চারটি নেপালি কবিতা
অনুবাদঃ সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান
বিভৎস পরিবেশ
অস্মিতা ভাণ্ডারী
আমি কি মৃতদেহের কথা লিখবো?
কিংবা আতঙ্কের কথা
অথবা মানুষের মনের অবিশ্বাসের কথা?
কিংবা লিখবো কি ধূলা ও ধুঁয়ার সংমিশ্রণে
প্রবাহিত ধুমায়িত নিশ্বাসের কথা?
আমি কি গুলির শব্দের কথা লিখবো
অথবা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের আগুন ঝরানো
লোলুপ জিহ্বার কথা
কিংবা সেই বুলেটের কথা
হৃৎপিণ্ড ছিদ্র করে যেটা ছুটে যায় দিগন্তের দিকে?
অথবা থাময়ে দেয় মহামতি বুদ্ধের বানী?
কিংবা স্বয়ম্ভুর দৃষ্টিতে ফুটে ওঠা
চঞ্চলা স্রোতস্বিনীর কথা লিখবো
ইদানিং প্রায়শঃই পর্বত
উদ্গীরণ করে অগ্নি
পাহাড়গুলোর অভ্যন্তরে ফুঁসে ওঠে আগুন
আমি কি মৃতদেহের কথা লিখবো
কিংবা অবিনাশী জীবনীশক্তির কথা
লিখবো কি অন্তরঙ্গতার তৃষ্ণার কথা
কিংবা লিখবো কি আমি অশ্রু মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্যের কথা?
একটি প্রেমের কবিতা
বিভাস পোখরেল
এই সময়টা
পুরাতন ছবির এলবামের পাতাগুলো উল্টিয়ে দিচ্ছে
আমি তোমার কথা ভাবছি
ভালবাসায় ধরে থাকা তোমার হাতের গোলাপটি এখন শুকিয়ে গেছে
সেইসব সুন্দর চিঠিগুলো আর তোমার সেই সব মধুর পংঙ্কিমালা এখন বিস্মৃতি
জানি না কখন নিঃশব্দ রাত্রি মুছে ফেলেছে আমাদের সেই সোনালী সকাল
যখন অশেষ ভালবাসার শপথ নিয়েছিলাম আমরা।
এই সময়টা
আমার স্মৃতিতে সেই শেষ মিলনের মুহূর্তটার কথা ভাসছে
মনে পড়ে যখন ধুঙ্গেধারা নদীতে কাপড় পরিস্কার করছিলাম
সাবানের ফেনায় ঝরে পড়ছিল তোমার অশ্রুকণা
তুমি ছুটে গিয়েছিলে নদীর তীরের দিকে
তুমি, ঝুঁকে, প্রায় দুই ভাঁজ হয়ে ছুটছিলে;
আমার চোখে ভাসছিল তোমার কয়েকটি চুল ঝোপের কাঁটায় আঁটকে ছিল
আমরা একসাথে ছিলাম অনেকক্ষণ আর কাঁটার বাঁধন থেকে ছাড়াতে ব্যস- ছিলাম আমি
আমার শক্ত আঙুলগুলো কাঁটায় আঘাতে হয়েছিল রক্তাক্ত।
এই সময়টা
হয়তো, আমার মতো তুমিও হারিয়ে গেছ একই ধরনের বিস্মৃতিতে
হয়তো তুমিও সেই সময়টাকে অভিশাপ দিচ্ছো কিংবা, তুমি তোমার চোখদুটি বুঁজে
ভাবছো সেই সব গিরিখাত, পাহাড়, আশ্রম আর মন্দিরের কথা
যেখানে অশেষ ভালবাসার শপথ নিয়েছিলাম আমরা।
দেখ কোন কিছুই ভাগ্যকে অতিক্রম করতে পারে না
ক্ষমা করো, এই সময়
পুরাতন ছবির এলবামের পাতাগুলো উল্টিয়ে দিচ্ছে
আমি তোমার কথা ভাবছি
ভালবাসায় ধরে থাকা তোমার হাতের স্নিগ্ধ গোলাপটি
এখন শুকিয়ে গেছে।
সহিংসতার সংবাদ সম্পাদনা
ব্যাকুল পাঠক
যারা সংঘর্ষে নিহত হয়েছে এবং
যাদের জীবন বিসর্জিত হয়েছে
তাদের মৃত্যুর সংবাদ যখন ঘিরে ধরে তোমাকে,
আপনজনের শবদেহ চিতায় পুড়তে দেখা
যতটা বেদনার, তার চেয়ে কোন মতেই বেশী নয়।
এমন কি সেই সব মানুষের মৃত্যু
যারা ‘শত্রু’ কিংবা ‘সন্ত্রাসী’ নামধারী, তাদের ক্ষেত্রেও
কেবল যেভাবে যে দেখে থাকে
আর আমাকে তো সেই সংবাদ সম্পাদনা করতে হয়,
দেশের নিহত ‘সেরা’ বা ‘সর্ব শ্রেষ্ঠ সাহসী’দের সংবাদ।
আজ আবার খবরের শীর্ষ সংবাদের স্থান দখল করবে এমনই এক রক্তাক্ত সংবাদ
আর সেই সাথে নিকটাত্মীয়ের অশ্রু ভারাক্রান্ত আর একটি সংবাদ,
টেবিলের উপরে পড়ে আছে নিহতের প্রাণহীন দেহের মতো
আর ঠিক একই রকম আর একটি সংবাদ।
এমনই আর একটি খবর এই সাথে জুড়ে দিতে হবে।
আগামীকাল আমাকে ছাপতে হবে ক্ষতবিক্ষত
মৃতদেহের পড়ে থাকা ছবি আর ভয়ার্ত স্বজনের বিষ্ফারিত অভিব্যক্তি।
প্রস্তর যুগের এমন সব রক্তাক্ত সহিংসতা,
প্রাচীনকালের নিবুদ্ধিতা,
একের পর এক নৃশংসতার ঘটনা পৌনঃপুনিকভাবে।
এই সব যদি চিরতরে বন্ধ করতে চাই,
তবে আমাকে নীল পেন্সিল দিয়ে ঘটনার পরম্পরা কেটে দিতে হবে,
এই সব যদি চিরতরে বন্ধ করতে চাই,
তবে আমাকে নীল পেন্সিল রেখে দিয়ে লাল পেন্সিল দিয়ে কেটে দিতে ,
এই কলমটা দিয়ে
ঠিক এই কলমটা দিয়েই।
ইতিহাস
বিমল নিভা
আমি সেখানে ছিলাম
সব স্থানে
তোমার সাথে
যখন বনাঞ্চল পরিস্কার করে
বপন করেছিলে ফসলের বীজ
পাহাড়ের পাথর ভেঙে
করেছিলে তুলার চাষ
আবিস্কার করেছিলে লোহা
আর বানিয়েছিলে চাকা
আমি তখনও তোমার সাথে ছিলাম
যখন তোমার ত্বক ছিঁড়ে ফেলা হলো
হাড়গুলো মিশিয়ে দেয়া হলো মাটির সাথে
অক্ষিগোলক বের করে নেয়া হলো
আর তোমাকে যখন হত্যা করা হলো
তখনও তোমার সাথে ছিলাম
আর তখন
যখন তুমি প্রতিবাদ করেছিলে
সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে
আর এক সাথে মিলিত হয়ে
অবিচার মানতে বিরোধিতা করেছিলে।
সকল সময়
প্রতিটি মুহূর্তে
আমি তোমার সাথে ছিলাম
ও আমার দেবদূত!
আমি সাক্ষী ছিলাম
তোমার প্রতিটি মুহূর্তের,
বেদনার আর দুঃখের,
সংগ্রামের আর আত্মত্যাগের,
ক্লান্তির, অত্যাচারের আর অস্থিরতার।
আমি পরিস্কার ভাষায় বলতে চাই,
সমস্ত ভবিষ্যৎ কিন্তু কেবল তোমারই জন্য।