১৯৫৩ সালে আমার যখন ছয় বছর বয়স, আব্বা পররাষ্ট্র দপ্তরের চাকরী নিয়ে কলকাতায় চলে গেলেন। মা ও আমাদেরকে রেখে গেলেন ঢাকায়। আব্বার ইচ্ছা ছিল, ঢাকায় সংসার খরচ কম, এখানে পরিবারটা থাকলে আব্বা অনেক টাকা সাশ্রয় করতে পারবেন। কিন্তু মা চিনত্মা করলেন অন্য কথা। ঢাকায় থাকলে চারপাশের অনুন্নত পরিবেশের কারণে সনত্মানদের পড়াশুনা কিছুই হবে না। তাই মা জোর করে আমাদেরকে নিয়ে কলকাতায় চলে গেলেন।
মা আগে থেকে কলকাতায় থেকে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা আব্বাকে জানাননি বলে আব্বা আমাদের থাকার কোন ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি, অথবা হয়তো ভেবেছিলেন, মা কিছুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছেন, তাই আমাদেরকে নিয়ে তার এক সহকর্মীর বাসায় গিয়ে উঠলেন। এলাকাটা প্রায় ঢাকার আমলিগোলার মতোই। বাড়িটার কাছেই চার b¤^i পুল। আমরা বিকাল বেলায় এই পুলের উপর দাঁড়িয়ে নীচের রেললাইনে শিয়ালদহ-বালিগঞ্জ রম্নটের ট্রেনের যাওয়া আসা দেখতাম। এখানে একটা ঘরে আমাদের খুব গাদাগাদি করে থাকতে হতো। মা খুব একটা ¯^w¯Í বোধ করছিলেন না।
আব্বা প্রথমে ভেবেছিলেন, মা সনত্মানদেও নিয়ে কোলকাতায় বুঝি কিছুদিন বেড়াতে এসেছেন। কিছু দিনের মধ্যে আব্বা মা’র আসল উদ্দেশ্য জানতে পেরে, অনন্যোপায় হয়ে পার্ক সার্কাস ও গড়িয়াহাটার মাঝামাঝি জায়গায় একটা তিন তলা বাড়ির একতলার তিনটি ঘরের ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিলেন আর আমরা সেখানে গিয়ে উঠলাম। এই বাড়িটার ঠিকানা ৮বি তারক দত্ত রোড। তারক দত্ত রোড আর সার্কাস রেঞ্জ রাসত্মার সংযোগস্থলের ঠিক উল্টো পাশের এক গলির শেষ মাথায় এই বাড়িটা। এই বাড়িটার কয়েকটা বাড়ির পশ্চিমে গিয়ে উত্তর দিকে দুটি বাড়ি পরে পার্ক সার্কাস এলাকার কড়েয়া থানা। আর পূবে দশ বারটা বাড়ি পার হয়ে সৈয়দ আমির আলী এভিনিউ-এর ট্রাম রাসত্মা। বাড়িটার মালিক বিখ্যাত গবেষক ও সাহিত্যিক কাজী আবদুল ওদুদ। আমাদের বৈঠকখানার ঠিক উপরে দোতলার ঘরটা ছিল কাজী আব্দুল ওদুদ সাহেবের স্টাডি। ঘরটা খুব একটা ছোট ছিল না। কিন্তু দরজা দিয়ে ঢুকলেই সামনে দেখা যেত একটা বিশাল পালঙ্ক আর দরজার পাশে বিশাল কাঠের আলমারী- বইয়ে ঠাসা।
কাজী নানা বসতেন আলমারীটার সামনে একটা ইজি চেয়ারে। তার ডানদিনের দেয়াল ঘেঁসে রাখা তিনটি বেতের বুনুনী দেয়া কাঠের সোফাসেট। সোফা তিনটির মাত্র একটিতে একজন বসতে পারতো আর বাকী সোফাগুলি ভরা থাকতো বইয়ে। ঘরের উত্তর দিকের দেয়ালে ছিল একটা বড় কাঠের ভারী বনেদী টেবিল, উপরে থাকতো থরে থরে বই। সাজানো না, গাদা করে রাখা। ঘরে দরজা দিয়ে ঢুকে সোফাটাতে বসতে যাওয়ার জন্য ছিল সরম্ন একচিলতে পথ।
কাজী নানার সংসারে তখন ছিলেন তাঁর স্ত্রী, সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রসত্ম, তার জগৎ-সংসার ছিল কেবল বিছানার চারপাশ। সেখানে শুয়ে শুয়েই তিনি বাড়ির বাজার-ঘাট, রান্না, খাওয়ানো সব তদারক করতেন। তাদের সনত্মানদের মধ্যে বড় এক মেয়ে, জেবুন্নিসা, যার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, ¯^vgx কলেজের অধ্যাপক। দ্বিতীয় সনত্মান ছেলে, ইঞ্জিনিয়ার আর সব থেকে ছোট ছেলে তখন মেডিকেল কলেজে পড়তো। কাজী নানা বড় ছেলেকে ডাকতেন বুদ্ধ বলে, গৌতম বুদ্ধের কথা মনে করে, আর ছোট ছেলের নাম, ছিল জিবু, গৌতম বুদ্ধেরই অন্য নাম জীবকের অপভ্রংশ।
কাজী নানা আব্বার সামনে দুঃখ করে বলতেন, আমার দুই ছেলেই অশিক্ষিত। তাঁর দুঃখ ছিল ছেলেদুটির কোনটিই তার মতো বিদ্বান হয়নি। তারা শিক্ষিত হয়ে জীবন ধারণের অর্থ উপার্জন করতে পারে, কিন্তু জ্ঞানের চর্চ্চা করে না কেউই।
শ্যামবর্ণ, দীর্ঘদেহী এই মানুষটির ঘরের পোশাক ছিল, ধবধবে সাদা রঙের লুঙ্গি ও সাদা ফতুয়া। কোন অনুষ্ঠানে গেলে অতি অবশ্য তার গায়ে উঠতো উৎকৃষ্ট মানের আচকান আর চুড়িদার পয়জানা। চোসত্ম মুসলমানী পোষাক।
তাঁর বড় ছেলে থাকতেন †ev¤^vB‡q| কদাচিৎ কলকাতায় আসতেন। তাঁর বিয়ে হয়েছিল শীলা আব্দুলস্নাহ নামের এক মেয়ের সাথে। শীলা শ্যামবর্ণ হলেও অত্যনত্ম সুন্দরী ছিলেন। লেডী ব্রেবোন কলেজে পড়ার সময় তাঁকে ভারত সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু মুসলিম পরিবারের মেয়ে হওয়ায় তার অভিভাবকরা এ দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডে মেয়েকে পাঠাতে সাহস পাননি। শীলা আব্দুলস্নাহ-র যখন বিয়ে হয় তখনও তিনি কলেজের ছাত্রী। কিন্তু তাদের দাম্পত্য জীবন খুব বেশীদিন টেঁকেনি। একটি পুত্র সনত্মান হওয়ার পরই তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
কাজী নানার দ্বিতীয় পুত্র জীবু অত্যনত্ম মা-অনত্ম প্রাণ ছিলেন। মেডিকেল কলেজের ক্লাস শেষ করেই পক্ষাঘাতগ্রসত্ম মায়ের াশে শুয়ে শুয়ে গল্প কেও দীর্ঘ সময় ব্যয় করতেন।
ওদুদ সাহেব তখন আমার নানা। সম্পর্কটা অবশ্য নানা-নাতির মতো তরল ছিল না। প্রথম কিছুদিন পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝতে সময় লেগেছিল আমার, তারপরই ওদুদ সাহেবের স্টাডির একজন সদস্য হয়ে গেলাম আমি। কিন্তু তিনি যেমন একমনে পড়তেন, ভাবতেন ও লিখতেন, আমি শুধু পড়েই যেতাম।
কিভাবে যে বই পড়ার প্রতি আমার এমন আগ্রহ ও অভ্যাসটা তৈরী হলো বলতে পারবো না। সম্ভবত প্রথম দিকে আমার কোন বন্ধু গড়ে না ওঠায় এমন অভ্যাস দেখা দিয়েছিল। বন্ধু না হওয়ার আর এক কারণ আছে। আমরা কলকাতায় যাবার পর আব্বা আমাদের সবাইকে পই পই করে বলে দিয়েছিলেন, চারপাশের সবাই বাংলায় কথা বললেও ওরা সবাই বিদেশী, তাই ওদের সাথে সহজভাবে মেলামেশা করা চলবে না। আর একটা বিষয় মনের মদ্যে গেঁথে গিয়েছিল, সেটা হলো আমাদেও চারপাশের সবাই আমাদেও মতো ধর্মাচরণ করে না, একটু যেন আলাদা। তাই আমি গভীর আগ্রহে তৃষ্ণার্ত প্রাণীর মতো পড়তে লেগে গেলাম। কাজী নানা তার ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে পড়তেন, ভাবতেন আর লিখতেন। আমার এই পড়ার অভ্যাসে তিনি কখনই কোন বাধা দিতেন না, বরং আমার পড়ায় তাঁর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল।
দর্শন না সাহিত্য, কবিতা না প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী না রাজনৈতিক প্রতিবেদন, কোরআন-হাদিস-ফিকাহ না হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খ্রিষ্টান ধর্মের বিশ্লেষণ- কোন কিছুই বাদ বাছাই নেই। রবীন্দ্র রচনাবলী, শরৎ সাহিত্য, বঙ্কিম রচনাবলী তো ছিলই, আরও ছিল ভারতের বিভিন্ন সাহিত্যিকদের উপহার দেয়া বই ও পত্র-পত্রিকা। সবার উপরে ছিল কাজী আব্দুল ওদুদের নিজের লেখা বইগুলো, প্রবন্ধের বই- শাশ্বত বঙ্গ, বাংলার জাগরণ, মহাকবি গ্যেটে, এবং উপন্যাস নদীবক্ষে ও আজাদ। আমি তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি। বছরের মাঝামাঝি, আসেপাশে কোন বন্ধুও তৈরি হয় নি। তাই আমার গনত্মব্য শুধু দোতলার ঐ বইয়ের জগতে। তখনও স্কুলে ভর্তি হই নাই। বছরের মাঝামাঝি, আসেপাশে কোন বন্ধুও তৈরি হয় নি। তাই আমার গনত্মব্য শুধু দোতলার ঐ বইয়ের জগতে।
কাজী নানার স্ত্রী প্রায়ই নানা জটিলতায় ভুগতেন। এক দিন তিনি অত্যনত্ম অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এরকম হলে সাধারণত কাজী নানা নিজে হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করে অক্সিজেন এনে তার শ্বাসকষ্ট দূর করার চেষ্টা করতেন।
১৯৫৫ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। সেদিন বিকেলে রোগীর অবস্থার অবনতি হলে কাজী নানা নিজে গেলেন অক্সিজেন আনতে। সন্ধ্যার একটু আগে ভদ্রমহিলা মারা গেলেন। মা দ্রুত উপরে চলে গেলেন। আমাকে বলে গেলেন ঘরে থাকতে। কিন্তু আমার ইচ্ছা করছিল উপরে গিয়ে কি ঘটনা ঘটছে দেখার। আমি গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ির কাছে গিয়েছি এমন সময় কাজী নানা অক্সিজেন সিলিণ্ডার সহ এক জন সহকারীকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকছেন। উপর থেকে তখন কাজী নানা ছোট ছেলে জিবু ও কাজের মেয়েগুলির কান্নার উচ্চকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। কাজী নানা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে, কাঁদছে কেন?’ আমি বোকার মতো বলে ফেললাম, ‘মনে হয় নানী মরে গেছে।’ কাজী নানা কোন কথা না বলে সহকারীটাকে বললেন, ‘সিলিণ্ডার ফেরত নিয়ে যাও।’ তারপর আসেত্ম আসেত্ম করে উপরে উঠে গেলেন।
এর পর থেকে দীর্ঘদিন কাজী নানা আমাকে ‘ভগ্ন দূত’ বলে ডাকতেন। তখন বুঝিনি শব্দটির অর্থ। পরে বড় হয়ে জেনেছি রাজাদের কাছে দুঃসংবাদ পৌঁছে দিত যে দূত, তাকে ‘ভগ্ন দূত’ বলে ডাকা হতো। কাজী নানার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের সংবাদ তাকে সরবরাহ করে আমিও ‘ভগ্ন দূত’ হয়ে গিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন কাজী নানা আমাকে ভগ্নদূত বলেই ডাকতেন।
মা’র মৃত্যুর পর জীবু মামা এত বড় মানসিক আঘাত পান যে প্রায় মসিত্মষ্ক বিকৃতি দেখা দেয়। তিনি পড়াশুনা ছেড়ে দেন। এ পর্যায়ে তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন নিজে নিজে হাতে প্যাথেডিন ইনজেকশন নিতেন। তাকে বেশ কিছু কাল চিকিৎসা নিতে হয়। এ সময়ে তিনি পথে-ঘাটে যেখানেই বিড়ালের বাচ্চা দেখতেন, তখনই তাকে সাথে করে নিয়ে আসতেন ও তার পরিচর্যায় মত্ত থাকতেন। এমন করে বাড়িতে প্রায় এক ডজনেরও বেশী বিড়াল জমে গেল। বিড়ালের অত্যাচারে আমরা, ভাড়াটে, কিংবা প্রতিবেশী কারও কোন আপত্তিতে কর্ণপাত করতেন না তিনি। শীতের সকালে তার ঘরে গেলে দেখা যেত তিনি লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন আর লেপের বিভিন্ন স্থানে ফুটো, সেই সব ফুটো দিয়ে বিড়াল তাদের মাথা বের করে তার সাথে শুয়ে আছে। জীবু মামা নিজের হাতে মাংশ কিনে এনে নিজ হাতে রেঁধে খেতেন আর বিড়ালদের খাওয়াতেন।
এক পর্যায়ে জীবুকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হলো। বলতে পারবো না, বিদেশে যাওয়ার ব্যয়ভার কাজী নানা কোথা থেকে জোগাড় করেছিলেন। সম্ভবত তাকে কানাডায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেখানে বেশ কিছুকাল চিকিৎসার পর জীবু মামা দেশে ফিরে এলেন। কিন্তু আর ¯^vfvweK জীবন-যাপনে অভ্যসত্ম হলেন না। তার বদ্ধমূল ধারণা হলো তার মার মৃত্যুতে বাবাই দায়ী। বড় ছেলে বুদ্ধ তো অনেক আগে থেকেই বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতো। তার ছোট ছেলেও তাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতে থাকে। এক পর্যায়ে জিবু আবার বিদেশে চলে যান।
আমরা ওখানে থাকতে থাকতেই ১৯৫৫ সালে কাজী নানা ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচীর আমন্ত্রণে বাংলার জাগরণ সম্পর্কে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য বিশ্বভারতীতে আমন্ত্রণ জানালেন। এ বক্তৃতা তিনি ১৯৫৬ সালে দিলেন।
১৯৫৭ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শরৎ স্মৃতি বক্তৃতা’ দিলেন। মনে পড়ছে, এর অধীনে তিনি যে চারটি বক্তৃতা দেন, তার তিনটি ছিল শরৎচন্দ্র m¤^‡Ü এবং চতুর্থটি ছিল পরবর্তীকালের কথাসাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে। এই চারটি বক্তৃতা কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে ১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘শরৎ চন্দ্র ও তাঁরপর’ শিরোনামায় প্রকাশিত হয়। এই চার দিনই কাজী নানা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং প্রথম সারিতে বসিয়ে দিয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল পুরো বক্তৃতাটা শোনার। পরে অবশ্য তার এ বইটি পড়েছি।
এ সময় থেকেই রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য প্রস্তুতি শুরম্ন হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনার জন্য নানা দিক থেকে তাঁকে অনুরোধ করা হলো। এ-সময় তিনি ‘কবিগুরম্ন রবীন্দ্রনাথ’ রচনায় নিেেজকে নিয়োজিত করলেন। তিনি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বক্তৃতা দিলেন গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে। বক্তৃতাটির শিরোনাম ছিল ঞধড়মড়ৎব্থং জড়ষব রহ ঃযব জবপড়হংঃৎঁপঃরড়হ ড়ভ ওহফরধহ ঃযড়ঁমযঃ.
এর পরে চৌষট্টি সালে তিনি লেখা শুরম্ন করেন হজরত মোহাম্মদ ও ইসলাম এবং কোরআন শরীফ অনুবাদ। এই দুটি বই লেখা ও প্রকাশের পিছনে অবশ্য আমার আব্বার গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
এক শবে কদরের দীর্ঘ সময় এবাদত করতে করতে বাবা বাসার সামনে গলিটাতে একটা পায়চারি করছিলেন- শরীরটা কিছু চাঙ্গা করতে বোধ হয়। এ সময় কাজী নানাও তার দোতলার স্টাডিতে পড়ছিলেন। বাবাকে গলিতে হাটতে দেখে তিনি দোতলার বারান্দায় এসে একটু ঝুকে জিজ্ঞেস করলেন ‘রহমান সাহেব, এত রাতে কি করেন?’
বাবা উত্তর দিলেন, ‘আজ শবে কদর, তাই একটু পড়াশুনা করছি।’
কাজী সাহেব বলেছিলেন, ‘ও হ্যাঁ আমার স্মরণ ছিল না। আজ তো আপনাদের শবে কদর’, তারপর একটু থেমে বলেছিলেন, ‘উপরে আসেন, আপনাকে একটা জিনিস দেখাই।’
বাবা উঠে গেলেন দোতলায় কাজী সাহেবের কক্ষে। চেয়ারে বসতে কাজী সাহেব আলমারী থেকে বের করলেন 9Óx11Ó মাপের একটা বিরাট বই। বাবা বইটি হাতে নিয়ে দেখেন বইটা কোরান শরীফ। বইটির অক্ষর বিন্যাস ও পৃষ্ঠা বিন্যাস সে সময় প্রচলিত লক্ষ্মৌ বা কলকাতা এই দুই ধরনের ছাপার মতো নয়।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কোথায় থেকে পেলেন, আপনি?’
কাজী সাহেব শোনালেন এক চমৎকার ঘটনা।
সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণ পশ্চিমবঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টির একদল নেতা সোভিয়েত ইউনিয়নে যান তাদের এক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য। সেই দলে ছিলেন কমরেড মোজাফফর আহমেদ। সম্মেলন শেষে দেশ ভ্রমণের এক পর্যায়ে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় তাশাখন্দ সমরখন্দ ও বোখরায়। সোভিয়েত ইউনিয়নে সবধর্মের সমানধিকার আছে এ কথা প্রচারের জন্যই হয়তো তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় গমনার্থদের মসজিদের প্রধান খতিব অন্যান্য মুসলিম ব্যক্তিদের সঙ্গে। মসজিদের প্রধান খতিব অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদকে উপহার দেন তাশখন্দে ছাপা এই কোরআন শরীফটি। মোজাফফর আহমেদ দেশে গিয়ে ঐ কোরআনটি নিজের জন্য অপ্রয়োজনীয় মনে করে কাজী আব্দুল ওদুদকে দিয়ে দেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে মোজাফফর আহমেদের কাছে কোরআন শরীফটা অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়াতেই তিনি কাজী আব্দুল ওয়াদুদকে সেটা দিয়েছিলেন। যে একজন সাহিত্যিক মানুষের যদি কোন কাজে লাগে। অথচ কাজী আব্দুল ওদুদ নিজে খুব ভালো আরবী জানতেন না বলে কোরআনটি তার কাছে পবিত্র গ্রন্থ মনে হলেও তিনি কোন কাজে লাগাতে পারছিলেন না। বাবা সেই সুযোগে তাঁর কাছে কোরআন চেয়ে বসলেন।
‘আপনি যখন আরবী পড়তে পারেন না তখন এটা আমাকে দিয়ে দেন। আমি আপনাকে মার্মডিউক পিকথল-এর অনুবাদ করা “দি হোলি কোরআন” এক কপি দেবো, যাতে আপনি পড়তে পারেন।’
কাজী সাহেব অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হয়ে গেলেন। বাবা যেন দ্বিগ্বিজয় করে ফেলেছেন। সকাল হলে মহা উৎসাহে আমাদের সকলকে একসাথে জড়ো করে সেই মহা পবিত্র গ্রন্থটি দেখালেন।
কাজী আব্দুল ওদুদ সাহেবের কাছে প্রায়ই নানা বিশিষ্ট ব্যক্তি আসতেন। অধিকাংশই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। তবে তখনকার পূর্ব পাকিসত্মান থেকে প্রায়ই যে বিশিষ্ট ব্যক্তিটি কলকাতায় গিয়ে কাজী সাহেবের আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন তিনি ছিলেন ড. কাজী মোতাহার হোসেন। এই বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদ ও শিক্ষাবিদকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় প্রতি বছরই এক্সটারনাল পরীক্ষক হিসাবে আমন্ত্রণ জানানো হতো। আর তিনি কলকাতায় এলেই অবধারিতভাবে কাজী নানার বাসায় এসে উঠতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর দায়িত্ব পালনের সময়টুকু ছাড়া বাকী প্রায় সকল সময়ই তিনি ও কাজী নানা বসে বসে দাবা খেলতেন। এ খেলায় তারা এতই মগ্ন থাকতেন যে তাদের সময়জ্ঞান পর্যনত্ম রহিত হয়ে যেত। অনেক দিনই আছে সন্ধ্যার পর আমি তাদের ঘরে গিয়ে লাইট জ্বেলে দিতাম। সন্ধ্যার অন্ধকারে দাবা ঘুটি দেখতে অসুবিধা হলেও দুজনের কেউই তারা উঠে গিয়ে আলো জ্বালানোর কথা মনে আনতেন না। তা বলে কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন ঘোর নামাজী। দাবা খেলার ফাঁকে ফাঁকে ঠিকই তিনি তার ওয়াক্তিয়া নামাজ আদায় করতে ভুল করতেন না, অন্যদিকে কাজী নানা কিন্তু তেমন একটা দৈনন্দিন নামাজ আদায় করতেন না, জুম্মার নামাজও তেমন পড়তেন না, তবে ঈদের নামাজ পড়তেন।
সবচেয়ে মজা হতো রোজার সময়। সারা দিন খাওয়ার ঝামেলা ছিল না তাই কেবল দাবার ছক পেতে দুই জনে মগ্ন থাকতেন। সাধারণত মগরেবের আজান হলে মা দুই থালায় ইফতারী সাজিয়ে আমার বড় ভাইকে দিয়ে ওদের ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে ইফতারী করার কথা ভাল করে বলে না দিলে হয়তো তারা খাবার সময়টুকুও পেতেন না। ইফতারীর সময় না হয় আমাদের বাসা থেকে খাবার পাঠানো হতো, কিন্তু সেহেরীর সময় তো তাদের মনে করিয়ে দেয়ার কেউ থাকতো না। প্রায়ই দেখা যেত কাজী মোতাহার হোসেন সাহেব না খেয়ে রোজা আছেন।
কাজী নানা আমাদের বাসার বৈঠকখানায় বেশ কিছুদিন অনত্মর সাহিত্য আসর বসাতেন। সে আসরে সে সময়ের অনেক বিশিষ্ট সাহিত্যিকরা আসতেন। এ অনুষ্ঠান আমাকে খুব একটা আকৃষ্ট না করলেও সে অনুষ্ঠানের একটা নির্দিষ্ট সূচি ছিল আমার কবিতা আবৃত্তি। যে কবিতাগুলো আবৃত্তি করতে হতো, সেগুলো অবশ্য কাজী নানাই বেছে দিতেন। একবার মনে পড়ে আমি আবৃত্তি করেছিলাম-
‘জীবনে যত পূজা হলো না সারা
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।
যে ফুল ণা ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে
যে নদী মরম্নপথে হারালো ধারা
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।
কবিতাটির অর্থ তখন অবশ্য বোঝার কথা নয়, তবে আমার মনে কবিতাটা গেঁথে গিয়েছিল।
এর মধ্যে একবার ঈদের সময় কাজীনানা আমাদের বললেন, ‘চলো, এবার গড়ের মাঠে নামাজ পড়বো।’
কাজী নানা ট্যাক্সিতে করে আব্বা, বড়ভাই ও আমাকে নিয়ে ঈদের দিন সকালে গড়ের মাঠে গেলেন। মাঠের অনেক দূরে ট্যাক্সি ছেড়ে দিতে হলো। অন্যান্য ঈদের নামাজ পাড়ার মসজিদে পড়তাম, তাই ঈদের নামাজের যে সার্বজনীন মজা সেটা অনুভব করতে পারতাম না।
ট্যাক্সি ছেড়ে দেয়ার পর যখন মাঠের উদ্দেশ্যে হাঁটছিলাম তখন দলে দলে শত শত মুসলিমকে মাঠের উদ্দেশ্যে যেতে দেখে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। মাঠে গিয়ে তো আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার দশা। পুরো গড়ের মাঠ ততক্ষণে জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। কোন রকমে অক্টরলনীর মনুমেন্টের (বর্তমানের শহীদ মিনার) গোড়ায় এক ধারে কোনরকমে বসার জায়গা করা গেল। চুপচাপ বসে আছি।
এক সময় একটু দূর থেকে শুনতে পেলাম, ‘খাড়া হো যাইয়ে, নম্জ শুরম্ন হোতা হায়।’ সবাই আমরা কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়ালাম। আবার অনেক দূর থেকে আওয়াজ এলো, ‘নিয়ত কিজিয়ে’ এবং একটু পরে আবার শোনা গেল ‘আলস্নাহু আকবর’। তারপর সব শুনশান। অনেক পরে আওয়াজ এলো, ‘রম্নকুমে যাইয়ে, রম্নকুমে যাইয়ে- আলস্নাহু আকবর’ আবার একটু পর আওয়াজ এলো, ‘রম্নকুসে উঠিয়ে- সামিয়ালস্নাহু লেমান হামিদাও’ ও সাথে সাথে ‘সিজদা মে যাইয়ে- আলস্নাহু আকবর’। নিয়ম মতো সিজদা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দেখি সামনে বহু দূরের নামাজিরা তখন দ্বিতীয় সেজদায় যাচ্ছে। সে সময়ে ইসলামী কোন অনুষ্ঠানে মাইক ব্যবহার করা ছিল নিষিদ্ধ- বেদাত। তাই বড় জামাতগুলিতে একদিকে যখন নিয়্যত করা হতো, অন্যদিকে তখন মোনাজাত হচ্ছে। আব্বা বাসায় এসে মা-র সামনে গজ গজ করতে লাগলেন, ‘হুঁ তেলাওয়াত শুনতে পেলাম না, খোতবা শুনতে পেলাম না, এ কেমন নামাজ হলো!’
কাজী নানার সাথে দেখা করতে নানা বিশিষ্ট জনেরা আসতেন। এর মধ্যে মাঝে মাঝে আসতেন মনোজ বসু। তিনি যেহেতু পূর্ব বাংলার মানুষ সেই সুবাদে মাঝে মাঝে পুর্ব পাকিসত্মানে তিনি বেড়াতে আসতেন। অর আব্বা ভিসা সেকশনের দায়িত্বে ছিলেন বলে আব্বার সাথে তার বেশ সখ্যতা হয়ে গিয়েছিল। একদিন শুনি তিনি ‘চীন দেখে এলাম’ নামে একটি বই লিখেছেন। বইটা আব্বাকে এক কপি উপহারও দিলেন তিনি। আমরা সবাই মিলে সেই চমৎকার ভ্রমণ কাহিনী পড়ে খুব আনন্দ পেলাম।
এর মধ্যে হঠাৎ একদিন রেডিওতে শুনি ভারত ও চীনের মধ্যে নেফা অঞ্চল নিয়ে বিরোধের ভিত্তিতে দুই দেশের মথ্যে যুদ্ধ শুরম্ন হয়ে গেছে। সারা দেশে সে কি উত্তেজনা। প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহেরম্ন সারা দেশে জরম্নরী অবস্থা জারী করলেন। সারা দেশ থেকে সমসত্ম সোনা বাজেয়াপ্ত করা হলো, সোনার দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গেল। চৌরঙ্গীর ফুটপাতগুলোতে অভাবী রোগা ¯^Y©Kviiv কাগজ সেলাই করা বড় বড় সুঁই আর কাগজ ফুটো করার ভ্রমর তৈরী করে বেচতো আর আকুতি করতো, ‘দাদা, একটা কিনে আমাদেরকে সাহায্য করম্নন। আমরা ভিক্ষা চাচ্ছি না।’ অনেকে অভাব সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যাও করেছিল। সে সময়ে সমসত্ম বিদেশী আমদানী নিষিদ্ধ হয়ে গেল।
প্রধানমন্ত্রী আরও ঘোষণা করলেন, ভারত নিজের জিনিষ নিজে বানাবে না হলে সে জিনিষ বিদেশ থেকে এনে ব্যবহার করবে না। মনে পড়ে বালিগঞ্জের একটা গ্যারেজে তখন ঊষা ফ্যান তৈরী হতো, অত্যনত্ম নিম্নমানের, ফ্যানের ব্লেড খুলে অনেকে আহত হয়েছেন বলেও শোনা গেল। বাজার থেকে বহু খাদ্যদ্রব্য উধাও হয়ে গেল। চাল-ডাল-তেলের জন্য রেশন পদ্ধতি চালু হলো। আব্বা অবশ্য দূতাবাসের কর্মকর্তা বলে মিশন থেকে রেশন পেতেন। আমাদের খাওয়ার নিয়মও বদলে গেল। সকালে ও রাতে রম্নটি আর একবেলা ভাত। সব ধরনের ডাল বাজার থেকে উধাও হযে গেল। বেশ কিছুকাল পর বাজােও উঠলো কেমন অদ্ভুত ধরনের দানা- দোকানীরা বলতে লাগলো ‘মোট’। মুগ না, মুশুর না, অড়হড়-খেসারী-মটর না- মোট। সে ডাল পানি দিয়ে তিন ঘন্টার কম সময় ফুটালে গলতো না, ¯^v`UvI ছিল কেমন অদ্ভুত। সেই ডাল খেয়েছি বহু দিন।
মজার ঘটনা ঘটলো এই সময়। একদিন বিকালে মনোজ বসু হসত্মদনত্ম হয়ে কাজী নানার বাসায় এসে বললেন, ‘ওদুদ সাহেব আমাকে কিছুদিন একটু আশ্রয় দেন।’ কাজী নানা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন কি হয়েছে।’ মনোজ বসু বললেন, ‘আমার ‘চীন দেখে এলাম’ বইয়ের জন্য আমাকে চীনের দালাল আর গুপ্তচর সন্দেহ করে লোকজন আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে, আমি কোন রকম পালিয়ে এসেছি। বাড়িতে তখন আর কেউ ছিল না বলে রক্ষা না হলে সবইকে মারধর করতো।’
মনোজ বসু কয়েকদিন আমাদের ড্রইং রম্নমে, কাজী নানার স্টাডিতে কাটানোর পর কোন রকমে একটা সংবাদ সম্মেলন ডেকে, ‘আমি প্রতারিত হইয়াছি। আমাকে ভুল বুঝানো হইয়াছে।’ প্রভৃতি বিবৃতি দিয়ে কোন রকমে আত্মরক্ষা করতে পারলেন।
কিন্তু মজার ব্যপার কাজী নানা একদিন আব্বাকে বললেন, সে সময়ের বড় সাহিত্যিকদের কেউই মনোজ বসুকে কোন রকম সহায়তা দেননি।
উনিশ শত চৌষট্টির দিকে একবার ভারতে সামপ্রদায়িক দাঙ্গা বেধে গেল। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে বিহার, পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গার তান্ডব ছড়িয়ে পড়লো প্রতিটি জনপদে। কলকাতাতেও এই প্রভাব আমরা যে পাড়ায় থাকতাম সেখানেও এসে পৌঁছালো। তবে তখন কড়েয়া থানায় যে ওসি দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, তিনি যে কি ধাতুতে গড়া জানি না। একদিনের মধ্যেই তার এলাকার সব রাসত্মার মোড়ে পুলিশ প্রহরা বসিয়ে নিজে রাত দিন একটা জিপে চড়ে হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে টহল দিতে থাকলেন। দিনে রাতে আমাদের বাসার সামনে দিয়ে তাকে গাড়ীতে করে যেতে দেখেছি দুই তিন বার করে। পাড়ার ছেলেরা বলাবলি করতো পুলিশদের নাকি তিনি আদেশ দিয়েছিলেন “সি এন্ড শুট” দেখামাত্র গুলি করতে। অন্য এলাকার কথা আমার ততো মনে নেই, তবে দুই দিনেই আমাদের এলাকাটা একেবারে শানত্ম হয়ে গেল। যদিও বড় বাজার, শোভাবাজার, নাখোদা মসজিদের চারপাশে জাকারিয়া স্ট্রীটে দাঙ্গা বেশ কয়েকদিন চলেছিল।
আমার মা এমনিতে খুবই সাহসী আর ডাইনামিক ধরনের মহিলা হলেও এই একটি বিষয়ে তিনি ভয়াবহ রকম আতঙ্কিত বোধ করতেন।
খবরের কাগজের এক ভারতের কোথাও কোন দাঙ্গার খবর বের হলেই তার খাওয়া- দাওয়া বন্ধ হয়ে যেত। রায়টের আতঙ্কে তিনি খুবই ভীত থাকতেন। আর এ সময়ে মা ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে প্রায় শ্বাসবন্ধ অবস্থায় বসে থাকতেন।
দাঙ্গার দ্বিতীয় দিনেই মার আতঙ্ক এমন তীব্র হয়ে গেল যে বাবাকে বার বার জোর করতে থাকলেন ডেপুটি হাই কমিশন অফিসের মধ্যে আশ্রয় নেবার জন্য। আব্বা বার বার করে বোঝাতে পারলেন না যে আমাদের বাসায় তিনতলায় বাড়িওয়ালা মুসলমান, চারপাশে বেশ কয়েকজন মুসলমান আছে। এলাকায় অনেক খ্রিষ্টানও আছে। তাছাড়া আইন রক্ষাকারী সদস্যরা এই এলাকায় অনেক আনত্মরিক। তাই এখানে বিচ্ছিন্নভাবে কোন আক্রমণ হতে পারে না।
কিন্তু মাকে বোঝাবে এমন ব্যক্তির জন্ম হয়নি পৃথিবীতে। তিনি যা বুঝবেন সেটাই চূড়ানত্ম। অবশেষে আমরা ৯ সার্কাস রেঞ্জে পাকিসত্মান ডেপুটি হাই কমিশন অফিসের পিছনে ড্রাইভার আর তৃতীয় শ্রেণীদের ব্যারাকে গিয়ে উঠলাম।
আমরা থাকাতে কাজী নানা বেশ নিশ্চিনেত্ম থাকতেন। কিন্তু আমরা চলে যেতে তিনি খুবই নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন। কারণ আমরা চলে আসার পর তাঁর অন্য ফ্ল্যাটের যে পরিবারটি ভাড়া থাকতেন, তারা এই বৃদ্ধ পন্ডিতের সাথে তো কোন যোগাযোগই রাখতো না, উপরন্তু নানাভাবে উত্যক্ত করতো। কেবল দুই তিনটি কাজের মেয়ের উপর নির্ভর করে তাঁর দিন কাটতো আতঙ্কময় ও নির্বান্ধব পরিবেশে।
হজরত মোহাম্মদের জীবনী লেখার ইচ্ছে তার অনেককাল আগেই ছিল। কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। উনিশ শ’ চৌষট্টি সালের জানুয়ারীতে যখন সামপ্রদায়িক দাঙ্গায় সারা কলকাতা বিপর্যসত্ম, দীর্ঘ সময় কারফিউয়ে জনজীবন ছিল রম্নদ্ধ, তখন একদিন তিনি লেখা আরম্ভ করলেন ‘হজরত মোহাম্মদ ও ইসলাম’ গ্রন্থটি।
তিনি হজরত মোহাম্মদের জীবনী লেখার সময় আর কোরআনের প্রথম খণ্ড অনুবাদ করলেন তখন প্রতি সপ্তাহে দোতলার স্টাডি থেকে নেমে এসে তিনি আব্বাকে তার লেখাগুলি পড়ে শোনাতেন। আরবী ভাষায় আব্বার উলেস্নখযোগ্য দক্ষতা থাকার কারণে, কাজী আব্দুল ওদুদ সাহেব আব্বার কাছ থেকে তার লেখা সঠিক এবং ভাষা সহজ ও সুন্দর হচ্ছে কি না তা ঝালিয়ে নিতেন। একাজে তিনি আমার মা-র পরামর্শও নিতেন। তিনি যখন তার এ সব লেখা পড়তে আমাদের বাসায় আসতেন তখন অবধারিতভাবে আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে সে সব জ্ঞানগর্ভ লেখা মনযোগ দিয়ে শুনতাম।
১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে এ বইটি প্রকাশিত হয়। এ বইটির মুখবন্ধে কাজী নানা লিখেছিলেন: ‘বইখানির নাম আমরা দিয়েছি ‘হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম’। একে ভাগ করা হয়েছে চার ভাগে- পরিবেশ ও প্রযত্ন, সংঘর্ষ, বিজয়, পরিণতি। হযরতের সুপরিচিত জীবন-কথা বিবৃত হয়েছে এর প্রথম তিন ভাগে-অবশ্য কিছু কাটছাঁট করে। চতুর্থ ভাগটিতে ইসলামের সুপরিচিত ইতিহাসের সংক্ষেপ; তবে সেই সঙ্গে তাতে, আর প্রথম তিন খন্ডের অনুবর্তিতে কিছু নতুন ভাবনা ও ¯^xK…wZ দাবি জানিয়েছে। বলা বাহুল্য নতুন চিনত্মা-ভাবনার দাবি যদি ¯^xKvi না করতাম তবে নতুন কালে এই বই লেখা অর্থহীন হতো।’
কাজী নানা আরও লিখেছিলেন: ‘অশেষ শক্তিমান আর অশেষ প্রেমিক হযরত মোহাম্মদের একটি জীবন চরিত্র লিখবার সংকল্প করি বহুদিন পূর্বে-১৯২৮ সালে। সেই দিনেই আরম্ভও করেছিলাম। কিন্তু তাতে বাধা পড়ে, কাজ অবশ্যই চলতে থাকে, তবে সেই চরিত্র চিত্রে প্রকৃত প্রসত্মাবে হাত দিতে পারি ১৯৬৪ সালের শেষে। ১৯৬৪ সালের সূচনাতেও বলা যেতে পারে, কেননা, সমগ্র কোরআনের বাংলায় অনুবাদ আরম্ভ করি সেই সময়ে-এই অনুবাদের কাজটি আমি গ্রহণ করি, হযরতের চরিত্র কথার ভূমিকা রচনা হিসাবেই। হযরতের পত্নী হযরত আয়েশা বলেছিলেন : কোরআন হযরতের চরিত্র হযরতের মানস ও চরিত্র m¤^‡›` এর চাইতে সারগর্ভ কথা আর কেউ বলতে পারে নি।’
এর পর চার মাস ধরে অক্লানত্ম পরিশ্রম করে তিনি কোরআনের প্রথম খণ্ড অনুবাদ করলেন, যা একই বছর আগস্ট মাসে প্রকাশিত হলো।