হিজরী ৮৯৯ (১৪৯৪ খ্রীষ্টাব্দ)। গ্রীষ্মকাল। ফরগানার উত্তপ্ত আকাশে ঘন মেঘ পাক খাচ্ছে, সারাদিন চাপা গুমোট গরমের পর সন্ধাবেলায় বৃষ্টি নামলো মুষলধারে। লালামাটির পাহাড়গুলোর মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা কুভাসাইয়ের পানি অল্পক্ষণের মধ্যেই লাল মেটে রং ধারণ করে ফুলে উঠলো। যেন রক্ত এসে মিশেছে শ্রোতের সাথে।
নদীতীরের ঝুঁকে পড়া বেতের একটি ঝোপের নীচে অবাঞ্ছিত দৃষ্টি আড়াল করতে আশ্রয় নিয়েছে একটি যুবক ও একটি কিশোরী ।
‘তুমি আমাকে বিশ্বাস কর রাবেয়া, যতক্ষণ আমার দেহে প্রাণ আছে, কোন বিপদ তোমাকে ছুঁতে পারবে না’, স্বরে উদ্বেগ নিয়ে ফিসফিস করে বলল যুবকটি।
‘আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন, তাহের.. কিন্তু .. হাজারে, হাজারে শত্রু এসে হানা দিয়েছে আমাদের দেশে। ওদের কি থামানো যাবে? … কে ওদের থামাবে?… ঐ দেখ, আবার আসছে ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসা মানুষের ঢল.. দেখেছ সংখ্যায় ওরা কত? আহ, কী দুর্ভাগ্য ওদের।’
তাহের কিশোরীর দিক থেকে চোখ সরালো। কুভাসাইয়ের ওপার বরাবর জলাভূমি, নলখাগড়ার ঘন ঝোপ; নদীর ওপরের ধনুকের মত বাঁকা, লম্বা, কাঠের সেতুটা এখন বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আবছা দেখা যাচ্ছে। সেতুর ওপর দিয়ে পিঁপড়ের সারির মত চলেছে লোক, ঘোড়া, ভেড়া, ধীরে ধীরে চলেছে উঁচু করে মাল চাপানো ঘোড়াগাড়ী। শত্রুসৈন্যদের সমরখন্দের শাসনকর্তার পরিচালনায় আক্রমণ করে মার্গিলান, সে দেশের লোকেরা যুদ্ধের দুর্দশার হাত থেকে নিজেদের ধনসম্পত্তি ও স্ত্রী-কন্যাদের মান বাঁচাবার জন্য পালাতে থাকে কুভা হয়ে আন্দিজান।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাবেয়া। তারপর বলল, ‘আমাদেরও পালাতে হবে! আমার বিয়ের যৌতুকের বাক্স মা বিচালি ঘরে লুকিয়ে রেখেছেন … আমার জন্য চিন-া কোরো না। আজ সন্ধ্যায় মাহ্মুদ আমাকে নিয়ে চলে যাবে আন্দিজান দুর্গে।’
আন্দিজান দুর্গের অবস্থা জানতো তাহের। মাহ্মুদ তার বোনকে নিয়ে যাবে আন্দিজান দুর্গে, তারপর কী হবে? সেখানকার স্বেচ্ছাচারী, শক্তিমান বেগরা কি কুমোরের সুন্দরী মেয়ের পক্ষে কম বিপজ্জনক? তাহের বলল, ‘যদি আমার কথার গুরুত্ব দাও তো, যেও না!’
তাহেরের পরনে ঘরে তৈরী ডোরাকাটা কাপড়ের জামাটার কোমরবন্ধে ঝুলছে একটা ছোরা। ও মেয়েটার মুখ আর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। যে চোখে সারক্ষণ থাকে ছেলেমানুষী একগুঁয়ে দৃষ্টি, আজ তা ভয়ে আর উদ্বেগে অস্থির।
‘আমারও যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু কী করব? এখানে থাকলে যে বিপদ!’
তাহেরের সঙ্গে দেখা করার জন্য বেরিয়ে আসার সময় মেয়েটা বাবার কালো পশমের চেকমেন মাথায় ঢাকা নিয়েছিল, এখন বৃষ্টিতে ভিজে সেটা খুব ভারী হয়ে উঠেছে। রাবেয়া ওটা চাপিয়ে নিল কাঁধে, কামিজের গলার কাছের বোতামটা খুলে গেছে, ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সাদা ত্রিকোণ এলাকা – সে দিকে তাহেরের চোখটা গিয়ে থামলো। সবুজ রংয়ের হাতকাটা পোশাকটা সতের বছরের রাবেয়ার নমনীয় ক্ষীণ কোমর আর আঁটসাঁট বুকটা চেপে বসেছে।
তাহের আর রাবেয়া একসঙ্গেই বড় হয়ে উঠেছে, বহুদিনের প্রতিবেশী ওদের দুই পরিবার, কিন’ এই প্রথম তাহের অনুভব করলো কি কোমল আর সুন্দর রাবেয়া, তারই রাবেয়া। এমন সুন্দর মেয়ের দিকে লোভের হাত বাড়াবেই বিদেশী বেগ আর ভাড়াটে সিপাইরা।
বসনে- যখন ওদের আক্দ্ করেন ওদের বাবা-মা, তখনও রাবেয়াকে এত সুন্দর মনে হয়নি। রমজান শেষ হলেই ওদের বিয়ে হবে। অল্প কয়েকদিন বাদেই ওদের মিলন হবে, এই স্বপ্নে ওদের মন ভরে আছে অপূর্ব প্রশান্তি- আর সুখের অনুভূতিতে। কিন’ ঘটনার মোড় ঘুরলো অন্যদিকে; যুদ্ধের আগুন এসে লাগল কুভাও।
তাহের হঠাৎ মেয়েটাকে টেনে নিল কাছে। চোগাটা মাটিতে পড়ে গেল, তাহের অনুভব করলো রাবেয়ার সারা দেহ কাঁপছে, কাঁপছে তার দেহের প্রতিটি অণু-পরামাণু।
‘তুমি তো এমন ভীরু ছিলে না, রাবেয়া। কি হয়েছে তোমার?’
নিজের দুশ্চিন্তা কমাবার জন্য বললো তাহের।
‘আমি একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি তাহের জান! ইয়া আল্লাহ্, বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করো!’
‘খারাপ স্বপ্ন? … আমাকে নিয়ে? বল শুনি।’
‘বলতে আমার জিভ সরছে না।’
‘স্বপ্নে কত কি না দেখে মানুষ!.. বল আমায়!.. যা হয় হবে!’
‘একটা কালো ষাঁড় ছোরার মত ধারাল শিংয়ে বিঁধেছে তোমাকে… না! না!’ শিউরে উঠল ও। ‘ভাবলে গায়ে এখনও কাঁটা দিচ্ছে।’
স্বপ্নে বিশ্বাস করে তাহেরও। এক অস্বসি-কর অনুভূতিতে ভরে গেল তার মন, রাবেয়াকে ছেড়ে দিল হাতের বাঁধন থেকে।
‘ভাল করে বুঝিয়ে বল দেখি…. শিংয়ে বিঁধিয়ে ওপরে তুলেছে… আর রক্তও দেখেছ?’
‘হ্যাঁ … ফিনকি দিয়ে রক্ত!’
‘তা হলে ভয়ের কিছু নেই। রক্তের স্বপ্ন দেখলে মঙ্গল হয়। বাবা তাই বলেন সবসময়।’
‘আল্লাহ করুন, তাই যেন হয়। তাহের, আমি… যদি তুমি আন্দিজান না যাও… আমি যাব না। যদি কিছু ঘটেই, এখানেই ঘটুক.. একসঙ্গে…’
গাছের ডাল থেকে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল, মাঝে মাঝে মেয়েটির লম্বা লম্বা চোখের পলকে পড়ছিল। তাহেরের মনে হলো কাঁদছে রাবেয়া।
‘আমার জন্য ভেবো না, রাবেয়া। আমি এক সাধারণ কিষাণ। সূর্য উঠবে, আকাশে মেঘ কেটে যাবে, বলদজোড়া নিয়ে মাঠে যাব। গম তুলবো। আমাকে কার প্রয়োজন? কে আমার শত্রু? আমার শত্রু সম্বন্ধে কোন মাথাব্যধা নেই। আমার… আমার মনে পড়েছে আন্দিজানের দুর্গে তোমার নিজের ফুফু আছে না! চলে যাও, তার কাছে যাও!’
‘আন্দিজানে তোমারও তো আত্মীয় আছে!… একসঙ্গেই গেলে হয় না?’
চিন্তায় পড়লো তাহের। আন্দিজানে আছে ফজল উদ্দিন মামা। দরবারের স্থপতি। তাঁকে কুভাতেও সবাই জানে, নদীর ওপরের ঐ কাঠের পুলটা তার পরিকল্পনা মতোই তৈরী হয়েছে। মোল্লা ফজল উদ্দিনের পরিকল্পনায় তৈরি নীল টালি আর কারুকাজে অলঙ্কৃত আন্দিজানের দিওয়ানাখানা শাসক ওমর শেখের অত্যন- পছন্দ হয়, সেই থেকেই মামার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ওমর শেখ মামাকে উপহার দেন একটি ঘোড়া আর থলিভর্তি মোহর, এ সব কথা তাহের শুনেছে, আরো শুনেছে যে মামা দুর্গে থাকেন না, থাকেন শহরের বাইরে নিরালায় সুখে-স্বচ্ছন্দে।
যখন মোল্লা ফজল উদ্দিন কুভায় ছিলেন, তাহেরকে লেখাপড়া শেখাতেন তিনিই। এখন যদি ভাগ্নে এসে তার কাছে আশ্রয় চায়… মামা অবশ্যই তাকে আশ্রয় দিতে পারেন। কিন’ বৃদ্ধ বাবা-মা কি বলবেন? তাহের তাদের একমাত্র ছেলে, তাকে যেতে দেবেন না। আর কেন হঠাৎ তার আন্দিজান যাবার ইচ্ছে হলো তার আসল কারণটা তাদের বলতে সংকোচ লাগে… আচ্ছা মাহ্মুদ যদি বাবাকে বলে, তবে কেমন হয়?
‘ঠিক আছে, রাবেয়া, আমরা একসঙ্গে আন্দিজান যাবো। কিন’ আমার আব্বাকে রাজী করানো কঠিন হবে… মাহমুদ বাড়ীতে আছে?’
‘কোথায় যেন বেরোচ্ছিলো, ইফতারের আগে ফিরবে, কী দরকার?’
‘ইফতারের পরে আমাদের বাড়ীতে যেন আসে একবার, কথা বলা দরকার।’
‘আচ্ছা বলবো।’
রাবেয়া তাহেরের প্রশস্ত বুকে মুখ লুকায়, বলে, ‘আল্লাহ, আমাদের বিচ্ছেদ ঘটিও না!’
বলেই পিছিয়ে গিয়ে ডালপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে গেল। নদীর তীরে পড়ে থাকা খালি তামার কলসীটার ওপর বৃষ্টি পড়ে আওয়াজ উঠছিলো। সেটার দিকে তাকিয়ে রাবেয়ার মনে পড়লো সে পানি নেবে বলেই এসেছিলো। পানি ভরে নেওয়াই ভাল। তারপর বাড়ী যাবে।
রাবেয়া তীর থেকে বেশ দূরে চলে যাবার পরই কেবল তাহের বেরিয়ে এল গোপন জায়গা ছেড়ে। হঠাৎই ওর মনে পড়লো রাবেয়ার স্বপ্নের কথা। বুকটা অজানা বিপদের আশঙ্কায় মোচড় দিয়ে উঠলো।
২
রোজা পড়েছে এ বছর গ্রীষ্মের সবচেয়ে গরম দিনগুলিতে। এই দীর্ঘ উত্তপ্ত দিনে খিদে, বিশেষ করে পিপাসা সংবরণ করা অত্যন্ত কষ্টকর, অধৈর্য হয়ে সবাই অপেক্ষা করতো কতক্ষণে গোধুলি নামবে, মগরিবের আজান শোনা যাবে। শেষে কুভার মসজিদের মিনার থেকে আজান শোনা গেল। যুদ্ধের আশংকা যতই থাক না কেন, ইফতার তো করতেই হয়। সন্ধ্যার ইফতারের সময় সবাই অন্তত কিছুক্ষণের জন্যও সবকিছু অপ্রিয় কথা ভুলে যায়।
তাহেরও খেতে বসেছে তার বাবা আর মার সঙ্গে। গরম রুটী, খরমুজের সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সুস্বাদু রুটী আর টক-দুধ দেওয়া সুস্বাদু মাস্তাভা। আন্দিজান যাবার ব্যাপারে কথা কিছুতেই আরম্ভ করতে পারছে না তাহের। এ সময় ফটকে ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজ শোনা গেল। ফটকের কাছে শুয়ে থাকা বুড়ো কুকুরটা ঘড়ঘড়ে গলায় ডেকে উঠলো।
‘সাবধান!’ নীচু গলায় সতর্ক করে দিলেন বাবা, ‘জিজ্ঞেস করো কে।’
বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন’ আকাশের মেঘের ভীড় সন্ধ্যার অন্ধকারকে আরো ঘন করে তুলেছে। ফটকের একেবারে কাছে এগিয়ে গিয়ে তাহের জিজ্ঞাসা করলো, ‘কে?’
কুকুরটা আবার চেঁচাতে যাবে এমনি সময় ফটকের ওপাশ থেকে শোনা গেল, ‘তাহের, তুই নাকি?…. খোল, আমি রে, তোর মামা!’
‘খুলছি, ফজল উদ্দিন মামা!’
বাড়ীর দিকে মুখ ফিরিয়ে তাহের ফটকের হুড়কোয় লাগানো শিকলটা তাড়াতাড়ি খুলতে খুলতে বলল, ‘মা, ফজল উদ্দিন মামা এসেছেন।’
রাস্তায় বেরিয়ে ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে বুড়ো-বুড়ি আত্মীয়ের সাথে উপযুক্ত সম্মান দেখিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। তাহেরও রাস্তায় বেরিয়ে এলো। ওদের বাড়ীর অল্প দূরে একটা দু’চাকার ঢাকা দেয়া গাড়ী দাড়িয়ে। একজন লোক গাড়ীটায় জোতা ঘোড়ার লাগাম ধরে বসেছিল, ঘোড়ার জিন থেকে লাফিয়ে নামল সে।
‘এ কার গাড়ী?’
লোকটা কোন উত্তর দিল না। উত্তর দিলেন মোল্লা ফজল উদ্দিন, ‘আমার রে ভাগিনা, আমার। জিনিসপত্র নিয়েই চলে এসেছি তোদের কাছে।’
‘তাই নাকি?’
বিস্ময় চেপে রাখতে পারে না তাহের। মামা এসেছেন তা অবশ্যই আনন্দের কথা। কিন্তু কেমন করে তা হয়?… ও ভেবেছিল আন্দিজান যাবে, এদিকে মামা নিজেই এসে পড়েছে, তাও জিনিসপত্র নিয়ে, তার মানে আন্দিজানের পথ তার কাছে বন্ধ। তাহলে রাবেয়ার কি হবে?
‘তাহের, তুই হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা মাল নামা! বৃষ্টির মধ্যে পথে মামার খুব ধকল গেছে।’ মা চেঁচিয়ে বললেন।
‘আর বোলো না বোনটি, ধকল বললেও কম বলা হয়। গাড়ীর চাকা কাদায় বসে যাচ্ছিল বারবার, টানাটানি করতে করতে বিরক্ত ধরে গেছে। ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি, রাস্তায় অগুনতি ঘরছাড়া লোক চলেছে।’
কোচোয়ানকে মাল নামাতে সাহায্য করতে লাগল তাহের। ঘোড়াটার গায়ে একটু হাত বোলাবে ভাবলো, উষ্ণ কাদামাটিতে হাত ভরে গেল। কাদামাটি লেগেছে ঘোড়াটার প্রায় ঘাড় পর্যন্ত। বেচারী! কপালে জুটেছে বটে… কিন্তু কেন, যখন সবাই বিপদ এড়াবার জন্য আন্দিজানে পালাচ্ছে, তখন ওরা কেন কুভায় এসেছে ?…
কোচোয়ান ওর হাতে ধরিয়ে দিল বড় একটা বস্তায় ভরা কি একটা ভারী জিনিস, তাহের সেটা মাটিতে নামিয়ে রাখার চেষ্টা করল।
‘এই, আস্তে, ওটা খুব ভারী, দু’জনেই ধর বরং।’ ফজল মামা পিছন থেকে বললেন।
বস্তার মধ্যে একটা মাঝারি আর প্রচন্ড ভারী লোহার বাক্স। মোল্লা ফজল উদ্দিন এক সময় কুভার কামারদের দিয়ে ওটা তৈরী করিয়েছিলেন। ভেতরে পানি ঢুকবে না, আগুনেও পুড়বে না। তিনি তার নক্সাপত্র রাখতেন এর ভেতরে। আর থাকতো তার কিছু শিল্পচর্চার উৎকৃষ্ট নমুনা- কিছু ছবি।
মোল্লা ফজল উদ্দিন পড়াশোনা করেছেন তিন বছর সমরখন্দে, চার বছর হীরাটে: সেখানে স্থাপত্যবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে জীবন- প্রাণীকে সজীবভাবে ফুটিয়ে তোলার গোপন কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন। যুদ্ধের কাহিনী কেবল অলংকরণে ভরিয়ে তোলা নয়, বিভিন্ন ছবি অলঙ্কৃত করে তোলা একটা প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে হীরাটে। আর বেহ্জাদের কলমে-তুলিতে ফুটিয়ে তোলা আলি শের নবাই আর হুসেন বাইকারার ছবি তার যশ বাড়িয়েছে। সমরখন্দ আর ফরগানাতে তো আরো বেশী করেই নজরে পড়বে মানুষের মুখের ছবি; আল্লাহ্ সকল জীবের একমাত্র স্রষ্টা। সর্বশক্তিমানের সঙ্গে পাল্লা দেবার চেষ্টা মারাত্মক। সেইজন্যই মোল্লা ফজল উদ্দিন নিজের ছবিগুলি লুকিয়ে রাখেন লোহার সিন্দুকে। তাহের ওদিকে বস্তাটা একাই বয়ে এনেছে বাড়ীর মধ্যে।
ভারী লাল চেকমেন আর ভিজে জুতোজোড়াটা দরজার কাছে খুলে ফেললেন মোল্লা ফজল উদ্দিন। পায়ে ঢুকিয়ে নিলেন চামড়ার আরেক জোড়া হালকা জুতো। পানি জমে থাকা ঢাকনা দেয়া গর্তের ধারে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিলেন। চেকমেনের নীচে জামাটাও ভিজে গিয়েছে বৃষ্টিতে, কিন্তু গ্রীষ্মের এই সন্ধ্যা বেশ উষ্ণ, যদিও আবহাওয়া ভিজে। মোল্লা ফজল উদ্দিন জামাটা আর বদলালেন না।
পথের ক্লান্তিতে তিনি এমন অবশ হয়ে পড়েছেন যে মাস্তাভা ছুঁলেন না, কেবল দু’টুকরো খরমুজ খেলেন আর নিঃশেষ করলেন কয়েক পেয়ালা চা। গাড়োয়ান ছোকরাটিকেও খাবার দেয়া হলো, ও তো টক-দুধ মেশানো মাস্তাভার পাত্রের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দু’বাটি উড়িয়ে দিলো। তারপর বাইরে বেরিয়ে তার ঘোড়াগুলোর কাছে গেল।
তাহেরের বাবা এবার নিজের লম্বা সাদা দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘তা’হলে, মোল্লা ফজল উদ্দিন, ভালই হলো, আপনি এসে পড়েছেন। এমন দুর্দিনে আমাদের একসঙ্গেই থাকা উচিত!’
‘এলাম তো, কিন্তু ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত তাই না? সবাই এই হামলায় ভয়ে ছুটে পালাচ্ছে আর আমি নিজেই বিপদের মুখে মাথা বাড়িয়ে দিলাম।’
বিষণ্ন চোখে তাহেরের দিকে তাকালেন মোল্লা ফজল উদ্দিন।
‘নিশ্চয়ই এর পেছনে কোন কারণ আছে, তাই না মামা?’ তাহের জিজ্ঞেসা করে।
‘কারণ? কারণ তো একটাই রে, তাহের। যখন যুদ্ধ শুরু হয় দালানকোঠার কাজ থেমে যায়, কারিগরের প্রয়োজন হয় না আর….’
‘কিন্তু আপনাকে তো খোদ বাদশা ওখানে কাজে লাগিয়েছিলেন?’
‘বাদশা এখন আখসির কেল্লা মজবুত করার কাজে ব্যস্ত। শুনলাম তাশখন্দের খান মাহ্মুদ আমাদের দুশমন হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠিয়েছেন। ওদিকে পুবে কাশগরের বাদশা আবু বকর-দুগ্লাত সোজা এগিয়ে চলেছেন উজগেন্দের দিকে।’
তাহেরের বাবা আতঙ্কিত হয়ে জামার গলার কাছটা চেপে ধরল তিন আঙুলে।
‘হায় আল্লাহ! ওখানে কাশগর, এখানে সমরখন্দ …. তার মানে, তিন দিক থেকে শত্রু আক্রমণ করেছে? শাহ্ সুলতানরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বন্ধ করে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারছেন না কেন কিছুতেই? তাছাড়া, এঁরা তো নিজেরা আত্মীয়ও, তাই না?’
‘হ্যাঁ তা’ তো বটেই। আমাদের বাদশা ওমর শেখ তাশখন্দের খানের জামাই। আর সমরখন্দের শাহ সুলতান আহ্মদ মির্জা, আমাদের শাহের ভাই, কোকন্দ লুট করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। এ ছাড়া দু’ভাই আবার বেয়াই হতে চেয়েছিলেন: সমরখন্দের শাহের মেয়ে আর আমাদের বাদশাহের ছেলের বাগদান হয়ে আছে পাঁচ বছর বয়স থেকেই। তার মানে ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে, শ্বশুর জামাইয়ের বিরুদ্ধে তলোয়ার তুলে ধরেছে।’
‘হায় খোদা! এই কি তাহলে রোজ-কেয়ামত? মোল্লা ফজল উদ্দিন?’
‘জানি না! … কেবল জানি যে ওরা নিজেদের মধ্যে মারপিট করছে, আর এই যুদ্ধের ফলে দুর্ভোগ, দুদর্শা ভোগ করছে অন্যরা। এই আমাদের মত লোকেরা।’
‘এই তাহলে আমাদের ভাগ্যে ছিল…’
‘হ্যাঁ, মন্দ ভাগ্য নিয়ে বাঁচা খুবই মুশকিল।’
মোল্লা ফজল উদ্দিন যেন তাহেরের বাবার কথা শুনতে পান নি, নিজের মনে বলেই চললেন, ‘কত আশা নিয়ে ফিরলাম হীরাট থেকে! আমার প্রিয় ফরগানাতে চমৎকার মাদ্রাসা তৈরী করার স্বপ্ন দেখেছি, যেমনটা আছে সমরখন্দে, হীরাটে… শাহ্, সুলতান খান … কেউ চিরকাল বেঁচে থাকে না। কিন’ উলুগ বেগের মাদ্রাসা, নবাইয়ের খামসা লোকের স্মৃতিতে থাকবে।’
কথাগুলো বলে ফেলে স্থপতি কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলেন, একঝলক তাকিয়ে নিলেন দরজার দিকে। দরবারের লোকেদের মধ্যে বাস করা মামার অভ্যেস, তাই চরের ভয়।
‘মামা, আপনি বলুন, এখানে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই… আন্দিজানে আপনার থাকা হলো না কেন?’
এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন না মোল্লা ফজল উদ্দিন, আপন ভাবনায় ডুবে গেলেন।
গতকাল মগরেবের সময়ে, মোল্লা ফজল উদ্দিন গিয়েছিলেন পাশের রাস্তায় তার বন্ধু এক লিপিকরের বাড়ীতে। এমন সময় তার বাড়ীর দরজা ভেঙে কয়েকজন অপরিচিত ব্যক্তি ভেতরে ঢোকে। কুকুরটা চীৎকার করতে করতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ায় ওরা দু’টুকরো করে ফেলে সেটাকে। মামার ঘোড়ার গাড়ী নিয়ে আজ কুভাতে এসেছে যে ছেলেটা, তার হাত-পা বেঁধে মুখে কাপড় গুঁজে দেয়। তারপর আরম্ভ করে বাড়ীময় তল্লাসী। সিন্দুকটা খুঁজে বার করে কুড়াল দিয়ে তালা ভাঙতে আরম্ভ করেছিলো।
এমন সময় মোল্লার প্রতিবেশীরা কুকুরটার মরণচীৎকার শুনতে পায়। ব্যাপার ভাল না বুঝে পাশের বাড়ীর একজন লোক চুপিচুপি বেরিয়ে আসে রাস্তায়, দেখে গাছের ছায়ায় একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, হাতে চারটে ঘোড়ার লাগাম ধরা- লোকটির মুখ দেখা যায় না, কালো মুখোস ঢাকা মুখ। ফজল উদ্দিনের বাড়ী থেকে শোনা যাচ্ছে ধুমধাম আওয়াজ। প্রতিবেশী লিপিকরের বাড়ী ছুটে সে খবর দিতে ফজল উদ্দিন দৌড়ালেন নিজের বাড়ীর দিকে। তিনি যখন এসে পৌঁছলেন ঠিক তখনই সেই লোকগুলে ভারী সিন্দুকটার তালা ভাঙতে পেরেছে। বাড়ীর মালিককে দেখে দু’জন তখনি জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালালো, জানলার কাঠামোটা ভেঙে গেল, আর তৃতীয়জন দরজার দিকে দৌড় লাগাল। ভালুকের মত বড়সড় চেহারার মুখ মুখোস ঢাকা যুবকটা কাঁধের এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে দিয়ে ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে গেল। তারপর লাফিয়ে ঘোড়ায় উঠে এক মুহূর্তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
খোলা সিন্দুকটার ওপর ঝুঁকে পড়লেন মোল্লা ফজল উদ্দিন। কুলুঙ্গিতে রাখা জ্বলন্ত মোমবাতির মিটমিটে আলোয় দেখতে পেলেন সিন্দুকের জিনিসগুলোতে চোরদের হাত পড়েছে, নকশাগুলো কোথাও দুমড়ে মুচড়ে গেছে, বাদশাহের উপহার মোহরভরা থলিটা উধাও হয়ে গেছে। কিন’ মোহর নিয়ে ফজল উদ্দিনের কোন মাথাব্যথা নেই। গোপন খুপরিটার কি হলো? যেখানে তার আঁকা ছবিগুলো লুকানো আছে? বুঝতে পেরেছে নাকি ওরা? হায় আল্লাহ্, খুলেছে নাকি? তাড়াতাড়ি লোহার চৌকো টুকরোটা বাঁদিকে আসে- করে সরিয়ে দিলেন, সিন্দুকের তলায় আর একটা চাবির গর্ত দেখা গেল। চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন মোল্লা ফজল উদ্দিন, বাড়ীতে কেউ নেই, হাত গলিয়ে ছোট্ট একটা চাবি বার করে এনে চাবির গর্তে ঢোকালেন… আসে- করে ডালাটা তুলে ধরলেন- ওই তো তার আঁকা ছবিগুলো কাগজের ভাঁজে ভরা রয়েছে। কোন ছবিটার পর কোন ছবি তা খুব ভাল করেই জানা। … বুড়ো মালী গাছে পানি দিচ্ছে।… চিলমহরা পাহাড়ে শিকার। … নীচে সুন্দরী এক মেয়ের ছবি, ‘চঙ্গ’ বাজাচ্ছে মেয়েটি। … এ হলো মির্জা ওমর শেখের মেয়ে খানজাদা বেগম।
হীরাট থেকে ফিরে আসার পরে, আন্দিজানে মোল্লা ফজল উদ্দিনের কাজ আরম্ভ হয় ওমর শেখের বাগানবাড়ীর অলঙ্করণে। খানজাদা বেগম জানতে পারলেন প্রতিকৃতি অঙ্কনে তার দক্ষতার কথা। একদিন তাকে অনুরোধ করলেন নিজের প্রতিকৃতি এঁকে দেবার জন্য। সে অনুরোধ রাখতে হলো গোপনে। মেয়ের এই খেয়াল জানতে পারলে বাবা বাধা তো দেবেনই আর এই সুন্দরী কর্ত্রীর খেয়াল মেটানোর জন্য ফল ভোগ করতে হবে শিল্পীরও।…
পরিচারকটির শেষ পর্যন্ত অল্প হুঁশ হয়েছে, ছাড়াছাড়াভাবে বলছে বাড়ীতে এই হানা দেওয়ার ঘটনাটা। পরিচারকের কথা, প্রতিবেশীর কথা আর নিজে চোখে যা দেখেছেন তা সব বিবেচনা করে মোল্লা ফজল বুঝলেন যে এই অপরিচিত লোকগুলো মোটেই সাধারণ চোর নয়। ওরা কারও নির্দেশেই এ হামলা চালিয়েছে। কি খুঁজছিল ওরা ওখানে? নকশাগুলো? সেগুলো তো নেয় নি, যদিও ওগুলো একেবারে উপরেই ছিল। ছবিগুলো খুঁজছিল ওরা! তার মানে ওদের পাঠাতে পারে এমন একজন যে মোল্লা ফজল উদ্দিনের অঙ্কন প্রতিভার কথা জানে। কোন অপমানের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল কি সে?
মোল্লা ফজল উদ্দিনের মনে পড়লো বসন্তকালে একদিন প্রথম সারির একজন ধনী বেগ হাসান ইয়াকুব তাকে বাড়ীতে ডেকে এনে জাঁক করে বললো, ‘হামাম তৈরী করতে চাই, সবার হামামের চেয়ে সেরা হয় যেন! সেই হামামে থাকবে গরমকালে গোসলের জন্য স্বেত পাথরের বাঁধানো জলাধার…’ তারপর গলা নীচু করে হাসান ইয়াকুব বলল, ‘খুবসুরত বাঁদী কিনবো বেশ কিছু, মোহরের কমতি নেই আমার। এমনভাবে তৈরী করতে হবে যেন ঐ মেয়েরা গোছল করলে, ঘুলঘুলিগুলো যেন সবার চোখের আড়ালে থাকে বুঝলেন?’ বলে বেগ আত্মতৃপ্তি আর খুশীর অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। ‘আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি কাজ আরম্ভ করতে বলার জন্য। যত পারিশ্রমিক চাইবেন, পাবেন।’
মোল্লা ফজল উদ্দিন পেশার পবিত্রতায় বিশ্বাস করতেন। বিরক্তিকর অনুভূতি গোপন করতে না পেরে এই অপবিত্র নির্মাণকাজের ভার নিতে রাজী হলেন না।
‘অপবিত্রতার কি আছে? হামাম তৈরী হবে আমার নিজের অর্থে।’
‘অনেক মিস্ত্রী আছে, হুজুর, যারা এমন ধরনের ঘুলঘুলি তৈরীতে হাত পাকিয়েছে, তাদেরকে ধরে আনুন। আমাকে বাদশাহ হুকুম দিয়েছেন মাদ্রাসা তৈরী করতে। এখন আমি সেই নকশা তৈরীর কাজে ব্যস্ত।… আমাকে মাফ করতে আজ্ঞা হয়।’
হাসান ইয়াকুব মোল্লা ফজল উদ্দিনের দিকে বাঁকা চাউনি হেনে বলল, ‘ঠিক আছে। … কিন’ যা আমি বলেছি তা যেন গোপন থাকে। নাহলে….’
‘নিশ্চয়ই। আমাদের আলাপ এখানে আরম্ভ হয়েছিল, এখানেই শেষ হয়ে গেল। কিন’ আপনি আমার ওপর নারাজ হবেন না হুজুর?’
নারাজ হবেন না… তাও কি হয়। ঘাড়ে গর্দানে হাসান ইয়াকুব এর বদলা নিলেন। এই বেগের হাত থেকে রেহাই পাবার দিন পনেরো পরে। মোল্লা ফজল উদ্দিনের তাই মনে হয়েছিল, একদিন সন্ধ্যার আধোঅন্ধকারে তার বাড়ীতে এসে হাজির অন্য এক ধনী বেগ- আহ্মদ তনবাল। নির্জনে, কোন সাক্ষী না রেখে আহ্মদ তনবাল পকেট থেকে বার করে আনল এক থলি মোহর।
‘এই মোহরের বদলে একটা ছবি এঁকে দিতে হবে আমায়…’
‘কিসের ছবি।’
আহ্মদ তনবালের বয়স পঁচিশ ছাড়িয়ে গিয়েছে, কিন’ মুখে দাঁড়িগোফের কোন বালাই নেই এখনও। মাকুন্দ বেগ পাতলা ঠোঁট জোড়া মোল্লা ফজল উদ্দিনের কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলল, ‘আমাদের বেগমের তসবীর চাই আমার।’
‘কোন বেগমের?’ সতর্ক প্রশ্ন ছুঁড়লেন মোল্লা ফজল উদ্দিন,
‘বাগানবাড়ীতে বাদশাহের বারমহলের দেয়ালে নকশাকাজ করবার সময় আপনি তাকে প্রথম দেখেন তাই না? হ্যাঁ, খানজাদা বেগমকে? আপনার অঙ্কনপ্রতিভার কথা বলতে বলতে তো উনি প্রেমাকুল হয়ে পড়েন…’
মোল্লা ফজল উদ্দিনের বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল, যেন ফেটে যাবে এখুনি। মাকুন্দটা টের পেয়ে গেছে নাকি?
কে একথা বলেছে আপনাকে?…আমি স্থপতি… বাড়ীঘরের নকশা করতে পারি…’
‘আমার কাছ থেকে লুকোবার দরকার নেই। শরীয়তের নিয়ম কে পালন করে বা না করে তা লক্ষ্য করার দিকে আমার কোন মাথাব্যথা নেই।’
‘জীবন্ত মানুষের তসবীর যারা করে তাদের দলে পড়ি না আমি। একথা কি সত্যি যে হীরাটে বাইসুনকুর মির্জার জন্য শাহানশাহ শাহরুখ যে প্রাদাস তৈরী করেন, তা খুবসুরত যুবতীদের তসবীরে সাজানো? সত্যি?’
‘সত্যি, কিনা… প্রত্যেক শহরে নিজস্ব প্রথা প্রচলিত। যদি খানজাদা বেগমের তসবীরের কথা আমাদের বাদশাহের কানে পৌঁছায় তাহলে কি হবে? সে কথা ভেবেছেন?’
‘কারও কানে যাবে না, কোন সাক্ষী থাকবে না। বসুন তো দেখি। নিন মোহরগুলো, ধরুন।’
ফিসফিস করে বলল আহ্মদ তনবাল।
‘আমাকে আদেশ দেবেন না হুজুর… আপনাকে কে বলেছে আমি মানুষের তসবীর আঁকতে পারি?’
‘শুনেছি আমরা…. লোকে জানে..’
‘কার কাছে শুনেছেন?’
‘হাসান বেগের কাছে।’
তার মানে দু’জনে মিলে মতলব ভাঁজা হয়েছে, ভাবলেন মনে মনে মোল্লা ফজল উদ্দিন। আমাকে হাতের পুতুল করতে চায়… এই মাকুন্দ কোলাব্যাংটার জন্য বেগমের তসবীর আঁকব? মাথার গোলমাল হয়নি আমার এখনও!
‘হুজুর আহ্মদ বেগ, আপনার এই ভৃত্য যখন বাগানের নকশা আঁকে, তখন সেই নকশার এক কোনায় সাদাসিধে এক মালীকেও এঁকে রাখতে পারে; স্থাপত্য শিল্পে বা পবিত্র কোরানের কোন নিষেধ নেই তাতে। কিন’ খানজাদা বেগমের ছবি আঁকা? না, না, তা করার আমার কোন অধিকারও নেই আর ক্ষমতা বা সাহস কোনটাই নেই!’
‘আপনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করছেন? আমাকেও?’
‘দুঃখের কথা, অন্য কোন সম্ভাবনার কথা আর আসছে না। মাফ করবেন আমায়… আর মনে হয় এমন প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে আসাটাই এমন কি আপনার পক্ষেও বিপজ্জনক।’
‘আমি অত ভয় করি না। কিন’ ভীরুদের কেউ কেউ এই ভীরুতার জন্য আফশোষ করবে।’ বলে রেগে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল আহ্মদ তনবাল।
সেই হুমকিটাই সত্যি হ’ল এই অপরিচিত চারজন ব্যক্তির ডাকাতিতে। … নিরস্ত্র স্থপতির পক্ষে এমন বেগের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে টিকে থাকা মুশকিল। শোনা যায় দু’শ জন গুন্ডা রাখা আছে ওর। কিন’ এসব জেনেশুনে চুপ করে থাকাও যায় না- একটা কিছু প্রতিকার না করলে এই বদ্ধ পাগলটা হয়ত আরো কিছু নোংড়া কাজ করে বসবে।
দীর্ঘ রাত ঘুমহীন কাটিয়ে মোল্লা ফজল উদ্দিন ওমর শেখ যে ঘোড়াটা তাকে উপহার দিয়েছিলেন সেটার পিঠেই জিন চাপালেন সকালবেলায়। সোজা হাজির হলেন আন্দিজানের নগররক্ষকের দপ্তরে।
লম্বা, রোগা চেহারার নগররক্ষক স্থপতির কথা মন দিয়ে শুনলেন না। কী করে আরো বেশী লোক এনে সৈন্যবাহিনীতে ঢোকানো যায়, শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো মজবুত করা যায় উজুন হাসানের মাথা তখন সেই চিন্তায় ভর্তি। তার দিকে ঝুঁকে থাকা স্থপতিকে ছাড়িয়ে ওপরে কোনদিকে যেন অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
‘মাফ করবেন, এখন এসব ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সময় নয়। …. মোহর খোয়া গেল দুঃখের ব্যাপার ঠিকই। … কিন’ আপনার নকশাগুলো ছোঁয়নি, তার মানে এ হল শহরের বাইরের বনবাদাড় থেকে আসা চোরেদের কাজ। ওখানেই ওদের ডেরা। আল্লার মর্জি ভালোয় ভালোয় যুদ্ধবিগ্রহ কেটে গেলে বনবাদাড়গুলোকে সাফ করে ফেলব চোর বাটপাড়দের তাড়িয়ে দিয়ে।… আর এখন, নিজেই দেখতে পাচ্ছেন, ওদিকে মন দেবার সময় নেই…’
বলে দু’হাত ছড়িয়ে নিরপায় অবস্থাটা বোঝাল নগররক্ষক।
মোল্লা ফজল উদ্দিন কাছে এগিয়ে এলেন, আবার কুর্ণিশ করলেন সসম্মানে, ‘আমার সন্দেহ হয়, হুজুর. .’ নীচুস্বরে বললেন তিনি। তারপর সংক্ষেপে বললেন কেমন করে আহ্মদ তনবাল তাকে অনুরোধ-উপরোধ করেছিল মানুষের তসবীর আদায় এঁকে দেবার জন্য।
‘তসবীর? কার তসবীর?’ আগ্রহ হল নগররক্ষকের।
‘হুম্… রূপকথার পরীর…আমি ঠিক বুঝতে পারি নি, কার…’
‘আপনার সিন্দুকে এমনি সব তসবীর ছিল বোধহয়? পরীর অথবা সত্যিকার মেয়েদের নাকি? সেগুলো লুঠ হয়ে যায় নি তো?’
‘এমন সব তসবীর আসবে কোথা থেকে হুজুর? আমাদের শাহ্ যে মাদ্রাসা তৈরির আদেশ দিয়েছেন তার নকশা আঁকার কাজে ব্যস্ত আমি। চিত্রকলায় মন দেবার মত আমার সময়ও নেই আর প্রতিভাও নেই।… আর অবশ্যই ইচ্ছাও নেই হুজুর। সিন্দুকে ছিল শেষ না হওয়া কতকগুলো নকশা, হ্যাঁ ওগুলোই ছিল কেবল।’
‘সেগুলো তো ঠিকই আছে?… তাই যদি হয় তাহলে মহামান্য আহ্মদ তনবালকে আপনি সন্দেহ করছেন কেন?’
পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল তারা কিছুক্ষণ, কেউ কোন কথা বলছে না।
‘আমার বাড়ীতে হানা দেওয়ার ঠিক কারণই আমি বলেছি হুজুর। এসম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে অনুরোধ জানাই আপনাকে।’
‘আমি আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে আহ্মদ তনবাল সুলতানবংশীয়। আমাদের শাহের বড় বিবি ফতেমা সুলতান বেগম আহ্মদের আত্মীয়া। এই তো ফতেমা বেগম ডেকে পাঠিয়েছেন বলে আজ ভোরবেলায় আহ্মদ তনবাল আমাদের রাজধানী আখসি রওনা হয়ে গেলেন।’
মাকুন্দটা যদি আমার সিন্দুকের ছবিগুলো হাতে পেতো তাহলে আখসিতে বাদশাহ আর বড় বেগমের হাতে তুলে দিতো, এই চিন্তায় হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল ফজল উদ্দিনের। খালি আমার সর্বনাশ করার জন্যেই খানজাদা বেগমের ওই তসবীরের দরকার নাকি ওর? তাছাড়া কী? সুলতানের বংশধর। এখনও অবিবাহিত, এদিকে বিয়ের বয়স হয়েছে। ‘শ্রদ্ধেয়’ এই বেগটি বাদশাহের জামাই আর সুন্দরী বেগমের স্বামী হবার মতলব করেছে। মোল্লা ফজল উদ্দিনের মনে হলো যেন সে মাকড়সার চটচটে জালের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে। পালিয়ে যেতে হবে এই জাল থেকে।
‘হুজুর, আমাদের মেহেরবান বাদশাহ এখানে আন্দিজানে আমাকে আপনার হেফাজতে রেখেছেন যদি আপনি ঐ লুঠেরাদের সাজা না দেন, তাহলে আমাকে সোজাসুজি বাদশাহের কাছেই নালিশ জানাতে হবে।’
‘জনাব ফজল উদ্দিন, ভুলে যাবেন না যে আপনার আগেই বাদশাহের কাছে পৌঁছে যাবে আপনার প্রিয় সেই কথাগুলি যা আপনি প্রায়ই বলেন।’
‘কী কথা, হুজুর?’
‘কেউ কেউ.. এমন ধরনের কথা বলতে ভালবাসে যেমন, রাজা-বাদশাহ্রা মানুষের মনে কোন ছাপ রেখে যায় না, রেখে যায় কবি, স্থপতি আর শিল্পী। … কেউ বলে আর কেউ হয়ত শোনে…. কবি, স্থপতিদের বন্ধুদের সঙ্গে আমাদেরও বন্ধুত্ব।’
আচ্ছা, তার মানে এখানে চারদিকে চরেরা কান পেতে আছে। কিন’ ভয় পেয়েছি দেখালে খুব বিপদের হবে! তাই মোল্লা ফজল উদ্দিন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘এ মিথ্যে অপবাদ। হুজুর, আমি এমন অনেক বন্ধুকে জানি যারা আপনার নামেও অপবাদ দেয়। আপনি নিজেও সে কথা জানেন।… আন্দিজানে যত বাড়িই তৈরি করেছি আমি প্রতিটি বাড়ির ওপরেই ফুটিয়ে রেখেছি আমাদের শাহ মির্জা ওমর শেখের নাম। দুর্গদ্বারের দিকে তাকিয়ে দেখুন আর একবার। বাগানবাড়ির প্রতিটি কক্ষে দেখুন। আমার নাম কি লেখা আছে কোথাও? তার মানে ইতিহাসে লেখা থাকবে আমার নাম নয়, লেখা থাকবে আমাদের বাদশাহের নাম – সেই নিয়েই আমার যত চিন্তা! ঠিক কি না? বলুন।’
উজুন হাসান চুপ করে রইলেন।
‘আর চোর-ডাকাতের হাত থেকে আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা না করে আমার নামে মিথ্যে অপবাদকে সমর্থন করছেন আপনি। হায় রে! আমি আপনার নামে নালিশ জানাবো বাদশাহের কাছে।’
এমন কথা বলা উচিত ছিল না। উজুন হাসান সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে গেল। মাথা আরো উঁচু করে বলল, ‘আমার নামে নালিশ করতে যাবেন? বেশ যান, নালিশ করুন। ভয় পাই না আমি আপনাকে। এই দুর্যোগের দিনে যখন তিনদিক থেকে শত্রু আমাদের ওপর এসে চড়াও হয়েছে তখন বাদশাহের আর আমাদের দেশের প্রয়োজন জঙ্গী বেগদের, স্থপতিদের কোনই প্রয়োজন নেই এখন। আহ্মদ তনবাল আর আমি – এমন কয়েকজনকে ধরে রাখার জন্য আপনার মত জন দশেককেও তাড়িয়ে দেবেন বাদশা।’
‘আখসিতে গিয়েই দেখা যাবে কাকে তাড়িয়ে দেন।’
রাগে আত্মহারা হয়ে চীৎকার করে উঠলেন মোল্লা ফজল উদ্দিন। পিছন ঘুরে এমনভাবে বেরিয়ে এলেন দপ্তর থেকে যেন তিনি এখুনি আখসি রওনা দেবেন। বাড়ীতে এসে অবশ্য তার রাগ জল হয়ে গেল- উজুন হাসানের কথা অপ্রিয় হলেও সত্য। মির্জা ওমর শেখ অবশ্যই একজন স্থপতির মান বাঁচাতে আসবেন না, বেগ আর তাদের অনুচরদের বিরুদ্ধে যেতে পারবেন না (এ সময়ে!)। এরা হল আসল যোদ্ধা — সামরিক শিক্ষাহীন কৃষকদল নয়, যাদের জোর জবরদসি- করে তাড়িয়ে এনে সৈন্যদলে ঢোকান হয়। আর স্থপতির মত নিষ্কর্মাও নয়, তিক্ত হাসি হাসলেন মোল্লা। তাহলে আহ্মদ তনবাল আজই পৌঁছে যাচ্ছে আখসির প্রাসাদে, আর পৌঁছেই সঙ্গে সঙ্গে উল্টোপাল্টা বকবক আরম্ভ করবে, বলবে যে মোল্লা ফজল উদ্দিন শাহজাদীর তসবীর এঁকেছে… তাদের পরিবারের বেইজ্জতী করেছে।
মোল্লা ফজল উদ্দিন পুরোপুরি বুঝতে পারলেন খানজাদা বেগমের অনুরোধ রাখতে গিয়ে নিজের কতখানি বিপদ ডেকে এনেছেন। তুলি-কলম হাতে তুলে নিয়ে অমন সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে তার কি সুখের অনুভূতিই না হয়েছিল তখন- কিন’ সেই সৌন্দর্যের অধিকারিণীরও চরম বিপদ আসবে যদি এ ছবি অন্যের হাতে বা চোখে পড়ে।
কাঁপা কাঁপা হাতে মোল্লা ফজল উদ্দিন খানজাদার প্রতিকৃতিটি বার করলেন সিন্দুকের গোপন খোপ থেকে। ঐ নীচ বেগগুলোর হাতে যেন কোন প্রমাণ না থাকে, নষ্ট করে ফেলতে হবে এ ছবিকে। আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
তুলি-কলমের সূক্ষ্ম টানে ফুটিয়ে তোলা ছবিটি। সেখান থেকে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত একটি মেয়ে, যেন জীবন্ত। চুলার আগুনের আভায় তার দীর্ঘ আঁখিপল্লবগুলি যেন সামান্য নড়ছে, রক্তিম অধরে প্রশ্রয়ের মৃদু হাসি। খানজাদার মনমোহিনী সৌন্দর্য আবার স্থপতির হৃদয়কে যেন যাদুমন্ত্রে বশ করে ফেললো। ঐ মেয়েটির প্রেমে পড়েছি নাকি আমি? ভাবলেন মোল্লা ফজল উদ্দিন যুগপৎ সুখী ও বিস্মিত হয়ে। গরীব অভাগার শাহ্জাদীর প্রেমে পড়াটা হাস্যকর নয় কি? আর সেই অভাগা যদি পরে শিল্পী হয়ে ওঠে? না, না। আমি ভালবাসি আমার এই সৃষ্টিকে। এটাকে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। বেঁচে থাকলে এমনি আরো অনেক ছবি আঁকবো।
ছবিটা আগুনে ফেলার জন্য সামান্য ঝুঁকে পড়লেন। কিন’, ফেলা হলো না। তার মনে হল যেন আগুনের নিষ্ঠুর শিখা লেগে ছবিটার মুখ যন্ত্রণায় বেঁকে উঠলো। আগুনের কাছ থেকে পিছিয়ে গেলেন তিনি। জীবন্ত লোককে মেরে ফেলা, নিজের প্রিয়তমাকে আগুনে ফেলা কেমন করে সম্ভব? তার অন্তরের গভীর থেকে তিনি যেন শুনতে পেলেন ধমকানি আর হুমকি-
কাপুরুষ তুই! ভীরু! তোর শত্রুরা তো এখনও তোর দরজায় ঘা দেয় নি এসে, আর এরমধ্যেই এমন পাপ করতে উদ্যত হয়েছিস। নিজের কাছে মিথ্যা কথা বলার সাহস করিস না: এমনটি তুই জীবনে আর কখনও আঁকতে পারবি না। এতে তুই কেবল বেগমের সৌন্দর্যই নয়, ফুটিয়ে তুলেছিস তার কোমলতা, তার অনবদ্য মাধুরী। এমন অনুপ্রাণিত সাফল্য দ্বিতীয়বার আসে না। যদি নিজেকে পুরুষমানুষ বলে মনে করিস তো একে বাঁচিয়ে রাখ্!
মোল্লা ফজল উদ্দিন আবার সাবধানে লুকিয়ে রাখলেন ছবিটি সিন্দুকের গোপন খোপে। ভৃত্যকে কাছে ডাকলেন, ‘জিনিসপত্র গুছিয়ে গোড়ায় জিন দে দেরী না করে। এখান থেকে চলে যাবো আমরা! আজই! এখুনি!’
এখন তিনি ভগিনীপতির বাড়ীতে বসে সেই সব ঘটনা বলার সময়, এমন কি আত্মীয়দের কাছেও গোপন করলেন যে তার লোহার সিন্দুকে লুকানো আছে খানজাদা বেগমের প্রতিকৃতি। কাউকেই জানাতে চান না তিনি এই গোপন কথা।
‘হায় নসীব, নসীব!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তাহেরের বাবা, ‘মোল্লা ফজল উদ্দিন, আপনিই আমাদের আশা-ভরসা ছিলেন। আপনার যখন এমন বদ-নসীব… বাদশাহ কি আপনাকে মদত দেবেন না? যখন লড়াই শেষ হবে, আল্লাহের মর্জি হলে যদি আমরা বিজয়ী হই, তো তখন যাবো বাদশাহের কাছে। আমার করুণ প্রার্থনায় যদি কান দেন তো ভাল, আর যদি না দেন তো আবার চলে যার হীরাটে! শুনেছি আলি শের নবাই এক চিকিৎসালয় নির্মাণের কথা ভাবছিলেন। আমাদের, স্থপতিদের কাছে এখন একটাই আশার আলো জ্বলছে সেখানে, যেখানে নবাই আছেন।’
‘কেবল হীরাটই কেন? সারা দুনিয়াও, আপনার দাম দেবার জন্য শুধু হীরাটই আছে এমন নয়। ফরগানাতেও এমন লোক আছে যারা আপনার মূল্য বোঝে। আমরা কুভার বাসিন্দারা আজ পর্যন্ত সসম্মানে স্মরণ করি আপনাকে, ঐ পুলটা তৈরীর জন্য। কাল অথবা পরশু ঐ পুল পেরিয়ে চলে আসবে শত্রুর দল। যখন আমাদের মাথার ওপর নেমে আসা এই দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করি তখন মনে হয় জোর বর্ষা নেমে নদীতে বান ডাকুক- ভাসিয়ে নিয়ে যাক ঐ পুলটা। পুলটা যদি পুড়ে যায় যাতে ওটার ওপর দিয়ে শত্রুরা আসতে না পারে তাহলে মনে প্রাণে খুশী হব আমি।’
এতক্ষণ চুপ করে শুনতে শুনতে তাহেরের মনে হল হঠাৎ, সত্যিই তো, পুলটা তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিলেই হয়। শত্রুরা নদী পেরোতে পারে কেবল ঐ পুল দিয়ে। পায়ে হেঁটে পেরিয়ে যাবার মত অগভীর পানি নেই কোথাও, আর চারদিকে কেবল জলাভূমি, নলখাগড়ার ঝোপ। যদি কাঠের পুলটা পুড়ে যায় . . .।
হঠাৎ গরম বোধ হল তাহেরের- যেন আগুনের শিখার মধ্যে পুলটা এর মধ্যেই মড় মড় করছে। এই চালই লুকিয়ে রাখবে রাবেয়াকে। বাবা আর মামার দিকে তাকাল তাহের। বলব নাকি ওদের? না! বাবা এমন ঝুঁকি নিতে চাইবেন না, আমি তার একমাত্র সন্তান . . . মামা বিদ্বান মানুষ, তাকে এসবের মধ্যে জড়ানো উচিত না। অল্পবয়সী, বিশ্বাসী আর বেপরোয়া ছেলের দল তৈরী করতে হবে।
মজলিশ থেকে আসে- আসে- উঠে তাহের ঘর ছাড়িয়ে উঠোনে পেরিয়ে ফটকের বাইরে চলে এলো। এখনও জমে থাকা ভারী মেঘের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটি তারা দেখা যাচ্ছে। কোন বাড়ীতে আলো দেখা যাচ্ছে না। চারদিক নিস্তব্ধ। এমনকি কুকুরের চীৎকারও শোনা যাচ্ছে না। মাহ্মুদও ঐ সময়ই রাস্তায় বেরিয়ে এলো, যেন তারা দু’জনে ঠিক করেছিল যে এই সময়ে বাইরে বেরোবে। বোনকে নিয়ে যাওয়ার ব্যপারে কথা আরম্ভ হলো।
‘ভাবিস কেন, কেল্লায় থাকবে। আন্দিজানের কেল্লা বেশ মজবুত…’
‘না, কেল্লা এমন কিছু মজবুত না।’
তার কথায় বাধা দিয়ে তাহের এখুনি মোল্লা ফজল উদ্দিনের কাছে যা সব শুনেছে তাড়াতাড়ি করে বলল সে সব কথা।
‘হায় কপাল, বাঁচার কি কোন পথই নেই!’
‘ওরে অনাথ, নিজেই নিজের জন্য প্রাণ দে, কেউ তোকে সাহায্য করবে না, এই প্রবচন তোর মনে আছে মাহ্মুদ? চল তোদের উঠোনে গিয়ে ঢুকি। গোপন কথা গোপন রাখতে পারিস?’ বলেই দুম করে বলে বসলো, ‘পুলটা জ্বালিয়ে দেবো, শত্রুদের আটকাবো এইভাবে, বুঝলি?’
তাহেরের কথায় মাহ্মুদের মনে প্রথম সংশয় জাগল। পুলটা বিশাল, বৃষ্টির মধ্যে কাঠ জ্বলবে না। তা ছাড়া পুলের ওপর পাহারাও আছে।
‘ওই পাহারাদারগুলোকে দাঁড় করিয়েছে বেগরা। বেগদের পিছনে পিছনে ওরাও কেল্লায় গিয়ে ঢুকবে, দেখিস! কেউ আমাদের বাধা দিতে আসবে না- রাতের বেলায় জ্বালাব! তেল ঢেলে দেব, জ্বলে যাবে।’
‘দাঁড়া, তাড়াহুড়ো করিস না। শুনেছি, আখসি থেকে আমাদের বাদশাহ্ আসছেন সৈন্যদল নিয়ে। তার মানে আমাদের নিজেদেরই প্রয়োজন হবে পুলটা!…’
‘যদি তিনি সমরখন্দবাসীদের বাধা দেবার জন্য বেরিয়ে থাকতেন, তাহলে অনেক আগেই পৌঁছে যেতেন এখানে। কিন’ তিনি কেল্লা ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন না… কেল্লাগুলোও সব হার মেনেছে, এই তো মার্গিলানও হার মানল। বলছি তো নিজেই নিজের জন্য প্রাণ দে।’
‘কী জানি, গাঁয়ের মোড়ল বলছিলেন, বাদশাহ আসছেন। বলছিলেন, আমাদের বাঁচাবার জন্য ছুটে আসছেন।’
‘আমার বিশ্বাস হয় না।’
‘আমার হয়।’
‘আমার হয় না।’