পাখি – The Birds

পাখি

দ্যাফ দ্যু মরিয়ের-এর The Birds-এর অনুবাদ

অনুবাদক – সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান

ডিসেম্বরের তিন তারিখে বাতাসের গতি রাতারাতি বদলে যাবার পথে সাথেই শীত এসে পড়লো। গতকাল পর্যন্তও হেমন্তের কোমল, মিষ্টি আবেশ লেগেছিল সারা প্রকৃতিতে। গাছপালার অবশিষ্ট পাতার রং ক্রমে সোনালী আর বিভিন্ন ঘনত্বের লাল হয়ে গেলেও, ঝোপঝাড়গুলো এখনও সবুজ রয়েছে। এমন কি চষা ক্ষেতগুলোর মাটিও রয়েছে বেশ সরস।

যুদ্ধে গিয়ে ন্যাট হকেন প্রায় অক্ষম হয়ে গিয়েছে। সরকারের থেকে অবসর ভাতা পায় বলে খামারে বাঁধা সময়ের কাজ করে না ও। সপ্তাহে মাত্র তিনদিন হালকা কাজ করে সময় কাটায়। আগাছা সাফ করা, ঘর ছাওয়া, বেড়া বাঁধা, ঘরদোর আর খামারের হরেক রকম যন্ত্রপাতি মেরামত করা, এই সব কাজে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে ও।

বৌ-ছেলে-মেয়ে থাকলেও মানসিকতায় ও কিছুটা নিঃসঙ্গ। খামারে সাধারণত এমন কাজ বেছে নেয়, যেগুলো ও একা, নিরিবিলিতে করতে পারে। তাই, খালের পাড় বাঁধা, খামারের এক ধারে, যেখানে সাগরটা খামারটাকে তিনদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে, সেখানকার ক্ষেতের বেড়া বাধা, এসব কাজে ও-ই একমাত্র উপযুক্ত কর্মী। দুপুরবেলা খাঁড়ির ধারে বসে বৌয়ের বানানো রুটি আর কাবাব চিবাতে চিবাতে সাগরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে পাখির ঝাঁকের আনাগোনা লক্ষ্য করে ও।

বসন্তে পাখিগুলো স্থির লক্ষ্যে আগ্রহের সাথে উড়ে আসে দেশের ভেতরের দিকে। ওরা জানে, কোথায় ওদের যেতে হবে, ওদের জীবনধারায় দেরী বলে কোন শব্দ নেই। হেমন্তেও যারা দেশান্তরী হতে পারে না, তারা সারাটা শীতকাল একটা স্বপ্নের ঘোরে চলে, এই দেশান্তরী না হওয়াটা ওদের জীবনে নতুন পথের সন্ধান দেয়। বিশাল এক একটা ঝাঁক তখন এই উপদ্বীপটাতে চলে আসে। ওরা তখন অস্বস্তিতে চঞ্চল হয়ে উড়ে বেড়ায়। আকাশে চক্কর খেতে খেতে ঝপ্‌ করে নেমে পড়ে চষা জমিতে, পোকামাকড় খাওয়ার জন্যে। কিন্তু খাওয়ার সময়ও ওদের কোন আগ্রহ থাকে না, কেমন যেমন অনিচ্ছায় খুঁটে খুঁটে খায়, আবার হঠাৎই আকাশে ডানা মেলে দেয়।

কালো আর সাদা, দাঁড়কাক আর গাংচিল, অদ্ভুত বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ওড়ে, এক অনাস্বাদিত স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার জন্যে, অতৃপ্ত আর অশান্তভাবে, আতঙ্কিত হয়ে। ওরা ডানার খশ্‌ খশ্‌ শব্দ করে উড়ে যায় এক ক্ষেত থেকে আর ক্ষেতে। ছোট পাখিগুলো- ভরত, শ্যামা আর দোয়েলগুলো নিচের ঝোপ থেকে গাছের উঁচু ডালে উড়ে গিয়ে একবার বসে, আবার নামে, একই অস্থিরতায়।

ন্যাট এদের দিতে তাকিয়ে থাকে; সামদ্রিক পাখিগুলোকেও লক্ষ্য করে ও। খাঁড়ির ভিতরে ওরা অপেক্ষা করে জোয়ার আসার জন্যে। ওদের ধৈর্য্য অবশ্য একটু বেশী। শামুখ ভাঙ্গা, লাল চন্দ্রানী, রাঙা ঠ্যাঙা আর বকগুলো পানির ধারে ধারে উড়ে বেড়ায়। সাগরের ঢেউ যখন পাড়ের উপরে আছড়ে পড়ে ধীরে ধীরে সরে যায়, তখন বেলাভূমিতে ছড়িয়ে থাকা জলজ উদ্ভিদ আর পোকা-মাকড়গুলোর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা। পরবর্তী আর একটা ঢেউ এলে ওরা আবার আকাশে ডানা মেলে দেয়। ওরা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডাকে, শীষ দেয়, ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দে যেন কেঁদে কেঁদে ওড়ে, ছটফট করে কি এক দুর্বোধ্য যন্ত্রণায়। অস্থির হয়ে ওরা কখনও আকাশে ওড়ে. কখনও নিচে নেমে আসে। কেন? কিসের জন্যে? তা কেউ বোঝে না।

হেমন্তের এই অস্থিরতা, এই অতৃপ্তি, এই বিষণ্নতা ওদের উপরে একটা অজ্ঞাত প্রভাব বিস্তার করে, ওদেরকে দলবদ্ধতায় উদ্বুদ্ধ করে। ওরা একসাথে জড়ো হয়ে ওড়ে, ডাকে। শীত আসার আগেই এক অস্থির, অস্বস্তিকর গতির আবর্তে নিজেদের ডুবিয়ে ফেলে।

পাহাড়ের ঢালে বসে কাবাব-রুটি চিবাতে চিবাতে আজকে ন্যাট ভাবলো, হয়তো হেমন্ত এলেই একটা বিপদ-সংকেত টের পায় পাখিগুলো। যেন ওরা খবর পেয়ে যায়- শীত আসছে। আর ওরা অনেকেই এ সময় মারা যাবে। অকাল মৃত্যুর আগে যেমন অনেক লোকই বুঝতে পেরে বোকার মতো কাজ করে বসে, পাখিগুলোও বোধ হয় তেমনি।

কিন্তু এবারের হেমন্তে পাখিগুলোকে যে অনেক বেশী অস্থির মনে হচ্ছে। দিনগুলো যতোই শান্ত হয়ে আসছে, ওদের অস্থিরতা যেন ততোই বাড়ছে। উড়ে উড়ে চিৎকার করে বেড়ানো ঝাঁকগুলো মাঝে মাঝে পশ্চিমদিকের ক্ষেতে চাষ করতে থাকা ট্রাকটর আর তার চালকের ছায়া-ছায়া অবয়বটাকে ঢেকে দিচ্ছে এক একবার।

ন্যাটের মনে হলো, এটা সত্যিই খুব A¯^vfvweK| আগের হেমন্তে ওরা ট্রাকটরের পেছনে উড়ে বেড়াতো ঠিকই, কিন্তু এমন বিরাট ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তো না।

ঝোপগুলো ছাঁটা হয়ে যেতে এই নিয়েই ন্যাট আলাপ করছিল। জোতদারও ¯^xKvi করলো কথাটা,

ঠিকই বলেছো। অন্যবারের চেয়ে এবারে ওরা অনেক বেশী। আমিও ওদের লক্ষ্য করেছি। কতকগুলো আবার খুব বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ট্রাকটরটাকেও আমল দিতে চায় না যেন। কয়েকটা গাংচিল এতো নিচুতে নেমে ডানার ঝাপটা মারছিল যে, আমার মনে হচ্ছিল আমার টুপিটাই উড়িয়ে নেবে। ওরা এতো নিচু দিয়ে উড়ছিল যে, অনেক সময় আমি কি করছি, সেটা বুঝতেই পারছিলাম না। মনে হচ্ছে, আবহাওয়ার বেশ বড় পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে এবার। মনে হয় জব্বর শীত পড়বে। তাই ওরাও ওরকম অস্থির।

বাড়ী ফেরার পথে মাঠ পাড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ন্যাট লক্ষ্য করলো, পশ্চিমের টিলাগুলোর উপর দিয়ে অস্তমিত সূর্যের সামনে দিয়ে ওরা চক্কর মারছে। একটুও হাওয়া নেই, ধূসর সাগরটা নিস্তব্ধ। ঝোপের মধ্যে দুই একটা ক্যাস্পান ফুল এখনও ফুটে আছে।

জোতদার ঠিকই বলেছিল। রাতের মধ্যেই আবহাওয়া আমুল বদলে গেল। ন্যাটের শোবার ঘরটা পূর্বমুখো। রাত দুটোর দিকে ওর ঘুম ভেঙে যেতে বাতাসের প্রচন্ড বেগ টের পেলো। এটা ঠিক দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের বৃষ্টি বয়ে আনা ঝড়ো-হওয়া না, এটা শুকনো খট্‌খটে ঠান্ডা পূবের হাওয়া। চিমনীর মধ্যে বাতাস কেমন যেন একটা ফাঁপা শোঁ শোঁ আওয়াজ তুলছে।

বাতাসের এই শব্দের সঙ্গে সাগরের ঢেউয়ের গম্ভীর গর্জনও শুনতে পেলো ন্যাট। এই ছোট ঘরটার বদ্ধ হওয়াটাও কেমন কেন কন্‌কনে হয়ে উঠেছে। দরজার তলা দিয়ে এক ঝলক দমকা হাওয়া ঘরে ঢুকে বিছানা পর্যন্ত চলে এলো। ন্যাট গলা পর্যন্ত কম্বলটা টেনে দিয়ে ঘুমন্ত স্ত্রীর গায়ের কাছে সরে এলো।

কিন্তু ঘুম এলো না ওর। জেগে গিয়ে প্রতীক্ষা করতে থাকলো। ওর মনে হলো নিশ্চয়ই একটা কিছু ঘটবে।

ঠিক এমনি সময় জানালায় কিসের একটা ঠক্‌ঠক্‌ শব্দ শুনলো ন্যাট। বাইরের দেয়ালে কোন ঝুলন্ত লতা নেই, যে বাতাসে সেটা জানালার কাঁচে বাড়ি খেতে পারে।

ও চুপ করে শুনতে থাকলো। কি হতে পারে?

একটানা ঠক্‌ঠক্‌ শব্দ শুনতে শুনতে কেমন যেন একটা উত্তেজনা বোধ করতে থাকলো ও। শেষে না পেরে, উঠে জানালার কাছে গিয়ে সেটা খুলতেই অস্পষ্ট কি যেন একটা হাতের উপরে সজোরে আছড়ে পড়ে আঙ্গুলের উপর ঝাপটা মারলো। ওর আঙুলের চামড়া ছিঁড়ে গিয়ে জ্বালা করে উঠলো, আর তখনই উড়ন্ত পাখির ডানা চোখে পড়লো।

কি পাখি অন্ধকারে ন্যাট ভালো করে বোঝার আগেই ওটা পালিয়ে গেল। আঙুলটা জ্বালা করছে এখন, ওখানটা কেমন যেন ভিজে উঠেছে। বিস্ময় আর ভীতি ন্যাটকে ক্ষণিকের জন্য আচ্ছন্ন করে ফেললো। পাখিটা রক্ত বের করে দিয়েছে! ভাবলো, আশ্রয়ের খোঁজে পাখিগুলো উন্মত্ত হয়ে মানুষকে আক্রমণ করতেও ছাড়ছে না।

জানালা বন্ধ করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো ন্যাট।

আবার ঠক্‌ ঠক্‌ শব্দ শুরু হলো, এবার ওটাকে অনেক জোরালো আর একরোখা মনে হলো।

আওয়াজে ওর স্ত্রীর ঘুম ভেঙে গেল, ন্যাটের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, কিসের শব্দ ন্যাট? দেখো না একটু।

ন্যাটচ জবাব দিলো, দেখেছি, পাখিগুলো ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে। বাতাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছো না? পূর্বের ঐ ঠান্ডা কনকনে ঝড়ো হাওয়ার জন্যেই ওগুলো অস্থির হয়ে একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে।

ওগুলো তাড়িয়ে দাও না। আমি ঘুমাতে পারছি না।

ন্যাট দ্বিতীয়বারের মতো জানালার কাছে গিয়ে ওটা খুলতেই আগের মতো একটা না, প্রায় পাঁচ-ছয়টা পাখি সরাসরি ওর মুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ও ব্যথায় চিৎকার করে উঠে দুই হাত দিয়ে আঘাত করে মুখের উপর থেকে ওগুলোকে সরিয়ে দিল।

ওর হাতের আঘাত খেয়ে পাখিগুলো হতচকিত হয়ে উপর দিকে উড়ে পালিয়ে যেতেই ও তাড়াতাড়ি জানালাটা বন্ধ করে দিল।

দেখলে তো? ওরা আমার উপরেই হামলা চালিয়েছিল। আর একটু হলে চোখই খুবলে নিতো।

কথাটা অনেকটা নিজের মনে বলে বন্ধ জানালার কাঁচের মধ্যে দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলো ও কিছুক্ষণ, কিন্তু কিছুই নজরে এলো না। ওর স্ত্রী ততক্ষণে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে, ঘুমের মধ্যেই বিড়বিড় করে কি যেন বললো ও।

ন্যাট গজগজ করে উঠলো, হুঁ, আমার আর কোন কাজ নেই, সারারাত কেবল পাখি তাড়িয়েই বেড়াই, তাই না? বাইরের পাখি ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে শুধু।

এমন সময় হঠাৎ পাশে বাচ্চাদের শোবার ঘর থেকেই দুই ছেলেমেয়ের ভয়ার্ত চিৎকার ভেসে এলো। চিৎকার শুনেই ওর স্ত্রী লাফ দিয়ে উঠে বসলো।

জিলের গলার আওয়াজ না? এই, দেখো না গিয়ে, ওদের কি হলো আবার।

ন্যাট দ্রুত একটা মোমবাতি জ্বেলে নিয়ে দরজা খুলতেই দমকা হাওয়ায় ওটা নিভে গেল। তখনই আবার ছেলেমেয়ে দুজনের সম্মিলিত চিৎকার শোনা গেল। ন্যাট এখানে ওখানে অন্ধকারের মধ্যে ধাক্কা খেতে খেতে ওদের ঘরে ঢুকতেই সারা সারা ঘরে পাখির ডানার ক্রমাগত ঝাপটা অনুভব করলো। ঘরের জানালাটা হাট করে খোলা, আর ওটা দিয়ে পাখিগুলো তীব্রগতিতে ঘরে ঢুকে পড়ছে, দেয়ালে-ছাদে বাড়ি খেয়ে বাচ্চাদের বিছানার উপরে নেমে আসছে।

ন্যাট বাচ্চাদের সাহস দেবার জন্যে আওয়াজ করে উঠলো, কোন ভয় নেই, এই তো আমি এসে গিয়েছি।

ওর সাড়া পেয়েই ছেলে-মেয়ে দুজনেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে দুইদিক দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো। পাখিগুলো একই অধ্যবসায় নিয়ে তেমনিভাবে ছাদের দিকে উড়ে গিয়ে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকলো।

পাশের ঘর থেকে ওর স্ত্রীর গলা শোনা গেল, এই, কি হয়েছে? কি ব্যাপার? বলো না।

কিন্তু ন্যাট সেদিকে মন না দিয়ে বাচ্চা দুটোকে দ্রুত এই ঘর থেকে বের করে দিয়েই দরজাটা বন্ধ করে দিল। এখন ও একা, বাচ্চাদের এই খালি ঘরটাতে পাখির সাথে মোকাবেলা করার জন্যে থেকে গেল। ও একটানে বিছানার উপরে থেকে চাদরটা তুলে নিয়ে মাথার চারদিকে বিপুল বেগে ঘোরাতে থাকলো। ঘুরন্ত চাদরের সাথে থুপ্‌ থাপ্‌ শব্দে পখিদের সংঘর্ষের আওয়াজ কানে এলো ওর।

কিন্তু এতো বেশী সংখ্যায় পাখি ক্রমাগত ঢুকছে যে, ওদের আক্রমণের তীব্রতা কমার কোন লক্ষণই দেখলো না ও। ওর পাল্টা আক্রমণের ভিতরেও হাতে, মাথায় আর মুখে তীক্ষ্ণ ঠোঁটের আক্রমণে দিশেহারা বোধ করতে থাকলো ও। শেষে সহ্য করতে না পেরে চাদরটা ভালো করে মাথায় আর সারা মুখে জড়িয়ে নিয়ে খালি হাতেই পাখির আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকলো।

এক সময় দরজা খুলে পালিয়ে যাবার কথাও ভাবলো ও, কিন্তু দরজা খুললে পাখিগুলোও পাশের ঘরে চলে যেতে পারে মনে করে, পরিকল্পনাটা বাতিল করে দিল ও।

সেই অন্ধকারের মধ্যে কতক্ষণ ন্যাট এভাবে যুদ্ধ করে গেল, সেটা খেয়ালই থাকলো না ওর। পাখির আক্রমণটা ধীরে ধীরে স্থিমিত হতে হতে এক সময় একেবারে থেমে গেল। ডানার ফর্‌ ফর্‌ শব্দ আর কানে এলো না, চাদরের ভেতর থেকেও ভোরের আবছা আলো টের পেলো ন্যাট। তবু, আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো ও, কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করলো পাখিদের আওয়াজ, কিন্তু ওর ছোট ছেলেটার কান্নার শব্দ ছাড়া আর কিছুই ওর কানে এলো না।

অবশেষে সন্তর্পনে মুখের উপর থেকে চাদরটা সরালো ন্যাট। ভোরের ঝাপসা আলোয় ঘরের সবকিছুই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আলো ফুটতেই জীবন্ত পাখিগুলো বাইরে চলে গিয়েছে খোলা জানালা দিয়ে, কেবল মরা পাখিগুলোর ছিন্নভিন্ন দেহ ঘরময় ছড়ানো। পাখির ছোট ছোট মৃতদেহগুলোর দিকে তাকিয়ে ন্যাটের দুঃখ, হলো, সাথে সাথে আতংকে সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে এলো। সারা মেঝেতে প্রায় পঞ্চাশটা মরা পাখী- টুনটুনি, চড়াই, দোয়েল, বাবুই, বুলবুলি- এমনি সব পাখী। সাধারণতঃ যেগুলো দল বেঁধে একটা সুস্পষ্ট এলাকায় ঘোরাফেরা করে। কিন্তু আজ? আজ তারা সবাই একসাথে কেবল মানুষকে আক্রমণ করার জন্যেই একজোট হয়েছে। দেয়ালের সাথে, ন্যাটের হাতের সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে মরেছে ওরা। যেগুলো পড়ে আছে ওদের কারও ডানা ভাঙা, কারও পালক ছেঁড়া। কারও ঠোঁটে রক্ত- ন্যাটের গায়ের রক্ত।

Normal 0 false false false EN-US X-NONE BN-BD MicrosoftInternetExplorer4 /* Style Definitions */ table.MsoNormalTable {mso-style-name:”Table Normal”; mso-tstyle-rowband-size:0; mso-tstyle-colband-size:0; mso-style-noshow:yes; mso-style-priority:99; mso-style-qformat:yes; mso-style-parent:””; mso-padding-alt:0in 5.4pt 0in 5.4pt; mso-para-margin:0in; mso-para-margin-bottom:.0001pt; mso-pagination:widow-orphan; font-size:11.0pt; mso-bidi-font-size:14.0pt; font-family:”Calibri”,”sans-serif”; mso-ascii-font-family:Calibri; mso-ascii-theme-font:minor-latin; mso-fareast-font-family:”Times New Roman”; mso-fareast-theme-font:minor-fareast; mso-hansi-font-family:Calibri; mso-hansi-theme-font:minor-latin; mso-bidi-font-family:Vrinda; mso-bidi-theme-font:minor-bidi;}

দুঃসহ মানসিক চাপে বিপর্যস্ত ন্যাট ধীরে ধীরে জানালার কাছে গিয়ে বাগান আর দূরের মাঠের দিকে তাকালো। বাগান আর মাঠের উপরে হালকা একটা বরফের প্রলেপ। রাতে বরফ পড়েছিল। কিন্তু আকাশে ঘোলাটে মেঘ থাকায় এই সাদা বরফও কেমন ধূসর বর্ণের আর কেমন নিষপ্রাণ লাগছে। জোয়ারের তাড়নায় সাগরের পানি ফুঁসে উঠছে, সাদা আর তীক্ষ্ণ ঢেউয়ের মাথাগুলো তীব্র আক্রোশে পাড়ের উপরে আছড়ে পড়ছে, চারদিকে পাখির কোন চিহ্ন মাত্র নেই। এমনকি একটা চড়াইকেও দূরের মাঠে, কিংবা বাগানের ঝোপগুলোতে লাফালাফি করতে দেখলো না ও। চারধারে কোন শব্দ নেই, শুধু পূর্ব থেকে ভেসে আসা কন্‌কনে ঠান্ডা বাতাস আর সাগরের উত্তাল তরঙ্গের গর্জন শোনা যাচ্ছে।

ন্যাট জানালা আর দরজা শক্ত করে বন্ধ করে দিয়ে নিজের ঘরে এসে ঢুকলো। ওর স্ত্রী বিছানার উপর উঠে বসে আছে। বড় মেয়েটা পাশে ঘুমাচ্ছে, আর ছোটটা স্ত্রীর কোলে শুয়ে, সারা মুখে ব্যান্ডেজ বাঁধা। জানালাগুলোতে পর্দা টেনে দেওয়া আর ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। মোমবাতির আলোয় ওর স্ত্রীর মুখটা জ্বলজ্বল করছে। মাথা নেড়ে কথা বলতে মানা করলো ও।

ন্যাট কাছে যেতে ফিসফিস করে বললো, এখুনি ঘুমালো। কিসে যেন ওর সারা মুখ খামচে দিয়েছে। চোখের কোনা দিয়েও রক্ত বের হচ্ছিল। জিল বললো ওগুলো নাকি পাখি। ওর ঘুম ভাঙতেই নাকি ঘরময় পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল।

ন্যাটের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখেমুখে কথাটার সমর্থন খুঁজলো ও। ওর সারা অবয়বে ভয় আর উদ্‌ভ্রান্তি। ন্যাটেরও বলতে ইচ্ছে হলো সেও খুব ভয় পেয়েছে। এই কয়টা ঘন্টার ঘটনায় ও একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছে। অনেক হিসেব করে মুখ খুললো ও।

হ্যাঁ, অনেক পাখি। প্রায় পঞ্চাশটার মতো চড়াই, বাবুই, টুনটুনি এইসব আর কি। ঐ কন্‌কনে ঠান্ডা পূবের হাওয়াটাই ওদের পাগল করে দিয়েছে।

স্ত্রীর পাশে এসে ন্যাট আস্তে করে বসে ওর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে তুলে নেয়।

এই আবহাওয়াটা, বুঝলে- এই বিশ্রী আবহাওয়াটাই যতো নষ্টের মূল। এগুলো কিন্তু এই এলাকার পাখি না। দেশের অনেক ভিতর থেকে ঠান্ডার দাপটে এদিকে উড়ে এসেছে।

ওর স্ত্রীর তেমনি ফিসফিস করে বলে ওঠে, কিন্তু ন্যাট, আবহাওয়ার এরকম অবস্থা তো গতরাত থেকেই। এখনও তো বরফ পড়েনি যে ওগুলো পালিয়ে আসবে। এ মুহূর্তে ওদের তো খাবারের জন্যে এতো অস্থির হওয়ার কথা না, এখনও মাঠেঘাটে ওদের জন্যে প্রচুর পোকা-মাকড় আর শষ্যের বীজ পড়ে আছে।

ন্যাট মাথা নাড়ে, যাই বলো না কেন, আসলে এর জন্যে এই হতচ্ছাড়া আবহাওয়াটাই দায়ী।

ও নিজেও ওর স্ত্রীর মতো এখন অবসন্ন, কিন্তু তবু ভিতরে কিসের যেন একটা অস্থিরতা।

দুজনেই দুজনের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থেকে অবস্থাটার গুরুত্ব বুঝতে চেষ্টা করে।

এক সময় ন্যাট উঠে দাঁড়ায়, যাই, এক কাপ চা খেয়ে আসি।

ও নিচে নেমে আসে। রান্নাঘরের ঘনিষ্ঠ পরিবেশ অনেকটা আশ্বস্ত হয় ও। কাপ-পিরিচ সুন্দর করে সাজানো, টেবিল-চেয়ার সব ঠিক জায়গায় রাখা। ওর স্ত্রীর উল আর বোনার কাঁটা, উল ওর চেয়ারের উপরে রাখা, বাচ্ছাদের খেলনাগুলো আলমীরাটার পাশে থরে থরে সাজানো।

ন্যাট হাঁটু গেড়ে বসে ফায়ারপ্লেসের কয়লাগুলো উল্টেপাল্টে দিয়ে আগুন ধরালো। আগুনের উত্তাপে ঘরের অবস্থা আরও বদলে গেল। কেতলিতে পানি ফোটার শব্দ আর তারপরে চায়ের মিষ্টি সুবাস ন্যাটের মনের সাহস বাড়িয়ে দিলো। নিজের চা খুব ধীরে ধীরে খেয়ে নিয়ে স্ত্রীর কাপটা নিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে দিলো। তারপর মুখ-হাত ধুয়ে ভারী জুতোটা পরে দরজা খুলে বাইরে এলো ও।

আকাশটা কেমন যেন ছাই রং ধরেছে; দূরের টিলাটা অন্যদিনের মতো আর ঝলমল করছে না এখন। চারদিক কেমন বিষণ্ন আর ভোঁতাভোঁতা লাগছে। ছুরির মতো তীক্ষ্ণ পূবের হাওয়ার তাড়নায় গাছের পাতাগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে, গাছগুলো বারবার নুয়ে নুয়ে যাচ্ছে বাতাসের চাপে। মাটিতে পা ঠুকলো কয়েকবার ন্যাট। ইটের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছে মাটিটা। জীবনে এর আগে কোনদিন এত দ্রুত আর হঠাৎ আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন হতে দেখেনি ন্যাট।

ও ঘরের ভিতরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। এতক্ষণে বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। ওপর তলায় জিলের বকবকানি আর ছোট জনিটার ঘ্যান ঘ্যান আওয়াজ ভেসে আসছে। ওর স্ত্রী বাচ্চাটাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। ওরা তখুনি নিচের তলায় নেমে এলো। ততক্ষণে ন্যাট ওদের সবার নাস্তা তৈরী করে ফেলেছে। দিনের কাজ শুরু হলো একে একে।

দিনের আলো, ভরপেট নাস্তা আর ঘরের উত্তাপে জিলের মন থেকে গত রাতের ভয় দূর হয়ে গিয়েছে।

জিল বললো, আব্বু, পাখিগুলোকে তুমি সব তাড়িয়ে দিয়েছো, না?

ন্যাট উত্তর দেয়, হ্যাঁ, আম্মু, ওরা সব চলে গিয়েছে, পূবদিকের কন্‌কনে ঠান্ডা হাওয়াতেই ভয় পেয়ে ওদের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল- ওরা একটা ভালো থাকার জায়গা খুঁজছিল।

ওরা আমাদের বারবার ঠোকরাচ্ছিল। জনির চোখের মধ্যে আর একটু হলে ঠুকরে দিতো।

ভয় পেয়েই ওরা অমন করছিল। ওরা কি করছে, কোথায় আছে, কিছুই বুঝতে পারছিল না কিনা। অন্ধকারের মধ্যে ঘরে ঢুকে আরও ঘাবড়ে গিয়েছিল।

আর আসবে না- তাই না? আমি ওদের জন্যে বাইরে রুটি ছড়িয়ে রাখবো, ওরা খেয়ে দেয়ে চলে যাবে, তাই না আব্বু?

ও খাওয়া সেরে স্কুলের কাপড় পরে বইখাতা গুছাতে থাকলো।

ন্যাট কিছু বললো না। কিন্তু ওর স্ত্রী ওর দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইলো। ওর চোখে অনেক না বলা অনুরোধ।

ন্যাট মুখ খুললো, আমি ওকে বাস পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবো। আজ আর খামারে যাবো না।

মেয়েটা পাশের ঘরে মুখ ধুতে যেতেই ও দ্রুত স্ত্রীকে বললো, শোন, সবকটা দরজা-জানালা ভালো করে বন্ধ করে রাখবে। বলা যায় না, কি হয়। আমি খামারে গিয়ে শুনে দেখি, রাতে ওদের কিছু হয়েছে কিনা।

মেয়েকে নিয়ে বের হলো ন্যাট। গতরাতের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছে মেয়েটা। ওর আগে আগে মেয়েটা লাফাতে লাফাতে এগোলো। চুড়োওয়ালা লাল টুপিটার তলায় ওর মুখটা আরও গোলাপী লাগছে।

এখন কি বরফ পড়বে আব্বু, অনেক তো ঠান্ডা পড়েছে?

জিল মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে।

ন্যাট মুখ তুলে ধূসর আকাশটার দিকে তাকাতে গিয়ে গলায় তীব্র কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার কামড় অনুভব করলো।

নাহ, এবার বরফ পড়বে না, এবারে বরফ ছাড়া শীত হবে, অন্য বারের মতো সাদা শীত হবে না।

কথা কটা বলে ও ধারেকাছের ঝোপঝাড়, চষাক্ষেত, গাছের আড়ালে চকিত দৃষ্টি ফেলে পাখি খুঁজলো। ওখানেই ওদেরকে দলবদ্ধ অবস্থায় সাধারণত দেখা যায়। আজ একটাও নেই।

অন্য বাচ্চারা জিলের মতো টুপি পরে মাফলার জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠান্ডায় ওদের সবারই ঠোঁট মুখ রক্তশূন্য আর নাকের ডগাগুলো লাল। জিল ওদের কাছে ছুটে গেল।

আব্বু বলেছে এবারে আর বরফ পড়বে না। এবারের শীত কালো হবে।

ও পাখীর কথা কিছু বললো না। আর সব বাচ্চাদের সাথে মিশে খুনসুটি করতে থাকলো। তারপর স্কুলবাসটা এসে পড়তে সবাই হুটোপুটি করে বাসে গিয়ে উঠলো। ন্যাট ওদের চলে যাওয়া দেখলো, তারপর খামারের দিকে বাড়ালো।

খামারে আজকে ওর কোন কাজ নেই। কিন্তু সবকিছু ঠিকঠাক অবস্থায় আছে কিনা দেখে স্বস্তি পেতে চাইলো ও। জিম খামারের গরুগুলোয় তদারকিতে ব্যস্ত।

বস কোন দিকে?

ন্যাট জানতে চাইলো।

কেন? হাটে গেছে! আজ না মঙ্গলবার?

কথাটা বলেই নিজের কাজে মন দিল জিম। ন্যাটকে ও কেয়ারই করে না। ন্যাটকে ও একটু উপরের স্তরের লোক মনে করে অবজ্ঞা করে, কারণ ন্যাট খবরের কাগজ, বই-পত্র পড়ে, আর এইসব ব্যাপার নিয়েই শুধু কথা বলে। ন্যাট ভুলেই গিয়েছিল আজকে মঙ্গলবার, হাটবার। গতরাতের ঘটনা ওকে মানসিক দিক দিয়ে কেমন যেন বিপর্যস্ত করে ফেলেছে, এখন বুঝতে পারলো ন্যাট। ও খামারবাড়ীর পিছন দিকে যেতে যেতে শুনলো রান্নাঘরে বসের বউ মিসেস ট্রিগস্‌ গান গাইছেন, রেডিওতে গানটার আবহসংগীত বাজছে।

কেমন আছেন, ম্যাডাম?

আরে, কি খবর হকেন? এই কন্‌কনে ঠান্ডা কোথা থেকে আসছে বলুন তো? রাশিয়া থেকে নয় তো? এমন অদ্ভুত আর হঠাৎ পরিবর্তন সারা জীবনে দেখিনি। রেডিও তো বললো এমনি নাকি চলবে। কি যেন বললো…….ঐ …. মেরুবলয়ের প্রভাব, না কি যেন, ছাই।

আমি সকালে রেডিও শুনতে পারিনি। মানে- গতরাতটা খুব অসুবিধার মধ্যে দিয়ে গেছে আমাদের।

বাচ্চাদের শরীর খারাপ নাকি?

না- মানে. . . .

ও ঠিক বুঝতে পারলো না গতরাতের ঘটনাটা কিভাবে বলবে। এখন দিনের আলোয় গতরাতের পাখির সাথে সংঘর্ষটা ওর নিজের কাছেই কেমন অবাস্তব লাগছে।

ও মিসেস ট্রিগস্‌কে বোঝাতে চেষ্টা করলো ঠিক কি ঘটছে। কিন্তু ভদ্রমহিলার অদ্ভুত চোখের দৃষ্টিটাই বলে দিল ওর গল্পটা কতটা বিশ্বাসযোাগ্য হলো। ভদ্রমহিলা নিঃসন্দেহে মনে করছেন, ওর ঐ বর্ণনা মাঝরাতের স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না।

তাই নাকি? ওগুলো সত্যিকারের পাখি? মানে-পালক-টালক আছে তো? নাকি স্বপ্নের মধ্যে যেমন আজব সব জিনিস দেখি আমরা -তেমনি কিছু?

মিসেস ট্রিগস্‌, প্রায় পঞ্চাশটা বাবুই, চড়াই, টুনটুনি ধরনের মরা পাখি, এখনও বাচ্চাদের শোবার ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে আছে। ওরা আমাকেও আক্রমণ করেছিল, জনের চোখে ঠোকর মারতে গিয়েছিল প্রায়।

মিসেস ট্রিগস্‌ অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। প্রায় অনিশ্চিত আর অন্যমনস্কভাবে বললেন, হুঁ- হতে পারে। মনে হয়- এই আবহাওয়ার জন্যেই ওরা ভিতরে ঢুকেছিল। নিশ্চয়ই বিদেশী পাখি, মেরু অঞ্চলেরও হতে পারে, তাই ঘরের অপরিচিত পরিবেশে ঘাবড়ে গিয়ে ওরকম করেছিল, কি করবে বুঝতেই পারেনি, তাই না?

কিন্তু ম্যাডাম, ওরা বাইরের পাখি না, এই এলাকারই পরিচিত পাখি।

আজব ব্যাপার! কোন ব্যাখ্যা নেই ওর। এক কাজ করো, হকেন, গার্ডিয়ান পক্রিকায় লেখো, নিশ্চয়ই ওরা এর একটা ব্যাখ্যা দিতে পারবে।

ভদ্রমহিলা মিষ্টি ঘাড় নেড়ে রান্নাঘরের ভিতরে চলে গেলেন। অসন্তুষ্ট ন্যাট খামারের দিকে ফিরলো। ওর ঘরের মেঝেতে যদি মরা পাখির মৃতদেহগুলো পড়ে না থাকতো, তাইলে ও নিজেই হয়তো এটাকে উদ্ভট গল্প বলে মনে করতো। তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরে ঘরের ঐ মরা পাখীগুলো বাইরে কোথাও পুঁতে ফেলার কথা ভাবলো ও। জিম গেটের কাছটায় দাঁড়িয়ে ছিল।

ন্যাট আগ্রহে জানতে চাইলো, পাখি নিয়ে কোন ঝামেলা হয়নি তো তোমার গতরাতে?

পাখি? কিসের পাখি?

আমরা খুবই মুসিবতে পড়েছিলাম। গতরাত কয়েকশ পাখি বাচ্চাদের ঘরে ঢুকে পড়েছিল। একেবারে উম্মাদ হয়ে গিয়েছিল ওরা।

ব্যাপারটা জিমের মাথায় ঢুকতে অনেকক্ষণ সময় নিলো।

সত্যি? এমন আজব কথা বাবা- কালেও শুনিনি। ওরা তো অনেকটা পোষা পাখির মতো। রুটি-বিস্কুট খাবার জন্যে ঘরের মধ্যেও অনেক সময় ঢুকে যায়।

গতরাতের পাখিগুলো শান্ত তো নয়ই, পোষাও ছিল না।

তা-ই? তাহলে নিশ্চয়ই ঠান্ডার জন্যে। খুব খিদে পেয়েছিল বোধ হয়। এক কাজ করো, আজকে ওদেরকে রুটি-বিস্কুট খেতে দিও বরং।

মিসেস ট্রিগ্‌স-এর মতো জিমও ব্যাপারটাকে খুবই হালকাভাবে নিলো। ন্যাটের মনে পড়লো, অনেকটা গত বিশ্বযুদ্ধের বিমান হামলার মতোই ব্যাপরটা ঘটেছে। সেই সময়ে কেউই বিশ্বাস করেনি প্লিমাউথের লোকজন কি দেখেছিল আর কি দুঃসহ অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিল। কোন কিছু সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলে সে ব্যাপারকে আপাত দৃষ্টিতে খুবই অবিশ্বাস্য মনে হয়।

Normal 0 false false false EN-US X-NONE BN-BD MicrosoftInternetExplorer4 /* Style Definitions */ table.MsoNormalTable {mso-style-name:”Table Normal”; mso-tstyle-rowband-size:0; mso-tstyle-colband-size:0; mso-style-noshow:yes; mso-style-priority:99; mso-style-qformat:yes; mso-style-parent:””; mso-padding-alt:0in 5.4pt 0in 5.4pt; mso-para-margin:0in; mso-para-margin-bottom:.0001pt; mso-pagination:widow-orphan; font-size:11.0pt; mso-bidi-font-size:14.0pt; font-family:”Calibri”,”sans-serif”; mso-ascii-font-family:Calibri; mso-ascii-theme-font:minor-latin; mso-fareast-font-family:”Times New Roman”; mso-fareast-theme-font:minor-fareast; mso-hansi-font-family:Calibri; mso-hansi-theme-font:minor-latin; mso-bidi-font-family:Vrinda; mso-bidi-theme-font:minor-bidi;}

ন্যাট ধীরে ধীরে বাড়ী ফিরে এলো। ওর স্ত্রী তখন রান্নাঘরে কাজ করছে, আর ছোট জনি পায়ে পায়ে ঘুরছে।

কারও সাথে দেখা হলো?

ওর স্ত্রীর গলায় আগ্রহ।

মিসেস ট্রিগস্‌ আর জিম। ওরা বিশ্বাসই করলো না আমার কথা, যাই হোক ওদিকে কিছু হয়নি।

তুমি উপরের পাখীগুলো ফেলে দাও দেখি। আমি ঘর সাফ করতে যেতে পারছি না। আমার ভয় লাগছে।

ভয়ের কিছু আছে নাকি? ওগুলো তো মরা, নাকি অন্য কিছু?

কথা কয়টা বলে একটা বস্তা নিয়ে ও দোতলার ঐ ঘরে গিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া পাখির মৃতদেহগুলো বস্তায় ভরে ফেললো একটা একটা করে। সব মিলিয়ে পঞ্চাশটা হরেক রকম পাখি। বাড়ীর ধারেকাছের ঝোপেঝাড়ে যেসব ছোট ঘরোয়া পাখি সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ায়, কোনটাই শালিকের চেয়ে বড়ো না। হয়তো প্রচন্ড আতংকে ওরা একাজ করেছে। ভাবতেই অবাক লাগে এদের ঠোঁটে এত শক্তি! ঠোঁকর মেরে মুখে-হাতে ক্ষত সৃষ্টি করে দিয়েছিল গতরাতে।

বস্তাটা ন্যাট নিয়ে গেল পাখিগুলো পুঁতে ফেলার জন্যে। সাথে সাথে আর একটা বড় অসুবিধার সম্মুখীন হলো ও।

বাগানের মাটি ভীষণ শক্ত হয়ে গেছে। মাত্র একদিনের প্রচন্ড ঠান্ডায় জমাট বেঁধে মাটি একেবারে পাথরের মতো কঠিন হয়ে গিয়েছে, যদিও এখনও বরফ পড়েনি। গতকাল থেকে কেবল পূবের হাওয়া আরম্ভ হওয়া ছাড়া আর কিছুই ঘটেনি, কিন্তু এখন মাটিতে কোদাল মারলে সাথে সাথে ফিরে চলে আসছে কোদালের ফলা। সত্যিই A¯^vfvweK কিছু ঘটতে যাচ্ছে আবহাওয়াবার্তায় হয়তো ঠিকই বলেছিল, ঐ মেরু বলয়ের সাথেই বোধ হয় এর কিছু সম্পর্ক আছে।

হওয়াটা একেবারে হাড়ে গিয়ে বিঁধছে যেন। অনিশ্চিতের মতো বস্তাটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো ন্যাট। ধুরে সাদা ফেনা মাথায় নিয়ে ঢেউগুলো পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে; সাগরের পাড়ে গিয়ে বালিতে এই পাখিগুলো পুতে ফেলাটা সহজ হবে মনে করলো ও।

সাগরের ধারে বাতাসের বেগ এতো প্রবল যে, সোজা হয়ে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছিল ন্যাটের; শ্বাস নিতেও অসুবিধা হচ্ছে ওর, হাতের আঙ্গুলগুলো ঠান্ডায় জমে নীল হয়ে উঠেছে এর মধ্যেই। জীবনে এমন ঠান্ডার পাল্লায় পড়েনি ও; এ জীবনে দেখা বহু কষ্টকর শীতের সাথে আজকের শীতের তুলনা করলো ও মনে মনে।

এখন ভাঁটা। ও একটু এদিক ওদিক হেঁটে নরম বালি খুঁজে বের করলো, তারপর গোড়ালী দিয়ে গুঁতো মেরে মেরে মাঝারী গর্ত করে ফেললো। গর্তটাকে সবকটা মরা পাখি একসাথে ফেলে দেবার জন্যে বস্তার মুখ খুলে উল্টে দিতে ঝড়ের মতো হাওয়ায় মৃতদেহ সমেত বস্তাটা হাত-ছাড়া হয়ে গেল ওর, আর তখনই ঘটলো এক অভাবনীয় ঘটনা। বস্তার ভিতরের মরা পাখিগুলো নিচে পড়ার আগেই প্রবল হাওয়ার টানে পলকের মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে গেল।

হতচকিত ন্যাট বোকার মতো তাকিয়ে দেখলো পঞ্চাশটা মরা পাখি প্রচন্ড বাতাসে বিরাট বেলাভূমির চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়ে পড়লো। দৃশ্যটা ওর মোটেই পছন্দ হলো না। অবশ্য জোয়ার এলেই সব ধুয়ে নিয়ে যাবে।

ও সাগরের দিকে তাকিয়ে রইলো। দূরে সাদা ফেনার মুকুট পড়া বড় বড় ঢেউগুলো এগিয়ে আসছে বেলাভূমির দিকে। ওগুলো উঠছে, গোল হয়ে যাচ্ছে, তারপর আছড়ে পড়ছে। এখন ভাঁটা বলে গর্জনটা আস্তে হচ্ছে আর কেমন গম্ভীর আর তাই ভয়াবহতাও নেই।

হঠাৎ ওর চোখে পড়লো- গাংচিল। ঢেউয়ের ঠিক ওপর দিয়ে ওগুলো উড়ছে। এতক্ষণ গাংচিলগুলোকেই ঢেউয়ের ফেনা বলে মনে করেছিল ও। শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে, লাখে-লাখে গাংচিল ঢেউয়ের উত্থান-পতনের সাথে নিচে নামছে আর আকাশে উঠে যাচ্ছে, ওগুলোর মুখ বাতাসের দিকে ফেরানো, যেন নংগর করা বিশাল একটা নৌবহর। ওরা অপেক্ষা করছে, ডাইনে-বাঁয়ে, সবদিকে, যেদিকে দুচোখ যায় পরস্পরের গায়ে লাগিয়ে ওরা অপেক্ষা করছে। সাগরটা শান্ত থাকলে ওগুলো সমস্ত এলাকা জুড়ে সাদা মেঘের মতো ছড়িয়ে থাকতো। পূবের তীব্র বাতাস ওদের এগিয়ে আসা প্রতিহত করছে।

সাগরের পাড় ছেড়ে বাড়ীর পথ ধরলো ন্যাট। কাউকে এসব কথা জানানো দরকার, কাউকে এ সংবাদ দেওয়া দরকার। কিছু একটা ঘটছে। এই তীব্র পূবের বাতাস, এই অদ্ভুত আবহাওয়ায় কিছু একটা কান্ড ঘটতে চলেছে, ন্যাটের মাথায় ঢুকছে না এসব। পুলিশকে জানানোর কথা ভাবলো ও। আচ্ছা, কি করবে ওরা তখন? আর কেই বা কি করতে পারবে? যখন ঐ হাজার হাজার গাংচিল, ঝড়ের জন্যেই হোক আর খিদের জন্যেই হোক, উড়ে আসছে, ক্ষেপে উঠছে? পুলিশ ওকে হয় পাগল, নয় মাতাল মনে করবে, হয়তো নির্লিপ্ত গলায় বলবে, ঠিক আছে, খবরের জন্য ধন্যবাদ। এ ব্যাপারে আগেই খবর পেয়েছি। এই বিদঘুটে আবহাওয়ার জন্যেই ওরা এখন দলে দলে দেশের ভিতরে চলে যাচ্ছে।

ন্যাট চারদিকে ঘুরে ঘিরে দেখলো। নাহ, ছোট পাখীগুলোর চিহ্নমাত্র নেই। মনে হয় এই বাতাসের তাড়নায় ওরা এই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

ন্যাট বাড়ীর কাছাকাছি আসতে দরজায় ওর স্ত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। সেখান থেকেই উত্তেজিতভাবে বলে উঠলো ও, ন্যাট, রেডিওতেও ঐ কথা বলেছে। বিশেষ সংবাদ বুলেটিনে ঐ কথা বললো। আমি লিখে রেখেছি।

স্ত্রীর উত্তেজনা ওর মধ্যেও সংক্রামিত হলো, কি বললো?

ঐ পাখিগুলোর কথা। কেবল এখানেই না, সব জায়গাতেই- লন্ডনে, সারা দেশে। পাখিদের সত্যিই একটা কিছু হয়েছে।

ওরা একসাথে রান্নাঘরে ঢুকলো। টেবিলের উপর থাকা কাগজটা তুলে নিয়ে পড়লো ন্যাট।

স্বরাস্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আজ সকাল এগারোটায় একটা বিশেষ বিবৃতি প্রচার করা হয়েছে। সমগ্র দেশের প্রায় সকল স্থান থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গিয়েছে যে, বিপুল সংখ্যক পাখীর ঝাঁক শহরে গ্রামে-সব জায়গায় জড়ো হচ্ছে। এরা বিভিন্ন যানবাহন ও কাজকর্মে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রায় সমস্ত জিনিষেরই ক্ষতি সাধন করছে। ওগুলো মানুষের উপরেও আক্রমণ করতে ছাড়ছে না। মনে করা হচ্ছে, বর্তমানে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বায়ু প্রবাহ এইসব পাখীগুলোকে দক্ষিণে দেশান্তরী করতে বাধ্য করছে হঠাৎ। এই প্রবল শীত আর প্রচন্ড ক্ষুধায় এগুলি উম্মাদ হয়ে মানুষকেও আক্রমণ করতে দ্বিধা করছে না। গৃহস্থদের সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে, তারা যেন তাদের নিজ-নিজ বাড়ীর দরজা, জানালা ও চিমনী প্রভৃতি সম্পর্কে সচেতন হন এবং তাদের শিশুদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা বিধানের সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট হন। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবৃতি শীঘ্রই প্রচার করা হবে।

এক অদ্ভুত উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল ন্যাটের শরীরে। বিজয় আনন্দে স্ত্রীর দিকে তাকালো ও,

কেমন, বলেছিলাম না? নিশ্চয়ই খামারের সবাই এটা শুনেছে। মিসেস ট্রিগস্‌ বুঝবেন, আমি গল্প বলিনি, এটা সত্যি ঘটেছে। হুঁ, সারা দেশে এটা ঘটছে। এই একটু আগে সাগরের ধারে কি দেখলাম জানো? ঢেউয়ের উপর দিয়ে লাখে লাখে গাংচিল সারা আকাশ জুড়ে উড়ছে। সুঁই ঢোকাবার জায়গা নেই যেন। কিছু একটার জন্যে অপেক্ষা করছে মনে হয়।

কিসের জন্যে অপেক্ষা করছে বলে মনে হয় তোমার?

ন্যাট ওর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো, তারপর চোখ ফেরালো হাতের কাগজটার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে উত্তর দিল,

কি জানি বলতে পারবো না- হয়তো ওরা যা বলছে, পাখিগুলো ক্ষুধার্ত- তাই হবে।

কথাটা বলে যন্ত্রপাতি রাখার জায়গায় গিয়ে হাতুড়ি-বাটালী বের করলো ও।

ওর স্ত্রী অবাক হলো,

কি করবে ওগুলো দিয়ে?

ঐ যে, রেডিওতে যা বললো, জানালা-দরজা আর চিমনী ঠিক আছে কিনা দেখি গিয়ে।

অনিশ্চিতের মতো ন্যাট উত্তর দিল।

স্ত্রী অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

তোমার কি হয়ে হয় ওগুলো জানালা ভেঙ্গে ঢুকবে? মানে ঐ চড়াই, বাবুই-ওদের তো অতো জোর নেই। ওদের পক্ষে কি করে সম্ভব?

ন্যাট উত্তর দিলো না। ঐসব চড়াই আর বাবুই নিয়ে ওর চিন্তা না, ও এখন গাংচিলগুলোর কথা ভাবছে।

ন্যাট উপর তলায় গিয়ে সারা বেলা কাজ করলো, শোবার ঘরের জানালায় আলাদা তক্তা লাগালো, চিমনীটা ঠিক করলো। এসব কাজ করতে করতে পুরোনো দিনের কথা মনে হতে থাকলো ওর। যখন ও বিয়ে করেনি, যুদ্ধের প্রথম দিকে, যখন প্লিমাউথে মা-র সাথে থাকতো ও, তখন নিষপ্রদ্বীপ মহড়ায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে ঠিক এই রকম কাজই ও করেছিল। প্রকৃত দুর্যোগের সময় অবশ্য সেগুলো কোনই কাজে লাগেনি।

খামারে এরকম কোন ব্যবস্থা ওরা নিচ্ছে কিনা, তাই ভাবলো ও। ওর সন্দেহ হলো, হয়তো নেবে না। বড়ই অলস ওরা, ঐ হ্যারী ট্রিগস আর তার বউ, কেয়ারই করতে চায় না কোন কিছু। হয়তো কোন নাচের আসরে কিংবা হুইষ্ট তাসের আড্ডায় গিয়ে বসবে।

খাবার তৈরী। নিচে থেকে ওর স্ত্রী ডাক দিলো।

হয়ে গিয়েছে। আসছি। ও সাড়া দিলো।

যেটুকু করেছে তাতেই বেশ সন্তুষ্ট বোধ করলো ও। জানালা আর চিমনীর নিচে ফ্রেমগুলো ঠিকঠিক বসে গিয়েছে।

খাওয়ার পরে ওর স্ত্রী বাসনপত্র ধুতে গেল আর ও বেলা একটার খবর শোনার জন্যে রেডিও খুললো। ঠিক সকালের খবরই পুনরাবৃত্তি করা হলো আবার, তবে তা অনেক ব্যাপকভাবে বলা হলো।

পাখিদের আক্রমণে দেশের বহু প্রত্যন্ত প্রদেশের সাথে রাজধানীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। লন্ডনের আকাশে সকাল দশটার সময় এতো পাখী উড়ছিল যে, মনে হচ্ছিল আকাশ ঘন কালো মেঘে আবৃত। পাখিগুলো এখন বাড়ীর ছাদে, জানালার ধারে, চিমনীর উপরে, দল বেঁধে বসে আছে। এইসব পাখির মধ্যে বেশির ভাগই হলো চড়াই, টুনটুনি, বুলবুলি ধরনের ছোট পাখি, যা সাধারণতঃ শহরগুলোতেই দেখা যায়, এর সাথে অবশ্য যোগ গিয়েছে পায়রা, ঘুঘু, বৌ-কথা-কও আর লন্ডনের টেমসের ছোট ছোট গাংচিলগুলো। সমস্ত এলাকা এমন A¯^vfvweK রূপ ধারণ করেছে যে, সবাই রাস্তার ধারে ভীড় করে দাঁড়িয়ে দেখছে। কাজকর্ম প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে, দোকানপাট ও অফিস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সকলেই বাইরে বেরিয়ে এই পাখির ঝাঁক দেখছে।

এ খবরের সাথে বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা বলা হলো। বলা হলো সেই শীতের সম্ভাব্য কারণ আর ক্ষুধার কথা। সেই সঙ্গে গৃহস্থদের আরও বেশী সতর্ক থাকার নির্দেশও জারী করা হলো। ভাষ্যকারের গলার ¯^i খুব শান্ত আর কোমল শোনালো ন্যাটের কানে। ওর চেহারাটা মনে মনে এঁকে নিলো ন্যাট। সে সমস্ত ব্যাপারটাকেই একটা মজার কিছু বলে মনে করছে। দেশের বেশীর ভাগ লোকই ঐ ভাষ্যকারের মতো। সবাই ভাবছে পাখির সাথে বিরোধ বাঁধার কি আছে? আজ রাতে হয়তো অনেক ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। সবাই খাবে, নাচবে, হাসি-ঠাট্টা করবে, হয়তো বাগানে ঘুরে ঘুরে মাতাল হয়ে হাসতে হাসতে বলতে, দেখো, দেখো, পাখিগুলো কেমন দল বেঁধেছে।

ন্যাট রেডিওটা বন্ধ করে দিয়ে উঠে রান্নাঘরের জানালার দিকে মনোযোগ দিলো।

ওর স্ত্রী এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

রান্নাঘরের জানালাও বন্ধ করে দেবে নাকি? দিনের বেলাতেও আলো জ্বেলে কাজ করতে হবে? বাদ দাও দেখি ওসব।

আমি ঝুঁকি নিতে চাই-না। মোটেই ঝুঁকি নিতে চাই না। ওদের উচিত সেনাবাহিনী তলব করে পাখিগুলোকে গুলি করা। তাতে হয়তো ওরা ভয় পেয়ে পালাবে।

ওদের কাজ ওরা করবে। কিন্তু সেনাবাহিনী দিয়ে কি করা যাবে?

কেন, ধর্মঘট দেখা দিয়ে ওরাই তো মাল ওঠানো-নামানোর কাজ করে বন্দরে, ট্রেন চালায়, চিঠি বিলি করে।

হ্যাঁ করে, কিন্তু লন্ডনের লোক সংখ্যাই তো কোটির উপরে। ভাবো একবার, কতো হাজার বাড়ী, কতো লক্ষ ফ্ল্যাট। তোমার কি মনে হয় সবকটা বাড়ীর সবকটা জানালায় সৈন্য বসানো সম্ভব?

আমি তার কি জানি? কিন্তু একটা কিছু তো করা দরকার। ওদের নিশ্চয়ই একটা কিছু করা উচিৎ।

ন্যাট চুপ করে থেকে মনে মনে বলে, নিশ্চয়ই ওরা এই সমস্যা নিয়ে কিছু ভাবছে, কিন্তু ওরা যাই সিদ্ধান্ত নিক না কেন, কয়েকটা বড় বড় শহর ঠেকাতেই ওরা হিমসিম খেয়ে যাবে, তারপর রয়েছে হাজার হাজার গ্রাম। তিন চারশ মাইল দূরের এলাকায় সে সাহায্য আর পৌঁছাবে না। প্রত্যেকের বাড়ীঘরে নিজেদেরই নজর রাখতে হবে।

রান্নাঘরের জিনিসপত্র কতটা কি আছে?

ন্যাট জানতে চাইলো।

তোমার মাথায় কি ঢুকলো বলো তো?

ওর স্ত্রী অবাক হয়।

ন্যাট একটু অধৈর্য হয়ে বলে,

আমি কি ভাবছি তা তোমার জানার দরকার নেই। ভাঁড়ারে কি কতটা আছে তাই বলো।

কালকে হাট করার কথা। গাদাগাদা জিনিস কিনে ঘর ভরানো আমি দুচোখে দেখতে পারি না। গত পরশু কসাই মাংস দিয়ে যায়নি। কালকেই সব কিনে আনবো।

ওর স্ত্রীকে আর ভয় পাইয়ে দিতে চাইলো না। কিন্তু কেন যেন ওর মনে হলো আগামীকাল পর্যন্ত সময় পাবে না ওরা। ন্যাট নিজেই ভাড়ার ঘরে গিয়ে সমস্ত টিন আর কৌটা উল্টে-পালটে দেখলো। হুঁ, দুএকদিন আরও যাবে। কিন্তু রুটিটাই বাড়ন্ত।

রুটিওয়ালা কবে আসবে?

ওরও তো কালকে আসার কথা?

ভাঁড়ার ঘরে এখনও কিছু ময়দা আছে। যদি রুটিওয়ালা না আসে, তাহলে আর একটা রুটি তৈরী হয়তো করা যাবে।

পুরানো দিনে ফিরে যেতে হবে। যখন নিজেরা রুটি বানিয়ে, মাছ-মাংস নোনা করে, শুঁটকী করে রাখতো লোকেরা। মনে করতে হবে একটা অবরুদ্ধ শহরে বাস রছি।

স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসতে চেষ্টা করলো ন্যাট।

আমি বাচ্চটাদের টিনের মাছ খাওয়াতে চেষ্টা করেছিলাম। ওদের নাকি ভালো লাগে না।

ওর স্ত্রী একটু খুঁত খুঁত করলো।

ন্যাট রান্নাঘরের জানালগুলো হাতুড়ী মেরে বন্ধ করতে থাকলো। মোমবাতি- ওদের তো মোমবাতিও কম। মনে হয় বউ ওটাও আগামীকাল কিনবে বলে মনে করে রেখেছে। কিন্তু এরকমভাবে কতদিন চলবে? আজকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে।

Leave a Reply