শরমিন বাসা থেকে যখন বের হলো, তখন ওর ঘড়িতে সকাল সাড়ে ছয়টা। বাড়ির কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। কেবল কিচেনে খুটখাট শব্দ শোনা যাচ্ছে। ও ওর দোতলার ঘর থেকে ব্যাগটা কাঁধে ফেলে বের হয়ে প্রায় নিঃশব্দে নেমে এলো এক তলায়। ড্রইংরুমটা পার হলো। বাইরের দরজাটার নবটাতে চাপ দিতে আস্তে করে দরজাটা খুলে গেল। দরজট] পার হয়ে সামনের পোর্টিকোতে বের হয়ে এলো ও নির্বিঘ্নে।
এবারে বাগানের ধার ঘেঁসে গুঁড়ো পাথর বিছানো পথটা পার হয়ে গেটের কাছে এসে একটু থমকালো শরমিন। গেটের পাশের ছোট্ট গুমটি ঘরটাতে দারোয়ান রেডিওতে গান শুনছে, রেডিওর আওয়াজটা বেশ কম। ওর পিঠটা দেখা যাচ্ছে আধা বন্ধ দরজাটার ফাঁক দিয়ে।
শরমিন গেটটার দিকে তাকিয়ে দেখে গেটে তালা দেওয়া নেই। একটা পাল্লায় একটু চাপ দিতে ধীরে ধীরে ভারী পাল্লাটা সরতে থাকলো বাইরের দিকে। একজন মানুষ পার হতে পারে এমন একটু ফাঁক হতেই শরমিন ঐ ফাঁক গলে কাত হয়ে বাইরে বের হয়ে এলো।
নিজের ঘর থেকে বের হওয়ার সময় যে শ্বাসটা বন্ধ করে রেখেছিল, সেটা যেন এতক্ষণ পরে ওর বুক কাঁপিয়ে বের হয়ে এলো। এক মুহূর্ত ওর এই হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতাটুকু উপভোগ করলো চুপ করে দাঁড়িয়ে। তারপর এক হাত দিয়ে গেটের পাল্লাটা ঠেলা দিয়ে আগের জায়গায় নিয়ে এলো। তারপর রাস্তায় নেমে এলো ও। মনে মনে গান গেয়ে উঠলো ও, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে’।
* * * * * * * * * * * * * *
গতকাল সন্ধ্যায় ও বাড়ি থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। মনের ভেতর অল্পবিস্তর অসন্তুষ্টি থাকলেও সেটা খুব একটা বড় দানা বাঁধেনি মনে। আচ্ছা, ঠিক আছে, বাবা যখন চাইছেন, তখন না হয় মেনেই নেয়া যাক। বিয়ে তো একদিন না একদিন করতেই হবে। আর নিজের যখন কোন মনের মানুষ নেই . . তখন . . না হয়. . . এই বিয়ের কারণে যদি বাবার ব্যবসায়ের লাভ হয়।
বাবা এ বিয়ের সব দিক – ভাল, মন্দ, লাভ, ক্ষতি, সবকিছুই ওকে পরিস্কার করে সুন্দর যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ওর বুঝতে অসুবিধা হয়নি, মানতেও আপত্তি করেনি। বিশাল রাজ্য, রাজপুত্র, আমেরিকা, জাপান, দুনিয়ার যে প্রান্তে যেতে চাও, কোন মানা নেই। তবে হ্যাঁ, ‘জামাই খুব একটা হ্যান্ডসাম না, বয়সের ফারাকও বেশ একটু . . মানে .’
বাবা এ সময় একটু কেশে নিয়ে বলেছিলেন, ‘সেক্স তো দুদিনের . . কিন’ সারা দুনিয়া তোমার হাতে। আমার বিজনেসও তো আলটিমেটলি তোমারই।’
একটু হেসে তিনি বলেছিলেন, ‘জানি, তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই। আর সবার ভাগ্যেই তো আর সিনেমার নায়ক, এডোনিস মার্কা ছেলে জোটে না। ওর সাথে একটু মেলামেশা করো। একটু ছাড় দাও। দেখো, ওর সাথে জীবনটা খারাপ যাবে না। আমি নেহাতই একটু আটকে গিয়েছি বলেই না . . .’
এই বাইশ বছরের জীবনে কোন রকম বিপথে যায়নি শরমিন। বাবা-মার অবাধ্যও হয়নি। খুব যে গুডি গুডি গার্ল ছিল, তা’ও না। তবে বাবাকে সে সব নিয়ে কোনদিনই তেমন বড় রকমের দুশ্চিন্তা করতে হয়নি। বাবা জানতেন শরমিন ওর কথার অবাধ্য হবে না। বিপ্লব করার মানসিকতা ওর শরীরে ছিল না।
বিপ্লব করার ইচ্ছেও ছিল না ওর। কিন্তু! হ্যাঁ, আর এই ছোট্ট একটা কিন্তুতেই একেবারে বিগড়ে গেল শরমিন। আর তাই এই পলায়ন।
ও ওর উড-বি হাসব্যান্ডের সাথে দেখা করেছে। খুব একটা পছন্দ না করলেও তার সাথে হেসে হেসে কথা বলেছে। একাধিকবার শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছে। সিনেমায় গেছে। অস্বন্তি লাগলেও সিনেমা হলের অন্ধকারে ভদ্রলোককে ওর হাত ধরতে, কাঁধে হাত রাখতেও দিয়েছে। তাই বলে বিয়ের আগে বিছানায় শোয়া? ছিঃ!
যেদিন ও ওর বেডরুমের নতুন ফার্নিচার দেখাবার নাম করে ঘরে নিয়ে ওকে জাপটে ধরে বিছানায় চিত করে ফেলে ওর গায়ের ওপর উঠে আসতে গেল। সেদিনই ও সিদ্ধান্ত নিলো, আর না।
আমি স্বাধীন, কাকে আমার শরীর ছুঁতে দেবো, সেটা আমি সিদ্ধান্ত নেবো। অন্তত এই ‘ইক্রেডিবল হাল্কে’র সাথে আর এক মুহূর্ত না। একটুখানি কারাতে শেখা ছিল শরমিনের। ঘাড়ের ওপর একটা চপ বসাতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল বীরপুরুষটা।
* * * * * * * * * * * * * *
গুলশান দুই নম্বর গোল চক্করের দিকে চলতে চলতে সাদেকের চোখে পড়লো ফুটপাথের ধারে একটা মেয়ে হাত তুলে ইশারা করছে। পা পর্যন্ত লম্বা প্রচুর ঘের দেওয়া গাঢ় সবুজ রঙের স্কার্ট আর একটা উজ্জ্বল লাল ব্লাউজ। বাম কাঁধে একটা সবুজের ওপর পলকা লাল ডটের দোপাট্টা, হাতে একটা মাঝারি বড় ব্যাগ।
সাদেক গাড়ির গতি কমিয়ে মেয়েটির কাছে এসে থামে। হাত বাড়িয়ে পিছনের দরজা খুলে দিয়ে বিদেশী কায়দায় জিজ্ঞেস করে, ‘হোয়ার ট্যু, ম্যাম?’
মেয়েটা ট্যাক্সিতে উঠে বসে বলে, ‘ট্যু দ্যা স্টারস্? পারবেন নিয়ে যেতে?’
একটু চমকে ওঠে সাদেক, ‘জ্বি?’
মেয়েটি একটু হাসে, তারপর বলে, ‘ফরগেট ইট। ধানমন্ডির দিকে চালাতে থাকুন, একটু চিন্তা করে নেই, কোথায় যাব।’
মহাখালি ওভার পাসটাতে ও যখন উঠেছে তখন সাদেকের সেলফোনটা বেজে উঠলো। ও হাত বাড়িয়ে বোতাম টিপে একটিভেট করে, তারপর ড্যাশবোর্ডের নিচে আর একটা বোতাম টিপে সাড়া দেয়, ‘হ্যা। বল্।’
স্পিকার থেকে শব্দ আসে, ‘ভাইয়া, তুই এখন কোথায়?’
‘কেন? কি খবর?’
‘সুনন্দদা ফোন করেছিল। তোর রেজাল্ট আউট হয়েছে।’
নিরাসক্ত গলায় সাদেক বলে, ‘ও আচ্ছা।’
‘তুই ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিস। কনগ্র্যাটস্।’
‘থ্যাংক ইউ। তোর একটা বড় পুরস্কার পাওনা হয়ে গেল।’
‘এবার কিন্তু, এমনি পুরস্কারে হবে না।’
‘তা’ হলে?’
‘একটা সুন্দর ভাবী এনে দিতে হবে।’
‘ভাগ এখন। কাজের সময় ফালতু কথা।’
‘সুনন্দদাকে ফোন করিস।’
‘আচ্ছা।’
‘কখন ফিরবি?’
‘আসছি। গিফট কিনেই ফিরছি।’
‘ভাবিসহ তো! হি, হি। রাখছি।’
ফোনটা কেটে যায়।
সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পেছন থেকে মেয়েটি কথা বলে ওঠে, ‘কিসের রেজাল্ট?’
‘মাস্টার্স।’
‘কোন সাবজেক্ট?’
‘ইংলিশ লিটারেচার।’
‘ও বাবা। মাস্টার্স করেছেন। অথচ ট্যাক্সি ড্রাইভিং?’
‘এটা আমার সখ। যাতে অহঙ্কার মনে না আসে।’
‘বাসায় আপনার কে আছে?’
‘বাবা-মা আর ছোট বোন?’
‘মাস্টার্স তো হলো। এবার?’
‘ভাবিনি। দেখি এমবিএ করতে পারি।’
কথাটা বলে গাড়ির গতি কমায় ও।
‘কি হলো?’
‘চেকিং হবে।’
‘ও বাবা, কেন?’
‘কি করে বলবো, বলুন।’
পুলিশ ভ্যানটার পাশে দাঁড় করায় সাদেক।
একজন কনস্টবল দরজা বরাবর মাথা নামিয়ে বলে, ‘গাড়ির কাগজপত্র দেখান।’
ড্যাশবোর্ডের ভেতর থেকে গাড়ির কাগজপত্র বের করে ও বেরিয়ে আসে।
আর সাথে সাথে একজন কনস্টবল এগিয়ে এসে ওর কনুইটা ধরে পেছনদিকে হাতটা ঘুরিয়ে ধরে, ‘কোথায় লুকিয়ে রেখেছো, চাঁদ?’
সাদেক অবাক হয়, ‘কি লুকাবো?’
প্রথম কনস্টবলটা এতক্ষণ গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করছিল, ‘এগুলো তো সব ঠিকই আছে দেখছি। তা’ মেয়ে হাইজাকের বুদ্ধি মাথায় এলো কোথা থেকে?’
‘কার মেয়ে, কোন মেয়ে? আমি কোনো মেয়ে হাইজাক করিনি।’
‘তুমি আজ সকালে ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট দলিলউদ্দিন সাহেবের মেয়েকে হাইজাক করেছো ওদের বাসা থেকে।’
‘আমার কাছে কোন অস্ত্র নেই, অজ্ঞান করার ওষুধও নেই। আমি বাচ্চা মেয়ে হাইজাক করবো কেমন করে।’
‘বাচ্চা না। দলিলউদ্দিনের নাবালিকা মেয়ে। এখানে কথা বলে লাভ নেই। থানায় চলো, চটকানা দেই কটা, কথা আপনা থেকেই বের হয়ে আসবে।’
* * * * * * * * * * * * * *
এতক্ষণে পেছনের সিট থেকে মেয়েটি বের হয়ে আসে।
‘কি ব্যাপার অফিসার?’
‘এই লোকটা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের নাবালিকা মেয়েকে হাইজাক করে লুকিয়ে রেখেছে। আপনি ওর ট্যাক্সিতে ছিলেন তো। একটু দাঁড়ান, আপনাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিচ্ছি, আপনি চলে যান।’
‘আমি তো চলে যাবোই। কিন্তু মেয়ে হাইজাক তো সাংঘাতিক অপরাধ। তাও আবার শিল্পপতি দলিলুদ্দিন সাহেবের মেয়ে! সাংঘাতিক ব্যাপার!’
সাদেক অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকায়। এ মেয়ে ওকে ফাঁসিয়ে দেবে না তো? ও দলিলউদ্দিনের কেউ না তো? সন্দেহ নাড়া দেয় ওর মনে।
‘জি, ম্যাডাম। থানায় নিয়ে চটকান দিলেই সব জানা যাবে।’
মেয়েটা বলে, ‘ঠিকই বলেছেন অফিসার। চটকান দিলে তো কথা বের হবেই। তবে ওর সাথে যে আমার একটু লেন-দেন বাকি আছে?’
অফিসার জিজ্ঞেস করেন, ‘কিসের লেনদেন?’
মেয়েটা বলে, ‘আছে একটু। আচ্ছা, আপনি কি দলিলউদ্দিনের মেয়েটাকে দেখেছেন?’
‘না। ম্যাডাম। থানায় ছবি পাঠানো হয়েছে। ওখানে গেলেই পাবো।’
‘ভেরি গুড। থানায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। দলিলউদ্দিন সাহেবের মেয়ের ছবি আমার কাছে আছে, আমি দেখাচ্ছি।‘ মেয়েটা হাতের পার্স খুলে একটা আইডি কার্ডের মতো জিনিষ বের করে অফিসারের হাতে দেয়, ‘এই দেখুন।’
মেয়েটা বলে, ‘এটা দলিলউদ্দিনের মেয়ে নাজনিন আখতার। অর্থাৎ আমি। ওতে আমার জন্ম তারিখ দেয়া আছে। আমি নাবালিকা না। আমার বয়স এখন একুশ। এ ছেলেটি আমাকে হাইজাক করেনি। আমি আমার নিজের ইচ্ছেতে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি। দলিলউদ্দিন সাহেব, মানে আমার বাবা মিথ্যে কথা বলেছেন। আমি নিজেই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম। পথে এই ট্যাক্সিতে উঠেছি। ওর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। ও আমাকে হাইজাক করেনি। ঠিক আছে?’
অফিসার মেয়েটির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান।
নাজনিন ভ্রু নাচিয়ে বলে, ‘এবার আমার ট্যক্সি ড্রাইভারকে ছেড়ে দিতে নিশ্চয়ই আপনার কোন অসুবিধা নেই।’
এ সময় অফিসারের ওয়াকি-টকি কড় কড় শব্দ করে ওঠে, তিনি ওটা অন করে বলে, ‘এক মিনিট। স্যার, আমি এখন সংসদ ভবনের সামনে থেকে বলছি। মেয়েটা, মানে শরমিন আখতারের খবর পাওয়া গেছে, স্যার। তিনি একটা ট্যক্সি করে যাচ্ছিলেন। স্যার। আমরা ট্যাক্সিটা থামিয়োছি, স্যার। আমাদের ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে, স্যার। আমাকে মিস নাজনিন তার ন্যাশনাল আই ডি কার্ড দেখিয়েছেন, স্যার। তিনি তো নাবালিকা নন, স্যার। আমরা কি এখন ওদের ছেড়ে দিতে পারি, স্যার?’ – – – ঠিক আছে, স্যার।’
অফিসার ওয়াকি-টকি বন্ধ করে শরমিনকে বলেন, ‘আপনি ট্যাক্সি নিয়ে যেতে পারেন। তবে ফর সিকিউরিটি রিজন, আমাদের সাথে টাইম টু টাইম যোগাযোগ রাখতে হবে আপনাকে। এটা অর্ডার। না হলে, আমরা আপনার বিরুদ্ধে এরেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করে আটক করতে বাধ্য হবো।’
শরমিন মাথা ঝাঁকায়, ‘ঠিক আছে। আমি আজ সন্ধ্যা পর্যন- এই ট্রাক্সি ড্রাইভারের বাসায় থাকবো। আপনি ওর ঠিকানা আর ফোন নিয়ে রাখুন। পরে সন্ধার দিকে আপনাকে জানাবো আমি কোথায় থাকবো।’
সাদেক এতক্ষণ নাজনীনের কথাবার্তা অবাক বিস্ময়ে শুনছিল। ও অফিসারকে ওর বাসার ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিয়ে দেয়।
* * * * * * * * * * * * * *
নাজনিন ট্যাক্সিতে উঠে বলে, ‘নিন চলুন এবার। আপনার বোনটার সাথে পরিচয় করি, আর আপনার ভাল রেজাল্টটা সেলিব্রেট করি।’
সাদেক গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দেয়, তারপর বলে, ‘এটা আপনি কি করলেন?’
শরমিন হাসে, ‘সিম্পল, পুলিশের চটকান খাওয়ার হাত থেকে আপনাকে বাঁচালাম।’
সাদেক রাস-ার দিকে চোখ রেখে গাড়ি চালাতে চালাতে বলে, ‘আপনি তা’হলে সত্যিই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন?’
পেছন থেকে শরমিন উত্তর দেয়, ‘আমি বেকায়দায় না পড়লে মিথ্যে বলি না। আর এখন তো আমি বেকায়দায় নেই।’
‘পালাচ্ছিলেন কেন?’
‘সিনেমায় যা হয়, বাবা তার ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবসায়িক বন্ধুর ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিলেন।’
‘তা’তে অসুবিধাটা কি? এক ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের মেয়ের সাথে আর একজনের ছেলের বিয়ে, উভয় শিল্প এক মহা-শিল্পের পথ সুগম করে দেবে। টক অব দি টাউন, টক অব দি কান্ট্রি। মিডিয়া এটা নিয়ে দু’মাস লাফালাফি করবে। আমাদের নিস-রঙ্গ জীবনে আলোচনার সাবজেক্ট পাওয়া যাবে।’
‘প্রথমে আমারও আপত্তি ছিল না। গুডি গার্ল হয়ে মেনে নিয়ে তার সাথে প্রি-ম্যারেজ মেলামেশা করতেও গিয়েছিলাম। কিন’ সে ভদ্রলোককে অত্যন- রিপালসিভ মনে হলো আমার কাছে। আমি আমলকি খেতে চেয়েছি, যে কোন ছেলে হলে নিজে এক শ’ গ্রাম আমলকি কিনে এনে আমার হাতে দিয়ে বলতো, তুমি খাও, আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। আর সে কি করলো জানেন, ফোন করে ম্যানেজারকে বলে দশ কেজি আমলকি আনতে বললো। জাস্ট ইমাজিন!
‘ভাল তো কতো বড় প্রেমিক! আগামী এক বছরের জোগান এক দিনে।’ হা হা করে হেসে উঠলো সাদেক।
‘রোজ একশ’ গ্রাম খেলেও দশ কেজি খেতে আমার তিন মাস লাগতো, এদিকে তিন দিনের মাথায় ঐ আমলকি নরম হয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যেতো। তার ওপর ইনক্রেডিবল হাল্কের মতো ফিগার, চলাফেরা – কথায় কথায় ব্যবসা আর কিভাবে বেশি ইনকাম আর প্রফিট করা যাবে – আরে বাবা, প্রেম করতে এসেছিস ফিয়ান্সের সাথে দুটো প্রেমের কথা বল, না, সেরকম কোন কথা বলে না, জানেও না, প্র্যাডো গাড়ির দাম বেড়ে গেল, আগামী সপ্তাহের ভেতরই বেক্সিমকোর শেয়ার আরও কিনে রাখতে হবে। এই সব। কতক্ষণ সহ্য করা যায় বলুন।’
‘সেটাই বা খারাপ কি, ঝগড়ার কোন সাবজেক্ট থাকবে না। ও বলবে আর আপনি শুনবেন। ব্যাস চুকে গেল।’
‘বুঝলাম। আপনার যুক্তি ঠিক আছে, মানলাম। কিন’ এতক্ষণ আসল যে কথা, সেটা তো বলিনি, আমার পলায়নের।’
‘কি সেটা।’
‘তিনি আমাকে তার বিছানা দেখাতে নিয়ে গেছিলেন।’
‘তো?’
‘আচ্ছা, আপনি কি ইডিয়েট, যে সবকিছু ভেঙে বলতে হবে? তিনি আমার শরীরের দখল নিতে গিয়েছিলেন।’
‘ওহ! শিট!’
‘শুধু, ওহ শিট? ভাবুন একবার!’
‘আমি ভাবতেই পারছি না।’
‘আমার পালানো কি নেহায়েতই যুক্তিহীন?’
‘না। কিন’, আপনার কোন পছন্দের কথা তো বাবাকে বলতে পারতেন, কোন ক্লাসফ্রেন্ড, পাড়াতুতো বন্ধু, বান্ধবীর বড় ভাই, আঙ্কেল, এমন কেউ।’
‘পারতাম, যদি থাকতো। নেই তো।’
‘আপনি এতো রোমান্টিক, আর বয় ফ্রেন্ড নেই, ভাবা যায় না।’
‘বন্ধু-বান্ধবী তো আছে অনেক। বাট দে আর নট মাই লাইক। ঐ যে বললেন না, আমি রোমান্টিক, হ্যাঁ, আমি খুব রোমান্টিক। আর সেই সাথে খুব এডভেঞ্চার পছন্দ করি, ইমোশনালও। আমার অধিকাংশ বন্ধু আর বান্ধবীরাও প্রায় আমার সেই সো-কল্ড ফসকে-যাওয়া হাসবেন্ডের মতো, টাকা কামাও, খরচ করো, খাও-দাও, মসি- করো, ব্যস! টু হেল উইথ দ্যট সোসাইটি।’
সাদেক কোন কথা না বলে গাড়ি চালানোর দিকে মন দেয়।
* * * * * * * * * * * * * *
দু-মিনিট চুপ করে থেকে শরমিন বলে ওঠে, ‘এক কাজ করবেন?’
সাদেক রাস-ার দিকে নজর রেখেই উত্তর দেয়, ‘কি?’
‘আমাকে আপনি বিয়ে করবেন? ট্যাক্সি ড্রাইভার ওয়েডস ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাইকুন দলিল উদ্দিনস্ ডটার। ভাবুন একবার। মিডিয়াতে বম্বশেল পড়বে।’
‘মাথা খারাপ হয়েছে আপনার?’
‘কেন, আমি কি দেখতে খারাপ?’
‘না। খবরটা প্রচারের সাথে সাথে জনাব দলিলউদ্দিন আর আপনার ঐ ফসকে যাওয়া টাইকুন-পুত্র আমাকে গুলি করে মারবে। নিরীহ বাবার অন্ধের-যষ্টি বেঘোরে মারা পড়বে।’
‘কিন’ ভেবে দেখুন, আমার কি বড় এডভেঞ্চার হবে? লাইফ লং — প্রতিদিন হাড়ি-বাসন মাজা, রান্না করা, কলস-বালতিতে সারা দিনের জন্য কলের পানি ভরা, শাশুড়ির সেবা করা, দেবর-ননদের দেখভাল করা, সিনেমার আদর্শ স্ত্রীর মতো।’
‘ওটা সিনেমাতেই মজা লাগে। ওটা অভিনয়।’
‘রাইট উই আর। আমি না হয় কয়েক বছর অভিনয় করে দেখলাম। শুধু আমার সামনে ক্যামেরা থাকবে না, আর সবচেয়ে বিরক্তিকর জিনিষ, কিছুক্ষণ পর পর পরিচালকের কাট, কাট চিৎকার তো থাকবে না।’
‘আপনার আর কোন কাজ নেই?’
‘আরে, আমার পড়াশুনা তো শেষ, এ-লেভেল পাশ করেছি। আর কি কাজ? হ্যাঁ, করবো, আপনি যখন এমবিএ করবেন, তখন আপনার সাথে আমিও এমবিএ করবো। মাথা ভাল আমার। সংসার সামলে গৃহবধুর এমবিএ পাশ- কেমন এডভেঞ্চারাস খবর? ভাবুন একবার।’
‘আপনার সার্টিফিকেট বয়স একুশ হলেও মনের বয়স বারো পার হয়নি।’
‘শুনুন, মনের বয়স যতদিন কমিয়ে রাখতে পারবেন, ততোই মঙ্গল। আমার বাবার মতো আমি হতে চাই না। তার জীবনে আনন্দ বলতে কেবল টাকা কামানো। ও জীবন আমি চাই না। বয়স বাড়াতেও না।’
সাদেক নাজনীনের কথার উত্তর দেয় না।
শরমিন আবার বলে, ‘আপনার বাসা আর কতদূর?’
‘এই এসে গিয়েছি। আর একটু।’
‘আপনার বাসায় পৌঁছানোর আগেই সিদ্ধান- নিয়ে ফেলুন, আমাকে আপনি বিয়ে করতে রাজি কি না। ওহ, তার আগে আমাকে একটু বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে নিয়ে চলুন তো।’
সাদেক প্রশ্ন করে, ‘কেন? ওখানে কি?’
শরমিন উত্তর দেয়, ‘আরে, বাড়ি থেকে বের হয়েছি। কিছু পারসোনাল জিনিষ কেনা হয়নি? কিনবো।’
সাদেক গাড়ি ঘুরিয়ে বসুন্ধরা কমপ্লেক্সে উপসি’ত হয়।
শরমিন গাড়ি থেকে নেমে বলে, ‘আপনিও চলুন আমার সাথে। আমার মতো একজন সুন্দরী মহিলার ব্যাগ ধরতে পারাও তো সৌভাগ্যের ব্যাপার, তাই না?’
সাদেক দ্বিরুক্তি করে না। সাথে সাথে হাঁটতে থাকে।
শরমিন পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, আপনার বোনটির বয়স কতো?’
‘কেন? কি দরকার?’
‘বলুন তো। এত তর্ক করেন কেন?’
‘ও এবারে এইচএসসি পরীক্ষা দেবে।’
শরমিন কেবল, ‘হুম,’ বলে চুপ করে যায়।
তারপর প্রায় আধাঘন্টা ধরে চর্কির মতো ঘুরে প্রচুর কেনাকাটা করে শরমিন।
* * * * * * * * * * * * * *
নিচে নেমে গাড়িতে এসে বসে বলে, ‘নিন। চলুন এবার আপনার বাড়ি।’
সাদেক বলে ‘বাড়িটা আমার না আমার বাবার।’
শরমিন বলে, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আপনার বাবার বাড়িতে নিয়ে চলুন আমাকে।’
কিছুক্ষণ দুজনের কেউ কথা বলে না। তারপর শরমিন মুখ খোলে, ‘আচ্ছা, ভাল কথা আপনার কোন বান্ধবী বা প্রেমিকা নেই তো?’
সাদেক জিজ্ঞেস করে, ‘কেন?’
শরমিন বলে, ‘না। তা’ হলে তো আমি আউট। আমার অন্য ভাবনা ভাবতে হবে।’
সাদেক বলে, ‘সেটা না হয় একটু ভেবে রাখুন।’
শরমিন উদ্বিগ্ন গলায় বলে, ‘প্লিজ, প্লিজ, বলুন না। আছে, আপনার কোন প্রেমিকা? রিয়ালী, আই ওয়ান্ট টু নো। আমি ওরিড। এই সম্ভাবনার কথা মনেও আসেনি আমার । ও মাই গড! প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, টেল মি।’
সাদেক মনে মনে ওর এই উদ্বিগ্নতা বেশ উপভোগ করে কিছুক্ষণ। তারপর মুখ খোলে, ‘না, আমার কোন বান্ধবী, গার্ল ফ্রেন্ড, প্রেমিকা, কিছুই নেই। আমার একমাত্র বন্ধু, আমার ছোট বোন। শি ইজ মাই এঞ্জেল।’
হাঁফ ছেড়ে চেঁচিয়ে ওঠে শরমিন, ‘খুব বাজে মানুষ আপনি। আর একটু হলে আমার হার্ট এটাক হয়ে গিয়েছিল। তা’হলে আমার ব্যাপারটা? প্লিজ, আপনার বাসায় ঢোকার আগেই বলে ফেলুন।’
সাদেক গম্ভির হয়ে যায়, ‘দেখুন মিস শরমিন। জীবনটা অত সহজ নয়, যে এক মিনিটে সিদ্ধান- নিয়ে ফেললেন। জীবনটা খুব কঠিন। ইট টেকস ইয়ারস টু টেক সিরিয়াস ডিসিশান অন ফিউচার লাইফ।’
শরমিনও গম্ভির হয়, ‘সাদেক সাহেব। আমি এতক্ষণ হালকাভাবে কথা বলছি বলে মনে করবেন না, আমার জীবন সম্পর্কে আমি কেয়ারলেস। একজন মানুষকে দেখতে, বিচার করতে দশ বছর লাগে না, দশ মিনিট লাগে। আপনার বাবা বা দাদু তাদের স্ত্রীদেরকে পাঁচ বছর ধরে দেখেশুনে বিয়ে করেননি। ডু ইউ থিঙ্ক দে ওয়্যার ফেইলিয়র ইন দেয়ার ফ্যামিলি লাইভস্? লাইফ এন্ড ডেথ এক মুহূর্তের ব্যাপার, পাঁচ বছর ধরে কারো জন্ম হয় না, মৃত্যুও হয় না। লাগে এক সেকেন্ড। ওয়েল, থ্যাংক ইউ। গাড়ি থামান, আমি এখানে নেমে যাবো।’
সাদেক বলে, ‘এখানে নেমে যাবেন মানে? কোথায় যাবেন?’
শরমিন গম্ভির গলায় বলে, ‘দ্যাটস নট ইওর লুক আউট। আপনার সাথে আর আমার কোন সম্পর্ক নেই।’
সাদেক বলে, ‘আপনি বিপদে পড়বেন।’
শরমিন উত্তর দেয়, ‘পড়ি পড়বো, আপনার কি?’
সাদেক কোন কথা না বলে ট্যাক্সি চালিয়ে যেতে থাকে।
শরমিন বলে, ‘আপনি ট্যাক্সি থামাবেন, না আমি চিৎকার করবো?’
সাদেক বলে, ‘আপনি পুলিশ অফিসারকে আমার বাসার ঠিকানা দিয়েছেন। এবার পুলিশ অফিসার আমাকে ধরবে, আপনার হোয়ার এবাউটস জানতে, আর সেটা না পেয়ে চটকান দেবে। সেটাই আপনি চান তো, তা’হলে।’
শরমিন চুপ করে যায়।
* * * * * * * * * * * * * *
সাদেক ততক্ষণে শঙ্কর বাসন্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে গলির ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে ট্যাক্সিটা। কেবল বলে, ‘সামনেই আমার বাসা। এতক্ষণ অনেক কথা হয়েছে, এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যান, আটকাবো না।’ বলতে বলতে একটা দেয়াল ঘেরা বাগানওয়ালা বাড়িতে ঢোকায় গাড়িটা।
শরমিন গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে ফুল গাছ ভরা দো’তলা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়, ‘ঢাকার বুকে এত সুন্দর ছোট্ট বাগানবাড়ি? ভাবাই যায় না।’
‘হ্যাঁ। এটা আব্বার তপোবন। আমরা চার জন এখানটায় থাকি। আসুন।’
শরমিন সাদেকের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে মন-ব্য করে, ‘এমন বাড়িতে সারা জীবন থাকতে পারলে জীবনে শানি- পেতাম। আমি আর কিছু চাই না।’
সাদেক রসিকতা করতে ছাড়ে না, ‘এক কাজ করুন, আপনি আপনার ইনক্রেডিবল হাল্ককে এখানে নিয়ে আসুন, আমি না হয় আপনাদের দুজনের জন্য এ বাসায় একটা রুম খালি করে দেবো।‘
শরমিন বলে, ‘ওর নাম আপনার মুখে আর একবার শুনলে আমি কিন’ আপনাকে খুন করে ফেলবো।’
ওরা দু’জন বারান্দায় উঠলে কলিং বেলে একবার চাপ দেয় সাদেক।
একটু পরেই দরজাটা খুলে যায়। দরজার ওপারে শরমিনের বয়সী একটা মেয়ে দরজা খোলে। ওদের দিকে আধা মিনিট চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘মা। আব্বু। তোমাদের ছেলে তোমাদের জন্য পুত্রবধু নিয়ে এসেছে, দেখে যাও।’
সাদেক হাত বাড়িয়ে মেয়েটার মুখ চেপে ধরে, ‘থামবি! কি বলছিস, যা’. তা’। উনি আমার গেস্ট।’
কথাটা ভেতর বাড়িতে পৌঁছে যায়। সাদেকের মা, নাসরিন বেগম আর বাবা সাজ্জাদ করিম সদর দরজার কাছে এগিয়ে আসেন। ওরা দুজনের চোখে-মুখে কেমন একটা দিশাহারা ভাব।
দরজায় দাঁড়ানো মেয়েটিকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সাদেক ঘরে ঢোকে, ‘মা, আব্বু, ইনি শরমিন আখতার, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট দলিল উদ্দিন সাহেবেব মেয়ে। একটু শহর দেখতে বেরিয়েছেন। আমরা মধ্যবিত্ত, ছা-পোষা মানুষরা কেমন থাকি, তাই দেখতে এসেছেন।’
শরমিন দু’পা এগিয়ে এসে নিচু হয়ে নাসরিন বেগম আর সাজ্জাদ সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলে, ‘আপনাদের মনে হয় অস্বসি-তে ফেলে দিলাম। আসলে ট্যাক্সিতে শুনলাম সাদেক সাহেবের রেজাল্ট আউট হয়েছে। উনি ফার্ষ্ট ক্লাস পেয়েছেন। ওর বোন বলছিল বাসায় সেলিব্রেশন হবে। তাই লোভ সামলাতে পারলাম, না।’
নাসরিন বেগম দ্রুত সামলে নিলেন।
‘না, না, কি আশ্চর্য, অস্বসি-র কি আছে? তুমি এসেছো, খুব ভাল লাগছে। আসো। এই কুমু, যা তুই ওকে তোর ঘরে নিয়ে যা। একটু ফ্রেস হয়ে নিক।’
দরজায় দাঁড়ানো মেয়েটা, কুমু এগিয়ে এসে শরমিনের হাত ধরে বলে, ‘আসো ভাবি। থুড়ি। আসুন আমার সাথে।’
শরমিন কুমুর সাথে যেতে যেতে কুমুর কানে কানে বলে, ‘ইন কেস, আমি যদি তোমার ভাবি হয়েই যাই, তখন তোমার জান চটকে ছাড়বো বলে রাখলাম।’
* * * * * * * * * * * * * *
সন্ধ্যায় শরমিন কুমুর সাথে চায়ের টেবিলে এসে বসে। ওর হাতে একটা বড় শপিং ব্যাগ। নাসরিন বেগম বললেন, ‘এসো মা, কি খাবে বলো? ঝাল, না মিষ্টি? তোমরা তো আজকাল ফ্যাটি হয়ে যাওয়ার ভয়ে ডায়েটিং করো।’
‘না আম্মা, আমি ডায়েটিং করি না। যা ইচ্ছে, তাই খাই। কোন রকম নাক উচু করি না খাওয়ার ব্যাপারে।’
নাসরিন বেগম একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘তুমি আমাকে আম্মা বললে?’
শরমিন গলা নমিয়ে ধীরে ধীরে বলে, ‘আমার মা মারা গেঝেন তখন আমার দশ বছর বয়স। মায়ের আদর কখনও পাইনি। আপনাকে দেখে মনে হলো, আপনাকে আম্মা বলে ডাকা যায়। যায় না?’
নাসরিন বেগম চেয়ার ছেড়ে উঠে শরমিনের কাছে গিয়ে ওর মাথাটা জড়িয়ে ধরেন, ‘তুমি আমাকে আম্মা বলেই ডেকো।’
সাথে সাথে শরমিনের গলার স্বর বদলে যায়, ‘তা হলে, এ বাড়িতে আমার যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারি। তাই তো?’
কথাটা বলে ওর হাতের শপিং ব্যাগ থেকে এক একটা করে প্যাকেট বের করে এক এক জনের সামনে রাখতে রাখতে বলে, ‘আমার তরফ থেকে আম্মার জন্যে, আব্বার জন্যে, আর কুমুর জন্যে।’
নাসরিন বেগম বরে উঠলেন, ‘এগুলো কি?’
শরমিন বলে, ‘আব্বা, আম্মা আর ছোট বোনের জন্য আমি কিছু দিতে পারি না? আগে কখনও তো কাউকে কিছু দেইনি আমি।’
ওদের মুখে কথা হারিয়ে যায়। কুমু প্যাকেটটা আগে খুলে দেখে খুব চমৎকার একটা শাড়ি। নাসরিন বেগমের প্যাকেটেও শাড়ি আর সাজ্জাদ করিমের প্যাকেট থেকে বের হলো একটা পাঞ্জাবী।
সাদেক রসিকতা করে, ‘আরে রেজাল্ট ভালো করলাম আমি, আর আমিই বাদ?’
শরমিন একটা ছোট বাক্স সাদেকের দিকে এগিয়ে বলে, ‘এটা আপনার।’
সাদেক খুলে দেখে খুব দামী একটা ঘড়ি।
নাসরিন বললেন, ‘এটা ঠিক না। মোটেই ভাল হলো না।’
শরমিন বললো, ‘আম্মা। আমি বাড়ি থেকে সারা জীবনের জন্য চলে এসেছি। আপনাদের ছেলেকে সব বলেছি। এখন আমার যাওয়ার আর কোন যায়গা নেই। এ পৃথিবীতে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার শক্তি-সামর্থ-বুদ্ধি আমার আছে। কিন’ আমাকে সে যুদ্ধ একা লড়তে হবে। আমাদের সমাজ সেটা আমাকে কখনই করতে দেবে না। আর আমার বাবা সব সময় আমার পিছনে লেগে থাকবেন। কেবল পারবেন না যদি আমি কারো স্ত্রী হয়ে যেতে পারি।’
একটু থেমে শরমিন আবার মুখ খোলে, ‘আর এ জন্যই আপনার ছেলের সাথে পরিচয় হবার পর আর আপনাদের মেয়ের ফোনের কথা শুনে মনে হলো, যদি আমি আপনাদের সাথে থাকতে পারি, তা হলে হয়তো, নিজের মতো একটু শ্বাস নিয়ে বাঁচতে পারবো।’
সাদেকের দিকে ফিরে শরমিন বলে, ‘আমি কিন’ আপনাকে যখন ঐ কথাগুলো বলছিলাম, সিরিয়াসলি বলছিলাম। আপনার কাছে সেটা ফাজলামীর মতো মনে হয়েছিল। আমার পায়ের তলায় কোন মাটি নেই। বাবা আমার সাথে যেটা করেছেন, তারপর আমি তো কোনদিনই তার সামনে দাঁড়াতে চাই না, মৃত্যু পর্যন-ও না। মেয়েকে যে দাড়িপাল্লায় তোলে ব্যবসায়ের জন্য, সেখানে তো আর কোন সম্পর্কে থাকে না, থাকতে পারে না।’
সাদেক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা-মাকে সারা দিনের সব কথা খুলে বলে। তারপর বলে, ‘এখন তোমরা বলো এ মেয়েটা কোথায় যাবে।’
* * * * * * * * * * * * * *
সাদেক আর শরমিনের বিয়েটা পরদিন বেলা এগারোটার সময় ধানমন্ডি কাজি অফিসে অনুষ্ঠিত হলো। সাক্ষি হিসেবে শরমিনের পক্ষে ছিলেন শরমিনের খালু ব্যারিস্টার আমিন আহমেদ।
* * * * * * * * * * * * * *
বাসর ঘরে কুমু যখন শরমিনকে নিয়ে এলো শরমিন কুমুকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘বাড়ি থেকে মাথা গরম করে বের হয়ে, মুখে তো বড় বড় ফট ফট করছিলাম। কিন’ জানো, বের হওয়ার পর আমি কি করবো, কোথায় যাবো, ভাবতে ভাবতে আতঙ্কে আমি অসি’র হয়ে ছিলাম। ভাগ্যিস, তুমি তোমার ভাইকে রেজাল্টের খবর জানানোর সময় ভাবি আনার অনুরোধ করেছিলে। তখনই আমি তোমার ভাইয়ার ঘাড়ে চাপার সিদ্ধান- নিয়েছিলাম। না হলে যে আমার কি হতো, এখন মনে করতেই গা শিউরে উঠছে।’
* * * * * * * * * * * * * *
তার পরদিন আসলেই খবরের কাগজে শিরোনাম প্রকাশ হলো:
”মাল্টিমিলিওনিয়ারস ডটার ওয়েডস ট্যাক্সি ড্রাইভার।”