যশোর থেকে ঢাকা ১৯৪৬-১৯৫৩
ঊনিশ শ’ সাতচল্লিশ সালের ১৪ আগস্টে রাজনৈতিক নেতা আর ইংরেজ শাসকদের কলমের খোঁচায় সহশ্র বছরের অবিভক্ত ভারত, পাকিস-ান ও ভারত নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে দেখা দিলেও এই অসম বিভক্তির কারণে দুই দেশের কোটি কোটি মানুষ এমন এক ভয়াবহ জটিলতার মধ্যে পড়ে গেল, যার ওপর তাদের নিজেদের কারো কোন হাত ছিল না। সে সময়ের রাজনৈতিক নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতা, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, হিংসা আর ক্ষমতার লোভের কারণে লক্ষ কোটি নিরীহ জনগোষ্ঠি ১৫ আগস্ট ভোর হতে না হতেই শরণার্থীর খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য হলো আর নিশ্চিনে- পাশাপাশি বসবাসকারী দুটি ধর্মীয় সমপ্রদায় দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে হঠাৎ করে পরস্পর চিরশত্রুতে পরিণত হয়ে গেল। তারই ধারাবাহিকতা আজও দক্ষিণ এশিয়ায় একটা দগদগে বিষাক্ত ক্ষত, তিনটি দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠিকে বিষাক্ত করে চলেছে। যে ক্ষতের উপশম করতে এই তিনটি রাষ্ট্রের কোন রাষ্ট্রনায়কই সচেষ্ট হননি।
ইতিহাসের পাতায় দেখা যাবে, মুহম্মদ বিন কাশিমের সময় থেকে ঊনিশ শতক পর্যন- অবিভক্ত ভারতে বৌদ্ধ ও হিন্দুদের মধ্যে, হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে এবং হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে মধ্যে সামপ্রদায়িক দাঙ্গা যে দেখা দেয়নি তা নয়। ছোটখাট ধর্মীয় সংঘর্ষের অনেক ছোটখাট ঘটনার বিবরণ পাওয়া যাবে এ দীর্ঘ সময়ে। তা’ছাড়া প্রতিটি ধর্মের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য গোত্র ও গোষ্ঠির মধ্যে সংঘর্ষও কিন’ কম হয়নি। বরং আমার মনে হয়, আন-ঃধর্ম সংঘর্ষের চেয়ে গোত্রভ্যন-রের সংঘাতের সংখ্যা ও সে সবের উত্তাপে দগ্ধ নিরীহ মানবসন-ানের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়!
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ইংরেজ শাসক যখন হিন্দু আর মুসলমান সম্মিলিত শক্তির আগুনের আঁচ টের পেলো, তখন থেকেই ব্রিটিশ শাসকবর্গ নানা কূট কৌশল অবলম্বন করে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ অর্থাৎ বিভক্তির মাধ্যমে শাসন পদ্ধতির মাধ্যমে এ দেশটিকে শোষণ করতে সচেষ্ট থাকে। দুই বিশাল ধর্মের অসংখ্য অনুসারীদের একের সাথে অন্যের বিরোধ সৃষ্টিতে তারা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। যার ভয়াবহতায় চল্লিশ দশক থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় সামপ্রদায়িক সংঘর্ষ আরম্ভ হয়ে যায়।
সাতচল্লিশ সালে দেশবিভাগের কথা উচ্চারণের সাথে সাথে প্রাণের ভয়ে ভারতে অবসি’ত অসংখ্য মুসলমান যেমন মুসলমান অধ্যুষিত পাকিস-ানে চলে যেতে উন্মাদ হয়ে উঠলো, তেমনই একইভাবে পাকিস-ানের বিপুল সংখ্যক অমুসলিম নাগরিক ভারতে চলে যেতে মরিয়া হয়ে উঠলো।
দুই দেশের এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠিকে নির্বিঘ্নে স্ব স্ব পছন্দের দেশে চলে যাওয়া আর বসতি ও ব্যবসায়-বাণিজ্য স’াপনের সুবিধা করে দেওয়ার জন্যে উভয় দেশের সরকারই তাদের দুই দিকের সীমান- বেশ কিছুকাল অবারিত করে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। তিপ্পান্ন সালের দিকে পাকিস-ান ও ইণ্ডিয়ার মধ্যে পাসপোর্ট-ভিসা ব্যবস’া চালু হয়। পাসপোর্ট-ভিসা ব্যবস’া চালুর আগে পর্যন- দুই দেশের নাগরিক যে কয়বার আর সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস- পর্যন- সারাদিনের মধ্যে যখন খুশি সীমান- পার হয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করতে পারতো, নিয়ে যেতে পারতো তাদের অর্থ-সম্পদ। কোন বাধা ছিল না।
এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠির অভিবাসন ভারত ও পাকিস-ানের পশ্চিম সীমানে-র লাহোর-অমৃতসর আর পূর্ব সীমানে-র প্রায় চার দিক দিয়েই এই চলাচলটা বেশী ছিল। অবশ্য সে সময় নিরীহ ও বোকা কিসিমের মানুষ যাতায়াতের পথে নানা ধরনের প্রতারণা ও ছিনতাইয়ের শিকার যে হতো না তার বলার অপেক্ষা করে না। কেউ হারাতো তার সারা জীবনের সঞ্চয়- অর্থ, সোনা-দানা, এমন কি পরিবারের কিশোরী-যুবতীরা প্রতারণার খপ্পরে পড়ে একেবারে লাপাত্তা হয়ে যেত।
এই বিপুল জনগোষ্টির সুবিধার জন্যে তিপ্পান্ন সালে পাকিস-ানের সে সময়ের রাজধানী করাচি আর ইন্ডিয়ার রাজধানী নূতন দিল্লীতে হাই কমিশন অফিস স’াপনের পাশাপাশি ভারত পশ্চিম পাকিস-ানের লাহোর ও পূর্ব পাকিস-ানের ঢাকায় এবং পাকিস-ান ভারতের পশ্চিম সীমানে- অমৃতসর ও পূর্বে কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশন অফিস চালু করে। আগে যাতায়াতের কোন নির্দিষ্ট পথ না থাকলেও পাসপোর্ট-ভিসা ব্যবস’া চালুর পর যশোরের বেনাপোল, কুষ্টিয়ার গেদে, বগুড়ার হিলি, রাজশাহীর আমনুরা, দিনাজপুরের তেঁতুলিয়া-বাংলাবন্ধ, সিলেটের জাফলং এবং কুমিল্লা প্রভৃতি স’ানসহ আরও বেশ কিছু জায়গা নির্দিষ্ট করে সীমান- ফাঁড়ি বসিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পরীক্ষা ও পাসপোর্টে ছাপছোপ দেওয়া ও মালামাল পরীক্ষার ব্যবস’া রাখা হলো।
সে সময়ে দুই রকমের পাসপোর্ট ছিল। কেবল ভারত আর পাকিস-ানের মধ্যে যাতায়াতের জন্যে এক রকম, যা কম পয়সায় পাওয়া যেত আর আন-র্জাতিক পাসপোর্ট। ভিসা ছিল বেশ কয়েক রকমের- এ, বি, সি, ডি, ই, এফ আর কে শ্রেণীর। ডি অর্থাৎ ডিপ্লোমেটিক শ্রেণীর ভিসা। এই ভিসা নিয়ে দূতাবাস বা হাই কমিশন অফিসগুলির দূত শ্রেণীর নন, এমন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও দুই দেশের মধ্যে যাতায়াতের সুবিধা লাভ করতেন।
আমার আব্বা, ফরিদপুরের সদর উপজেলার ব্রাহ্মন্দি গ্রাম নিবাসী ফজলুর রহমান। তার বাবা, অর্থাৎ আমার দাদা মরহুম মওলানা আহমদ নূর আল-মক্কি ওরফে নূরুদ্দিন আহমদ ছিলেন মক্কার বাসিন্দা। আনুমানিক ১৮৫৬ সালের দিকে ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় ভারতীয় মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করার লক্ষ্যে নিজ দেশ ছেড়ে ভারতে আসেন। সিপাহী যুদ্ধে মুক্তিকামী জনগণের পরাজয় হলে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা হয়। তখন তিনি উত্তর ভারতের নানা স’ানে ও এক সময় নেপালে আত্মগোপন করে থাকেন। সবশেষে তিনি ফরিদপুরের প্রত্যন- এই ব্রাহ্মন্দী গ্রামে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি প্রায় মধ্যবয়সে গ্রামের এক সম্পদশালী ব্যক্তির কন্যাকে বিবাহ করেন। আমার আব্বা দাদার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন-ান। দাদার দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ে হয়। বাবার আট বছর বয়সে আমার দাদা প্রায় নব্বই বছর বয়সে ইনে-কাল করেন। তিনি জীবদ্দশায় তার জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারেননি।
ব্রিটিশ আমলে তো বটেই, এমন কি পাকিস-ানের শাসনামলে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম দিকেও ফরিদপুর শহর থেকে ঐ গ্রামে সহজভাবে যাওয়ার কোন উপায় ছিল না। কেবল বর্ষাকালে নৌকায় বিরাঠ একটি বিল পার হয়ে সেখানে পৌঁছানো যেত। অন্য সময় প্রায় কোমর-সমান কাদা ভেঙে আড়াই মাইল পথ পাড়ি দিতে হতো।
আব্বা প্রথমে গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। যদিও তার আগেই বাড়িতে মা, বড় বোন, বড় ভাই ও গ্রামের মসজিদের ইমামের কাছ থেকে আরবী ভাষা ও কোরআনের ওপর তাঁর বুনিয়াদী শিক্ষার ভিত রচিত হয়। আব্বা ব্রাহ্মন্দী স্কুল থেকে ক্লাস সিক্সে বৃত্তি লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে ডিগ্রি পর্যন- পড়াশুনায় তাঁর কোন অর্থ ব্যয় করতে হয়নি।
যশোরের সদর উপজেলার পুরাতন কশবা গ্রাম নিবাসী যশোর কালেক্টরেটের একজন কর্মচারী কাজী হাবিবুর রহমানের বড় মেয়ে সাজেদা রহমান বাড়ির সাংস্কুতিক আবহে বড় হয়ে ওঠেন। স্কুলে নইনে পড়ার সময় আব্বার সাথে মা’র বিয়ে হয় উনিশ শ’ সাঁইত্রিশ সালে। তখন আব্বা গণশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক, ডিপিআই-এর একান- সচিব হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগে আব্বার কার্যালয় ছিল কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এ।
আব্বা আর মা’র প্রথম সন-ান মেয়ে, সেলিমা খাতুনের জন্ম ৭ অক্টোবর ১৯৩৮, যশোরের পুরাতন কশবায়, তার নানাবাড়িতে; দ্বিতীয় সন-ান ছেলে, মাহবুবুর রহমান ফারুক, জন্ম ২ জুলাই ১৯৪২, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গের বনগ্রাম বা বনগাঁয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে মা তখন বনগাঁয়ে তার ছোট বোনের স্বশুরবাড়িতে ছিলেন; আর সর্ব কনিষ্ঠ স্ন-ান আবার পুত্র, আমি আসলে মাহমুদুর রহমান সিদ্দিক, জন্ম ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬, যদিও স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার ফর্ম পূরণের সময় আমার নাম বদলে সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান করা হয়েছিল। আমার জন্ম দেশ বিভাগের এক বৎসর বিশ দিন আগে। তাই বলা যেতে পারে আমি ব্রিটিশ যুগের মানুষ। আমার জন্ম যশোরের খড়কী গ্রামে মা’র নিজের কেনা জমিতে নিজের বাড়িতে।
অবশ্য বড় আপা সেলিমা খাতুন ও সর্বশেষ সন-ান আমার মাঝে আমাদের আরও একটি বোন ও দুটি ভাই জন্মের কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরাধাম ত্যাগ করে। সে সময়ে আধা ডজন সন-ান জন্ম দেওয়া এবং তার মধ্যে দুই-চারজনের মরে যাওয়া অত্যন- স্বাভাবিক ঘটনা ছিল।
দেশ বিভাগের সময় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে কে কোন দেশে যেতে ইচ্ছুক এমন একটা প্রশ্নের জবাবে অন্য অনেক মুসলমান সরকারী কর্মচর্তা-কর্মচারীর মতো আব্বাও পাকিস-ানে চলে যেতে মত প্রকাশ করেন।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে কলকাতা থেকে পাকিস-ান রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় ও বিপুল পরিমান অপ্রয়োজনীয় নথিপত্র, ব্যবহারযোগ্য আসবাবপত্র ও বিপুল পরিমান অযোগ্য আসবাবপত্র প্রভৃতি মালামাল বোঝাই কয়েকটি জাহাজের বিশাল বহর পূর্ব পাকিস-ানের উদ্দেশ্যে নদীপথে রওনা দেয়। এ বহরটি ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ ঘুরে সুন্দরবনের ধার ঘেঁষে পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা ও নারায়ণগঞ্জ পার হয়ে ঢাকার সদরঘাটে উপসি’ত হয় আগস্টের শেষ সপ্তাহে। এই বহরের আর একটি অংশ চট্টগ্রামে গিয়ে নোঙ্গর করে।
আমার জন্মের কিছুক্ষণ পর, সন-ান প্রসবের প্রাথমিক কষ্ট লাঘবের পরই আমার সাহিত্যিকা মা আমাকে নিয়ে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখে ফেলেছিলেন। কবিতাটির কথা আমার জানা ছিল না। ষাট বছর পর ক্িতাটা আমার বড় বোন মায়ের বেশ কিছু লেখা আমাকে দেন। ঐ লেখাগুলির ভেতর আমি এই কবিতাটা পাই। দীর্ঘ চৌষট্টি বছর পর প্রকাশ করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
“আমার দ্বিতীয় পুত্র শ্রীমান মাহমুদর রহমান সিদ্দিকের জন্ম উপলক্ষ্যে মায়ের আশীষবাণী
সুন্দর তব মুখখানি আজ হেরিছি সকাল বেলা
লিলায়িত কত ভঙ্গিতে তব খেলিছ কত খেলা।
হেরিছি যত, পুলক তত, উথলি উঠিছে হিয়া
হাতদু’টি নাড়ি পা দু’খানি তুলি খেলিছে সুন্দর তব কায়া।
ক্ষুধিত মানব রহিতে নারে হাহাকার চারি ভিতে
রক্ত নদী বহায়ে দিতাছে আপন ভাইয়ের চিতে।
তারি মাঝে (ওগো) সুন্দর শিশু মধুর সকাল বেলা
দেখা দিয়ে (ওগো) কি মায়া জড়ালে অপরূপ তব খেলা।
ভাষা নাই, তত হাসি নাই, নাহিকো কোনই জোর
একটু শুধু ক্রন্দনধ্বনি, একটু আঁখির লোর।
তাই দিয়ে তুমি এমন বাঁধা বাঁধিলে কেমন করে
ছিঁড়িতে আমি পারি না তাহা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জোরে।
(ওগো) শিশু সুন্দর শিশু শক্তি তোমার অপার
আমি তব মাতা ভাবি দান তুমি বিধাতার।
কি দিয়ে তোমা করিব আশীষ ওগো মোর ভাবীকাল
তোমার দ্বারা দ্বারা মুক্ত যেন হয় ভারতের ভাবী ভাল।
ইতি তোমার ‘মা’/ ৪ঠা সেপ্টেম্বর ১৯৪৬/ ১৯ই ভাদ্র ১৩৫৩/ যশোহর (খোড়কী)
আমি জানি না, আমার মা-র মতো অন্য কোন মহিলা আদৌ তার সন-ান ভুমিষ্ট হওয়ার অব্যবহিত পর সন-ানের উদ্দেশ্যে এমন কোন লেখা লিখেছেন কি না। খুব সাধারণভাবে সন-ানের উদ্দেশ্যে, তার কোন জন্মদিনে বা অকাল মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে হয়তো কিছু লেখা থাকলেও থাকতে পারে, আমার জানা নেই। কিন’ জন্মের কিছুক্ষণের মধ্যেই নবজাতককে নিয়ে লেখা হয়তো হয়নি আর কখনও।
দেশবিভাগের অব্যবহিত পূর্বে দেশের কি অবস’া ছিল তার কিছুটা আভাস হয়তো এ কবিতায় মধ্যে পাওয়া যাবে। বিশেষ করে পাঁচ ও ছয় নম্বর পংক্তিতে এ সময়ের ভয়াবহতার চিত্র ফুটে উঠেছে।
আমার জন্মের সময় মা-র পাশে নাকি আমার মেজ খালা উপসি’ত ছিলেন। মা-র ভাষ্যমতে, তিনি আমাকে দেখে নাকি মন-ব্য করেছিলেন, ‘বু-র ছেলেটা কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছে দেখ। চোখদুটো যেন গরুর চোখের মতো বড় বড়।’
১৯৪৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। তারিখটা এত স্পষ্টভাবে বলতে পারলাম তার কারণ হলো, মা’র কাছে অনেকবার শুনেছি, আমাদের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া কথা ছিল, কিন’ ঐ দিন সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ই জানা গেল পাকিস-ান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ‘কায়েদে আজম’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ মৃত্যুবরণ করেছেন। খবর প্রচারের সাথে সাথে দেশের সমস- যানবাহন, দোকান-পাট বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আমাদের যাত্রাও স’গিত হয়ে যায়।
১৯৪৮ সালে ঢাকায় আমি আমার বড় আপা সেলিমা খাতুন কাজলের কোলে,
পাশে আমার বড় ভাই, মাহবুবুর রহমান ফারুক
এতে আমাদের সংসারে এক ভয়াবহ ক্ষতি হয়ে যায়। কারণ ঐ রাতে আমাদের বাড়ির সমস- জিনিষপত্র চুরি হয়ে যায়। সকালে উঠে আব্বা-মা দেখতে পেলেন যে, তাদের পরণের পোষাক ছাড়া ঘরের আর কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই।
খড়কী গ্রামেই আমার মেজ খালার শ্বশুরবাড়ি। আধা ফার্লং দূরে। আমাদের রওনা করে দেওয়ার জন্যে সকালে খালু কাজী শামসুল আলম সাহেব ও খালা আমাদের বাসায় এসে দেখেন আব্বা-মা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। সকালে যে কিছু খাবার কিনে তাদের তিন সন-ানকে খেতে দেবেন সেটুকু টাকাও অবশিষ্ট নেই। মেজ খালু তাড়াতাড়ি বাজারে গিয়ে মা-র জন্যে একটা শাড়ি ও কিছু খাবার কিনে এনে দিলেন। ঢাকায় যাবার ট্রেনের টিকিট কিনে দিলেন। আব্বার হাতেও বিশ-পঞ্চাশ টাকাও গুঁজে দিয়েছিলেন, পথ খরচ আর ঢাকায় গিয়ে দুই-দশ দিন চলার জন্য।
ঢাকায় আমরা ছিলাম আটচল্লিশ থেকে তিপ্পান্ন সাল পর্যন-, এই পাঁচ বছর। আমার সাত বছর বয়স পর্যন- সময় কেটেছে লালবাগের আমলীগোলায়। রাস-ার নাম হরমোহন শীল স্ট্রীট। বাড়ীটা একতলা। প্রধান শোয়ার ঘর বাড়ির সবচেয়ে পিছনে, সামনে একটা চওড়া বারান্দা, তারপর চার-পাঁচ ধাপ সিঁড়ির নিচে কিছুটা উঠান মতো জায়গা। উঠানের একপাশে কয়েকটা পেঁপে গাছ, পুঁই শাকের লতা, শীতে ধনে পাতা, ঢেঁড়শ প্রভৃতি সবজি, ডাঁটার বাগান- আব্বার হাতের পরিচর্যায় সেগুলো ঝক ঝক করতো। অন্য পাশে একটা লাউ লতা ছাদে উঠে গেছে, গোড়ার মাটিতে মাছ ধোয়া পানি আর ভাতের ফ্যানের দাগ দেখা যেতো। এটা মায়ের হাতের জিনিষ। এতো পরিচর্যা সত্ত্বেও লাউগাছ কেমন যেন ম্রিয়মান। সামনে বৈঠক খানা- ওখানেই আমাদের প্রথম শিক্ষাগৃহ- ফজরের নামাজের পরই মৌলভী সাহেবের কাছে আ- বে- তে- সে আর আমপারা শেখা।
তার অনেক আগেই অবশ্য আমি পড়তে শিখে গিয়েছি। অন্য অনেক শিশুর মতোই আমার হাতে খড়ি আমার মা’র হাতে, মা আমাকে একই সাথে বাংলা, ইংরেজি, আরবী আর উর্দু বর্ণমালা শিখিয়েছিলেন। যে বাংলা খবরের কাগজ আব্বা রাখতেন, সেটা দেখে দেখে শব্দগুলো বানান করে করে পড়তে শিখে গেছি।
আমার প্রথম খবরের কাগজ পড়া নিয়ে আমার বড়ভাই পরে আমাকে খেপাতেন ‘জবীলতৈ’ বলে। পত্রিকাটি উল্টো করে ধরে আমি নাকি ‘তৈলবীজ’কে পিছন থেকে উল্টো করে ‘জবিলতৈ’ পড়েছিলাম। আর একটা বাক্য নিয়েও আমাকে খেপানো হতো, সেটা হলো ‘এস কে ঘোষের চালের দোকান লুট’ বাক্যটি। আমি নাকি পড়েছিলাম ‘এসকে (এসোকে) ঘেষের . . ’। এর কারণও ছিল- ‘এস্’ অক্ষরটির নিচে কোন হসন- না থাকায় এবং ঘোষ শব্দটির ঘ-এর পর কোন আকার ছাপা না হওয়ায় আমি এ রকম উচ্চরণ করেছিলাম।
মারা গেলেও ‘কায়েদে আজম’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে, ঢাকায় এসে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দুর ঘোষণা দেওয়াতে জনমনে খুব বেশী ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও, হঠাৎ করে তিনি মারা যাওয়ায় সেই ক্ষোভ কিছুটা হলেও কমে গিয়েছিল। তারপরও ‘কায়েদে মিল্লাত’ লিয়াকত আলী খান, ‘শের-এ-বাংলা’ ফজলুল হক আর নূরুল আমিনের কথা অনেক বেশি করে কাগজে আসে। কাগজে আসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহেরু, তার বোন বিজয়লক্ষী পন্ডিত, রাজনীতিবিদ লালা লাজপত রায়, লর্ড মাউন্টব্যাটেন প্রমুখদের খবর। হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়া নেতাজী সুভাষ বসুর খবরও অনেক সময় পত্রিকার বেশ বড় জায়গা দখল করে রাখতো।
তৎকালীন পূর্ব বাংলা কিংবা পূর্ব পাকিস-ানের এলিট শ্রেণী যারা ছিলেন, তারা মনে করতেন তারা বাদশাহের কাছের লোক, তাই তারা অভিজাত শ্রেণীর। ফলে অভিজাতদের ভাষা বাদশাহের জবান- ফার্সিতে হতে হবে। কিন’ ফার্সি শেখা অনেক ঝক্কির ব্যাপার, এদিকে সে তুলনায় উর্দু শেখা অনেক সহজ, তাই আভিজাত্যের অহঙ্কারে তারা বাসায় নিজেদের মধ্যে তো বটেই, সকল সময় উর্দু ভাষায় কথা বলতেন। তারা মনে করতেন বাংলা অশিক্ষিত দরিদ্র চাষাদের ভাষা, আর তারপরেও যেহেতু হিন্দুরাও ঐ ভাষায় কথা বলতো, তাই তারা যদি বাংলাতে কথা বলেন তা’হলে তাদের আভিজাত্য- শরাফতি নষ্ট হয়ে যাবে।
অবশ্য এমন ভাবনার জোয়ার আজ-কাল বিশ শতকের শেষেও দেখা যাচ্ছে। ইদানিংকালে শিশুদের ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে পড়ানো ও বাসায় যতটা সম্ভব ভুল ইংরেজিতে কথা বলার প্রচলন দেখা দিয়েছে। চারপাশের ছেলেমেয়েদের থেকে নিজের সন-ানের পার্থক্য ও আভিজাত্য পৃথকভাবে তুলে ধরার জন্যে বিদেশী ভাষা ও ভাবধারায় ডুবে যাওয়ার প্রবণতা এখন উগ্রভাবে দেখা দিয়েছে। ছেলে-মেয়েরা বাংলাদেশের টেলিভিশন দেখার চেয়ে ভারতীয় হিন্দী চ্যানেলগুলির প্রতি আসক্তি উদগ্র হয়ে দেখা যাচ্ছে। বাংলা না জানতে পারাটা এখন একটা গর্বের বিষয় আর ফ্যাশন হিসেবে দেখা দিয়েছে।
সেই সময়ে যখন ভাষা নিয়ে নানা প্রতিবাদ দানা বাঁধতে আরম্ভ করলো, তখন এই উর্দুভাষী এলিট শ্রেণী জন্মজন্মান-রে এদেশের নাগরিক হয়ে এদেশের জল-হাওয়ায় বেড়ে উঠলেও বাংলা ভাষার বিরোধিতা ও উর্দুর পক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকলেন। নিজেদের প্রতিবেশীদের প্রতি সমর্থন না জানিয়ে হাজার মাইল দূর এলাকায় বসবাসকারী, আচারে-ব্যবহারে পৃথক এক ভিন্ন জনগোষ্ঠির ভাষা চালু করতে উঠে পড়ে লাগলেন। আর একটি বিষয় এসময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলো এই সব শিক্ষিত জনগোষ্ঠি পশ্চিম পাকিস-ানের জনগোষ্টির সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলে সরকারের উচ্চ পদে ও বেশী সুবিধা ভোগের জন্যও ব্যস- হয়ে পড়েন।
আজকাল যেমন মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ আর আমেরিকা যাওয়ার জন্যে বাঙালীরা মুক্তকচ্ছ হয়ে ছুটছেন, সে সময়ে সিন্ধু আর পাঞ্জাবে যাওয়ার জন্যে মানুষ পাগলপারা হয়ে ছুটতো। পাগলপারা ছোটা জনগোষ্ঠি আবার দুটো শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল, একটি উচ্চশিক্ষিত শ্রেণী, যারা সরকারী চাকরীতে আরও ভাল পদ বা ব্যবসায়ে বেশি সুবিধা লাভের আশায় ওদেশের মেয়ে বিয়ে করতেন, আর এক শ্রেণী হলেন একেবারেই হত-দরিদ্র, কেবল ভাগ্যান্বেষণে ছুটে যেতেন পশ্চিম পাকিস-ানে।
আব্বা অফিস থেকে ফেরার পর ও মগরিবের নামাজ জামাতে আদায় করার পর বড় আপা সবার জন্য জোরে জোরে খবর পড়ে শোনাতো – আর এ ভাবেই আমি পূর্ব পাকিস-ানের রাজনীতি সম্পর্কে ধীরে ধীরে অবহিত হতে শুরু করেছি।
দেশ ক্রমে তখন উন্মাতাল হচ্ছে বাংলা ভাষাকে দিয়ে। আমরা দুই ভাই আর বড় আপা বেশ রাজনীতি সচেতন হয়ে গিয়েছিলাম আব্বার প্রতি দিনের আলোচনা শুনতে শুনতে।
মা-ও যথেষ্ঠ রাজনীতি সচেতন ছিলেন। তুরস্কের বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমত ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কবি। আমি বলতে পারবো না এ কবির লেখা অনুবাদ, মা কোথায় পড়েছিলেন। নাজিম হিকমতের লেখা মাকে এত বেশি প্রভাবিত করেছিল যে, তিনি তাকে স্মরণ করে একটা কবিতাও লিখেছিলেন।
আব্বার পছন্দের কবি ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম আর কবি জসিমুদ্দিন। আব্বা কবি জসিমুদ্দিনকে পছন্দ করতেন কারণ ফরিদপুর থেকে ১৯২৫ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে আব্বা যখন কলকাতায় এসে প্রথম কলেজে ভর্তি হন, তখন সেই কলেজে কবি জসিমুদ্দিন উচু ক্লাসে পড়তেন। তখনই কবির লেখা কবিতা ডিগ্রি ক্লাসের বাংলা বইয়ে পাঠ্য হয়ে গিয়েছিল। আব্বা দুই বছরে আইএ শেষ করে বিএ ক্লাসে এসে হাজির হলেও ততদিনে জসিমুদ্দিন সেই ডিগ্রি ক্লাসেই আটকে ছিলেন। মজার ব্যাপার হলো আব্বা যে বছর বিএ পাশ করলেন সে বছরই কবি জসিমুদ্দিন বিএ পাশ করে ফেললেন। আর তিনি মনে করলেন আব্বার জন্যেই তার বিএ ডিগ্রি হয়েছে। এ কারণে তিনি আব্বাকে তার ঘনিষ্ট বন্ধু করে নেন এবং পরবর্তী জীবনে তিনি সব সময় আব্বাকে খুব খাতির করতেন।
আব্বা ১৯৩০ সালে কলকাতায় এসে রাইটার্স বিল্ডিং-এ চাকরীতে যোগ দেন। দেশ বিভাগের পর আব্বা ডিরেক্টর সব পাবলিক ইনষ্ট্রাকশন অফিসে কাজ করেন। এ সময়ে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন অব বেঙ্গলী ল্যাঙ্গুয়েজে প্রকল্পের কাজ নিয়ে তাকে ব্যস- থাকতে হয়। পরে আব্বার কাছে শুনেছি এই স্টাণ্ডার্ডাইজেশনের নাম করে কিভাবে এক শ্রেণীর ‘বিজ্ঞজন’ বাংলা ভাষা নিয়ে ‘খেলায়’ মেতেছিলেন। তার কাছে শুনেছি এর মধ্যে একটা প্রস-াব ছিল আমরা মুখে বলার সময় যে ভাবে বানান করি লেখার সময় সেভাবেই লেখার পদ্ধতি চালু করা অর্থাৎ ‘ডিরেক্টর’ শব্দটি লিখতে হবে ‘ডরিক্টরে’ (ড+হ্রস্বই+ ক+ট+র++ের) বানানে। মজার বিষয় অতি সমপ্রতি ইন্টারনেটে বাংলা লেখার “অভ্র” পদ্ধতিতে একই নিয়মে বাংলা লেখার ব্যবস’া চালু করা হয়েছে। এটা আসলে টাইপ মেশিনে ইংরেজি শব্দগুলো যেভাবে টাইপ করতে হয়, সেই পদ্ধতিতেই বাংলা লেখার ধরন।
মায়ের সাথে আব্বার বিয়ে হয় যখন মা স্কুলের উচু ক্লাসে, নাইনে কি টেনে পড়তেন। বিয়ের পর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনায় ইতি পড়লেও মা’র উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ আর জ্ঞান অর্জনের অস্বাভাবিক অদম্য আগ্রহের কারণে প্রচুর বই পড়তেন। এসব বই পাড়া ও আব্বার অফিসের লাইব্রেরী থেকে আব্বাই সংগ্রহ করে দিতেন। তাছাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনের বইয়ের আলমারীতে হামলা দেয়াও মাযের একটা নেশা ছিল।
মায়ের এই ‘জেনেটিক নেশা’ সম্ভবত আমারও রক্তে প্রবাহিত হয়েছিল, যদিও শিশুকালে এর খুব একটা প্রসাব লাভ করতে পারেনি। আমার পাঁচ বৎসর পর্যন- বইয়ের জগত ছিল খুবই সীমিত। পঞ্চাশ-বায়ান্ন সালের দিকে একটা প্রাদেশিক শহর ঢাকার পুরোনো এলাকার শিশু কিশোরদের বুদ্ধি-বৃত্তির চর্চার তেমন কোন সুযোগ ছিল না। তাই নানা জনের মুখে শোনা কেচ্ছা-কাহিনী আর গল্পই ছিল আকাঙ্খা মেটানো একমাত্র মাধ্যম।
এ বিষয়ে মা’র ভূমিকা ছিল অনেক জোরালো। মা সে সময়েই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্রের সমগ্র রচনাবলী পড়ে ফেলেছেন। আমাদেরকেও সেই সব রচনাবলীর গল্প, নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতে পছন্দ করতেন। যদিও ধর্মীয় আদব-কায়দা ও অনুশাসন কঠিনভাবে আমাদের পালন করতে হতো, ফজরের আজান হওয়ার সাথে সাথে ঘুম থেকে উঠে জামাতে নামাজ আদায় করতে হতো আমাদের দুই ভাইয়ের। আব্বাই ইমামতি করতেন। মাঝে মাঝে অবশ্য মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতাম। তখন বড় ভাইয়ের নেশা ধরে গেল সাত বছর বয়স থেকে ও ভোরে উঠে পাড়ার মসজিদে আজান দিতে যেত। পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ খুব একটা বাদ পড়তো না। ভোরে আমপারা পড়া ছিল বাধ্যতামূলক। কিন’ তা বলে ধর্মের কোন গোঁড়ামিত্ব আমাদেরকে প্রভাবিত করেনি কখনও।
আব্বা সব সময় বলতেন, ‘মুসলমানের জন্য আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ট দান কোরআন শরীফ। মুসলমান মাত্রই এই কোরআনকে শিখতে হবে। কোরআন পড়তে জানি না, এই অজুহাত অত্যন- খোঁড়া যুক্তি। মাতৃভাষা হিসেবে আমরা অনায়াসেই বাংলা শিখে ফেলি, ইংরেজী আর উর্দু শিখি চাকুরী আর ব্যবসায়ের লাভের জন্য, তা’ হলে আত্মিক লাভের জন্য আরবী শিখতে এত অনীহা কেন?’
একজন মৌলবী নিয়মিত আসতেন আমাদের কোরআন পড়া শেখানোর জন্য। আব্বা নিজেও অত্যন- ভাল আরবী জানতেন আর আমাদের সকলকে নিজে হাতে আরবী শিখিয়ে ছিলেন। কেবল কোরআন তেলাওয়াত নয়, আমাকে বিশেষ করে আরবী ভাষা শিখিয়ে ছিলেন, যাতে আমি কোরআন পড়ে সরাসরি অর্থ বুঝতে পারি।
এত সব ধর্মীয় আচার-আচরণের পরও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও আমাদের যথেষ্ট ঘনিষ্ট সম্পৃক্ততা ছিল। আব্বা পাড়ার একটি সমাজ সেবামূলক সমিতির একজন একনিষ্ট কর্মী ছিলেন। প্রায়ই সেখানে ছুটির দিন সন্ধ্যার পর সাহিত্য সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। আমরা মাঝে মাঝে আব্বার সাথে অনুষ্ঠান দেখতে যেতাম।
তখনকার দিনে আমলিগোলার পরিবেশ কিন’ মহিলাদের জন্য খুব একটা সুখকর ছিল না। বোরকা পড়া ছিল প্রায় বাধ্যতামূলক। শহরে যানবাহনের একমাত্র মাধ্যম রিক্সায় উঠলে রিক্সার হুড তুলে দিয়ে বড় চাদর অধবা শাড়ি দিয়ে সামনে পিছনে মুড়ে দিতে হতো যাতে পথচারী কেউ কোনমতে রিক্সায় চড়া ঐ অন-ঃপুরবাসিনীকে কোন অবস’াতেই দেখতে না পারে।
বহিরাঙ্গনে মহিলাদের পদচারণা ছিল না বললেই চলে। তার মধ্যেও মা পাড়ার একটা প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতার কাজ পেয়ে গেলেন। সেই সাথে পাড়ার মহিলাদের মধ্যে প্রায় কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে গেলেন। তাঁর আচার-আচরণ ও পাড়া-পড়শিদের সাথে সহজ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্কের কারণে তিনি অল্প সময়েই যথেষ্ট পরিচিত হয়ে পড়েন। ফলে আমাদের বাড়ির জন্য এলাকার প্রচলিত কঠোর পর্দা প্রথা খুব একটা কঠোর হতে পারেনি। অথবা মায়ের জেদের কারণে ঐ পর্দা প্রথা মা পালন করতে চাইতেন না।
আজ জীবনের শেষ প্রানে- এসে সে সব দিনের কথা যখন ভাবি তখন মনে হয় আমার মা আসলে যথেষ্ট ‘এডভান্সড অব হার এজেস’ ছিলেন। তিনি সে সমাজের আর দশটা মহিলার চেয়ে চিন-া-চেতনায় অনেক বেশি অগ্রগামী ছিলেন। অথচ তাঁর কথায়, কাজে বা মানসিকতায় ধর্মীয় অনুশাসন ও নিয়ম-শৃংখলা পরিপন’ী কোন কিছু প্রতিফলিত হয়নি। তিনি আসলে সকল প্রকার কূপমণ্ডুকতা, গোঁড়ামি আর কুসংস্কারকে উপেক্ষা করে চলতে চেষ্টা করে গেছেন। এই স্বাধীনচেতা মানসিকতার জন্যেই পরিবার ও সমাজের অনেকের সাথেই সারাজীবন বিরোধে লিপ্ত হতে হয়েছে। একারণে তিনি জীবনে অনেক ক্ষতিগ্রস’ হয়েছেন, কিন’ কখনও মাথা নোয়াননি।
বড় হয়ে যখন বুঝতে শিখেছি, তখন দেখেছি একটু ছাড় দিলেই হয়তো এই সব সংঘাত তিনি অনায়াসেই এড়িয়ে যেতে পারতেন, কিন’ তিনি তা’ করেননি। তিনি তাঁর আদর্শ থেকে সারা জীবনে এক চুল পরিমান বিচ্যূত হননি। মা’র এ মানসিকতা কি করে জানি না আমার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। মা-র এ গুণটি (নাকি, দোষ বলবো?) আমার মধ্যে আরও কঠিনভাবে দেখা দিয়েছিল। তাই সারা জীবনে আমার ঘনিষ্ট আত্মীয় কারো সাথেই আমার মতের মিল হয়নি। আমি সবার থেকে আলাদা থেকে গিয়েছি।
আমার বড় ভাই আর বড় বোন যেখানে, সহজেই পরিবার আর সমাজের বিরুদ্ধ শক্তির কাছে অবনত হয়ে সমাজে অনেক ভাল আছে, মাথা উচু করে চলাফেরা করছে, সেখানে আমি আমার অন্য ভাই-বোনের চেয়ে মেধায়, মননে, জ্ঞানে ও অভিজ্ঞতায় অনেক বেশি এগিয়ে থেকেও কেবল একটুখানি সমঝতা না করার কারণে সকলের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়ে আছি।
আসলে আমি হয়তো তেলাপোকার জীবন-যাপন করতে চাইনি। যে তেলাপোকা পরিবেশ ও প্রতিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে যুগের পর যুগ টিকে আছে, অথচ খাপ খাওয়াতে না পেরে তেলাপোকার চেয়ে প্রায় কয়েক হাজার গুণ বড় আর শক্তিশালী হয়েও ডাইনোসর পৃথিবীতে টিকতে পারেনি।
আমার প্রথম মঞ্চে ওঠার সুযোগ আসে চার বছর বয়সে। ওঠার সুযোগ আসে না বলে আমি মঞ্চে উঠতে বাধ্য করি আয়োজকদের। সে অনুষ্ঠানটি সম্ভবত ১৪ আগস্টকে কেন্দ্র করে। শুনতে পেলাম বিরাট বড় আয়োজন হচ্ছে। সবচেয়ে অবাক হলাম এই অনুষ্ঠানের প্রধান আয়োজকদের মধ্যে আব্বাই মোটামুটি প্রধান। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আব্বা অত্যন- উৎসাহের সাথে মাকে অনুষ্ঠানের নানা আয়োজনের কথা বলছেন।
আমি ছোটবেলায় যে ভাল আবৃত্তি করতে পারতাম তা মা-খালা আর প্রতিবেশীরা অনেকের মুখেই শুনেছি। শুনে শুনে আমার মনে হলো আমি তো ভাল কবিতা বলতে পারি। তাহলে অনুষ্ঠানে কেন বলতে পারবো না। অনুষ্ঠানের আগের দিন আমার জ্বর এলো। বিছানায় কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে শুয়ে শুনলাম পর দিন অনুষ্ঠান আর আব্বাই এর মুল উপস’াপক। তখনই ঠিক করলাম আমি ঐ অনুষ্ঠানে কবিতা বলবো।
অনুষ্ঠানের দিন সকাল থেকেই আব্বা অনুষ্ঠানের আয়োজনে ছোটাছুটি করছেন। বিকালে মা আমাকে চুপ করে শুয়ে থাকতে বলে পাশের বাসায় গেলেন কোন এক কাজে। আমাকে আর পায় কে, আমি বিছানা থেকে উঠে এক দৌড়ে অনুষ্ঠানে গিয়ে হাজির। মঞ্চের সামনে অগণিত দর্শক। অনুষ্ঠানের মূল সঞ্চালক ছিলেন আব্বা নিজে। আমি আব্বার কাছে গিয়ে বললাম, আমি কবিতা বলবো। অনুষ্ঠানসূচি তৈরী করা আছে আব্বা তার বাইরে কিভাবে যান? তাছাড়া আমি তখন নাবালক, আমার আবদার গুরুত্ব দেয়ার ইচ্ছেই ছিল না তার। এক একটা পর্ব শেষ হচ্ছে আর আমি আব্বাকে বলছি আমাকে সুযোগ দেয়ার জন্য।
আমাকে বারবার খুঁতখুঁত করতে দেখে আর একজন সঞ্চালক আব্বাকে জিজ্ঞেস করে আমার আবদার সম্পর্কে জানতে পেরে আব্বাকে বললেন আমাকে একটু সুযোগ দেয়ার জন্য। শেষে আব্বা রাজি হলেন। আমার শরীরে তখন বেশ জ্বর। জ্বরের দাপটে আমি নাকি তখন কাঁপছি। আব্বা আমাকে মঞ্চে নিয়ে গিয়ে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন। অনেক চেষ্টার পরও মাইক আমার মুখের আছে আনতে না পেরে আমাকে টেবিলের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে মাইকটা ঠিক করে দেয়া হলো। পরে মা-র কাছে শুনেছি আমি নাকি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সংকল্প’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলাম। এখন মনে নেই তবে পরে আব্বার মুখে শুনেছিলাম আমার স্পষ্ট ও তীক্ষ্ণ কন্ঠশ্বরে কবিতাটির সম্পূর্ণ আবৃত্তি শুনে অনেকেই দাঁড়িয়ে উঠে আমাকে হাততালি দিয়ে সম্বর্ধিত করেছিল।
আমার সেই জ্বর ছেড়েছিল তেইশ দিন পরে।
কেবল আমিই না আমরা তিন ভাই বোনই প্রায় একই সাথে সে সময়ের সবচেয়ে আতঙ্কজনক রোগ টাইফায়েডে আক্রান- হয়েছিল। আমরা তিন ভাই বোন বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে থাকতাম। তখন তো টাইফায়েডের কোনই চিকিৎসা ছিল না। কেবল পরিচ্ছন্নতা আর পরিচর্যা। অধিকাংশই তখন টাইফায়েডে মারা যেত। কিন’ কেবল মায়ের রাত-দিন অক্লান- সেবায় আমরা তিন ভাই বোন ধীরে ধীরে সেরে উঠলাম।
সেরে ওঠার পর মা প্রথম যে দিন আমাকে ভাত খেতে দিলেন, সে দিনের কথা এখনও আমার মনে পড়ে। ঘরের সামনের বারান্দায় পাটি পেতে মা আমাকে বসিয়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে এনামেলের থালায় করে গরম ভাত নিয়ে এলেন, আর সাথে বাটিতে করে আনলেন সিঙি মাছের হালকা ঝোল। ভাতের পাশে একটুকরো লেবু। আমাকে বললেন, ‘আসে–ধীরে খাও।’
সেই গরম ভাতের গন্ধ, লেবুর গন্ধ আর সিঙি মাছের পাতলা টলটলে ঝোলের স্বাদ এখনও আমার স্মৃতিকে আপ্লুত করে আছে। আমি যেন এখনও আমার জিভে সেই স্বাদ আর নাকে সেই গন্ধ টের পাই।
জানি না কেন, সেই টাইফায়েডে যখন ভুগছিলাম, তিন-কি চার বছর হবে, আমার বয়স, তখনকার, একটা ঘটনা অস্পষ্টভাবে মনের ভেতর কেঁপে কেঁপে ওঠে। তখন সন্ধ্যা, কি রাত, বলতে পারবো না, সঠিক মনে নেই, আমি বিছানায় শুয়ে, মা কাছে এসে দেখেন আমি জেগে আছি, জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ঘুম আসছে না?’
আমি মাথা নেড়েছিলাম কি না মনে নেই। মা বললেন, ‘আমি গল্প বলি?’
আমি মনে হয় মাথা নেড়েছিলাম আবার।
মা বললেন, ‘থাম, আমার নাচ দেখবি? নাচ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যা।’
তখন মা-র বছস কতো হবে? আমার চার হলে বড় ভাই আট আর আপা বারো। তা’হলে মা-র বয়স বড়জোর বিশ কি একুশ হবে।
মা উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে বিছানার সামনে দাঁড়ালেন. তারপর গান করতে করতে নাচতে থাকলেন,
”প্রলয় নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে,
হে নটরাজ, জটার বাঁধন পড়লো খুলে।’
আমি বলতে পারবো না, আমি সেদিন সত্যিই মা-র নাচ আমি দেখেছিলাম কি না? বা মা ওরকম গান সত্যিই গেয়েছিলেন কি না। কারণ আমাদের জন্মের আগে বা অব্যবহিত পরে বাড়িতে গান শোনার আবহ থাকলেও, চর্চা করার পরিবেশ ছিল না, নাচ তো দূরের কথা। আব্বা তার প্রথম জীবন কাটিয়েছেন জিপসিদের মতো, তার শিক্ষা জীবন কলকাতায় কাটানোর কারণে গানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ থাকলেও নৃত্যকলা নিয়ে একটা ‘ট্যাবু’ ছিল, মুসলিম পরিবারের সন-ান হওয়ার কারণে। অন্য দিকে আমার নানা বাড়িতে সংস্কৃতির চর্চ্চা কিছুটা চললেও, গান শোনা ও বেসুরো গাওয়া গ্রহণযোগ্য হলেও, নাচ একেবারেই চলতো না। তা’হলে সেই দিন মা তার সন-ানকে ঘুম পাড়ানোর জন্য সত্যিই নেচেছিলেন কি না, তা’ও আবার অমন একটা গানের সাথে! এখনও আমার কাছে ঘটনাটা রহস্যজনক বলে মনে হয়।
আমার ছোটখালু কলকাতায় ব্যবসা করতেন। নানা ধরনের ব্যবসা ছিল তার। তিনি সেখানে নিরাপদ বোধ না করায় তার বিপুল সম্পত্তি ঢাকায় সরানোর উদ্যোগ নিলেন। সেই কার্যক্রম সফল করতে তিনি প্রায়ই ঢাকা-কলকাতা যাতায়াত করতেন এবং দীর্ঘ দিন তিনি আমাদের বাসায় থাকতেন ও সম্পত্তির বিলি বন্টনে ব্যস- থাকতেন। পরে ওরা সবাই ঢাকার টিকাটুলি এলাকায় বাড়ি কিনে সি’তু হরেন। ছোট খালার ছোট ছেলে আমিনুর রহমান খোকন ছিল আমার চার দিনের বড়। তার বড় বোন ফরিদা রহমান, যার ডাক নাম ছিল হেনা, আমার চেয়ে চার বছরের বড়। হেনা আপা খুব বেশী মিশুক ছিলেন না। দিনের প্রায় পুরোটা আর সন্ধ্যার অনেকটা জুড়েই তিনি তার পড়ার বই নিয়েই ডুবে থাকতেন। তার মধ্যেও অবশ্য মাঝে মাঝে আমাদের সাথে একটুখানি সময় দিতেন। বই থেকে পড়ে পড়ে গল্প শোনাতেন, মজা করতেন।
যদিও হাটখোলার এই বাড়িটাতে আমাদের যাতায়াত খুব একটা ঘন ঘন হতো না। কারণ আমার খালারা, বিশেষ করে ছোটখালা ছিলেন অত্যন- সম্পদশালী, আর পাছে দরিদ্র হওয়ার কারণে তাঁরা আমাদেরকে কোনও প্রকার তাচ্ছিল্য করেন, এর জন্য মা অত্যন- সচেতন থাকতেন। যেখানে তাঁর কিংবা ত্বার ছেলে-মেয়ের কিছু অসম্মান হতে পারতো, সেখানে পারতপক্ষে তিনি নিজে যেতেন না, আমাদেরকেও যেতে দিতেন না।
আমাদের আর্থিক অবস’া মোটেই ভাল ছিল না। কেবল আব্বার চাকুরীর মাইনের উপর ভরসা। যদিও পৈত্রিক সূত্রে আব্বা তার জন্মস’ান ফরিদপুরের সদর উপজেলার ব্রাহ্মণদী গ্রামে প্রচুর সম্পত্তির জমির অধিকারী ছিলেন। কিন’ বড় ভাইয়ের সাথে জমির ভোগ-দখল করা নিয়ে পাছে গোলযোগ করতে হয়, তার জন্য জীবনে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হয়েও তিনি কখনও গ্রামে যাননি, আমাদেরকে যেতেও দেননি। আমাদের কাছ থেকে তিনি প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন পরবর্তীতে আমরা যেন ঐ সম্পত্তির কোন দাবি না তুলি। আমি আব্বার এ আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গিয়েছি।
একদিন দুপুরের পরই মা আমাদের সাজগোজের ব্যাপারে মনযোগ দিলেন। যে দিন খালার বাড়ীতে বেড়াতে যেতাম সে দিন পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজটা একটু গুরুত্ব পেত এ বাড়ীতে। কথা প্রসঙ্গে শুনলাম আজ নাকি সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যাবো আমরা। বিষয়টা আমাকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেনি (এ বিষয়টা আমাকে আমার যুবক বয়সেও তেমন প্রভাবিত করেনি)।
তখনও পর্যন- আমার সিনেমা হলে ঢোকার কোন সুযোগ হয়নি, তাই একটা প্রচ্ছন্ন কৌতুহল যে হয়নি তা নয়। রিক্সা কিংবা ঘোড়ার গাড়িতে করে খালার বাড়িতে যাবার সময় গুলিস-ান সিনেমা হলটার সামনে দিয়ে যখন যেতাম তখন বাইরে দিকে হাতে আঁকা বড় বড় পোস্টার চোখে পড়লেও খুব আকর্ষণ বোধ করতাম না। কারণ সিনেমা দেখাটা খুব একটা আকর্ষণীয় বিষয় হিসেবে তখনও দেখা দেয়নি আমার কাছে।
যাই হোক গুলিস-ান সিনেমা হলের ভিতরে দল বেঁধে যখন ঢুকলাম তখন আমার কাছে বিষয়টা খুব একটা উত্তেজিত হওয়ার মত মনে হলো না। স্বল্প আলোয় বিরাট বড় একটা ঘরের মধ্যে অনেকগুলো সারিবদ্ধ চেয়ার সাজানো, সবকটা চেয়ারই সামনের দিকে মুখ করা। একটা চেয়ারে বসার পর আমার একই বয়সী অথচ অভিজ্ঞতায় অনেক পরিপক্ষ খালাতো ভাই আমিনুর রহমান খোকন সামনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘ঐ সাদা চৌকা জায়গাতে ছবি দেখা যাবে, তাকিয়ে থাক।’
এখন আর আমার সঠিকভাবে মনে নেই ছবিটার নাম, বা ছবির ঘটনাবলী। সম্ভবত দিলিপ কুমার আর মধুবালা অভিনীত কোন ছবি। কারণ তখন এদের দুজনের নাম চারদিকে কান পাতলেই শোনা যেন। তবে, তার একটি গানের দুটি চরণ এখনও মনে পড়ে-
‘আয় মেরে দিল কাহিঁ আওর চ্যল গামসে দুনিয়াকে দিল ভর গ্যায়া
ঢুঁড় লে আপকো হি ঘর নয়া।’
আজকাল এ গানটির লাইন দুটি মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে অবাক হয়ে ভাবি ষাট-বাষট্টি বছর আগে একবার শোনা সেই গানটি কিভাবে আমার মগজে ঢুকে গিয়েছিল, যা আজও মাথা থেকে মুখে যায়নি।
মায়ের বই পড়ার “জেনেটিক নেশা” সম্ভবত আমাদের রক্তে প্রবাহিত হয়েছিল সম্ভবত। শিশুকালে এর খুব একটা প্রসার লাভ করতে পারেনি। আমার পাঁচ বৎসর পর্যন- বইয়ের জগত ছিল খুবই সীমিত। পঞ্চাশ-বায়ান্ন সালের দিকে একটা প্রাদেশিক শহর ঢাকার পুরানো এলাকায় শিশু-কিশোরদের বুদ্ধি বৃত্তির চর্চার তেমন কোন সুযোগ ছিল না। তাই নানা জনের মুখে শোনা গল্পই ছিল দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো একমাত্র মাধ্যম।
আমার যখন সাড়ে চার বছর তখন আমার সাড়ে তিন বৎসরের বড় বড়ভাইকে আব্বা ওয়েস্ট এন্ড স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে যান। ঐ দিন আমিও জেদ ধরলাম আমিও স্কুলে পড়বো। কোন নিষেধেও আমাকে টলাতে না পেরে এবং সম্ভবত আমার মার প্রচ্ছন্ন সমর্থনে আব্বা বাধ্য হলেন আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতে। বড় ভাইয়ের ক্লাস থ্রির ভর্তি প্রক্রিয়া সহজই ছিল। কিন’ হেড মাষ্টার আমাকে কিছুতেই ভর্তি করতে রাজি হলেন না। আমি এমন কান্নাকাটি আরম্ভ করে দিলাম যে শেষে ঠিক হলো আমার ভর্তির জন্য আমাকে বুদ্ধিবৃত্তির পরীক্ষা দিতে হবে। দুইজন শিক্ষক অনেকক্ষণ ধরে বিভিন্ন প্রশ্ন করেও আমাকে বিপদে ফেলতে পারলেন না। আমি তাদের সব কটি প্রশ্নের উত্তরই দিতে পেরেছিলাম। তখন প্রধান শিক্ষক বাধ্য হয়ে আমাকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করতে সম্মত হলেন। আমিও মহা উৎসাহে আমার স্কুল জীবন আরম্ভ করে দিলাম।
বড় ভাই আমার চেয়ে চার বছরের বড় হওয়ায় তখন সে নিজেকে বেশ বড় বলে মনে করতো। স্কুলে ওর সাথেই আমি যাওয়া-আসা করতাম। মাঝে মাঝে স্কুল আগে ছুটি হয়ে যেত, কি সব কারণ এখন আমার ঠিক মনে নেই, সে দিনগুলিতে বড় ভাই আমাকে নিয়ে আমাদের লালবাগ এলাকা ছেড়ে নানা দিক বেড়াতে নিয়ে যেত- অর্থাৎ তার আট বছর বয়সের ক্ষমতায় যতটা কুলায়। মনে আছে একদিন আমাকে বললো, ‘চল তোকে নিউ মার্কেটটা দেখিয়ে আনি।’
তখন সবে নিউ মার্কেটটা তৈরী হয়েছে। মনে আছে বেশ কিছু দূর ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে আমরা একটা বিরাট গোল পাঁচিল ঘোরা এলাকায় সারি সারি দোকান দেখেছিলাম। তখন প্রায় দুপুর। সারা এলাকায় প্রায় জনশূন্য। দোকানগুলোতে পসার সাজিয়ে দোকানদাররা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে হু হু করে বাতাস ধূলো উড়িয়ে দোকানের পসরার ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছে। একটুক্ষণ পর পর দোকানদাররা একটা ছোট লাঠির আগায় একটুকরো কাপড় বেঁধে ঝাড়ন বানিয়ে ঐ ধূলো ঝেড়ে দিচ্ছে। দোকানগুলোর দুই-একটাতে কমদামী রঙীন ছবি ছাপা টিনের ট্রে, কাপ-পিরিচ, প্লেট- অধিকাংশই সস-া জাপানী পণ্য দেখেছিলাম বলে এখনও মনে পড়ে।
আর একদিন বড়ভাই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল লালবাগ দুর্গে। আমার এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে বড়ভাই আমাকে নিয়ে দুর্গের এক পাশের দেয়ালের পাশে একটা দরজা দিয়ে ভিতরে নিয়ে গেল। পথটা ক্রমে বেশ নীচে নেমে গেছে। একটু দূর যেতে অন্ধকারে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না, আমার একটু একটু ভয় করতে লাগলো। সামনে আর একটু এগিয়ে যেতে দেখি একটা লোহার শিকের বন্ধ দরজা। পথটা আরও নীচে নেমে গেছে। আমি আর বেশী দূর যেতে রাজি হলাম না। বড়ভাই বলেছিলো এই দিক দিয়ে নাকি বুড়ি গঙ্গার অন্য পাড়ে যাওয়া যায়, কিন’ কেউ নাকি ভয়ে চেষ্টা করেনি। বড়ভাই আরও বলেছিল আর একটু বড় হয়ে ও নাকি এই পথ দিয়ে আরও ভিতরে যাবে। সত্তরের দশকে যখন আবার এখানে বেড়াতে আসি তখন দেখি সেই সুড়ঙ্গটা একেবারে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
স্কুলে যাওয়া-আসার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলা ভাষা নিয়ে উত্তেজনা বিরাট আকার ধারণ করলো। প্রায় প্রতি দিনই স্কুলে গেলে উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা আমাদের বোঝাতো বিদেশী শত্রুরা আমাদের মুখের কথা কেড়ে নিতে চায়। ওরা আমাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলতে দেবে না। ওদেরকে আমাদের তাড়াতে হবে। ঐসব ছেলেদের কাছ থেকেই প্রথম শিখলাম সেই বিখ্যাত স্লোগান “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। নূরুল আমিনের কল্লা চাই।” আমার কয়েকজন সহপাঠী আর প্রতিবেশীদের ছেলেদের নিয়ে আমি মহা উৎসাহে পাড়ার রাস-ায় চিৎকার করে বলতে থাকতাম, ”রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই………”
এরই মধ্যে একদিন আমরা কয়েকজন চিৎকার করতে করতে বড় রাস-ার মোড় পর্যন- চলে গিয়েছি। হঠাৎ সামনে দেখি পুলিশের গাড়ি। গাড়িটা দ্রুত বেগে আমাদের সামনে এসে থেমে যেতে কয়েকজন সিপাহী লাফিয়ে নেমে আমাদেরকে ধরে ফেললো। আমি তখনও এর পরিণতির কথা কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।
পুলিশরা আমাদের নিয়ে কি করতো জানি না। আমাদের বয়স দেখে কোন নিবর্তনমূলক ব্যবস’া নেয়ার কথা হয়তো তাদের মনে আসেনি। এমন সময় জানি না কিভাবে আব্বা ওখানে এসে হাজির হলেন। আমাকে দলের মধ্যে দেখে এগিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছোট, তুই কি করছিস এখানে?’
আমি কোন উত্তর দেয়ার আগে অফিসার আব্বার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এ আপনার ছেলে?’
আব্বা তখন তার পরিচয়পত্র দেখিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। অফিসার একটু হেসে বললেন, ‘আপনার ছেলে মহা বিপ্লবী হয়ে উঠেছে। সামলান ওকে, না হলে এ বয়সেও ওর বিপদে পড়তে দেরী হবে না।’
আব্বা ঐ সময় অকুস’লে উপসি’ত হওয়াতেই সম্ভবত আমরা রক্ষা পেলাম। পরে মা-র মুখে শুনেছি বাসায় ফিরে তার যত রাগ সব তিনি মা-র উপর ঝাড়লেন, কেন তিনি আমাকে বাইরে ছেড়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে আব্বা আর মা-র মধ্যে বেশ তীক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল।
আমলিগোলা থেকে আজিমপুর হয়ে চানখাঁর পুল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, গুলিস-ান এবং ঠাঁঠারি বাজার, ওয়ারী হয়ে টিকাটুলীর প্রায় শেষ মাথায় হাটখোলাতে আমার ছোট খালার বাড়ি। বাড়ির সামনে দিয়ে নারায়ণগঞ্জের রাস-া চলে গিয়েছে। একপাশে হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরী। বাড়ির ডান দিকে একটুখানি গেলে বলদা গার্ডেন।
চারপাশে বাগানের মধ্যে একতলা বিরাট বড় বাড়ি। অনেকগুলো ঘর আর বিশাল ছাদ। আমার অনেকটা টান ছিল বাড়ির পাশের ছাপাখানটার দিকে। ঝম ঝম শব্দ করে ট্রেডল আর ফ্ল্যাট মেশিনগুলো চলতো আর বড় বড় কাগজের শিটে লেখা আর ছবি ছাপা হয়ে যেত চোখের পলকে। প্রেসটার নাম ছিল, ‘প্যারামাউন্ট প্রেস’।
এই প্রেস থেকে পঞ্চাশের দশকে সরকারের ‘পাকিস-ান খবর’ আর ‘মাহে নও’ পত্রিকা। ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকাটা প্রথমে সাপ্তাহিক হিসেবে ও পরে দৈনিক হিসাবে ছাপা হতো। আমার সবচেয়ে ভাল লাগতো প্রেসের কাটিং মেশিনের পাশে জমে থাকা কুঁচি কুঁচি টুকরো কাগজের বিশাল স’পটাকে। লুকোচুরী খেলার জন্য ঐ কাগজের টুকরোর স’পের মধ্যে ডুবে গেলে সহজে কেউ খুঁজে পেত না।
আজ আমার মনে হয় ঐ ছাপাখানার মেশিন, ঝম ঝম শব্দে ছাপা হওয়া কাগজ, মুদ্রিত কাগজ আর কালির গন্ধ, ভাঁজ করে রাখা বিপুল পরিমান বই-পত্রিকা, কুচি কাগজের স’প, প্রভৃতি বিষয় আমার চিন-া চেতনায় এমনভাবে ঢুকে গিয়েছিল, যে পরবর্তী জীবনে নিজের অজানে-ই অবধারিতভাবে মুদ্রণ ও প্রকাশনা কাজে জড়িয়ে গিয়েছি।
আমাদের একা একা ছাদে ওঠা বারণ ছিল, পাড়ায় অসংখ্য বানরের কারণে। ছোট বাচ্চা দেখলে, বিশেষ করে যদি তাদের হাতে কোন খাবার থাকতো, তবে অবধারিতভারে বানরের দল এসে হামলা করতো আর খাবার তো কেড়ে নিতোই, আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করতো বলেও আমরা জানতাম। তবে বড়দের সাথে ছাদে উঠলে আসেপাশের ছাদে-কার্নিসে সব সময়ই বেশ কয়েকটা বানর বসে থাকতে বা ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত।
ছোট খালু হাবিবুর রহমান সাহেব ছিলেন বেশ বড় ব্যবসায়ী। ছাপাখানা ছাড়াও আরও অনেক রকম ব্যবসায় ছিল তাঁর। প্রতি বৎসর কলকাতায় একবার বেড়াতে যেতেন ওরা সবাই। গরমে কখনও কাশ্মির, কখনও দার্জিলিং বেড়ানো ছিল তাদের নিত্য কর্ম।
ও বাড়ির আর একটা জিনিষ আমাকে খুব বেশি অবাক করেছিল। খালার শোবার ঘরে একদিন সকাল বেলা গিয়ে দেখি কি একটা অসুস’তার কারণে খালা শুয়ে আছেন। বিছানায় মশারী টাঙ্গানো। খালা আমার মা অর্থাৎ তার বড় বোনকে দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে মশারীর বাইরে বেরিয়ে এলেন।
আমি অবাক বিষ্ময়ে দেখলাম খালা পুরো মশারী না তুলে বিছানার মাঝখানে মশারীটার কিছু অংশ ঠিক দরজার মতো ফাঁক করে বেরিয়ে এলেন। আমি এতোটাই আশ্চর্য হয়েছিলাম যে মাকে বলেছিলাম, ‘দেখছো মা, দরজাওয়ালা মশারী।’
আমার এই ’দরজাওয়ালা মাশারী’ কথাটা এর পর আমাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে খুব প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল।
খালার ছোট ছেলে ছিল আমার চারদিনের বড় তার বড় বোন হেনা আমার চেয়ে চার বছরের বড়। হেনা আপা খুব বেশি মিশুক ছিলেন না। দিনের প্রায় পুরোটা আর সন্ধ্যার অনেকটা জুড়েই তিনি তার গড়ার বই নিয়ে ডুবে থাকতেন। তার মধ্যেও অবশ্য মাঝে মাঝে আমাদের সাথে একটু খানি সময় দিতেন। গল্প পড়ে শোনাতেন, মজা করতেন যদিও হাটখোলার বাড়িতে আমাদের যাতায়াত খুব একটা ঘন ঘন হতো না।
একদিন ও বাড়িতে আমাদের কি এক অনুষ্ঠনে আমার সবাই গিয়েছি দশটা এগোরটার দিকে। গিয়ে শুনলাম হেনা আমার পরীক্ষা চলছে। আমাদের বলা হলে ওকে যেন আমরা বিরক্ত না করি। আমি যথারীতি ছাপাখানায় চলে গিয়ে ওদের ঐ সব ছাপার কাজ দেখতে লাগলাম। ভাবতে অবাক লাগে, ত্রিশ বছর পরে এই ছাপাখানাই ওতোঃপ্রতোভাবে আমার জীবনে এমনভাবে জড়িয়ে গেল, যে পরবর্তী সারা জীবনেও এর প্রভাব থেকে আর মুক্ত হতে পারলাম না।
দুপুরে আমার সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া করছি এমন সময় হেনা আপা তার ঘর থেকে বের হয়ে বলে উঠলেন, ‘কি আশ্চর্য, বড় খালা কখন এসেছেন?’ মা হেসে বললেন, ‘আমরা তো দশটার দিকে এসেছি।’ সারা বাড়ি ছেলেমেয়েরা হট্টগোল করলো আর তুই টেরই পেলি না?’ আসলেই হেনা আপা যখন পড়তেন তখন তার ঘরে কেউ ঢুকলেও তার মনোযোগে কোন ভাঁটা পড়তো না।
ভারত ও পাকিস-ানের মধ্যে পাসপোর্ট ও ভিসা চালু হওয়ার পর কলকাতায় প্রক্রিয়া পরিচালনা করার জন্য কলকাতায় যে অফিস চালু করা হলে তাতে কিছু লোক নিয়োগের প্রক্রিয়া আরম্ভ হওয়ায় আব্বা সেখানে দরখাস- করেন ও তিনি নির্বাচিত হয়ে কলকাতার ঐ ডেপুটি হাই কমিশন অফিসে যোগদান করেন। আমরা ঢাকার আমলিগোলাতে থাকি। আব্বা কলকাতাতে চলে যাওয়ার পর আমরা এখানেই থেকে গেলাম। আব্বার ইচ্ছা ছিল পররাষ্ট্র দপ্তরের অধীনে বিদেশে বেশী মাইনের চাকরী করে দেশে আমাদের রেখে গেলে তিনি কিছু বেশী অর্থ সঞ্চয় করতে পারবেন।
আব্বা কলকাতায় যাবার পর পরই মা বুঝতে পারলেন, আমরা যদি ঢাকার ঐ আবহাওয়ায় থাকি, তবে আমাদের উচ্চ শিক্ষা হবে না। বড়ভাই তখন বড় হয়ে উঠছে, পাড়ার ছেলেদের সাথে মিশে ও বখে যাবে। মা তাকে (এবং আমাকে) নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। তা’ছাড়া ঢাকার আমলিগোলার পঞ্চাশের দশকের পরিবেশে বড় আপার পড়াশুনা চালানো মোটেই সম্ভব হবে না। বরং পাড়ার উঠতি বয়সের ছেলেদের দাপটে হয়তো দুই-এক বছরের মধ্যে মেয়েকে বিয়েও দিয়ে দিতে হবে। তিনি দেখলেন ঢাকায় আমাদের যে সব আত্মীয়-স্বজন ছিল, তাদের কাছ থেকেও মা আমাদের উচ্চশিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে কোন সহায়তা পাবেন না। বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে মা সিদ্ধান- নিলেন যে আমাদেরকে এই পরিবেশে না রেখে কলকাতায় নিয়ে গেলে উচ্চশিক্ষা দেয়া সুবিধা হবে।
আমলিগোলার পরিবেশে আপাকে কোনদিন স্কুলে পড়াতে পারেননি মা। আপার বয়স তখন তের বছর। বাসার মৌলবীর কাছে আরবী ও উর্দু বেশ ভালভাবেই শিখে নিয়েছে আপা, স্মরণশক্তিও তার যথেষ্ট যথেষ্ট ভাল ছিল। এই সময় মা-র এক চাচাতো ভাই- দুলাল মামা আমাদের বাড়ি থাকতে এলেন- এখানে কিছুদিন থেকে ডিগ্রি পরীক্ষা দেবেন। তার কোন একটা পাঠ্যক্রমে উর্দু নিয়েও একটা পরীক্ষা দিতে হবে। আমাদের বাসায় থেকে তিনি পড়াশুনা করেন। একদিন উর্দুর কোন একটা পাঠ করার সময় আপা মামার ভুল ধরে দিলেন। একটি পাঠ থেকে অন্য পাঠ- এমন করে আপা তাকে উর্দু পড়ায় বেশ সাহায্য করে দিল।
দুলাল মামা আপার এ পারদর্শিতায় মোহিত হয়ে মাকে বললেন, ‘বু, কাজল তো ভালই পারে। আপনি ওকে পড়াশুনা করান না কেন।’
মা চারপাশের পরিবেশের কথা তুলে বললেন, ‘এখানে থাকলে তো ওকে স্কুলে দিতে পারবো না।’
মামা বললেন, ‘স্কুলে পাঠাতে পারছেন না তো ঠিক আছে, এক কাজ তো করতে পারেন, ওকে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়াতে তো পারবেন।’
মা মুখ কালো করে বললেন, ‘সেটাই বা কে করে বল্। আমি কোথায় দৌড়াদৌড়ি করবো?’
মামা বললেন, ‘ঠিক আছে, আমিই ব্যবস’া করে দিচ্ছি।’
কিছু দিনের মধ্যে দুলাল মামা দশম শ্রেণীর বইপত্র জোগাড় করে নিয়ে এসে আপাকে দিয়ে বললেন পড়তে। তিনি নিজেও তাকে বেশ সহায়তা করতে লাগলেন।
কিন’ সমস্যা দেখা দিল যখন মা আপাকে নিয়ে স’ানীয় একটি গার্লস স্কুলে নিয়ে গেলেন নাম রেজিস্ট্রি করাতে। আপার বয়স তখন চৌদ্দও পার হয়নি। সে সময়ে কমপক্ষে পনেরো বছর পার না হলে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় নাম নিবন্ধন করা হতো না।
তাছাড়া নাম রেজিস্ট্রি করতে হয় নবম শ্রেণীতে, মা যখন আপাকে স্কুলে নিয়ে গেছেন তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার মাত্র চার মাস বাকি। এ নিয়ে প্রধান শিক্ষিকাকে নানাভাবে মা রাজী করাতে চেষ্টা করলেন। মহিলা কিছুতেই রাজী হবেন না।
শেষে মহিলা ধারণা করলেন, মা তার মেয়েকে কোন ভাল জায়গায় বিয়ে দেবেন বলে প্রমাণ করতে চাচ্ছেন যে মেয়ে বিবাহযোগ্যা- সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে।
যাই হোক মাত্র চার মাস আগে কোনক্রমে নাম নিবন্ধন কার্যক্রম নিবিঘ্নে শেষ হলো। আপাও পড়াশুনাতে আরও মনোনিবেশ করলো।
এর মধ্যে আমাদের ফুফু গ্রাম থেকে বেড়াতে এলেন আমাদের বাসায়। তাদের কাছে মেয়েদের স্কুলে পড়া মোটেই গ্রহণযোগ্য কাজ না। আপা পড়তে বসলেই তিনি নানা অজুহাতে পড়া থেকে আপাকে বিরত রাখতে সচেষ্ট হলেন। মা তার এই ননদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারতেন না এই মনে করে যে মা-র শ্বশুর বাড়িতে কোন অপ্রীতিকর অবস’ার সৃষ্টি হতে পারে, আবার তার এই কার্যকলাপ সহ্যও করতে পারছিলেন না।
ফলে পরীক্ষার আগের প্রস’তি মোটেই ভাল হলো না আপার। তবু মা জেদ ধরে আপাকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে গেলেন, ফুফুর শত আপত্তি সত্ত্বেও।
অবাক বিষয় পরীক্ষার ফল বের হতে দেখা গেল আপা দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছে। বহিরাগত ছাত্রী হলেও ঐ বিদ্যালয়ে তিনিই ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণী পাওয়া প্রথম ও একমাত্র ছাত্রী। আশ্চর্যের বিষয় আমি যখন কলকাতা থেকে স্কল ফাইনাল পরীক্ষা দেই, সেবারও ঠিক এমনই ঘটনা ঘটেছিল। েবইয়ের অন্যখানে না হয় বল যাবে এটা।
এ সময়ে একদিন, কার মুখের থেকে তা’ বলতে পারবো না, একটা ছড়া শুনলাম। ছড়াটা শুনেই খুব ভাল লেগে গেল আর প্রায় সাথে সাথেই মুখস- হয়ে গেল:
ইন্দি, বিন্দি, সিন্দি উঁকি মারে গাছের আড়াল থেকে
একদিন নিশিভোরে গাইছিল কে গান তাই শুনে ইন্দি-বিন্দির উড়ে গেল প্রাণ।
ইন্দির ক্ষিধে পেল গাছ থেকে নেমে এলো
খিচুড়ি খাবে বলে কাঁদিল রে। মা এসে দু’ঘা দিল
খাওয়া তার ঘুচে গেল রাগ করে ইন্দি-বিন্দি শুতে গেল রে।
পরবর্তীতে কোন বইতে, কিংবা অন্য কোনখানে কারও মুখে এ ছড়াটা শুনিনি। এ ছড়াটার সূত্র কি, কার লেখা কিছুই জানি না। অথচ এ ছড়াটা আমাদের ভাই বোনদের মধ্যে খুব প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। আজও এতবছর পরও ছড়াটা আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
শিশু বা কিশোরকালের একটা ছড়ার কথা বলতে গিয়ে আরও দু’টি ছড়ার কথা মনে পড়ে গেল।
প্রথম ছড়াটা এরকম:
‘নাড়- রে, বুড়ু রে, আম কুড়াতে গেল রে, আম না পেয়ে দিলো, ধপাস!’
আমাদের বংশের শিশুদেরকে নিয়ে তিন মাস থেকেই এই খেলাটা করা হতো। ছড়াটার লাইনগুলি বলতে বলতে বাচ্চার হাতদুটি আর পাদুটি একটা একটা করে হাতের মুঠার ভেতর ধরা হতো আর ”ধপাস” শব্দটা বলেই অন্য হাত দিয়ে হাত-পা ধরে থাকা হাতের ওপর চাপড় মেরে বাচ্চাটার হাত-পা একসাথে ছেড়ে দেয়া হতো। ফলে এই আকস্মিকতায় বাচ্চাটা চমকে উঠতো। এই চমকে ওঠাটা বাচ্চার বেড়ে ওঠাতে সহায়তা করতো বলে অনেকের কাছে আমি শুনেছি।
দ্বিতীয় ছড়াটিও আমাদের বংশে খুবই প্রচলিত ছিল। ছড়াটির আবৃত্তিকারী পুরুষ বা মেয়ে নিজে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে হাঁটু ভাঁজ করে ছ’মাসের চেয়ে বড় বাচ্চাকে নিজের দুই পা এক করে পায়ের পাতার ওপর বাচ্চাটাকে বসাবে, বাচ্চার মাথা থাকবে হাঁটুর কাছে। এরপর হাঁটু বুকের কাছে কাছে টেনে এনে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে একটা দোলানির ছন্দ আনতে হবে ছড়ার ছন্দের সাথে মিলিয়ে। বাচ্চা যেন পড়ে না যায়, তাই দুই হাত দিয়ে ওর কাঁধ ধরে ছড়াটি বলতে হবে।
ঘুঘু সই, তোর পুত (পুত্র) কই? আমের ডালে, জামের ডালে।
কি কাম করে? পিঁড়ি চাঁছে।
পিঁড়ি কি হবে? বউ বসবে।
বউ কোথায়? পানি আনে।
পানি কি হবে? ঘোড়া খাবে।
ঘোড়া কোথায়? মাঠে গেছে।
মাঠ কোথায়? পুড়ে গেছে
ছাই কোথায়? ধোপা নিয়েছে
ধোপা কোথায়? কাপড় কাঁচে।
ধোপার নাচন, কাপড় কাচন।
(শেষ লাইনটি কয়েকবার বলে ছড়া শেষে হবে।)
আমি পরে বহু পরিবারের সাথে মিশেছি, কিন’ এমন ছড়া আর কোন পরিবারে শুনিনি। আমি বলতে পারবো না, আর কারো এই ছড়া বা এমন কোন ছড়া সম্পর্কে কোন তথ্য জানা আছে কি না।
আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ট প্রতিবেশী ছিলেন এক পরিবার। স্বামী-স্ত্রী আর পাঁচ মেয়ে। আমরা থাকতে থাকতেই মহিলার আর একটা সন-ান হলো, সেটাও মেয়ে। দরিদ্র পরিবার, অথচ একটা পুত্র সন-ানের আশায় স্বামী-স্ত্রী বার বার এক্সপেরিমেন্ট করে যাচ্ছিলেন। পরিচিত অপরিচিত বিভিন্ন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের নিকট থেকে আনা পানি-পড়া নিয়ম মেনে খাওয়া, হাতে-কোমরে একাধিক তাবিজ পরে থাকার পরও তাদের মেয়ে হওয়া বন্ধ হয়নি।
ওদের সাথে আমাদের পরিবারের বেশ ঘনিষ্টতা হয়ে গিয়েছিল। তৃতীয় মেয়েটার সাথে আপার বেশ খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। একদিন মা ওদের বাসায় গিয়েছেন, আপা আর আমিও সাথে গিয়েছি। আপার গায়ে একটা নতুন ফ্রক। নানা গল্পের মধ্যে আপার বান্ধবী ওর মাকে বললো, ‘মা দেখ কাজলের গায়ে কত সুন্দর জামা।’ ওর মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন,‘ হ্যা, মা। কাজলের মায়ের কি, ওর একটা মাত্র মেয়ে, এক গজ কাপড় কিনে একটা জামা বানাতে পারে। কিন’ আমার একটা জামা বানাতে গেলে ছয় গজ কাপড় কিনতে লাগবে।’
আমার বয়স তখন চার কি পাঁচ। ভাল করে সব কিছু বোঝার বয়স হয়নি তা’ সত্ত্বেও সেই মহিলার কষ্ট সেদিন আমাকেও স্পর্শ করেছিল। আজ ষাট বছর পরও সেই কথা আমাকে তাড়িত করে।
আমরা কলকাতায় চলে আসার পর জানতে পেরেছিলাম, ছেলে সন-ানের আশায় মিলু মিয়া কোন এক বড় প্রসিদ্ধ পীর সাহেবের দ্বারস’ হন। যিনি তার চল্লিশোর্ধ পুত্রের জন্য মিলু মিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী চতুর্থ কন্যাটিকে চেয়ে বসেন, যদিও তখনও মিলু মিয়ার বড় তিন মেয়ের বিয়ের ব্যবস’া হয়নি।
পুত্রধনের আশায় মিলু মিয়া সেই অসম বিয়েতে রাজী হলেও তার পরবর্তী সন-ান কিন’ মেয়েই হয়েছিল। মিলু মিয়ার স্ত্রীর জীবনের সবচেয়ে দুঃখময় ঘটনা হলো, যে সময় মিলু মিয়া মারা যান, সে সময় মিলু মিয়ার স্ত্রী গর্ভবতী ছিলেন। ঈশ্বরের কী নির্মম পরিহাস! মিলু মিয়ার মৃত্যুর পর কোন তাবিজ-কবজ-পানিপড়া-পীরের কাছে যাওয়া, সবকিছু ছাড়াই মিলু মিয়ার সেই সর্বশেষ সন-ান পুত্র হয়েছিল।
আমাদের বাসার পাশের বাড়িতে নূর মোহাম্মদ নামে এক যুবক তখনকার রেডিও পাকিস-ানে স্ক্রিপ্ট রাইটার বা কপি এডিটর পদে কাজ করতেন। মা-র মুখে শুনেছি, তিনি কবি জসিমউদ্দিনের হাতের লেখা ভালভাবে পড়তে পারতেন বলেই বিশেষ করে তার চাকরীটা পাকা ছিল। তিনি আব্বা ও মাকে যথেষ্ট সম্মান করতেন।
তখন আমার চার কি পাঁচ বছর বয়স, পাড়ার অনুষ্ঠানে আমার আবৃত্তি শোনার পর তিনি একদিন মা-র কাছে এসে আমাকে রেডিওর ছোটদের আসরে যোগ দেয়ার অনুরোধ করলেন। সে সময়ে রেডিওতে অনুষ্ঠান করার মতো বয়স্কদের সংখ্যাই ছিল নিতান-ই দুষ্কর, তার ওপর তো ছোটদের। মা তো এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন।
আমার ভাল মনে নেই- তবে রেডিওতে ছোটদের আসরে আমি বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠান করেছিলাম। অনেক দিন পর আব্বা একদিন তার ট্রাঙ্ক থেকে বের করে আমাকে দেখিয়েছিলেন আমার নাম লেখা রেডিও পাকিস-ানের ঢাকা কেন্দ্রের একটা কন্টাক্ট ফর্ম। সেই সময়ে এক একটা অনুষ্ঠান করে আমি পাঁচ টাকা সম্মানী পেতাম। এর কিছুদিন পরই মা আমাদেরকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার প্রস’তি নিলেন। কলকাতায় চলে যাওয়ায় আমার রেডিও শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার আর সুযোগ থাকলো না।
কলকাতার পথে ১৯৫৩
আমার মা ছিলেন তার বংশের সবচেয়ে বড় মেয়ে এবং সবার খুব আদরের। এটা অবশ্য তার ছোট দুই বোন খুব একটা সহজভাবে নিতো না। সবচেয়ে বেশি হিংসা করতেন মা-র ছোট বোন। তার অন্য একটি কারণ ছিল।
আমার নানা হঠাৎ করেই তার ছোট মেয়েকে অত্যন- অল্প বয়সে, মাত্র তের বছর বয়সে, এক মধ্যবয়সী ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে দেন। ভদ্রলোকটির পূর্বের স্ত্রীর ঘরে এক ছেলে ও তিন মেয়ে ছিল। মহিলা পক্ষাঘাতে আক্রান- হয়ে পড়লে সেই ভদ্রলোক খালাকে বিয়ে করেন ছেলে-মেয়েদের দেখাশুনা করার জন্য।
ছোট খালার যখন বিয়ে হয় তখন খালুর বড় ছেলেটির বয়স তার নতুন মা-র চেয়ে তিন-চার বছরের ছোট ছিল। খালুর সন-ানরা এই নতুন মাকে খুব সহজভাবে নিতে পারেনি। যদিও তারা এই নতুন মা-র সাথে কোন বিরোধে জড়ায়নি। এরা তার সৎ মায়ের তুলনায় আমার মার সাথে পরিচিত হওয়ার পর তাকে খুব পছন্দ করতো এবং প্রায়ই মা-র কাছে চলে আসতো, বিশেষ করে বড় ছেলেটি। খালুর প্রথম স্ত্রী মারা গেলে বড় ছেলে রেজাউর রহমান ওরফে বাদল মাকে ‘মা’ বলে ডাকতো, সবার সামনে বলতো, ‘তুমিই আমার মা’। আর এ বিষয়টিও আমার ছোট খালা মোটেই পছন্দ করতেন না।
আমরা যখন ঢাকার আমলিগোলা থাকতে লাগলাম, তখন আমার নানা আর আমাদের বিভিন্ন বয়স্ক আত্মীয়-স্বজন আমাদের বাসায় মাঝেমধ্যেই বেড়াতে আসতেন। তারা সম্পদশালী খালার বাসায় থাকার চেয়ে আমাদের বাসায় থাকা বেশি পছন্দ করতেন আব্বার সহজ ও ভক্তিপূর্ণ ব্যবহারের কারণে। এটা ছোটখালার মনঃপূত হতো না। কিন’ যখন বাদল ঘন ঘন আমাদের বাসায় আসতে থাকলো, তখন ছোট খালা আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে নানা কটু কথা ছড়াতে থাকলেন, বিশেষ করে এ কথাটা বেশি ছড়িয়ে পড়লো যে, মা খালুর ছেলেকে নানাভাবে ‘পটাচ্ছেন’ যাতে তিনি তার মেয়েকে বড়লোকের ঘরের বৌ করতে পারেন।
কথার সূত্রপাত অবশ্য হয়েছিল ছোটখালার বিয়ের পর আমার নানার মাধ্যমে, তিনি প্রায়ই রসিকতা করে বলতে থাকলেন এই দুই নাতি-নাতনীর বিয়ে দিলে ভাল হয়। এ ধরনের কথা সে যুগে প্রায় সব পরিবারের নানা-দাদারা বলতেন, অনেক ক্ষেত্রে রসিকতা করতে, অনেক সময় গুরুত্বসহকারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা কেবল কথার-কথাতেই থেকে যেত, মাঝে মধ্যে অবশ্য ছেলে-মেয়ের বাবা-মায়েরা সেটাকে বাস-বে রূপ দিতেন বয়ষ্ক অভিভাবকদের কথাকে গুরুত্বসহ নিয়ে।
কিন’ বিষয়টা চিরচরিত বড়লোক-গরিবলোক সংঘাতে রূপ নিয়েছিল। আত্মীয়দের মধ্যে খালার ক্রমাগত বিষোদ্গার এক সময় এমন রূপ ধারণ করলো যে, আব্বা ও মার মধ্যেও অশানি-র সৃষ্টি হলো। শেষে মা রাগ করে ঢাকা ছাড়ার পরিকল্পনা নিলেন, যাতে এই বদনামের হাত থেকে তিনি তার মেয়েকে দূরে সরিয়ে রাখাতে পারেন।
মা তার সমস- পরিকল্পনার কথা আব্বাকে না জানিয়ে সন-ানদের নিয়ে কেবল কলকাতায় বেড়াতে যাচ্ছেন এমন একটা ভাব দেখিয়ে আমাদের সবাইকে নিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
দীর্ঘ পথ ঢাকা থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট, সেখান থেকে যমুনা নদী পার হয়ে আবার ট্রেনে উঠে বাংলাদেশের হিলি সীমান- ফাঁড়ি, এখানে এ পারের শুল্ক কর্মকর্তাদের শ্যেন দৃষ্টি পার হয়ে ওপারে ভারতের গেদে সীমান- ফাঁড়িতে একই রকম শুল্ক কর্মকর্তার অত্যাচার পেরিয়ে তবে ওপারের ট্রেনে চড়ে কলকাতায় যাওয়া। তখনও পাসপোর্ট-ভিসার অনুসঙ্গ পুরোপুরিভাবে চালু হয়নি। কিন’ কাস্টমস্-এর যন্ত্রণা আরম্ভ হয়ে গেছে, কেবল দুর্বল আর অসহায় মানুষদের উত্যক্ত করে ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিল করার উদ্দেশ্যেই।
উনিশ শ’ তিপ্পান্ন সালে তিন জন নাবালক সন-ান নিয়ে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সের একজন স্বল্পশিক্ষিত মফস্বলের বাসিন্দা, মা সম্পূর্ণ অজানার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে কী রকম যে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, সে কথা ভাবলে আজও আমাকে অবাক করে দেয়।
সন-ানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার উদগ্র বাসনায় কী অপরিসীম দুঃসাহসিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন আমার মা ভাবতে আজও আমি শিউরে উঠি। তিনি তখনও জানতেন না তার স্বামী তাকে কলকাতায় আদৌ তার সেই পরিকল্পনা বাস-বায়নে সহযোগিতা করবেন, না কয়েকদিন কলকাতা ভ্রমণের পর আবার পাঠিয়ে দেবেন ঢাকায়। ভাবতে অবাক লাগে মা কিন’ তার স্বামীকে না জানিয়ে ঢাকার সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়েই কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন।
অবশ্য আমাদের এই প্রায়-অনিশ্চিত এ যাত্রায় আমাদের সঙ্গী হয়েছিলেন ছোটখালুর বড় জামাই মহিউদ্দিন আহমদ সাহেব। এই ভদ্রলোক আব্বা ও মাকে অসম্ভব রকমের পছন্দ করতেন এবং ঢাকার আমলিগোলার বাসায় প্রায়ই এসে আব্বা আর মায়ের সাথে গল্পগুজব করতেন, দুলাভাই হিসেবে আমাদের সাথেও নানা রকম রসিকতা করতেন।
মহিউদ্দিন সাহেব পরে পূর্ব পাকিস-ান সরকারের তথ্য ও প্রকাশনা বিভাগের অনেক বড় পদে আসীন হয়েছিলেন। তিনি অত্যন- বড় মাপের সাহিত্যিক ছিলেন এবং অত্যন- ভাল অনুবাদকও ছিলেন। পাকিস-ান আমলে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের আনুকূল্যে তাঁর অনেকগুলো অনুবাদগ্রন’ প্রকাশিত হয়েছিল। তার একটি ছিল এডগার এলান পো-র ছোটগল্প। সম্ভবত এটাই বাংলা ভাষায় এডগার এলান পো-র ছোটগল্পের অনুদিত প্রথম গ্রন’।
মহিউদ্দিন সাহেব নিজের উদ্যোগে ঢাকা থেকে হিলি সীমান- পর্যন- আমাদের যাত্রাসঙ্গী হয়েছিলেন। এমন কি যতক্ষণ না পর্যন- তিনি আমাদের নিতে ওপারে আব্বার উপসি’তি দেখে নিশ্চিন- হলেন ততক্ষণ পর্যন- সীমানে-র পাকিস-ান অংশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
পরবর্তীকালেও তার মৃত্যু পর্যন- তার সাথে আমাদের ঘনিষ্টতা অটুট ছিল। তিনি অকালে মৃত্যুবরণ করেন। আমি তখন যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজে বিএ ক্লাসের ছাত্র। তার মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে ঢাকায় তার অফিসে আমার একবার দেখা হয়েছিল, সম্ভবত সেই শেষ বার। তিনি আমার পড়াশুনার খোঁজ নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, পরীক্ষা দিয়েই যেন আমি তার সাথে দেখা করি। আমাকে নিয়ে তার একটা পরিকল্পনা ছিল হয়তো, তা’ আর আলোর মুখ দেখতে পেলো না। আমার জানা মতে, তিনি একজন অতি বড় ও ভাল মনের মানুষ ছিলেন।