কোলকাতা ও কোলকাতা ১ * সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান

কোলকাতা ও কোলকাতা ১

নিজেকে নিয়ে কিছু কথা

আমি নিজেকে নিয়ে, অর্থাৎ আত্মজৈবনিক কিছু লিখবো, এ রকম কথা কোনদিনই মাথায় আসেনি। যদিও আমার লেখালেখির বয়স পঞ্চাশ বছর আর এ কাজ হয়েছে তিন ধাপে।
প্রথম ধাপের লেখালেখি আরম্ভ করেছিলাম একেবারে ছেলেবেলা থেকেই, ৬০-এর দশকের একেবারে শুরুর দিকে। তখন আমার বয়স বার-চৌদ্দ হবে। কিন’ সে সব ছিল একেবারেই পাগলের প্রলাপ। ওগুলোর বেশ কিছু আমার নিজের গাফিলতিতে আর অব্যবস’াপনায় নষ্ট হয়ে গেছে, আর বাকীগুলো, বেশ পরে, যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, পড়তে গিয়ে ওর ভেতর অসারতা লক্ষ্য করে নিজেই ছিঁড়ে নষ্ট করে ফেলেছিলাম।
দ্বিতীয় ধাপে, ১৯৬৫-৬৬ সালের দিকে যশোর ইনস্টিটিউটের সাহিত্য বাসরে যাতায়াত আরম্ভ করার পর আবার লেখালেখি করতে লাগলাম। সেগুলো মাঝে মধ্যে স’ানীয় পত্রিকায় প্রকাশ হতে থাকে। যারা সেগুলো পড়তো, তারা বলতো, আমার ভেতরে শক্তি আছে, আমি যেন লেখা চালিয়ে যাই। কিন’ সেগুলোরও অসি-ত্ব নেই হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বাড়ি লুট হয়ে যাওয়ার কারণে। আমার বিশাল ডাকটিকিট ও মুদ্রার সংগ্রহের ভাণ্ডারও ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের ৬ তারিখে যশোর শহর মুক্ত হওয়ার পর বাসায় ফিরে খুঁজে পাইনি। নিদারুণ অভিমানে লেখালেখির পাট চুকিয়ে দিয়েছিলাম।
তা’ছাড়া সে সময়টা, অর্থাৎ স্বাধীনতাত্তোর দশটা বছর আমার জীবনের দ্বিতীয় মশীলিপ্ত অধ্যায়। যেমন আমার প্রথম মশীলিপ্ত অধ্যায় ছিল উনিশ শ’ সাতান্ন থেকে পঁয়ষট্টি, আমার স্কুল জীবনটা। আর স্বাধীনতাত্তোর সময়ের কথা পরে কোনও এক সময় না হয় বিস-ারিত বলা যাবে।
দ্বিতীয় ধাপের লেখালেখি সময়ের আলোকময় দিক হলো, এ সময়ে আমি একটা পত্রমিতালী পত্রিকা ‘প্রাচ্যবানী’ (অংরধহ ঠড়রপব) প্রকাশ করতাম, যা অল্প সময়ে অত্যন- জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এ সময়টা অর্থাৎ ষাটের দশকে কিশোর-যুবকেরা পত্রমিতালী ও নানা প্রকার সংগ্রহ-দ্রব্যের (পড়ষষবপঃরনষবং) প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল। প্রতি দশজনের মধ্যে ছয়-সাতজনই দেশে-বিদেশে পত্রমিতালী করতো আর ডাকটিকিট, ম্যাচবাক্সের লেবেল, সিগারেটের খোল, ভিউকার্ড, ধাতব মুদ্রা প্রভৃতি জমানোর প্রতি বিপুলভাবে আকর্ষিত ছিল।
আমার পত্রমিতালী পত্রিকা, তাই অল্প সময়ের মধ্যেই অত্যন- জনপ্রিয় হয়ে পড়েছিল। বিশ্বের প্রায় সকল দেশে এর গ্রাহক গড়ে উঠেছিল আর এ কারণে প্রতিদিনই আমার নামে প্রচুর চিঠিপত্র আসতো। যে দিন চিঠি থাকতো না, সেদিনও পোস্টম্যান বাসায় এসে বলে যেত যে আজ আমার কোন চিঠি নেই। তেমন চিঠি না আসার দিনের সংখ্যা ষাট ও সত্তর দশকে খুব কমই ছিল।
যদি এ পত্রিকাটাকে আমি টিকিয়ে রাখতে পারতাম, তবে এটা একটা লাভজনক প্রকল্প হিসেবে পরিণত করা যেত। পরবর্তী জীবনে এটা হয়তো আমার পেশা হিসেবেও পরিণত করা যেত। যদিও আমার বাড়ির লোকজন এইসব কাজের প্রবল বিরোধিতা করে এসেছিল এবং নিতান- কৈশোরিক ক্রীড়া বলে মনে করে অন্য কোন যৌক্তিক কাজে মনোনিবেশ করতে বার বার চাপ প্রয়োগ করতো। আশির দশকের প্রথম ধাপে আমি কেবল আর্থিক অনটনের কারণে এটা চালাতে অপারগ হয়ে যাই।
তৃতীয় দফা লিখতে আরম্ভ করলাম ১৯৮০ সালে ঢাকায় এসে চাকরীতে ঢোকার পর। এ সময় আমি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র আর বাংলাদেশ কথাশিল্পী সংসদের সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কথা আমাকে জানিয়েছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। ঢাকায় আসার কয়েকদিন পরই আমি একদিন পল্টনের মোড়ে অবসি’ত বিটপি এডভার্টাইজারর্স-এর অফিসে হাজির হয়েছিলাম অস্কার ওয়াইল্ডের ‘লেডি উইন্ডারমেয়ারস্‌ ফ্যান’ নাটকটির অনুবাদ হাতে নিয়ে। রামেন্দু মজুমদারকে দেখিয়ে ওটা ওরা মঞ্চস’ করবেন কিনা জানার জন্যে। রামেন্দু মজুমদার আমাকে সরাসরি মুখের ওপর ‘না’ না বলে, আমাকে বলেছিলেন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে যাতায়াত করতে। ওখানে যাওয়ার ফলে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাঈদের সাথে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্টতা হয়।
তখন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ভোরবেলা। সবে ওটা সংগঠিত হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে রবিবারে ঢাকা কলেজের পেছনে সাহিত্য আসর বসে। তখন সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার হয়নি। বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন বইয়ের ওপর আলোচনা হয়, তর্ক-বিতর্ক হয়। এক গুচ্ছের উঠতি সাহিত্যিকদের সাথে ঘনিষ্টতা হয়ে গেল। যাদের অনেকেই পরে এই ধারা থেকে ছিটকে সরে চলে যান। তবে এখনও যারা এর সাথে জড়িত, তাদের মধ্যে আহমাদ মাজহার বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। বাকী দুই একজনের সাথেও আমার কিঞ্চিত যোগাযোগ আছে।
অন্যান্যদের মতো আমিও আবদুল্লাহ আবু সাঈদ সাহেবকে ’স্যার’ বলে সম্বোধন করতাম। তাঁর স্ত্রী প্রায়ই সাহিত্য সভায় উপসি’ত থাকতেন। অচীরেই ওঁদের দুজনের সাথে আমার বেশ ঘনিষ্টতা গড়ে উঠেছিলো।
একদিন সাঈদ স্যার জানালেন কেন্দ্রের জন্যে বেশ কিছু বই উপহার হিসেবে পাওয়া গেছে। সেটাই মনে হয় কেন্দ্রের প্রথম বড় ধরনের উপহার পাওয়া। ওগুলো গুছিয়ে দেয়ার জন্য আরও দুই-এক জনের সাথে আমাকেও ডাকলেন স্যার তাঁর বেইলি ডাম্প কলোনীর বাসায় যেতে। সাঈদ স্যার তখন ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করেন। সরকারী চাকুরীর কারণে সম্ভবত তার এই সবকারী কোয়ার্টার।
গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড! কেবল রান্নাঘর আর টয়লেটের মেঝে বাদ দিয়ে সারা ফ্ল্যাটের সব যায়গায় গাদা-গাদা বই, স’প হয়ে আছে। আমরা বহুক্ষণ ধরে বইগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলাম। এ সময়ে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কোন স’ায়ী ঠিকানা ছিল না।
বছরখানিক পরে ইন্দিরা রোডে এটা বিশাল বাড়ি ভাড়া নিয়ে ওটার আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটলো। প্রতি সপ্তাহে ওখানে গল্প করতে আসতেন নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান, আবুল হায়াত- আরও কত মানুষ। অল্প কিছু দিনেই আমি সাহিত্য অঙ্গনে বেশ একটু শক্ত অবস’ান নিতে আরম্ভ করেছি।
কিন’ তারপর আবার ছিটকে পড়লাম। এ সময়ে পারিবারিক চাপে বিয়ে করতে হলো। তখন অল্প বেতন পাই। আমার বিয়ের ছয় মাস আগে আমার ভাগ্নীর বিয়ে হওয়ার কারণে আমাকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়েছিল, তাই আমার হাতে কোনও সঞ্চয় ছিল না। নতুন সংসারে হাজার রকম সমস্যা দেখা দিলো, এক বছর যেতে না যেতে বাসায় আমাদের নতুন অতিথি, আমাদের একমাত্র সন-ান, সায়েম মাহমুদ এলো। তাকে সঠিক সমাদরের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় সামলাতে হতো। আমার কর্মস’ালেও বিভিন্ন বিরুদ্ধ স্রোতের সাথে আমার সংগ্রাম করতে হচ্ছিল।
নানা জটিলতায় পড়ে আমি একেবারে দিশেহারা হয়ে গেলাম। যেমন করে আমার ‘প্রাচ্যবানী’ পত্রিকার বিপুল জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেও আছাড় খেয়ে পড়েছিল। তেমনি এবারও সাহিত্যের আসরে নিজের অবস’ান সি’র হতে না হতেই আবার আছাড় খেলাম। সম্ভব হলে সে কথা আর এক দিন বলবো।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রেই খবর পেলাম বাংলাদেশ কথাশিল্পী সংসদের সাহিত্য বাসরের কথা।
কথাশিল্পী সংসদের সাপ্তাহিক গল্পপাঠের আসর বসতো প্রতি রবিবার বিকেলে রমনা পার্কের সবুজ ঘাসের ওপর। সংসদের মূল সঞ্চালক ছিলেন নুরুল ইসলাম খান। তার সাথে সহযোগী ছিলেন শহীদ আখন্দ।
প্রতি আসরে দশ-বারজন নানা বয়সের সাহিত্যপ্রেমী এসে জুটতো এখানে। সবার কাছে আসরের খবর পৌছানো হতো পোষ্টকার্ডে। যারা আসতো তারা সঙ্গে করে আনা গল্প পড়তো। আর সঞ্চালকসহ দুইজন বিচারক তাৎক্ষণিক বিচার করতেন কার গল্প প্রথম বা দ্বিতীয় হয়েছে। প্রথম পুরষ্কারপ্রাপ্ত গল্প দুই শ’ টাকা আর দ্বিতীয় জনকে এক শ’ টাকা পুরষ্কার দেয়া হতো।
আমি প্রথমে কয়েক সপ্তাহ কেবল শুনতেই যেতাম। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে আমি পাঠক আর আলোচক হয়েই খুশি থাকতাম। কিন’ এক সময়ে মনে হলো দেই না দুই-একটা গল্প লিখে। দেখি আমার লেখার মান কেমন। আসরে এক বছরে আমার ছয়টি গল্প প্রথম পুরষ্কার পায় আর এ বাবদে আমি ছয় দু’গুণে বার শ’ টাকা পুরষ্কারও পেয়েছিলাম।
কথাশিল্পী সংসদের ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত সাহিত্য আসরে পুরষ্কারপ্রাপ্ত গল্পগুলো নিয়ে ১৯৯৫ সালে গ্লোব লাইব্রেরী থেকে ‘বাংলাদেশের ছোটগল্প’ নামে ৫১৫ পৃষ্ঠার একটি সংকলন বের হয়। এই সংকলনে আমার একটি গল্প স’ান পেয়েছিল।

১৯৮৭ সালে আমার প্রথম বই বের হয়। সে বইটা অবশ্য সাহিত্যের কোন বিষয় না, সেটা বাংলাদেশের ডাকব্যবস’ার বিবর্তন নিয়ে লেখা প্রথম গবেষণাভিত্তিক বই। তারপর অবশ্য পর্যায়ক্রমিকভাবে বেশ কয়েকটা বই বের হয়। মজার বিষয়, অধিকাংশ লেখকের নাম পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও আমার কোন লেখা কোনদিনই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। অজ্ঞাত কারণে পত্রিকার সম্পাদকরা আমার লেখা তাদের পত্রিকায় ছাপাতেন না। আজও ছাপেন না। এর পর ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটা বই বের হয়।
মজার বিষয়, সাহিত্য বিষয়ে আমার প্রথম বই, দ্যফঁ দ্যু মরিয়ে বিরচিত ‘দি বার্ডস’-এর অনুবাদ ‘পাখি’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯১ সালে বাংলা একাডেমি থেকে। আমি বইটার পাণ্ডুলিপি একাডেমিতে জমা দিয়েছিলাম প্রায় বছর দুই আগে। আমি তখন কাউকে চিনি না, কেউ আমাকেও চেনেন না। অথচ একদিন আমাকে একাডেমি থেকে ডাক দিয়েছিল কন্টাক্ট সই করার জন্য। তারপর বইটা বের হয়ে গেল। সেই প্রথম আর আমার সাহিত্য জীবনে সেই শেষ বারের মতো আমি আড়াই হাজার টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলাম লেখার জন্য। তারপর ৪৮টা বই বের হলেও কোন প্রকাশকই আমাকে একটিও টাকা সম্মানী দেননি।
২০০৭ সালে নিতান- ঝোঁকের মাথায় ‘সে আমার গোপন কথা’ নামে একটা বই কম্পোজ করে এক প্রকাশককে দিয়েছিলাম প্রকাশ করতে। বইটাতে আমি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল অর্থাৎ আমার শিশুকাল থেকে কিশোর বয়সের কথা লিখেছিলাম। সেটাতে যে সময়ের কথা বলা হয়েছে, সে সময়ে, ১৯৫৭ সালে আর্থিক কষ্টের কারণে আর বাড়িতে এক নতুন অতিথি, আমার বড় আপার মেয়ে সোনালীর জন্ম হয়। তার অতিরিক্ত পরিচর্যার প্রয়োজনে বাবা আমাকে দীর্ঘদিন স্বুলের গণ্ডির বাইরে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। সে আমার ভাগনী নিতান- শিশু ছিলেন এবং তার কারণেই আমার পড়াশুনাতে বাধা পড়েছিল। যদিও আমার সেই সময়ে নিদারুণ অসুবিধায় তার সরাসরি কোন ভূমিকা ছিল না।
কিন’ সে বই পড়ে আমার ভাগনী এমনই ক্রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, যে আমাকে একদিন সামনে পেয়ে ‘ন ভুত ন ভবিষ্যত’ গালাগাল করলেন এবং শাসাতে থাকলেন তিনি পারিবারিক আদালতে আমার বিরুদ্ধে মামলা করবেন। অবশ্য তিনি সে পথে কেন যে হাঁটেননি তা’ বলতে পারবো না।
অর্থ-সম্পদে বা বাচনিক কর্মে সব দিক দিয়েই আমি তার চেয়ে নিতান- দূর্বল প্রকৃতির মানুষ ছিলাম। সে কারণেই সম্ভবত দয়া পরবস হয়েই তিনি আমার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস’া গ্রহণ করেনি। কিশোর বয়সের সেই সব কষ্টের দিনগুলোর কথা লেখাতে তিনি কেন যে অমন ভয়াবহ রকমের ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন, তা বলতে পারবো না।

আমার ভাগনী অতি অল্প সময়ের মধ্যে ‘নানা উপায়ে’ বিপুল অর্থ ও সম্পদের মালিক হয়ে পড়ায় তার চারপাশের নিম্নবিত্ত আত্মীয়দের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে আরম্ভ করেছিলেন। আর আমি অর্থ-সম্পদে নেহায়েতই নিম্নবিত্ত শ্রেণীর হওয়ায় তিনি আমাকে এড়িয়ে চলতেন। নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানে দেখা হয়ে গেলে, তিনি নানাভাবে আমাকে অপদস- ও উত্যক্ত করার চেষ্টা করতেন।
এর মধ্যে আমার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়ে যাওয়ায়, এই প্রতিযোগিতায় তিনি বেশ পেছিয়ে ছিলেন, অবশেষে তিনি তিনটি উপন্যাস প্রকাশ করে তাবৎ আত্মীয়-স্বজনকে সেই বই বিলিয়ে চরম আত্মপ্রসাদ লাভ করতে আরম্ভ করছিলেন। কিন’ এর মধ্যে আমার একমাত্র পুত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পর পর তিনটি বার্ষিক পরীক্ষায় খুব ভাল ফল লাভ করায় এবং ছেলেটি সকল আত্মীয়-স্বজনের বাসায় নিয়মিতভাবে দেখা-সাক্ষাতের কারণে আত্মীয়দের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। আর এ কারণে আমার সেই আত্মীয়াটি বিপুল মনোকষ্টে কালাতিপাত করছিলেন।

আমার প্রথম সাড়াজাগানো আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘সায়েম মাহমুদের নিষ্ফল দ্বৈরথ’ প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। উপন্যাসটিতে আমার একমাত্র সন-ানের জন্ম, বেড়ে ওঠা, বড় হওয়া আর একজন সত্যিকারের পবিত্র মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার শেষ ধাপে, মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে, ক্যান্সারের আক্রমণে আর আমার দু-একজন অতিবিজ্ঞ আত্মীয়ের হিংসা ও অবিমৃষ্যকারিতার ফলশ্রুতিতে যার তিরোধানে আমি এমনই বিপর্যস- হয়ে পড়েছিলাম যে, হয়তো নিজেকেই ধ্বংস করে ফেলতাম। কেন যে করিনি, বলতে পারবো না।
করিনি, তার অন্যতম কারণ হয়তো আমার স্ত্রী। ঐ অসহায় মহিলার পাশে দাঁড়ানোর মতো তখন আর কেউ ছিল না। এম.এস. পড়া একমাত্র সন-ান, যুবক ছেলে যার চলে যায়, মারা যায়, তার অবলম্বন আর কি কিছু অবশিষ্ট থাকে? তার তো কোমর ভেঙে যাওয়ার কথা। উঠে দাঁড়নো শক্তিটুকুও তিরোহিত হয়ে যায়।
এমন অবস’ায় সাধারণত চারপাশের আত্মীয়-স্বজনের মানসিক সহায়তায় ক্রমে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। এমন সময় শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-স্বজন, মানে ভাসুর-ননদের সন-ানরা তার অন্যতম অবলম্বন হয়ে ওঠে। না, অন্য অনেকের মতো আমার স্ত্রীকে কারো কোন দয়া বা আনুকূল্যে জীবন ধারণ করতে হতো না। সে যে চাকরী করে তার থেকে বেশ ভাল বেতন পায়, প্রতিষ্ঠানটিতে তার সম্মান ও প্রতিপত্তি অনেকেরই ঈর্ষার বিষয়।
তাই কারো আশ্রয়ে আশ্রিতা হতে হতো না তাকে। এমন একটি বেদনাদায়ক ঘটনার পর সাধারণত ভাসুর-দেবর-ননদের সন-ানরা পাশে প্রহরীর মতো এসে দাঁড়ায়। আমার স্ত্রীর দুর্ভাগ্য, দুর্ভাগ্য আমারও, না হলে যেখানে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র ও ভাগিনা এবং তৃতীয় প্রজন্ম আমাদের পাশে এসে বলবে, ‘আপনার একমাত্র সন-ান গেছে তো কি হয়েছে, আমরা আছি না? মনে করেন আমরাই আপনার সন-ান’। কিন’ সে সৌভাগ্য তো হয়নি, বরং তারা আমাদের দুজনকে বিষবৎ পরিত্যাগ করে রেখেছে।
ওদের ভবিষ্যতে লাভ ছাড়া ক্ষতি হতো না। আমার এফডিআর আছে, চল্লিশটার ওপর বই আছে, যার রয়ালটি কম কিছু হওয়ার কথা না, এক সময় তো পাওয়া যাবেই। আমার আর আমার স্ত্রীর যে টাকা জমানো আছে, তার অংশ তো আমাদের অবর্তমানে ওদেরই পাওয়ার কথা। আমরা বেঁচে থাকতেই তো দুটো ঈদ, জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী প্রভৃতি নানা অনুষ্ঠানে উপহারও তো নেহায়েত কম পেত না। বাচ্চারা দাদা-দাদী, নানা-নানীর কাছ থেকে অঢেল উপহার পেত, যদি ওরা আসা-যাওয়া করতো, খোঁজ-খবর নিতো।
কিন’ আমার ভ্রাতুষ্পুত্র, ভাগিনা আর নাতী আমাদের ছেঁড়া কাগজের মতো দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। কাছে এসে সান-না দেওয়া দূরে থাক, টেলিফোনেও একদিন খোঁজ নেয়নি, এখনও নেয় না।
আমার স্ত্রীর এই অসহায়ত্ব বুঝতে পেরেই আমার নিজের কোন অসঙ্গত কাজ করে ওঠা হয়নি। সে সময়ে আমার ভেতর থেকে এক অতিপ্রাকৃত তাগিদ অনুভব করেছিলাম আমার প্রয়াত সন-ানের কথা লেখার জন্যে। অবিশ্বাস্য দ্রুততায়, অল্প কিছুদিনের মধ্যে ১৪০ পৃষ্ঠার উপন্যাস তৈরী হয়ে গেল। ২০০৯ সালে বইটা প্রকাশের পর পাঠক সমাজে জনপ্রিয়তা পেল। যারা পড়লেন, তারা কেঁদে-কেটে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করলেন আমার কাছে। আমার প্রতি জানালেন তাদের অকৃত্তিম সমবেদনা, আমার
সন-ানের প্রয়াত আত্মার মাগফেরাতের জন্য ঈশ্বরের কাছে নিয়মিত প্রার্থনা করার প্রতিজ্ঞাও করলেন অনেকে। যা আমার অতি ঘনিষ্ট পরম আত্মীয়রাও করেননি।
আমি কেন এমন সত্যি কথা সোজাসাপটাভাবে লিখলাম আর তাদের ষড়যন্ত্র ও অসংঙ্গত কর্মকাণ্ডের কথা কেন প্রকাশ করে দিলাম এই রাগে অতি ঘনিষ্ট পরম আত্মীয়রা আমার সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন।

এতে আমার কোন ক্ষতি হয়নি, বরং লাভ হয়েছিল। কারণ তাদের বিভিন্ন অন্যায় আবদার চরিতার্থ করা আর ঈদ-পরবে বাণ্ডিল-বাণ্ডিল, দিসে–দিসে- উপহার কিনে দেওয়ার হাত থেকে আমি বেঁচে গিয়েছি। উপহার কিনে দেওয়াতে আমার তেমন কোন আপত্তি থাকার কথা ছিল না। কিন’ এক ঈদে লক্ষ্য করলাম আমার আপন বড় ভাই আমাকে অতি নিম্নমানের একটা পাঞ্জাবী দিলেন আর আমার স্ত্রীকে আমার এক আত্মীয়া ভাঁজ পড়া বহুব্যবহৃত পুরাতন শাড়ি উপহার দিয়েছেন, অথচ সে ঈদে আমাকে উপহার কিনতে হয়েছিল বড় বোন, বোনের একমাত্র কন্যা, জামাতা, এক নাতি ও এক নাতনি, বড় ভাই, ভাবী, তাদের দুই পুত্র, দুই পুত্রবধু, দুই পৌত্র ও দুই পৌত্রীর জন্যে। তবেই দেখুন এমন বিনিময় বাণিজ্যে কে আর আগ্রহী হবে?
প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি আমার আত্মজীবনীকে উপন্যাস বলছি কেন। উপন্যাস ছাড়া কি বলবো? আমার জীবনে একের পর এক যে সব ঘটনা ঘটেছে, সেটা কোন স্বাভাবিক মানুষের জীবনে ঘটে না। আমার মা তাঁর মৃত্যুশয্যায় আমাকে বলে গিয়েছিলেন, ‘তোর ওপর অনেক অবিচার হয়েছে, অনেক অন্যায় হয়েছে, যেটা হওয়া উচিৎ ছিল না। আমি তখন বুঝতে পারিনি।’
প্রকারন-রে মা তার ও আমার বাবার অক্ষমতার জন্য আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে গিয়েছিলেন- আমিও তাঁদেরকে মনে-প্রাণে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। যতই হোক, তাঁরা আমার জন্মদাতা বাবা আর মা, তাঁদের সকল অপরাধ মার্জনীয়।
কিন’ আমার আট বছরের বড় বোন, যার জন্যে আর যার মেয়ের জন্যে আমার জীবনের বিশাল বড় ক্ষতি হয়ে গেল, কিশোর বয়সে পাঁচ পাঁচটি বছর আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে থাকলো, তার জন্যে তাদেরকে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা করতে দেখিনি। এমন কি মুক্তিযুদ্ধের পর যখন সকলে আমকে বললো আবার পড়াশুনা আরম্ভ করো। আমি আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশুনা আরম্ভ করতে পারিনি, কারণ বাসায় অন্ধ বাবা, অসুস’ মা আর একা বোনের পাশে থেকে তাদের বাজার-ঘাট, পথ-মাঠ করার কেউ ছিল না।
আমার বড় ভাই তখন ক্যাডেট কলেজে অধ্যাপনা করেন। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে আনন্দের সংসার। সপ্তাহানে- বেড়াতে আসেন, সেটাই তার জন্য অনেক। সে সময়ও আমার জীবন থেকে ঝরে গেল আরও পাঁচটা বছর। এত সব কিছুতেও আমার এই ক্ষতির জন্য কোন অনুশোচনা করতে দেখিনি আমার বোনকে, কিংবা আর কোন আত্মীয়কে। একটি দিনও তাদেরকে এ নিয়ে কথা বলতে দেখিনি। বরং আমি কেন আমার বোনের সাথে আর তার মেয়ের সাথে যোগাযোগ করি না, তাদেরকে উপহার-সামগ্রী কিনে দেই না তার জন্য আমাকে গঞ্জনা শুনতে হয়েছে বহুবার।

অথচ আমি কেন আমার সন-ানের বড় হয়ে ওঠা আর তার চলে যাওয়ার কথা একটা সত্য অনুসন্ধানের লক্ষ্যে ‘সায়েম মাহমুদের নিষ্ফল দ্বৈরথ’ বইটা লিখলাম, তাঁর মেয়ের কুকীর্তির কথা বললাম, এই আক্রোশে তিনি আমার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলেন। এখন তো তার, তার ভাই আর তার মেয়ে আর ভাইপোদের সব চাওয়া-পাওয়া সম্পূর্ণ হয়ে গেছে, তাদের জীবন ভরে উপচে পড়ছে সম্পদে। এখন আমি তো ছেঁড়া কাগজ হবোই।
আমি কেন ও বইটা লিখবো না? আমাদেরকে মিথ্যে কথা বলে, ক্যান্সারের স্ফিতিকে ‘টিউমার’ আখ্যায়িত করে, ‘কেটে ফেললেই সেরে যাবে’ বলে সত্য গোপন করে, ভুল তথ্য দিয়ে, অন্য ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ না নিয়ে, কারো সাথে কোন আলাপ-আলোচনার সুযোগ না দিয়ে, আমার অতি ঘনিষ্ট আত্মীয়া, আমার ভাগনী, মামুলি একজন অর্থপেডিক্স সার্জনকে দিয়ে আমার সন-ানের কাঁধের ওপরের ক্যান্সারের স্ফীতিটা কেটে ফেলে দিল অল্প কয়েক ঘন্টার নোটিসে। আমি পাশে থাকা সত্ত্বেও সে নিজেই অত্যুৎসাহী হয়ে রোগীর অস্ত্রোপচারের সম্মতিপত্রে সই করে দিল।
তিনি এতবড় দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিজে নিজে তুলে নিলেও অস্ত্রোপচারের সকল ব্যয়ভার কিন’ ঠিকই আমার কাছ থেকে কড়ায়-গণ্ডায় অস্ত্রোপচারের আগেই আদায় করে নিয়েছিলেন। আমরা তার বাবা-মা, আমাদেরকে বলার প্রয়োজনই করলো না যে ছেলেটার কি রোগ হয়েছে। তার স্বামী, একজন বিজ্ঞ-বিশিষ্ট চিকিৎসক, আমাদেরকে বললো, ‘একটুখানি ফুলে উঠেছে, কাটলেই সেরে যাবে।’ চিন-া করুন, কতবড় প্রতারণা করলো সে আমার সাাথে! আমি তার মামাশ্বশুর, আমার সাথে সে প্রতারণা করলো?

সব লোক যখন বলেছে ক্যান্সারে আক্রান- রোগীকে তার কষ্ট লাঘবের জন্য উচ্চ মাত্রার পেইন কিলার দাও। তখন আমার বিজ্ঞ আত্মীয়া আর তার মহা বিজ্ঞ স্বামী আমার ছেলেটাকে তাদের বাড়িতে একা ফেলে রেখে পুত্র-কন্যা নিয়ে বেড়াতে চলে গেলো। অথচ, সে নিজেই আমার বাসা থেকে ‘ভাই আমার কাছে থাকবে, আমি কোলে করে রাখবো’, বলে ক্যান্সারের রোগীটাকে তার বাসায় নিয়ে গিয়ে রেখেছিলো। মৃত্যুর দু’দিন আগে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে রাস-ায় যে তেতুলের আচার বিক্রি হয়, সেটা কিনে নিয়ে খাওয়ালো আমার সেই বিজ্ঞ আত্মীয়া। এমন কতগুলো ঘটনার কথা বলবো?
আমার ছেলেটা সেই অপারেশনের মাত্র আট মাস পরে মারা যায়। এই আট মাসে আমার সেই আত্মীয়ার আচরণগুলো একটার পর একটা বয়ান করলে কয়েক শ’ পৃষ্ঠার বিশাল বড় একটা বই হয়ে যাবে। সে সময়ে আমাদের কিছু করার ছিল না।
আসলে, যখন শুনলাম আমার ছেলের ক্যান্সার হয়েছে, তখন আমরা সম্পূর্ণ নির্বোধের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। সুস’ভাবে চিন-া করার ক্ষমতা আমার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তখন আমার সেই আত্মীয়ার স্বামী, মেডিসিনের বড় অধ্যাপকের কাছে বার বার ছুটে গিয়েছিলাম পরামর্শের জন্যে, চিকিৎসার পরামর্শের জন্যে, আর্থিক সাহায্যের জন্যে না। তারা দুজনেই আমাদের সাথে প্রতারণা করে গেল সারাটা সময়।

আমার ছেলের সম্পূর্ণ চিকিৎসা আমার স্ত্রী আর আমার টাকায় করা হয়েছে। সাহায্যের জন্যে আমি কারো কাছে হাত পাতিনি। কাউকে বলিনি, আমাদের সাহায্য করো। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেইনি, ‘আমার ছেলের ক্যান্সারে আমাদের সহায়তা করো’। বরং আমার ছেলের বন্ধুরা ‘দৈনিক প্রথম আলো’র ‘বন্ধুসভা’ পৃষ্ঠায় ‘এই অত্যন- মেধাবী শিক্ষার্থীকে সহায়তা’ করার আবেদন প্রকাশ করেছিল, আমাদের না জানিয়ে।
দেশের মধ্যে থেকে তো বটেই, বিদেশ থেকেও আমার ছেলের একাউন্টে বেশ অনেক টাকা জমা পড়েছিল। সে টাকার কথা আমি জানতে পেরেছিলাম ওর মৃত্যুর পর। ও টাকা আমার সন-ানের চিকিৎসায় ব্যয় করতে হয়নি। আমার বড় বোন আমার হাতে গুঁজে নিয়েছিল ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকার মতো, আমার বড়ভাই এ বাবদে আরও তালেবর, তিনি সব মিলিয়ে সম্ভবত হাজার বিশেক টাকা দিয়েই হাফেজ হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের টাকার ওপর ভরসা করতে হলে আমার ছেলেকে বিনা চিকিৎসায় চলে যেতে হতো। ওদের টাকাও আমি আমার সন-ানের চিকিৎসায় লাগাইনি। পরে গরীব মানুষদের সাহায্যে খরচ করেছি।
অবশ্য আমার সেই আত্মীয়া, আমার ভাগনী, এ বাবদে সবচেয়ে বড় তালেবর ব্যক্তি- অপারেশনের পর ‘মিটিং’ ডেকে ঢাকঢোল পিটিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি কেমো থেরাপির টাকা দেবো।’ সে টাকা আর কোনদিনই দেয়া হয়নি তার। অন্যদিকে তিনি আমার আত্মীয়-স্বজন সবাইকে বলে বেড়ালেন, ‘এ ক্যান্সারের মেয়াদ মাত্র দুই বছর। ও যখন মরেই যাবে, তখন আর ওর পেছনে টাকা খরচ করে কি হবে- পুরোটাই তো বরবাদ হবে। শুধু শুধু কেন টাকা ঢালবেন?’

কিন’ আমরা তো আমাদের সন-ানকে পথের ওপর ফেলে দিতে পারি না। আর সমস- সময় আমাদের মনে হয়েছে, ওকে বাঁচিয়ে তুলতে পারবো। এক এক ধরনের চিকিৎসা করি- এক এক করে পাঁচ ধাপে কেমো থেরাপি, আঠারো না বিশ ধাপে রেডিও থেরাপি- সেই সাথে নানা ধরনের আনুসাঙ্গিক ওষুধ খাওয়াই- আর মনে মনে ভাবি এবারই ও সেরে উঠবে।
যখন এপ্রিলের পাঁচ তারিখে ওর ‘টার্মিনাল কন্ডিশনে’ ডেল্টা হাসপাতালের শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত কেবিনে ভর্তি করলাম, তখন ও সারাটা সময় চোখ বুঁজে ঝিমিয়ে থাকতো। তখনও আমি মনে মনে ভেবেছি, এই বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে- সোনা বাবা আমার চোখ খুলে বলবে, ‘আব্বু, এখন আমার একটু ভাল লাগছে।’
সেই ভাবনা আর কখনও বাস-বে রূপ নিলো না। দু’দিন পর, এপ্রিলের আট তারিখের দুপুরে ওর শরীরটা দুবার ঝাঁকি দিয়ে চিরদিনের মতো শান- হয়ে গেল।
আমি সারা জীবনে আমার চারপাশের সকলের উপকারে কাজ করেছি, সাহায্য করেছি। আমার সারা জীবন অপরিসীম আর্থিক কষ্টে কেটেছে। অভাবের মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করেছি, কিন’ অন্যের কাছ থেকে কোনদিনই পাঁচটা টাকা সাহায্য নেইনি।
আমার বড় আপা আর বড় ভাই, আমার বাবা-মার বড় দুই সন-ান, ওরা আমার চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছল। আমার বড় আপার একমাত্র সন-ান, আমার ভাগ্নি, যাকে আমি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি, যার বিয়ের সময়, ১৯৮২ সালে, পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করে গহনা তৈরী করে দিয়েছি, ভাগ্নি-জামাইকে তার জীবনের প্রথম স্যুট তৈরী করে দিয়েছি, জাপানের ‘সিকো ৫’ ঘড়ি কিনে দিয়েছি। আমার বড় ভাইয়ের দুই ছেলে, বড় ছেলে সামরিক বাহিনীতে চাকরী করে, যখন ও নিতান- দুগ্ধপোষ্য শিশু, মুক্তিযুদ্ধের সময়, আমরা তখন গ্রামে পালিয়ে থাকি। শিশুর দুধ আনার জন্য আমাকে প্রতিদিন প্রায় দুই মাইল গ্রামের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে পুরো তিন মাস। অথচ আমার বড় ভাই ‘জীবনের ভয়ে’ সারাটা দিন ঘরের মধ্যে চুপটি করে বসে থাকতো। আমার ভাতিজাটি যখন ক্যাপ্টেন, তখন ওর বিয়ে হলো। বিয়ের পর আমার বাসাতেই ওদের বাসর রাত হয়েছিল। আমি আমাদের বেডরুম ছেড়ে দিয়েছিলাম ওদের বাসরের জন্য। ওর বিয়েতেও প্রচুর টাকাও খরচ করেছি। দুহাতে খরচ করেছি বড় ভাইয়ের ছোট ছেলের বিয়েতেও।
অথচ আমার সাথে, আমার স্ত্রীর সাথে আর আমার ছেলের সাথে, ওরা সকলে যে চরম দুর্ব্যবহার করেছে, ঐ আট মাসে, তা’ ভাষায় প্রকাশ করার নয়। কেবল ঐ আট মাসই না, আমার ছেলে চলে যাবার পর ‘কুলখানি’র মিলাদের পর আমরা যখন আমাদের বাসায় ফিরে এলাম, সেদিনটা এক প্লেট ভাত এনে কেউ বলেনি, তোমরা খাও। সেই রাতে আমি ভাত রেঁেধ আমার স্ত্রীকে মুখে তুলে খাইয়েছি। কেউই আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি।

এমনকি বাবা-মার মৃত্যুর পর আমার অভিভাবক- মায়ের মত বড় আপা, বাবার মতো বড় ভাই, বন্ধুর চেয়েও আপন ভাবী, আপন সন-ানের মত আপন- তাদের দুই ছেলে, পুত্রবধু, ভাগ্নী-ভাগ্নী-জামাই, নাতি-নাতনী সবাই আমার ছেলের ওপর বইটা প্রকাশের পর আমাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল।
আমি বুঝি সবই। আমি যদি সম্পদশালী হতাম। ঢাকা শহরে আমার যদি দুই-তিনটে ফ্ল্যাট থাকতো, গোটা দুটো গাড়ি থাকতো। তখন আমি লাথি মারলেও ওরা সবাই আমার কাজে-কথায় ধন্য ধন্য করতো। আমার বাসায় পড়ে থাকতো পোষা কুকুরের মতো। আমি তো সম্পদশালী নই, এমএ পাশ করার পর আমি চাকুরী জীবন আরম্ভ করেছিলাম ১৯৮০ সালে, একেবারে সর্বনিম্ন পদে, অফিস সহকারী। যখন অবসর গ্রহণ করি তখনও আমার অবস’া দিন-আনি, দিন-খাই। আমার স্ত্রীর চাকরী না থাকলে যে কি হতো, তা’ ভাবলে এখনও আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে।
সে তুলনায় আমার ভাগ্নীকে আল্লাহ দু’হাত ভরে দিয়েছেন। ভাগ্নী-জামাইয়ের সৎ-অসৎ বে-মাপা টাকায় ঢাকা শহরে দুটো এপার্টমেন্ট, দুটো গাড়ি, প্রচুর ব্যাংক ব্যালান্স। বাড়িতে এক বিঘত লম্বা পাবদা মাছ রাঁধা হয়- তাদেরকে তৈলমর্দন করতে পারলে লাভ ষোল আনার ওপর আঠারো আনা। আমার মতো ফকির-ফাকরাদের থেকে দুরে থাকাই তো ভালো!

আমার ‘সায়েম মাহমুদের নিষ্ফল দ্বৈরথ’ বইয়ের পাঠকরা আমার ওপর বেশ অসন’ষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। তারা আমাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, আমার ভাগ্নী আর ভাগ্নী-জামাই আমার সন-ানের সাথে যে আচরণ করেছে, সেটা শাসি-যোগ্য অপরাধ এবং বাংলাদেশের প্রচলিত ফৌজদারী আইনেই তাদের বিচার করা সম্ভব। তাদের অনেকেই, এর মধ্যে দুই-একজন বেশ বড় আইনজ্ঞ, বলেছিলেন, আমাকে কিছু করতে হবে না, কেবল আমি সম্মতি দিলেই আদালতের ব্যাপার-স্যাপার তারাই সামলাবেন। এমন একটা অমানবিক অপরাধের শাসি- হওয়া দরকার।
আমি তাদের এ উদ্যোগে সম্মতি দিতে পারিনি, কারণ আমার সন-ান তার ক্ষুদ্র জীবনটাতে কারও প্রতি বিদ্বেষ করে যায়নি, ক্রোধ প্রকাশ করেনি, কোনও দিন হিংসা করেনি, লোভ করেনি, দম্ভ বা অহঙ্কারও প্রকাশ করেনি। অথচ দম্ভ বা অহঙ্কার করার মতো জ্ঞান-বুদ্ধি আর বিদ্যা সে অর্জন করেছিল। স্কুলের দশটা বছর, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি বছর সে সকল সময় প্রথম শ্রেণী অর্জন করে এসেছিল। ছোট্টবেলা থেকে সে কোনদিন কোন আবদার করেনি, কারও কাজে কখনও কোনদিন ‘রসিকতা করেও’ সমালোচনা করেনি, কোনদিন তার মুখ দিয়ে কোন অশালীন শব্দ উচ্চারণ করেনি।
মারা যাওয়ার আগের দিন ও দু’বার চেষ্টা করেছিল আমাকে কিছু বলে যাওয়ার, জিভ জড়িয়ে যাওয়ায় সে তার সেই শেষ ইচ্ছেটা জানাতে পারেনি। আমার মনে হয়েছে, আসলে সে হয়তো সকলকে ক্ষমা করে দিতে বলতে চেয়েছিল। কারণ সে জানতো তার আত্মীয়দের মধ্যে কে কেমন।
পরে আমার স্ত্রী বলেছিলেন, তিনি আমার ভাগ্নী আর ভাগ্নী-জামাইয়ের কৃতকর্মের শাসি-র ভার ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। আমি আমার স্ত্রীর কথার বাইরে যেতে পারিনি।

‘সায়েম মাহমুদের নিষ্ফল দ্বৈরথ’ বইটা বের হওয়ার পর নানা বিষয় নিয়ে লিখলেও নিজের জীবন নিয়ে আর কিছু লিখবো ভাবিনি। এর মধ্যে অকস্মাৎ আমার সেই লেখিকা আত্মীয়ার মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার বয়ান পুস-কাকারে পড়ে মাথায় বাজ পড়লো। কারণ মুক্তিযুদ্ধকালীন সারাটা সময় আমার সেই আত্মীয়া যে সকল গ্রামে ছিলেন, সেখানে আমিও ছিলাম। কিন’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতো এমন একটা পবিত্র ঘটনা নিয়ে যে কেউ এমন আষাঢ়ে গল্প (ইংরেজিতে একটা ভাল শব্দ আছে, পড়পশ ধহফ নঁষষ ংঃড়ৎু) লিখতে পারে তা’ আমার ধারণা ছিল না।
আত্মজৈবনিক রচনায় অনেকেই তাদের খারাপ আচরণ ও ঘটনাগুলো চেপে যান, ভালগুলো বাড়িয়ে লেখেন। সেটা দোষের কিছু না। কিন’ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেউ যদি কোন মিথ্যাচার করেন, সেটা কোনমতেই মেনে নেওয়া যায় না। আর তাই আমি আবার কলম তুলে নিলাম। না, হাতে ঠিক কলম তুলে নিলাম না, আমি ল্যাপটপের সাহায্য নিলাম, সরাসরি কম্পিউটারে লিখতে আরম্ভ করলাম। তৈরী হয়ে গেল ‘পলাতক কাল’।

তারপর আমার মনে হলো লোকে যখন আমার লেখার প্রশংসা করছে, তখন লিখি না কেন আরও কিছু। তৈরী হয়ে গেল আমার আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড, আমার কিশোর বয়সের কথা ‘কোলকাতা, ও কোলকাতা।’ এই তিনটি বইয়ে যে সব সময়ের কথা লেখা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে আমার কলেজ জীবন আর চাকুরী জীবনের বেশ কিছু অংশ বাদ রয়ে গেছে, তাই আবার ল্যাপটপের সামনে বসলাম। ‘জিপসী জীবন’ বইয়ের মধ্যে দিয়ে আমার জীবনের মূল কথা ফুটে উঠেছে।
আমি সারা জীবন কেবল ‘পরের জাগা, পরের জমি’তেই কাটিয়ে গেলাম জিপসীদের মতো। আমার সারাটা জীবনই জিপসী জীবন। আশ্চর্যের বিষয়- আমার বাবা, জনাব ফজলুর রহমান, সারা জীবন এক রতি জমি কিনে বসত বানাননি। পৈত্রিকসূত্রে অঢেল জমি, ধান-পান ছিল। মহা-সুখে আরাম আয়েসে তিনি জীবন কাটাতে পারতেন। এমন কি গ্রামে গিয়েও থাকতে হতো না। গ্রামের আয়-ব্যয়ের ওপর একটু খবরদারী করলেই শহরে জমিদারী আয়েসী জীবন তার যে হতো না, এমন না। কিন’ বাবা কোনদিনই গ্রামে যাননি। তার বড় ভাই অর্থাৎ আমার চাচা, তাদের পিতার সমস- সম্পত্তি পুত্র-কন্যা, জামাতা-পুত্রবধু, পৌত্র-পৌত্রী দৌহিত্র-দৌহিত্রীগং নিয়ে মহা আরাম জীবন অতিবাহিত করে গেছেন।
যশোর শহরে আমার মায়ের এক বিঘা জমি ছিল। তার বাবা, অর্থাৎ আমার নানা সারা জীবনভোর সেই জমিতে বাড়ি বানিয়ে গাছ-পালা লাগিয়ে জমিদারী হালে চলেছেন। তিনি ঢাকায় তার ছোট মেয়েকে জমির ফল-ফলাদি টাকা খরচ করে পৌঁছে দিতেন, কিন’ আমাদেরকে তিনি কোন কিছুই দিতেন না। মা সারা জীবন চুপ করে থেকেছেন। এমন কি আমরা যখন যশোরে বসবাস আরম্ভ করলাম, তখনও নানা বছরে দুই একবার টাকা-পয়সা খরচ করে ঢাকায় যেতেন বস-া ভর্তি করে ফলাফলাদি নিয়ে, অথচ এক মাইলের মধ্যে আমরা থাকতাম, আমাদের বাসায় কিছুই পাঠাতেন না। মা আগেও যেমন চুপ থেকেছেন, তখনও চুপ থেকেছেন।
অন্যদিকে বাবা সারা জীবন কলম পিষে একেবারে যধহফ ঃড় সড়ঁঃয অবস’ায় জীবনযাপন করে গেছেন। তিনি তাঁর সারা জীবন সকল সময় আমাদেরকে পই পই করে বলে গেছেন, আমরা যেন আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তির ওপর দাবী করতে গিয়ে চাচাতো ভাইদের সাথে দ্বৈরথে জড়িয়ে না পড়ি। তিনি যখন ইনে-কাল করেন, তখন তার যে টাকা সঞ্চয় ছিল, সরকারী পেনসন থেকে পাওয়া, তা’ কেবল তাঁর দাফন-কাফন করতেই ব্যয় হয়ে গিয়েছিল। দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ বাবা একটি দিনের জন্যে তার দুই পুত্র সন-ানের গলগ্রহ হননি।
আমার কথা আমি বামে জমা দিয়ে রাখি। বলতে পারেন, আমারও তো দায়িত্ব ছিল বাবা-মায়ের দেখাশুনা করার। হ্যাঁ, ছিল। কিন’ আমি প্রথম চাকরীতে ঢুকি ১৯৮০ সালে, ৩৪ বছর বয়সে। ১৯৮২-এর এপ্রিলে আমার ভাগ্নীর বিয়ে হয়। সে বিয়েতে আমি আমার সমস- জমানো টাকা, বিপুল পরিমান মূল্যবান ডাকটিকিট সংগ্রহ বিক্রি করে ভাগ্নীর গহনা আর জামাইয়ের স্যুট আর ঘড়ি কিনে দিয়েছিলাম। এর ছয় মাসের মধ্যে ৮২-এর অক্টোবরে বিয়ে হয় আমার। তখন আমার হাত একেবারে খালি, নতুন বৌকে আমি সখ করে কিছু কিনে দিতে পারিনি।
না, আমার বিয়ে আমার ইচ্ছেতে, এমনকি আমার সম্মতিতে হয়নি। বলতে পারেন, ‘ধরে বেঁধে হাড়িকাঠে’ ভরে দেওয়ার মতো অবস’া করা হয়েছিল আমার সাথে। কোরবানীর ঈদে বড় বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়ে শুনি আমার বড় ভাই মেয়ে দেখে দিন-তারিখ ঠিক করে এসেছে। ঈদের দুই দিন পরে বিয়ে। এমন অবস’ায় আমি প্রতিবাদ করবো কিভাবে? আমি একজন এম এ পাশ, চাকরীজীবী ছেলে, আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আগ্রহ, চাহিদা কোন কিছুই না জেনে কিভাবে বিয়ে ঠিক করা হয়?
বিয়ের দু’মাসের মধ্যে ঢাকায় আমরা সংসার পাতলাম তাও, আমাদের ইচ্ছেতে না। ভাগ্নী ঢাকায় চাকরী করবেন, তাই আমার বউ তাদের রান্না করে খাওয়াবেন, এ জন্যেই আমাদের ঢাকায় সংসার আরম্ভ করতে হয়েছিল। পরে শুনি, আমরা নাকি ঢাকায় সংসার করছি আমার ভাগ্নীর বদান্যতায়, না হলে নাকি আমরা ঢাকায় সংসার করতে পারতাম না।

আমার বিয়ের মাত্র দু’মাসের মধ্যেই আব্বা ইনে-কাল করলেন। আর মা তার বহু আগে থেকেই ছিলেন পক্ষাঘাতস’।
আব্বা-মা আপার সাথেই থাকতেন বহুকাল ধরে। আপা তার বিয়ের অল্পকাল পর থেকেই একা। চাকরী জীবন যাতে একা না থাকে এর জন্যে মা আর আব্বা আপার কাছেই থাকেন। মাঝে মধ্যে বড় ভাইয়ের ক্যাডেট কলেজের বাসায় গিয়ে কিছুদিন করে থাকলেও তারা ওখানে স্বসি- বোধ করতেন না। আমরা ঢাকায় সংসার পাতার পর অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আব্বা ইনে-কাল করেন।
আমার বড় আপা আমার আর আমার স্ত্রীর কাছে মাকে পাঠাতে কোনদিন সাহস পাননি। আমার স্ত্রী তার শাশুড়িকে অত্যন- শ্রদ্ধা ও পছন্দ করতেন। অথচ পরে অবশ্য তিনি বহুবার বলে বেড়িয়েছেন যে, আমি না-কি বাবা-মা-র দেখাশুনা করিনি। মজার ব্যাপার, তিনি বাবা-মাকে দেখাশুনা না করার জন্য আমার দোষারোপ করেছেন, অথচ বহু বছর আগে থেকেই চাকুরীরত ও স্বচ্ছল, একই দোষে দোষী, বড় ভাইটির সমালোচনায় তার মুখ থেকে একটি শব্দও বের হয়নি।
বাবা-মার বড় পুত্র ক্যাডেট কলেজে বেশ অনেক দিন ধরে চাকরী করলেও বাবা বা মা কেউই তার পুত্র-পুত্রবধুর কাছে গিয়ে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। কেন? কি করে বলবো বলুন। তবে বাবা এবং মা সব সময় বড় ভাই আর ভাবীকে এড়িয়ে চলতেন, সেটাই দেখে এসেছি।
বড় ভাই আর বোনের থেকে বয়সে আমি অনেক ছোট। আব্বার আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে দীর্ঘদিন পড়ালেখা থেকে দুরে থাকতে হয়েছে আমাকে। মুক্তিযুদ্ধের কারণে পুরোটা সময় কেটেছে পালিয়ে পালিয়ে। তারপর বাবা অন্ধ হয়ে যাওয়ায় বোনের সংসারে থেকেছি তাদেরকে সহায়তা করার জন্যে। পড়া-লেখা আবার আরম্ভ করতে পারতাম বা চাকরীতে ঢুকতে পারতাম, কিন’ আমি তা করিনি। আপার সাথে থেকেছি, তার বাজার-ঘাট করে দিয়েছি, বাবার পেনসনের টাকা তুলে দিয়েছি। তারা কোথাও যেতে চাইলে সাথে সাথে থেকেছি। এভাবেই কাটিয়ে দিয়েছি আরও পাঁচটা বছর।
তারপরেও দায়িত্ব নেওয়ার মতো মন-মানসিকতা আমার বা আমার বৌয়ের থাকলেও আপা কোনদিনই আমার ওপর ভরসা করে মাকে আমাদের কাছে পাঠাননি। তাঁর ধারণা ছিল মায়ের দেখভাল আমরা করতে পারবো না। অথচ শত মুখে আমাদের সমালোচনা করে গেছেন তিনি।

ঐ যে বললাম না, জিপসী জীবন আমার। যেখানে রাত, সেখানেই কাত। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে পড়তাম। কেমন ছাত্র ছিলাম নিজের মুখে বলবো না। মুক্তিযুদ্ধের কারণে এমএ প্রথম বর্ষের পড়া শেষ হওয়ার আগেই পড়াশুনা থমকে গেল। কিন’ স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলা হলো ক্লাসে যোগ দিলেই হবে। প্রথম বর্ষটাকে পাশ ধরে নিয়ে আমাদের দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি করে নেওয়া হবে। আমার সে সুযোগ নেয়া হয়নি।
পরে ভূগোল বিভাগ থেকে যে সব টিচার পরীক্ষা নিতে যশোরে আসতেন, আমার সাথে দেখা হতোই, দেখা হলে অত্যন- রাগ করতেন, বলতেন, ‘বোনের বাজার করলেই জীবন চলবে? নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে না?’
আমি হাসতাম। বাবা, মা, বোন কিংবা ভাই উদ্যোগ নিলেই, কেবল একটু ‘ইনসেনটিভ’ দিলেই, কিন’ আমার জীবনটা বদলাতে পারতো। আমি না হয় চোখ-কান-নাক বুঁজে স্যাক্রিফাইস করছিলাম। তারাও কি করে সেটা নির্বিবাদে গ্রহণ করে গিয়েছিলেন, আমার জীবনের বিনিময়ে? বলতে পারবো না।
অবশেষে আপা যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরী নিয়ে গেল, তখন সুযোগ এলো আমার ভাগ্য পরিবর্তনের। আমি প্রথমে বিএড করলাম, তারপর এম.এ করলাম ইংরেজি সাহিত্যে। ছিলাম ভূগোলের ছাত্র। ডিগ্রি হলো ইংরেজিতে। বুঝতেই পারছেন, আমার মাথার গ্রে সেলগুলো একটু ভিন্ন প্রকৃতির ছিল। না হলে পাঁচ বছর পড়াশুনা থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে আবার যখন পড়াশুনায় ঢুকলাম, তখন কোন বিরতি ছাড়াই ব্যাচেলর অব এডুকেশন আর ইংরেজীতে মাস্টার্স- দুটো ডিগ্রি নিয়ে ফেললাম। আর মানও খারাপ হলো না- দুটোতেই দ্বিতীয় বিভাগ।
আমি জানি না, আজ আটষট্টি বছর বয়সে, এখন আমার মনে হচ্ছে, আমার বাবা, মা, ভাই আর বোনের থেকে আমার কেমিস্ট্রি কিছুটা পৃথক ছিল, তাই তারা ছোটবেলা থেকেই আমাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে এসেছেন।
বাবার প্রিয় সন-ান ছিল আপা আর মা-র প্রিয় ছিল বড় ভাই। আমি সকল সময়ই ছিলাম পরিবারে অপাঙক্তেয়, সংসারে অপ্রয়োজনীয়। মা কথা প্রসঙ্গে এ কথা বহুবার বলেছেন। আমার ভাল হোক, আমার উন্নতি হোক, তা’ সম্ভবত তারা মনে-প্রাণে চাননি। চাইলে আমার সাথে এমন আচরণ কেউ করতেন না। হাতের পাঁচটি আঙুল সমান হয় না। আমি ছোটবেলায় মোটেই চৌকশ ছিলাম না, কিন’ আমার মেধা ছিল। হয়তো আর একটু নজর দিলে আমি ভাল করতে পারতাম। নজর দেয়া অর্থাৎ আমার চালচলন, গতি-প্রকৃতির প্রতি খেয়াল রাখা। আমি ক্লাসে কেমন করছি, কোনটাতে খারাপ করছি, কেন করছি, ইত্যাদি কেউ কোনদিন খোঁজ নেননি।
আর নেননি বলে আমি যেটুকু উঠেছি, তার সাথে আমার আব্বা, মা আর বড় বোনের সম্পর্ক কিছুটা ভাত-কাপড় সরবরাহের যোগসূত্র থাকলেও বড় ভাইয়ের সেটুকু দায়িত্ববোধও ছিল না। বড় ভাই চাকরীতে ঢোকার পর থেকে আজ পর্যন-, ঐ যে বললাম কেবল পাঞ্জাবী ‘উপহার’ দেয়া ছাড়া পাঁচটা টাকাও আমার হাতে দেননি।
আমি যেটুকু উঠেছি সম্পূর্ণ একা, নিঃসঙ্গভাবে, সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে করে এগিয়ে গিয়েছি। আমি লেখালেখি করি কিশোর বয়স থেকেই কিন’ আমার বাবা, মা, বড় আপা কিংবা বড় ভাই কোন দিন ঘুরেও দেখেনি কি লিখছি। পড়াশুনার ক্ষেত্রেও তাই। স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার ভেতরেই সব দায়িত্ব শেষ। পড়ছি কি না, পড়া পারছি কি না। কিন বিষয়ে কোন অসুবিধা হচ্ছে কি না। সেটা কোনদিনই কেউ খোঁজ নেননি। অথচ বড়ভাইয়ের জন্য ভাল কোচিং-এর ব্যবস’া হয়েছে। আমার জন্য হয়নি।
তাই আমি মাঝারী, বা আরও সত্যি কথা বলতে হয় নিম্ন-মাঝারি শিক্ষার্থী হিসেবে কোন মতে এক একটা ধাপ পার করেছি। আজও যেটুকুৃ আমার অর্জন তার সবটুকুই আমার একার কৃতিত্ব।
আমার স্কুল জীবনে পাঁচ বছর নেই, মুক্তিযুদ্ধের পর আবার আমার জীবনের পাঁচ বছর বাদ- তাই মাস্টার্স শেষ করলাম পঁত্রিশ বছর বয়সে।
ফলে যা হবার তাই হলো। চাকুরী জীবন শুরু করতে হয়েছে অনেক পরে। অথচ সেটা নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। চাকরীতে ঢোকার পরও একের পর এক ঝামেলায় পড়েছি। ঠেকা দেওয়ার লোকের অভাব ছিল না। কিন’ আমার আপা বা বড় ভাই কোন দিনই জিজ্ঞেস করেনি আমার অফিস কেমন চলছে, সংসার কেমন চলছে।
আমার অন্য সব বন্ধুরা যখন সিনিয়ার অফিসার হয়ে মহাসুখে অফিস সামলাচ্ছে, সেই বয়সে আমি সবে নিম্নকরনিক হয়ে জীবন আরম্ভ করেছিলাম।
সেটা অবশ্য অনেক পরের কথা।

Leave a Reply