জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনে নিও ক্ষুধার লাগি
জুটে যায় যদি দুইটি পয়সা অর্ধেকে তার
ফুল কিনে নিও, হে অনুরাগী।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানব, ইসলামের প্রবর্তক হজরত মোহাম্মদ মোসত্মফা (দঃ) সম্পর্কে এমন কথা প্রচলিত আছে। বাংলা ভাষায় কথা বলেন এমন অনেকেরই এই কবিতাটি মুখসত্ম এবং তাঁরা সকলেই জানেন ও বিশ্বাস করেন যে মহানবীর (দঃ) পক্ষে এমন কথা বলা মোটেই অসম্ভব নয়। এই কবিতাটির বরাত দিয়ে বলা হয় যে, নবী করিম (দঃ) সৌন্দর্যের পুজারী ছিলেন বলেই ক্ষুধার জন্য খাদ্য কেনার পরই সৌন্দর্যের প্রতীক ফুলকে গুরম্নত্ব দিয়েছেন। আর সে জন্যই তিনি তাঁর অনুসারীদের খাবারের পর ফুল কিনতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ফুল যে কেবল সৌন্দর্যের প্রতীক তাই নয়, ফুল পবিত্রতারও প্রতীক। পবিত্রতার জ্বলনত্ম উদাহরণ মহানবী (দঃ) এমন একটা পবিত্র জিনিষের প্রতি তাঁর অনুসারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাবেন তা’ বলাই বাহুল্য। কিন্তু তার পরেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানব নবী করিম (দঃ) যে যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, আরবের সে যুগকে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হতো। সে যুগে নারীর কোন মর্যাদা ছিল না, চুক্তিবদ্ধতা, ন্যায়-পরায়ণতা, বিশ্বসত্মতা প্রভৃতি গুণাবলীর কিছুই ছিল না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় আরবরা মূলতঃ সেমিতি বংশদ্ভুত, মরম্নভূমির অধিবাসী। সেখানকার জীবনযাত্রা অত্যনত্ম কঠোর, ‘প্রিমিটিভ’ সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা। কেবল এক আঁজলা পানির জন্য তাদের মাইলের পর মাইল অতিক্রম করতে হতো সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এক মরম্নদ্যান থেকে অন্য মরম্নদ্যানে। তৃষ্ণা আর প্রাত্যহিক কর্ম সম্পাদনের পানি, পানির উৎসে গজিয়ে ওঠা খেজুর গাছের ফল, তরমুজ, শশা জাতীয় কিছু সবজী ও ফল আর পোষ-মানানো কিছু উট, ঘোড়া, ছাগল, ভেড়া আর `y¤^vi দুধ ও মাংস ছিল তাদের একমাত্র খাদ্য। তারা মূলত ছিলেন ¯^ívnvix ও পরিশ্রমী। বিলাসী দ্রব্যের চেহারা কেবল আসেপাশের দেশ মিসর, ইরান, তুরস্ক, রোম আর গ্রীস থেকে আসা পর্যটক আর ব্যবসায়ীদের।
পঞ্চম শতকে আরবদের সভ্যতা আর সংস্কৃতি তৎকালীন রোম, গ্রীস, মিসর wK¤^v ইরানের মতো ছিল না। সে যুগের আরবরা অনত্মতপক্ষে পঞ্চম শতকের ইংল্যান্ড বা ইউরোপের অধিবাসীদের মত বর্বর ছিল না। তারা Avo¤^i-ˆefe, বিলাস-ব্যসনে ছিল অনভ্যসত্ম। নৈতিক অবক্ষয় থাকলেও কোন কোন সমপ্রদায় বা গোষ্ঠিতে মূল্যবোধের চর্চ্চা আর ন্যায়নিষ্ঠতা ছিল। আর ছিল বলেই আবদুলস্নাহ-র পরিবারে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মানব নবী করিম (দঃ)-এর জন্ম সম্ভব হয়েছিল।
বিজ্ঞানের ভাষায় ‘কেবল ভাল বীজেই, ভাল ফল সম্ভব’। ‘গোবরে পদ্মফুল’ কথাটা বাংলা ভাষায় প্রচলিত থাকলেও, এ শব্দের ভেতরেও বিজ্ঞানের এই কথাটিই প্রমাণ করে, পদ্মের বীজ থেকেই পদ্ম সৃষ্টি, গোবর এখানে পরিবেশ। আর তাই কলুষ পরিবেশে জন্মগ্রহণ করলেও পবিত্র পিতা-মাতার সনত্মান পবিত্রতম হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হজরত মোহাম্মদ (দঃ)।
হজরত মোহাম্মদের (দঃ) জীবনের দিকে একনজর তাকালে আমরা দেখি শৈশবে পিতৃমাতৃহীন এই বালক পিতৃব্যের আশ্রয়ে কৈশোরকাল কাটিয়ে প্রাক-যৌবনেই জীবিকার সন্ধানে প্রথমে পিতৃব্যের সাথে ও পরে সম্পদশালী খাদিজা বেগমের ব্যবসায় তদারকি করছেন। পরবর্তীতে বিবি খাদিজার সাথে তাঁর বিবাহ হলে তাঁর আহার-বাসস্থানের জন্য চিনত্মা করতে হয়নি বটে, কিন্তু তাঁর চালচলনে কোন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়নি। অবশ্য এর কিছুকাল পরই তিনি আলস্নাহ্-এর ওহি লাভ করতে থাকেন।
সম্পূর্ণ কপর্দকশুন্য অবস্থায় জীবন আরম্ভ করে সারাটা জীবন তিনি কখনও বিলাস, বৈভব wK¤^v Avo¤^ic~Y© জীবনযাপন করেননি। এমন কি তিনি সঙ্গীত-বাদ্যতে মনোনিবেশ করতেও উৎসাহী ছিলেন না। তাঁর নেতৃত্বে আরবে নাতিবৃহৎ ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু হয়। তিনি এই রাষ্ট্রের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও কথাবার্তা ও চালচলন তিনি ছিলেন অত্যনত্ম বিনয়ী, সংযমী ও সাত্মিক। হালকা মেজাজে অপ্রয়োজনীয় ও অকারণ রসিকতাপূর্ণ কথাবার্তা বলাও তাঁর ¯^fve ছিল না। এমন যে সাদামাঠা জীবনের অধিকারী মহাপুরম্নষ, যিনি দেহ ও মনের মৌলিক চাহিদা পূরণে ছিলেন অত্যনত্ম সতর্ক সংযমী, তিনি কিভাবে এবং কেন তাঁর অনুসারীদের ফুলের মতো অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহে উৎসাহিত করবেন, সেটা গভীরভাবে ভাবা প্রয়োজন।
সে যুগের সামাজিক চিত্র যতটুকু পাওয়া যায় তাতে, বেদুইন আরব পরিবারকে সারা দিনমান সনত্মান প্রতিপালন, পর্যাপ্ত পানির নিশ্চয়তা বিধান, †Nvov-QvMj-†fov-`y¤^v আর উটের পরিচর্যা আর ন্যূনতম খাদ্য সংগ্রহে যেখানে ব্যতিব্যসত্ম থাকতে হতো, সেখানে দু’দন্ড মানসিক তৃপ্তি আর বিনোদনের জন্য ফুল ফোটানোর মত কঠিনতর কাজ কি’ভাবে সে যুগে এসেত্মমাল করা হতো, wK¤^v আদৌ করা হতো কি না, সেটাই প্রশ্ন। অবশ্য এটা ঠিক যে, মরম্নভভূমির এখানে সেখানে, মরম্নদ্যানের পানির উৎসের পাশে, কিছু যে ফুল ফুটতো না তা’ নয়। জৈববৈজ্ঞানিক গবেষণায় বলা হয়, মরম্নভূমিতেও ফল-ফসলের সাথে ফুল জড়িত আর অনেক লতা-গুল্মেও ফুল ফুটতো।
যতদুর জানা যায় এর মধ্যে দুই-একটি ফুল সুগন্ধময় ও মাদকতাসম্পন্ন ছিল। বাংলাদেশের মহুয়া ফুল ও ফলের মতো কিছু কিছু ফুল দুধের সাথে পিষে অর্বাচীনেরা খেত এবং মাদকতায় মত্ত হতো। কোরআন শরীফে আঙ্গুর ও খেজুর থেকে নেশাজাতীয় খাদ্য ও পানীয় তৈরীর কথা আছে :
. . . আর খেজুর ও আঙ্গুর ফলের মধ্যেও শিক্ষাপ্রদ বিষয় আছে, এগুলি হ’তে তোমরা মাদক দ্রব্য ও উত্তম খাদ্য প্রস্তুত কর . . (১৬/৬৭)
যাদের এ সামর্থ ও সম্পদটুকু ছিল, এদের সংখ্যা তো ছিল অতি-অতি নগন্য। তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া যেতে পারে, তারা না হয় ফুলের কিঞ্চিৎ চাষ-আবাদ করতেন, যদিও এ বিষয়ে সন্দেহ আছে। যে দেশে প্রত্নতাত্মিক বা ঐতিহাসিক নিদর্শন বলতে কেবল একটিই – কা’বা ঘর, সেখানে সংস্কৃতির চর্চ্চার নিদর্শন বলতে যে ফুল অন্যতম একটি মাধ্যম হিসাবে গণ্য হবে, তা’ মেনে নিতে কিছুতেই মন টানে না। অন্যদিকে আম-জনতার উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক ক্ষূদ্র ও মাঝারী মাপের ব্যবসায়ী, যেমন নবী করিম (দঃ)-এর চাচা, তার প্রথমা স্ত্রী, ¯^í-msL¨K সম্পদশালীদের উট-চালক, হুঁকো-বরদার, তাবুঁরক্ষক, QvMj-`y¤^v-†glcvjK প্রভৃতি কিছু কর্মচারী (যারা ক্রীতদাস নয়, তবে তার চেয়ে কিছু উন্নত শ্রেণীরও নয়) আর অধিকাংশই ক্রীতদাস সমপ্র্রদায়ের। এরা কিভাবে ফুল ফোটানোর চর্চ্চা করবে?
ইতিহাসে আছে সে যুগে সাহিত্যের চর্চ্চা হতো এবং বেশ কিছু জাঁদরেল কবির নাম ও রচনা আরবের এ যুগেও স্মরণ করা হয়। আমাদের দেশে চর্যাপদ আর বড়ূ চন্ডিদাসের কাব্যও তো বেশ প্রাচীন। কিন্তু সংস্কৃতির চর্চ্চা বলতে আর কোন কিছুই তেমন শোনা যায় না। সে যুগে লেখনীর চর্চা বলতে এক রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে অন্য রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে পাঠানো ইসলামের দাওয়াতপত্র ছাড়া কেবল কোরআনের নকল তৈরী করা বাদে আর তেমন কোন কিছু সম্পর্কে জানা যায় না। পরবর্তীতে কোর-আনের ক্যালিগ্রাফী, ইমারতের তোরণ, কার্নিশ, মসজিদ, মিনার, wg¤^vi আর M¤^y‡Ri ইসলামী ফ্লোরাল অলঙ্করণ প্রভৃতি বিশ্বব্যাপি আলোচিত, অথচ তা’ কিন্তু বিশ্ব নবীর পরবর্তী যুগের। এবং এ বিষয়েও দু’টি স্পষ্ট স্রোতধারা লক্ষ্য করা যায়।
বৌদ্ধধর্মের মহাযান ও হীনযান কিংবা খৃষ্টান সমপ্রদায়ের ক্যাথলিক আর প্রটেস্টেন্টদের মতো ইসলামের এক শ্রেণীর প্রবক্তাদের ভাষ্য ছিল নবী করিম (দঃ) ঠিক যেভাবে জীবন-যাপন করেছেন, সঙ্গীত-চিত্রকলা-বৈভববিহীন কট্টর কোর-আন ও সুন্নাহ-র পথ – রেল লাইনের মতো সোজা পথে ‘সিরাতুল মুসত্মাকিম’ জীবন-যাপন করতে হবে।
অন্য শ্রেণীর অভিমত হলো, নবী করিম (দঃ) যখন কবিতা লিখতে সরাসরি বারণ করেননি, সাহিত্য রচনা নিষেধ করেননি, বিশ্বের শ্রেষ্ঠগ্রন্থ কোর-আন যখন সবচেয়ে সুন্দরতম সাহিত্যকর্ম, অপূর্ব সুললিত কাব্যগ্রন্থ, কেবল কঠিন-কঠোর গদ্য নির্দেশনা নয়, তখন অপটু হাতে নবী বন্দনা, গুরম্ন (পীর বা মুর্শিদ) বন্দনা বা দেশ বন্দনা বা অন্য কিছু লিখতে দোষের কিছু নাই।
মুজতবা আলীর এক প্রবন্ধে পড়েছিলাম, প্রাক মুসলিম যুগের এক কবিতায় নাকি ঊষর মরম্নর এক প্রেমিক প্রেমিকাকে না পেয়ে বলছে,
“এই জলবিহীন রম্নক্ষ ভূমিতে যখন তোমাকে পেলাম না, প্রার্থনা করি তোমার সাথে পর জনমে এমন দেশে যেন দেখা হয়, যেখানে তোমার বিহনে অনত্মত ডুবে আত্মহত্যা করার মতো অঢেল পানি থাকে।”
কিন্তু এ সব রচনাও নবী করিম (দঃ)-এর জীবদ্দশায় যতটা না প্রসার লাভ করেছিল তার চেয়ে তাঁর তিরোধানের এবং বিশেষ করে মিসর ও পারস্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসার পর এবং তারও পরে মধ্য-এশিয়ায় তাশখন্দ, সমরখন্দ, বোখারা প্রভৃতি অঞ্চলে পত্রে-পুস্পে-পলস্নবে-মঞ্জরীতে চারদিক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
তাহলে যে কবিতা দিয়ে আলোচনা আরম্ভ করেছিলাম, সেই দুই পয়সার অর্ধেক দিয়ে ফুল কেনার বিষয়টার কোন ফয়সলা না হলেও একটি বিষয় স্পষ্ট হলো যে, বস্তু হিসাবে ফুলের তেমন কোন ব্যবহার সে যুগে ছিল না, থাকার কথাও নয়। অনত্মতঃ “ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী” বলার মতো প্রাকৃতিক, সামাজিক কিংবা মনোদৈহিক অবস্থা সে যুগে ছিল না। মনোদৈহিক কথাটা ব্যবহার করলাম এই জন্য যে, ইসলাম আসার আগে আরবে নারীর অবস্থা যাই থাকুক না কেন, প্রিয়াকে ফুল কিনে তার মন পাওয়ার চেষ্টা সে যুগের পুরম্নষরা, এমন কি নূতন যুবকরাও করতেন না।
তা’হলে কি আমরা ধরে নেবো যে কবিতাটা দিয়ে এ আলোচনা সুরম্ন তার বাসত্মবগ্রাহ্যতা নেই? তাই বা কি করে হবে! ইসলাম আসার পরে ইসলাম বিরোধী যত প্রচারণাই হোক না কেন নবী করিম (দঃ) সম্পর্কে কোন যুক্তিগ্রাহ্য মিথ্যাচার কেউ প্রচার করেননি, করতে পারননি। তা হলে এ কবিতার হাল কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো?
তাহলে এই বিষয়টা অর্থাৎ ফুল জিনিষটি বস্তুগতভাবে বিবেচনা করে ভাববাদী বিষয় হিসাবে বিস্লেষণ করলে কি আমরা কোন সমাধান পাবো? আর তখন চিত্রটি কেমন হবে?
আগেই বলা হয়েছে রম্নক্ষ, শুষ্ক, কঠোর মরম্নজীবন যাপনে অভ্যসত্ম বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত আরবের মানুষগুলোকে ইসলামের ডাক দিয়ে নবী করিম (দঃ) এক পতাকাতলে সমবেত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে একটি পবিত্র, শৃংখলাপূর্ণ জীবনযাপন পালনে অভ্যসত্ম করতে কোরআন-এর গূঢ় সূত্রগুলি যতটা সম্ভব সহজ করে তাঁর অনুসারীদের ব্যাখ্যা করে দিতেন।
এতকাল যে মানুষদের কাছে জীবন মানে ছিল weev`-wem¤^v`, সংগ্রাম, অন্যের কাছ থেকে খাদ্য-বস্ত্র-পশু-নারী কেড়ে নিয়ে নিজে বাঁচা, অন্যের কষ্টে নির্বিকার থাকা, হত্যা করে, তা সে নিজের সনত্মানই হোক, নিজের পথ নিষ্কন্টক করা। তাদেরকে নবী করিম (দঃ) শেখালেন অন্যের প্রতি মমত্ববোধ দেখানো, শত্রুকে ক্ষমা করা, একত্র হয়ে পরস্পরকে সহযোগিতা করা, দরিদ্রকে মুক্তহসেত্ম দান করা, পরোপকার করা, পিতৃমাতৃহীনদের প্রতি দয়ার্দ হওয়া প্রভৃতি কোমল গুণাবলীর চর্চা।
সমাজকল্যাণের ‘কনসেপ্ট’ (ধারণা) এ যুগেই প্রথম উদ্ভাবিত ও উদ্ভাসিত হয়। কঠোর রম্নক্ষ আরবজাতিকে এক অভাবনীয় শৃংখলাপূর্ণ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতিতে রূপানত্মরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। সে জাতি পরবর্তী যুগে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশী অঞ্চল জুড়ে শানিত্ম ধর্মের প্রসার ও বিকাশ ঘটালো। যার ফলশ্রুতিতে, বিভিন্ন জাতি তাদের নিজেদের জীবনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে পেরেছিল, কেবল তাই নয়, বিশ্বের সকল দেশে, সকল জাতিতে এই ধর্মের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই জাতির প্রভাবে পঞ্চ ম-কারে আকর্ষণে ডুবে থাকা ইরানী, তুর্কী, হিংস্র আফগান ও মোঙ্গল জাতির শাসকবর্গ অদ্ভুত সৃষ্টিশীল, সংবেদনাশীল শাসকে পরিণত হয়েছে। তারা কেবল রাজ্য জয় করেনি, বিজিত রাজ্যে শানিত্ম-শৃংখলা, আইনের অনুশাসন প্রবর্তন, জনহিতকর কাজ সম্পাদন এবং সবচেয়ে বড় যে কাজটি সে সব অঞ্চলের সকল কুসংস্কার দূর করতে তারা ছিলেন বদ্ধ পরিকর।
ভারতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো মুহম্মদ বিন কাশিম রাজা দাহিরের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন ঐ অঞ্চলে রাজার অত্যাচারে অতীষ্ট প্রজাদের হাহাকার থেকে রক্ষা করতে। পরবর্তীতে ভারতে বহু মুসলিম বীর যোদ্ধা ঠিক একই কাজ করেছিলেন। বাদশাহ আকবরের সময় থেকে মোগল রাজবংশে অমুসলিম নারীদের স্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হতো তাদেরকে ভোগের সামগ্রী হিসাবে নয়, এই বৃহৎ ভারতে ধর্মে ধর্মে সম্পৃতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং এই সকল অমুসলিম মায়ের সনত্মানেরা পরবর্তীতে সিংহাসনে আরোহন করে। এর আগেই দিলস্নীর সিংহাসনে বেশ কয়েক জন বাদশাহ ছিলেন ক্রীতদাস।
কোর-আনে আলস্নাহ বলেছেন, অপরিমিত সচ্ছল জীবিকা ভূপৃষ্ঠে অশানিত্মর সৃষ্টি করে . . ৪২/২৭
এ থেকেই মনে হয় বাংলায় প্রচলিত কথাটি “অর্থই অনর্থের মূল” প্রত্যেকের জন্য পালনীয়। অর্থাৎ অতিরিক্ত অর্থ অর্জন সঠিক নয়। কিন্তু প্রাচীন যুগে ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং এখনকার যুগে অনেক ধরণের কর্মকান্ডেই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশী অর্থ আয় করা যায় সহজেই। কোরানে যখন বলা হয়েছে অতিরিক্ত অর্থ অশানিত্ম সৃষ্টি করে, তাহলে তা দিয়ে আমরা কি করবো?
এক হাদিসে আছে, আমার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকলে, আমার খাদ্য গ্রহণ (তাকে সেই খাবার থেকে ভাগ না দেয়া পর্যনত্ম) জায়েজ হবে না।
কোর-আন শরীফে এ নিয়ে আর কি বলা হয়েছে দেখা যাক।
১। আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে AvZ¥xq-¯^Rb, এতিম-মিসকিন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। (২/১৭৭)
২। তোমার কাছে জিজ্ঞাসা করে, কি তারা ব্যয় করবে? বলে দাও- যে বস্তুই তোমরা ব্যয় করো, তা হবে পিতা-মাতার জন্য, AvZ¥xq-¯^R‡bi জন্য, এতীম-অনাথের জন্য, অসহায়দের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। (২/২১৫)
৩। হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রম্নজি দিয়েছি, সে দিন আসার পূর্বে, তা থেকে ব্যয় করো, যাতে না আছে বেচা-কেনা, না আছে সুপারিশ কিংবা বন্ধুত্ব। (২/২৫৪)
৪। যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি খয়রাত কর গোপনে এবং অভাবগ্রসত্মদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরও উত্তম। (২/২৭১-২৭৪)
৫। যাকাত হল কেবল ফকির, মিসকিন, যাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্য, ঋণগ্রসত্মদের জন্য, আলস্নাহর পথে জেহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য – এই হল আলস্নাহর নির্ধারিত বিধান। আলস্নাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (৯/৬০)
৬। সে সমসত্ম লোক যারা ভৎর্সনা-বিদ্রুপ করে সে সব মুসলমানদের প্রতি যারা মন খুলে দান-খয়রাত করে এবং তাদের প্রতি যাদের কিছুই নেই শুধুমাত্র নিজের পরিশ্রমলব্ধ বস্তু ছাড়া। অতঃপর তাদের প্রতি ঠাট্টা করে। আলস্নাহ তাদের প্রতি ঠাট্টা করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব। (৯/৭৯)
৭। . . . . এবং আমার দেয়া রিজিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করম্নক ঐদিন আসার আগে, যে দিন কোন বেচা-কেনা নেই এবং বন্ধুত্বও নেই। (১৪/৩১)
৮। . . তোমাদের মধ্যে যারা উচ্চমর্যাদা ও আর্থিক প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন কসম না খায় যে, তারা আত্মীয়-স্বজনকে, অভাবগ্রস্থকে এবং আল্লাহর পথে হিজরতকারীদেরকে কিছুই দেবে না। . . . । (২৪/২২)
৯। . . আত্মীয়-স্বজনকে তাদের প্রাপ্য দিন এবং মিসকিন ও মুসাফিরদেরকেও। এটা তাদের জন্য উত্তম, যারা আলস্নাহর সন্তুষ্টি কামনা করে। তারাই সফলকাম। (৩০/৩৮)
১০। . যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহর তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তা থেকে ব্যয় কর। তখন কাফেররা মুমিনদের বলে, ইচ্ছা করলেই আলস্নাহ যাকে খাওয়াতে পারেন, আমরা কেন তাকে খাওয়াব? . . . . ; (৩৬/৪৭)
১১। . শোন, তোমরাই তো তারা, যাদেরকে আলস্নাহর পথে ব্যয় করার আহ্বান জানানো হচ্ছে, অতঃপর তোমাদের কেউ কেউ কৃপণতা করছে। যারা কৃপণতা করছে, তারা নিজেদের প্রতিই কৃপণতা করছে। আলস্নাহ অভাবমুক্ত এবং তোমরা অভাবগ্রসত্ম। যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এরপর তারা তোমাদের মত হবে না। (৪৭/৩৮)
১২। . এবং তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক ছিল। (৫১/১৯)
১৩। . আপনি কি তাকে দেখেছেন, যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, এবং দেয় সামান্যই আর পাষাণ হয়ে যায়? (৫৩/৩৩-৩৪)
১৪। . তোমাদেরকে আলস্নাহর পথে ব্যয় করতে কিসে বাধা দেয়, যখন আলস্নাহই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অধিপতি?. . . (৫৭/১০)
১৫। . আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় কর। . (৬৩/১০)
১৬। . এবং তোমরা ধন-সম্পদকে প্রাণভরে ভালবাস; (৮৯/২০)
১৭। . অতএব যে দান করে এবং খোদাভীরম্ন হয়, এবং উত্তম বিষয়কে সত্য মনে করে, আমি তাকে সুখের বিষয়ের জন্য সহজ পথ দান করব। (৯২/৫-৭)
১৮। . যে অর্থ সঞ্চিত করে ও গণনা করে; সে মনে করে যে, তার অর্থ চিরকাল তার সাথে থাকবে; কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে পিষ্টকারীর মধ্যে। (১০৭/২)
এখানে কোরআনের মাত্র আঠারোটি আয়াত উদ্ধৃত করা হলো। এগুলির মধ্যে অতিরিক্ত অর্থ যাদের জন্য ব্যয় করার কথা আলস্নাহ নির্দেশ দিয়েছেন তারা হলেন- আত্মীয়-স্বজন, এতিম-মিসকিন, ফকির, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাস, পিতা-মাতা, অসহায়, প্রার্থী ও বঞ্চিত, যাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের এবং ঋণগ্রসত্ম, আলস্নাহর পথে জেহাদকারী অতিরিক্ত অর্থ দান করা নিয়ে আলস্নাহ আরও অনেক স্থানে মোমেনদের নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় স্ত্রী-পুত্র-কন্যার ভবিষ্যতের জন্য কিংবা দুঃসময়ের জন্য সঞ্চয় করতে আলস্নাহ কোনআনের কোন স্থানে কোন নির্দেশ দেননি, বরং যে কোন দুঃখ, কষ্ট, দুর্বিপাকের সময় তিনি কেবল তাঁর উপরই ভরসা করার জন্য বলেছেন। আর প্রকারনেত্ম একজনের কষ্টে অন্য মুসলমানের এগিয়ে আসার কথা বলে এই সমস্যার সমাধানের কথাই তো আলস্নাহ বলেছেন। একজনের দুঃসময়ে একজন মোমেনই তো পাশে দাঁড়াবেন। আর এটাই তো মানবধর্ম এটাই ইসলামের প্রধানতম শিক্ষা। ফলে দুঃসময়ে বা বিপদের সময় কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
সুরা নিসার ১২ ও ১৩ সংখ্যক আয়াতে কোন ব্যক্তির সম্পদ কিভাবে বণ্টন করা যাবে বা করতে হবে তার নির্দেশনা দেয়া আছে। কেবলমাত্র এই দুটি আয়াতের মাধ্যমেই অতিরিক্ত সম্পদ বিলিবণ্টনের যে হিসাব আলস্নাহ্ দিয়েছেন, তা কিন্তু সম্পদশালী ব্যক্তির মৃত্যুর পর বণ্টনযোগ্য, আগে নয়। আলস্নাহ্ বলছেন-
আলস্নাহ্ নির্দেশ দিচ্ছেন তোমাদের সনত্মানসনত্মতি সম্পর্কে: এক ছেলে পাবে দুই মেয়ের অংশের সমান; যদি দুই মেয়ের বেশি থাকে, তবে তারা পাবে যা সে (মৃত ব্যক্তি) রেখে গিয়েছে তার দুই-তৃতীয়াংশ, আর যদি এক মেয়ে থাকে, তবে সে পাবে অর্ধেক। আর তার পিতা-মাতা- তার যদি সনত্মান থাকে, তবে পিতা-মাতা প্রত্যেকে পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ, কিন্তু যদি তার সনত্মান না থাকে, শুধু পিতা-মাতা তার উত্তরাধিকারী হয়, তবে তার মা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ; কিন্তু যদি তার ভাইরা থাকে, তবে মা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ, মৃত ব্যক্তির ওসিয়্যতের দাবি অথবা ঋণ পরেশোধের পর; আর তোমরা জান না তোমাদের পিতা-মাতা আর তোমাদের সনত্মানরা, এদের কে তোমাদের উপকারের দিক দিয়ে বেশি আপন। এ আলস্নাহ্-র তরফ থেকে বিধান; নিঃসন্দেহে আলস্নাহ্ জানেন- জ্ঞানী। (৪/১১)
তোমাদের স্ত্রীরা যা রেখে যায়, তার অর্ধেক তোমরা পাবে, যদি তাদের সনত্মান না থাকে, কিন্তু যদি তাদের একটি সনত্মান থাকে, তবে তোমরা পাবে তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ, তাদের ওসিয়্যতের দাবি অথবা ঋণ পরিশোধের পর; আর তারা পাবে তোমরা যা রেখে যাও তার চার ভাগের এক ভাগ, যদি তোমাদের সনত্মান না থাকে, কিন্তু যদি একটি সনত্মান থাকে, তবে যা রেখে যাও, তার আট ভাগের এক ভাগ তারা পাবে, তোমাদের ওসিয়্যতের দাবী অথবা ঋণ পরিশোধের পরে; আর যদি কোন পুরম্নষ অথবা স্ত্রীলোক সম্পক্তি রেখে যায়, যার উত্তরাধিকার গ্রহণ করবার জন্য পিতা-মাতা অথবা সনত্মান নেই, আর তার (পুরম্নষের বা স্ত্রীর) আছে এক ভাই অথবা এক বোন, তবে তাদের প্রত্যেকে পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ, কিন্তু যদি তারা সংখ্যায় বেশি হয়, তবে তিন ভাগের এক ভাগের অংশী তারা হবে, ওসিয়্যতের দাবি ও ঋণ পরিশোধের পর- অবশ্য সেই ঋণ যেন (উত্তরাধিকারদের) ক্ষতি না করে; এ হচ্ছে আলস্নাহ্-র তরফ থেকে বিধান; আল্বলাহ জানেন- ক্ষমাশীল। (৪/১২)
এই আয়াত দু’টি থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে কোন ব্যক্তি তার জীবদ্দসায় তার সনত্মানদের বা স্ত্রী (স্ত্রীদের) কোন সম্পত্তি দিয়ে যেতে পারবেন না; সম্পত্তি কেবল মৃত্যুর পর বিলিবণ্টন হবে, যেভাবে আলস্নাহ্ নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
হজরত মুহম্মদের (দঃ) সময়কার একটি গল্প প্রচলিত আছে। সঠিক সূত্র আমি উলেস্নখ করতে পারবো না, তবে ঘটনাটি সত্যি বলেই মনে হয়েছে এর বিষয়বস্তুর কারণে।
হজরত মুহম্মদের (দঃ) সাহাবীরা তাদের দৈনন্দিন পারিবারিক চাহিদা পূরণের জন্য প্রতিদিন ততটুকুই পরিশ্রম করতেন, যতটুকু ঐ দিন তার পরিবারে ও সংসার প্রতিপালনের জন্য প্রয়োজন হতো, তার অতিরিক্ত নয়। সে সময়ের এক সাহাবী সম্পর্কে বলা হয়েছে, জোহারের নামাজের পূর্বে তিনি তাঁর ঐ দিনের প্রয়োজন তিন দিরহাম আয় করে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন। এমন সময় একজন বিধর্মী তাকে ডেকে একটি ভারী দ্রব্য তার বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ করলেন। উক্ত সাহাবী তাকে উত্তর দিলেন, তিনি তার ঐ দিনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আয় করে ফেলেছেন, ঐ দিন তিনি আর কোন কাজ করবেন না। উক্ত বিধর্মী উক্ত ভারী দ্রব্যটি তার বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্য উক্ত সাহাবীকে অতিরিক্ত পারিশ্রমিকের প্রসত্মাব করলে সাহাবী হেসে উত্তর দিলেন, আপনার প্রয়োজনে আমি এ বস্তুটি আপনার বাড়িতে পৌঁছে দেবো, তবে কোন পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নয়, সওয়াব হাসিলের জন্য।
আর এ বিষয়টি যদি মোমেন মুসলমানরা যথাযথভাবে পালন করে তবে আজকাল যে সকল ঘটনা আমরা চারদিকে দেখতে পারছি (সম্পদ সংগ্রহের অসুস্থ ও মাতাল প্রতিযোগিতা এবং পুত্র/ কন্যা/ স্ত্রী প্রভৃতির জন্য বাড়ি/ গাড়ি/ সম্পদ-সম্পত্তির পাহাড় [পর্বত] গড়ে তোলা) এবং সম্পদ নিয়ে হানাহানি, খুন-জখম- তা থেকে আমরা পরিত্রাণ পাবো।
আলস্নাহ আমাদের সহায় হোন আর এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার মানসিকতা থেকে বিরত থাকতে সহায়তা করম্নন।