবারে ঝুঁকে পড়েছেন, তার কথাগুলো বাবরের কাছে ভেসে আসছে যেন নীচের দিকে থেকে, ‘সন্ধিপ্রস্তাব দিয়ে লোক পাঠিয়েছে শয়বানী খান।’
‘সন্ধি’ এই কথায় যেন বেজে উঠল বাঁচার মন্ত্র। কিন’ সেই রক্ষাকর্তা শয়বানী, শয়বানী খান শানি-স্থাপনকারী? অবিশ্বাস নিয়ে তাকালেন বাবর প্রথমে দাদী, তারপর মা’র দিকে। কুতলুদ নিগর-খানমের মুখচোখ বিমর্ষ, যেন কেঁদেছেন একটু আগে। কিন’ এসান দৌলত বেগমের হাতে গোটান চিঠিটা, সোনালী ফুৎনা ঝুলছে পাকানো দড়িটা থেকে।
‘এই যে খানের বার্তা,’ বলে দাদী কেমন এক বিশেষ দৃষ্টিতে হাতে ধরা কাগজটির দিকে তাকালেন।
খানের বার্তা এসান দৌলত বেগমের হাতে পড়ল কেন? বাবর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে এসেছে?’
‘এক খোদাবন্দ দরবেশ। নক্‌সাবন্দীদের একজন, এক বুড়ো। খাজা ইয়াহিয়া ছিলেন তার মুরশিদ।’
মার দিকে তাকালেন বাবর, ‘আপনাকে এসে দিয়েছে?’
‘না,’ বিমর্ষমুখে মাথা নাড়ালেন কুতলুগ নিগর-খানুম।
এসান দৌলত বেগম চিঠিটা বাবরের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে ইতস্ততঃ করে বললেন, ‘এটা পাঠিয়েছে খানজাদা বেগমের নামে।’
‘আজব কথা।’ সাবধানে চিঠিটা হাতে নিয়ে বাবর ঘৃণাভরা চোখে লক্ষ্য করতে লাগলেন সেটি, খুললেন না তখনও চিঠিটা।
‘বলা অত্যন্ত কঠিন হলেও বলা আমার প্রয়োজন,’ থেমে গেলেন এসান দৌলত বেগম। … ‘শয়বানী খান অনেক শুনেছে আমাদের খানাজাদার রূপের কথা। ওকে পেতে চায়। এই চিঠিতে সে সম্বন্ধে কবিতাও লিখেছে সে।’
শয়বানীর পঞ্চাশ বছর বয়স হলো, ছেলেদের বিয়ে দিয়েছে বহুদিনই, নাতিনাতনী আছে। ক্রুদ্ধভাবে চিঠিটা খুললেন বাবর। তখনই তার দৃষ্টি পড়ল দুুই ছত্র কবিতার উপর।
মুগ্ধ তোমায়, বিরহ জ্বালায় মরণ ঘনায়,
দগ্ধ এখন হৃদয়াবেগের অগ্নিকণায়।

চিঠিটা ছুড়ে ফেলে দিলেন বাবর লাগিচার উপর।
‘আপনারা ভুলে গেছেন, গতবছর খান এমনি ছড়া দিয়েই প্রলুব্ধ করেছিলেন সুলতান আলি মির্জার মা জোহরা বেগমকে? শয়বানীর চিঠিতে কি করে বিশ্বাস করেন আপনারা?’
কুতলুগ নিগর-খানম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ওদিকে এসান দৌলত বেগম ঠান্ডা মাথায় বলে চললেন, ‘অন্য সময় হলে এমন চিঠি পড়তে আমাদেরও ঘৃণা হতো, কিন’ এখন সবার সামনে যখন এমনি বিপদ, আমার আর কি, বুড়ো হয়েছি, আমার দিন ফুরিয়েছে, আমার কাছে একই কথা এই নশ্বর দুনিয়া ছেড়ে যাওয়া পাঁচ দিন আগে বা পরে, কিন’ তোমাদের বয়স কম, জাঁহাপনা, তুমি আমার একমাত্র নাতি, আমাদের চোখের মণি…’
প্রতিবাদ করছেন বাবর, কখনও বা ধীরসি’রভাবে কখনও বা দারুণ রাগে, ওদিকে বৃদ্ধা কিন’ নিজের কথা বলেই চললেন যে তাদের বয়স কম, এমনি করে সবাই মিলে মরার কোন অর্থ হয় না, আর খানজাদা বেগম সবার চেয়ে বেশী বুদ্ধিমতী, দয়াময়ী, সব বুঝেছে সে, রাজী হয়েছে।
চীৎকার করে উঠলেন বাবর, ‘বিশ্বাস হয় না। আমার বোন সুন্দর মনোমুগ্ধকর কুসুম যাবে সে-পের ঔ নোংরা বুড়োটার হারেমে। না, না! এ বেইজ্জতি! এ হবে না!’
এবার কাসিম বেগ যোগ দিল, ‘জাঁহাপনা, আমরা অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করবো, ভেঙে বেরিয়ে যাব।… নয় মরবো। সে যাই হোক না কেন শয়বানী সমরখন্দ দখল করবেই তখন যে করেই হোক নিজের উদ্দেশ্যসাধন করবে।’
কুতলুগ নিগর-খানম এতক্ষণ নিজেকে সংযত করে রেখেছিলেন। বাবর তার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতে আর ধরে রাখতে পারলেন না নিজেকে, হু-হু করে কেঁদে ফেললেন, ‘কোথায় যাবে তোমরা? নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে?…ও দয়াময় আল্লাহ্, এমন দুঃখ দেয়ার চেয়ে আমার জীবন নিলে না কেন তুমি। খানজাদা বেগম- আমার প্রথম, আমার প্রিয় সন্তান, তার সঙ্গেই আমি মন খুলে কথা বলি, আমার বিধবা একাকিনী জীবনের সেই আমার সান্ত্বনা। তাকে ছেড়ে বাঁচবো কী করে আমি, হায় খোদা? নিজের মেয়েকে দুশমনের হাতে ছেড়ে দেব কী বলে?’
দাদী আরও অনেকক্ষণ ধরে কী সব বললেন, মা কাঁদলেন অনেকক্ষণ, বিশ্বস্ত কাসিম বেগ সন্দেহের দোলায় অস্বাসি-বোধ করলো।
‘ঠিক আছে,’ বললেন, বাবর, ‘বেগমের সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি।’
অধৈর্য হয়ে তিনি বোনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। বোন এলো যখন বাবর তার দিকে তাকিয়ে বুঝলেন এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে…
বোনকে নিজের সামনে বসিয়ে বাবর নীরবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। গাল বসে গেছে খানজাদা বেগমের, ম্লান অধর। কিন’ বড় বড় চোখগুলি আগের মতই সুন্দর, উজ্জ্বল আর সে চোখে পড়া যাচ্ছে দৃঢ়সঙ্কল্প।
‘আপাজান, শয়বানী খানের প্রস্তাবে আপনি সম্মতি জানিয়েছেন? দাদী কি ঠিক খবরই দিয়েছেন আমায়?’
‘আর কী করার আছে আমার?’
‘জানি, জানি… আমার পরাজয়ই আমাদের সবাইকে এমন নিরুপায় অবস্থায় ফেলেছে। কিন’ আপনার ভাই তো এখনও মরে নি। ওদের হাতে বন্দী হবো না আমি কিছুতেই। মৃত্যু জীবনে একবারই আসে, তার হাত এড়ানো যাবে না… যদি আমরা অবরোধ ভেঙে বেরোতে পারি, যদি বেঁচে থাকি, তো ফিরে এসে নিয়ে যাব আপনাকে। আর যদি আমার দিন শেষ হয়েই থাকে তাহলে তরবারি হাতে নিয়েই মরবো।…. তখন রাজী হবেন…. তখন কেউ বলতে পারবে না, দেখেছ বাবর কেমন স্বার্থপর: নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য বোনকে বলি দিল। এমন লজ্জার থেকে মৃত্যুই ভাল।… সম্মতি জানাবেন না বেগম।’
খানজাদা বেগমের চোখে আঁধার নামলো, জলে ভরে গেল চোখদুটি। যতই সাহসী হোন না কেন বাবর, এই অবরোধ ভেদ করার মত শক্তি তার নেই, তা জানেন তিনি। বাবর নিজেও তা জানেন। অবরোধ ভেদ করার এই যে সংকল্প এ হল মৃত্যুবরণ করার সংকল্প। সে কারণেই তিনি বোনকে আহ্বান জানাচ্ছেন না যুদ্ধসাজ করে তাদের সঙ্গে যেতে।… সাহসী, মনখোলা এই ভাইকে তিনি প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসেন- সেজন্যই সি’র করেছেন নিজেকে শত্রুর হাতে তুলে দিয়ে ভাইকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবেন।
কিন’ যা ভেবেছেন তা কি সোজাসুজি বলা যায় তাকে? সিদ্ধান্ত শুদ্ধ অন্তঃকরণে মেনে নিতে না পেরে বাবর যে নিজের বোঝা হালকা করার জন্য যুদ্ধ মৃত্যুবরণ করার সংকল্প নিয়েছেন সে কথা তার বোন অনুমান করতে পেরেছেন- এটা যদি বাবর জানতে পারেন, তাহলে যে কোন উপায়ে তিনি তার বোনকে আত্মবলি দেওয়া থেকে বিরত করার চেষ্টা করবেন। তাহলে তাদের সবারই বিপদ। আর যদি বাবরের মৃত্যু হয় তাহলে তার কপালে জুটবে হয় তরবারি নয় বিষ।
‘বাবর জান, আমার জন্য অসময়ে নিজেকে মৃত্যুপথে এগিয়ে দেবেন না। আহমদ তনবালের যে অত্যাচার আমাদের সইতে হয়েছে তাই যথেষ্ট।’ হাত দিয়ে চোখের চল মুছে খানাজাদা আবেগাপ্লুতস্বরে জোরে জোরে বললেন, ‘আমি আপনার উজ্জ্বল ভবিষ্যতে বিশ্বাস করি, জাঁহাপনা। অন্যেরা জানে না, কিন’ আমি তো জানি এমন বিরল প্রতিভা পৃথিবীতে খুব অল্পই জন্ম নেয়। আপনার বেঁচে থাকা দরকার। মহান কাজের জন্য। মহান কাব্যের জন্য। অভাগা বোনের ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্য জড়াবেন না।’
‘এমন কথা বলছেন কেন, আপা? আমরা, আমরা সবাই…’ থেমে থেমে বললেন বাবর, ‘এই ছলনাময় পৃথিবীতে কয়েকদিনের অতিথি। আপনি, আমি- এক মায়ের পেটের সন্তান!’
‘কিন’ আমি জন্মেছি মেয়ে হয়ে!… তাছাড়া, আমার বয়স এখন পঁচিশ, এখনও বিয়ে হল না। যাকে ভালবাসলাম তাকে পাওয়া আমার কপালে নেই। সব আশার মৃত্যু হয়েছে। কোন কিছুতেই আমার আর সুখ নেই। আর কতদিন আমি আপনার কাছে পড়ে থাকব, জাঁহাপনা আইবুড়ো হয়ে? যথেষ্ট হয়েছে, এবার আমারও একটু পরখ করা দরকার নারীজন্ম।’
‘তাই নাকি… নাতিনাতনীতে ঘরভরা ঐ বৃদ্ধের স্ত্রী হবার উপযুক্ত মনে করেন নাকি নিজেকে?’
‘খুঁজে, খুঁজে নিরাশ হয়ে পড়েছি আমি বাবরজন। বৃদ্ধ কি যুবক তা বিচার করে আমার আর লাভ কী?’
‘কিন’ আপনি… আমাকে সেবার কী বলেছিলেন ওশে মনে আছে? নিজের অন্তরের কথা শোন! নিজের হৃদয়ের সঙ্গে কি ছলনা চলে, খানাজাদা? ঐ নিষ্ঠুর,ধূর্ত শয়বানী খান আমাদের যে দুঃখকষ্টের কারণ হয়েছে তা আপনার হৃদয় ভুলতে পারল কী করে? অন্ততঃ জোহরা বেগমের সঙ্গে তার খলতা ও শয়বানীর কথা কি ভোলা যায়?’
হু-হু করে কেঁদে ফেললেন খানজাদা।
বাবর বলে চললেন, ‘একই মায়ের সন্তান আমরা। আমাদের দু’জনের ভাগ্যও একই সূত্রে বাঁধা থাক। আপনি জানেন যে আজ রাতে আমরা অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করবো। আপনিও প্রস্থত হন আমাদের সঙ্গে যাবার জন্য। হয়ত আমরা সফল হবো।’
ভীষণ ইচ্ছা হলো খানাজাদা বেগমের আবার পুরুষের পোশাক পরতে, হালকা বর্ম গায়ে চড়িয়ে ভাইয়ের সঙ্গে একসঙ্গে লড়াইতে নামতে। বৃদ্ধ কামুকের হারেমে পড়ে পচে মরার চাইতে রণক্ষেত্রে মৃত্যু বরণ করা শ্রেয় তা ঠিক। হঠাৎ খানাজাদা বেগম আবেগকম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কখন যাবেন? কখন?’
‘আজ রাতে!’ শান্ত দৃঢ়স্বরে বললেন বাবর।
তার ভাই যে আজ রাতেই মারা পড়বে, তার কবিতার সূত্র, তার আলাপ আলোচনা, খানাজাদার প্রতি তার ভালবাসার সূত্র ছিঁেড় যাবে, এই চিন্তা তার অন্তর বিদ্ধ করলো, চীৎকার করে উঠলেন তিনি, ‘আজ নয়। না, না।’
এবার উঠে দাঁড়ালেন বাবর, ‘যদি ভাইয়ের কথা আপনি না শোনেন, তাহলে আপনার বাদশাহের হুকুম অন্তত তামিল করুন। আপনি যাবেন আমাদের সঙ্গে। এখনও যথেষ্ট সময় আছে- নিজের ঘরে গিয়ে প্রস্থত হন।’
উঠলেন খানজাদা বেগম আসন ছেড়ে, নীরবে বাবরের কাছে এগিয়ে গিয়ে মুখ রাখলেন তার বুকে। এভাবে বিদায় নিলেন ভাইয়ের কাছ থেকে।
মাঝরাতে শেখজাদা দরওয়াজার কাছে সমবেত হলেন বাবর, কাসিম বেগ, কুতলুগ নিগর-খানম, আয়ষা বেগম ও আরও কিছু স্ত্রীলোক বসেছেন শক্তিশালী ঘোড়াজোতা এক গাড়ীতে, গাড়ীটি রাখা হয়েছে দলের ঠিক মাঝখানে। গাড়ীতে বা অশ্বারোহীদের মধ্যে কোথাওই দেখতে পাওয়া গেল না খানজাদা বেগমকে।
জিজ্ঞেস করে জানা গেল তারা এখানে মিলিত হবার এক ঘন্টা আগেই খানাজাদা বেগম দাদীর সঙ্গে রওনা দিয়েছেন শহরপ্রাচীরের বিপরীত দিকে অবসি’ত প্রবেশপথ চাররাহের দিকে। কুতলুগ নিগর-খানম অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বলতে লাগলেন যে তিনি মেয়েকে বারবার বুঝয়েছেন এমন না করতে, কিন’ দাদী ঠিক ততই জোর দিয়ে বারবার বলছিলেন যে খানাজাদা যেন নিজের উদ্দেশ্য পালন করে।
বাবর তার অনুচরদের দিকে ফিরলেন। দৃষ্টি দিয়ে খুঁজলেন তাহেরকে, ‘চাররাহ দরওয়াজার দিকে যাও। খানাজাদা বেগমকে খুঁজে বার করে আমার আদেশ জানিও তাকে। অবিলম্বে এখানে আসেন যেন তিনি! বলো, যতক্ষণ তিনি না এসে পৌঁছবেন ততক্ষণ আমরা কোথাও যাব না।’
‘জাঁহাপনা …’ কী যেন বলতে চাইলো কাসিম বেগ, কিন’ সেকথায় কান না দিয়ে চীৎকার করে বাবর বললেন, ‘জলদি যাও, তাহের।
ছুটে চললো তাহেরের ঘোড়া শহর পেরিয়ে। পাথরে বাঁধান পথে ঘোড়ার খুরের ধাক্কায় আগুনের ফুলকি ছুটতে লাগলো। চাররাহ দরওয়াজার কাছে পৌঁছে ত হের দেখল খানজাদা বেগমকে নিয়ে চমৎকার করে সাজান শকটটি পরিখার উপর ফেলা সেতু পেরিয়ে যাচ্ছে, মশালধারী অশ্বারোহীরা চারদিক থেকে ঘিরে আছে শকটটি।
কয়েকমাস ধরে অবরোধের ফলে খানের সৈন্যদলও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তারাও অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে সন্ধির, আর অনেকেই জানে যে বাবরের ভগ্নী খানের স্ত্রী হলেই সন্ধি স্থাপিত হবে। শয়বানীও জানতো যে এবার সে জোহরা বেগমের সঙ্গে যেমন করেছে তেমন করবে না, এবার জমকালো গাড়ীতে তার কাছে আসছে একেবারে অন্য ধরনের এক নারী। পবিত্র স্ত্রীলোক আর বহুপ্রতীক্ষিত সন্ধির মাধ্যমেই সে মাভেরান্‌নহরকে নিজের অধীনে রাখবে, নতুন করে রক্ত বহানোর প্রয়োজন নেই।… তাছাড়া শোনা যায় সে খানজাদা নাকি প্রকৃতই অপূর্ব সুন্দরী।
শয়বানীর আদেশে সুন্দরীর সম্মানে ঢাকঢোল, কাড়ানাকাড়া বেজে উঠল। শয়বানীর বিশাল সৈন্যবাহিনী সাড়ম্বরে অভ্যর্থনা জানালো খানজাদা বেগমবে।
তাহের এ সব দেখলো খোলা প্রবেশপথ দিয়ে, তারপর প্রাচীরের উপর থেকে। তারপর প্রাচীরের উপর থেকে নেমে ঘোড়ায় উঠে শহরের মধ্যে ছুটে চললো শেখজাদা দরওয়াজার দিকে।
শয়বানীর শিবির থেকে হর্ষধ্বনি এখান পর্যন্ত এসে পৌঁছচ্ছিল। বাবর যে কেবল দুঃখিত বোধ করলেন তাই নয়- এই ঘটনায় কেমন যেন অভিভূত বোধ করলেনও। এক মুহূর্তের জন্য তার একথাও মনে হল যে খানজাদা বেগম চিরজীবন কুমারী থেকে যাবার ভয়ে ভাইয়ের বিষাদজনক অসাফল্যে তিক্ত হয়ে নিজে থেকেই গিয়েছেন শয়বানীর কাছে। পরিপূর্ণ জীবন হয়ত বা সুখী জীবনের জন্যও।
‘এ দুনিয়ায় বিশ্বাস বলে কিছু নেই।’ বিষণ্ন নীচু স্বরে নিজেকেই নিজে বললেন বাবর, তারপর ঘোড়া ঘুরিয়ে আদেশ দিলেন, ‘ফটক খোল।’
সতর্কভাবে ফটক খোলা হলো। রাতের অন্ধকারে প্রায় নিঃশব্দে পরিখার ওপর সেতু নামানো হলো। অশ্বারোহী আর পদাতিক বাহিনী তাদের মাঝে শকটটি নিয়ে সাবধানে সেতু পেরিয়ে গেল। চারদিকে বিপদ ওৎ পেতে আছে। মনে হচ্ছে যেন প্রতিটি গাছের আড়ালে মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য। খানের প্রহরীদের অবসি’তি ভালো করেই পর্যবেক্ষণ করেছে কাসিম বেগ, দুর্গম পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে বাহিনীকে, প্রায়ই খানাখোঁদল নালা পার হতে হচ্ছে, শকটটিকে প্রায় হাতে করে বইতে হচ্ছে।
পরে অজ্ঞ লোকে বলতে লাগল যে জাদুমন্ত্রবলে, নাকি এসান দৌলত বেগমের সমরখন্দের দানিশমন্দ লোকেরা আগে থাকতেই শর্ত রেখেছিল যে খানজাদাকে তুলে দেওয়ার বদলে বাবর সমরখন্দ থেকে চলে যাবার সুযোগ পাবেন, ধূর্ত খান প্রহরীদের ‘গোপন’ আদেশ দিয়েছিল বাবরের চলে যাবার পথে বাধা সৃষ্টি না করতে। সে যে কারণেই হোক তার নিরাপদে শত্রু অবরোধ পেরিয়ে গেলেন।
খানাজাদা বেগম যে দুঃখের জীবন বরণ করে নিলেন ভাইকে মৃত্যুর হাত থেকে আর মাকে লজ্জাজনক বন্দীদশা থেকে বাঁচাবার জন্য- তা বাবর জানতেন না, কিন’ কুতলুগ নিগর-খানম তা জানতেন। তাই যতই জোরে জোরে বাজছে বাঁশী, কাড়ানাকাড়া বিজয় ও বিবাহ-উৎসব উপলক্ষে বিরাট ভোজের বার্তা জানিয়ে, ততই বেশী করে চোখে জল ভরে উঠতে লাগলো তার।

Leave a Reply